হুমায়ূন, রাজনীতি ও ‘মানবিক সম্পর্ক’


‘আমার কাছে মানবিক সম্পর্ক রাজনীতির চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হয়’- হুমায়ুন আহমেদ

হুমায়ূন ‘জনপ্রিয়’। কিন্তু এই জনপ্রিয়তাটা কিভাবে ব্যাখ্যা করব? জনপ্রিয়তার সুবিধাটা হুমায়ূনের পুঁজি হতে পেরেছে। তাকে নিয়ে বই ও মিডিয়া ব্যবসায়ী ব্যবসা করে গেছে; হুমায়ূনের মৃত্যুর ফলে মৃত হুমায়ূন নিয়েও আরও ব্যবসায়িক ফায়দা তোলার সুযোগ তৈরী হয়েছে। তার জন্য ব্যবসায়ীরা আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেটা শুরুও হয়ে গিয়েছে। হুমায়ূন কর্কট বা ক্যান্সার রোগে মারা গেছেন। ক্যান্সারে মারা যাবার কারনে যে মানবিক সহানুভূতি তৈরী হয় সেটাও ব্যবসার কাজে লাগবে। বাজার এইভাবেই কাজ করে।

আবার এই জনপ্রিয়তা রাজনৈতিক পুঁজিও বটে।  তরুন ও মধ্যবিত্তের মধ্যে হুমায়ূনের জনপ্রিয়তা এবং প্রভাবকে অতএব রাজনৈতিক পুঁজি করার  চেষ্টা চলবে তাতেও অবাক হবার কিছ্ব নাই। তার প্রবল চেষ্টা ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। এই রাজনীতির দুইটা ধারা আছে। একটা ধারা মুক্তিযুদ্ধ বেচাবিক্রি করে টিকে থাকতে চেষ্টা করেঃ বাঙালী জাতীয়তাবাদীর দলবাজি ধারা। অপরটা সুশীল ধারা। সুশীল রাজনীতিও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিশাবেই নিজেদের হাজির করে কারণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্যেকুলারিজমের পিঠে চড়ার আরাম আছে। এতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তির স্থানীয় বরকন্দাজ হয়ে কাজ করতে সুবিধা। তাছাড়া দলবাজ জাতীয়তাবাদকে দেশের কথা বলতে হয়, জনগণের কাছে দেশের প্রতি আনুগত্য আছে কি নাই তার পরীক্ষা দিতে হয়। সুশীল রাজনীতির সেটা দরকার নাই। তাকে রক্ষা করতে হয় কর্পোরেট স্বার্থ। দেশ নয়, তার কাজ হচ্ছে পরদেশের স্বার্থ হাসিল করা। জনগণের কাছে রাজনৈতিক দলের জবাবদিহিতার জায়গা থাকলেও সুশীলদের নাই। হুমায়ূনের জনপ্রিয়তা বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর খেয়োখেয়ির বাইরে মধ্যবিত্তের উপর যে প্রভাব তৈরি করে আছে তাকে তারা সবসময়ই ব্যবহার করে এসেছে। এখন আরও জোরেসোরেই করবে।  মধ্যবিত্তকে হিলারির গ্লোবাল সুশীল প্রজেক্টের “স্মার্ট পাওয়ার এপ্রোচের” অধীনে এনে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির সাথে মিলিয়ে দেওয়া তাদের এখনকার রাজনৈতিক কাজ। নতুন ক্লাস এলায়েন্সে নতুন করে ১/১১ ধরনের রাজনীতির এক কুশন তৈরি করার প্রক্রিয়া জারি রয়েছে। হুমায়ূন তরুনদের কাছে জনপ্রিয়, কিন্তু এটাও ঠিক তাদের জন্য কোন রাজনীতি তৈরী করতে পারে না হূমায়ূন। অর্থাৎ সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্র, বর্তমান দুনিয়া, এখনকার সংকট ইত্যাদি কোন বিষয়ে নিবিষ্ট ভাবে ভাববার কোন তাগিদ বা  প্রেরণা হূমায়ূন তৈরী করে না। সাহিত্য ও শিল্পকলাকে এই কাজ করতে হবে সেই দাবি আমরা করছি না। কেন হুমায়ূন সুশীল সমাজের জন্য মূল্যবান সেটা বোঝা দরকার। অন্যদিকে হুমায়ূন মোটা দাগে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বাইরে্র কেউ নয়। সুশীলদের জন্য হুমায়ূন খুবই মূল্যবান জিনিস। ফলে তাদের পত্রপত্রিকায় টেলিভিশনে জনপ্রিয়তাকে আরও হাওয়া দিয়ে ফুলিয়ে হুমায়ূনকে অতিমানব করে তোলার অক্লান্ত চেষ্টা থাকবে এটাই স্বাভাবিক।  এই চেষ্টা প্রবল ভাবেই জারি থাকবে, চলে যাবে না। এই দুই ধারার মিলের দিকটা হলো, হুমায়নের জনপ্রিয়তার বিষয়টা তাদের কাছে বুঝাবুঝির চেষ্টা বা  তার কাজ নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলার বিষয় নয় বরং হুমায়ূনকে সামনে রেখে মধ্যবিত্ত তরুণদের ওপর প্রভাব জারি রাখার প্রতিযোগিতা করছে তারা। একটি ধারা চাইছে তরুণদের ওপর তাদের দলীয় প্রভাবের বিস্তৃতি ঘটুক, অন্য ধারা চাইছে বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়াকে আরও বেগবান করার ক্ষেত্রে তরুণদের কাছে হুমায়ূনের জনপ্রিয়তা কাজে লাগুক।


