হুঁশিয়ার বাংলাদেশ


এ লেখা যখন লিখছি, তখন আঠারো দলীয় জোটের ডাকা হরতাল চলছে। হেফাজতে ইসলামও তাদের দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য কর্মসূচী দিয়েছে। সংলাপের মাধ্যমে – অর্থাৎ উদার বা লিবারেল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের কোন সুযোগ আদৌ ছিল কিনা তা নিয়ে এখন কূটতর্ক হতে পারে, কিন্তু তার কোন উপযোগিতা আর নাই। হরতালের মতো কর্মসুচী দেয়া শুরু হয়ে যাবার পর রাজনীতির গতিমুখ বোঝা যাবে আগামি কয়েক দিনেই। আগামি ৭ তারিখের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে একটি পর্ব শেষ হবার পর আরও অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ওদিকে সাত তারিখ থেকে হেফাজতে ইসলামের ১৫ তারিখের সমাবেশ অবধি কী ঘটে তার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ লেখা হয়ে যাবে। তাতে কোন সন্দেহ নাই।

আমি এই লেখা লিখছি চরম উদ্বিগ্নতা থেকে। এই উদ্বিগ্নতা ও উৎকন্ঠার অনেকগুলো দিক আছে। প্রথম দিক হচ্ছে আদর্শিক, দ্বিতীয় নৈতিক, তৃতীয় বর্তমান রাজনীতির অভিমুখ নির্ণয়ের দিক এবং চতুর্থত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার দিক। আদর্শিক দিক হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা। সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা ছাড়া কোন গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন অসম্ভব। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই দেশে প্রত্যেকেই নাগরিক। নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করার প্রধান বা মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এরপর নাগরিকদের। কিন্তু আমরা দেখেছি রামুতে বৌদ্ধ জনপদ ও উপাসনালয়ে যখন হামলা হয়েছিল ক্ষমতাসীনরা তা বন্ধ করতে পারে নি। কিম্বা করে নি। নাগরিকরা তীব্র ভাবে তার প্রতিবাদ করেছেন। দলমত নির্বিশেষে সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যে শক্তি আমরা দেখেছি তা কম নয়। কিন্তু দলীয় ও মতাদর্শিক বিভাজনের কারণে তাকে সংঘবদ্ধ সামাজিক শক্তি হিসাবে আমরা হাজির করতে পারি নি। তারপরও সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে যারা যেখানে দাঁড়িয়ে লড়েছেন তাদের আমরা অভিনন্দন না জানিয়ে পারি না।

কিছুদিন থেকে অমুসলিম নাগরিকদের ওপর যে হামলা শুরু হয়েছে তা লক্ষণ হিসাবে খুবই বিপজ্জনক। সাঁথিয়ায় যে ঘটনা ঘটেছে তার সঙ্গে রামুর ঘটনার আশ্চর্য মিল আছে। এটা পরিষ্কার যে কোন না কোন অশুভ শক্তি বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে চায়। ফায়দা তুলতে চায়। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তা খুবই বিপজ্জনক। ইতোমধ্যে অনেকে ঘরে বসে না থেকে রাস্তায় প্রতিবাদ করছেন, জনগণকে অশুভ বিপদ সম্পর্কে সচেতন করছেন। তাঁরা আমাদের ধন্যবাদের পাত্র। তাঁদের প্রতি সকলের পূর্ণ সমর্থন ও সংহতি জানানো উচিত। এই বিপজ্জনক মুহূর্তে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কোন বিশেষ রাজনৈতিক পক্ষকে দায়ী করা হবে খুবই ভুল নীতি। কারণ সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রশ্নে সমাজকে যে কোন মূল্যে ঐক্যবদ্ধ রাখাই আমাদের কাজ। নইলে যারা ঘোলা জলে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছে আমরা তাদের রাজনীতির ক্রীড়নকে পরিণত হবো।

