বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসে নাই


ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের হেড অফিস থেকে গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১২ দিন-শেষে (অর্থাৎ বাংলাদেশের ২১ সেপ্টেম্বর ভোর রাতে) পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে এক প্রেস বিবৃতি প্রকাশ করেছে।

অনেকেই জানেন গত কয়েকদিন ধরে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভি ওয়াশিংটনে আছেন, এব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কথা বলার জন্য তিনি সেখানে আছেন।এখনও ফেরেননি। বিশ্বব্যাংকের সাথে গত ২০ সেপ্টেম্বর তাঁর আলাপের পর বিশ্বব্যাংকের এই বিবৃতি তৈরি ও প্রকাশিত হওয়ার কয়েকঘন্টা আগেই অর্থমন্ত্রী মাল মুহিত ঐদিনই (তবে আমাদের তখন রাত্রি) দেশের রাতের স্থানীয় খবরে ‘বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসছে’, ‘বিবৃতি আসছে’ ইত্যাদি বলে খবরটা প্রথম চাউর করেন। এইসব আমরা দেখেছি। এতে পরেরদিন ২১ তারিখে প্রিন্ট মিডিয়ায়, টেলিভিশনের সারাদিনের খবর আর শেষ রাতের টক শোগুলোর প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো, ‘বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসছে’। এনটিভিতে দেখা গেল, আওয়ামি লীগের যুগ্ম-সম্পাদক হানিফ ও তোফায়েল আহমেদ ব্যাপারটাকে ‘ভুল বুঝাবুঝি’ হিশাবে দেখেছেন; বিশ্বব্যাংকের সাথে একটা ‘ভুল বুঝাবুঝি’ হয়েছিল সেটা কেটে গিয়েছে – এই ছিল তাদের ভাব।

কিন্তু কঠিন সত্য হলো, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসে নাই। তবে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে তার তদন্ত, ফলাফল, বিচার ও শাস্তির কি হচ্ছে তা দেখার পর বিশ্বব্যাংকের কাছে সন্তোষজনক মনে হলেই তারা ফিরে আসতে পারে। এটাই ছিল বিশ্বব্যাংকের ২০ সেপ্টেম্বর তারিখের বিবৃতির মুল কথা। অথচ আজ ২১ তারিখের বাংলাদেশের সব মিডিয়ার রিপোর্টিং (রাতের টকশোগুলো সহ) মারাত্মক গলদপুর্ণ, আধা সত্য কথাবার্তা বলছে যেমন, ‘বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসছে’ – এটা আধা সত্য কথা। পুরা সত্য হলো, বা আমরা বড়জোর বলতে পারি - বিশ্বব্যাংক কঠোর শর্ত সাপেক্ষে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসতেও পারে - এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে মাত্র। কিন্তু কী সেই শর্ত?


বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসে নাই, কিন্তু গণমাধ্যমগুলো আমাদের এই ধারণাই দিচ্ছে। তবে পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে তার তদন্ত, ফলাফল, বিচার ও শাস্তির কি হচ্ছে তা দেখার পর বিশ্বব্যংকের কাছে পুরা প্রক্রিয়া সন্তোষজনক মনে হলেই তারা ফিরে আসতে পারে। অথচ আজ ২১ তারিখের বাংলাদেশের সব মিডিয়ার রিপোর্টিং (রাতের টকশোগুলো সহ) মারাত্মক গলদপুর্ণ, আধা সত্য কথাবার্তা বলছে যেমন, ‘বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসছে’ – এটা আধা সত্য কথা।


গত সপ্তাহ ধরেই মিডিয়ায় খবর ছিল যে বিশ্বব্যাংকের দেয়া চার শর্তের সর্বশেষটা – অর্থাৎ উপদেষ্টা মশিউর রহমানের ছুটিতে যাওয়া না যাওয়া - এটাই নাকি এখনও পুরণ হয়নি তাই বাধা। বলা হয় এটা সর্বশেষ বা চতুর্থ শর্ত – অথচ কথাটাই মিথ্যা। তিনি গেলেই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসবে এই ধরণের একটি প্রবল ধারণা গণমাধ্যম তৈরী করেছিল। অথচ এটা আংশিক সত্য। তবে শর্তের সংখ্যা চার এই কথাটাই শুধু সঠিক। মিডিয়াগুলো আসল চার শর্তের কেবল প্রথম শর্ত নিয়েই কথা বলছে। কিন্তু প্রথম শর্তকেই তারা নিজেরা আবার চার অংশ বানিয়ে সেটাকেই চার শর্ত বলে বুঝেছে, আমাদেরও বুঝিয়েছে। তার মানে, মশিউর রহমানের ছুটি প্রসঙ্গ বিশ্বব্যাংকের চতুর্থ শর্ত নয় বরং প্রথম শর্তের চতুর্থ ভাগ। এছাড়া প্রথম শর্ত আবার একা মশিউর রহমানও সেখানে একমাত্র প্রসঙ্গ নয়। পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্মকর্তাদের মধ্যে যারা দুর্নীতির সাথে সম্পর্কিত বলে প্রাথমিকভাবে বিশ্বব্যাংকের কাছে মনে হচ্ছে তাদের সবাইকে ছুটিতে পাঠিয়ে দিয়ে এরপর দুর্নীতির তদন্ত পুরা করতে হবে। এটাই হলো বিশ্বব্যাংকের চার শর্তের প্রথম শর্ত। এই দুর্নীতিচক্রে যেসব সরকারি কর্মকর্তা (all public officials) জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে তাদেরকে তদন্ত পুর্ণ না হওয়া পর্যন্ত সরকারি চাকুরি থেকে ছুটিতে পাঠাতে হবে। এই প্রথম শর্ত পুরণের ক্ষেত্রে, একটা অপুরণীয় দিক ছিল মশিউর রহমানের ছুটিতে যাওয়া। এটা একটা বাধা। তবে এই ক্ষেত্রে মশিউর রহমান মিডিয়ায় স্বশরীরে হাজির হয়ে যা কিছুই দাবি করুন না কেন কার্যত তিনি আসলে ছুটিতে চলে গেছেন - গওহর রিজভি বিশ্বব্যাংককে তাই জানিয়েছেন। শুধু মশিউর রহমান না, দুর্নীতির অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে আছে তারা সকলেই যে ছুটিতে চলে গেছেন এটা বিশ্বব্যাংক বুঝতে পেরেছে বলে ঐ বিবৃতিতে জানিয়েছে।
এতে প্রথম শর্ত পুরাটাই পুরণ হয়েছে। কিন্তু এখনও তিনটা আসল শর্ত বাকি। বাকি তিন শর্ত পুরণ সাপেক্ষে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসতে পারে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে মাত্র। এটাই সর্বশেষ খবর। এটাই পুরা সত্য। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে এসেছে বিষয়টা এতো সরল নয়।