হুমায়ূনের জনপ্রিয়তা বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর খেয়োখেয়ির বাইরে মধ্যবিত্তের উপর যে প্রভাব তৈরি করে আছে তাকে  সুশীল সমাজ সবসময়ই ব্যবহার করে এসেছে। এখন আরও জোরেসোরেই করবে।  মধ্যবিত্তকে হিলারির গ্লোবাল সুশীল প্রজেক্টের “স্মার্ট পাওয়ার এপ্রোচের” অধীনে এনে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির সাথে মিলিয়ে দেওয়া তাদের এখনকার রাজনৈতিক কাজ। নতুন ক্লাস এলায়েন্সে নতুন করে ১/১১ ধরনের রাজনীতির এক কুশন তৈরি করার প্রক্রিয়া জারি রয়েছে।


এর বাইরে হুমায়ূনকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করবার একটা করুণ চেষ্টা বিএনপিপন্থীদের মধ্যেও লক্ষ্য করা গেছে। হুমায়ূন বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকার সময় উপকৃত হয়েছেন সন্দেহ নাই। তিনি ‘আগুনের পরশমনি’ ছবিটি বানাতে গিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার প্রত্যক্ষ আনুকুল্য পেয়েছিলেন। কিন্তু ২০১০ সালে ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করবার যে অভিযোগ মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া তুলেছিলেন হুমায়ূন তাকে আক্ষরিক অর্থে ধরে নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন। আর, মৃত্যুর আগে ‘দেয়াল’ উপন্যাস লিখে তিনি দলবাজির যে-কাতারে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন সেটা বিএনপির বিরুদ্ধে। আমাদের আলোচনার জন্য এইসব প্রাসঙ্গিক নয় বলে এখন সেদিকে সময়ক্ষেপ কবার দরকার নাই।

বরং প্রশ্ন হচ্ছে, যারা বাংলাদেশে  নিজেদের রাজনীতি সচেতন, প্রগতিশীল বা কমিউনিস্ট মনে করেন তারা হুমায়ূনকে কিভাবে দেখে এসেছেন? হুমায়ূন আহমেদের বিরুদ্ধে এদের অনেক অভিযোগের একটা হচ্ছে তিনি ‘হাল্কা’ লেখেন। এই অভিযোগটা কম করে হলেও ত্রিশ বছরের পুরানো। হুমায়ূন সাহিত্যিক হয়ে উঠবার কালে পুরা আশির দশক জুড়েই এই অভিযোগ চলেছিল। এই অভিযোগকে অন্তত এখনকার মত  পরাজিত বলা যায়। এদের অভিযোগ পাশে ফেলে মাড়িয়ে উপর দিয়ে হেঁটে নিজের সাহিত্যিক-উপন্যাসিক পরিচয়টা তিনি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন সেকালেই। আমরা মানি না মানি তখন থেকেই তিনি সাহিত্যিক-উপন্যাসিক;এটা ফ্যাক্টস। নব্বই দশকের শুরুতে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় এক মেন ষ্টোরি ছিল - শাহরিয়ার কবিরের নেয়া হুমায়ূন আহমেদের এক সুদীর্ঘ সাক্ষাতকার। পরে সেটা আলাদা বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে, বাজারে পাওয়াও যায় বলে জানি। বিচিত্রার  মুল কপি আমি এখন হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু ঐ বইয়ের ভুমিকার প্রথম বাক্যে শাহরিয়ার কবির লিখছেন, “হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হিসাবে সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রচ্ছদে এসেছিলেন সাত মাস আগে”। আর শাহরিয়ার এই ভুমিকা লিখে নীচে তারিখ লিখেছেন ১০ ফেব্রুয়ারী ১৯৯২। তার মানে বিচিত্রায় হুমায়ন ঐ প্রচ্ছদ সাক্ষাতকার হয়েছিলেন ১৯৯১ সালের আগষ্টের কোন এক সংখ্যায়। ঐ ভুমিকায় শাহরিয়ারের আরেকটি মন্তব্য-বাক্য হলো, ‘নিজেকে তিনি অঙ্গিকারবদ্ধ লেখক না বললেও মানুষের প্রতি গভীর মমতা তাঁর যেকোন লেখায় গভীরভাবে প্রকাশিত”। শাহরিয়ারের এই কথন থেকে বুঝা যায় যেসব কমিউনিস্ট আকাঙ্খা থেকে অভিযোগ সে আমলে উঠেছিল তা ততদিনে তিনি পরাস্ত করতে পেরেছিলেন। তাই শাহরিয়ার তাকে “সবচেয়ে জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক” মানছেন আর কমিউনিস্ট প্রশ্ন বা বিচারবোধ থেকে তোলা ‘অঙ্গিকারবদ্ধতা” সংক্রান্ত প্রশ্নে একটা ফয়সালা নিজেই করে নিচ্ছেন। বলছেন, হুমায়ূনের লেখায় “মানুষের প্রতি গভীর মমতা” প্রকাশিত। ফলে আমরা বলতে পারি সেকালেই এসব অভিযোগকে হুমায়ূন ঠেলে ফেলে নিজের সাহিত্যিক পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। যদিও তাঁর মৃত্যুর পর অভিযোগটা আবার কোথাও কোথাও উঁকি মারতে দেখা যাচ্ছে।

