ইনসাফ না থাকলে যা ঘটে

বাংলাদেশের সমাজ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে, এতে সন্দেহ নাই। এই বিভাজনকে এতদিন আমরা যেভাবে আওয়ামী লীগ- বিএনপি বলে চিনতাম সেই বিভক্তি নয়। এই ভাগাভাগি আরও গভীরে, আরও ব্যাপক, আরো বিস্তৃত।
সমাজে মানুষ বিভিন্ন পরিচয় নিয়ে হাজির থাকে। সমাজের ভাষা ও সংস্কৃতিগত নানান ভিন্নতা ও বৈচিত্র আছে, নানা নৃতাত্ত্বিক জাতি আছে, বিভিন্ন ধর্ম রয়েছে এবং তাদের নিজের নিজের সংস্কৃতি, ধর্ম ও আত্মপরিচয়ের নানান ব্যাখ্যাও আছে। এই বিভিন্নতা ও বৈচিত্র থেকে সমাজ ও সংস্কৃতি তাদের পারস্পরিক ঐক্যের রসদ সংগ্রহ করে। সমাজ গতিশীল থাকে। পরস্পরের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা যেমন থাকে, তেমনি নানান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময় ও নিত্যনতুন সম্পর্ক নির্মাণের মধ্য দিয়ে একটা সামাজিক ভারসাম্য গড়ে ওঠে। সমাজ এগিয়ে যায়, বিকশিত হয়।
সমাজ কোন বিমূর্ত ব্যাপার নয়, তবে পত্রিকার পাতা সমাজতত্ত্ব নিয়ে আলোচনার উপযুক্ত জায়গা নয়। তবুও এটা বোঝা দরকার যে সমাজ আমাদের নিজ নিজ চাহিদা পূরণের বাধা হয়ে যেমন হাজির, একই সঙ্গে সেই সমাজই আবার চাহিদা পূরণের উপায়ও বটে। আমাকে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই চাকুরি করতে হয়, ব্যবসা চালাতে হয়, আর্থ-সামজিক ক্ষেত্রে নানান প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। সমাজের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে আমার স্বার্থের সংঘাত আছে, তেমনি নিজের শ্রেণি, গোষ্ঠি সম্প্রদায়ের সঙ্গেও অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকে। সমাজ কখনই দ্বন্দ্বমুক্ত নয়। এসব দ্বন্দ্বও অস্বাভাবিক কিছু নয়। দ্বন্দ্ব সংঘাত আছে বলেই সকলের সার্বজনীন স্বার্থ রক্ষার দরকারে রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। সেখানে সকলেই নাগরিক। রাষ্ট্রের পরিসরে এবং রাষ্ট্রের চোখে আমরা আর আলাদা বা ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ের কেউ নই। রাষ্ট্র সকল নাগরিকের প্রতি বৈষম্যহীন বা সমান আচরণ করতে বাধ্য। যে রাষ্ট্র এই কাজ করে না, সেই রাষ্ট্র টেকে না। সমাজের ভারসাম্য এতে নষ্ট হয়। যারা এই রাষ্ট্রে বঞ্চিত বোধ করে তারা বিদ্রোহ করে।
সমাজের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে আমার স্বার্থের সংঘাত আছে, তেমনি নিজের শ্রেণি, গোষ্ঠি সম্প্রদায়ের সঙ্গেও অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকে। সমাজ কখনই দ্বন্দ্বমুক্ত নয়। এসব দ্বন্দ্বও অস্বাভাবিক কিছু নয়। দ্বন্দ্ব সংঘাত আছে বলেই সকলের সার্বজনীন স্বার্থ রক্ষার দরকারে রাষ্ট্র গড়ে ওঠে।
একজন মানুষ নিজের মধ্যে বিভিন্ন পরিচয় ধারণ করতে পারে। যেমন সে একই সঙ্গে বাঙালি এবং মুসলমান, কেউ চাকমা এবং বৌদ্ধ। কেউ দাবি করতে পারে আমি প্রধানত বাঙালি, তারপর মুসলমান বা ধর্মে আমার বিশ্বাস নাই। আরেকজন বলতে পারে আমি প্রথমে মুসলমান, তারপর বাঙালি। কিন্তু সমাজের কোন সম্প্রদায় যদি দাবি করে যে সমাজের সকলেরই পরিচয় হতে হবে ‘মুসলমান’, আর অন্য কোন পরিচয় রাষ্ট্র মানবে না। রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি হবে ইসলাম। অর্থাৎ রাষ্ট্র হবে ইসলামি রাষ্ট্র। তখন যারা নিজেদের ‘বাঙালি’ মনে করে তারা সে রাষ্ট্র মানবে না। একে বলা