মোদি বাংলাদেশে আসছেন, তাতে কী!
এক এগারো ও দিল্লী
বাংলাদেশ ভারতের কাছে কী? মুঠোয় থাকা খেলনা? বিড়াল যেমন ইঁদুর নিয়ে খেলে সেই রকম কোন তুলতুলে খেলনা ইদুর? মানে ঠিক প্রাণহীন প্লাস্টিকের খেলনা নয়। বিড়ালের সামনে ইঁদুরের প্রাণে নিয়ে দাঁড়ানো খেলা? তাই কী?
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিজেপির নরেন্দ্র দামোদর মোদি বাংলাদেশ সফরে আসছেন আগামি ৬-৭ জুন ২০১৫; তারিখটা এখন সরকারিভাবেও নিশ্চিত করা হয়েছে। কোন পরিপ্রেক্ষিত থেকে এই সফরকে আমরা দেখব সেই তালিকা অনেক লম্বা হবে। কোন একদিক থেকে শুরু করা যাক।
এক এগারোর এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের মাইনাস টু ফর্মুলার কথা সকলে শুনেছি। দুই দলের দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার প্রবল আগ্রহটা উঠেছিল মূলত আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমের দুই নেত্রীর প্রতি অসন্তুষ্টির কারণে। অসন্তুষ্টির মুল কারণ তাদের মনে হয়েছিল খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের শাসনকালে বাংলাদেশ আমেরিকানদের যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ ও পছন্দ মোতাবেক চলছিল না। যদিও শেষ পর্যন্ত রাজনীতি থেকে কাউকে মাইনাস হতে আমাদের দেখতে হয় নাই। আর তা হয় নাই ভারতের কারণে। বিশেষত বাংলাদেশ বিষয়ে যার মতামতকে কংগ্রেস সেই সময় সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিল তিনি হচ্ছেন তৎকালের ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। সেই প্রণব মুখার্জি মাইনাস টু ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। এতে মাইনাস টু বন্ধ হয়ে যায় বা বলা ভাল তার মোড় পরিবর্তন হয়ে যায় ঠিকই, নেত্রীরা স্ব স্ব দলের নেতৃত্বে থেকে যায়। তবে ভারত বাংলাদেশে কাকে ক্ষমতায় আনবে রাখবে কিম্বা বাদ দেবা ইত্যাদির নির্ধারক হয়ে উঠে। আমেরিকানদের সক্রিয় সম্মতির জন্য এমনটা সম্ভব হয়। শেষে ব্যাপারটা দাড়িয়েছিল এমন যে, বাংলাদেশের দুই নেত্রীর মধ্যে আওয়ামি লীগের হাসিনাকে বেছে নিবার জন্য তৎকালে ভারতের ক্ষমতাসীন প্রণবের কংগ্রেসকে সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। মাইনাস টুর ক্ষমতা দখল শেষমেষ মোড় পাল্টিয়ে হাসিনাকে ক্ষমতায় বসাবার কারবার হয়ে যায়। এর পিছনে ভারত-আমেরিকার মূল যৌক্তিকতা বা রেশনাল অনায়াসেই অনুমান করা যায়। তারা পাবলিকলি সরাসরি না বললেও তাদের কথাবার্তা বক্তৃতা বিবৃতিতে বোঝা যায় যে, আমেরিকায় ৯/১১ এর হামলা আর এর প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকার ওয়ার অন টেরর নীতির সময় ইসলামি জঙ্গী সন্ত্রাসবাদের হাত থেকে বাংলাদেশকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এমন কোন অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করা যাবে না যার সুযোগ কোন ইসলামপন্থি যেন নিয়ে বসতে পারে। বাংলাদেশে আমেরিক ও ভারতের স্বার্থ অটুট রাখতে গেলে এটাই সঠিক উপায় ও ব্যবস্থা। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই শেখ হাসিনা নিজের স্থান পোক্ত করে নিতে পারে।
বিগত বিএনপি আমলে যেন বাংলাদেশ আমেরিকান ফর্দ মোতাবেক সবকিছু করে নাই। তাই কামাল হোসেন আর ইউনুসের নেতৃত্বে প্রধান দুই দলের সংস্কারবাদী মিলে যে সরকার কায়েমের ইচ্ছা ১/১১ এর ক্ষমতার কারিগরদের খায়েসে ছিল তা প্রণবের বিবেচনা ও সুপারিশ মোতাবেক যোগ্য বা উপযুক্ত হত না। তাই মাইনাস চিন্তা বাদ দিয়ে হাসিনাতেই থিতু হবার ব্যবস্থা। এসবের পিছনে অলক্ষ্যে আর এক কারণ ছিল।
বুশের ওয়ার অন টেররের আমলে সাউথইষ্ট এশিয়ায় আমেরিকার সন্ত্রাসবাদ বিরোধী “নিরাপত্তা নীতি”র প্রশ্ন। সেটা কি হবে তা ইতোমধ্যেই সাব্যস্ত হয়েছিল । সেটা হোল, ভারতের চোখ দিয়ে আমেরিকা নিজের নিরাপত্তা স্বার্থ দেখবে। মূলত একারণেই আমেরিকা বাংলাদেশে একটা ১/১১ ঘটিয়ে পাত্রী দেখানোর মত করে আমাদেরকে ভারতের কাছে পাঠিয়েছিল। দিল্লি পছন্দ করে কিনা দেখবার জন্য। পছন্দের জন্য পাঠানো হয়েছিল। এই আয়োজন ২০০৭ সালের, আজ থেকে আট বছর আগের। আজ পিছন ফিরে সেদিনের মুল্যায়ন করতে বসলে এক মহা তামশা আমরা লক্ষ্য করব। আসল কথা হোল, আমেরিকা, ভারত আর হাসিনার লীগ এই তিন পক্ষ সবাই সবার কাছ থেকে সত্য লুকিয়েছিল, মনের কথা কেউ কাউকে খুলে বলে নাই। সবাই মুখে বলেছে সন্ত্রাসবাদ কার্যকর ভাবে মোকাবিলার জন্য তাদের এই নতুন সিদ্ধান্ত। আসলে এই কথার আড়ালে নিজ নিজ ভিন্ন স্বার্থ হাসিল করার পথে এই সিদ্ধান্তকে তারা প্রত্যকে নিজের নিজের মতো করে ব্যবহার করে গিয়েছে। “সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার” কথার আড়ালে স্ব স্ব সংকীর্ণ স্বার্থ বাংলাদেশ থেকে বের করার চেষ্টা করেছে।
সন্ত্রাস দমনের জন্য র্যাব গঠন, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট গঠন, আমেরিকার নির্যাতন উপযোগী রেন্ডিশনের ব্যবস্থাদি তৈরি, নিজেদের মধ্যে তথ্য শেয়ারের ব্যবস্থা করা, ডাটাবেস তৈরি ইত্যাদি যা কিছু আমেরিকান চাহিদা ছিল এর সব কিছুই এর মধ্য দিয়ে পুরণ করা হয়েছিল। এর এমন কিছুই বিএনপি সরকারের আমলে বাদ ছিল না অথবা বিএনপি করতে রাজি ছিল না এমন কিছুই নাই যেটা ১/১১ পরবর্তী সরকারের আমলে করা হয়েছে। তাহলে ভারতের চোখ দিয়ে আমেরিকা নিজের নিরাপত্তা স্বার্থ দেখবে এমন কথা বলার বাস্তব অর্থ দাড়িয়েছিল আমাদেরকে বলির পাঁঠা বানানো যাতে বোঝানো ও প্রদর্শন করা যায় ভারতকে