সুন্দরবন ও জীবনযাপন: আরও কথা


রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিতার পক্ষে সমাজে একটা গণসমর্থন গড়ে উঠেছে। যেহেতু রামপাল প্রকল্পের স্থান ঠিক হয়েছে সুন্দরবন অতএব এই প্রকল্পের বিরোধিতা সুন্দরবন রক্ষার জন্য জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির সুযোগও তৈরী করেছ। কিছু কথা ‘বাঘ, সুন্দরবন ও রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প’ শিরোনামের লেখায় বলেছি। এখন কিছু বাড়তি কথা বলার সুযোগ নেব। কেউ কেউ বলছেন, ‘সুন্দরবন ছাড়া বাংলাদেশ টিকবে না’ – এই কথাটা ঠিক কিনা সেই প্রশ্ন তোলার মধ্য দিয়েই নিজের কথা পেশ করব।

কথাটা প্রতীকী। ইতিবাচক অর্থে আবেগী, অবশ্যই। কিন্তু আক্ষরিক ভাবে  কথাটির অর্থ করা ঠিক না। এ ভাবে বলার মধ্য দিয়ে পরিবেশ রক্ষার আকুতি অনায়াসেই কানে বাজে। রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বিরোধিতা করবার পক্ষে জনমত তৈরীর জন্য এ ধরণের বক্তব্য কাজে লাগতেও পারে। কিন্তু কেউ যদি আক্ষরিক অর্থে কথাটি বুঝে থাকেন, তাহলে বিপদ। তাই একে আক্ষরিক অর্থে ধরে নিয়েই কিছু কথা বলব। যাতে আক্ষরিক অর্থে বোঝার সোমাবদ্ধতা আমরা বুঝতে পারি।

সুন্দরবন না থাকলে বাংলাদেশ না টেঁকার কোন কারন নাই। এমনিতেই সুন্দরবনের একাংশ চকোরিয়া-সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে গেছে, সুন্দরবনের খুলনা-অংশের বিনাশ প্রক্রিয়া রামপাল প্রকল্পের প্রস্তাবেরও আগে থেকেই জারি রয়েছে। রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়ত হলে গরান বন বিলুপ্তির প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হবে। এই তফাৎ। তারপরও বাংলাদেশ থাকবে, তবে সুন্দরবন থাকবে না।

বিদেশি দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সংস্থার পুঁজিতান্ত্রিক উন্নয়ন নীতি ও কৌশল হিসাবে রপ্তানিমুখী সাপ, ব্যাং, গুঁইসাপ, বানরসহ শেষমেষ চিংড়ি রপ্তানির সময় থেকেই এক দশকের মধ্যে চকোরিয়া সাফ হয়ে গিয়েছে, খুলনার সুন্দরবনও একই নীতির কুফলে ধ্বংসের পথে। সুন্দর বনের চিংড়ি ঘের কেন্দ্র করে যে সহিংস ও ভয়াবহ অপরাধের চক্র গড়ে উঠেছে তাও বিশ্বব্যাংক-এডিবিসহ দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক দাতা সংস্থার বিদেশে কম দামে বাংলাদেশের চিংড়ি রপ্তানি করবার নীতির কারণেই। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে বলে আমরা বাহবা কুড়িয়েছি, সেই নীতি এখনও বহাল আছে। রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিতা করছি, কিন্ত একই সঙ্গে পরিবেশ বিধ্বংসী উন্নয়ন নীতিরও বিরোধতা করতে হবে। বেহুঁশ থাকলে চলবে না।