হয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয়ের রাজনীতিকরণ। অর্থাৎ যে পরিচয় সামাজিক পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকার কথা ছিল তা থাকল না। গত ১৯৪৭ এ আমরা প্রথম যে রাষ্ট্র পেয়েছিলাম তখন থেকেই পাকিস্তানী শাসকশ্রেণি সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়কে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের স্তরে তুলে এনেছে। যারা সেই পরিচয় মানতে চায় না তাদের ‘শত্রু’ বানিয়েছে। এই কাজ পাকিস্তানী আমলে হয়েছিল, বাঙালিরা তার প্রতিবাদ করেছে, পরিণতিতে পাকিস্তান ভেঙে গিয়েছে, রক্তে স্নান করে আমরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছি। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রথম পাঠ হচ্ছে, যে-পরিচয় সামাজিক স্তরে থাকা উচিত তাকে রাজনীতির স্তরে উন্নীত করা যাবে না। যদি করা হয় তাহলে রাষ্ট্র টিকবে না, রাষ্ট্র ভেঙ্গে যাবে। পাকিস্তানীরা তাদের সকল সামরিক শক্তি দিয়ে আমাদের দমন করতে চেষ্টা করেছে, ত্রিশ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছে, নারীপুরুষ বিভিন্ন ভাবে মুক্তি যুদ্ধে অশেষ ত্যাগ স্বীকার করেছে। কিন্তু আমরা এতো বড় আত্মত্যাগ থেকে বড় শিক্ষাটাই গ্রহণ করি নি। আমরা মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললেও চিন্তাচেতনায় পাকিস্তানী থেকে গিয়েছি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রথম পাঠ হচ্ছে, যে-পরিচয় সামাজিক স্তরে থাকা উচিত তাকে রাজনীতির স্তরে উন্নীত করা যাবে না। যদি করা হয় তাহলে রাষ্ট্র টিকবে না, রাষ্ট্র ভেঙ্গে যাবে। পাকিস্তানীরা তাদের সকল সামরিক শক্তি দিয়ে আমাদের দমন করতে চেষ্টা করেছে, ত্রিশ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছে, নারীপুরুষ বিভিন্ন ভাবে মুক্তি যুদ্ধে অশেষ ত্যাগ স্বীকার করেছে। কিন্তু আমরা এতো বড় আত্মত্যাগ থেকে বড় শিক্ষাটাই গ্রহণ করি নি। আমরা মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললেও চিন্তাচেতনায় পাকিস্তানী থেকে গিয়েছি।
জাতীয় মুক্তি যুদ্ধে নিপীড়িত জাতিসত্তা সবসময়ই শত্রুর বিপরীতে তার আত্মপরিচয়ের একটা বয়ান খাড়া করে। আমরাও করেছি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা। যেহেতু আমাদের বিপরীতে ইসলামকে খাড়া করানো হয়েছিল, বলা হয়েছিল আমাদের মুসলমান পরিচয়ই সত্য, অন্য পরিচয় রাষ্ট্র স্বীকার করবে না। ফলে ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ঝাণ্ডা নিয়ে আমরা লড়েছি। বাঙালি শুধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য লড়াই করে নি, লড়েছিল একটি সংবিধানের জন্য যার মধ্যে এই বিরোধের মীমাংসা করা যেত। কিন্তু মীমাংসা হয় নি।
মুক্তিযুদ্ধ যে-নীতির ভিত্তিতে হয়েছিল সেটা আমরা মুজিবনগরে ১০ এপ্রিল তারিখে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পড়ে দেখতে পারি। সেখানে পরিষ্কার বলা হয়েছে ‘সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র’ রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হচ্ছে “বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে”। এর ভিত্তিতেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। এই তিনটি বিষয় -- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার -- আসলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি। এটা জানা কথা যে ভাষা ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের আঘাত এসেছে বলেই বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধে গিয়েছে। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। তার মানে এ নয় যে জনগণ তাদের নৃতাত্ত্বিক, জাতিগত বা ধর্মীয় পরিচয় ভুলে গিয়েছে, বা তার কোন মূল্য নাই। আমরা যুদ্ধ করেছিলাম “সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত” ভাবে কায়েম করবার জন্য। কিন্তু আমরা মুক্তিযুদ্ধের এই শিক্ষাটিও ভুলে গিয়েছি। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতে গিয়ে বলে থাকেন সেটা হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র - তারা আসলে আওয়ামি লীগের সংকীর্ণ দলীয় অবস্থানের পক্ষেই দাঁড়ান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে কথা বলেন না। “বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে” সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র কায়েম –এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তাহলে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা কি বলবে যে স্বাধীনতার এই ঘোষণা মিথ্যা? মনে রাখতে হবে এই ঘোষণা নিশ্চিত ভাবে কায়েম করবার জন্যই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে।
যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতে গিয়ে বলে থাকেন সেটা হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র - তারা আসলে আওয়ামি লীগের সংকীর্ণ দলীয় অবস্থানের পক্ষেই দাঁড়ান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে কথা বলেন না। “বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে” সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র কায়েম –এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীনতার ঘোষণা তো তাই বলে।
মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হওয়াএক জিনিস, আর রাষ্ট্র গঠন ভিন্ন বিষয়। আওয়ামী লীগ তার দলীয় কর্মসুচিকেই রাষ্ট্রের সংবিধানে পরিণত করল। “সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে” কী ধরণের কন্সটিউশান বা গঠনতন্ত্র দরকার আমরা আলোচনার সুযোগ পর্যন্ত পাই নি। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে স্বাধীনতার পর নতুন করে গণপরিষদ বা কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলির প্রতিনিধি কারা হবেন এমন কোন নির্বাচন ডাকা হয়নি। বরং পাকিস্তানের সংবিধান লিখবার জন্য যারা পাকিস্তান আমলে নির্বাচিত হয়েছিল, তারাই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান লিখেছে। এই গোড়ার ইতিহাস না জানলে আমরা এখনকার রাজনৈতিক সংকটের চরিত্র বুঝতে পারবো না।
স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতিকরণ শুরু হোল। অর্থাৎ দাবি করা হোল এটাই আমাদের একমাত্র রাজনৈতিক পরিচয়, রাষ্ট্রীয় মূল নীতির মধ্যে এটা স্থান পেল। অর্থাৎ পাকিস্তান আমলের ভূত কাঁধে থাকায় পাকিস্তানী পন্থায় রাজনীতি ও রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা চলল। এর প্রথম পরিণতি গড়ালো গৃহযুদ্ধে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠি বাঙালি নয়, তারা বলাবাহুল্য ‘বাঙালি’ হতে চাইলেন না। তারা তাদের ‘জুম্ম জাতীয়তাবাদ’ নিয়ে রুখে দাঁড়ালেন। সশস্ত্র সংগ্রাম করলেন। পাহাড়ের জনগোষ্ঠির কাছে বাঙালি জনগোষ্ঠি চিরকালের জন্য শত্রুতে পরিণত হোল।বাঙালি যেভাবে পাকিস্তানীকে দেখে, পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার চোখে আমরাও সেই একই ‘পাকিস্তানী’ – যারা গণহত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অপরাধী। এই ইতিহাস আমরা চাপা দিয়ে রাখি। কিন্তু মিথ্যা দিয়ে সত্য ঢাকা যায় না।