পদ্মা সেতু খবর হওয়ার পর থেকে এপর্যন্ত গত দশ মাসে নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য আমরা পাইনি। বিশ্বব্যাংকের দিক থেকে বললে, আমরা কোন তথ্যই পাইনি বললে চলে। তবে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছিল আমাদের সরকার চাইলে সব তথ্য, সব চিঠি চালাচালি জনগণের কাছে প্রকাশ করতে পারে। অন্যদিকে সরকারের দিক থেকে কোন চিঠি বা পত্র চালাচালির তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। আমরা যা পেয়েছি তা হলো বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে সরকারের রাজনৈতিক অভিযোগ, আর বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ তদন্ত করবার কোন উদ্যোগ না নিয়ে, কোন অনুসন্ধানে না গিয়ে শুধু কোন দুর্নীতি হয়নি বলে প্রচার। এর সারকথা হচ্ছে, পুরা বিষয়টিকে নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করবার জন্য দরকারী কোন তথ্য আমরা কোন পক্ষের কাছ থেকেই পাই নি। আমরা কেউ আলাদা করে নিজেরা নিরপেক্ষভাবে ঘটনার বিচার করতে পারি তার কোন সুযোগ ছিল না। এমনকি মিডিয়ায় যে চার শর্তের কথা এপর্যন্ত আলোচনা হয়েছে তা সরকার বা বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে আমরা জানিনি। বলা যায় এটা মিডিয়ার নিজের অনুমান বা 'নিজস্ব সুত্র'। বলা বাহুল্য এই অনুমান বা ‘নিজস্ব সুত্র’ যে সঠিক ছিল না, নিছকই আংশিক - তা বিশ্বব্যাংকের গতকালের বিবৃতি থেকে আমরা নিশ্চিত হতে পারছি।

এই দিক থেকে বিচারে, গতকাল বিশ্বব্যাংকের এক পাতার বিবৃতিই আমাদের কাছে প্রথম নির্ভরযোগ্য তথ্য এবং এটা বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ অবস্থানের একটা সার সংক্ষেপও বটে। কিন্তু ২১ তারিখে সারাদিনের সব প্রিন্ট ও টিভি মিডিয়া রিপোর্ট, এমনকি রাজনৈতিক নেতা, ‘উন্নয়ন’ পেশাজীবিদের বক্তব্য ইত্যাদি শুনে একথা মনে করার কারণ আছে যে বিশ্বব্যাংকের ওয়েব সাইটে প্রকাশ্য করে দেয়া সত্ত্বেও কেউই বিশ্বব্যাংকের মূল বিবৃতিটা মনোযোগ দিয়ে পড়েননি। কোন কারণে তাদের পড়া হয়নি হয়ত, আর হয়ত তারা শুধু মিডিয়া রিপোর্টই পড়েছেন। আগেই বলেছি এই বিবৃতিটা পদ্মা সেতু ঘটনা বিরোধের সার-সংক্ষেপ এবং প্রথম নির্ভরযোগ্য তথ্য। ফলে পদ্মা সেতু ইস্যু নিরপেক্ষেভাবে বুঝবার জন্য এই বিবৃতি খুবই গুরুত্বপুর্ণ একটা ডকুমেন্ট। এই বিবেচনায় বিশ্বব্যাংকের বিবৃতি যেন আমরা সরাসরি পড়ি তার জন্য লিংকটি এখানে দিচ্ছি। ( World Bank Statement of September 20, 2012 on Padma Bridge)