যাদের উন্নয়ন সাহায্য, নীতি ও বন ধ্বংসের বড় কারণ সেই সংস্থাগুলো উল্টা বলে দোষ বাংলাদেশের জনগণের। তারা বলে বন ব্যবস্থাপনার ত্রুটির জন্যই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বন ও বিশেষ ভাবে সুন্দরবন বন ধ্বংস হয়েছে। বন মন্ত্রণালয় ও সরকারী বন কর্মকর্তাদের সীমাহীন দুর্নীতির কথা আমরা জানি। কিন্তু দাতা সংস্থা ও সরকার দায়ী করে স্থানীয় জনগণকে। বনের ক্ষয় ও বিনাশের সমাধান রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর এবং বনের ওপর স্থানীয় জনগণের কর্তৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক নজরদারি প্রতিষ্ঠা। কিন্তু গোড়ার চিন্তা আমরা করি না। ওদিকে বহু এনজিও কিভাবে নতুন ধরণের ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যায় সেই প্রকল্প এখন বাস্তবায়ন করছে। মার্কিন সাহায্য সংস্থা এই ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হাজার বছর ধরে যে সকল স্থানীয় জনগোষ্ঠি সুন্দরবন সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বনের ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করেছিল তাদের উৎখাত কিম্বা বাদ দেওয়া হয়েছে সুন্দরবন রক্ষার নামেই। সুন্দরবনের ব্যবস্থাপনা বিদেশী সংস্থার অধীনেনিয়ে নেবার প্রক্রিয়া চলছে এখন। সুন্দরবন কেন্দ্র করে নানান উন্নয়ন ও পরিবেশ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বনটি বাংলাদেশের হাত ছাড়া করবার প্রক্রিয়া  তো বহালই রয়েছে।

মনে রাখা দরকার বিদেশীদের সুন্দরবন সরাসরি নিজেদের দখলে নেবার দরকার নাই। এটা তো ঔপনিবেশিক আমল না। ধনি ও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো চায় ভিন্ন ধরণের দখল, সেটা হচ্ছে সুন্দরবন ব্যবহারের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা। তারা এর নাম দিয়েছে sustainable utilization ‘টেঁকসই ব্যবহার’। এই উন্নয়ন দর্শনের গোড়ার কথা হচ্ছে স্থানীয় জনগণ বা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ খুবই খারাপ, তারা বনের ব্যবহার জানে না, তাদের এখন টেঁকসই ব্যবহার শিখতে হবে বিদেশিদের কাছ থেকে। সেটা শেখাবে বেসরকারী সংস্থা এবং বিদেশিরা। তারা শেখাচ্ছেও বটে। স্থানীয়দের বন থেকে উৎখাত করা হয়েছে, কিম্বা বন স্থানীয় জনগণের নিয়ন্ত্রণে বা অধিকারে আর নাই। তারা প্রাকৃতিক বনকে ‘রিজার্ভ ফরেস্ট’ বানিয়েছে। যার অর্থ হচ্ছে সাধারণ স্থানীয় মানুষের আর সেই বনের ওপর আর আগের অধিকার নাই। বনে প্রবেশ করতে হলেও তাদের অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হবে। যদি আমরা আসলেই সুন্দরবন রক্ষা করতে চাই তো এই সব গোড়ার প্রশ্ন বাদ দিয়ে কিভাবে তা সম্ভব? রামপাল প্রকল্পের বিরোধিতার পাশাপাশি পরিবেশ, বন ও প্রাণবৈচিত্র বিরোধী নীতির বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে হবে। খণ্ডিত ভাবে নয়।

সুন্দরবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমের অজুহাত হয়ে ওঠে বাঘ বা বিলুপ্ত প্রাণী রক্ষা, কিম্বা ইউনেস্কোর মহৎ ঘোষণায় বগল বাজিয়ে। যথা, সুন্দরবন ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’। এই ধরণের ঘোষণার উদ্দেশ্য বুঝলে আনন্দিত কিছু নাই। যেহেতু সুন্দরবন বিশ্বের সম্পত্তি – বা Common Heritage বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ – অতএব এর ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রন আর স্থানীয় অধি্বাসীদের ওপর কিছুতেই থাকতে পারেনা। বিশ্ব অধিবাসীদেরই নিতে হবে। অর্থাৎ দাতা সংস্থা, নানান কিসিমের কন্সাল্টিং ফার্ম, এনজিও ও কর্পোরেশান সুন্দরবনের দায় নিয়ে আমামদের ভারমুক্ত করপ্তে চায়। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা ওপনিবেশিক শাসন বা ভূমি দখল নয়। কিন্তু এই ব্যবস্থায় কিভাবে নিজেদের ভূখণ্ড ও সম্পদের ওপর জনগণ তাদের সার্বভৌম অধিকার হারায় এইসব হচ্ছে তার নজির। ওদিকে সুন্দরবন সম্পর্কে ইউনেস্কোর সার্টিফিকেট পেয়ে পরিবেশ রক্ষার জন্য কাতর মধ্যবিত্ত শ্রেণি বগল বাজাতে থাকে। গরিব মেহনতি জনগোষ্ঠি– যারা মধু, কাঠ ও অন্যান্য সামগ্রী আহরণের অধিকার ঐতিহ্যগত ভাবে ভোগ করত তারা বনে প্রবেশের অধিকার হারিয়ে নির্বংশ হয় – অর্থাৎ তাদের হাজার বছরের বন রক্ষা ও বন ব্যবস্থাপনার লোকায়ত জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে থগাকে; অথবা জীবিকার তাগিদে এলাকা ছেড়ে শহরের বস্তিতে বাসা বাঁধে – যে শহরের বিচিত্র জঙ্গলের কিছুই তারা জানে না।

