রাজনৈতিক অসুখের ‘চিহ্ন’ ও তাৎপর্য

বাংলাভাষায় ‘লক্ষণ’ কথাটা আমরা ইংরেজি ‘সিম্পটম’ অনুবাদ করতে গিয়ে ব্যবহার করি। গ্রিক symptomat বা symptoma থেকে ল্যাটিন হয়ে ইংরেজিতে সিম্পটম। এর অর্থ কোন দুর্ঘটনা, দুরবস্থা বা দুর্দশায় পতিত হওয়া – যার ঘটেছে তিনি সেটা উপলব্ধি করেন। এটা সাবজেক্টিভ – অর্থাৎ ব্যাক্তির বোধ, উপলব্ধি অনুভব ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত। ডাক্তারি শাস্ত্রে এটি যখন ব্যবহার শুরু হোল তখন এই সাবজেক্টিভ বা ব্যাক্তির উপলব্ধির দিকটার ওপর জোর রইল। রোগের লক্ষণ মানে রোগটা কি সেটা না জানা থাকলেও রোগী নিজে যা উপলব্ধি করেন সেটাই ‘লক্ষণ’। যদি সিম্পটম অনুবাদের ক্ষেত্রে ‘লক্ষণ’ ব্যবহার করতে না চাই, তাহলে এর একটি ভাল বাংলা অনুবাদ আছে। সহজ। সেটা হোল ‘অসুখ’। অসুখ বা সুখের অনুপস্থিতি ব্যাক্তিগত উপলব্ধির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু রোগের পরিবর্তে ‘অসুখ’ কথাটা আমরা ব্যাবহার করি বলে সিম্পটমের অনুবাদ ‘লক্ষণ’ হয়ে গিয়েছে। তবে এই ক্ষেত্রে উপসর্গ কথাটাও ব্যবহার করা হয়।
এর বিপরীতে আরেকটি ধারণা হোল রোগের চিহ্ন (sign)। চিহ্ন রোগীর ব্যাক্তিগত উপলব্ধির ওপর নির্ভর করে না। সেটা বাইরে থেকে অন্যেরা দেখতে পারে। রোগের চিহ্ন রোগী বুঝতে পারুক বা না পারুক বাইরে থেকে ধরা যায়। বাইরে থেকে রোগের চিহ্ন দেখলে বলা যায় কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু লক্ষণ বা চিহ্ন এর কোনটাই রোগ নির্ণয় নয়। মানে রোগীর উপলব্ধি বা বাইরে থেকে ধরা পড়া রোগের চিহ্ন দুটোর একটিও আসল রোগ নয়। ঠিক কী হয়েছে সেটা লক্ষণ, চিহ্ন বা উপসর্গ দেখে বা অসুস্থতা উপলব্ধি করে বোঝা যাবে না। রোগ নির্ণয় করা না গেলে রোগের চিকিৎসা অসম্ভব।
কথাগুলো ভাবছিলাম বাংলা ভাষা বা রোগতত্ত্ব নিয়ে নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে। হঠাৎ করে আওয়ামি লীগের অন্দর মহলে যে আলোড়ন দেখা যাচ্ছে সেটা কীসের ‘অসুখ’ কিম্বা কীসের ‘লক্ষণ’? আলোড়ন তুলেছে মূলত দৈনিক প্রথম আলো। কর্নেল আবু তাহের সম্পর্কে মহিউদ্দিন আহমেদের লেখালিখি নিয়ে প্রথম তোলপাড়টা শুরু হয়। আবু তাহের সম্পর্কে যে জাসদীয় বয়ান গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে প্রায় বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে, মহিউদ্দিনের নিবন্ধ তার তলা থেকে মাটি সরিয়ে নেয়।
নতুন জাসদীয় বয়ানের মূলকথা হচ্ছে শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি জাসদীয় আনুগত্য।
আওয়ামি ঘরানার রাজনীতি করেও জাসদ শেখ মুজিবর রহমানকে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে উৎখাত করতে চেয়েছিল। এটাই ইতিহাস। জাসদ ছিল হাসানুল হক ইনুর ভাষায় একটি ‘জঙ্গী’ সংগঠন। এই রাজনীতির পতনের পর জাসদীয় রাজনীতি যে-বয়ানের ওপর দাঁড়াতে প্রাণপণ কোশেশ করেছে সেটা হোল শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি সবিশেষ আনুগত্য প্রমাণ, বা ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসার রাজনীতি। এরই নগদ পুরস্কার হচ্ছে হাসানুল হক ইনুর মন্ত্রীত্ব। এই আনুগত্য প্রমাণের অংশ হিসাবেই কর্নেল আবু তাহেরের ভূমিকা প্রায় অলক্ষ্যে বদলে দেওয়া হোল।