আমি দাবি করছিনা যে সুনির্দিষ্ট ভাবে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে, বা হাতেনাতে কোন প্রমাণ থাকলে আমরা তাদের দোষী করব না। অবশ্যই করব। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা শুধু ইসলামি দলগুলোই করে এই বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক মানসিকতা থেকেও আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।পাবনার হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের চন্দন কুমার চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেছেন, “এটি একটি ষড়যন্ত্র বলে আমাদের ধারণা”। প্রথম আলো মনে করে তার কথাকে আমলে নেয়া দরকার। এ’ব্যাপারে আমরা সম্পুর্ণ একমত।

আমাদের অবস্থান হবে সরকারকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেওয়া এবং বিরোধী জোটকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে বাধ্য করা। সাধারণ নাগরিকদের পক্ষ থেকে আমরা বিরোধী জোটকে হুঁশিয়ার করে দিতে চাই যে এখন যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেষ্টা হচ্ছে তার লক্ষ্য বিরোধী দলীয় আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেওয়া। অতএব তাদের অবশ্যই উচিত অবিলম্বে জেলায় জেলায় তাদের সংগ্রাম কমিটিগুলোকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সক্রিয় করে তোলা। এই ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে তাদের আন্দোলন সংগ্রামও ব্যর্থ হতে বাধ্য।

মনে রাখা দরকার, সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, বিরোধী দল ক্ষমতায় আসলে এদেশে একটি হিন্দুও থাকবে না। তার এই অভিযোগকে হাল্কা ভাবে নেবার কোন সুযোগ নাই। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভাবে বিরোধী দলীয় জোটের বিরুদ্ধে প্রচারণার এটা একটি প্রধান দিক। এই একটি মাত্র দোষে বিরোধী দলীয় রাজনীতি বাংলাদেশে সম্পূর্ণ পরাস্ত ও পর্যুদস্ত হতে পারে। কারণ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে যে কারণেই হোক বিরোধী জোট যেসব পয়েন্টে এখনও আস্থা অর্জন করতে পারে নি তার একটা হল যে তারা ক্ষমতায় এলে অমুসলিম নাগরিকরা নিরাপদ থাকবে কিনা। আন্তর্জ্জাতিক মহলের এই রিডিং ভুল বা ঠিক যাই হোক বিরোধী জোটকে এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। অমুসলিমদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে সক্রিয় থেকেই নেতিবাচক আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি কাটিয়ে তোলা সম্ভব।

অতএব সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে বিপজ্জনক গণ্য করে তা মোকাবেলার রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক উপযুক্ত প্রস্তুতি নিতে হবে। বাস্তব কাজে দেখাতে হবে। তা না নিয়ে শুধু কুচক্রী মহলের বিভেদ সৃষ্টির পাঁয়তারা বলে দায়সারা গোছের মন্তব্য কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। বিরোধী দলীয় জোট এই ক্ষেত্রে কিভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা মোকাবিলা করবে আমরা নাগরিকরা তা স্পষ্ট ভাবে জানতে চাই।

বিরোধী রাজনৈতিক দল্গুলো সরকারী দমন নিপীড়নের মুখে আছেন, আমরা জানি। তারপরও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া, প্রতিবাদ বিক্ষোভ জানানো এবং জেলায় জেলায় কর্মীদের হুঁশিয়ার থাকার জন্য সতর্ক করে দেওয়া প্রাথমিক কাজ। তারপর স্থানীয় ভাবে কারা এই ধরণে ঘৃণিত কাজ করছে তাদের খুঁজে বার করা ও তথ্য প্রমাণ হাতে রাখার জন্য এলাকার সমর্থকদের নির্দেশ দেওয়াও দরকারী কাজ। সাম্প্রদায়িকতার প্রতিরোধ করারা সংকল্প ও সাফল্যের ওপর বিরোধী জোটের রাজনৈতিক সাফল্য নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

সবচেয়ে বেশী হুঁশিয়ার হতে হবে ইসলামপন্থীদের। ঘটনা যারাই ঘটাক পুরা দোষ তাদের ওপর চাপানোর চেষ্টা চলবেই। ইতোমধ্যে তা শুরুও হয়ে গিয়েছে। জামাত শিবিরের ওপর দোষ চাপানো সাধারণ ফর্মুলা। তবে এবার মূল আঘাত আসবে হেফাজতে ইসলামের ওপর।