আমেরিকা খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে । এভাবে ভারতের ভোগে বাংলাদেশকে সঁপে দেয়া হয়েছিল। আর ভারত- আমেরিকার এমন ঘনিষ্ঠতার মূল উদ্দেশ্য ছিল চীনের অর্থনৈতিক উত্থান প্রভাবের বিরুদ্ধে আমেরিকার পক্ষে ভারতকে পাশে পাওয়া। কিন্তু সে উদ্দেশ্য লুকিয়ে আমেরিকা বাংলাদেশে যেকোন সরকারের রূপ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ক্ষমতার যে যাঁতাকাঠিটিও আছে তা অবলীলায় ভারতের হাতে ছেড়ে দিয়েছিল।
আবার ভারতের দিক থেকে দেখলে, বাংলাদেশ থেকে ভারতের জন্য বিপজ্জনক কোন ইসলামি সন্ত্রাসবাদি হামলা বা আক্রমণ থেকে সুরক্ষা পাবার কোন ইস্যুই নাই। এমন অনুমিত বিপদ গত ১৫ বছরে দেখা যায় নাই রুটিন কিম্বা স্বাভাবিক কিছু বিষয়াদি ছাড়া। হাসিনার গত সাত বছরে এমন সার্ভিস ভারতের নিবার দরকার হয় নাই কারণ তেমন কোন ইস্যু বাস্তবে উদয় হয় নাই। অথচ জবরদস্তি ১/১১ ঘটিয়ে পরিণতিতে ২০০৯ সালে যে সরকার আনা হল - বলা হয়েছিল ভারতের জন্য হুমকি হতে পারে এমন ইসলামি সন্ত্রাস ঠেকানোর সার্ভিস পাবার জন্যই নাকি সেটা করা হচ্ছে। ইসলামি সন্ত্রাসবাদ ঠেকানোর সার্ভিসের নাম করে ভারত আসলে ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ থেকে যেটা পেয়েছে সেটা হল মূলত ভারতের বিপুল অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও ট্রানজিট স্বার্থ । এককথায় বললে, যেভাবে খুশি সেভাবে নিজের পক্ষে ব্যবহার, যেটা এমনকি নিজের কোন রাজ্যকেও কেন্দ্র সরকার করতে পারে না।
আর ওদিকে হাসিনা সরকার ইসলামি সন্ত্রাসবাদ ঠেকানোর সার্ভিস দেওয়ার নাম করে দেশের বিরোধী দলের ওপর দমন, পীড়ন এবং ন্যূনতম নাগরিক ও মানবিক অধিকার অস্বীকার করাকে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করছে বলে চালিয়ে দিয়েছে। গুম খুন, আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, পুলিশী হেফাজতে মৃত্যু এবং লক্ষ লক্ষ মামলা দিয়ে অত্যাচার চালিয়ে গিয়েছে। এখনও তা চলছে। মনে রাখতে হবে ভারতের সাতভাই রাজ্যের বিদ্রোহ দমনে শেখ হাসিনার ভারতকে দেয়া সার্ভিস – এটা কোন ইসলামি সন্ত্রাসবাদ নয়। ভারতকে আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিদ্রোহ মোকাবিলা করতে সার্ভিস দেওয়া। ফলে এটাও ইসলামি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার নামে ভারতকে দেয়া হাসিনার বিশেষ সার্ভিস। ইসলামি সন্ত্রাসবাদের জুজু্র ভয় এই ক্ষেত্রে দিল্লী ও ঢাকা উভয়েই কূটনৈতিক ভাবে যেভাবে বিশ্বকে দেখাতে পেরেছে তা কূটনৈতিক ইতিহাসে অভূতপূর্ব। তাহলে দেখা যাচ্ছে ১/১১ এর ক্ষমতা দখল ও হাসিনা ধরণের ২০০৯ সালের সরকার কায়েমের যৌক্তিকতা হিসাবে যা বলা হয়েছিল – অর্থাৎ হাসিনা সরকার ভারত ও আমেরিকাকে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ ঠেকানোর সার্ভিস দিবে -- সেটা ছিল কথার কথা। তিনপক্ষ কেউই কাউকে সত্যি কথা বলে নাই। বাংলাদেশের জনগণকেও কেউই সত্য জানায় নি, জানানোর প্রয়োজন বোধ করে নি। তিনপক্ষই জানত “ইসলামি সন্ত্রাসবাদ ঠেকানোর সার্ভিসের” নাম করে প্রত্যেক পক্ষ আসলে কি হাসিল করবে।
