সুজাতা সিং পুরানা চিন্তাই ফেরি করলেন


এক

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে শেখ হাসিনার এক তরফা নির্বাচনের পথকেই সম্মতি জানিয়ে গেলেন; দিল্লী ঢাকাকে যেটা জানাতে চেয়েছে সেটা ভারতীয় পত্রপত্রিকা ও তাদের থিংক ট্যাংকগুলোর সুবাদে আমরা জানি। সুজাতা সিং নেপালের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, সেখানেও একটি দল নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিয়েছিল, কিন্তু শেষাবধি সেখানে নির্বাচন হয়েছে। অতএব নির্বাচন বর্জনের পরোয়া না করে শেখ হাসিনাকে ‘গণতন্ত্রের স্বার্থেই’ নির্বাচন করতে হবে, এটাই উচিত কাজ। (দেখুন প্রথম আলো, ‘গণতন্ত্রের স্বার্থেই নির্বাচন হওয়া উচিত’, ৬ ডিসেম্বর ২০১৩)। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় দিল্লী সবার অংশ গ্রহণে নির্বাচনে হোক সেটাই চায় কিনা বাংলাদেশের সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন। সুজাতা সিং বলেছেন, ‘অধিকাংশের অংশগ্রহণ’ কাম্য। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করা গেলে দিল্লীর তাতে বিশেষ আপত্তি থাকবে না।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দিল্লীর এই বিবেচনাবর্জিত অদূরদর্শী অবস্থান দায়ী, এটা আমি অন্যত্র অনেকবার বলেছি। সুজাতা সিং তার প্রমাণ দিয়ে গেলেন। আজ এখানে একই কথা আবার বলব না। বরং সকলকে বুঝতে বলব, ভারত একটি বড় ও সমৃদ্ধশালী দেশ হতে পারে, কিন্তু দিল্লী রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার দিক থেকে পশ্চাতপদ; সেটা তার পররাষ্ট্র নীতির মধ্যে প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে। এর একটা বড় কারণ দিল্লীর পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণে রাজনীতিবিদদের চেয়েও আমলাদের ভূমিকা প্রধান। ফলে দুরদর্শী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী দিল্লীর কাছ থেকে আশা করা দূরাশা মাত্র।

দিল্লীর প্রশ্রয়ে ও সমর্থনে শেখ হাসিনা যে-পথ অবলম্বন করছেন তা বাংলাদেশকে রক্তে পিচ্ছিল করে তুলবে। আর তাকে নির্বিচার সমর্থন দেবার কারনে এ লড়াই একই সঙ্গে হয়ে উঠবে দিল্লীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের লড়াই। ইসলামাবাদও এই রক্তাক্ত পথে বাংলাদেশকে নিয়ে গিয়েছিল, সফল হয় নি। দিল্লীও সফল হবে না। একটি ভারতীয় গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে সমস্যা মূলত ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির। ভারতে আগামি বছর নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক সংঘাত দেখা দেবার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনীতি তার সঙ্গেও জড়িত হয়ে পড়েছে। সে বিষয়েও দুই একটি কথা বলব। তবে তার আগে কিছু তত্ত্ব কথা ও প্রাসঙ্গিক মন্তব্য।

বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, একথা আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনছি। কিন্তু ‘ভুরাজনৈতিক গুরুত্ব’ কোন স্থির ধারণা নয়। বিশ্ব বদলাচ্ছে, বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তন ঘটছে এবং পরিবর্তনের যারা কর্তাশক্তি তাদের শক্তির হ্রাসবৃদ্ধি এবং রূপান্তরও ঘটছে। আসলে কী ঘটছে তার ওপর নজর রাখা এবং সঠিক অবস্থান নির্ণয় করাবার জন্য যে-গবেষণা, বিশ্লেষণী দক্ষতা ও দূরদৃষ্টি দরকার দিল্লীর সেটা নাই, একথা বিভিন্ন গবেষক নানান সময়ে বলছেন। কথাটা উঠবার কারন হচ্ছে গত কয়েক দশকে অর্থনৈতিক ভাবে ভারতের সমৃদ্ধি। এই সমৃদ্ধি বিশ্বপর্যায়ে না হোক আঞ্চলিক ভাবে ভারতকে মোটামুটি একটা পরাশক্তির মর্যাদা পাবার জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব পর্যায়ে না হোক, আঞ্চলিক পর্যায়ে ভারত অবশ্যই একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র। কিন্তু এই সমৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করবার জন্য প্রতিবেশী ছোট দেশগুলোর সঙ্গে সঙ্গতি-পরায়ন পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়ণ ও বাস্তবায়নের ক্ষমতাও বেড়েছে এ প্রমাণ দিল্লী দিতে পারে নি। সেখানে সবসময়ই ফুটে উঠেছে অদূরদর্শিতা ও সংকীর্ণ চিন্তা। এই দেশগুলোর জনগণের আত্মমর্যাদা বোধ ও স্বাধীন চেতনাকে দিল্লী সম্মান দিতে শেখে নি। সম্পর্কের ধরণ রয়ে গিয়েছে পুরানা ঔপনিবেশিক চরিত্রের, এই দেশগুলোকে নিজের কলোনির অধিক কিছু দিল্লী ভাবতে শেখে নি।