আসল চার শর্তঃ

বিশ্বব্যাংকের আসল চার শর্ত কি ছিল তা এই বিবৃতিতে পুরাটাই দেয়া আছে, এভাবেঃ (১)এই দুর্নীতিচক্রে যেসব সরকারি কর্মকর্তা (all public officials) জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে তাদেরকে তদন্ত পুর্ণ না হওয়া পর্যন্ত সরকারি চাকুরি থেকে ছুটিতে পাঠাতে হবে। (২) খতিয়ে তদন্ত করার কাজ ঠিকমত করার জন্য বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের অধীনে একটা বিশেষ অনুসন্ধান ও আইনী পদক্ষেপ নেবার টিম নিয়োগ দিতে হবে। (৩) তদন্ত অনুসন্ধানে এদের প্রাপ্ত সব তথ্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত এক বাইরের প্যানেলের কাছে পরিপুর্ণভাবে সবকিছু দেখার সুযোগ উন্মুক্ত করে দিতে সরকারকে রাজি হতে হবে যাতে তাঁরা তদন্ত অনুসন্ধানের অগ্রগতি, পর্যাপ্ততা ও ন্যায্যতা সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক ও সহযোগী বিনিয়োগকারিদের দিকনির্দেশনামূলক পরামর্শ (give guidance) দিতে পারে। (৪) প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজের এক নতুন আয়োজন-নিয়ম তৈরি করতে সরকারকে রাজি হতে হবে যেন বিশ্বব্যাংক ও সহযোগী বিনিয়োগকারিরা প্রজেক্টের ক্রয়সংক্রান্ত প্রক্রিয়া আরও বেশি নিজেদের নজরদারিতে আনতে পারে।

তবে বিশ্বব্যাংক এটাকে ‘শর্ত’ বলেনি। সেটা কূটনীতির ভাষা হোত না। বলেছে এগুলো হছে বিশ্বব্যাংকের হাতে চিহ্নিত এবং সরকারকে নিতে হবে এমন ‘ধারাবাহিক সুনিদির্ষ্ট পদক্ষেপ’ (“Bank had identified a series of clear measures to be implemented by the Government”)। এই “ধারাবাহিক সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ” কথাগুলোই পুরা বিতর্কের মুল বিষয়। কেমন মুল বিষয়?

বলা হয়েছে কি ধরণের পদক্ষেপ নিতে হবে বিশ্বব্যাংকের কাছে তা আইডেনটিফাইড বা চিহ্নিত। এর ফলে এটা কি কেবল বিশ্বব্যাংকের একান্ত নিজস্ব ধারণা? না, মোটেই না। দুটো কারণে। প্রথম কারণ, এটা বিশ্বব্যাংকের হাতে চিহ্নিত – সন্দেহ নাই। বিবৃতি পরিস্কার করে আমাদের সেটাই জানাচ্ছে। কিন্তু বিবৃতি একই সাথে সাথে বলছে, “এই প্রজেক্টের সাথে বিশ্বব্যাংককে সংশ্লিষ্ট রাখতে হলে সরকারকে ‘ধারাবাহিক সুনিদির্ষ্ট পদক্ষেপগুলো’ বাস্তবায়ন করতে হবে”। ইংরাজিতে, “ for the Bank to remain engaged with the project ”। অর্থাৎ সরকার যদি বিশ্বব্যাংককে এই প্রজেক্টে সংযুক্ত থাকুক চায় তবে বিশ্বব্যাংকের হাতে চিহ্নিত ‘ধারাবাহিক সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলো’ বাংলাদেশ সরকার নিজেই চিহ্নিত করেছে মনে করে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবু আমাদের অনেকের মনে হতে পারে এই ব্যাখ্যাও যথেষ্ট নয় বা স্পষ্ট নয়। তাদের জন্য আরেকটি উদ্ধৃতি দেই। সেটাই দ্বিতীয় কারণ।


বিশ্বব্যাংকের চার শর্ত

১. এই দুর্নীতিচক্রে যেসব সরকারি কর্মকর্তা জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে তাদেরকে তদন্ত পুর্ণ না হওয়া পর্যন্ত সরকারি চাকুরি থেকে ছুটিতে পাঠাতে হবে।

২. খতিয়ে তদন্ত করার কাজ ঠিকমত করার জন্য বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের অধীনে একটা বিশেষ অনুসন্ধান ও আইনী পদক্ষেপ নেবার টিম নিয়োগ দিতে হবে।

 ৩. তদন্ত অনুসন্ধানে প্রাপ্ত সব তথ্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত এক বাইরের প্যানেলের কাছে পরিপুর্ণভাবে সবকিছু দেখার সুযোগ উন্মুক্ত করে দিতে সরকারকে রাজি হতে হবে যাতে তাঁরা তদন্ত অনুসন্ধানের অগ্রগতি, পর্যাপ্ততা ও ন্যায্যতা সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক ও সহযোগী বিনিয়োগকারিদের দিকনির্দেশনামূলক পরামর্শ দিতে পারে।

৪. প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজের এক নতুন নিয়মশৃংখলা তৈরি করতে সরকারকে রাজি হতে হবে যেন বিশ্বব্যাংক ও সহযোগী বিনিয়োগকারিরা প্রজেক্টের ক্রয়সংক্রান্ত প্রক্রিয়া আরও বেশি নিজেদের নজরদারিতে আনতে পারে।