আ্মেরিকা ও বাংলাদেশে মার্কিন স্বার্থ
পরিণতিআমেরিকার দিক থেকে দেখলে, ২০০৯ সাল থেকে আজ প্রায় সাত বছর পর আমেরিকার পরিণতি সবচেয়ে করুন। না ভারত না শেখ হাসিনা সরকার তার কোন কথা শোনে কিম্বা পাত্তা দেয়। আমেরিকান রাষ্ট্রদুতকে মুখ সামলে চলতে হয়, কোথায় না আবার বিরাগভাজন শব্দ মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়ে যায়। হাসিনার অপছন্দের যে সব কথা যা আমেরিকাকে বলতেই হয় তা ঢাকা থেকে নয় ওয়াশিংটন স্টেট অফিস থেকে প্রকাশ করতে হয়। খোদ আমেরিকান অবস্থানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছে। কিভাবে নির্বাচন হয়েছে সেই কাহিনী সবার জানা। এর পরেও শেখ হাসিনার সরকারের নিজেদেরকে বৈধ সরকার বলে দাবি নিঃসন্দেহে আমেরিকার গালে চপেটাঘাত। চোখে আঙুল দিয়ে আমেরিকার মুরোদহীনতা দেখিয়ে দেওয়া। স্রেফ ভারতের সমর্থনের উপর দাঁড়িয়ে আমেরিকার মুরোদ নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফেলেছে হাসিনা। এমন নাকানি চুবানি আমেরিকার জন্য আর কী হতে পারে। অথচ আমেরিকান যাঁতাকাঠি ব্যবহার করতে দেবার মার্কিনী শঠতাই আমেরিকার জন্য এই অপমানজনক পরিণতি তৈরি করেছে। নিজেই শঠতা করে মার্কিনীরা এমনটা হতে দিয়েছিল। নিজ কর্মদোষে আজ আমেরিকার নিজের হাত নিজে কামড়ানোর দশা!
শেখ হাসিনার দিক থেকে বললে, নিঃসন্দেহে তার সরকার বহাল তবিয়তে ক্ষমতায় আছে। কিন্তু যেটা নাই তা হল, পাবলিক রেটিং। গণসমর্থন। দিনকে দিন গুম খুন ঘটাবার ঝুঁকি, দমন হামলা সবই ক্ষমতাসীনরা বাড়িয়ে চলেছে কিন্তু তাতে পাবলিক রেটিং নিজেদের পক্ষে বাড়বার কোন আলামত নাই। বরং প্রতিদিন সমাজের সব পক্ষের কাছেই উলটা এক ভীতিকর ক্ষমতা হিসাবে হাজির হচ্ছে। পাবলিক রেটিং কথাটা আর এক ভাবে বলা যায়। আমরা দেখছি, হাসিনা খোলাখুলি হস্তক্ষেপ ছাড়া কোন নির্বাচন করতে সাহস করছেন না। এটাই নিজের পাবলিক রেটিং সম্পর্কে হাসিনার নিজের ধারণার বহিঃপ্রকাশ। অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের আত্মবিশ্বাস নাই বললেই চলে। ওদিকে নিজের সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন ও স্বীকৃতি বলতে একমাত্র ভরসা হয়ে দাড়িয়েছে ভারতের সমর্থন। এটা এমন অতি নির্ভরশীলতার পর্যায়ে যে মানুষ যেমন ভাতের অভাবে থালাবাটিও বেচতে রাজি হয় বিনিময়ে