কৃষি ও খাদ্যে সার্বভৌমত্ব
উবিনীগ ও নয়াকৃষি আন্দোলনের ধান মেলা ও কৃষক সমাবেশ
ডিসেম্বর মাসের দুই থেকে চার তারিখ উবিনীগ ও নয়াকৃষি আন্দোলনের ধানমেলা ও কৃষক সমাবেশ হয়েছিল টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার রিদয়পুর বিদ্যাঘরে। নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উবিনীগ’ এর একটি উদ্যোগ হচ্ছে নয়াকৃষি আন্দোলন। দেশীয় বীজের সংরক্ষণ, পুনরুৎপাদন, খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা এবং রাসায়নিক সার ও কীট নাশক মুক্ত চাষাবাদ বিস্তারে মেলাটির আয়োজন করা হয়। উনিশটি জেলা থেকে দুই হাজার কৃষক মেলায় যোগ দিয়েছিলেন। মেলায় ছিলেন চিন্তার নিজস্ব প্রতিবেদক আতাউর রহমান রাইহান
‘আঁরা কত সোন্দর আছিলাম!’
নিজের নাম ঠিকানা জানিয়েই জনাব মঞ্জুর জানান দিলেন ‘আঁরা কৃষকের গরে জন্ম নিয়ি।’ মঞ্জুরের জীবনের বয়ান মোটামুটি এরকম; তার বাবা তো বটেই, দাদার সময় থেকে কৃষিকাজ করে তার পরিবার-পরিজন। কৃষি পরিবার। দুই মৌসুমে ধান চাষ করতেন তারা। ভাদ্রমাসে শেষ হত এক মৌসুম, আবার আশ্বিনে আরেক মৌসুম শুরু, পৌষ পর্যন্ত। ষাটোর্ধ মঞ্জুর স্মৃতিচারণ করছিলেন মঞ্জুর বললেন ‘আরা আগে আল চইতাম। আরার বীজতলা আরা রাখিতাম।’
কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে ধান মেলায় এসেছিলেন মঞ্জুর আলম। মেলা শুরু হবার আগের দিন সন্ধ্যার পরে নয়াকৃষি আন্দোলনের রিদয়পুর বিদ্যাঘরে বসে কথা হচ্ছিল তার সাথে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় তিনি বলে চলছিলেন যে, হালচাষ করতেন তারা, তখনো ট্রাক্টর আসে নাই। নিজেদের কাছে সংরক্ষণ করা ধানের বীজ বুনে বীজতলা নিজেরাই ধানের চারাগাছ করতেন। বীজ সংরক্ষণ করা বীজ কোম্পানীর কাছ থেকে কিনতে হত না। আবার কোনো মৌসুমে ধান নষ্ট হয়ে গেলে, বা যে কোনো কারণে চালের ভাড়ারে টান পড়লে ওই জমানো বীজধান থেকেই চাহিদা মেটাতো কৃষি পরিবারগুলো।
মঞ্জুরের জবানিতে; ‘হয়দে এইবার ভাদ্রের ধান ফুরাই গিয়ই, তাইলে বীজধান খাইতাম, খাইতে খাইতে আবার আওন মাইস্যা ধান আই গিয়ই।’ নিজেদের বীজ, নিজেদের ধান, আর খেয়ে-পরে আরামে থাকার সেই দিনগুলির স্মৃতিচারণক করতে করতে মঞ্জুরের স্বগত উক্তি ‘তাইলে আরা কত সোন্দর আছিলাম!’ কিন্তু এখন কি হল? জীবন অসুন্দর হয়ে পড়ল কেন?
‘আঁরার লাই প্যাকেট ধান আনিয়রে’
সে প্রশ্নের জবাবে জন্য মঞ্জুর মুখ খুলতে না খুলতেই আশেপাশে বসা অন্যান্য কৃষকরা বলতে শুরু করলেন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে এসেছেন তারা। অনেকের মাঝে কথা বলছিলেন গাজীপুরের মধুপুর থেকে আসা কৃষক লোকমান খিন, টাঙ্গাইলের কিষাণী সুরাইয়া বেগম ও রাবেয়া বেগম, নেত্রকোনার বিরিশিরি থেকে আসা কিষাণী অনামিকা রেমা, রাজশাহীর গোদাবাড়ি থেকে আসা কৃষক রবিউল ইসলাম, চাপাইনবাবগঞ্জের মোহাম্মদ রমজান আলী, কক্সবাজারের মোহাম্মদ আক্কাস ও হাবিবুর রহমান। সবাই কথা বলতে চান, এবং একসাথে কথা বলতে চান। সবার কথা সবাই শুনবো, একে একে--একথা বলে আবারও শুনতে শুরু করি মঞ্জুরের অভিজ্ঞতা।
মঞ্জুর জানান মাঝখানে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলে চলছিলেন ‘মাঝের দি গরি, এই কিছুদিন অইজ্জে, এই আত দশ বছর অইতে বিদেশী কোম্পানিহগলে আইয়েরে। আরার লাই প্যাকেট ধান আনিয়রে, এই সোনার বাংলা, হীরা ধান, মুক্তা ধান, এইসব ধান আনিয়রে ঘরে ঘরে যাই যাই . . .’। তারপর কি হল? কোম্পানীগুলো ‘প্যাকেট ধান’ বিক্রি করতে কৃষকের ঘরে ঘরে পৌছে যাবার পর এমন কি ঘটলো যে, মঞ্জুরদের ‘সোন্দর’ জীবন হারিয়ে গেল? সেই বিশদ বয়ান শুনতে শুনতে মাঝরাত। হাইব্রিড ধানকে কৃষকরা ‘প্যাকেট ধান’ বলেন।
‘নিজের চাষের বীজের জন্য কোম্পানির দিকে তাকায়ে থাকবো কেন?’