ওপরের ইতিহাস বুঝতে পারলে আমরা দ্বিতীয় প্রজন্মের তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধ বা বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের বর্তমান গৃহযুদ্ধের মর্ম বুঝব। প্রথম যুদ্ধ হয়েছিল পাহাড়িদের বিরুদ্ধে। এবার যুদ্ধ তাদের বিরুদ্ধে যারা মনে করে তারা অবশ্যই বাঙালি কিন্তু বাঙালিত্ব তার প্রধান সত্তা নয়। তাদের সত্তায় ইসলাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিচয়। যারা দ্বীতিয় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছেন, তারা গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছেন ইসলামের সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের। খেয়াল করতে হবে ‘বাঙালি’ বা ‘মুসলমান’ এই দুইয়ের মধ্যে কোন পরিচয় প্রধান সেটা এখানে আমাদের তর্কের বিষয় নয়। রাজনৈতিকতা ও রাষ্ট্রের বিচার করবার ক্ষেত্রে এই তর্ক অপ্রাসঙ্গিক। তর্কের বিষয় হচ্ছে, যে-পরিচয় সামাজিক পরিসরে থাকবার কথা এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভাবে ভাঙ্গাগড়ার ভিতর দিয়ে থিতু হবার বিষয় তাকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের স্তরে টেনে আনার পরিণতি। এর কুফল কতোটা ভয়ানক হতে পারে তা গত কত কয়েক সপ্তাহ জুড়ে দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া সংঘাত ও সংঘর্ষের অভিজ্ঞতা থেকে সহজেই বোঝা যায়। অনেক মানুষ ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন, বহু মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। আহত কতো তার কোন হিসাবও কারো কাছে নাই। বিএনপি জামাতের নেতৃত্বাধীন জোটকে সভা সমাবেশও করতে দেয়া হচ্ছে না। সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা দেবার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অফিসে হামলা করে বিএনপির মহাসচিব সহ শীর্ষ নেতাদের কিভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা সবাই দেখেছে।
অনেকে বলছেন বটে যে সংকটটা রাজনৈতিক, একে রাজনৈতিক ভাবে সমাধান করতে হবে। একথা বলে তারা সমস্যার গোড়ায় যেতে চাইছেন না, ধরে নিয়েছেন এটা বুঝি রাজনৈতিক দলগুলোর ঝগড়া। অনেকে পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করছেন, জামাত-শিবির যুদ্ধাপরাধের বিচার হোক তা চায় না, তাই তারা তাণ্ডব করে বেড়াচ্ছে। সমাধান হিশাবে তারা বলছেন বিএনপি জামাত-শিবিরকে ত্যাগ করুক। তাহলে ক্ষমতাসীনরা জামাত-শিবির সহজে নির্মূল করতে পারবে, দেশ আবার স্থিতিশীল হবে।
প্রথম যুদ্ধ হয়েছিল পাহাড়িদের বিরুদ্ধে। এবার যুদ্ধ তাদের বিরুদ্ধে যারা মনে করে তারা অবশ্যই বাঙালি কিন্তু বাঙালিত্ব তার প্রধান সত্তা নয়। তাদের সত্তায় ইসলাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিচয়। যারা দ্বীতিয় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছেন, তারা গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছেন ইসলামের সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের।