একটুখানি চাল যোগাড়ের জন্য – শেখ হাসিনার সরকারের সে অবস্থা। নিজ সরকার পরিচালনার সব সিদ্ধান্ত এমনভাবে নিবার চেষ্টায় তারা রত হয়েছেন যাতে মোদি বা ভারত সরকার হাসিনার এই সার্ভিস কিনতে আগ্রহি হয়, বিনিময়ে তারা যেন হাসিনা সরকারকে সমর্থন দেয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে শেখ হাসিনার এভাবে নিজেকে হাজির করার সুযোগ অফুরন্ত নয়। এমনকি এভাবে এই ধরণের নিজের দর নিয়ে দরাদরি করার সুযোগও সীমিত। যেমন, সাধারণভাবে বলা যায়, ভারতের এখন বাংলাদেশ থেকে যা পাবার দরকার তা মূলত অর্থনৈতিক ও, বাণিজ্যিক স্বার্থ; - রাজনৈতিক স্বার্থ বলতে যা বুঝায় তা আর খুব কিছু অবশিষ্ট নাই যা শেখ হাসিনা ভারতের কাছে বিক্রি করতে পারবেন।
অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের বিষয় বলে বুঝতে হবে যেমন এটা হাসিনার ভারতকে কোন এক চুক্তিতে বাড়তি সুবিধা দিয়ে দেওয়া অথবা অনুমতি দিয়ে দেওয়ার মত ব্যাপার নয়। যেমন গভীর সমুদ্র বন্দর ইস্যুতে ভারতকে চীনের উপর বাড়তি সুবিধার ব্যবস্থা করে দেয়া। প্রশ্ন হল শেখ হাসিনার পক্ষে এটা বাস্তবে দেওয়া সম্ভব কিনা। এটা কাগুজে অনুমতি দিয়ে দেওয়ার মত বিষয় কি না। জবাব হচ্ছে না; এটা একেবারেই তা নয়। কারণ এই প্রকল্প বাণিজ্যিক অর্থনৈতিকভাবে ফিজিবল বা লাভজনক না হলে কোন কিছুই চীনের ঘাড়ের উপর দিয়ে ভারতকে ফেভার করে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়। কোন প্রকল্প আগে বাণিজ্যিক অর্থনৈতিকভাবে ফিজিবল বা লাভজনক হতে হবে যেটা হাসিনার হাতের বিষয় নয়। ফলে চাইলেই এটা হাসিনা ভারতকে দিতে পারে না।
কী আছে শেখ হাসিনার এখন ভারতকে দেবার!
ভারতের মিডিয়ার মত বাংলাদেশের মিডিয়াতেও কোন ইস্যুকে বাস্তবে বুঝার চেয়ে সেনসিটাইজ বা চাঞ্চ্যল্যকরভাবে নিউজ উপস্থাপনের ঝোঁক আছে। যেমন বাংলাদেশের টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়ায় দেখি আলোচনায় ফেনা তুলে ফেলা হয়েছে – “গভীর সমুদ্র বন্দর ইস্যুতে বাংলাদেশ কার প্রস্তাব নিবে ভারতের নাকি চীনের”? অথবা পত্রিকার হেডলাইন দেখা যাচ্ছে, “ভারত পায়রাতে গভীর সমুদ্র বন্দর চাচ্ছে’।
অথচ প্রথম কথা হল, বন্দর বানিয়ে দেবার কোন অর্থনৈতিক প্রস্তাবই ভারত বাংলাদেশকে দেয় নাই। এ রকম কোন প্রস্তাব টেবিলে নাই। তবে বন্দরটা কোথায় হলে ভারতের জন্য ভাল হয় এমন পছন্দ জানিয়ে ভারত টেবিলে হাজির আছে। কিন্তু এই পছন্দের ভিত্তি হল, কোথায় বন্দর হলে সেটা ভারতের রাজনৈতিক ষ্ট্রাটেজিক স্বার্থের দিক থেকে বেশি ভাল উপযুক্ত মনে করছে সেই বিবেচনা কেবল প্রকাশ করে রাখা। ভারতের এই পছন্দ প্রকাশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা বা বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হবে কিনা এমন সব মৌলিক নির্ধারক বিবেচনাগুলো আমল না করেই এমন পছন্দের কথা জাহির করা হয়েছে।