 বন চিরদিন বনবাসীরা বা স্থানীয় অধিবাসীরাই রক্ষা করেছে। স্থানীয় মানুষ – লোকায়ত, আদিবাসী বা উপজাতি যাই হোক -- তাদের বাদ দিয়ে বনরক্ষার মানে হচ্ছে বনকে পুঁজির মুনাফার ক্ষেত্রে পরিণত করবার জন্য স্থানীয় জনগণকে বন থেকে বিচ্ছিন্ন ও উৎখাত করা। স্থানীয় জনগোষ্ঠি থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে বন, বন সম্পর্কিত প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্রকে দেখা সে কারণে মূলত সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গী। এই ভাবে দেখা হয় বলেই সুন্দরবনের বাওয়ালি ও অন্যান্য জনগোষ্ঠিকে রক্ষার জন্য আমরা আকুতি বোধ করি না, শহুরে মধ্যবিত্তের আবেগ বাঘ ভাল্লুকের জন্য উথলে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদের জন্য এই আবেগটাই কাজে লাগে।

সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে মস্তো মস্তো লেকচার দেওয়া সহজ, কিন্তু  বাস্তবে এই বিশ্বব্যবস্থা কিভাবে কাজ করে সেটা বোঝা ও অন্যদের বোঝানো সহজ নয়। সাম্রাজ্যবাদ কিভাবে নতুন ধারণা, প্রত্যয়, বর্গ বা ডিস্কোর্স তৈরী করে ও আন্তর্জাতিক পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনে কাজে খাটায় সেটা বোঝার, বিশ্লেষণের এবং প্রতিরোধের রাজনীতি বাংলাদেশে গড়ে ওঠে নি।  প্রাচীন ও বদ্ধ চিন্তা দিয়ে তা সম্ভবও নয়।

দ্বিতীয়ত আমাদের এক অদ্ভূত ধারণা হচ্ছে যে পরিবেশ আর তথাকথিত ‘জীববৈচিত্র’ বুঝি শুধু সুন্দরবনেই আছে। কৃষিতে, নদিতে, সমুদ্রে বা যেখানে সুন্দরবন নাই সেখানে নাই। ফলে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সুন্দরবনে হলে আমাদের আপত্তি আছে, কিন্তু অন্যত্র হলে আপত্তি নাই। আমরা বলি সুন্দরবন খুব ইউনিক পরিবেশ। অথচ সব পরিবেশই এবং প্রতিটি পরিবেশ অনুযায়ী প্রাণের ব্যবস্থাপনা (ইকোলজি ও ইকোসিস্টেম) ইউনিক বা অনন্যই হয়। অনন্য বলেই ‘প্রাণবৈচিত্র’ বা বায়োডাইভারসিটির ধারণা অনিবার্য হয়ে পড়ে।  পরিবেশবাদীদের লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়েি ধারণাটি গড়ে উঠেছে। প্রকৃতির প্রতিটি  ইকোসিস্টেমই অনন্য বলেই তাদের বৈচত্রও প্রাণবৈচিত্র। এ ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা মনে করি পরিবেশ বুঝি আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনেও নাই। পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র সম্পর্কে এও ভারি ভুতুড়ে ধারণা। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে যদি ভাবি ও উপলব্ধি করি আমার দৈনন্দিনের ভোগী জীবনযাপনে আমি প্রাণ ও পরিবেশের কী ভয়ানক ক্ষতি করছি, তাহলে তো পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন নিজের জীবন থেকেই শুরু হতে পারে। সুন্দরবন বা কোন রামসার সাইটে যেতে হয় না। আমরা নিজ নিজ জীবনযাপন বা লাইফ-স্টাইল নিজের সাধ্যমতো কিছুটা তো বদলাতে পারি। তাহলেই তো বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলন বহুদূর এগিয়ে যায়। স্রেফ নিজের ভোগী জীবনের বিরুদ্ধে লড়াই বা জীবনযাপনের নতুন সংস্কৃতির জন্য লড়াইও যে প্রচণ্ড শক্তিশালী রাজনৈতিক লড়াই -- প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার লড়াই -- এই উপলব্ধি আমাদের নাই। আমরা, মানে আমরা যারা শহরে থাকি, নিজেদের শিক্ষিত আর প্রগতিশীল মনে করি, চে গুয়েভারার টি শার্ট পরে নিজের সামাজিক দায় চুকিয়ে দিচ্ছি মনে করি, তাদের কথাই বলছি। তো যেহেতু আমাদের জীবনযাপনকে আমরা প্রাণ ও পরিবেশ আন্দোলনের ক্ষেত্র গণ্য করি না, অতএব আমাদের সুন্দরবনের ‘জীব’ ও ‘বিপন্ন প্রাণি’ খুঁজতে হয়। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ভাগিনা হতে পেরে আমরা খুবই আনন্দিত বোধ করি।

