নির্বাচন নাকি গণতন্ত্র?
বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হবার আগে আদৌ কোন নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় নতুন নয়। হয়তো হবে না, হয়তো হবে। ভদ্রলোক সমাজে যে উদ্বিগ্নতা আমরা দেখছি তাকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক পক্ষে রয়েছে আইনী উদ্বিগ্নতা। যেমন, এই সরকারের মেয়াদ শেষ হলে যে সাংবিধানিক জটিলতা তৈরী হবে তার মীমাংসা কিভাবে হবে? আরেক ধরণের উদ্বিগ্নতা হচ্ছে সামাজিক। সেটা হোল নির্বাচন যদি না হয়, ক্ষমতাসীনরা যদি একতরফা নির্বাচন করে, তাহলে দেশে একটা সংঘাতময় পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটবে। সেটা সামাল দেওয়ার উপায় কি? বড়লোকদের জানমাল রক্ষার ব্যবস্থা কিভাবে হবে? পাহারাদারি কে করবে? পুলিশ? সরকারের মেয়াদ শেষ হলে পুলিশও নাকি চোখ উল্টিয়ে ফেলে, আর হাওয়া যদি ভিন্ন ভাবে বইতে শুরু করে তাহলে তো কথাই নাই। সহিংসতা ও অস্থিরতা পুলিশ সামাল দিতে পারবে না ।
তাহলে কি সেনাবাহিনী? এই আতংক ও ভীতি থেকেই তৃতীয় শক্তির কথা আমরা হামেশা শুনি। তাহলে তো বড়লোকদের জানমাল রক্ষার জন্য ‘তৃতীয়’ শক্তিকে আসতেই হয়। নইলে তাদের রক্ষা করবে কে? ফলে রাজনৈতিক দলের ওপর ত্যক্তবিরক্ত সমাজের বিশাল একটা অংশ প্রকাশ্যে কিম্বা গোপনে সেনাশাসনের পক্ষে চলে যায়। রাজনৈতিক দলগুলো এটা মোটেও পছন্দ করে না। এটা টের পেয়ে হন্তদন্ত শেখ হাসিনা আগাম ধমক দিয়ে বেড়াচ্ছেন যে ‘অসাংবিধানিক’ পথে কাউকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হবে না। তিনি সেনাবহিনীর সঙ্গেও দেনদরবার করে বেড়াচ্ছেন। হয়তো তার অনুমায়া, বিপদ যদি আসে তাহলে তার উৎপত্তি সেনাছাউনি থেকেই ঘটবে। এই বিপদের আশংকা তিনি করছেন অনেক দিন ধরেই। এটা সাম্প্রতিক নয়। বিডিআর সেনাবিদ্রোহের পর থেকেই এই আতংক তার মধ্যে কাজ করছে।
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসাবে ২০১১ সালের জুলাই মাসে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ হাসিনা সংবিধান বদলিয়ে নিয়েছেন । সেখানে সন্নিবেশিত হয়েছে নতুন ৭(ক) এবং ৭(খ) অনুচ্ছেদ। সেখানে যা বলা হয়েছে তার সারমর্ম পরিষ্কার। তা হোল, কারো যদি বুকের পাটা থাকে তাহলে পঞ্চদশ সংশোধনী সম্বলিত ‘সংবিধান কিম্বা তার কোন অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত’ করবার চেষ্টা করুক। অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা দখল তো দূরের কথা। বদলাবার কোন চেষ্টা দেখলেই মজা দেখিয়ে দেওয়া হবে। অসাংবিধানিক পথ বলতে প্রথমে বোঝায় সশস্ত্র অভ্যূত্থান। কিন্তু সেটাই একমাত্র অসাংবিধানিক পথ নয়। পঞ্চদশ সংশোধনীতে অসাংবিধানিক পথ বলতে শুধু শক্তির ‘প্রদর্শন’ বা শক্তির ‘প্রয়োগ’ বোঝানো হয় নি। অন্য কোন ভাবেও হতে পারে, ‘অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায়’ ! সেটা কেমন? যেমন গণ অভ্যূত্থান। আর কিভাবে হতে পারে? জাতিসংঘের ‘শান্তি মিশন’। তবে তার জন্য প্রমাণ করতে হবে বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে এক এগারো ঘটাবার আগে বাংলাদেশকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা হয়েছিল। তখন ক্ষমতায় ছিল চারদলীয় জোট। সেই সময় ‘সুশাসন’, ‘সৎ প্রার্থী নির্বাচন’, দুর্নীতি প্রতিহত করবার বিবিধ জেহাদ আমরা প্রত্যক্ষ করে ছিলাম। যারা সেইসব কাণ্ড করেছিলেন, চেনা জানা মানুষ তারা। ‘সুশীল সমাজ’ হিসাবে যাদের খ্যাতি এর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সরকারের আমলে অবশ্য তাদের আওয়াজ ক্ষীণই মনে হয়। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশকে তারা ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ প্রমাণ করবেন না এটা আমরা ধরে নিতে পারি। কারণ ইসলামি রাজনীতির উত্থান ঠেকানোর জন্য শেখ হাসিনা তাদের মিত্র।