গওহর রিজভি ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক হেড কোয়ার্টারে গিয়ে ঠিক কী বলছেন, কী বলে নিগোশিয়েট করছেন – এনিয়ে আমাদের কৌতুহলের সীমা নাই – এটাই স্বাভাবিক। আর আমাদের অনেকের ধারণা এই বিষয়টা হয়ত কোনদিনই জানা যাবে না। তবু একমাত্র স্থানীয় এনটিভি নিউজ ঢাকা থেকে সংবাদদাতা জহিরুল আলমকে পাঠিয়েছে – বাড়তি কিছু জানা যাবে – এক্সক্লুসিভ, এই আশায়। কিন্তু জহিরুল আলমের রিপোর্ট দেখে আমাদের হতাশ হতে হয়েছে। যেসব মুল কথা এই বিবৃতি থেকেই জানা যাচ্ছে তা জহিরুল আলমের রিপোর্টে দেখিনি। যেমন বিশ্বব্যাংকের বিবৃতি বলছে, “The Government agreed to a series of measures as a pre-requisite for any renewed implementation” – বাংলায় অর্থটা হলো এরকমঃ প্রকল্প নবায়ন করার আগ্রহে বাংলাদেশ সরকার রাজি হয়েছে যে প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করবার কাজের নিয়ম পদ্ধতি বানানোর ক্ষেত্রে ধারাবাহিক কিছু সুনিদির্ষ্ট সরকারি পদক্ষেপ নেয়া একটা আগাম করণীয় কাজ। নবায়ন করার আগ্রহ - কথাটা এজন্য যে বিবৃতিতে ইংরাজী এই বাক্যের আগের বাক্যটা হলো এরকমঃ “বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংককে পদ্মা বহুমুখী ব্রিজ প্রকল্পে বিনিয়োগ বিষয়টা আবার বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করেছে”। গত কয়েক মাসে অর্থমন্ত্রী মাল মুহিত বিশ্বব্যাংককে আবার বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে কি না এনিয়ে একবার হ্যাঁ আরেকবার না বলে ধোঁয়াশার মধ্যে রেখেছিলেন আমাদের। যা হোক। এখন একথা পরিস্কার যে বিশ্বব্যাংকের চিহ্নিত ‘ধারাবাহিক সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলো’[ series of measures] আগাম করণীয় কাজ [ as a pre-requisite] হিসাবে মেনে নিতে আমাদের সরকার রাজি হয়েছে। আগে কাম পরে দামের মত আগে আগাম করণীয় কাজ সরকার করুক এরপর তাতে বিশ্বব্যাংক সন্তুষ্ট হলে পরে বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসা। তার মানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ওয়াশিংটনে গওহর রিজভি বিশ্বব্যাংক আদৌ বিনিয়োগ করবে কি করবে না সেটা নির্ধারণ করবার জন্য - এই আগাম কাজটি করতে রাজি হয়েছেন। ফলে বিশ্বব্যাংকের হাতে চিহ্নিত ‘ধারাবাহিক সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলো’ আর কেবল বিশ্বব্যাংকের নয়, সরকারের হাতেও চিহ্নিত এবং করণীয় হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের বিবৃতি কোন লিগাল ডকুমেন্ট নয় -এটা আমরা বুঝতে পারি। তবু বিশ্বব্যাংকের সাথে গওহরের আলোচনার বিবরণী বা মিনিটস এবং সেই সাথে এর এগ্রিড পয়েন্টস - এর যে লিখিত ডকুমেন্ট তা নিশ্চয় আছে। সেই ডকুমেন্টেরই প্রতিফলন বিবৃতিতে আছে - এটা অনায়াসেই বুঝে নেওয়া যায়।

এতক্ষণ উপরে যে আলোচনা করলাম তাতে কি ‘বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসছে” একথা বলা যায়? মিডিয়া রিপোর্টে এটাকেই কি ফোকাস মানা যায়? স্বভাবতই না। বরং যেটা ঘটেছে তা হলো, বিশ্বব্যাংকের চিহ্নিত চার ‘ধারাবাহিক সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলো’ [আমাদের ভাষায় চার শর্ত] বিশ্বব্যাংককে প্রকল্পে ফেরাতে গেলে আগেই বাংলাদেশ সরকারের আগাম করণীয় কাজ বলে স্বীকার করে নিয়েছে। আর এই শর্তগুলো পুরণের পরই বিশ্বব্যাংক প্রকল্পে ফিরতে পারে। আর, মনে রাখা দরকার, এই শেষ শর্ত মানে আমাদের মিডিয়ার দৌলতে যে আধা সত্য ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে মসিউর রহমানকে ছুটিতে পাঠানো - মোটেও তা  নয়। কর্মকর্তাদের ছুটিতে পাঠানো চার শর্তের মধ্যে একটি শর্তের অন্তর্ভূক্ত । তাও সেটা সেই শর্তের একমাত্র শর্ত নয়।

