রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র


[রোকেয়াকে নিয়ে এই লেখাটি ২১ বছর আগে ১৯৯৩ সালে সাপ্তাহিক ‘রোববার’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। লেখাটি নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা থেকে প্রকাশিত ‘রোকেয়া পাঠের স্থান, কাল পাত্র ও বোরকা’ পুস্তিকাটিতেও অন্তর্ভূক্ত। ডিসেম্বরের নয় তারিখে রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুদিবস পেরিয়ে এসেছি আমরা আবার; সেই  উপলক্ষে লেখাটি এখানে আবার দুই একটি জায়গায় খানিক পরিমার্জনা করে তুলে দেওয়া হোল। - সম্পাদনা বিভাগ]

[এক]

“উন্নতি কি পর্দার বাহিরে থাকে?”

পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সঙ্গে যুক্ত রফিকুল ইসলাম দুলালের সঙ্গে রংপুরে দেখা হয়েছিল কয়েক বছর আগে। তিনি বললেন, রোকেয়ার নামের সঙ্গে ‘বেগম’ নেই। তাঁর নাম ‘রোকেয়া, ‘বেগম রোকেয়া নয়। তিনি ঠিক বলেছেন। আমরা বেগম রোকেয়া লিখতে অভ্যস্ত। আর এটা সত্যি কথা যে নারী নামের সামনে ‘মিসেস’, ‘বেগম’ প্রভৃতি ব্যবহার পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতির লক্ষণ। আজকাল এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে, এটা খুবই ভাল কথা। তবে রোকেয়ার স্মৃতি রক্ষার জন্য পায়রাবন্দে যে সংসদটির সঙ্গে দুলাল যুক্ত তার নাম ঠিকই ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদ’।  আমি কি ঠিক বলছি? কাউকে দোষ দিচ্ছি না। পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি আমাদের হাড়েমজ্জায় চলাচল করছে, হরহামেশা। সচেতন হয়ে উঠলে ভাল।

অন্যদিকে বেগম রোকেয়া লেখিকা হিসাবে নিজের নাম মিসেস রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন লিখতেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। ‘বেগম’এর চেয়ে ‘মিসেস’ নিশ্চয়ই খুব ভাল কিছু নয়। আর তাঁর ইংরেজি নামের বানান হোল এই রকম: Roquiah Khatun। অর্থাৎ নিজের নামের খোদ উচ্চারণ বর্ণে গ্রেফতার করতে না পারলেও তাঁর নামের ‘কেয়া’ অংশ quiah-এর মতো অতি কঠিন কায়দায় ইংরেজি বর্ণ দিয়ে ধরার চেষ্টা করেছেন। তার মানে আমরা যেমন করে রোকেয়া নামটির উচ্চারণ খুব লবডঙ্কা রকম বঙ্গীয় করে ফেলেছি, রোকেয়ার সময়ে তিনি নিশ্চয়ই ঐ উচ্চারণে তাঁকে ডাকলে গোস্বা করতেন।

আরবি, ফারসি, উর্দু নাম আরবি-ফারসি-উর্দুর মতো চোস্ত উচ্চারণ করতে হবে এই বোধ কি কাজ করত সেই সময়? বোধহয় ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত মুসলমান সমাজে নিজের আভিজাত্য ও সম্প্রদায়গত পরিচয় বজায় রাখার জন্য এর দরকার ছিল। ‘ক্ষয়িষ্ণু’ -- এই কথাটা খেয়াল করতে হবে। ইউরোপে অভিজাততন্ত্রের ক্ষয়িষ্ণুতার মধ্য দিয়ে যে বুর্জোয়া সমাজ গড়ে উঠছিল ঔপনিবেশিক বাংলার ক্ষয়িষ্ণুতা কিন্তু আরো খারাপ। এই ক্ষয়িষ্ণুতা একটা ঔপনিবেশিক কাঠামোর মধ্যে ঘটছে। তাছাড়া এমন এক সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ক্ষয়িষ্ণুতা যে নিজেকে হিন্দুস্তানে মুসলমানের রাজত্ব ফিরে পাবার স্বপ্ন তখনও ত্যাগ করে নি। যদিও দায়ে পড়ে ইংরেজি শিক্ষা আর ইউরোপীয় বইপত্রের প্রবেশ এমনকি অন্তঃপুরেও ঘটছে। হোক না তা ভাইয়ের হাত ধরে বা স্বামীর উৎসাহে। রোকেয়াকে এই দিক থেকে দেখলে মুসলামান মেয়ের যে দুর্দশার চিত্র তিনি এঁকেছেন তার মানে খানিক ফিকে হয়ে আসে। ঐতিহাসিক ভাবে এটা বিশ্বাস করা মুশকিল যে বাংলার সকল শ্রেণীর নারীর অবস্থা ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারের মেয়েদের মতো ছিল। ফলে বোরকা, পর্দা প্রভৃতি ব্যাপারে তাঁর অভিজ্ঞতাকে বাংলার মুসলিম নারীর সকল শ্রেণীর অভিজ্ঞতার প্রামাণ্য চিত্র হিসাবে মেনে নেওয়া মুশকিল।