কৃষকদের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতার বয়ান থেকে যা জমা হল, তা এরকম; হাইব্রিড চাষে পাওয়া ধান যেহেতু বন্ধ্যা--নতুন ধানের জন্ম দিতে পারে না--তাই হাইব্রিড চাষী কৃষকের কাছে বীজধান বলে আর কিছু রইল না--প্রতিবছর নতুন করে বীজ কিনতে হল কোম্পানির কাছ থেকে। কৃষির আসল জিনিস--বীজ কৃষকের হাতছাড়া হয়ে গেল। হাইব্রিডে যেহেতু প্রচুর কীটনাশক ও সারের দরকার হয়, কাজেই চাষের খরচ গেল বহুগুন বেড়ে--কাজেই বীজ, সার ও কীটনাশক মিলিয়ে চাষের খরচ বহুগুন বেড়ে গেল--কৃষকের আয় কমে গেল।
তাছাড়া স্থানীয় জাতের বীজ ও প্রযুক্তিতে চাষাবাদের একটা বড় সুবিধা ছিল; একই সময়ে একই জমিতে নানা ফসলের চাষ করা যেত বছর জুড়ে--সেটাও বন্ধ হয়ে গেল হাইব্রিড ধানের কারনে--ফলে আসলে বেশি ধান ফলানোর নামে মোট খাদ্য উৎপাদন কমে গেল, প্রথম ধাক্কাটা গেল কৃষক পরিবারগুলার ওপর দিয়ে, তাদের পুষ্টিমান নেমে গেল। অন্যদিকে, স্থানীয় জাতের অনেক ফল-ফসলের বীজ হারাতে বসল, অন্যদিকে সার ও কীটনাশকে জমির উর্বরতা কমতে শুরু করল, দুষিত হতে লাগলো প্রাণ ও পরিবেশ।
‘জমি নাশ প্রাণ নাশ, কীটনাশকে সর্বনাশ’
কৃষক মোহাম্মদ আক্কাস আলী এখন আর হাইব্রিড চাষ করেন না। তিনি তার এলাকায় হাইব্রিড প্রবেশের ওই দু:সময়ের স্মৃতিচারণ করছিলেন, ‘আমাদের এলাকায় এসিআই, গ্যানজেস, সিনজান্টো, মনসান্টো, ম্যাকডোনাল্ড এইধান গুলা এই প্যাকেট ধান বিক্রি করছে এনজিওগুলারে দিয়া। যেমন ব্র্যাক এনজিওর মাধ্যমে যখন আলোক ধান আসল, তখন বলল, কেউ এই ধান চাষ না করলে তাকে লোন দেয়া হবে না। আমার পাশের বাড়ির মো. আতোয়ার রহমান হাইব্রিড ধান চাষ করতে লাগল। তার ধানের গাছ বড় বড় হইল। শিষও বড় হইল। কিন্তু ধানে চাল হয় নাই। সব চিটা হইছে।’ আক্কাস আলী জানান তারপরও ‘বীজ কেনার জন্য কোম্পানির কাছে ধরনা দেয়া লাগে।’ মঞ্জুরকে ঘিরে বসা কৃষকদের দিকে তাকিয়ে আক্কাসের প্রশ্ন, ‘নিজের চাষের বীজের জন্য কোম্পানির দিকে তাকায়ে থাকবো কেন?’
বেশি ফলন আর আর্থিক উন্নতির জিগির তুলে কোম্পানি আর এনজিওগুলা যখন হাইব্রিড বীজ বিক্রি করতে নামে, তখন নিজের বীজধান ফেলে কোম্পানির দিকেই তাকিয়েছিলেন টাঙ্গাইলের কিষাণী রূপসী বেগম। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে রূপসী বলছিলেন, ‘প্রথম দিকে পাঁচ কেজি সার দিলেও হত। কিন্তু পরের বছরগুলাতে দেখা গেল সার দেয়া লাগছে অনেক বেশি, সাত কেজি-দশ কেজি। এভাবে একসময় দেখা গেল বিশ পচিশ কেজি সার দিলেও ফলন ভাল হয় না। তাহলে হাইব্রীড চাষ করে কৃষকের কি লাভ? রুপসী বেগম আনমনে জবাব দেন, ‘কোম্পানি আমাগো লগে সারের ব্যবসা করছে।’ বলে রাখি, মেলার দ্বিতীয় দিনে, মানে ৩ ডিসেম্বর ছিল বিশ্ব কীটনাশক বিরোধী দিবস। তার দুদিন আগেই সেই সন্ধ্যা পেরোনো রাতের শুরুতে বিশ্ব কীটনাশক বিরোধী দিবসের একটি শ্লোগান মনে করিয়ে দেন রূপসী; ‘জমি নাশ প্রাণ নাশ, কীটনাশকে সর্বনাশ।’
সবার আগে স্থানীয় জাতের বীজের সুরক্ষা
পরদিনÑ মেলার প্রথম দিন সকালে মেলার উদ্বোধন হল আনুষ্ঠানিকভাবে। মঞ্চে অনুষ্ঠান চলছিল। ড. মান্নান-এর বক্তব্য শুনছিলাম। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. আব্দুল মান্নান অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি। তিনি বলেন, সেচসহ অন্যান্য কাজে মাটির নিচের পানি ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। মাটির নিচের পানির নির্বিচার ব্যবহার আমাদেরকে আর্সেনিক দূষণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে কোন সন্দেহ নাই। তিনি স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণের গুরুত্বের কথা বলছিলেন। সমবেত কৃষকদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন, যারা অনেক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে পরে হাইব্রিড ধানের চাষ ছেড়ে দিয়েছেন। তারা জানালেন, ব্রি কখনোই স্থানীয় জাতের ধানের বীজ কৃষকের কাছে সংরক্ষণের জন্য কোন উদ্যোগ নেয় নাই। তাছাড়া কৃষি অধিদপ্তরের ব্লক সুপারভাইজাররাও তাদের কোম্পানির হাইব্রিড বীজ চাষের পরামর্শ দিতেন। এখন উন্নত প্রযুক্তিতে স্থানীয় জাতের ধান চাষ করেন তারা। সার-কীটনাশক ও মাটির নিচ থেকে পানি উঠিয়ে সেচ দেওয়া ছাড়াই।