ভারত আধিপত্যবাদী শক্তি, সেটা নতুন কোন তথ্য নয়। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র কিনা তা নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলে, ডান ও বাম উভয় শিবিরেই। যারা মার্কসের অর্থশাস্ত্র এবং সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে ভ্লাদিদমির ইলিচ লেনিনের তও্ব মানেন তারা ভারতকে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করতে বিশেষ আপত্তি করেন না। তবে এই অর্থে যে বিশ্বব্যাপী পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার এই কালে ভারতকে বিশ্বব্যবস্থা থেকে আলাদা ভাবে বিচার করার কোন যুক্তি নাই। ধ্রুপদী সাম্রাজ্যবাদের একটি বিশেষ চরিত্র লক্ষণ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর পরস্পরের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতা। আর সেই দিক থেকে ভারত এই প্রতিযোগিতার বাইরে নয়। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যে স্বার্থের মিল নাই তা নয়, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ মানে একাট্টা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নয়। পুঁজি এই স্তরে একচেটিয়া রূপ পরিগ্রহণ করে, কিন্তু বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা কমে না। এগুলো তাত্ত্বিক কথা মনে হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের নীতি অনুধাবন করতে হলে তথ্য যথেষ্ট নয়, তত্ত্ব ছাড়া তথ্য ব্যাখ্যা করা যায় না। বিস্তর তথ্য সংগ্রহ জঞ্জালের স্তুপ তৈরী করতে পারে, কিন্তু তত্ত্ব পরিচ্ছন্ন না থাকলে তথ্য থেকে কোন সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ বা কংক্রিট অর্থ বের করা সম্ভব নয়। তত্ত্ব দিয়েই বোঝা যায়, বাংলাদেশের প্রশ্নে দিল্লী, ওয়াশিংটন, ইংলণ্ড, ব্রাসেলস কিম্বা বেইজিং-এর মধ্যে মিল থাকলেও তাদের পারস্পরিক স্বার্থ সবসময় সমান্তরালে চলে না। সাম্রাজ্যবাদের চরিত্রের কারণেই চলতে পারে না। পার্থক্য থাকে। তথ্যের কাজ হচ্ছে কোথায় পার্থক্য আর কোথায় মিল সেই দিকগুলো সুনির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত করা। নতুন কোন তথ্য তত্ত্ব সংশোধনের তাগিদ তৈরী করলেও তাকেও সুনির্দিষ্ট ভাবে শনাক্ত করা। ইত্যাদি।

অন্য যে কোন দেশের মতো বাংলাদেশ ভারতের বাজার। ভারতের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের জন্য মুনাফা অর্জনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। পুঁজির নিজের একটা লজিক বা অন্তর্গত বিধান আছে। তাকে পুঁজির চরিত্রও বলা যায়। ভারতীয় পুঁজি রামায়ন মহাভারত পড়ে রাম কিম্বা রাবণের চরিত্র নিয়ে বাংলাদেশে আসে না, পুঁজির চরিত্র নিয়েই আসে। সেইদিক থেকে ইয়াংকি কি বিলাতি কি হিন্দু পুঁজির এমন কোন চরিত্র নাই যা পুঁজির সার্বজনীন চরিত্র থেকে আলাদা -- আর সেটা হচ্ছে মুনাফা অর্জন এবং তা নিশ্চিত করবার জন্য অন্য পুঁজির সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার চেষ্টা।