এই রকম হাজারো প্রশ্ন কিন্তু মনে জাগে। উত্তর নেই। এই সকল বিষয়ে কাজও হয়েছে খুব কম। যেমন, বাংলার মুসলমান সমাজের মেয়েদের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই কাজ হয় নি বলা চলে। সর্বভারতীয় পর্যায়েও নয়। ভারতে যে সকল কাজ হয়েছে তা প্রায় সর্বক্ষেত্রেই হিন্দু নারীদের ওপর। অনেকের রচনা পড়ে মনে হয় ভারতবর্ষে হিন্দু নারী ছাড়া আর কোন ধর্মের আদৌ অস্তিত্ব ছিল কিনা সন্দেহ। সে যাই হোক, বাংলার নারীর একটা সামগ্রিক ইতিহাস লিখবার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করাটাও এখন বড়ো কাজ্। ঐতিহাসিক উপাদান ঘাঁটাঘাটি করে সেই ইতিহাস তৈরি করা পরের কথা। সেদিক থেকে এই উপলব্ধি এখন আসা দরকার যে বেগম রোকেয়ার রচনা পাঠ করবার সময় স্থান কাল পাত্র বিবেচনা করতে হবে। স্থান কাল পাত্র ভুলে গিয়ে তাঁর রচনা পাঠ করলে বাংলার নারী সম্পর্কে আমরা ভুল ধারণাই গড়ে তুলব। আমি এখানে পরিস্কার দাবি করছি যে রোকেয়ার রচনায় বাংলার মুসলমান মেয়েদের পর্দাবোরকায় জবুথবু যে-চিত্র আমরা পাই সেটা আংশিক সত্য এবং একান্তই অসম্পূর্ণ। এই কথাটি আমি জোর দিয়ে বলব এই কারণে যে অনেকেই দেখছি রোকেয়ার মহিমা প্রমাণের জন্য বাংলার মুসলমান নারী সম্পর্কে তাঁর আঁকা ছবিটাকেই বেশি বেশি তুলে ধরতে চেষ্টা করেন। অথচ এর কোনই প্রয়োজন নেই। রোকেয়া অনেক বুদ্ধিমতি এবং প্রতিভাময়ী নারী। এই সব হ্যাংআপগুলো কাটিয়ে উঠলে তাঁর তীক্ষ্ণ দিকগুলো আরো সহজে চোখে পড়ে।