বাংলাদেশের একজন বামপন্থী নেতা, যাকে আমি শ্রদ্ধা করি, মাসখানেক আগে শুনছিলাম তিনি বলছেন আওয়ামী লীগ এরশাদকে ছাড়ুক আর বিএনপি জামাতকে ছাড়ুক, তাহলে একটা রাজনৈতিক আপোষরফা হবে। এখন দেখছি তিনি বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলছেন, বিএনপি জামাত-শিবির ত্যাগ করুক, আর হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নিক। অর্থাৎ বিএনপি যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পেতে চায় তাহলে তাকে জামাত-শিবির ত্যাগ করতে হবে। এরপর হয়তো নিকট ভবিষ্যতে আমরা তাদের বলতে শুনব, বিএনপিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি করতে হবে, নইলে তাদের ক্ষমতার গদিতে বসতে দেওয়া হবে না। বোঝা যাচ্ছে সংকটের গোড়ায় না গিয়ে তারা খুবই সংকীর্ণ জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছেন।
ইসলাম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই রাজনৈতিক বিভাজন কাটিয়ে উঠে সমাজের ক্ষত যদি নিরাময় করতে চাই তার জন্য দূরদৃষ্টি এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দরকার। আমাদের সমাজে তার অভাব আছে। ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণার যে সংস্কৃতি গত ৪০ বছর চর্চা করা হয়েছে তার মূল্য দিতে হবে অনেক। আমরা এখনও কী ঘটেছে সে সম্পর্কে বেহুঁশ হয়ে আছি। দরকার সততার সঙ্গে এই ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি হওয়া এবং রাজনৈতিক সংকটের উৎপত্তির কারণ উপলব্ধি করা। সমাধানের সম্ভাব্য পথগুলো তখনই শনাক্ত করা সম্ভব হতে পারে। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সেই কাজগুলো করতে হবে। তবে সে কাজে আমাদের অযোগ্যতাই প্রমাণিত হয়েছে বারবার।
‘মানবিক মর্যাদা’ সুনিশ্চিত করা আমাদের স্বাধীনতার খুবই বড় একটি ঘোষণা। যদি আদালত ও বিচারের দিক থেকে দেখি তাহলে এর অর্থ হচ্ছে সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধীরও একটা ন্যয়বিচার ও সেখানে নিজেকে নির্দোষ প্রমানের এমন কিছু অধিকার আছে যা অলংঘনীয়। রাষ্ট্র যদি এই ন্যূনতম নীতিটুকুও না মানে রাষ্ট্র তার ন্যায্যতা হারায়। আমরা এতদিন বলে এসেছি আমরা বিচার চাই, অথচ করেছি নির্মূলের রাজনীতি। তারপরেও সাধারণ মানুষ ভেবেছিল এটা কথার কথা, আসলে আমরা বিচার চাচ্ছি। কিন্তু শাহবাগে শুধু জবরদস্তির কথা, ফাঁসির দাবি উঠল। ন্যায় বিচার রইল উপেক্ষিত। এমনকি শাহবাগের আবদার রক্ষা করে, আইনী বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে যে-অপরাধের বিচারে একবার রায় দেওয়া হয়ে গিয়েছিল সেই অপরাধের বিচার আবার করবার জন্য নতুন করে আইন পাশ করা হোল। আমরা দেখব যারা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছেন তারা কেউই একটি সুস্থ বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বললেন না। এমনকি বিচার প্রক্রিয়ার ভুলত্রুটি নিয়েও এক অক্ষর কথাও বলেন না। কারণ তারা মনে করেন না অপরাধীদের বিচারের কোন প্রয়োজন আছে। তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়াই একমাত্র কাজ। আদালতের কাজ হচ্ছে একটি ফাঁসির কাগজ শাহবাগীদের ধরিয়ে দেওয়া। এমন বেইনসাফির ফলে সমাজকে একত্রিত রাখবার কোন ন্যূনতম ভিত্তি আর থাকলো না। সে ভিত্তি চোখের সামনেই কিভাবে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে আমরা দেখছি।