এগুলো সবই সত্যি। কিন্তু কথা উঠেছে ভারত একটি শক্তিশালী দেশ হয়ে ওঠার পরেও রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি তার আচরণ এতো পশ্চাতপদ কেন? তাৎক্ষণিক তাত্ত্বিক উত্তর হচ্ছে শুধু পুঁজির বিমূর্ত বিশ্লেষণে আমরা দিল্লীর পররাষ্ট্র নীতি বা কূটনীতি বুঝবো না। বরং একটি দেশের পুঁজিতান্ত্রিক রূপান্তর সেই দেশের ঐতিহাসিক বাস্তবতায় কি ধরণের  শ্রেণি, সংস্কৃতি ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী করছে সেই দিকেও নজর ফেরাতে হবে। ভারতীয় আমলারা ঔপনিবেশিক শিক্ষা,  মনমানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গী ধারণ করেই 'আমলা' হয়। দিল্লীকে বুঝতে হলে ভারতীয় আমলাতন্ত্রের হদিস নেওয়া জরুরী হয়ে পড়ে।  দ্বিতীয়ত অর্থনৈতিক ভাবে দিল্লীর সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র আছে, রাজনৈতিক কারণে নিপীড়িত দেশ হিসাবে সাম্রাজ্যবাদের  মন্দ দিকটার প্রতি নজর রাখতেই আমরা ব্যস্ত থাকি। বিশেষত লড়াই-সংগ্রামের জায়গাগুলো যেখানে শনাক্ত করা হয়।  কিন্তু 'সাম্রাজ্য' কথাটাকে ব্যপক ভাবে বুঝতে চাইলে সাম্রাজ্যবাদী দেশ কিভাবে নিজের ক্ষমতা ও প্রভাবের বলয় ধরে রাখার জন্য অবস্থা ভেদে অধীনস্থ দেশগুলোর সঙ্গে  আচরণ বদলায় বা বদলাতে বাধ্য হয়, সেই দিকে আমরা কমই নজর রাখি।  এই ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ঔপনিবেশিক শক্তির পার্থক্য বিবেচনায় নিতে হবে। 'সাম্রাজ্য' রক্ষা করতে হলে অধীনস্থ দেশ বা জনগোষ্ঠির প্রতি কিছু দায়দায়িত্বও বর্তায়, দিল্লীর সেই দায়িত্ব নেবার সামর্থ নাই। লুটেরা ভূমিকা ছাড়া দিল্লী অন্য কোন ভূমিকা পালন করতে অক্ষম। দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা ও কর্ম সংস্থান বাড়ানো সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে টিকে থাকার জন্য  দিল্লীর দরকার, দিল্লী তা বুঝতে এখনও অক্ষম।  দিল্লী কিভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা (South Asian Association of Regional Cooperation) বিকাশের টুঁটি টিপে ধরে রেখেছে সেই নীতি বিচার করলেই দিল্লীর চিন্তার সংকীর্ণতা ধরা পড়ে। পুঁজিতান্ত্রিক গোলোকায়ন ও ভূরাজনৈতিক কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সমতা ও আত্মমর্যাদার ভিত্তিতে গড়ে উঠলে বৃহৎ দেশ হিসাবে দিল্লীরই লাভ, দিল্লীর আমলাদের এই কাণ্ডজ্ঞানের প্রকট অভাব রয়েছে। বিশেষত চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দিল্লীর প্রতিযোগিতার  দিক থেকে বিচার করলে এর গুরুত্ব অপরিসীম।