সত্তর-আশির দশকে সৈয়দ হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী (অথবা ওপার বাংলার মহাশ্বেতা দেবী) এদের মত উপন্যাসিকদের প্রবল প্রভাব প্রতিপত্তির মধ্যে বাংলাদেশের সাহিত্যের দিন কাটছিল। চিন্তার দিক থেকে এরা সকলেই ছিলেন কমিউনিস্ট ওরিয়েন্টেশনের লেখক। অন্যভাবে বললে, সাহিত্য-উপন্যাস কেমন হবে,কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে একটা পূর্ব নির্ধারিত কাঠামো কাজ করেছে তাদের প্রায় সকল লেখায়।  লেখার অভিমুখ ও গতিমুখ কমিউনিস্ট চিন্তার হেজমনিতে নির্ধারিত ছিল। সাহিত্যিক-উপন্যাসিকদের ঠিক কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য হতে হবে তা না, তবে কমিউনিষ্টদের সাথে ওঠাবসা, বন্ধুত্ব হওয়া  বা সোজাকথায় কমিউনিস্ট চিন্তার প্রভাব পরিমণ্ডলে থেকে চিন্তা করতে শেখা এবং সেই সাথে নিজের সাহিত্যিক গুণ-মন-ক্ষমতাটা কমিউনিষ্ট করে নিতে না পারলে সেকালে সাহিত্যিক-উপন্যাসিক হওয়া, স্বীকৃতি  জুটানো এককথায় অসম্ভব ছিল – ঐ যুগে। এটা শুধু সাহিত্যিক-উপন্যাসিক না, শিল্পের যে কোন ক্রিয়েটিভ জগতের কাজের বেলায় একথা সত্য ছিল। কমিউনিস্ট ওরিয়েন্টেশনের বাইরে থেকে যারাই শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা করতে গিয়েছিল তারা কতল হয়ে গেছিল, কেউ নিস্তার পায়নি। এদের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে, অভিযোগ তুলে কমিউনিস্টরা তাদের উত্থান রহিত করে দেবার ক্ষমতা রাখত। কমিউনিস্টদের দিক থেকে সবচেয়ে কমন যে অভিযোগগুলো তোলা হত তা ছিল – হাল্কা লেখা, গভীরতা নাই, জীবন ঘনিষ্ঠ নয়, মধ্যবিত্তের লেখক, সোশাল কমিটমেন্ট বা অঙ্গিকার নাই, মানুষকে সংগ্রাম করতে শেখায় না, কোন আদর্শ নাই, চরিত্রগুলো বাস্তব না ইত্যাদি। তো এরকমের এক পরিস্থিতির মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের আবির্ভাব ঘটেছিল।

এই যে ছকবাঁধা কিছু পূর্বানুমান মাথায় নিয়ে সাহিত্য বিচারের মানদণ্ড তাকে আমরা আদৌ ‘কমিউনিস্ট’ বলব কিনা তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। মার্কস, এমনকি লেনিনেরও সাহিত্য বিচারের পদ্ধতির সঙ্গে এই ধরনের ছককাটা ধারণার বিবাদ আছে। তবে ‘প্রগতিশীল’ সাহিত্য বিচারের মানদণ্ড হিশাবে বাংলাদেশে কমবেশী যা বদ্ধমূল হয়ে হাজির ছিল তার মধ্যেই হুমায়ূনকে নিজের জায়গা করে নিতে হয়েছে।


ছকবাঁধা কিছু পূর্বানুমান মাথায় নিয়ে সাহিত্য বিচারের মানদণ্ড তাকে আমরা আদৌ ‘কমিউনিস্ট’ বলব কিনা তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। মার্কস, এমনকি লেনিনেরও সাহিত্য বিচারের পদ্ধতির সঙ্গে এই ধরনের ছককাটা ধারণার বিবাদ আছে। তবে ‘প্রগতিশীল’ সাহিত্য বিচারের মানদণ্ড হিশাবে বাংলাদেশে কমবেশী যা বদ্ধমূল হয়ে হাজির ছিল তার মধ্যেই হুমায়ূনকে নিজের জায়গা করে নিতে হয়েছে।


অর্থাৎ হমায়ূন এই ছকবাঁধা সাহিত্যের ধারণাকে পরাজিত করতে পেরেছিলেন। হুমায়ূনের আগে হুমায়ূনের  মত যাদের চিন্তার কমিউনিস্ট ওরিয়েন্টেশন ঘটে নাই, ছিল না, যারা বশ্যতা মানে নাই – তাদের সবাইকে সাহিত্যে গৌণ জ্ঞান করা --সদর্পে তাদের সব সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেওয়া অসম্ভব ছিল না; কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হয় নি। ‘নন্দিত নরকে’ হুমায়ূনের প্রথম উপন্যাস হলেও প্রকাশের শুরুতে এটা তেমন খ্যাতি লাভ করে নি। পাঠকদের চোখ পড়ে নি। সাহিত্য আলোচনায় আসেনি। অনেকটা এরকম যে অনেকেই একটা উপন্যাস লিখেছেন, এটাও তেমন।  পরে সেইসব হারিয়ে গেছে বা চাপা পড়ে গেছে, এরও এই দশা ঘটবে – ‘নন্দিত নরক’ উপন্যাস এর বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায় নি।  কিন্তু পর পর কয়েক বছর বইমেলায় হুমায়নের নতুন উপন্যাস আসা বুঝিয়ে দিল, হুমায়ূন লিখতে এসেছেন। বই প্রকাশও আগের চেয়েও আরও চালু ও লাভজনক ব্যবসা হয়ে উঠতে শুরু করে হুমায়ূনের হাত ধরেই।