ড. মান্নানের বক্তৃতার এক ফাকে ওই কৃষকদের একজনের সাথে কথা বলছিলাম। টাঙ্গাইলেরই কৃষক: হাবিবুর রহমান। জনাব রহমানের কাছে জানতে চাইছিলাম ঠিক কেন তিনি স্থানীয় জাতের ধান চাষ করছেন? তার নিজের ঠিকঠিক লাভটা কি? তিনি বললেন, ‘আমরা সারা বছরই ফসল করার পারুম। খাদ্যাচাহিদা খুব একটা মারাত্মক থাকবে না। এক ফসল করলে খাদ্য চাহিদা মেটে না। একটা ফসলের মধ্যে আরও পাঁচটা ফসল চাষ করার পারুম। নয়াকৃষি আন্দোলন আমাদের একটা ফসলের ভিতরে আরও পাঁচটা ফসল করা শিখাইছে।’ ঠিক একইরকম কথা কিষাণী রূপসী বেগমও বললেন: ‘আমার বাপ দাদারা আগে ফসল করত চিনা, পায়রা, গম, মাসকলাই। আমরা পায়রার ছাতু খাইছি, ডাইলের চাপরা খাইছি। এহন ইরি ধানের ভাত খাইয়া গায়ে বল পাই না। ইরিধান আইল। আমাগো ইরিধানের লোভ ধরাইল। আগে ভাত না খাইয়া ডাইলের চাপড়া খাইয়াও শরীরে বল পাইছি। এহন ইরি ধানের ভাত খাইয়া গায়ে বল পাই না।’
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদে কৃষি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি জনাব শওকত মোমেন শাজাহান। স্থানীয় জাতের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে প্রধান অতিথি বলেন: ‘ফলন কেমনতর হবে তা নির্ভর করে বীজের বৈশিষ্ট্যের ওপর।’ বক্তৃতার এক পর্যায়ে কৃষকরা হাইব্রিড ধানের বিষয়ে সংসদ সদস্যের কাছে আপত্তি জানান। আনুষ্ঠানিক বক্তৃতার পরে এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপে জনাব শাজাহান জানান, বীজ সংরক্ষণের কোন নীতিমালা বাংলাদেশ সরকারের নাই।তবে নয়াকৃষি আন্দোলনের স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণের চেষ্টাকে তিনি স্বাগত জানান তিনি।
কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার ওপর জনগণের সার্বভৌমত্ব
উদ্ধোধনীতে বক্তৃতা করতে কবি ও দার্শনিক ফরহাদ মজহার হাল দুনিয়ার তিনটি বিশ্বজনীন লড়াইয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, বর্তমান দুনিয়ায় তিনটা লড়াই চলছে। পানি আর তেলের লড়াইয়ের পাশাপাশি চলছে বীজের লড়াই। কৃষকের বীজ আর কৃষির জ্ঞান বিলুপ্ত করার লড়াইয়ে নেমেছে বহুজাতিক বীজ ও কীটনাশক কোম্পানীগুলা। সারা দুনিয়ার কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার ওপর মালিকানা কায়েম করতে চায় তারা। তিনি জানান, কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার ওপর কোম্পানির বিপরীতে জনগণের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শেষের লড়াইটা বাংলাদেশে লড়ছে নয়াকৃষি আন্দোলন। ফরহাদ মজহার ব্যাখ্যা করেন; কোম্পানিগুলা কৃষিকে শিল্প কারাখানায় ঢুকিয়ে ফেলছে।
কোম্পানিগুলা বলছে; ধানের ফলন থাকে শুধু ধানের জিনের ভেতরে। কাজেই শুধু জিনগত উন্নয়ন ও পরিবর্তন করলেই যেন বীজে ভাল ফলন হবে। কিন্তু তাদের কথিত ভাল বীজ হলেই ত আর ভাল ফসল দুরের কথা, ফসলই যে হবে তা কিন্তু নয়। ভাল ফলনের নিশ্চয়তা শুধু বীজ দিতে পারে না। এটা নির্ভর করে পরিবেশ-প্রকৃতির ওপরে। ধানের জিনের মধ্যে যেমন ফলন থাকে, তেমনি পানি, পানির ব্যবহার, জীব-অণুজীব ও পরিবেশ প্রকৃতিতেও ফলন থাকে। কিন্তু এই সব পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ভূমিকা এড়িয়ে গিয়ে কোম্পানিগুলা জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ধান সহ নানা ফসলের বীজ বিকৃত করে ফেলছে। এই পুরা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এটাকে তারা রীতিমত ইন্ডাস্ট্রি বানিয়ে নিয়েছে। আর এসব বিকৃত বীজকে ওই ইন্ডাস্ট্রির কাঁচামালে পরিণত করছে। এর মাধ্যমে তারা তাদের ব্যবসা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর এই কৃষিকে এমন ব্যবসায়ের পণ্যে করে শিল্পপ্রক্রিয়ায় জুড়ে দেয়ার নাম তারা দিয়েছে ‘বৈজ্ঞানিক’ কৃষি।
স্থানীয় ও উন্নত কৃষি নিয়ে দীর্ঘ তিন দশক ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে জনাব মজহার বলেন, উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উবিনীগ’ কয়েকটি গবেষণায় প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে বিঘা প্রতি পাঁচ থেকে সাত টন ধান হয় এমন ধানও এ দেশে চাষ হত। তাহলে এখন তা হবে না কেন? যেটা জিনপ্রযুক্তি কিংবা হাইব্রিড জাতের বীজ ছাড়াই আগে রীতিমত ফল দিত। সেটা সম্ভব ছিল এবং এখনও নয়াকৃষি পদ্ধতিতে সেটা হচ্ছে। কারণ নয়াকৃষির কৃষি হল প্রাণ ও পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো বিজ্ঞান। যে বিজ্ঞানের কৃষি ব্যবস্থায় কৃষির ওপর--কৃষির জ্ঞানের ওপর--বীজের ওপর কৃষকের সার্বভৌমত্ব থাকে। ফলে পুরা কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার ওপরও জণগণের সার্বভৌমত্ব থাকে।