দিল্লীর নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ। এই ক্ষেত্রেও দিল্লীর দৃষ্টি সংকীর্ণ। বাংলাদেশের সঙ্গে দিল্লীর সম্পর্কের অবনতিকে এই ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসাবে হাজির করা যায়। একাত্তর সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের যে গভীর মৈত্রীর বন্ধন ও সম্পর্ক মাত্র তিন বছরের মাথায় দিল্লী প্রতিমা বিসর্জনের মতো সেই সম্বন্ধ বঙ্গোসাগরে ডুবিয়ে দিল। শেখ মুজিবরের হত্যা একটি কারণ, কিন্তু দিল্লী তা রোধ করতে পারে নি। কিম্বা করে নি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ ৭২ থেকে ৭৫ সালের মধ্যে বদলে গিয়েছে তাতো নয়। দিল্লীর বোঝা উচিত ছিল কেন এই বদল ঘটল। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, কিন্তু দিল্লী তাকে ব্যাখ্যা করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ বিজয় হিসাবে। দিল্লী ও দিল্লীর সমর্থকেরা বার বার প্রমাণ করতে চেয়েছে একাত্তর হচ্ছে দ্বিজাতিতত্ত্বের পরাজয়, অখণ্ড ভারততত্ত্বের বিজয়। আসলে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এটাই প্রমাণ করেছে দক্ষিণ এশিয়া বিভিন্ন জাতি, ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির দেশ। বাংলাদেশের মত বিভিন্ন জাতিসত্তা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের কিম্বা স্বাধীনতার জন্য লড়বে। লড়বেই। বাংলাদেশে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তারা জানেন স্বাধীনতার আকুতি কি জিনিস, এই এক আগুন যাকে নেবানো কঠিন। কিন্তু দিল্লী নির্মম ও নিষ্ঠুর ভাবে কাশ্মিরের জনগণকে আজ অবধি দমন করে চলেছে। দমন করছে নাগা, মিজো, মণিপুরী, ত্রিপুরী, অসমিয়া বা অহমসহ আরও অনেকে জাতিগোষ্ঠির। যুদ্ধ চালাচ্ছে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে, যারা মাওবাদীদের নেতৃত্বে সংগঠিত। এ সবই ভারতের আভ্যন্তরীণ সংকট। রাজনৈতিক সংকটের মীমাংসা রাজনৈতিক ভাবেই নিষ্পন্ন করা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। কিন্তু দিল্লী তা সমাধান করতে চেষ্টা করে আসছে সামরিক পদ্ধতিতে, নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এই সকল সমস্যা বা সংকটকে দিল্লী প্রায় কখনই তার নিজের রাজনৈতিক সমস্যা হিসাবে স্বীকার করতে চায় না। বরং উল্টা অন্য দেশের ওপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে। তাই আরও অনেক কারন ছাড়াও প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি দিল্লীর পশ্চাতপদ আচরণের একটি ব্যাখ্যা কাশ্মির কিম্বা বাংলাদেশের প্রতিবেশী সাতটি রাজ্যের প্রতি দিল্লীর ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গীকে অনেকে দায়ী করেন। বাংলাদেশকেও দিল্লী তার উপনিবেশের অধিক কিছু গণ্য করে কিনা সন্দেহ।

বাংলাদেশের জনগণ ভারতের জনগণকে বন্ধু গণ্য করে। বাংলাদেশের নিজের গরজেই এই বন্ধুত্ব দরকার। এতোটুকু বুঝলে দিল্লী এই বন্ধুত্বকে মর্যাদা দিত। বাংলাদেশ ছোট দেশ। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারবে না। তিন দিক থেকেই ভারত বাংলাদেশকে ঘিরে রেখেছে। ফলে ভারতের সঙ্গে শত্রুতা তৈরী বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী, এতটুকু বোঝার মতো কাণ্ডজ্ঞান বাংলাদেশের জনগণের আছে। অথচ দিল্লীর নীতিনির্ধারকরা একবারও ভেবে দেখতে চায় না, দিল্লীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ক্ষোভটা কীসের? বাংলাদেশের সীমান্তে যদি কুকুর বেড়ালের মত বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যা করা হয়, ফেলানির লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয় কাঁটাতারের বেড়ার ওপর – তাহলে এই ক্ষোভ পরিণত হয় দ্রোহে। আন্তর্জাতিক নদির পানির ন্যায্য হিস্যা দিল্লী যখন বুঝিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়, তারপর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আবার পানির প্রবাহ উজানে বাঁধ দিয়ে ও ড্যাম বসিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় তখন বাংলাদেশের জনগণ মনে করে দিল্লী বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষকে পানিতে মারতে চেষ্টা করছে। দিল্লী এক তরফা বাংলাদেশের বুকের মধ্য দিয়ে করিডোর চায়, অথচ বিনিময়ে কিছুই দিতে রাজি না। আমাদের ঘরের ভেতর দিয়ে দিল্লী আসা যাওয়া করবে, আমাদেরই তা করে দিতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ এতে বিক্ষুব্ধ। দিল্লী কখনই এ দেশের সাধারণ মানুষের উপলব্ধি ও আত্মমর্যাদা বোধকে মূল্য দেয় নি।