আসল চার শর্তের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শর্তঃ

তাহলে আসল চার শর্তের বাকি তিন শর্ত কি কি? দ্বিতীয় শর্ত হলো, দুর্নীতি দমন কমিশনের অধীনে একটা “বিশেষ অনুসন্ধান ও আইনী পদক্ষেপ নেবার টিম” [special inquiry and prosecution team ] নিয়োগ দিতে হবে। অর্থাৎ এটা ঠিক কোন ‘ইনকোয়ারি কমিশন’ নয় যে তদন্ত অনুসন্ধান করে সরকারের কাছে রিপোর্ট দিবে তারপর একটা থমকে সরকার তা কোন হিমাঘরে পাঠিয়ে দিবে এতেই সব গায়েব, সব শেষ। অর্থাৎ এনিয়ে কোন আইনী ব্যবস্থা নেয়া, আদালতে মামলা করা, অভিযোগ আনা হবে কি হবে না - সেটা সরকারের মর্জিতে ঠিক হবে। বরং এটা তদন্ত অনুসন্ধানের একই সাথে নিজেই প্রসিকিউশন টিমও বটে – মানে আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের, বিচার শেষ করে তবেই এই টিমের ম্যান্ডেট বা করণীয় শেষ হবে। এখান থেকে আমরা অনুমান করে নিতে পারি আগাম করণীয় হিসাবে গঠন করতে বলা টিমের নামের মধ্যে 'প্রসিকিউশন' শব্দটা রাখার তাতপর্য। ফলে বুঝা যায় বিশ্বব্যাংকের এটা সাদামাটা একটা বিবৃতি না, বিশ্বব্যাংকের লিগাল ডিপার্টমেন্ট ঘুরে আসা একটা বিবৃতি।  
এছাড়া আরও কথা আছে। এর আগে পদ্মা সেতু বিশ্বব্যাংকের সাথে বিরোধের ইস্যু হয়ে প্রকাশ্য হবার ও তা অমীমাংসিত বিরোধ হয়ে যাওয়া- ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা প্রত্যাহার বা ঋণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া - মানে আলোচনা ভেঙ্গে যাবার ঘটনাটা ঘটেছিল – দুর্নীতি দমন কমিশনের অধীনে একটা “বিশেষ অনুসন্ধান ও আইনী পদক্ষেপ নেবার টিম” কি পদ্ধতিতে বা নিয়মে বানানো যায় তা নিয়ে টার্মস কন্ডিশন,  পদ্ধতি ইত্যাদি গড়তে গিয়েই। দাবার ষ্টেলমেটের মত, বিরোধ অমীমাংসিত হয়ে পড়ে। বিরোধকে এভাবে অমীমাংসার জায়গায় ঠেলে দেবার জন্য দুদকের কর্মচারি নয়, দুদকের উকিল আনিসুল হক - প্রধানমন্ত্রীকে ভাল সার্ভিস দিয়েছিলেন। তিনি মুখ্য দুটো অজুহাত তুলেছিলেন – দুদকের আইনে দুদক নিজে এমনই ‘স্বাধীন’ যে নিজের তদন্ত অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় তদন্তের নামে কি করছেন, কি পেলেন, স্বচ্ছ রাখার জন্য আর কি করা যায়, কিভাবে ত্রুটি এড়ানো যায় ইত্যাদি বিষয় দুদক কারও সাথে শেয়ার করে না, কাউকে দেখতে দেন না – এটা নাকি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। এককথায় বললে, সার্বভৌমত্বের বকোয়াজির আড়ালে স্বচ্ছ তদন্ত অনুসন্ধানে না গিয়ে বরং দুর্নীতিবাজকে ক্লিন সার্টিফিকেট দেবার একটা ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন আনিসুল হক। এর বিপরীতে সে সময় বিশ্বব্যাংক যেটা চেয়েছিল তাই এখনকার তৃতীয় শর্ত।

তৃতীয় শর্ত বলছে, দুদকের “তদন্ত অনুসন্ধানে প্রাপ্ত সব তথ্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত এক বাইরের প্যানেলের কাছে পরিপুর্ণভাবে সবকিছু দেখার সুযোগ উন্মুক্ত করে দিতে সরকারকে রাজি হতে হবে যাতে তাঁরা তদন্ত অনুসন্ধানের অগ্রগতি, পর্যাপ্ততা ও ন্যায্যতা সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক ও সহযোগী বিনিয়োগকারিদের নির্দেশনামূলক পরামর্শ (give guidance) দিতে পারে”। সে সময় (১ জুলাই ২০১২) আনিসুল হক দুদক আহুত সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, “বিশ্বব্যাংক দুদকের অনুসন্ধান টিমের সঙ্গে তাদের একটি প্যানেল গঠনের প্রস্তাব দেয়। যে প্যানেল দুদকের অনুসন্ধানে যুক্ত থেকে তদন্ত পর্যবেক্ষণ করবে। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের সময় বিশ্বব্যাংকের প্যানেলের সদস্যরাও উপস্থিত থাকবেন। তিনি বলেন, ‘২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইন অনুযায়ী এর কোনো সুযোগ নেই।’ [দেখুন, প্রথম আলো ০২ জুলাই ২০১২]

একদিক থেকে আনিসুল হকের আপত্তি আপতিক দৃষ্টিতে বেশ গা-গরম দেশপ্রেমিক বক্তব্য মনে হতে পারে অনেকের কাছে। কিন্তু আসলেই এটা ছলনার দেশপ্রেম উস্কে দিয়ে বোকা বানানো ছাড়া কিছুই নয়। দুদকের ঐ সাংবাদিক সম্মেলনের পরের দিন অর্থমন্ত্রী মাল মুহিত ০২ জুলাই ২০১২ সংসদে ৩০০ বিধিতে যে লম্বা বিবৃতিটা পড়েছিলেন তা এর পরেরদিন ০৩ জুলাই ২০১২, হুবহু পুরাটাই দৈনিকগুলোতে ছাপা হয়েছিল। সেটা পাঠ করলে দেখা যাবে আনিসুল হকের আপত্তির উল্টাটাই মুহিত বলছেন। মাল মুহিত বলেছিলেন, “আইনানুগভাবে দুর্নীতি দমন কমিশন অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে দায়বদ্ধ নয় এবং তাদের নিজস্ব টীমকে কোন বিদেশি প্যানেলের তত্ত্বাবধানে তারা রাখতে পারে না। তবে উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নে যেসব কাজ বা ক্রয়ের চুক্তি হয় সেগুলো সবসময়ই তাদের সম্মতি নিয়েই সম্পাদন করা হয়। তাই দুর্নীতি দমন কমিশন এইসব বিষয়ে যখন তদন্ত করে তখন এইসব বিষয়ে সব তথ্য উন্নয়ন সহযোগীদের দিতে পারে এবং তাদের পরামর্শ বা নির্দেশ বিবেচনা করতে পারে"। বোঝা যাচ্ছে মুহিত বিবৃতি ড্রাফট করার সময় জানতেন না যে আগেরদিন আনিসুল হক জনগণকে কিভাবে বোকা বানিয়েছিলেন। এর সোজা মানে হলো, আনিসুল হক বাঙালি জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমের সুড়সুড়ি দিয়ে দুর্নীতি অনুসন্ধানের কাজটা আড়াল করতে চাইছিলেন; যেনবা এটা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বনাম বিশ্বব্যাংকের ইস্যু। যাতে সার্বভৌমত্বের সুড়সুড়ি দিয়ে দুদককে উল্টা দুর্নীতি ঢাকতে ব্যবহার করা যায়। আনিসুল হক সত্যিই ‘সফল’ ক্রিমিনাল উকিল!