সাধারণত রোকেয়াকে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয় সেই টিপিকাল বয়ানের বাইরে বেরিয়ে আসার দরকার আছে। প্রথমত বাংলার মুসলমান সমাজে মেয়েদের প্রশ্ন একমাত্র বেগম রোকেয়াই উত্থাপন করেন নি। মেয়েদের শিক্ষার প্রশ্নে তিনিই একমাত্র নারী নন। ফয়জুন্নেসার কথা এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার। দুজনের জীবন দুই রকম, পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন। কিন্তু ফয়জুন্নেসা ও অন্যান্যদের ভূমিকা বাংলার মুসলিম নারীদের বোঝার জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সেই ক্ষেত্রে শুধু রোকেয়া বা ফয়জুন্নেসাকে বুঝলেই চলবে না। আরো অনেককেই বুঝতে হবে। ঔপনিবেশিক আমল থেকে আজ পর্যন্ত মুসলমান সমাজ সম্পর্কে ক্রমাগত একটা বিরূপ ধারণা দেবার চেষ্টা চলছে। সেটা হোল, এই সমাজ পশ্চাতপদ এবং কুসংস্কারে অন্ধকারাচ্ছন্ন। ওরই মধ্যে বেগম রোকেয়া যেন একক ব্যতিক্রম। এই ধারণাও বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে যে অন্য যে কোন সমাজের চেয়ে মুসলিম সমাজে নারীদের অবস্থা খুবই খারাপ। এর কারণ হচ্ছে পর্দা বা অবরোধ প্রথা। দেখা যায় রোকেয়ার যে দিকটি নিয়ে বেশি হৈ চৈ হয়েছে সেটা পর্দা বা অবরোধ প্রথা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য। পর্দা হচ্ছে মুসলমান সমাজের পশ্চাদপদতার লক্ষণ, এই সমাজের নারীদের ওপর বর্বর নির্যাতনের দৃশ্যমান চিহ্ন। ইসলাম ও মুসলমান সমাজ সম্পর্কে এই ব্যাখ্যা এবং ধারণা একদিকে ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে ঔপনিবেশিক শাসনামলে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীও নিজের স্বার্থে মুসলমান সমাজকে হেয় করার জন্যে এই দিকগুলোকে বিশেষভাবে সামনে নিয়ে এসেছে। ঔপনিবেশিক শক্তি এখন আর সরাসরি আমাদের দেশে হাজির নাই। সাম্প্রদায়িক হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দাপটও আমাদের সমাজে এখন না থাকার কথা। কিন্তু এখনও ইসলাম ও মুসলমান সমাজ সম্পর্কে ঔপনিবেশিক ও সাম্প্রদায়িক আবহে গড়ে ওঠা দৃষ্টিভঙ্গির বিলোপ ঘটে নি। বরং তীব্র হয়েছে। ভারতে ইসলাম এবং মুসলমান সমাজের বিরুদ্ধে এখন উঠে পড়ে লেগেছে চরম সাম্প্রদায়িক শক্তি ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। সারা বিশ্বে এখন ইসলাম পশ্চিমা শক্তির প্রধান দুষমন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজেপির সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের দোস্তি এখন এই কারণেই ক্রমশ পোক্ত হচ্ছে। কমিউনিজমের পতনের পর বলা হচ্ছে ইসলাম হচ্ছে পশ্চিমা সভ্যতার প্রধান শক্র। বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীরা পশ্চিমা প্রভাবে এবং পশ্চিমের সঙ্গে যোগসাজশে যখন নারীবাদি হয়ে ওঠে তখনও তারা ইসলামকেই তাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হিসাবে নিশানা পাকায়। এটা খুবই শস্তা ও সহজ কাজ। ইসলামকে ধ্বংস করতে পারলেই যেন নারীর মুক্তি হবে। বাংলা সংস্কৃতির মধ্যে সাম্প্রদায়িক হিন্দু মধ্যবিত্তের ধ্যানধারণার প্রাবল্য এতো প্রকট যে ইসলাম বিরোধিতা বা নিজ সমাজকে হেয় করে ভাবার অভ্যাস শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গভীরে গেঁড়ে বসে আছে। খেয়াল করতে হবে নির্যাতনমূলক সকল ধমীয় নিগড় থেকে নারী ও পুরুষকে মুক্ত হতে হবে। ধর্মীয় অন্ধত্ব, কুসংস্কার ও মৌলবাদিতার নিপীড়ন সব ধর্মেই আছে। ইসলামকে এই ক্ষেত্রে একা চ্যাম্পিয়নের আসন দেওয়া খুবই উদ্দেশ্য প্রণোদিত।

এই ক্ষেত্রে রোকেয়ারা দূরদর্শিতা অবাক করে দেয়। দারুন মানুষ তিনি। একদিকে ইসলামের বিশেষ ধরণের বয়ান এবং মুসলমান সমাজের নিপীড়ক দিকগুলোর বিরুদ্ধে লড়ছেন ঠিকই, কিন্তু কখনোই তাঁর সমাজের দুষমনের হাতে তীর তুলে দিচ্ছেন না। রোকেয়ার রচনাকে তাঁর সমাজের বিরুদ্ধে ঢালাও ভাবে ব্যবহার করা অসম্ভব। তাঁর নিজের সমাজের ক্লেদ যেমন তাঁর জানা ছিল, তাঁর সমাজের দুষমনদেরও তিনি হাড়ে হাড়ে জানতেন, চিনতেন। এই উভয় দিক মনে রেখে তাঁর রচনায় তাত্ত্বিক এবং কৌশলগত দিকের বিচক্ষণ সমন্বয় ঘটিয়েছেন তিনি। রোকেয়ার চিন্তা ও ধ্যান ধারণার এই পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে পারেন না বলে অনেকে রোকেয়ার সরল-সাধারণ লেখাগুলোর অসাধারণ তাৎপর্য ধরতে পারেন না। যেমন, ‘বোরকা’। সকলেই জানেন রোকেয়া অবরোধবাসিনীর রচয়িতা, অবরোধের বিপক্ষে। আর 'বোরকা' বুঝি সেই অবরোধ প্রথারই দৃশ্যমান চর্চা। অবরোধ বাসের বিরোধী রোকেয়ার তাহলে বোরকার বিরুদ্ধেই অবস্থান গ্রহণ করবার কথা। অথচ ‘বোরকা’য়  দেখা যাচ্ছে রোকেয়া বোরকার পক্ষেই বলছেন। কারণ 'বোরকা' আর 'অবরোথ প্রথা তাঁর কাছে সমার্থক ছিল না। নারীকে সামাজিক ও উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরিয়ে রাখার যে শ্রম-বিভাজন ও সংস্কৃতি তার সঙ্গে 'বোরকা'র কোন সম্পর্ক নাই। নারীর উন্নতির প্রশ্ন অবরোধ প্রথা বা লিঙ্গ নির্দিষ্ট শ্রম বিভাজন বা নারীকে সন্তান উৎপাদনের হাতিয়ার গণ্য করে সমাজ থেকে আলাদা করে রাখার পুরুষতান্ত্রিক সম্পর্ক ও ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত, 'বোরকার' সঙ্গে নয়।  সামাজিক ও উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ড থেকে নারীকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রথার বিরুদ্ধে নারী বোরকা পরে বা পর্দা করেও লড়তে সক্ষম। কারন 'উন্নতি' বোরকার বাইরে থাকে না।