মূল্য দেওয়া দূরে থাক, যখনই বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এই ক্ষোভ দেখা গিয়েছে তাকে বোঝার চেষ্টা না করে দিল্লী প্রচার করেছে এই সব পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের কাজ। আইএসআই, সি আই এ, এমআই ৬, মোসাদ – কে নাই বাংলাদেশে? আইএসআই তার স্বার্থের জায়গা থেকে কাজ করে নিশ্চয়ই, কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও করে। প্রতিটি দেশ তাদের নিজ নিজ স্বার্থ দেখে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গোয়েন্দা সম্পর্কের প্রশ্ন নয়। একটি বড় দেশের সঙ্গে প্রতিবেশী ছোট একটি দেশের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ কূটনৈতিক সম্পর্ক। কিন্তু দিল্লীর প্রচারে মনে হয় বাংলাদেশের জনগণ আহাম্মক আর উজবুক। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীন হয়েছে; দিল্লী মনে করে তাদের গোয়েন্দা সংস্থার কথা শুনে বাংলাদেশের জনগণ ভারতের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে! এর চেয়ে হাস্যকর আর কিছুই হতে পারে না।

এই সকল কারনে এই সিদ্ধান্তে আসা অন্যায় নয় ভারত বড় দেশ ও অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ হতে পারে, কিন্তু বুদ্ধিবিবেচনা ও চিন্তাচেতনার দিক থেকে দিল্লীর নীতিনির্ধারকরা সংকীর্ণ ও পশ্চাতপদ। আফসোস, তারা মৌলবাদ আর পাকিস্তানের ভূত ছাড়া বাংলাদেশে আর কিছুই দেখে না। অথচ এই দেশ ১৬ কোটি মানুষের দেশ। হাসিনা ক্ষমতায় না আসলে বাংলাদেশে মৌলবাদীরা ক্ষমতায় আসবে দিল্লীর বর্তমান নীতি এই ভুলতত্ত্ব দ্বারা পরিচালিত। সুজাতা সিং তারই প্রতিনিধি হয়ে ঘুরে গেলেন।

বাংলাদেশের একটি দৈনিক পত্রিকা খবর দিয়েছে ভারতের গোয়েন্দারা সম্প্রতি তাদের সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছে বাংলাদেশ আগামী দিনে ভারতের ঘুম কেড়ে নিতে পারে। সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে হাতিয়ার করে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ভারতকে ‘বিব্রত, ব্যতিব্যস্ত ও রক্তাক্ত’ করতে পারে।

ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নাকি মারাত্মকভাবে ভাবে বিঘ্নিত হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বোঝার চেষ্টা না করে তাকে গোয়েন্দা তৎপরতার বিষয়ে পরিণত করার উদ্দেশ্য বোঝা কঠিন কিছু নয়। কিন্তু এর পেছনে যে-অনুমান কাজ করে সেটা হচ্ছে দিল্লীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের ক্ষোভবিক্ষোভের কোন ভিত্তি নাই। সেটা একান্তই পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের কাজ। পাকিস্তানী গোয়েন্দারা এখন বাংলাদেশে সক্রিয়, তারা বাংলাদেশের পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে ভারতের বিরুদ্ধে উস্কিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাতে পারে। খুবই উর্বর চিন্তা। দৈনিক প্রথম আলোর দিল্লী প্রতিনিধি এই রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। ছাপা হয়েছে নভেম্বরের ২৩ তারিখে। (দেখুন, গোয়েন্দাদের সতর্কবার্তা: ভারতের ঘুম কেড়ে নিতে পারে বাংলাদেশ)।

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে এই প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ভারতের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি্র মূল্যায়ন। বলা হয়েছে, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঘটনা ‘সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতাকে’ জাগিয়ে তুলছে। ভারতে আগামি বছর নির্বাচন। বলা হয়েছে, সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই সাম্প্রদায়িক বিভাজন রাজ্যবিশেষে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। নির্বাচন যতোই এগিয়ে আসছে উত্তর-পূব ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধিই এই দাঙ্গার মূল লক্ষ্য হবে – গোয়েন্দা প্রতিবেদনের এটাই হচ্ছে মূল কথা। এতে বাংলাদেশের জনগণেরও উদ্বিগ্ন হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের সম্পর্কেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ এ ব্যপারে অবশ্যই সচেতন। যে কারনে আমরা বারবারই বলে আসছি সকল ধর্ম বিশ্বাসী ও ধর্ম সম্প্রদায়ের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নির্ভর করে। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।

সুজাতা সিং আমাদের জন্য নতুন কোন আশার সঞ্চার করেন নি। দিল্লীর অদূরদর্শিতা এই অঞ্চলের পরিস্থিতিতিকে কোথায় নিয়ে যায় সেটাই এখন দেখার বিষয়।

৬ ডিসেম্বর ২০১৩। ২২ অগ্রহায়ন ১৪২০। আরশিনগর।

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।