তাহলে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছে সেনা অভ্যূত্থান ও গণঅভ্যূত্থান ঠেকানোর জন্য। তাই কি? না, শুধু তাই নয়। এমনকি কাউকে শক্তি প্রদর্শন, শক্তি প্রয়োগ বা গণ অভ্যূত্থানও করতে হবে না। ‘সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য কোন উদ্যাগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে’ সেটাও ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ হবে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ‘সর্বোচ্চ’ শাস্তি। মৃত্যুদণ্ড। তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। জনগণ কেমন রাষ্ট্র চায় এবং তাদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বর্তমান সংবিধানের যে অসঙ্গতি ও বৈরী চরিত্র সে সম্পর্কে কিছু বলার অধিকার এভাবেই হরণ করা হয়েছে। কিচ্ছু বলা যাবে না। সংবিধান নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করলেও তার বিরুদ্ধে কোন সমালোচনা করা নিষেধ, কোন বিধানের প্রতি নাগরিকদের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এই ধরণের ফাঁসির দড়ি ঝুলিয়ে রেখে বর্তমান সরকার দেশ শাসন করছে।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এই কাজ করতে কেউ যদি ‘সহযোগিতা’ করে বা ‘উস্কানি’ দেয় কিংবা এই কাজ ‘অনুমোদন’, ‘মার্জনা’, ‘সমর্থন বা ‘অনুসমর্থন’ করে তাকেও একই অপরাধে শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। এরপর রয়েছে ৭(খ) অনুচ্ছেদ। সেখানে জাতীয় সংসদের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। সংবিধান জাতীয় সংসদকে দুই তৃতীয়াংশ ভোটে সংবিধান সংশোধনের কিম্বা নতুন আইন প্রণয়ণের ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু ৭(খ) অনুচ্ছেদ বলছে এই ধরণের ক্ষমতা ১৪২ অনুচ্ছেদে দেওয়া থাকলেও জাতীয় সংসদ সেটা আর সকল অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রে খাটাতে পারবে না । কিছু কিছু অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রে ‘সংযোজন’, ‘পরিবর্তন’, ‘প্রতিস্থাপন’, ‘রহিতকরণ’ করা যাবে না । সেটা ১৪২ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলেই হোক, কিম্বা হোক ‘অন্য কোন পন্থায়’।
রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র ও কাঠামোর অতি গোড়ার ও মৌলিক জায়গাগুলোর গণতন্ত্রবিরোধী বিকারকে আমি সবসময়ই ‘ফ্যাসিস্ট’ বলে আসছি। জনগণের গণতান্ত্রিক আশা, আকাঙ্ক্ষা ইচ্ছা সংকল্প ইত্যাদিকে নস্যাৎ করে দেবার জন্য রাষ্ট্রের যে ভীতিকর ও ভয়ানক পরিগঠন সেই চরিত্রের দিকেই নজর নিবদ্ধ করবার জন্য ‘ফ্যাসিস্ট’ বলা। অনেকে বলেন এই রাজনৈতিক বর্গটি এতোই ক্লিশে হয়ে গিয়েছে যে এটা এখন গালাগালির মতোই শোনায়। সে ব্যাপারে সাবধান করবার জন্য আমি বারবারই বলি ফ্যাসিবাদ বা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা নিন্দাসূচক একটি ধারণা নয়। রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট বিকার বা সংকট ধরিয়ে দেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। রাষ্ট্র বা সরকারকে শুধু গণবিরোধী বা গণতন্ত্র বিরোধী বললে কিছুই বলা হয় না। সংবিধানে গণতন্ত্রের অনেক অভাব থাকতে পারে। রাষ্ট্র অবিকশিত হতে পারে। কিন্তু যখন বলা হয় যে সংবিধান নামক যে আইনী অস্ত্র দিয়ে ফ্যাসিস্ট শক্তি শাসন করে সেই সংবিধানের বিরুদ্ধে কিছুই বলা যাবে না – ‘সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত’ করার চেষ্টা করলে সেটা হবে রাষ্ট্রদ্রোহিতা -- তখন আমরা একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থারই মোকাবিলা করি। এটা একনায়কতন্ত্র নয়। একনায়কনায়কতন্ত্রের জনসমর্থন থাকে না, কিন্তু ফ্যাসিজমের থাকে, তার জনপ্রিয়তা বা জনসমর্থন থাকে। এই সরকারেরও রয়েছে।