দ্বিতীয় আরেকটি দিক থেকে তাঁর চিন্তা এবং কাজের বিশালতা ধরা পড়ে। সেটা হোল, ইংরেজি ভাষা জানতেন বলে পশ্চিমা নারীবাদী চিন্তার সঙ্গে রোকেয়ার পরিচয় ছিল, কিন্তু শস্তা নারীবাদের খম্পরে পড়েন নি তিনি। একাট্টা পুরুষ বিরোধিতা শস্তা নারীবাদের ভিত্তি। সবকিছুর জন্যে বায়োলজিকাল পুরুষকে দায়ী করা এবং নারী মানেই ভাল আর নির্দোষ- শস্তা নারীবাদ এই ধরনের তত্ত্বের ওপর দাঁড়ায়। রোকেয়া ‘নারীস্থান’ লিখেছেন, কিন্তু ‘স্ত্রী-জাতির অবনতি’ও লিখেছেন। স্ত্রী-জাতির অবনতির জন্যে তিনি স্ত্রী-জাতিকে দায়ী করতে কুন্ঠিত হন নি। মেয়েদের অবনতির জন্যে মেয়েরাও দায়ী, এই কথাটা রোকেয়ার মতো সাহস করে নারীবাদীরা বলেন না। কিন্তু রোকেয়ার চিন্তা যদি এই সহজ তত্ত্বে সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে তাঁকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হোত না। তিনি বুঝেছিলেন পুরুষতন্ত্র একটা সামগ্রিক সামাজিক প্রক্রিয়ার অন্তর্গত একটা দিক। সমাজের বৈষয়িক উৎপাদন ও প্রজাতি পুনরুৎপাদন সম্পর্কের খাপে খাপে জটাশিকড়ে আটকানো। এই সমগ্র ব্যবস্থার নিরন্তর প্রক্রিয়া নারীকেও পুরুষতন্ত্রী করে তোলে। পুরো প্রক্রিয়া নারীর চিন্তা ও ধ্যানধারণাকে আবিষ্ট করে, প্রভাবিত করে এবং নারীর চিন্তায় বদ্ধমূল গেঁথে যায়। ওর মধ্য থেকে নারী বেরিয়ে আসতে পারে না। এই ক্ষেত্রে নারী মুক্তির স্ট্রাটেজি কী হবে? প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো কী হবে? রোকেয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটা হতে হবে শিক্ষা। কেন? কারণ শিক্ষার মধ্য দিয়ে পুরুষতন্ত্রের মতাদর্শিক শেকলগুলো নারী আগে ভাঙতে শিখবে। সঙ্গে সঙ্গে পুরো প্রক্রিয়া কী করে কাজ করে তার নাটবল্টুগুলো চিনতে শিখবে নারী। এই প্রাথমিক পর্যায় অত্ক্রম না করতে পারলে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভাঙা যাবে না।

রোকেয়ার চিন্তা্র এই যোগসূত্রগুলো এবং পাশাপাশি কথার সঙ্গে তাঁর কাজের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক লক্ষ্য না করার কারণে অনেককেই রোকেয়া সম্পর্কে নানান মূর্খ মন্তব্য করতে দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি লক্ষ্য করছি রোকেয়াকে ‘সমাজ সংস্কারক’ হিসেবে দাঁড় করবার চেষ্টা চলছে। এদের ধারণা সমাজের বিরোধিতা না করলে, সমাজের বিরুদ্ধে চটকদারি কথা না বললে কিম্বা উত্তেজক, বিদ্রোহী বা বেয়াদপি না করলে কাউকে ‘বিদ্রোহী'’ বা ‘বিপ্লবী’ বলা যায় না। তাছাড়া শিক্ষা দেওয়ার কাজ বা নারীশিক্ষার জন্যে জান কবুল করা পরিশ্রম নেহায়েতই একটা সংস্কারমূলক কাজ। ওর ভেতরে কোন ‘বিপ্লব’ নাই। রোকেয়ার কাছে শিক্ষা হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের মতাদর্শিক শৃঙ্খল থেকে নারীর মুক্তি। নারীমুক্তির এটা প্রাথমিক শর্ত। বিপ্লব চটকদারি কথা দিয়ে হয় না। তার জন্য একনিষ্ঠ পদক্ষেপ দরকার এবং নিজ চিন্তার ন্যূনতম বাস্তবায়নের জন্য অধ্যবসায় প্রয়োজন। এখানেই রোকেয়া বিপ্লবী। স্ত্রী-জাতির অবনতি সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ, সেই বিশ্লেষণ থেকে ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সর্বোপরি সেই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের জন্যে তাঁর অপরিসীম পরিশ্রম ও অধ্যবসায় তাঁকে অনন্য করে তুলেছে। এই অনন্যতা বিপ্লবীর, সংস্কারকের নয়। শুধু কাজের ধরণ দিয়ে বিপ্লব আর সংস্কারের পার্থক্য ঠিক হয় না।