একই ধরণের সার্বভৌমত্বের কথা বলছিলেন নয়াকৃষি আন্দোলনের পরামর্শক কৃষিবিদ ড. এম এ সোবহান। উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানের একদম শুরুতে স্বাগত বক্তৃতায় তিনি বলেন, স্থানীয় জাতের ধান চাষই একমাত্র খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে পারে। অনুষ্ঠানের পরে জনাব সোবহানকে বিষয়টি সহজ করে বলতে বললে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, কোম্পানিগুলা যে খাদ্য নিরাপত্তার কথা বলছে ওই নিরাপত্তার মানে হল, মানুষ তাদের খাদ্য চাহিদা মেটাতে কোম্পানিগুলার ওপর নির্ভর করবে। কিন্তু খাদ্যের স্বার্বভৌমত্ব হল, মানুষ কি খাবে বা উৎপাদন করবে, নিজেরাই সেই সিদ্ধান্ত নেবে এবং তারাই তা উৎপাদন করবে। মোটকথা বীজ কৃষকদের হাতে থাকলেই কেবল খাদ্যে স্বার্বভৌমত্ব অর্জন সম্ভব।
ধানের বৈচিত্র্য: যেমন জমিন তেমন ধান
নয়াকৃষি আন্দোলন যেই কৃষকের হারানো বীজ কৃষককে ফিরিয়ে দিতে কাজ করছে সেই কৃষকের অভিজ্ঞতা কি? দেশের নানা অঞ্চলের স্থানীয় ধানের জাত আবার ওখানকার জমিনে ফিরছে কি? কিভাবে? মেলায় সমবেত কৃষকদের সাথে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাদের কথায় ধান চাষের আগের এবং বর্তমান আধুনিক ব্যবস্থার ভাল-মন্দ দিক তুলনামূলকভাবে উঠে আসে। টাঙ্গাইলের কিষাণী সুরাইয়া বেগম বলেন, ‘গভীর পানিতে আমরা ধান চাষ করতাম। পানিও বাড়ত সাথে ধান গাছও লম্বা হত। সেই ধান আর নাই এখন।’ কক্সবাজারের চকোরিয়া থেকে আসা কৃষক মনজুর আলম বলেন, ‘আমরা বাপ-দাদার আমল থেকে লবণাক্ত পানি সইতে পারে এমন ধান চাষ করেছি। ধানের ফলনও অনেক ভাল দিত। কিন্তু হীরা ধান আসায় আমাদের ধান হারিয়ে গেছে। ধান বানতে গিয়ে মেয়েদের যেই আনন্দ এবং গান ছিল তাও হারিয়ে গেছে।’
স্থানীয় জাতের ধানচাষের সুবিধার বিষয়ে কৃষক মো. আক্কাস জানান, আমরা জায়গা ভিত্তিক ধানের জাত নির্বাচন করতে পারি। ইরির মধ্যে কোন জাত নাই। কৃষক হাবিবুর রহমান বললেন, স্থানীয় জাতের ধান আমন আমরা সব জায়গায় লাগাইতে পারছি। এক মণ আমন ধান খাইবেন আর দুইমণ ইরিধান খাইবেন, সমান হইবে? সমান হইবে না। এই যে সকালে পান্তাভাত খাইয়া হাল চইতে যায়, আসর হইলেও খিদা লাগে না। কিন্তু ইরিধানের চালের গরমভাত খাইয়া সকালে ক্ষেতে গেলে এগারটার সময় চাইয়া থাহি--এহনও ভাত লইয়া আয় না কেন। ইরি ধান-২৯ আমাগো বয়সে হইছে। আমাগো কথা শোনে। কিন্তু পুষ্টি যোগাইতে পারে না।
আরেক কিষাণী রূপসী বেগম বললেন, ‘আঁরে আগেরকার পায়রা ছাতু আর এহনকার তিনবেলার ভাত সমান হইবে না। চত্তির মাস আইলে পায়রার ছাতু পাওয়া যাইত।’ আক্কাস আরও জানান, ‘কক্সবাজার লবণাক্ত জায়গা। লবণ পানিতে ধান হয়। তা আমরা দেখেছি। ওই জায়গায় ‘সাহেব চিকন’ ফলে বেশি। লবণাক্ত পানিতে। কাজেই এলাকাভিত্তিক জাত নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু কোম্পানি জাত নির্বাচন কইরা দেয় নাই। ওরা সব জায়গায় একই ধানের বীজ দেয়। কাজেই ওদের নিময়কানুনের লগে আমাগো নিজেগো নিয়মকানুনের লগে মেলে না। কক্সবাজারের মনজুর ভাইরে দাওয়াত দিমু, ভাইজান আপনি ‘সাহেব চিকন’ লইয়া আহেন। আর মনজুর ভাই আমাগো টাঙ্গাইলের মানুষেরে কইবেন, ভাই আপনাদের বিরুইবাহার, ফুরফুরি ধান লইয়া আহেন। এভাবে মতবিনিময় করে চাষ করতাম।
ফসল চাষের ভেতর দিয়েই সার তৈরি
কৃষক হাবিবুর রহমান তার কৃষি অভিজ্ঞতা থেকে জানান, ‘এক ফসলে সার নিয়া যায়, অন্য ফসলে সার দিয়া যায়। জমিতে পর পর ধান চাষ করলে মাটির উর্বরতা থাকে না। আর অন্য ফসল যদি বুনি তকন ওই ফসল সার দিয়া যায়। যেমন প্রথমে আমরা ধান বুনলাম, তারপর পাট বুনলাম। আবার আমন ধানে সার দেয়া লাগে না। আউসের পর আমন বুনলাম। আউসে যে নাড়া রইল ওইটা আমনের সার। যেখানে সার লাগে সেখানে জৈব সার দিলাম। এহনকার দিনের মুলা খাইয়া দেখছেন? বাজারে সব মৌসুমে মুলা পাওয়া যায়। কিন্তু সেই মুলা খাইলে লাগে কলাগাছের খোলের স্বাদের মত। এহন আমরা পিয়াজ বুনি না, রসুন বুনি না। দেখুন ইরি ক্ষেতে মশুরি বুনলে হবে না, বুট বুনলেও হবে না। আমরা এহন দেশী বুট খেতে পারি না। খাই ইনডিয়ান বুট, ডাল। তার স্বাদ লাগে না।’