যে কারণে বারবারই বলি, আবারও বলব যে ‘ফ্যাসিস্ট’ কথাটি কোন গালাগালির ভাষা নয়। প্রধানমন্ত্রীর অসৌজন্যমূলক ভাষা ও রূঢ় ভঙ্গী দিয়েও তার শাসনামলকে বিবেচনা করছি না আমরা। কিম্বা আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস ও সহিংসতা নিয়েও এখানে কথা হচ্ছে না। কারণ সন্ত্রাস ও সহিংসতা প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই সাধারণ বৈশিষ্ট। সেখানে মাত্রার হেরফের থাকতে পারে। ধনি ও শোষক শ্রেণির কোন দলই বলপ্রয়োগ ছাড়া রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারে না। সেটা অসম্ভব। গায়ের জোর কিম্বা পুলিশি ঠ্যাঙানি তারা শুধু গরিব, অসহায় ও খেটে খাওয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে তা নয়। পরস্পরের বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করে। বলপ্রয়োগের প্রতিযোগিতা পরস্পরের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতারই অংশ। সেই ক্ষেত্রে বরং অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং যে নিজেরা সন্ত্রাসী হয়েও কিভাবে তাদের শ্রেণি ও গোষ্ঠির জন্য বিপজ্জনক বামপন্থা বিশেষত মাওবাদীদের কিম্বা ইসলামপন্থি দল বা প্রবণতাগুলোকে অতি অনায়াসেই গণমাধ্যমের শক্তির জোরে ‘সন্ত্রাসী’ বলে তারা চিহ্নিত করতে পারে এবং সমাজে তাদের দেওয়া এই মার্কা মারা ট্যাগ প্রতিষ্ঠিত করতেও সক্ষম হয়।
এই হোল সাংবিধানিক দিক থেকে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার চেহারা। আর অন্যদিকে বিচার বিভাগের ক্ষয়। বিচার বিভাগ নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে, এখানে নতুন কিছু বলার নাই। তবে প্রশ্ন তুলতে পারি, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচারবিভাগের যে ভূমিকা থাকে বিচারবিভাগ তাঁদের সেই ভূমিকা সম্পর্কে কি সচেতন ও সজ্ঞান? গণতন্ত্রে বিচারবিভাগকেও জবাবদিহি করতে হয়। আমরা এখানে বিচার বিভাগের নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার কথা তুলতে চাই না। যেমন জুডিশিয়াল রিভিউ। বরং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে বৈচারিক জবাবদিহিতার যে ধারণা রয়েছে সে প্রশ্নটাই বরং তুলতে চাই। বিচারক ও বিচার বিভাগের বৈচারিক ন্যায্যতা নাগরিকদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার সংকল্প ও হিম্মত থেকেই তৈরী হয়। তারা কি বোঝেন যে এটাই তাদের প্রধান কাজ? আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নাগরিক আর মানবিক অধিকার রক্ষা করবার জন্যই ঐতিহাসিক ভাবে গড়ে উঠেছে। ফরাসি বিপ্লবের নাগরিক ও মানবিক অপধিকারের ঘোষণা যেমন। রাষ্ট্রের মিস্টেরিয়াস কোন ব্যাসিক স্ট্রাকচার, ব্যাসিক ফিচার বা মৌলিক কাঠামো রক্ষার মামলা এটা নয়। নাগরিক ও মানবিক অধিকারের প্রশ্ন বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো বা বেসিক স্ট্রাকচারের চিন্তা গণতন্ত্র বিরোধী । বাংলাদেশের বিচার বিভাগ বিচারকদের গোষ্ঠি স্বার্থ কিম্বা রাষ্ট্রের নির্বাহী ও আইন প্রণয়নী অঙ্গ থেকে নিজেদের ‘স্বাধীন’ করবার কথা যতোটা ভেবেছে নাগরিক ও মানবিক অধিকারের ক্ষেত্রে তাদের দায়দায়িত্ব নিয়ে খুব কমই ভেবেছে।