সরকারকে  বিশ্বব্যাংক আগেই “দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ (credible evidence)” দাখিল করেছে। সেই দুর্নীতির তদন্ত ও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় এখনও দেখতে পাচ্ছি, শুনছি – তিনি বলে চলেছেন, কোন টাকা না দিয়েই বিশ্বব্যাংক মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ করছে, কোন দুর্নীতি হয় নাই। ইত্যাদি।  বিশ্বব্যাংকের অবস্থান আর প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে এক বিশাল ফারাক থেকেই গিয়েছে। যেহেতু বিশ্বব্যাংক দাবি করছে তারা বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দিয়েহে, অতএব দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এটাই তারা আসলে দেখতে চায়।


আনিসুল হক দ্বিতীয় যে আপত্তিটা তোলেন সেটা আরও অভিনব। বিশ্বব্যাংকের দিক থেকে যে কোন অনিয়ম তদন্ত করে দেখার আলাদা বিভাগ আছে যেটা ইন্টিগ্রিটি বা সততা বিভাগ। মুহিত এর বাংলা করেছেন শুদ্ধাচার বিভাগ। বিশ্বব্যাংকের সাংগঠনিক কাঠামোতে [অরগানোগ্রামে] এটা ২০০১ সাল থেকে চালু হয়। এটা কোন কান্ট্রি অফিসের অধীনে নয়, স্বভাবতই রাখা হয়নি। এটা সরাসরি হেড অফিসে এক ভাইস প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে তবে পরিচালনা বোর্ডের অধীনে এবং সমান্তরাল থেকে কাজ করে। গত জুন মাসে বাংলাদেশের সাথে নিগোশিয়েশনের সময় এই ইন্টিগ্রিটি বিভাগকে দিয়েই দুদকের তদন্ত অনুসন্ধান কাজের উপর বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে তদারকি, কাজ বুঝে নেয়া, গাইড করার কথাবার্তা চলছিল। ইন্টিগ্রিটি বিভাগের ওভারসাইট বা তদারকিকে আনিসুল হক বিশ্বব্যাংকের ‘এডভাইসরি কমিটি’ ভেবেছেন বা কখনও ‘বেতনভুক কর্মচারি’ বলে বুঝিয়েছেন। আনিসুল হক ২ জুলাইয়ের ঐ সাংবাদিক সম্মেলনে এবার অরগানোগ্রাম না বুঝার ভান করে আপত্তি তুললেন যে বিশ্বব্যাংকের কেন্দ্রের ইন্টিগ্রিটি বিভাগ বা এক্সটারনাল প্যানেলকে নয় কেবল কান্ট্রি অফিসকে তিনি তদন্ত অনুসন্ধানের ফলাফল জানাবেন। বলেছিলেন, “আমাদের আইনে আছে যেটা তদন্ত বের হয়ে আসবে সেটা আমরা জানাতে বাধ্য। কিন্তু অ্যাডভাইজরি কমিটিকে নয়। কিন্তু তারা বলল, না, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে কিছু জানাতে হবে না। সেটার জন্য বেতনভুক্ত কর্মচারী বিশ্বব্যাংকের থাকবে তাদের জানাতে। আমরা বলেছিলাম ব্যাংককে জানাব। ব্যাংক তাদের প্যানেলকে জানাক। সেটাই হচ্ছে আইনসম্মত, বিধিসম্মত। তখন তারা বললেন যে না আমাদের জানাতে হবে না”। এভাবে‘আইনসম্মত’, ‘বিধিসম্মত’ ইত্যাদি কথা তুলে তিনি এক্সটারনাল প্যানেলের সাথে কোন কাজ করতে অস্বীকার করেছিলেন। অথচ এবার তৃতীয় শর্তের মধ্যে সেই এক্সটারনাল প্যানেলের সাথেই তদন্ত কাজ, গাইডেন্স সবই মেনে নেয়া হয়েছে। যদিও এবার গত ২১  সেপ্টেম্বর তারিখে ৭১ টিভির সাথে এক টকশোতে সেই পুরানো খোঁড়া আপত্তিগুলো আনিসুল হককে আবার তুলতে দেখা গেছে। তার কথা শুনে এটা মনে করার কারণ আছে যে হয় তিনি এই প্রেস বিবৃতি মনযোগ দিয়ে পড়েন নি অথবা হতে পারে সরকারি নতুন ব্রিফিং নিয়েই পুরানা খোঁড়া আপত্তিটাই আবার তুলছেন অথবা পুরানা ব্রিফিং এর উপর দাড়িয়েই কিছু না বুঝে ষ্টাডি না করে পুরানা খোঁড়া আপত্তিটাই আবার তুলছেন। এদিকগুলো এখনও পরিষ্কার ।
তাহলে কথা দাড়াচ্ছে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শর্তের ফলাফলে আমাদের দুদুকের উপরে ওর কাজ সে কি করছে, কিভাবে করবে করা উচিত সেসব তদারকির জন্য বিশ্বব্যাংকের এক এক্সটারনাল প্যানেল নজরদারি করবে - এই হতে যাচ্ছে এখনকার কর্মপদ্ধতির নতুন ব্যবস্থার মুল নীতি। এটা শুনে অনেকে খুশি হবেন হয়ত এই ভেবে যে এবার আমাদের সরকার বা প্রধানমন্ত্রী সোজা হবেন। কিন্তু এর দুর্ভাগ্যের দিকটাও আমাদের নজর করা দরকার। সেটা হলো, আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন এমনই যে একটা বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত অনুসন্ধান কাজ সম্পন্নকরার কোন যোগ্যতাই সে রাখে না। কোন আস্থাই সে তৈরি করতে পারেনি। একদিকে আমাদের রাষ্ট্রের এমন কোন বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠান নাই। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক নিজের ম্যান্ডেট অনুযায়ী নিজে সদস্য রাষ্ট্রের করণীয় কাজ করে দিতে পারে না। এটা তার দায়িত্ত্বের ভিতরে পরে না। ফলে আপাত সমাধান এক এক্সটারনাল প্যানেলের আবির্ভাব। এই প্যানেলের নজরদারি অধীনে দুদুককে কাজ করতে হবে। এটাই দুদুকের (ফলে আমাদেরও) দুর্দশা; ইজ্জত নিয়ে টানাটানি। এই দিকটা আমাদের সবাইকে নজর করতে বলব। তবু এবারের শর্তে, মানে বিশ্বব্যাংকের চোখে চিহ্নিত করা সরকারের করণীয় পদক্ষেপ হলো, এক্সটারনাল প্যানেল - দুদুক কি করছে দেখবে কিন্তু সরাসরি দুদুককে কিছু বলবে না, নির্দেশনামুলক পরামর্শ দিবে না। যা বলার তা বলবে বিশ্বব্যাংককে; ইংরাজিতে " can give guidance to the Bank and co-financiers"। সুক্ষ্মভাবে এতটুকু ইজ্জত আমাদের জন্য বাচিয়েছে। অথচ আমাদের দুদুক যদি একটা তদন্ত অনুসন্ধান কাজে এর উপর বিশ্বাস করে নির্ভর করা যায় এমন প্রতিষ্ঠান হত তবে এসবের নহবত আসত না, আমাদের দেখত হত না। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য! 