ভাল বিক্রি হওয়া বা সাধারণ পাঠকদের মন জয় করাকেই  সাহিত্যের প্রধান গুণ আকারে স্বীকার না করার পেছনে নানান সাহিত্যিক ও নান্দনিক যুক্তি থাকতেই পারে। এমন কি সেটা আদৌ কোন সাহিত্যিক গুণ কিনা তা নিয়েও বিস্তর কথা খরচ হতে পারে। কিন্তু ভাল সাহিত্য মানে বাজার না পাওয়া অর্থাৎ পাঠক না পাওয়া, তার কোন যুক্তি নাই। থাকতেও পারে না। বাজার ব্যবস্থায় বইয়ের বিপণন কিভাবে সাহিত্য ও সাহিত্যিককে বদলায়, কিভাবে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা সাহিত্যের আঙ্গিক ও মর্মবস্তুর মধ্যে মৌলিক রূপান্তর ঘটায় ও নিরন্তর ঘটাতে থাক্‌ সেই সবের বিচার ও বিশ্লেষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু জনপ্রিয় সাহিত্য  সাহিত্যের মানদণ্ডের বিচারে সর্বদাই নিম্ন মানের হবে এই বদ্ধমূল ধারণার কোন ভিত্তি নাই। জনপ্রিয় লেখা বাজারের মন জুগিয়ে তৈয়ার হয়, ঠিক, কিন্তু বাজার কোন বিমূর্ত ব্যপার নয়। জনপ্রিয় হওয়া মানে একই সঙ্গে ভোক্তা বা পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া। পাঠকের কোন না কোন চাহিদা মেটানো, পাঠকের কাছে পৌঁছানো। সে চাহিদা সাহিত্যের নাকি অন্য কিছুর তার বিচারের দরকার আছে। কিন্তু সেটা সাহিত্যের চাহিদা মেটায় না সেটা ঢালাও ভাবে দাবি করা কঠিন।

পাঠক তৈরীর ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে বাজার। কিন্তু সাহিত্য নিজেও নিজের শক্তি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে পাঠক তৈরীর প্রক্রিয়া জারি রাখে। বাজার ব্যবস্থার মধ্যে সাহিত্য তার নিজের গুণে কিভাবে পাঠক তৈরী করে এবং ওর মধ্য দিয়ে সাহিত্য কিভাবে নিজের জগৎ তৈরী করতে সফল বা ব্যর্থ হয় সেই সব দিকে নজর রাখা জরুরী।  হুমায়ূন সেই দিকে আমাদের নজর ফেরাতে বাধ্য করে। হুমায়ূনের বই ভাল বিক্রি হওয়ার অর্থ পাঠকদের সঙ্গে হুমায়ূন একটা সম্পর্ক তৈরী করেছে তারই জানান  দেওয়া। সাহিত্য সম্পর্কে ছক বাঁধা সমালোচনা এড়িয়ে সরাসরি পাঠকের সাথে হুমায়ূনের সম্পর্ক ঘটে গিয়েছিল। যখন পত্রিকার সাহিত্যের পাতায় এই সম্পর্ক আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে যায় তখন হুমায়নের বিরুদ্ধে ছক বাঁধা সমালোচনাগুলোও সরব হতে থাকে।এক পর্যায়ে হুমায়ন আর সাহিত্য পাতার সাংবাদিকের সাথে কোন কথা বলা বা সাক্ষাতকার দিতেন না। একেবারে দায়ে পড়ে গেলে তিনি অভিযোগ পাশ কাটানোর জন্য অভিযোগ মেনে নিতেন। যেমন বলতেন, হ্যাঁ, আমি মধ্যবিত্তের লেখক, এই জীবনটাই আমার দেখা জানা আছে, তো আর কি করব সেটাই লিখি – এমন। এইসব প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে মনযোগ দিয়ে নিজেকে লেখায় তুলে ধরা আর পাঠকের সাথে, বিশেষত অল্প পড়া সাহিত্যে নবীন তরুণ পাঠকদের সঙ্গে, সরাসরি সম্পর্ক গড়ে তোলা ছিল তাঁর কৌশল বা লড়াইয়ের পথ। হুমায়ূনের উপন্যাসের খ্যাতি,কিম্বা সাহিত্য সম্পর্কে ছক বাঁধা ওরিয়েন্টেশন বাইরে থেকেও গ্রহণযোগ্যতা পাবার ফলে হুমায়ূনের সামাজিক স্বীকৃতি অনেকের জন্যই বিড়ম্বনার কারন হয়ে উঠল। বিশেষত যারা নিজেদের উন্নাসিক নন্দনতত্ত্বের উঁচুতলা থেকে কিম্বা প্রগতিশীল বা কমিউনিস্ট নীতিনৈতিকতা রক্ষার দায়ে হুমায়ূনকে গ্রহন করতে পারছিলেন না । এই দিক থেকে শাহরিয়ার কবিরের সাক্ষাতকারকে এদের পক্ষ থেকে সর্বশেষ কামড় বলতে পারি আমরা। জনপ্রিয় সাহিত্যবিরোধী উঁচু মানের সাহিত্যওয়ালা কিম্বা কমিউনিস্ট নীতিবাদীদের তরফে  শাহরিয়ার কবির ছিলেন অভিযোগকর্তা বা প্রশ্নকর্তা। ঐ সাক্ষাতকারটা বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাসের জন্য এই দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদের আবির্ভাব এক ঐতিহাসিক টার্নিং পয়েন্ট যিনি নিজে চিন্তায় কমিউনিস্ট বা বামপন্থী নন, ওরিয়েন্টেশন তার নাই। সামাজিক স্বীকৃতির জন্য কারও কাছে তাকে আনুগত্য স্বীকার করতে হয় নি। ছক বাঁধা সাহিত্য বিচারের বৃত্ত স্রেফ জনপ্রিয়তা দিয়ে ভেঙ্গে নিজের জন্য সাহিত্যিক হিশাবে সামাজিক স্বীকৃতি আদায় করে টিকে গিয়েছিলেন।