সেই বেসিক স্ট্রাকচার বা মৌলিক কাঠামো দিয়ে নাগরিকদের কী লাভ যা তাকে রাষ্ট্রের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে পারে না। রাষ্ট্র নাগরিকদের কাছ থেকে তখনই পূর্ণ আনুগত্যের দাবি করতে পারে যখন প্রতিটি ব্যক্তির মানবিক ও নাগরিক অধিকার রক্ষার সংকল্প রাষ্ট্রের গাঠনিক ভিত্তি হয় এবং সেই অধিকার বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে ওঠে। এ কারণে বলা হয় গণতন্ত্রের নানান দার্শনিক ও ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা থাকলেও ব্যক্তির মর্যাদা ও স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতেই নিজের ন্যায্যতা কায়েম রাখতে পারে। নইলে না। গণতন্ত্রের জন্য এই কারণে স্বাভাবিক মনে হয়। কেউ এর বিরোধিতা করলে সেটা অস্বাভাবিক মনে হয়।
গণতন্ত্রের এই ঐতিহাসিক পর্যায় অতিক্রম করতে হলেও গণতন্ত্র দরকার। গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে তার সীমা ও সম্ভাবনা বোঝা যেমন জরুরী তেমনি ওর মধ্য দিয়ে সামাজিকতা ও সামষ্টিকতার বিকাশ ও উপলব্ধিও দরকার। মানুষ ব্যক্তি মাত্র নয়, সে সামাজিকও বটে। সেই দিক পরিচ্ছন্ন করতে হলে ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’, ‘মানুষের মুক্তি’ ইত্যাদি ধারণার দার্শনিক পর্যালোচনাই যথেষ্ট নয় – ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক উপলব্ধির জন্য বাস্তব পরিস্থিতিরও আবির্ভাব দরকার আছে। ব্যক্তির কাছে যখন তার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষাই প্রধান সংকট হয়ে হাজির হয় সে তখন তার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার লড়াইকে মুখ্য গণ্য করে – সমাজ, সামাজিকতা, সামষ্টিকতা ইত্যাদি তার কাছে গৌণ হয়ে থাকে। বাংলাদেশে আমরা এ পর্যায়েই রয়েছি। এ পর্যায়ে মানুষ যখন ঐক্যবদ্ধ হয়, লড়াই সংগ্রাম করে তখন সেটা অনেক সময় সমষ্টির নামে হলেও তার গোড়ায় থাকে তার সম্পত্তির অধিকারের চিন্তা, রাষ্ট্রের সঙ্গে আইনী ও ক্ষমতার সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার ব্যক্তি অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষার তাগিদ, ইত্যাদি। ধ্রুপদি বৈপ্লবিক রাজনীতি এই পর্ব, পর্যায় বা বিপ্লবের স্তরকে সে কারণে ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’-এর স্তর বলে গণ্য করে। গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম এবং এবং গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্য দিয়ে সমাজকে এই উপলব্ধিতে নিয়ে আসা দরকার যে ব্যক্তির মুক্তি সমাজের বাইরে নয়, সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত থেকে সমাজের অভ্যন্তর থেকেই সেটা ঘটতে হবে। ব্যক্তির সত্য সমাজের মধ্যেই স্ফূর্তি লাভ করে। সমাজের বাইরে নয়। নিঃসঙ্গ, একাকী ও সমাজ বহির্ভূত ব্যাক্তির ‘মুক্তি’ বলে কিছু নাই। অন্যদিক থেকে রক্তমাংসের মানুষের জীবজীবন ও পরমার্থিক জীবনের চাহিদা, প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষার বাইরে বিমূর্ত ‘সমাজ’ বলে কিছু নাই। অর্থাৎ সমাজও ব্যক্তির মধ্য দিয়েই ‘সমাজ’ হয়ে ওঠে।
ব্যক্তির মুক্তি, ব্যক্তিতন্ত্র, গণতন্ত্র ইত্যাদি ধারণা অতএব চিরায়ত কিছু নয়। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে মানুষের মধ্যে ব্যক্তিতান্ত্রিক ধারনার উদ্ভব খুবই স্বাভাবিক। যে কারণে ব্যক্তিতান্ত্রিক/গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে তীব্র হয়ে ওঠে। গণতন্ত্র পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থারই মতাদর্শ বলে তার বিরোধিতা করে এই পুঁজিতান্ত্রিক পর্যায় অতিক্রম করে যাওয়া যায় না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ বরং মানুষের চিন্তার এইসকল নানান গোড়ার বিষয় পর্যালোচনার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরি ও রক্ষা করতে পারে। যদি ব্যক্তির মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা না যায় তাহলে নতুন চিন্তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিচার করাও কঠিন হয়ে ওঠে – চিন্তা রুদ্ধ বা বদ্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের মতো দেশগুলো পিছিয়ে আছে শুধু অর্থনৈতিক কারণে নয়, ব্যক্তির মর্যাদার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য উপলব্ধির অভাবের কারণেও বটে। যে কারণে নাগরিক ও মানবিক অধিকারের প্রশ্ন আমামদের কাছে এখনও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু নয়। এটাও আমরা বুঝতে অক্ষম যে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের খুঁটি হচ্ছে নাগরিক ও মানবিক অধিকার। আসল খুঁটিই যদি না থাকে তাহলে রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো বা বেসিক স্ট্রাকচারের তর্ক ভূয়া তর্ক ছাড়া কিছুই নয়। আসল খুঁটি না থাকলে রাষ্ট্রের ভেঙ্গে পড়া ঠেকাবে কে? যে রাষ্ট্র আমার অধিকার নিশ্চিত করে না, সেই রাষ্ট্রের ভেঙ্গে পড়া আমি ঠেকাবো কেন? বরং তাকে ত্বরান্বিত করাই আমার কাজ। সম্প্রতি আন্তর্জাতিকভাবে অধিকার সংক্রান্ত ধারণাও সম্প্রসারিত হয়েছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ছাড়াও অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষাও রাষ্ট্রের কর্তব্য। সেটা আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। যার অর্থ হচ্ছে এই অধিকারগুলো সুরক্ষার দায় আন্তর্জাতিক বিধিবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের ঘাড়ে এসে পড়েছে। সংবিধানে সেইসব সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ থাকুক আর নাই থাকুক।
বিচারকরা জানেন তাঁরা নির্বাচিত নন, কিন্তু তাঁরা এজলাসে বসে যে নির্দেশ দেন সেটা নিছক ‘নির্দেশ বা আদেশ নয় বরং ‘রায়’। এই কারণেই নির্বাহী বিভাগ তা বলবৎ করতে বাধ্য কারণ রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি রক্ষার দায় বিচারকের ওপরই ন্যস্ত। কিন্তু ততক্ষণই কেবল যতক্ষণ তারা প্রতিটি নাগরিকের নাগরিক ও মৌলিক মানবিক অধিকার রক্ষা করতেই এজলাসে বসেন। একটি মামলার বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তাঁরা কিভাবে তা রক্ষা হচ্ছে তা প্রদর্শন করেন। জাতীয় সংসদ কিম্বা নির্বাহী বিভাগ যদি নাগরিক ও মানবিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করে এবং কোন নাগরিক বিচারকের কাছে নালিশ জানান তাহলে তার বিহিত করবার দায় বিচার বিভাগেরই। জাতীয় সংসদ বা নির্বাহী বিভাগ যদি রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকে নষ্ট করতে চায় বা বিকারগ্রস্ত করবার চেষ্টা করে তাহলে তা রুখে দেবার ক্ষমতাও জনগণের তরফে তাঁদেরই হাতে। এই কর্তব্য পালন করতে গিয়ে বিচারকদের সঙ্গে প্রতিটি নাগরিকের যে নৈতিক ও সাংবিধানিক সম্বন্ধ নিরন্তর স্থাপিত ও পুনর্স্থাপিত হতে থাকে তার তাৎপর্য নির্বাচিত প্রতিনিধির আইন প্রণয়নী শক্তি বা নির্বাহী ক্ষমতার চেয়েও অনেক বেশী। এই সম্বন্ধ রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকেই শুধু যাচাই করে না, এই নৈতিক ভিত্তির ক্ষয় ঘটলে রাষ্ট্রের ক্ষয়ও অনিবার্য হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রকে নতুন গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো ছাড়া তখন আর কোন বিকল্প থাকে না। নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বিচারকের