‘মানবিক মর্যাদা’ সুনিশ্চিত করা আমাদের স্বাধীনতার খুবই বড় একটি ঘোষণা। যদি আদালত ও বিচারের দিক থেকে দেখি তাহলে এর অর্থ হচ্ছে সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধীরও একটা ন্যয়বিচার ও সেখানে নিজেকে নির্দোষ প্রমানের এমন কিছু অধিকার আছে যা অলংঘনীয়। রাষ্ট্র যদি এই ন্যূনতম নীতিটুকুও না মানে রাষ্ট্র তার ন্যায্যতা হারায়।
একদিকে আত্মপরিচয়ের নামে রাজনৈতিক বিভাজন, অন্যদিকে ইনসাফের ন্যূনতম সম্ভাবনা উধাও করে দেওয়া। সমাজের দুই বিবাদমান পক্ষ রাষ্ট্রের কোন একটি সাধারণ পাটাতনে যে দাঁড়াবে তার আর জায়গা রাখা হোলনা। জামাত শিবির এই পরিপ্রেক্ষিতে পালটা বল প্রয়োগের নীতি গ্রহণ করেছে। সেটা ঠিক কি বেঠিক, ভাল কি মন্দ সেই নীতিবাদী বিচার করে এখন আর কোন লাভ হবে না। নিন্দা করলে রাজনীতির মুল সমস্যায় কোন কমবেশ হবে না। শুধু ক্ষমতাসীনদের সকল হিংস্রতা নিয়ে জামাত-শিবির নির্মূল করবার নীতিকেই সমর্থন করা হবে। রাজনীতির মূল তর্কে আমরা এতে কখনই পৌঁছাতে পারব না।
অতএব বোঝা যাচ্ছে, রাজনীতির বিদ্যমান যে ছক তার মধ্যে কোন সমাধান আছে বলে মনে করা বাতুলতা। ক্ষমতাসীনরা প্রতিপক্ষকে নির্মূলের পথ থেকে সরে আসবে এমন কোন লক্ষণ নাই। ইতোমধ্যেই তারা ‘সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করেছে। এর পালটা বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষ থেকে ‘কমিটি ফর পাবলিক সেইফটি’ বা ‘জননিরাপত্তা কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটির উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষ নির্মূলের নীতি বাস্তবায়ন। ‘জননিরাপত্তা কমিটি’ গঠনের উদ্দেশ্য জনগণের জানমাল রক্ষা। উদ্দেশ্যের এই পার্থক্য থাকলেও এটা পরিষ্কার দুই পক্ষই সংঘাতের জন্য তৈরী। ইতোমধ্যে ঢাকা অভিমুখে ৬ এপ্রিল লং মার্চের ডাক দিয়েছে আলেম সমাজ। আলেম সমাজ জামায়াত সমর্থক নন, বরং জামায়াত বিরোধী। এখন দেখা যাচ্ছে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল এবং তাদের সমর্থক ও অনুসারীরা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে একটি পক্ষ হিশাবে দাঁড়াচ্ছে। শুধু আওয়ামি লীগ তাদের প্রতিপক্ষ নয়, সেকুলার বা ইসলাম বিদ্বেষী ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীরাও তাদের প্রতিপক্ষ। আরেকটি বড় ধরনের সংঘাত আসন্ন।
এই সংকটের সমাধান সহজে হবে বলে মনে করার কোন কারন নাই। কিন্তু আমরা দেখছি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আলোচনায় বসার ডাক দিয়েছেন। বাংলাদেশের ব্যাপারের উদ্বিগ্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও দুই পক্ষকে বৈঠকে বসে সমঝোতার পরামর্শ দিচ্ছেন। বিবাদমান এই দুই পক্ষ বসলে প্রথমে তাদেরকে দুইটি বিষয়ে একমত হতে হবে।
প্রথমত, সকলকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য মাঠে এসব রাজনৈতিক দল কি ব্যবস্থা গ্রহণ করছে সেটাও জনগণকে পরিষ্কার ভাবে জানাতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুলিশের আইনগত বাধ্যবাধকতা এবং জাতিসংঘের নীতিমালা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। জনবিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করা যাবে না।
এই ধরণের প্রাথমিক শর্তগুলো পূরণ করতে না পারলে বিবদমান পক্ষগুলোর বসে কোন লাভ হবে না।
১১ মার্চ ২০১৩। ২৭ ফাল্গুন ১৪১৯। শ্যামলী।