মহৎ সাহিত্যের স্বাদ নেবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাঠক সমাজ উপযুক্ত কিনা সেই কূটতর্ক করা যেতে পারে। তবে বলে রাখা দরকার প্রগতিশীল সাহিত্য সংক্রান্ত ছকবাঁধা বৃত্ত যে হুমায়ূনই প্রথম ভেঙ্গেছিলেন তা নয়, বরং আরও গভীর অর্থে ভাঙচুর করেছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। কিন্তু ইলিয়াস চিন্তা চেতনায় তো বটেই, তার সাহিত্য জীবনের শুরু থেকেই বামপন্থীদের কুক্ষিগত হয়ে রয়েছেন, এখনও একটা সামাজিক-রাজনৈতিক বৃত্তের মধ্যে তাকে আটকে রাখার চেষ্টা রয়েছে। তাছাড়া ইলিয়াসের সাহিত্য কর্মের স্বাদ নেবার জন্য পাঠকের একটি সাহিত্যিক প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। ফলে বাংলাদেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার কারনে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ও অর্জন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ তরুন পাঠকদের মন ইলিয়াসের পক্ষে জয় করা সম্ভব ছিল না।   তুলনায় হুমায়ূন সম্পর্কে এককথায় বললে বলা যায় হুমায়ূন  রাজনৈতিক নন বা রাজনীতি বুঝনেওয়ালা লোকও হতে যান নি,নিজের কাজের রাজনৈতিক-দার্শনিক তাৎপর্য বোঝাকে তিনি তার দায় বা কর্তব্য হিসাবে নেননি। কেবল উপন্যাসিক বা শিল্পকলার লোক হিসাবেই থাকতে চেয়েছিলেন এবং শেষ অবধি তাই ছিলেন।


হুমায়ূনের উপন্যাসের খ্যাতি,কিম্বা সাহিত্য সম্পর্কে ছক বাঁধা ওরিয়েন্টেশন বাইরে থেকেও গ্রহণযোগ্যতা পাবার ফলে হুমায়ূনের সামাজিক স্বীকৃতি অনেকের জন্যই বিড়ম্বনার কারন হয়ে উঠল। বিশেষত যারা নিজেদের উন্নাসিক নন্দনতত্ত্বের উঁচুতলা থেকে কিম্বা প্রগতিশীল বা কমিউনিস্ট নীতিনৈতিকতা রক্ষার দায়ে হুমায়ূনকে গ্রহন করতে পারছিলেন না । এই দিক থেকে শাহরিয়ার কবিরের সাক্ষাতকারকে এদের পক্ষ থেকে সর্বশেষ কামড় বলতে পারি আমরা। জনপ্রিয় সাহিত্যবিরোধী উঁচু মানের সাহিত্যওয়ালা কিম্বা কমিউনিস্ট নীতিবাদীদের তরফে  শাহরিয়ার কবির ছিলেন অভিযোগকর্তা বা প্রশ্নকর্তা।


দার্শনিক-রাজনৈতিক বিষয়াবিষয়ের প্রতি হুমায়ূনের  মনোভাব বোঝার জন্য সম্প্রতি প্রকাশিত তার এক পুরানা এক সাক্ষাতকার বা কথোপকথনের আশ্রয় নেব।  প্রকাশিত এই লেখা থেকে আমরা জেনেছি গত বছর ২২ মে ২০১১ এটা নেয়া হয়েছে, http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-07-27/news/277119 । সেখান থেকে কিছু অংশ তুলে আনছি,

প্রশ্ন: লাতিন আমেরিকার মতো ভাবা যায়? লাতিন আমেরিকার লেখকেরা একটা চরিত্র খাড়া করে প্রতীকী উপস্থাপনের দিকে চলে যান। মানে, সরাসরি কথাটা না বলে, রূপকের মধ্য দিয়ে বলা। যেমন, মার্কেস লিখেছেন অটাম অব দ্য প্যাট্রিয়ার্ক। মানে, ওই সময়টাকে ঠিকই ধরেছেন উনি। কিন্তু চরিত্রগুলো তাঁর মতো করে বদলে নিচ্ছেন। আপনার হাত দিয়ে এ ধরনের একটা কাজ কি হতে পারত না?

হুমায়ূন: হ্যাঁ, নানাভাবেই ভাবা যায়। কিন্তু এতে যথার্থতার একটা সমস্যা থেকে যায়। যিনি যখনই কিছু বলছেন বা লিখছেন, তাঁর রাজনৈতিক পছন্দের বাইরে সাধারণত যেতে পারেন না। মার্কেসও পারেননি।

হুমায়ুনের মুখ্য বক্তব্য আমি বোল্ড করেছি। সার কথা হলো, হুমায়ূন কোন একটা দার্শনিক-রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে সেই রাজনৈতিক পছন্দের পক্ষে কলম নিয়ে বসতে চান না। এটাকে তিনি লেখকের জন্য সমস্যা মনে করেন। অনেকের মনে হতে পারে এটা তার এন্টি-পলিটিক্যাল বা এপলিটিক্যাল অবস্থান। আমার মনে হয় আমরা এটা ভিন্ন দিক থেকে দেখতে পারি। সেকাজে পরের প্রশ্নোত্তরে যাই। 

প্রশ্ন: আপনার রাজনীতির ব্যাপারে অনাগ্রহ, রাজনৈতিক লেখালেখিতে খুব সরব না, এর কি কোনো বিশেষ কারণ আছে?
হুমায়ূন: আসলে, আমার দেখা প্রথম মানুষ তো আমার বাবা। উনি ইত্তেফাক-এর নাম দিছিলেন মিথ্যা-ফাঁক।
প্রশ্ন: আপনার ওপর বাবার যতটা প্রভাব, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর কিন্তু প্রভাব ততটা না।
হুমায়ূন: সে তো বাবাকে কম দিন দেখেছে, এটা একটা কারণ হতে পারে। তবে আমার কাছে মানবিক সম্পর্ক রাজনীতির চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হয়।