এতে উৎকন্ঠিত হবার সমূহ কারণ রয়েছে। হেফাজতে ইসলাম জামাতে ইসলামীর মতো সংঘবদ্ধ দল নয়। যদিও গ্রামে তাদের অনুসারী ও সমর্থকও প্রচুর। আবার যে কোন ঘটনায় গ্রামের যে কোন লোককে ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে হেফাজতি প্রমাণ করা সহজ। হেফাজতে ইসলাম এই পরিপ্রেক্ষিতে কিভাবে সাংগঠনিক ভাবে সাম্প্রদায়িক হামলা বা দাঙ্গা প্রতিরোধ করবে সেটা তাদের অবিলম্বে ভেবে দেখতে হবে। এই ক্ষেত্রে তাদের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি জানানো যেমন দরকার তেমনি অবিলম্বে একে মোকাবিলার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ খুবই জরুরী।

হেফাজতে ইসলাম এ ব্যাপারে সচেতন রয়েছে বলে মনে হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফি সম্প্রতি বলেছেন, “ইসলাম ধর্মে সংখ্যালঘুদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। তাই হেফাজতে ইসলাম কখনোই সংখ্যালঘুদের প্রতি কোনো নির্যাতন করেনি। হাটহাজারী মাদ্রাসার কাছেই দেড়শ’ বছরের পুরোনো মন্দির রয়েছে। সেখানে কখনো কেউ হাত দেয়নি।’ অমুসলিম ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন, “আপনাদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। যারা আমাদের সম্পর্কে আপনাদের নিকট মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে, তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকুন”। (দেখুন RTNN)এগুলো নিঃসন্দেহে আশার কথা। হেফাজতের কর্মীদের এখন উচিত তাঁর ঘোষণা ও নির্দেশকে বাস্তব রূপ দেওয়া। অতএব জেলায় জেলায় অমুসলিম নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার জন্য তাঁদের উচিত হবে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ ও কর্মসূচী গ্রহণ করা।

আমি আবারও বলছি, বর্তমান রাজনৈতিক সংঘাত থেকে ফায়দা তোলার জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা তৈরীর আশংকা মোটেও অমূলক কিছু নয়। এই ধারার রাজনীতি ও পরিকল্পক দেশে বিদেশে আছে। আমি আশা করব সরকার তার দায়দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ ও ধর্মীয় আন্দোলনকেও প্রমাণ করতে হবে এই একটি প্রশ্ – বাংলাদেশে অমুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার প্রশ্নে তারা উপমহাদেশে আদর্শ স্থাপন করতে সংকল্প বদ্ধ।

নইলে এই একটি অজুহাতই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের কারণ হবে। আফগানিস্তানে ছুতা ছিল নারী, বাংলদেশে ছুতা হবে অমুসলিম জনগোষ্ঠি।

হুঁশিয়ার বাংলাদেশ। হুঁশিয়ার এ দেশের কৃষক শ্রমিক সাধারণ মানুষ, হুঁশিয়ার বাংলাদেশের প্রগতিশীল তরুণ সমাজ, হুঁশিয়ার ইসলামের ইমান-আকিদায় বিশ্বাসী অসাম্প্রদায়িক ধর্মপ্রাণ মানুষ, হুঁশিয়ার ইসলামী রাজনীতিতে বিশ্বাসী সেইসব মানুষ যারা জানেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর নিরাপত্তা, মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করারা মধ্য দিয়েই ইসলাম নিজেকে ইনসাফ কায়েমের ধর্ম হিসাবে প্রমাণ করতে পারে। অন্য কোন ভাবে নয়।

সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ কায়েমের রাজনীতি আমাদের সকলকেই ঐক্যবদ্ধ করুক, এই প্রত্যাশা করি।

৪ নভেম্বর ২০১৩। ২০ কার্তিক ১৪২০। আরশিনগর। ইশ্বরদী।

-------

এ ব্যাপারে  ভারতীয় পত্রপত্রিকায় খবর পরিবেশনের ধরন বুঝতে হলে দেখুন, Muslim mob vandalises 26 Hindu houses in Bangladesh, November 4, 2013। ছবিটি উল্লেখিত পত্রিকা ইন্ডিয়ান একপ্রেস থেকে নেওয়া।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।