আবু তাহের শেখ মুজিবর রহমানকে ক্ষমতা থেকে সশস্ত্র ভাবে উৎখাতের জন্যই গণবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য – একই কারণে সেই সময় বিএনপির জন্ম না হলেও পরবর্তীতে বিএনপি যে রাজনীতির জন্ম দিয়েছে তিনি তারও বিরোধী হতেন – কিন্তু এখন আওয়ামি লিগের প্রতি জাসদের আনুগত্য প্রমাণের জন্য তাঁকে ব্যবহার করা হোল জিয়াউর রহমান ও বিএনপিকে পর্যুদস্ত করবার কাজে। সাধারণ সৈনিকদের সংগঠিত করে সামরিক অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা এবং সংকীর্ণ ও সংক্ষিপ্ত কায়দায় ক্ষমতা দখল – এটাই ছিল সেই সময়ের জাসদ নেতৃবৃন্দের রাজনীতি। যার সঙ্গে ক্ষমতার বৈপ্লবিক রূপান্তরের কোনই সম্পর্ক নাই – জাসদ কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমকে দিয়ে সেই আত্মঘাতী রাজনীতিটাই করিয়ে নিয়েছিল। এটা কোন ভাবেই জনগণকে সম্পৃক্ত করে গণ অভ্যূত্থানের পরিকল্পনা ছিল না, বরং সাধারণ সৈনিকদের উসকিয়ে দিয়ে অফিসারদের হত্যার করে দ্রুত ক্ষমতা দখলের অবাস্তব, ভুল ও হঠকারী চিন্তা। কৌশল ব্যর্থ হবার পর ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলা যার জন্য ছিল অবধারিত। জাসদ নেতারা সেটা পরিষ্কারই জানতেন। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসির মঞ্চে বলী দিয়ে হাসানুল হক ইনু ও তাঁর সহকর্মীরা আজও বেঁচে আছেন, রাজনীতি করছেন এবং এখন মন্ত্রী। কিন্তু কর্নেল আবু তাহের নাই। বাংলাদেশ একজন মুক্তিযোদ্ধা ও অকুতোভয় বিপ্লবীকে হারিয়েছে। তাঁকে আবার আওয়ামি লীগের রাজনীতির যূপকাষ্ঠে নতুন করে বলী দেওয়া হোল। সম্প্রতি শেখ হাসিনার আমলে তাঁকে আদালত নতুন করে ‘দেশপ্রেমিক’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেন আদালত সিদ্ধান্ত না দিলে আবু তাহের বাংলাদেশের জনগণের কাছে 'দেশপ্রেমিক' বলে গণ্য হতেন না।
ব্যাক্তির ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ভূমিকার মূল্যায়ন ইতিহাস ও রাজনীতির দ্বারা সাব্যস্ত না হয়ে আদালত দিয়ে নিষ্পন্ন করার চিন্তাটা এবসার্ড একটা চিন্তা। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা এক অভূতপূর্ব ও অবিশ্বাস্য ভূতুড়ে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কর্নেল আবু তাহের সহ যেসব মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার করে বিভিন্ন ঘটনায় ফাঁসি দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাঁদের অবদানের জন্য নতুন করে মূল্যায়ন ঐতিহাসিক কর্তব্য। সেটা আদালতের কাজ না। দলীয় স্বার্থবুদ্ধির বাইরে দাঁড়িয়ে এই দেশের সাধারণ মানুষকে একদিন না একদিন সেই কর্তব্য পালন করতেই হবে। নতুন করে বর্তমান আদালতে কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমের বিচার ছিল একান্তই রাজনৈতিক, জিয়াউর