ন্যায়পরায়নতা রাষ্ট্রকে শুধু নৈতিক ভিত্তি দেয় তা নয়, সমাজকেও তার নীতিনৈতিকতার জায়গাগুলো বারবার পরখ করে নিতে সহায়তা করে এবং রাষ্ট্রের চরিত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মানদণ্ড হিসাবে কাজ করে। যেমন, অভিযুক্ত নাগরিকের ‘আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইন অনুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভে’র মর্যাদা যদি বিচারবিভাগ বজায় রাখতে ব্যর্থ হয় তাহলে তার পরিণতি হয় মারাত্মক। একজন বিচারক যদি এই ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় তাহলে সেই বিচারককে বিচার বিভাগকে থেকে বরখাস্ত করা যেতে পারে, কিন্তু খোদ বিচার বিভাগই যদি ফ্যাসিস্ট রাষ্টব্যবস্থার অঙ্গে পরিণত হয় তখন সেটা একটি জনগোষ্ঠির জন্য চরম রাজনৈতিক জুলুম হয়ে ওঠে। অকথিত দুর্দশা হয়েই সেটা হাজির হয়।
ফ্যাসিবাদকে অতএব রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইনশাস্ত্রের দিক থেকেই বুঝতে হবে। এই দিকটার ওপরই আমি বারবার জোর দিয়েছি। এই দিকটি পরিচ্ছন্ন না থাকলে বাংলাদেশের বিদ্যমান রাষ্ট্রের চরিত্র এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের সুনির্দিষ্ট কর্তব্য কি হতে পারে সে ব্যাপারে অস্পষ্টতা থেকে যাবে। আমি দেখছি, সমাজের যে সকল রাজনৈতিক প্রবণতা পরস্পরের সম্ভাব্য রাজনৈতিক মিত্র হতে পারে এই অস্পষ্টতার কারণে তারা পরস্পরের রাজনৈতিক দুষমনেও পরিণত হয়ে আছে। কারণ রাজনীতির বিচার হচ্ছে যার যার বদ্ধমূল মতাদর্শ থেকে। এই মুহূর্তের কর্তব্য নির্ধারণের তাগিদ থেকে নয়। এ ব্যাপারে আমাদের সমাজে আলোচনা নাই বললেই চলে। রাষ্ট্র সহ আমাদের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকারকে সামগ্রিক ভাবে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা হিশাবে শনাক্ত করা ও বিশ্লেষণ করা এ কারনে জরুরী। রাষ্ট্রের বিকারের ভয়াবহ দিক হচ্ছে পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সংবিধানের পরিবর্তন এবং দ্বিতীয় দিক হচ্ছে বিচার ব্যবস্থার ক্ষয়। দলীয় হাতিয়ার হিসাবে বিচার ব্যবস্থার ব্যবহার তার প্রকট দিক। নাগরিক হিসাবে এই ক্ষয়ের সবচেয়ে উৎকট নজির হচ্ছে নাগরিকদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষা দূরে থাকুক, উলটা বিচার বিভাগ নাগরিকদের নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
অনেকে মতাদর্শ বা সংস্কৃতি বিচার করেই ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। যেমন দাবি করা হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ যদি ফ্যাসিস্ট হয়ে থাকে তাহলে ইসলামপন্থী রাজনীতিও ফ্যাসিস্ট। অবশ্যই হতে পারে। কিন্তু ক্ষমতায় ইসলামপন্থিরা নাই, ক্ষমতায় রয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা। তারাই সংবিধানের এই দশা করেছে। তারাই ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় রাজনীতি বিরোধিতার নামে মূলত ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের গণভিত্তি হিসাবে ভূমিকা রাখে। হেফাজতে ইসলামকে শাপলা চত্বর থেকে নির্বিচারে হত্যা করে তাড়িয়ে দেবার পক্ষে গণমাধ্যমের নির্লজ্জ ওকালতি দেখেছি আমরা। এই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের পক্ষে বহু জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টকেই আমরা গীত গাইতে দেখেছি। যে কোন মতবাদই যদি পঞ্চদশ সংশোধনীর মত জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করবার কথা সত্য জেনেও তাকে স্বীকার না করে, এবং রাষ্ট্রের পক্ষে সাফাই গায়, তাহলে তাদের অবশ্যই ফ্যাসিস্ট বলতে হবে। তাই না?