এখন কি হতে যাচ্ছে?

এখনকার কাজের ধাপগুলো হলো, বিশ্বব্যাংকের পরবর্তী প্রথম পদক্ষেপ হবে সরকার বা মন্ত্রণালয়ের আগে দুদকের সাথে বসে তদন্ত অনুসন্ধানের টার্মস কন্ডিশন ঠিক করা। খুব সম্ভবত একটা এগ্রিমেন্ট বা এমওইউ (MOU) সই করা। এরপর সেই চুক্তি বা বুঝাবুঝির (মেমোরেন্ডাম অফ আন্ডারষ্টান্ডিং) দলিলের উপর ভিত্তি করে দুদুকের অধীনে একটা তদন্ত অনুসন্ধান ও প্রসিকিউশন টিম গঠন করা। আবার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এক এক্সটারনাল এক্সপার্ট টিমের (অনুমান করি এটা বিশ্বব্যাংকের সততা বিভাগ ঠিক করে দিবে) তদারকিতে দুদকের এই অনুসন্ধান টিম তদন্ত অনুসন্ধান কাজের অগ্রগতি, পর্যাপ্ততা ও ন্যায্যতা নিয়ে নিয়মিত কথা বলবে, গাইডেন্স নিবে। এককথায় বললে, যাই ঘটেছে আগে - পুরানো সেসব ঘটনার এক তদন্ত অনুসন্ধান শেষে একটা ক্লিন রিপোর্ট অথবা দুর্নীতির রিপোর্ট এবং রিপোর্ট অনুযায়ী প্রসিকিউশন অর্থাৎ বিচার ও শাস্তি –এভাবেই ফয়সালা হতে হবে। পুরানো বিষয়ের সমাপ্তি এভাবেই টানতে হবে; সবচেয়ে বড় কথা এই কাজগুলোর “সন্তোষজনক বাস্তবায়ন হওয়ার পর”, আমি আবার বলছি, এগুলো হবার পরই - বিশ্বব্যাংক নতুন করে পদ্মা বহুমুখী ব্রিজের কাজে জড়িত হবে। এই কথাটা কোন অনুমান নয়। বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিতে একথাই লেখা আছে। নিচে সেকথা তুলে দিলামঃ

“বিশ্বব্যাংক রাজি হয়েছে যে সরকার যেসব “সিদ্ধান্ত-পদক্ষেপ” নিতে একমত হলো সেইসবের সন্তোষজনক বাস্তবায়ন হওয়ার পর এবং বিশ্বব্যাংকের গভর্নিং বডির সহায়তা নিয়ে বিশ্বব্যাংক নতুন করে পদ্মা বহুমুখী ব্রিজের কাজে জড়িত হবে”।