রহমানকে পর্যুদস্ত করা। তাকে একজন খুনি শাসক হিসাবে প্রমাণ করা মাত্র। জিয়াউর রহমানের সমালোচনা অবশ্যই হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসকে একজন ব্যাক্তি ও একটি পরিবারের ইতিহাসে পর্যবসিত করবার রাজনৈতিক বয়ান তৈয়ারির জন্য যেভাবে আবু তাহেরকে ব্যবহার করা হোল তাতে তাঁর মর্যাদা বেড়েছে কিনা সন্দেহ। ইতিহাসের দিক থেকে দেখলে বরং এতে তাঁকে দ্বিতীয়বার ফাঁসিতে ঝোলানো হোল।
শেখ মুজিবর রহমানকে ভালবাসবার বা তাঁর প্রতি আনুগত্যের কোন কারন কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমের ছিল না। কিন্তু নতুন জাসদীয় রাজনীতি নিজেরা যেমন আওয়ামি লিগের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য বেচাইন হয়ে উঠেছিল, তেমনি তাদের প্রমান করতে হয়েছে আবু তাহেরও আদতে আওয়ামি লিগই করতেন, শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি তার আনুগত্যের কমতি ছিল না।। কিন্তু মহীউদ্দিন আহমদের লেখা প্রথম আলোর নিবন্ধে বলা হয়েছে, শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যুর খবরে সিরাজুল আলম খান বিচলিত হলেও আবু তাহের উল্টা কেন তার লাশ সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয় নি সেই আক্ষেপ করেছেন। অর্থাৎ শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি আবু তাহেরের অনুরাগ থাকা দূরের কথা বরং বিদ্বেষ ছিল। এটা জাসদকে আওয়ামি বান্ধব প্রমাণ করতে যারা গত কয়েক দশক ধরে কাজ করছেন তাদের জন্য নতুন বিড়ম্বনা তৈরি করেছে।
জাসদীয় আনুগত্যের বয়ানটা তৈরী হয়েছিল বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামি প্রপাগান্ডা ও প্রচারনার স্বার্থে। এর সার কথা হচ্ছে জাসদ আওয়ামি বান্ধব একটি দল। জাসদের দুষমনি একান্তই বিএনপির সঙ্গে কারন জিয়াউর রহমান অন্যায় ভাবে আবু তাহেরকে কারাগারে গোপনে বিচার করেছেন এবং ফাঁসি দিয়েছেন। আদালতও সাম্প্রতিক রায়ে বলেছে, ১৯৭৬ সালে মিলিটারি ট্রাইবুনালে আবু তাহেরের ফাঁসি ছিল, 'outright murder' -- স্রেফ খুন। সেই সময়ের প্রধান সামরিক প্রশাসক জিয়াউর রহমানই এই হত্যার পেছনে মূল কলকাঠি নাড়িয়েছেন। শেখ মুজিবর রহমান ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার পেছনে জিয়ার রহমানের ভূমিকা খুঁজে বের করার কথাও আদালত বলেছে। বিচার বিভাগের রায়ের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে আদালতে কার্যত খুনি প্রমাণ করা ছিল আওয়ামি লিগের জন্য বড় ধরনের জয়। আদালত একই সঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান হত্যার জন্যও জিয়াউর রহমানকে দায়ী করেছে।