কিন্তু আমরা তো এখন আর বলাবলি বা মতাদর্শিক জায়গায় নাই, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যেই আমরা বাস করছি। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণ নানান মতাদর্শ নিয়ে, নানান রাজনৈতিক বিশ্বাসের জায়গা থেকে লড়বে। সেটা যেমন হতে পারে কমিউনিস্টরা, তেমনি হতে পারে ইসলামপন্থিরাও। কিম্বা আওয়ামী লীগ বা বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিরোধিরাও রাস্তায় থাকতে পারে। যে কারণে বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রথমে বিদ্যমান সংবিধান, দ্বিতীয়ত বিচার ব্যবস্থা এবং তৃতীয় পর্যায়েই কেবল বাংলাদেশের বিভিন্ন মতাদর্শ ও সংস্কৃতির বিচার বা পর্যালোচনা কর্তব্য ওঠে। বিশেষত এই দিকটি বোঝাবার জন্য যে কিভাবে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ ও সংস্কৃতি রাষ্ট্রের এই রূপান্তর বা বিকৃতির শর্ত হিসাবে ভূমিকা রেখেছে এবং অন্যন্য মতাদর্শের ফ্যাসিবাদি বৈশীষ্ট বা চরিত্রের বিপদ্গুলো কোথায়। কিন্তু কাজের দিক থেকে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা যায় কিনা সেটাই প্রধান রাজনৈতিক বিবেচনার বিষয় হওয়া উচিত। নীতিগত দিক স্পষ্ট হলে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের কৌশলগত দিকও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শ্রেণি ও শক্তির কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এটা একটি প্রক্রিয়া। নীতির জায়গা হচ্ছে বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপান্তর ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ।
প্রশ্ন উঠতে পারে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই কালে বাংলাদেশের মতো প্রান্তিক দেশগুলোর এই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রূপান্তর অনিবার্য কিনা। এই ক্ষেত্রে আমি মনে করি সেটা মোটেও অনিবার্য নয়। কখনই অনিবার্য ছিল না। যদি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়ন করবার কর্তব্যকে বাংলাদেশের জনগণ বাস্তবায়িত করতে পারত, তাহলে বর্তমান রাজনৈতিক সংকটে আমামদের পড়তে হোত না। তার অর্থ কি? একাত্তরের দশই এপ্রিল তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণায় রাষ্ট্র গঠনের তিনটি আদর্শ গৃহীত হয়েছিল। এক. সাম্য, দুই. মানবিক মর্যাদা এবং তিন. সামাজিক ন্যায় বিচার বা ইনসাফ। এই তিনটি আদর্শের মধ্যেই নাগরিক ও মানবিক অধিকারের সারকথা নিহিত রয়েছে। এই তিনটি আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্যই বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তাহলে প্রয়োজন ছিল এই তিনটি ঘোষিত আদর্শকে ভিত্তি ধরে ঐতিহাসিক ভাবে পরিগঠিত হয়ে ওঠা নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির জন্য একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র (Constitution) প্রণয়ণ করা। কিন্তু জনগণের এই গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ও সংকল্প ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী’ মতাদর্শের মুখে বানচাল হয়ে যায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের গোড়ায় রয়েছে একদিকে বর্ণবাদ (racism) ও সাম্প্রদায়িকতা (racist communalism) আর অন্যদিকে চরম প্রতিক্রিয়াশীল পাতিবুর্জোয়া সমাজতন্ত্র। দুয়ে মিলে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল একাত্তরেই। সাময়িক তাকে পিছু হঠতে হয়েছে বটে কিন্তু গোলকায়নের ফলে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থানের ফলে নতুন পুরাতনে মিলে ফ্যাসিবাদের নতুন একটি চেহারা ও ভুমিকা আমরা এখন দেখছি।
যারা মনে করেন এর বিপরীতে সঠিক রাজনীতি হচ্ছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। এর প্রধান কারন এই ‘জাতীয়তাবাদও’ তার নৃতাত্ত্বিক বা বর্ণবাদী অহমিকা থেকে মুক্ত নয়। শেখ মুজিবর রহমান আদিবাসীদের ‘বাঙালি’ হয়ে যেতে বলেছিলেন এবং ১৯৭২ সালে একটি বর্ণবাদী সংবিধান প্রণয়ণ করেছিলেন। ‘বাঙালি’ ছাড়া অন্য নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠির প্রতি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিভঙ্গীও বর্ণবাদ মুক্ত নয়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নিজেকে ইসলাম অনুরাগী বলে মনে করে, কিন্তু ইসলামে বর্ণবাদ বা জাতীয়তাবাদের কোন স্থান নাই। সম্ভাবনা থাকলেও এই দিকগুলোকে সুস্পষ্ট করে একটি গতিশীল রাজনীতির