এই কথোপকথনে প্রশ্নকর্তা এবং সেই সুত্রে হুমায়ন নিজে রাজনীতি বলতে দলীয় রাজনীতি বুঝেছেন।  সাহিত্যের পিছনে বা আড়ালে, সাহিত্যিকের সচেতনে অথবা অসচেতনে জীবন-জগতের যে রাজনৈতিক অর্থ, অবস্থান বুঝাবুঝি থাকে -  বা জীবন মাত্রই যে কারণে রাজনৈতিক এই কথোপকথনে তার কোন উপলব্ধি নাই। ইত্তেফাক বিষয়ক আলাপটা পুরাপুরি অরাজনৈতিক এবং বিপজ্জনক।  তবে  নজর দিতে বলব আমার করা বোল্ড অংশটাতে। এখানে হুমায়ূনের কাছে রাজনীতির এন্টিথিসিস হলো মানবিক সম্পর্ক। তিনি কোন দার্শনিক-রাজনৈতিক তত্ত্ব থেকে যাত্রা শুরু করে সাহিত্যে তা ট্রান্সলেট করতেও চান না, বাস্তবে তা পরখ করতেও চাইছেন না।  বরং লেখক হিশাবে মানুষ ও মানুষের নানান সম্পর্ক দেখবার প্রখর ক্ষমতা ব্যবহার তার লেখার বিষয় বানাতে চান। তিনি যেভাবে দেখছেন সেখান থেকে  কোন রাজনীতি তৈরী হবে কিনা,  ওর মধ্য দিয়ে কোন তত্ত্ব দাঁড়াবে কিনা সেই সব বিষয়ে তাঁর কোন মাথাব্যাথা নাই। তিনি তার মতো করে দেখছেন, দেখে যেতে চাইছেন। কী দেখলেন বা কিভাবে দেখলেন সেটা পাঠকের ওপর ছেড়ে দেবার তিনি পক্ষপাতী। তার এই রাজনৈতিক নির্লিপ্ততাকে রাজনীতি বিরোধী বলা যাবে কিনা সেটা তর্ক সাপেক্ষ, তবে  মানবিক সম্পর্ক যেহেতু তার অনুসন্ধানের বিষয় বিষয়, তাই মানুষের মন তার লেখার বিষয় হয়ে উঠেছে।  

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ও অর্জনের বিচারে হুমায়ূন কোথায় স্থান পাবেন সেটা বিচার করবার আলোচনা এটা নয়। এই বিষয়ে এতো তাড়াতাড়ি কিছু বলা সমীচিন নয়। হুমায়ূন আমাদের সহজ সরল ভাবে গল্প বলতে চেয়েছেন, যাতে গল্পগুলো আমাদের মনে দাগ কাটে। যেন আমাদের ভাল লাগে এবং  হুমায়ূনের মুখে আরও গল্প শুনতে আমরা আগ্রহী হয়ে উঠি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ও অর্জনের দিক থেকে তার গল্প বলার বিষয় ও ধরণ নতুন কোন সাহিত্যিক ঘটনা ঘটাতে সক্ষম হয়েছে কিনা সেটা বিচারের সময় এখনও আসে নি। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক ঘটনা, যাকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলে আমাদের নিজেদেরকেই হয়তো আমরা নতুন ভাবে চিনতে পারব। অতএব তাকে আরও ঘনিষ্ট ভাবে ও মনোযোগের সঙ্গে বোঝা ও ব্যাখ্যার দরকার আছে। তাঁর জনপ্রিয়তার কথা বলতে গিয়ে নাক উঁচু করে রাখা সাহিত্যক উন্নাসিকতার চর্চা ভুল হবে। হুমায়ুন সমাজের স্বতঃস্ফুর্ত চিন্তা হয়েই থাকতে চেয়েছেন। বলছেন, “লেখাটা কীভাবে তৈরি হয় আমি সেটার ব্যাখা করতে পারবো না। তৈরি হবার পদ্ধতিটি আমি নিজেও পরিষ্কারভাবে জানি না” [ভোরের কাগজ সাজ্জাদ শরীফ ও ব্রাত্য রাইসুর সাথে কথোপকথন, মার্চ ১৯৯৪]।  সেই প্রক্রিয়াটা হুমায়নকে বুঝতে গয়ে আমরা ঠিকমত বুঝতে পারছি কিনা সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

হুমায়ূন তাঁর লেখার সাবজেক্ট-ম্যাটার বা ফোকাস হিসাবে হাজির করেছেন মানুষের মন। ফলে গল্প বলার ধরণটাও আলাদা এবং নতুন। ছক বাঁধা কমিউনিস্ট চিন্তা কাঠামো যেখানে “শ্রেণী সংগ্রাম”কে লেখার সাবজেক্ট ম্যাটার করতে নির্দেশ করে সেখানে হুমায়ুন হাজির হচ্ছেন মানুষের মন নিয়ে। রাজনীতির বিপরীতে নিজস্ব অস্বস্তির তাড়ায় হুমায়ূন ‘মানবিক সম্পর্ক” তালাশ করে ফিরেছেন, তার গল্প লিখছেন। “শ্রেণী সংগ্রাম” এর সাহিত্য করতে গিয়ে এক আদর্শবাদী নায়ক কে কেন্দ্র করে গল্পের বাদ বাকি চরিত্র সাজাতেই হয়; আর ভিলেন সহ সেসব চরিত্রের ততটুকুই ভুমিকা থাকে ঠিক যতটুকু বা যেভাবে হলে আদর্শ নায়ক চরিত্র ফুটিয়ে তুলে ধরতে দরকার। আর এতে গল্প বলার একটা একঘেয়ে প্যাটার্ন তৈরি হয়ে যায়। এভাবে গল্প লেখার আরও নানান সমস্যা আছে; যেমন, বাস্তব রক্ত-মাংসের মানুষ তো বাস্তবই, আদর্শের বিপরীতে সে দোষেগুণে মানুষ। “শ্রেণী সংগ্রাম” এর সাহিত্য এমন হয় যে সে নায়ক না, একেবারে বিপ্লবী নায়ক হয়ে ওঠে। উপরে আবার ন্যাংটা করে শ্রেণীদ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক সংগ্রাম ইত্যাদি দেখাতে হয়।