আবু তাহেরকে গোপনে বিচার করে ফাঁসি দেওয়া ছিল আইন ও মানবাধিকার উভয় দিক থেকেই চরম অন্যায় একটি কাজ। বিএনপির পক্ষে যে যুক্তি দেওয়া হয় সেটা হোল আবু তাহের সেনা অফিসারদের বিরুদ্ধে সাধারণ সৈনিকদের উস্কানি দিয়ে সেনাবাহিনীতে বিশৃংখলা তৈরি করেছিলেন এবং অফিসারদের হত্যায় ইন্ধন যুগিয়েছিলেন। তার ফলে রাজনীতির সেই টালমাটাল মূহূর্তে অফিসারদের প্রবল চাপ থাকার কারনে এ ছাড়া কোন উপায় ছিল না। এই অফিসাররা মুক্তিযুদ্ধ করেন নি, পাকিস্তান থেকে ফিরে এসেছিলেন। এই সময়ের নির্ভরযোগ্য ইতিহাস আমাদের জানা নাই। ফলে জিয়াউর রহমান অফিসারদের চাপে পড়ে তাহেরকে ফাঁসি দিয়েছিলেন, নাকি তার অন্য কোন কারন ছিল সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট অবস্থান নেবার মতো নির্ভরযোগ্য তথ্য কম। ফলে রাজনীতি কিভাবে মানবাধিকার ও আইনী প্রক্রিয়ার বিরোধী হয়ে উঠেছিল সেটা এখনও পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশে ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত বোঝার মতো যথেষ্ট তথ্য আমাদের হাতে নাই।
আবু তাহেরের উৎপাদক সেনাবাহিনীর ধারণা আমার কাছে রোমান্টিক চিন্তার অধিক কিছু মনে হয় নি। কখনই। কিন্তু সেই সময়কে বোঝার জন্য বিপ্লব, সৈনিকের ভূমিকা ও সৈনিকতা, গণবাহিনী, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি সম্পর্কে পেটি বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির রোমান্টিক চিন্তা ভাবনাকে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। এগুলো ঐতিহাসিক উপাদান। বাংলাদেশের ইতিহাস অনেকাংশেই এই ধরণের স্বপ্ন দ্বারা তাড়িত ও প্রভাবিত ছিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাবার জন্য আবু তাহের খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। যিনি ফাঁসির দড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর স্বপ্ন, কল্পনা বা আদর্শকে অস্বীকার করেন নি। সেটা বহন করেই তিনি ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছিলেন। এর মধ্যে মহত্ব্ব আছে, সন্দেহ নাই, কিন্তু চিন্তার সীমাবদ্ধতা, কিম্বা চিন্তাশূন্যতার মধ্য দিয়ে যে আত্মত্যাগ সেটা রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বাংলাদেশের বিকাশে কোন কাজে লাগে না। তার যে সম্ভাবনা অবশিষ্ট আছে সেটাও দ্রুত এখন নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে।
কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম (১৪ নভেম্বর ১৯৩৮ - ২১ জুলাই ১৯৭৬)
"ধরো সুর্যোদয় -- সেতো আজো যথারীতি উঠে আসে
সে কিন্তু দেখেছে সবি: ফাঁসি, রজ্জু, হত্যা ও খুন
একটি কাঠের ক্রাচ কারাগারে দেয়ালের পাশে
বৃক্ষ হয়ে জেগে আছে। সেখানে লেগেছে ফাল্গুন
বিদ্রোহের উত্থানের বিপ্লবের নিবিড় শিল্পের --
অব্যূদয় ফোটে কাঠে অজানা তা নাই সূর্যের।"
'আবু তাহেরের কাঠের ক্রাচ' -- আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে (১৯৬৮-১৯৮৩)