সূচনা ঘটাবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ব্যর্থ হয়েছে। ইসলামি মতাদর্শের প্রগতিশীল ভূমিকা নিশ্চিত করতে পারে নি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে একটি পালটা প্রতিক্রিয়ামূলক রাজনৈতিক ধারার বেশী তার আর কোন বিকাশ ঘটেনি। এই রাজনীতির প্রশ্রয়ে বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতি হিসাবে যে ধারাগুলো গড়ে উঠেছে তারা ইসলামের ধর্মতত্ত্ব ও নিজ সম্প্রদায়ের ইমান-আকিদার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ কিম্বা জালিম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মজলুমের পক্ষে লড়বার যে ঐতিহাসিক নজির ইসলামের ইতিহাসে আছে তারা সেই ইতিহাসের সঙ্গে সম্বন্ধ রচনা করবার ক্ষেত্রে অগ্রসর হয় নি। এমনকি উপমহাদেশের ইতিহাসের সঙ্গেও নয়। অথচ নানান কারনে ইসলাম বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, তার লক্ষণ এখন অতীতের চেয়েও অনেক বেশী স্পষ্ট। কিন্তু যারা নিজেদের প্রতিশীল বলে দাবি করেন, তারা তার জন্য প্রস্তুত নন।
বাঙালি ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ধারার মধ্যে গভীর ঐক্যের জায়গাও আছে। উভয়েই তাদের পরিচয় নির্ণয় করে একাত্তরের যুদ্ধ থেকে এবং ইসলামকে নিছকই ধর্ম বিশ্বাস হিসাবে দেখে – উপমহাদেশে ইসলামের ইতিহাস হিসাবে নয়। উভয়েই ইসলামকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক জায়গা থেকে ব্যবহার করে। ফলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম অনেক জটিল হয়ে গিয়েছে। ইংরেজের বিরুদ্ধে এই দেশের জনগণের দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম কিম্বা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে প্রতিষ্ঠিত জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগ্রামি ভূমিকার ঐতিহাসিক তাৎপর্য দুই জাতীয়তাবাদের কোনটিই স্বীকার করে না। ইসলাম আর ইংরেজ প্রবর্তিত জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে কৃষকের সংগ্রাম এই ভূখণ্ডে একাকার হয়ে আছে। সে লড়াইয়ে যুক্ত রয়েছে সাঁওতাল, মুণ্ডা ও সমতলের অনেক জনগোষ্ঠি। বাংলাভাষী হিসাবে এই দেশের জনগণের ইতিহাস একই সঙ্গে ইসলাম ও কৃষি ব্যবস্থার বিবর্তনের ইতিহাসও বটে। সেইদিক থেকে কৃষি প্রশ্ন বাদ দিয়ে এই দেশে ইসলাম প্রশ্ন বুঝবার বা জানবার কোন অবকাশ নাই। কিন্তু জাতীয়তাবাদী দুই ধারার কাছে ইসলাম নিছকই ধর্ম মাত্র – এর কোন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ভূমিকা নাই। অন্য ধর্ম সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠির অস্তিত্ব ছাড়াও এই দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগণ একই সঙ্গে বাঙালি ও মুসলমান । সংখ্যা গরিষ্ঠের এই ইতিহাস বাদ দিয়ে বাংলাদেশ গড়া সম্ভব কিনা সন্দেহ। এই অবিভাজ্য পরিচয় যারা যেদিক থেকেই আলাদা করুক তার পরিণতি ভাল হতে পারে না।
বাঙালি ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের তুলনামূলক বিচার এখানে আমাদের উদ্দেশ্য নয়। যে দিকটা আমরা এখানে জোর দিতে চাইছি সেটা হচ্ছে রাষ্ট্রব্যবস্থার ফ্যাসিবাদী রূপান্তর যদি বাংলাদেশের বাস্তবতা হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের মুল ভারকেন্দ্র খোদ এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পরিচালিত হতে বাধ্য। নির্বাচন হবে কি হবে না সেটা গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, গৌণ বিষয়। এটা সমাধান নয়। মূল প্রশ্ন হচ্ছে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথ কি হবে? জনগণ কিভাবে তাদের কর্তব্য নির্ধারণ করবে? গণতান্ত্রিক কর্মসূচি কী হতে পারে? একটি কর্তব্য তো পরিষ্কার সেটা হচ্ছে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অসম্পূর্ণ কাজ সমাপ্ত করা। অর্থাৎ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের নীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার কর্তব্যকে সামনে নিয়ে আসা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসাবে তাদের কিভাবে স্থাপন করব সেই দিকগুলো নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা। এই গোড়ার কাজ ভুলে গিয়ে নির্বাচন করার অর্থ হচ্ছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে ক্ষমতার হাত বদল। এটাই কি আমরা চাই?
এই জন্যই কি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল?
৬ অগাস্ট ২০১২৩। ২২ শ্রাবণ ১৪২০। শ্যামলী।