হুমায়ূন তাঁর লেখার সাবজেক্ট-ম্যাটার বা ফোকাস হিসাবে হাজির করেছেন মানুষের মন। ফলে গল্প বলার ধরণটাও আলাদা এবং নতুন। ছক বাঁধা কমিউনিস্ট চিন্তা কাঠামো যেখানে “শ্রেণী সংগ্রাম”কে লেখার সাবজেক্ট ম্যাটার করতে নির্দেশ করে সেখানে হুমায়ুন হাজির হচ্ছেন মানুষের মন নিয়ে। রাজনীতির বিপরীতে নিজস্ব অস্বস্তির তাড়ায় হুমায়ূন ‘মানবিক সম্পর্ক” তালাশ করে ফিরেছেন, তার গল্প লিখছেন।


কিন্তু বাস্তব জীবন দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় আর  শ্রেণী সংগ্রাম  নানান পর্দার আড়ালের নিচে থাকে, ঘটে চলে। বাইরে থেকে দেখলে যাকে জীবনের দৈনন্দিন আটপৌরে ঘটনা মনে হয়। তবে যে দেখতে জানে সে সাত পরতের পর্দার আড়ালের শ্রেণী সংগ্রামের দিকটাও বুঝতে পারে। বাস্তব জীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত বেশির ভাগ সময়েই ধনী-গরীবের শ্রেণী সংগ্রামের মত সরল সোজাসাপ্টা নয় বরং জটিল। এমনকি তা দুটো ন্যায়বোধের লড়াই হতে পারে, দুটো ভ্যলু বা মুল্যবোধের লড়াই হতে পারে যেটাকে ছকে বাঁধা শ্রেণী সংগ্রাম হিসাবে দেখানোর কোন মানে হয় না। আবার গরীব মানুষ মানেই সৎ নয়, বা তাকেই নায়ক বানাতে হবে এমন কোন মানে নাই। মানুষের লোভ, হিংসা, শঠতা উদারতা এইসব দোষ বা গুণ আছে। এমনকি আবার মানবিক মানুষ হবার আকুতি, প্রেমের আকুতি সবই থাকে। এবং শ্রেণী নির্বিশেষেই তা থাকে।  মানুষের জীবন যত জটিল একে সরল ধনী-গরীবের শ্রেণী সংগ্রামের মত করে রিডিউস করে হাজির করা যায় না। করা হলে বরং এক মেকি ক্যাম্পেইন ম্যাসেজ তৈরি করে। অন্যদিকে, মানুষের মন যদি সাহিত্যের বিষয় হয়  তবে  সেই সাহিত্যে মানুষের, সব শ্রেণীর মানুষেরই -- দোষগুণ ভালমন্দ ইত্যাদি সব কিছুরই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া তাতে ধরা পড়বার কথা। সবই সেখানে ধরা পড়ে। সবচেয়ে বড় কথা প্রতিটা চরিত্রের মন নিজেই এক গুরুত্বপুর্ণ চরিত্রের মধ্যস্থতায় হাজির হতে পারে। প্রতিটা ধরণের মানুষকে নিয়েই বাস্তবে  নাড়াচাড়া করা যায়। এতে গল্প বলার ধরণ বদলে যায়। যেভাবেই গল্প বলা হোক তা পরিচিত বাস্তব জীবন মনে হয়। আবার ব্যাকগ্রাউন্ডে বাস্তব জীবনের দ্বন্দ্ব সংঘাতও ছায়া হয়ে লুকিয়ে থাকে। মানবিক সম্পর্কের তালাশে থাকার কারণ মানবিক সমাজের একটা আকুতি লক্ষ্য হিসাবে না চাইতেও থেকে যায়। পাঠক দর্শকের সাথে সহজেই একটা কমিউনিকেশন তৈরি করে ফেলে। আমার বিচারে হুমায়ুনের মানবিক সম্পর্কের তালাশ বা মানুষের মনের খবরের কারবারি হওয়া এই দিকটাই সম্ভবত তার জনপ্রিয় হবার কারণ। ইতিহাস মাত্রই যদি শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস হয়ে থাকে তবে মধ্যবিত্তের সুখ দুঃখের ভালমন্দের মনের কাহিনী যেভাবেই লেখা হোক না কেন তার ভিতরেও শ্রেণী সংগ্রাম লুকিয়ে থাকারই কথা। হুমায়ুন আহমেদ চাইলেও তো তা বাদ দিয়ে কিছু লেখা সম্ভব না। তবে এটা অভিযোগ হতে পারে যে সেটা খোলে আম সরল ধনী-গরীবের শ্রেণী সংগ্রামের মত না। সেক্ষেত্রে একথার জবাব দিতে হবে, রক্ত-মাংসের বাস্তব জীবনের সবকিছুকে সরল ধনী-গরীবের শ্রেণী সংগ্রাম হিসাবে রিডিউস করা সম্ভব কি না? আবার সম্ভব হলেও তা করা জরুরি কি না? সেই পুরানা তর্কে আমাদের ফিরে যেতে হবে যে শ্রেণি সংগ্রাম ধারণ করা সাহিত্য বুঝতে কি আমরা রাজনৈতিক দলের প্রচারপত্র বুঝব?  যদি আমরা তা না চাই সেক্ষেত্রে  ‘আমার কাছে মানবিক সম্পর্ক রাজনীতির চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হয় ‘ হুমায়ূনের এই বক্তব্য আমাদের জন্য টার্নিং পয়েন্ট। এটা আমাদের মানতে হবে।