তারপরও তাহেরের ফাঁসি আমাদের অনেককেই গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। এখনও করে। আমি তাঁকে নিয়ে গান গেয়েছি ‘সাত তাড়াতাড়ি যাচ্ছি হেঁটে...’, ‘আবু তাহেরের কাঠের ক্রাচ’ শিরোনামে কবিতাও লিখেছি। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে এতো বড় আত্মত্যাগের পরও তাঁকে কেন্দ্রে রেখে বাংলাদেশে কোন রাজনৈতিক ধারা গড়ে ওঠে নি। গড়ে উঠবে না। সৈনিকতা – অর্থাৎ বাংলাদেশের মত দরিদ্র অথচ শত্রু পরিবেষ্টিত একটি দেশে সেনাবাহিনীর ভূমিকা, নাগরিকতা ও সৈনিকতার সম্পর্ক -- ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সদুত্তর খোঁজার জন্য আবু তাহের আমাদের কোন কাজে আসেন না। সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিকদের বিএসএফ হত্যা করছে নিয়মিত। সেটা আঞ্চলিক সম্প্রীতি বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন দ্বারা বন্ধ হবে সেটা ভাববার কোনই কারন নাই। বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রতিরক্ষা নাগরিকদেরই নিশ্চিত করতে হবে। কি ভাবে করবো সেই বুদ্ধি দেবার মতো মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সচেতন ও শিক্ষিত হয়ে ওঠা কোন সৈনিক এখন আর অবশিষ্ট নাই। কেউ শেখ মুজিবর হত্যার মধ্য দিয়ে নিজেদের নিঃশেষ করেছেন, কেউ জিয়াউর রহমানকে। আবু তাহের জাসদের রাজনীতি করে নিজেকে নিঃশেষ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদান থাকা সত্ত্বেও কেউই মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা করে নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অলিন্দে সৈনিকতার এই মর্মান্তিক ও করুন ইতিহাস দীর্ঘশ্বাস হয়ে থাকবে আরও বহুদিন।
জাসদের রাজনীতির উত্থান ঘটেছে জিয়াউর রহমানের বিরোধিতা করে নয়, একান্তই শেখ মুজিবর রহমান ও আওয়ামি লীগের বিরোধিতা করে। সত্তর দশকে তো আর বিএনপি ছিল না। ভুলে যাবার কথা নয় গণবাহিনী গঠিত হয়েছিল শেখ মুজিবর রহমানকে সশস্ত্র ভাবে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করবার জন্য। অতএব এটা অনুমান করা যায় শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি জাসদের কোন নেতা বা কর্মীর কোন আবেগমন্থিত অনুরাগ থাকবার কারন নাই। কিন্তু যখন জাসদকে বিএনপির দুষমন আর আওয়ামী ঘরানারই একটি ধারা হিসাবে আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু হোল তখন আওয়ামি বান্ধব অনুরাগের চল শুরু হোল। এই অনুরাগের চর্চা চলছিল মোটামুটি ভালভাবেই।
যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের খোঁজ খবর রাখেন এবং গবেষণা করেন তারা জানেন যে জাসদ মূলত ‘মুজিব বাহিনী’র বিবর্তনের ইতিহাস। এটা আওয়ামি লীগের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। এটা নতুন না। মতাদর্শিক দিক থেকে দিল্লী সমর্থিত বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের নিজেদের ঘরের লড়াই। শেখ মুজিবর রহমানের আমলেই এই বিভেদ তীব্র আকার ধারণ করেছিল যার ফলে জাসদ ও গণবাহিনীর উদ্ভব। এই ক্ষত আওয়ামি লীগ ও জাসদ দুই পক্ষকেই লম্বা দিন বহন করতে হয়েছে। ইন্টারেস্টিং দিক হোল নিজেদের শোচনীয় পতন ও ক্রমাগত ক্ষয়ের পর আওয়ামি লীগে ফিরে আসার জন্য জাসদ যে বয়ান গত তিন দশকে হাজির করছে তার প্রধান দিক হচ্ছে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ‘মুজিব বাহিনীর’ যে অংশ শেখ মুজিবর রহমানকে ক্ষমতা থেকে অপসারন এবং সাধারণ সৈনিকদের সেনা অফিসারদের বিরুদ্ধে উসকিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পঙ্গু করে দেবার রাজনীতি করে আসছিল সেই আদি ইতিহাস মুছে ফেলতে হবে। যেভাবেই হোক মুজিব বাহিনীর এই অংশকে আবার আওয়ামি লীগে ফিরে যেতে হবে। দেখাতে হবে তাদের প্রধান শত্রু বিএনপি এবং বিএনপির অধীনস্থ জোট।
এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে শেখ হাসিনার পারিবারিক ক্ষমতার সহযোগী হিসাবে দাঁড়ানোই মুজিব বাহিনীর এখনকার অবশিষ্ট অংশের নিয়তি। বিডিআর বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে অফিসার হত্যার মতো ঘটনা ঘটবার পর ক্ষমতাসীনদের অন্দর মহলে কারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন মুজিব বাহিনীর সেই ব্যক্তিগুলোকে চিহ্নিত করলে এখনকার টানাপোড়েনের অনেক কিছুই আমরা বুঝব। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা দাবি করছে যে মুক্তিযুদ্ধের মনগড়া কেচ্ছাকাহিনী নয়, আসলে কিভাবে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল, কারা দিয়েছিল, কোথায় দিয়েছিলো, কেন দিয়েছিলো ইত্যাদি খুঁটিনাটি আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে জানা। বিশেষত কারা কোথায় কার কাছে ট্রনিং নিয়েছিলেন এবং তারা এখন কে কোথায় আছেন সেটা জানা জরুরী। এই দিকগুলো জানলে এখন আওয়ামি লীগের অন্দর মহলে যে টানাপড়েন চলছে তার অনেক কিছুরই পশ্চাত কারন বোঝা যাবে।
দুই
প্রথম আলোতে কলাম লেখক মহিউদ্দিন আহমদের লেখা নিয়ে বিতর্কের পর নতুন বিতর্ক উঠেছে আবদুল করিম খন্দকারের বই নিয়ে। ঐতিহাসিক তথ্য হিসাবে কারো লেখা সত্য কি মিথ্যা সেটা বড় কোন রাজনৈতিক সমস্যা তৈরি করে না, ইতিহাস চর্চা তার নিজের পদ্ধতির মধ্য দিয়েই সেইসব নিরসন করে। শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন কি ছিলেন না, এটা ইতিহাসের বিষয়। তিনি যদি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে থাকেন, তাতে কি? বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর কেন্দ্রীয় ভূমিকা এতে খুব একটা হেরফের হয় না। কিন্তু আওয়মি লীগ এই বিষয়টিকে ইতিহাসের বিষয় নয় – আইন ও ক্ষমতার বিষয়ে পর্যবসিত করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বিচিত্র উদাহরণ তৈরি করেছে। আদালত রায় দিয়েছে শেখ মুজিবর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক। এটা রায় – অতএব এটা অস্বীকার করা যাবে না। ঐতিহাসিক সত্যের মীমাংসা আদালতের রায় দিয়ে নির্ণয় করবার এই দৃষ্টান্ত আন্তর্জাতিক ভাবেও বিপুল কৌতুহলের সৃষ্টি করেছে।