আমরা হচ্ছি জর্জ বুশেরই সন্তান যিনি ধরিত্রী সম্মেলনের সময় বলেছিলেন মার্কিন জনগণের ভোগী লাইফ-স্টাইল বা জীবন যাপন দুনিয়ার পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হলেও, মার্কিনীদের জীবনযাপন বা লাইফস্টাইল নিয়ে কোন দর কষাকষি বা নেগোশিএশান তিনি কারো সঙ্গেই করবেন না। মার্কিনীরা তাদের জীবনযাপনে কোন বদল ঘটাবে না, ফলে কারো সঙ্গে কোন দরকষাকষি না। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রাণবৈচিত্র চুক্তিতে স্বাক্ষরও করে নি। আমরাও তো মার্কন জীবনযাপনই আদর্শ গণ্য করি, উন্নয়নের জন্য এই ভোগী জীবনের মডেলই তো আমরা মাথায় বহন করি। অন্যদিকে আবার বাঘ, সাপ, গুঁইসাপ, পাখি, ডলফিন, কচ্ছপ, কুমির ও আরো নানান বর্ণাঢ্য প্রাণী রক্ষার জন্য কাতর হয়ে যাই। মার্কিনীরাও তাই করে। -- এই তো মধ্যবিত্তের পরিবেশ দর্শন!!

আমাদের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশের জন্য দরদও কম নয়। সুন্দরবন রক্ষার জন্য তারা দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছে। সাহায্য সহযোগিতা দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের মিশন পরিচালক ডেনিস রলিন্স ২০১১ সালে বলেছেন, সুন্দরবন রক্ষার জন্য তাঁদের সাহায্য সহযোগিতা তাঁরা চালিয়ে যাবেন। যে সভায় তিনি কথাটা বলছিলেন সেটা ছিল সরকার, দাতা সংস্থা, এনজিও ও বিভিন্ন কর্পোরেশান, যারা ‘প্রাইভেট সেক্টর’ নামে পরিচিত, তাদের সভা। বাংলাদেশের বন ও জলাভূমিগুলো কিভাবে তারা সবাই মিলে ‘রক্ষা’ করবে এবং রক্ষা করবার যে বিশেষ ব্যবস্থা কায়েম করতে চায় তারই সভা। ব্যবস্থাপনার ধরণ ছিল আলোচনার মূল বিষয়। ব্যবস্থাপনার ধরণ দাতা সংস্থা ও প্রাইভেট সেক্টরের ভাষায় বলা হয় ‘যৌথ ব্যবস্থাপনা’। রলিন্স ব্যখ্যা করে বলেছেন, যৌথ ব্যবস্থাপনাই হচ্ছে সুন্দরবন রক্ষার মর্ম কথা। সেখানে নামে মাত্র স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন রয়েছে। কিন্তু আদতে ‘যৌথ ব্যবস্থাপনা’ হচ্ছে স্থানীয় অধিবাসীদের বনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এমন এক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যার নিয়ন্ত্রণ দাতা সংস্থা ও প্রাইভেট সেক্টরের হাতে থাকে। আর সরকার থাকে তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ভূমিকায়।