চাপাইনবাবগঞ্জের চাষী মোহাম্মদ রমজান আলী এই প্রতিবেদককে তার এলাকার স্থানীয় জাতের ধানের কথা জানান। তিনি বলেন, ‘ভাদইধান অর্থাৎ সোনাপুটি, শনি, ষাইটা, শঙ্খবটি, ভইরা ধান আগ থেকে চাষ করে আসছি। এতে কোন সার ব্যবহার করি না। মাসকলাই বিঘাতে তিন থেকে চার মণ ধান চাষ করি। ভাদই ধান যখন কাটি, ভাদ্র মাসের পনের থেকে বিশ তারিখ হয়ে গেলে ওই ধান আর জমিতে থাকে না। আমরা কেটে ফেলি। এ সময়ে কিন্তু বন্যা হতে পারে। ভাদ্র মাস বা আশ্বিনের পনের তারিখ পর্যন্ত বন্যা থাকতে পারে। এরপর কলাই বুনে দিলে কোন খাটনি নাই, নিড়ানি নাই; কোন পরিশ্রম ছাড়াই এ ফসল আমরা পাই। গোবর, কম্পোজ (কম্পোস্ট) সার দেই। বিষ তো দে-ই না। কেউ তর্ক করতে আসলে তাকে ক্ষেতে নিয়ে যাই। বলি দেখ, বিষ ছাড়া ধান হয়েছে। আর তোরা তো খাটবি না। বাবুর মত পকেটে টাকা লইয়া গিয়া বিষ কিনে আনবি। আমার বাড়িতে এখন নিমের বীজ আছে। নিমের বীজ বিষের কাজ করে। নিমগাছের ফল পড়লে সেটা কুড়িয়ে ঘরে রেখে দিতে হবে। বোরো ধান লাগানোর পর গুড়া করে ক্ষেতে ছিটিয়ে দিলে তার গন্ধে কোন পোকা ক্ষেতে আসবে না। কিন্তু কোম্পানিগুলা আমাদের সাথে সারের ব্যবসা করছে, বীজের ব্যবসা করছে।’
রূপসী বেগম টাঙ্গাইলের কৃষক। বহু আগে থেকেই তিনি স্থানীয় জাতের ধান চাষ করে আসছেন। মাঝখানে উফশী ধান চাষ শুরু করেছিলেন। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি চিন্তাকে জানান, ‘কিন্তু নয়াকৃষি আমাগো কম্পোজ সার বানানো শিখাইছে। মিটিংয়ে বইয়া এসব হিকছি। কম্পোজ বানাইয়া সবজি বুনলাম। ভাল হইল। খাইতেও স্বাদ লাগে। কম্পোজ দিয়ে সবজি চাষ করলে সবজি নরমও হয়, খাইতেও স্বাদ লাগে। ভাবলাম সবজি যদি এত স্বাদ লাগে তাইলে জমিন চাষ কইরা দেহি। কম্পোজ দিয়ে জমি চাষ করতে শুরু করলাম। কিন্তু দেখলাম কম্পোজ দিয়া জমি চাষ করাতে অন্যদের চাইতে আমাগো ফসল কম হয়। তবে হিশাব কইরা দেখলাম, আমাগো সার কিনতে এক পয়সাও খরচ হয় না। পরিশ্রম কম হইছে। সার, বিষ লাগে নাই। ছয় পাহারি হইলে সেটাও আমাগো আসল। আলু বোনলাম। দেখলাম পাশের জমির আলুর চেয়ে আমার আলু ভাল হইছে। তবে আকারে ছোট হইছে। পরে পাশের জমির মালিকরে বললাম, আপনার সারের ব্যবহারে আলুতে ঘা হইছে। এভাবে পুরা এলাকায় চাষ শুরু হইল।
একই চাষে হরেক ফসল
কৃষক হাবিবুর জানান, ‘আমরা আষাঢ় মাসে একটা আবাদ করুম, ফাল্গুন মাসে আরেকটা আবাদ করুম। আষাঢ় মাসের খাটনিতে ফাল্গুন মাসেরটা হইয়া যায়। আখ চাষ করলে আখ খেতে আমরা কয়েকটা ফসল চাষ করতে পারি। কার্তিক মাসে আখ লাগাইলাম। তার মধ্যে আলু, সরিষা, মূলা, কফি, মরিচ সবটাই আবাদ করতে পারি। আখ চাষ করলাম, সাথে কোন খাটনি ছাড়া অনেকগুলা ফসল পাইলাম। আমরা যারা পুরাতন নয়াকৃষির তারা এহন জৈব সার বানাই না। আমরা এখন অদলবদল ফসল করি। অদলবদল ফসল করলে মাটি দূষিত হয় না। কেন হয় না, যদি পাট বুনি। বৈশাখ মাস থেকে যে পাটের পাতাগুলা জমিতে পরবে, সেগুলা সার তৈরি করবে। কি ভাই হইবে না? পাশের জনকে লক্ষ্য করে বললেন হাবিবুর। এই কারণে আমরা শিখে নিছি কোনটায় নাইট্রোজেন আছে। কোনটায় কি করলে কি হবে সব। আমরা শিখার মধ্যে আছি।’
স্থানীয় জাতের ধান চাষে কৃষকদের আগ্রহী করে তোলার কথা বললেন কৃষিবিদরা
মেলার দ্বিতীয় দিনে কয়েকটি আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের দুই বিজ্ঞানী ড. রহিমা আখতার ও ড. নার্গিস আক্তার। ড. নার্গিস আক্তার জানান, আমাদের দেহের ক্যালরির অর্ধেকটাই আসে ধান থেকে। জাতীয় আয়ের পাঁচ ভাগ আসে ধান থেকে। তাই স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু এর জন্য কৃষকদেরকে বিদেশী জাতের বীজের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে দিতে হবে। এর জন্য তাদেরকে স্থানীয় জাতের বীজের ধান চাষে আস্তে আস্তে উৎসাহী করে তুরতে হবে। এটা হতে পারে এভাবে যেমন: প্রত্যেক কৃষক উফশী ধান চাষ করবে, কিন্তু পুরা চাষের জমির দশভাগ স্থানীয় জাতের ধান চাষ করবে। এবং এটা ক্রমান্বয়ে বাড়াবে। এভাবে স্থানীয় জাতের ধান চাষের প্রতি কৃষকদের উৎসাহিত করা যেতে পারে। তিনি থাইল্যান্ডের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ধান উৎপাদন করেই থাইল্যান্ডের কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ।