একজন মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সের ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ এবং সেক্টর কমাণ্ডার ফোরামের সংগঠক ও প্রধান স্থপতি এ কে খোন্দকারের লেখা থেকে যখন এই সিদ্ধান্ত বেরোয় যে শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন নি এবং তিনি স্বেচ্ছায় পাকিস্তানীদের হাতে ধরা দিয়েছেন তখন ক্ষমতাসীনদের বয়ান তাদের আদালত, রায় ও ক্ষমতা শেকড়বাকড়সহ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। শেখ মুজিবর রহমানকে জাতির পিতা বা জাতির জনক বানাবার বয়ানটিও প্রশ্নবোধক হয়ে ওঠে। যিনি পাকিস্তান ভাঙতে চান নি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ঘোষণা দেন নি, তিনি কি করে জাতির পিতা বা জাতির জনক হতে পারেন? মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার হিসাবে একে খোন্দকারের বই সে কারনে আওয়ামি লীগকে এলোমেলো করে দিয়েছে। বিশেষত তাদের যারা শুধু বাংলাদেশ নয় – এমনকি আওয়ামি লীগের ইতিহাসকেও শেখ মুজিবর রহমান ও তার পরিবারের ইতিহাসে পর্যবসত করতে চায়। আওয়ামী লীগের রোগের লক্ষণ এখানেই। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এখন তাদের অসুখ নিজেরা উপলব্ধি করছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের ইতিহাসকে একটি পরিবারের ইতিহাস হিসাবে পর্যবসিত করবার যে প্রাণপণ প্রয়াস ক্ষমতাসীনরা করে সেটাও একে খোন্দকারের বইয়ের কারনে নড়বড়ে হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের জন্য এটা বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে হাজির হয়। একই সঙ্গে আদালতের জন্যও। আদালত এখন কি করবে? এ কে খোন্দকারকে গ্রেফতার করবে? শাস্তি দেবে? ইতিহাস তো আদালতের বিষয় নয়, আদালত কেন তার এখতিয়ারের বাইরে ভূমিকা রেখেছিল? জনগণকে এখন আদালতকেই জবাবদিহি করতে বাধ্য করার কথা উঠবে। আদালতকে তো কোথাও না কোথাও জবাবদিহি করতে হবে। সেটা কোথায়? আদালত কোথায় নিজের এখতিয়ারের বাইরে কাজ করেছে বলে জবাবদিহি করবে? কোথায়?
অথচ এ কে খোন্দকার যা বলেছেন তা নতুন কিছু নয়। এইসব তথ্য আমাদের আগে থাকতেই জানা। শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দিয়েছেন, এটা তো মোটেও নিন্দার কিছু না, বরং তাঁর দূরদৃষ্টির লক্ষণ। একদমই দুর্বলতার নয়। তিনি হোচি মিন বা মাও জে দং ছিলেন না। তিনি একটি পেটি বুর্জোয়া নির্বাচনবাদী ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক দলের নেতা। তিনি নিজেও পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। এই বিষয়ে বহু বছর আগে থেকেই আমি বলে আসছি যে শেখ মুজিবর রহমান ধরা না দিলে বাংলাদেশ স্বাধীন হোত না। তাঁকে পালিয়ে ভারতে যেতে হোত এবং তিনি দিল্লির এজেন্ট হয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন করছেন এটা পাকিস্তানী শাসকদের প্রমাণ করা সহজ হোত। শেখ মুজিবর রহমান আইনী বলয়ে থেকে একটি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করেছেন। তিনি সশস্ত্র যুদ্ধের কথা ভাবেন নি। করতেও চান নি। সম্ভবত এই নিয়মতান্ত্রিক ও আইনী রাজনীতিই তাঁর সাফল্যের মূল কারন। বরং নির্বাচনী রাজনীতির মধ্যে থেকেও যারা যুদ্ধের কথা বলতেন ও বলেছেন তাদের কোন সামরিক পরিকল্পনা ছিল না। ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার। তাঁদের সাহস ও বীরত্ব নিয়ে গল্পগাঁথা উপন্যাস লেখা যাবে, কিন্তু তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে জনগণের কাছে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক প্রতীক হয়ে ওঠেন নি। পঁচিশে মার্চের পর তারা পালিয়ে গিয়েছিলেন ভারতে। যারা বাংলাদেশের ভেতরে যুদ্ধ সংগঠিত করেছে তাদের অধিকাংশই ছিলেন মার্কসবাদী লেনিনবাদী রাজনীতির অনুসারী। কাদের সিদ্দিকীর মতো আওয়ামি ঘরানার ভুমিকার কথাও মনে রাখা দরকার। কিন্তু তখন তারা ছাত্র লীগের বড় কোন নেতা ছিলেন না। এদের ইতিহাস নানান ভাবে মুছে ফেলার রাজনীতিই আওয়ামি লীগ করেছে। এখনও করে যাচ্ছে।
ইতিহাস লিখবার সময় কি করা উচিত ছিল সেই ঔচিত্যের জায়গা থেকে বিচার না করে কী আসলে ঘটেছে সেই দিকে মনোযোগ দেওয়াই সঠিক কাজ। তারপর তার তাৎপর্য নিয়ে তর্ক হতেই পারে। আমি সবসময়ই মনে করেছি শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা না দেওয়া, আইনী পরিমণ্ডলে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এবং পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে ধরা দেওয়া --সবগুলো পদক্ষেপই ছিল সঠিক ও রাজনৈতিক নেতা হিসাবে তাঁর দূরদৃষ্টির প্রমান। ফলে এ কে খোন্দকারের বই এবং তার তথ্য আমার কাছে নতুন কোন তাৎপর্য বহন করে না। কিন্তু তিনি যা দেখেছেন, বুঝেছেন ও লিখে প্রকাশ করেছেন সেই সততার জন্য তিনি অবশ্যই প্রশংসার পাত্র।
আমাদের নগদ লাভ হচ্ছে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমাণ্ডার যখন তথ্যগুলো দেন তখন আওয়ামী লীগের অসুস্থ অবস্থার ‘লক্ষণ’ আমরা বুঝে যাই। সেটা হোল মুক্তিযুদ্ধের যে-বয়ানের ওপর শেখ হাসিনার রাজনীতি দাঁড়িয়ে আছে --- মুক্তিযুদ্ধের পুরা কৃতিত্ব তাঁর পরিবারের কৃতিত্বে পর্যবসিত করা – সেই বয়ান ভেঙে পড়ছে। খোন্দকার আওয়ামি লীগের ভেতরের মানুষ, বাইরের কেউ নন। তাঁর বিরুদ্ধে আওয়ামিওয়ালাদের হামলা দেখে বুঝি এই অসুখ বেশ গভীর। যারা আওয়ামী লীগকে একটি পারিবারিক দল হিসাবেই টিকিয়ে রাখতে চায়, তাদেরকেই দেখছি এ কে খোন্দকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশী রেগে গিয়েছেন। তাদের ক্রোধান্বিত চেহারা অনেক কিছুই আমামদের প্রকাশ করে দেয়।
নিজের অসুখ আওয়ামি লীগ নিজে উপলব্ধি করে কিনা সেটা আমরা আন্দাজ করতে পারি কিন্তু এখনও পুরাপুরি জানি না। তবে লক্ষণ দেখে বুঝি গণমাধ্যমের সঙ্গে আওয়ামিপন্থিদের বড় একটি অংশের সম্পর্ক বাড়ছে যারা টের পেয়ে গিয়েছে এই সরকারের আর বেশি দিন নাই এবং আওয়ামি রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে একটি পরিবারের স্বার্থকে আওয়ামি স্বার্থ মনে না করে বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাসের দিকে নজর দেওয়া। একই সঙ্গে ইতিহাসে অবদান রাখবার ক্ষেত্রে যার যার ঐতিহাসিক প্রাপ্য রয়েছে সেটা কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়ে দেওয়া।
হয়তো বাংলাদেশের জনগণকে আবার ঐক্যবদ্ধ করবার এটা একটা পথ। কে জানে!
১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪/ ২৮ ভাদ্র, ১৪২১, শ্যামলী, ঢাকা