এবং আমরাই প্রাণবৈচিত্রকে বলি ‘জীববৈচিত্র’ – কারণ বাঘ তো আসলে জীবই। অথচ আন্দোলন শুধু ‘জীব’ রক্ষার নয় – প্রাণ রক্ষার। যে প্রাণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রেও দেখা যায় না তাদেরকেও তো রক্ষা করবার কর্তব্য আছে পরিবেশ আন্দোলনের, কিম্বা প্রকৃতির যে সম্পর্কের কারণে প্রাণের উদ্ভব, বিকাশ ও বসতি রক্ষা সম্ভব হয় সেই প্রাণব্যবস্থাপনার (ecological complexes, ecosystem) বৈচিত্র রক্ষা করাও প্রাণবৈচিত্র রক্ষার কাজ। প্রাণবৈচিত্র চুক্তিতে সংজ্ঞাটা এরকম:

‘Biological diversity’ means the variability among living organisms from all sources including, inter alia, terrestrial, marine, and other aquatic ecosystems and the ecological complexes of which they are part; this includes diversity within species, between species and of ecosystems.

ভোগী জীবন ও জীবাশ্মভিত্তিক সভ্যতা ‘আধুনিক’ ইন্ডাস্ট্রিয়াল জীবনযাপনের মডেল। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা এই মডেলেরই সার্বজনীন রূপ দাঁড় করিয়েছে। এই গোড়ার গোলমাল আমরা সাধারণত বুঝি না বা বুঝতে চাই না। কারণ আমরা আধুনিকই হতে চাই। গোড়ার ফাঁকিটা সবার আগে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে পরিবেশ বিরোধী টেকনলজির প্রবর্তন ও প্রকৃতির ওপর মানুষের বিজয় কেতন ওড়াবার বিপজ্জনক খায়েশের ওপর গড়ে ওঠা ‘বিজ্ঞান’, ‘প্রযুক্তি’ ইত্যাদি ধারণার বিপদ। এইসকল ধারণার পর্যালোচনা ছাড়া পরিবেশের ধারণাও পরিচ্ছন্ন হবে না। একই সঙ্গে দরকার ‘প্রগতি’ নামক প্রাচিন ও প্রথাগত ধারণার পর্যালোচনা -- নইলে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক নির্ণয়ের নতুন সাংস্কৃতিক উপলব্ধি ঘটা অসম্ভব। এই গোড়ার কাজগুলো না হলে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র রক্ষার পক্ষে যে সচেতনতা তৈরী হয়েছে তাকে সঠিক অভিমুখ দেওয়া যাবে না। নইলে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র আন্দোলন বড় জোর হবে ইন্ড্রাস্টিয়াল সভ্যতার মানোন্নয়ন বিভাগের কেরানিগিরি।

একই ভাবে অর্থনীতিবাদী চিন্তার প্রাধান্য সম্পর্কেও হুঁশিয়ার হওয়ার দরকার। অনেক মার্কসবাদীরাও মনে করেন, প্রকৃতি বুঝি মানুষের ভোগের জন্যই শুধু হাজির, কিম্বা প্রকৃতি উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল সরবরাহের ক্ষেত্র শুধু হাতিয়ার তৈরীর উৎস বা কারখানা। ভোগে বা উৎপাদনে না লাগলে প্রকৃতির বুঝি কোন মূল্য নাই, অথচ এই ধারণা পুঁজিতান্ত্রিক সমাজেই প্রবল হয়ে ওঠে, আর এই সমাজে যারা বাস করে তাদের অজান্তে মনে গেঁড়ে বসে। আর পুঁজির কাছে মুনাফা তৈরীর কাজে না খাটলে প্রকৃতি তো আসলেই অর্থহীন। এই কালে প্রাণ, পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলন মাত্রই এই সকল গোড়ার জায়গাগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ও পরিচ্ছন্ন করবার কাজ।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।