[ দুই ]

rokeya

ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আলজিরীয় মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কে ফ্রানৎজ ফ্যানন (Frantz Fanon) তাঁর Dying Colnaialism বইতে বেশ কিছু প্রখর মন্তব্য করেছিলেন বহু আগে, পঞ্চাশ দশকের শেষের দিকে তাঁর এই বইটি ঔপনিবিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামের প্রতীকী দিকগুলো বোঝার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঔপনিবেশিক শক্তি কেন বোরকা বা পর্দাকে তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্ততে পরিণত করে সে সম্পর্কে ফ্যানন অনেক কথা বলেছেন। পোশাক হচ্ছে একটি সংস্কৃতির দৃশ্যমান দিক। এই দিকটা সহজেই চোখে পড়ে। পোশাকের এই দৃশ্যমানতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফ্যানন বলছেন, একজন মুসলমান যে শূকরের মাংস খায় না কিম্বা প্রতিদিন মুসলমান স্বামী-স্ত্রী সঙ্গমে লিপ্ত হয় না, সংস্কৃতির এই অপ্রকাশ্য দিকগুলো দখলদার ঔপনিবেশিক শক্তির পক্ষে বুঝতে সময় লেগে যায়। বিশেষত রমজান মাসে যে দৈহিক মিলন পরিত্যাজ্য ইসলামি সংস্কৃতির সেই খবর ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে অনেক দেরিতে পৌঁছায়। কিন্তু আরব মেয়েরা যে বোরকা পরে এটা তারা সহজেই দেখে। এটা তারা এতো বেশি জ্বলজ্বল দেখে যে আরব বা মুসলমান সমাজ বলতে তারা এই বোরকা পরা সমাজই বোঝে। এটাকেই ইসলামী সংস্কৃতির প্রধান রূপ হিসাবে তারা ধরে নেয়।

দখলদার ঔপনিবেশিক ফরাসি শক্তি ১৯৫৪ সালের আগে, সেই ত্রিশ দশকের শুরু থেকেই, পর্দার ওপর আক্রমণ শুরু করে, পরিকল্পিত ভাবে। জনগণের সংস্কৃতির দৃশ্যমান মৌলিক উপাদানগুলো নষ্ট করে ফেলা দখলদার শক্তির জন্যে ছিল একটা জরুরি কাজ। দখলদার ঔপনিবেশিক শক্তি চেয়েছে সংস্কৃতির সেই সকল উপাদান নষ্ট হয়ে যাক যেগুলো ‘জাতীয় বাস্তবতার’র ধারণা বা সংস্কৃতিগত ভাবে একটা জাতীয় ঐক্যের প্রতীকী সূচনা ঘটাতে পারে। পোশাক সংস্কৃতির অংশ হিসাবে সেটা ঘটতে সক্ষম। পর্দার বিরুদ্ধে দখলদার ঔপনিবেশিক শক্তির আক্রমণ হঠাৎ কোন ব্যাপার ছিল না। ফরাসি নৃতত্ত্ববিদ, সমাজতাত্ত্বিক ও অন্যান্য গবেষকরা এই লক্ষ্যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। অর্থাৎ পর্দার ওপর বা আরব বা ইসলামি পোশাক বা পরিচ্ছদের ওপর আক্রমণটা চালানো হয়েছে পরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ ভাবে।

এটা করতে গিয়ে ঔপনিবেশিক গবেষকরা প্রমাণ করে দেখাতে লাগল যে আলজিরীয় সমাজে দৃশ্যমান পুরুষতন্ত্রের আড়ালে রয়েছে এক প্রচ্ছন্ন মাতৃতন্ত্র। তারা আলজিরীয়ার মা, নানী খালাদের ভূমিকার তালিকা তৈরি করল আর পুঙ্খানুপুঙ্খ সেইসব বিশ্লেষণ করলো। আর সেই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গড়ে উঠল তাদের হামলার কৌশল। ফ্রানৎজ ফেনন বলছেন:

“এখান থেকেই ঔপনিবেশিক শাসকরা তাদের সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য সংজ্ঞায়িত করলো: আমরা যদি আলজিরীয় সমাজের কাঠামো এবং এর প্রতিরোধের ক্ষমতা ধ্বংস করতে চাই, আমাদের সকলের আগে দখল করে নিতে হবে মেয়েদের। বোরকার আড়ালে যেখানে তারা লুকিয়ে আছে এবং পুরুষরা ঘরের মধ্যে যেখানে তাদেরকে আড়াল করে রাখে সেখান পর্যন্ত তাদের পেছনে ধাওয়া করে খুঁজে বের করতে হবে”।“

এই আলোকে কার্যকর কৌশল হিসাবে সমাজে নারীর অবস্থানের বিষয়টি গ্রহণ করা হোল। দখলদার ঔপনিবেশিক প্রশাসন এই উদ্দেশ্যেই গুরুগম্ভীর ভাবে নারী প্রতিরক্ষার ভার নিজ কাঁধে তুলে নিলে। দেখানো হতে লাগল এই নারী অপমানিত বঞ্চিত, অবরোধবাসিনী.....এই নারীর অসামান্য সম্ভবনার বয়ান গাওয়া হোল যা দুর্ভাগ্যক্রমে আলজিরীয় পুরুষের হাতে পড়ে নিষ্প্রাণ, মূল্যহীন এবং বাস্তবিকই এক জড়পদার্থে পরিণত হয়েছে। (পৃ ৫৭-৫৮)।

নারীর অধোগতির কথা কয়ে আলজিরীয় সমাজকে নাকচ করে দেয়া হোল। দখলদার ঔপনিবেশিক শক্তি পদানত সমাজকে নাকচ করে দিয়েই কেবল তাদের দখলের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আলজিরীয় সমাজ যে একটি মধ্যযুগীয় ও বর্বর সমাজ সেটা নানান গবেষণায় প্রমাণিত হতে লাগল। নারীর প্রতি আলজিরীয় সমাজের আচরণ ও কার্যকলাপের তালিকা তৈরি হোল। পারিবারিক জীবন সম্পর্কে দখলদার ঔপনিবেশিক শক্তি এক গাদা তথ্য খাড়া করল যাতে আলজিরীয় পুরুষ পাপবোধ ভোগে এবং দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। ফ্যানন বলছেন:

“এই ঔপনিবেশিক প্রকল্পে আলজিরীয় পুরুষকে ছারখার করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব দেয়া হোল নারীকে। মেয়েদের নিজেদের দলে টেনে আনা, পশ্চিমা মূল্যবোধের পক্ষে তাদের মত কবুল করিয়ে নেওয়া, সমাজ নারীর অবস্থান থেকে তাকে মোচড় দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে মুক্ত করে আনার মানে একই সঙ্গে হয়ে দাঁড়াল পুরুষের ওপর সত্যিকারের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা এবং আলজিরীয় সংস্কৃতিকে বেহাল করে দেওয়ার একটা ব্যবহারিক ও কার্যকর উপায়।”

বেগম রোকেয়ার বোরকা পড়বার সময় ফ্রানৎজ ফ্যাননের এই কথাগুলো খেয়াল রাখতে হবে। রোকেয়ার জন্ম একটি ঔপনিবেশিক সমাজের মধ্যে। সেই সমাজের ভেতরে দাঁড়িয়ে ‘বোরকা’ লিখা। ঔপনিবেশিকতার দ্বন্দ্ব এই লিখার মধ্যে কিভাবে ধরা পড়েছে সেটা এই প্রখ্যাত নিবন্ধটির প্রথম ছত্রেই ষ্পষ্ট। তিনি লিখেছেন:

“আমি অনেকবার শুনিয়াছি যে, আমাদের ‘জঘন্য অবরোধপ্রথা’ নাকি আমাদের উন্নতির অন্তরায়। উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত ভগ্নীদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত হইলে তাঁরা প্রায়ই আমাকে ‘বোরকা’ ছাড়িতে বলেন। বলি, উন্নতি জিনিসটা কি? তাহা কি কবল বোরকার বাহিরেই থাকে? যদি তাই হয় তাহলে বুঝিবে যে জেলেনী, চামারনী, কি ডুমুনি প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা আমাদের অপেক্ষা অধিক উন্নতি লাভ করিয়াছে”।