এর মানে হলো, ‘বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসছে’ – এই ধারণা একেবারেই মিথ্যা। ওপরে যে চার শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে তার বাস্তবায়নের পর কী দাঁড়ায় তারপরই আমরা বুঝব বিশ্বব্যাংক ফিরে আসছে কিনা। মানে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত , বিচার ও আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়ার সন্তোষজনক সমাপ্তি বা পুরানা খাতা সন্তোষজনক ভাবে ক্লোজ হবার পরই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে টাকা ঢালতে ফিরে আসতে পারে। এর আগে নয়।

বিশ সেপ্টেম্বর তারিখের রাত থেকে মিডিয়া, টকশো, আলোচক সবাই এইদিকটা সম্পর্কে সম্পুর্ণ বেখবর দেখা গেল। সকলেই ধরে নিয়েছেন, ‘বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসছে’। অথচ বিবৃতির একটা বাক্যই বিশ্বব্যাংকের পুরা বিবৃতির মুলকথা,

The Bank has agreed that, upon satisfactory implementation of the agreed measures by the Government, and with the support of the Bank's governing bodies, the Bank will engage anew in the Padma Multipurpose Bridge - ।

‘সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলোর সন্তোষজনক বাস্তবায়ন’ - এটাই ষ্টেটমেন্টের ফোকাস বক্তব্য। আগেই বলেছি agreed measures মানে বিশ্বব্যাংকের চিহ্নিত ‘ধারাবাহিক সুনিদির্ষ্ট পদক্ষেপগুলো’-কে [ series of measures] আগাম করণীয় কাজ [ as a pre-requisite] হিসাবে মেনে নিতে বাংলাদেশের সরকারের রাজি হয়েছে।

এমনকি বিএনপির সেক্রেটারির প্রতিক্রিয়ায় দেখা যাচ্ছে মির্জা আলমগীরও আধা সত্য মিডিয়া রিপোর্ট পড়ে ধরে নিয়েছেন ‘বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসছে’। তিনি দাবি করছেন, কাদের জন্য দেরি হলো তদন্ত করে তাদের শাস্তি দেবার।

ওদিকে অনেক মিডিয়া অতি উৎসাহে আরও এক ধাপ এগিয়ে জামিরুল রেজা চৌধুরির কাছে ছুটেছেন, জানতে চাইছেন আবার টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করতে কতদিন লাগবে। অথচ কেউ একবারও চিন্তা করেন নাই দ্বিতীয় ও তৃতীয় শর্ত পুরণ সবচেয়ে শক্ত ও জটিল জায়গা। প্রধানমন্ত্রী কি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোন এক এক্সটারনাল এক্সপার্ট টিমের তত্ত্বাবধানে কাজ করার জন্য দুদকের অধীনে a special inquiry and prosecution team গঠন করবেন? সেই অনুসন্ধান ও প্রসিকিঊশন ক্ষমতাসম্পন্ন টিম দুর্নীতির তদন্ত করবে। কোন দুর্নীতি? এই বিবৃতির প্রথম প্যারার শুরুতেই বিশ্বব্যাংক উল্লেখ করেছে, “বিশ্বব্যাংকের তদন্ত শাখা ব্রিজ নির্মাণে অর্থায়নের সাথে সম্পর্কিত দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ (credible evidence) এর আগে বাংলাদেশ সরকারের সাথে শেয়ার করেছিল......” এই প্রজেক্টের সাথে বিশ্বব্যাংককে সংশ্লিষ্ট রাখতে হলে সরকারকে বাস্তবায়ন করতে হবে এমন কতগুলো ধারাবাহিক সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ বিশ্বব্যাংক যা চিহ্নিত করে দিয়েছিল, যেগুলো পুরণ করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছিল। সরকারকে দেয়া বিশ্বব্যাংকের “দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ (credible evidence)” – তদন্ত ও প্রসিকিউশন করতে হবে। আমরা কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় এখনও দেখতে পাচ্ছি, শুনছি – তিনি বলে চলেছেন, কোন টাকা না দিয়েই বিশ্বব্যাংক মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ করছে, ফলে কোন দুর্নীতি হয় নাই। ফলে আমরা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বব্যাংকের অবস্থান আর প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে এক বিশাল ফারাক এখনও থেকেই গিয়েছে। এপর্যন্ত আমরা কেবল এতটুকুই দেখছি যে, আবুল হোসেনের পদত্যাগ, মশিউর রহমানের ছুটি ইত্যাদিতে অর্থাৎ প্রথম শর্তের ক্ষেত্রে তারা উভয়ে একমত। কিন্তু অন্যান্য শর্ত সম্পর্কে আমরা বেখবর থেকেছি।

এই পরিস্থিতিতে একটা তদন্ত টিম যদিও বা হয় সেটা কি প্রসিকিউশন পর্যন্ত যেতে পারবে? কারণ তদন্তে কার না কার নাম বের হয়ে আসে সেসব পার হয়ে সেসব নামে মামলা দায়ের, বিচার শাস্তি – সত্যিই এখনও অকল্পনীয় সন্দেহ নাই। আর এসব কিছু যদি ভালয় ভালয় পার হওয়া যায় তারপরেই আসতে পারে বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতুতে নতুন করে বিনিয়োগে এগিয়ে আসা।

দিল্লী অনেক দুর!

সর্বশেষ এডিটঃ বাংলাদেশ সময়, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ভোর ০৫;৩০


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।