সবমিলিয়ে বলা যায় সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে একটা ছক বাঁধা প্রত্যাশা আমাদের উপর চেপে বসে আছে। এটা আমাদের সাহিত্যের এক বিশেষ বিচার ধারা তৈরি করেছে। যার কারনে শুধু হুমায়ূনই নয়, বরং বাংলা সাহিত্যের আরেক সাম্প্রতিক দিকপাল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে বুঝতেও বাধা তৈরি হয়ে আছে। আমার দাবি হুমায়ূন এই ছক বাঁধা চিন্তা থেকে আমাদের মুক্ত করতে কাজে আসবে। এই সমাজেই হুমায়ুনের সাহিত্যিক আবির্ভাব। এই সোশাল ফেনোমেনা কে যদি আমরা বুঝতে চাই তবে আমাদের সাহিত্য আকাঙ্খা ও সাহিত্যের  বিচারবোধ কী সমস্যা তৈরি করে তা আমরা খানিক বুঝতে পারব।

 হুমায়ুন আহমেদ এর জীবনের শেষ ১৫-২০ বছরের দিকে কিছু আলোকপাত করে শেষ করব। হুমায়ূন কি তার শেষ জীবনে মানবিক সম্পর্ক রাজনীতির চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয়  করে রাখতে পেরেছিলেন? এর সোজা জবাব, না, পারেননি একেবারেই না। নিজের কথায় তিনি অটল থাকতে পারেননি। এমনকি ২০১১ সালেও যখন তিনি একথা বলছেন তখনও না। কথাটাকে বোধহয় এভাবে বলা যায়, আমাদের কেউ কেউ তাঁর জীবনের শেষ ১৫-২০ বছরে তাকে সেভাবে থাকতে দেইনি। লোভ দেখিয়েছি। তিনি লোভে পড়েছেন। যারা এককালে হুমায়ূনের  খ্যাতি,সাহিত্য সম্পর্কে ছক বাঁধা চিন্তার বাইরে বসবাসের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন, শাসনের আঙ্গুল দেখিয়েছেন তাদেরই এক অংশ তাঁর জীবনের শেষ ১৫-২০ বছরে তাঁকে “বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের” নির্মাতা হিসাবে পেতে পরিবেশ আবহের চাপে ও লোভে তাকে প্রলুব্ধ করেছে। মানেটা দাঁড়িয়েছে এক সময় হুমায়ূন রাজনৈতিক নন এই ছিল মুল অভিযোগ। আবার সেই হুমায়ূনকেই  এযুগের “বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের” রাজনীতিতে তাঁকে খতনা দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা হতে দেখছি। এই ক্ষেত্রে প্রথম আলো আর চ্যানেল আইয়ের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এবার কিন্তু হুমায়ূন  উল্টা মানবিক সম্পর্কের চেয়ে এই রাজনীতি বেশি উপভোগ করছেন।  ততই আশির দশকের হুমায়ূন আহমেদ আর তিনি নন। নিজেই নিজেকে ত্যাগ করেছেন। কিন্তু তাতে সব রক্ষা হয় নাই। উপন্যাসিক হুমায়ূন এই রাজনীতির ধামাধরা হতে গিয়ে দলবাজির সর্বস্বতার পড়ে তার এই সময়ের লেখালিখিতে নিজের সব শিল্পগুণ ও বিশেষত্ব খুইয়েছেন। শেষ উপন্যাস “দেয়াল’ লিখতে গিয়ে বুঝেছেন কি না জানি না, কিন্তু ঘটনা তাই ঘটেছে। তিনি বুঝতেই পারেননি যে “বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের” দলবাজরা তাদের বয়ানে তাকে উপন্যাস লেখানোর জন্য কোর্টকাচারি পর্যন্ত করবে। তারা কেবল তাকে হাতকড়া পড়ায়নি, জেলের ভাত খাওয়ায় নি। তার ‘দেয়াল’ উপন্যাস আজও প্রকাশিত হয়নি। আর তিনি মরবার আগে অসুস্থ অবস্থায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মনোযোগ সহকারে কোর্টের পেপারবুক পড়েছেন, আর এর তারিফ করেছেন। বলা যায়, এই শেষ ১৫-২০ বছর এক ডিজেনারেটেড হুমায়ূন আহমেদকে দেখে আমরা ভীত হয়েছিলাম। আর এর শেষ পরিণতি -- আদালতের হুকুমেই উপন্যাসিক হুমায়ূনের যা অবশিষ্ট ছিল তার মৃত্যু ঘটেছে, বলা যায়। এই শেষাবশেষের তিরোধানের মধ্য দিয়ে তাঁর সত্যিকারের অবদান নিয়ে ভাববার সুযোগ তৈরী করে গিয়েছেন তিনি। তাকে নিয়ে আবেগ, উচ্ছ্বাস ও দলবাজির আড়ম্বর কমলে সেই কাজ শুরু হবে, আশা করা যায়।  


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।