দেলদুয়ার উপজেলা কৃষি অফিসার শাহ আলম জানান, ‘হাইব্রিড ধানের অরিজিন তিন বছরের বেশি স্থায়ী হয় না। বিপরীতে দেশীয় জাতের অরিজিন চিরায়ত। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ধানের ভেতরে ভিটামিন এ ঢুকানোর দরকার কেন! আমাদের চারপাশে এত ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ শাকসবজি থাকার পর ধানের ভেতরে ভিটামিন এ ঢুকানোর পাগলামি ছাড়তে হবে। কৃষি ব্যবস্থাকে টেকসই করতে হলে স্থানীয় জাতের বীজ চাষ করতে হবে।’ বিজ্ঞানী ড. রহিমা বলেন, ‘স্থানীয় জাতের ধানের সাথে আমাদের কৃষি সংস্কৃতি একাট্টা সম্পর্কিত। আর এ দেশের নারীরা স্থানীয় জাতের ধানের বীজ সংরক্ষণ করে আসছে বছরে পর বছর ধরে। অথচ হাইব্রিড চাষ করতে গিয়ে সমাজে নারীদের এ ভূমিকাকেও আমরা অবজ্ঞা করছি।’
কৃষিবিদ বেগম রহিমা বলেন, হাইব্রিড ধান চাষ করায় আমরা আমাদের নিজেদের বীজের প্রতি যত্ন নিতে পারি নাই। জমির স্বাস্থ্য ভাল থাকলে ধানও ভাল থাকে। ধানমেলা ও কৃষক সমাবেশের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে পাওয়ার পয়েন্ট ব্যবহার করে প্রজেক্টরের মাধ্যমে একটি গবেষণা চিত্র তুলে ধরেন উবিনীগের নির্বাহি পরিচালক ফরিদা আখতার। তিনি দেখান যে, আউশ, আমন, বোরো মৌসুমে কৃষকরা সুন্দর সুন্দর নামের স্থানীয় জাতের ধান চাষ করত। যেমন, কালামানিক (আউস), দুধসর (আমন), টুপাবোরো (বোরো)। আবার অঞ্চল ভেদে ধানের জাত ছিল। যেমন বন্যা প্রবণ অঞ্চলের ধানের একটা জাত হল কটকতারা, বরেন্দ্র অঞ্চলের কালোকচু, হাওড় অঞ্চলে মধুমালতি, উপকূলীয় অঞ্চলে আশাইল লেম্বুর ধান চাষ করা হত।
ফরিদা আখতার জানান, আবহাওয়া ও জলবায়ু সহনশীল ধানও ছিল আলাদা করে। যেমন, বন্যা সহনশীল ধান হল দিঘা, খরা সহনশীল ধান জবাফুল, লবণাক্ততা সহনশীল ধানের নাম নোনাশাইল, ঠাণ্ডা সইতে পারে এমন ধান হল রাতা। পুরা মাঠে একরকম ধান চাষ করায় একসাথে পোকায় আক্রান্ত হয় সব ধান। এরকম অবস্থায় কীটনাশকও কোন কাজ করে না। কিন্তু মাঠে বিচিত্র রকমের ধান থাকলে একাধারে পোকায় আক্রমণ করতে পারে না। কারণ, সব ফসলের জন্য একরকম পোকা ক্ষতিকর না। একরকম ফসলের জন্য এক একরকম পোকা ক্ষতির কাজ করে। চাপাইনবাবগঞ্জের কৃষক রমজান আলী বলেছেন, চাইটা, শনি, শঙ্খবাটি, ধানের বীজ সে নিজে রাখে। অনেককে বীজ দিয়ে সাহায্য করে। ইচ্ছা করলে যে কেউ তার কাছ থেকে বীজ নিতে পারে।
সেচের কাজে ভূগর্ভস্থ পানির বন্ধ করতে হবে
মেলার শেষ দিনে আলোচনা সভায় বিভিন্ন বক্তার বক্তব্যে কৃষিতে সেচ ব্যবস্থা ও পানি ব্যবহারের নিয়ম-পদ্ধতির কথা গুরুত্বের সাথে উঠে আসে। সমাপনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন টাঙ্গাইল নির্বাচনী এলাকা-৬ এর মাননীয় সংসদ সদস্য খন্দকার আবদুল বাতেন। তিনি বলেন, সেচ কাজে মাটির উপরিভাগের পানি ব্যবহার করতে হবে। সরকারও আইন করতে যাচ্ছে এ ব্যাপারে।
রাজশাহীর গোদাবাড়ি থেকে আসা কৃষক রবিউল ইসলাম চিন্তাকে বলেন, আমাদের বাপ-দাদারা ধান চাষ করত পুরাপুরি আল্লার ওপর নির্ভরশীল হয়ে। আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র আশ্বিন এই মাসে বরেন্দ্র এলাকায় দফায় দফায় বৃষ্টি হত। এসময়ে আমরা ধান চাষ করি। চিরদিন এরকম হয়ে আসছে। কিন্তু এখন ভূ-গর্ভের পানি তুলে সেচ দেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের কোন আইন নাই। আমরা প্রকৃতি থেকে বেরিয়ে আসায় বৃষ্টি এখন ঠিক সময় হয় না।
সমাপনী অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে ড. এম এ সোবহান একই কথা বলেছেন ভিন্নভাবে। তিনি বলেন, পানির সুরক্ষা এবং সেচ দিতে হবে মাটির উপরিভাগের পানি থেকে। ভূ-কম্পন, আর্সেনিক দূষণ থেকে বাঁচতে এর বিকল্প আপাতত নাই আমাদের। ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা আইন নামে একটা আইন আছে বলে জানান দেলদুয়ার উপজেলা কৃষি অফিসার মো. শাহ আলম। তিনি বলেন, ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা আইন আছে, কিন্তু তা আমরা বাস্তবায়ন করছি না।
মেলার অন্যান্য দিক
১.