আক্রমণ তিনি দুদিকে করেছেন। একদিকে করেছেন উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত’ ভগিনীদের। ফ্রানৎজ ফ্যানন যাঁদেরকে দেখেছেন দখলদার ঔপনিবেশিক শক্তির পক্ষে চলে গিয়ে ঔপনিবেশিক শক্তি বহাল রাখার কর্তব্যে রত হিসেবে। এই জন্যে ‘উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত ভগিনী’ কথাটার মধ্যে একটা শ্লেষ এবং একটা তাচ্ছিল্য আছে। এদেরই কাজ হচ্ছে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সমাজের প্রতিরোধের ক্ষমতা দুর্বল করা, দুষমনের বিরুদ্ধে সমাজের লড়াই চালিয়ে যাবার আত্মিক শক্তিকে নস্যাৎ করে দেওয়া। দখলদার ঔপনিবেশিক শক্তি যখন ক্ষমতায় তখন ‘বোরকা’র বিরুদ্ধে আক্রমণ বা ‘বোরকা’ ছাড়ার কথা বলা মানে পদানত জাতির সংস্কৃতিকে আক্রমণ করা। বোরকার পক্ষে দাঁড়িয়ে রোকেয়া সেই ঔপনিবেশিক হামলা প্রতিহত করছেন, সেটা ষ্পষ্ট। কিন্তু তাঁর কথাকে তিনি ইঙ্গিতেও দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় গোঁড়মির ফাঁদে পড়তে দিলেন না। নিবন্ধটির কোত্থাও তিনি কোন অক্ষরের ফাঁকফোকরের মধ্যে ইশারায় ইঙ্গিতে আভাসে অজ্ঞানতা বশে ভুল করেও একবার বলেন নি যে বোরকা ধর্মসম্মত, ইসলাম সম্মত, সেই জন্যে তিনি বোরকার পক্ষে। যেখানে ধর্মের নিগড় ভাঙবার জন্যে তিনি লড়ছেন সেখানে এই কথা তোলার প্রশ্নই আসে না। তোলেন নি। বরং আদত আরও গভীর প্রশ্নটাই তুলেছেন, ‘উন্নতি কি বোরকার বাইরে থাকে?’ ঔপনিবেশিকতার কালপর্ব এখন সাম্রাজ্যবাদী কালপর্বে প্রবেশ করেছে। উন্নতি কি বোরকার বাইরে থাকে এই প্রশ্নের গুরুত্ব সাম্রাজ্যবাদী কালপর্বে এসে নতুন তাৎপর্য গ্রহণ করেছে। এখানেই রোকেয়ার অসামান্য মৌলিকত্ব। এখানেই তিনি অপূর্ব আর দুর্দান্ত। এখানেই ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন লড়াইয়ের কৌশল সাফ সাফ ধরা পড়ে। আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়।

আক্রমণের অন্য দিকটি হোল জাতিপ্রথার বিরুদ্ধে, বা আরো পরিষ্কার করে বললে সামাজিক শ্রমবিভাগের সেই কাঠামোর বিরুদ্ধে যেখানে জেলে, চামার এবং মুচি জন্মদোষে আজীবন জেলে, চামার আর মুচি থেকে যায়। থেকে যায় অস্পৃশ্য এবং সমাজে থেকেও সমাজের বহির্ভূত। ওরা পর্দা করে না। কিন্তু এই নিম্ন বর্গের মানুষের কাছ থেকে খোদ সমাজটাই পর্দা করে। আশ্চর্য্য। অদৃশ্য এই পর্দা। এই অর্থে এটা পর্দা যে নিম্নবর্গের মানুষের জায়গা নির্দিষ্ট, তাদের কাজ নির্দিষ্ট, আচার আচরণ ব্যবহারও নির্দিষ্ট। সমাজের উচ্চবর্গের মানুষ এদের কাছ থেকে আলাদা। একটা সামাজিক অবরোধ বিভিন্ন বর্ণকে পরস্পর থেকে আলাদা করে রাখে। এখানে কোন দৃশ্যমান পর্দা নেই। অথচ যে পর্দা জারি রেখে বর্ণাশ্রম প্রথা কার্যকর তাহলে কিন নিম্নবর্গের মানুষ উন্নত? তাহলে কি জাতিভেদ প্রথা উন্নতির লক্ষণ?

রোকেয়া বোরকার পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে ধর্ম বা ইসলামের অজুহাত তোলেন নি, সেটা আগে বলেছি। আবার বোরকা বা অবরোধ প্রথার উদ্ভব বিচার করতে গিয়ে তিনি দেখিয়েছেন অবরোধ বা পর্দা শুধুমাত্র ইসলাম বা কেবল মুসলমান সমাজের ব্যাপার নয়। তিনি বলছেন, ‘অবরোধ-প্রথা স্বাভাবিক নহে - নৈতিক। কেন-না পশুদের মধ্যে এ নিয়ম নাই’। মানুষের স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে রোকেয়া সাংস্কৃতিক বা অর্জিত বৈশিষ্ট্যের তুলনা করেছেন। তিনি লিখছেন:

“মানুষ্য ক্রমে সভ্য হইয়া অনেক অস্বাভাবিক কাজ করিতে শিখিয়াছে। যথা পদব্রজে ভ্রমণ করা স্বাভাবিক, কিন্তু মানুষের সুবিধার জন্য গাড়ী, পাল্কী প্রভৃতি নানাপ্রকার যানবাহন প্রস্তুত করিয়াছে। সাঁতার দিয়া জলাশয় পার হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু মানুষে নানবিধ জলযান প্রস্তুত করিয়াছে। তাহার সাহায্যে সাঁতার না জানিলেও আনায়াসে সমুদ্র পার হওয়া যায়। ঐরূপ মানুষের ‘অস্বাভাবিক’ সভ্যতার ফলেই অন্তঃপুরের সৃষ্টি ”।

পর্দা, অবরোধ, অন্তঃপুর প্রভৃতি শব্দ বা ধারণা রোকেয়া কাছাকাছি অর্থে ব্যবহার করেছেন। একদিকে পর্দা করা বা শরীর ঢাকাকে তিনি সভ্যতার বিবর্তন হিসাবে দেখেছেন।

“পৃথিবীর অসভ্য জাতির অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় থাকে। ইতিহাসে জানা যায়, পূর্বে অসভ্য ব্রিটনরা অর্ধনগ্ন থাকিত। এই অর্ধনগ্ন অবস্থার পূর্বে গায়ে রঙ মাখিত। ক্রমে সভ্য হইয়া তাহারা পোশাক পরিতে শিখিয়াছে”।

ফাঁকফোকরে ঔপনিবেশিক শক্তিকে কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না। ‘পূর্বে অসভ্য ব্রিটনরা অর্ধনগ্ন থাকিত’। ব্রিটেনের মানুষ সৃষ্টির আদি থেকেই সভ্য এই ধারণাকে থাপ্পড় মারছেন এখানে। সভ্যতা একদিকে মানুষকে পোশাক পরিতে শিখিয়েছে। অন্যদিকে বাহির ও অন্দরের পার্থক্যও সুনির্দিষ্ট করেছে। সভ্যতার বিবর্তনের মধ্য দিয়েই অন্তঃপুরের সৃষ্টি। তাঁর কথার সারমর্ম দাঁড় করালে যেটা দাঁড়ায় তা হোল সভ্যতার বিবর্তনের মধ্য দিয়ে public এবং private sphere আলাদা হয়ে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। সব সংস্কৃতি বা সভ্যতার মধ্যে public আর private-এর বিশেষ ভাগ আছে। তার প্রকাশ ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু পর্দা করে না এমন কোন সভ্যতা নেই। কারণ সভ্যতার বিবর্তনের যে জায়গায় মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সেখানে পর্দা ত্যাগ করা কথাটার কোন অর্থ দাঁড়ায় না। সেই কারণে রোকেয়া লিখছেন:

‘সময় সময় ইউরোপীয় ভগ্নিগণও বলিয়া থাকেন, আপনি কেন পর্দা ছাড়েন না (Why don’t you break off purdah) ? কি জ্বালা! মানুষে নাকি পর্দা ছাড়িতে পারে? ইহাদের মতে পর্দা অর্থে কেবল অন্তঃপুরে থাকা বুঝায়। নচেৎ তাঁহারা যদি বুঝিতেন যে, তাঁহারা নিজেও পর্দার (অর্থাৎ privacy-র) হাত এড়াইতে পারেন না, তবে ওরূপ বলিতেন না।’ এখানে ইংরেজি কথাগুলো রোকেয়ার নিজের। পর্দাকে তিনি privacy হিসাবে দেখছেন সেটা এখানে খুবই স্পষ্ট।

রোকেয়ার চিন্তার বৈশিষ্ট্য ও মৌলিকত্ব অনুধাবন করবার জন্যে তাঁর যে কোন রচনা নিয়ে আলোচনা করা যেত। ‘বোরকা’ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যে মৌলিক ভাবনা বিস্তর। সেটা অবাক করে। সেই কারণে এখানে কিছু ইঙ্গিত দেয়া হোল মাত্র।

ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনে পদানত একটি সমাজের ভেতর থেকে রোকেয়া কথা বলেছেন, কাজ করেছেন, লড়েছেন। পেছনের এই পটভূমি মনে না রাখার কারণে একদিকে যেমন তাঁকে ভুল বোঝা হচ্ছে, অন্যদিকে তাঁর বিশালতা সহজে চোখে পড়ছে না। আমরা যেন পটভূমি বা ইতিহাসের দিগন্তরেখাগুলো সতত খেয়াল রাখি।

১৫ অগ্রহায়ণ ১৪০০

২৯ নভেম্বর, ১৯৯৩ সাল


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।