মেলায় রিদয়পুর বীজ সম্পদশালার চারপাশ ঘিরে ছোট ছোট মাটির বাসনে স্থানীয় জাতের তিন হাজার ধানের প্রদর্শনী হয়। এরসাথে প্রদর্শন করা হয় ধান চাষের প্রয়োজনীয় নানান জিনিসপত্র। লাঙ্গল, জোয়াল, মাথাল, পাচন, মই, নিড়ানি ইত্যাদি দেশীয় কৃষী উপকরণ। মেলায় তাঁতীরা নিজ হাতে বোনা শাড়ি, কাপড়, পাঞ্জাবি, কামিজ-ওড়না, গামছা ছোট ছোট দোকানে মেলে ধরে। তাঁতের শাড়ি বানানো হয় কিভাবে তা দেখানোর জন্য একজন তাঁতি একটা তাঁত মেশিনও নিয়ে এসেছিল। মেলার উদ্ধোধন করেন বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি শওকত মোমেন শাজাহান। বিশেষ অতিথি হিশাবে হাজির ছিলেন কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. আব্দুল মান্নান ও দেলদুয়ার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুক। পাওয়ার পয়েন্ট প্রোগ্রাম ব্যবহার করে ‘ধানের বৈচিত্র্য রক্ষার সংগ্রাম’ শিরোনামে বিশেষ গবেষণা চিত্র তুলে ধরেন উবিনীগ’র নির্বাহি পরিচালক ফরিদা আখতার। স্বাগত বক্তব্য রাখেন নয়াকৃষি আন্দোলনের পরামর্শক ড. এম এ সোবহান। অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব করেন কবি ও দার্শনিক ফরহাদ মজহার। অনুষ্ঠান পরিচালনায় ছিলেন উবিনীগের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা পরিষদ সদস্য সীমা দাস সীমু।
২.
বিশ্ব কীটনাশক বন্ধ দিবস পালন
এ দিবসটা পালন করা হয়েছে ডিসেম্বর মাসের তিন তারিখে। নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকরা এ উপলক্ষে একটা র্যালির আয়োজন করে ওইদিন। প্রায় এক হাজার কৃষক এবং কিষাণী র্যালিতে যোগ দেন। শিশু এবং কিশোররাও ছিল র্যালিতে। পাথরাইল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হওয়া র্যালি গিয়ে থেমেছে পাথরাইল বাজারে। এ পথটুকুতে কৃষকদের হাতে ছিল ব্যানার, ফেস্টুন এবং প্লেকার্ড। একটা শিশুর হাতের ব্যানারে লেখা ছিল তোমরা আমাদের জন্য হলেও কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ কর। র্যালি পরিচালনা করেছে উবিনীগের সমন্বয়ক মোজাহিদুল ইসলাম প্রিন্স এবং রবিউল ইসলাম চুন্নু। বক্তব্য দিয়েছে উবিনীগের ব্যবস্থাপনা পরিষদের সদস্য জাহাঙ্গির আলম জনিসহ আরও অনেক পরিবেশকর্মী এবং কৃষকরা। জাহাঙ্গির আলম জনি টাঙ্গাইলকে কীটনাশক মুক্ত এলাকা ঘোষণা করার আহ্বান জানান। এবং কৃষকরা যাতে ফসলে কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ রাখেন সে ব্যাপারে তাগিদ দেন। এ ব্যাপারে উবিনীগের সমন্বয়ক গোলাম রাব্বী বাদল এ প্রতিবেদককে জানান, উনিশশ চুরাশি সালে দুই ডিসেম্বর ইনিডয়ার ভূপাল শহরে চল্লিশ টন মিথাইল আইসোসাইনেট, হাইড্রোজেন সায়ানাইডের মত কিছু বিষাক্ত গ্যাস বিষ কারখানা থেকে নির্গত হয়। এবং ছড়িয়ে পড়ে পুরা ভূপাল এলাকায়। গভীর রাতে মানুষ ঘুমিয়েছিল। পাঁচ লাখ নারী, পুরুষ, শিশু এই বিষাক্ত গ্যাসের ধোঁয়ায় আটকে পড়ে। গ্যাস নির্গত হওয়ার প্রথম সপ্তাহে মারা যায় ছয় হাজার মানুষ। উনিশশ সাতানব্বই সাল পর্যন্ত এ দুর্ঘটনায় সৃষ্ট নানা রোগে ভুগে মারা যায় আরও দশ হাজার মানুষ। এরপর থেকে প্রতিবছর তিন ডিসেম্বর আমরা বিশ্ব কীটনাশক বন্ধ দিবস পালন করছি। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, কীটনাশক তৈরির ওই কোম্পানিটি ছিল আমেরিকার একটা বহুজাতিক কোম্পানি। দুর্ঘটনার পর কোম্পানিটি ওখান থেকে চলে গেছে। মামলা করা হয়েছিল এ কোম্পানির বিরুদ্ধে। কিন্তু দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের দুঃখ লাঘব হয় নাই আজও। র্যালি শেষে কৃষকদের ঘোষণা পাঠ করান উবিনীগের নির্বাহি পরিচালক ফরিদা আখতার।
৩.
সিনজেন্টা কোম্পানির প্রতারণার শিকার রাজশাহীর কৃষকরা
রাজশাহীর গোদাবাড়ি থেকে আসা কৃষক রবিউল ইসলাম এই প্রতিবেদককে তার দুঃখ এবং আক্ষেপের কথা জানান এভাবেÑ ‘গেল বছর দুই যাবত আমরা সিনজেনটা কোম্পানির কাছ থেকে বীজ কিনে টমোটো চাষ করতাম। আগে আমরা ধান চাষ করতাম। আট থেকে দশ বছর থেকে টমেটো চাষ হচ্ছে। আমাদের জীবিকা নির্বাহ করছি টমেটো চাষের আয় থেকে। এই বছরও আমরা গোটা গোদাবাড়ির কৃষকরা সিনজেন্টা কোম্পানির বীজ নেই। কৃষকরা সবাই বিভিন্ন ব্যাংক, এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে জমি চাষ করেছে। আমি ছয়বিঘা জমি চাষ করেছি, বিভিন্ন জনের কাছ থেকে কর্জ করে খরচ জুগিয়েছি এ চাষের। আমার ষাট হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু এখন এ সময়ে ভরপুর টমেটো উঠবার কথা, অথচ আমি দুই পয়সারও টমেটো বেচতে পারি নাই। ক্ষতির পরিমাণ আমাদের এমন যে, পিঠ আমাদের দেয়ালে ঠেকে গেছে। গোদাবাড়িতে প্রায় পাঁচহাজার একর জমিতে যে টমেটো চাষ হয়েছে তার আশি ভাগ লোক ক্ষতিগ্রস্ত। বীজ বেচার সময় বহুত কিছু বলেছে কোম্পানি যে এ বীজ নিলে ভাল হবে। আমরা কৃষকরা বেশিরভাগই অশিক্ষিত। তখন আমরা কিছুই বুঝি নাই। এখন আমাদের টমেটো গাছে ফল ধরে না। এলাকার বেশিরভাগ কৃষকের জমিতেই ফল হয় নাই।’
তিনি আরও জানান, এ নিয়ে কৃষি অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয় নাই। যাদের কাছ থেকে বীজ নিয়েছি তারা পলাতক। আমরা মামলা করেছি। কৃষক সমাবেশ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে। এখন আমি আপনাকে দুঃখের কাহিনী ছাড়া কিছুই বলতে পারব না। আমাদের দিনগুলা খুব দুঃখে এবং কষ্টে কাটছে। কৃষি মন্ত্রণালয় আমাদের ব্যাপারে জানে। এখন সামনে যে একটা ধান আমরা চাষ করব, এর যে একটা খরচ তা আমার কোথা থেকে জোগাব? দেনা শোধ করতে গিয়ে কৃষককে বাড়ির টিনও বেচতে হয়েছে। আমি দেনা দিতে গিয়ে বাড়ির দুটা গরু বেচে দিয়েছি। এ ক্ষতির পর বুঝতে পারছি, কি পরিমাণ ক্ষতি আমাদের হয়েছে দেশী জাতের বীজ চাষ না করায়। টমেটো চাষের সময় আমাদের এত পরিমাণ কীটনাশক চাষ করতে বলেছে তা বলার মত না। আমার কাছে এসব বীজ এবং কীটনাশকের নমুনা আছে, আপনাকে দেখাতে পারব। তারা আমাদের সাথে কেবল বীজের ব্যবসাই করে নাই, কীটনাশক এবং সারের ব্যবসাও করেছে। আমাদের আশা-ভরসা, সন্তানদের লেখাপড়া, ভবিষ্যত সব কেড়ে নিয়েছে এই সিনজেন্টা কোম্পানি। কৃষকরা সরল, জানে কম; প-িতরা এ সুযোগ নিয়েছে। কৃষকদের বারবার বোকা বানিয়েছে। কিন্তু আমরা গোদা বাড়ির কৃষকরা এক হয়েছি। আর যাতে ঠগাইতে না পারে সে ব্যবস্থা করছি। বীজের দাম ছিল বিষগ্রাম আটশ পঞ্চাশ টাকা। কিন্তু কোম্পানি একটা সংকট তৈরি করে প্রতি বিষগ্রাম বিষের দাম রেখেছে তেইশ শত টাকা। এর চেয়ে শোষণ আর কি হতে পারে?’
৪.
বীজ সংরক্ষণে নারী
ফরিদা আখতার তার উপস্থাপনা কালে আরও জানায়, সবুজ বিল্পব শুরু থেকে স্থানীয় জাতের পরিবর্তে নতুন উদ্ভাবিত ধানের বীজ চালু করেছে। তাতে কৃষকের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং বীজ সংরক্ষণে নারীর জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা হারিয়ে গেছে। সিরাজগঞ্জ জেলা থেকে মোসাম্মত কামনা বেগম আসেন বীজ মেলা ও কৃষক সমাবেশে অংশ নিতে। কামনা বেগম সিরাজগঞ্জে নিজেই কৃষি কাজ করছেন। তার পাঁচটা ছেলে মেয়ে। প্রতিবছর তিনি প্রয়োজনীয় বীজ জমিয়ে রাখেন পরের বছর চাষ করার জন্য। তিনি কেবল বীজ জমিয়েই রাখেন না, এলাকার অন্যান্য কৃষকদের সাথে বীজ বিনিময়ও করেন। বীজ নিজ হাতে সংরক্ষণ করায় তিনি কখনও কোম্পানির দারস্থ হন নাই। আর সবার চেয়ে তার ফলনও ভাল হয় কীটনাশক, সারের ব্যবহার ছাড়াই।
৫.
জমির উর্বরতা রক্ষায় স্থানীয় জাতের ধান
চাপাইনবাবগঞ্জের কৃষক রমজান আলী আরও জানান, রবিশাইল, মাগুরশাইল, ঝিঙ্গাশাইল, বাতরাই, সোনাকাঠি, সোনাশাইল, দুধখানি, মাগুরছড়া, এসব ধানের মজা আলাদা। অথচ এসব ধানের নাড়াতেই সার আছে। ইরিধানের নাড়া গরুতে ভাল করে খায় না। ভাদইধানের নাড়া মাটিতে পড়লে মাটি উর্বর হয়ে যায়। আষাড়, শ্রাবণ, ভাদ্র আশ্বিন এই তিনমাস গোবর জমালে প্রায় দুই বিঘা জমিতে আমি সার দিতে পারি। গোবর দিলে মাটি নরম থাকে লাঙ্গল চালানো যায় সহজে। গোবর দিয়ে মাটিতে সূর্যের তাপ সহজে ঢোকে। কিন্তু ইরিধান চাষ করা জমিতে লাঙ্গল ঢোকে না। সূর্যের তাপ ঢোকে না। ইরিধানের নাড়া গুরুতে খায় না। গোবর পেতে হলে গরুকে নাড়া খাওয়াতে হবে। ফলে জমির উর্বরতা রক্ষায় স্থানীয় জাতের ধানের বিকল্প নাই।