ভারতের ইচ্ছায় পায়রাতে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পের কাজ চলছে। সেকাজ শেষ হবার আগেই বলা যায়, বন্দর যেখানেই হোক, চীন ব্যবহার করতে রাজি হবে না কেবল ভারত ও বাংলাদেশ ব্যবহার করবে বা খাতক হবে এমন যদি পরিস্থিতি হয় সেক্ষেত্রে যে কোন সম্ভাব্য বন্দর প্রকল্পের বাণিজ্যিক ফিজিবিলিটি থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ ব্যবহারকারি বা ভোক্তার সংখ্যা কম মানে রিটার্ণ রাজস্ব আয় কম, মানে অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক। এছাড়া আবার ফিজিবিলিটির অবস্থা যাই হোক প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ বা বিনিয়োগ প্রাপ্তির একটা গুরুত্বপুর্ণ ধাপ আছে। এই ঋণ অবশ্যই বিশ্বব্যাংক অথবা চীনের হবু এশিয়ান ব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠানের কনসেসনাল সুদের (০.৭৫%) ঋণ হতে হবে। আন্তর্জাতিক পুঁজি বাজারের বাণিজ্যিক ঋণের সুদ ৪% এর কম হয় না, খাতক কে তার উপর নির্ভর করে সুদের হার ঠিক হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি, ৬% হবার সম্ভাবনা। মোদির বাংলাদেশ সফরের কালে ভারতের প্রয়োজনে যেসব প্রকল্প বা ক্রয়ের ঋণ ভারত আমাদের গছাচ্ছে সেই সকল ক্ষেত্রে ভারত ৩% সুদ চাচ্ছে। অর্থাৎ গভীর সমুদ্র বন্দর ইস্যুটা পাঠকেরা বুঝে নেবার সময় আমাদের বাণিজ্যিক ঋণ আর কনসেশনাল সুদে ইনফ্রাষ্টাকচার গঠনের ঋণের ফারাক যেন মনে থাকে। কনসেশনাল সুদে প্রাপ্ত ঋণ না হলে এই প্রকল্পের বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হওয়া বা ভায়াবিলিটির দিকটা আরও থাকবে না। অর্থাৎ সোজা কথা হল, বন্দর বানানোর কনসেশনাল সুদের লোন ভারত দিবার সামর্থ্য রাখে না। আবার সামর্থওয়ালা বিশ্বব্যাংক বা চীন তখনই কেবল এগিয়ে আসবে যখন এই হবু প্রকল্প অন্ততপক্ষে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক বা ভায়াবিলিটির শর্ত পূরণ করবে। ভায়াবিলিটি মানে হল, প্রকল্প শেষে এর ভোগ ব্যবহার যথেষ্ট হওয়া, ফলে যথেষ্ট রাজস্ব আয় হওয়া যাতে সুদসহ লোনের কিস্তি পরিশোধ করা সম্ভব। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে এগুলো এমন সব বিষয় যার নিয়ন্ত্রণ শেখ হাসিনার হাতে থাকা দূরে থাক ভারতের সামর্থ ও সাধ্যের ভিতরেও নাই। থাকার বিষয়ই নয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদির ভারতকে এমন কী দিতে পারে যার বিনিময়ে সে নিজ সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থন কিনতে সক্ষম হয়। এমন বিষয় আসলেই খুবই সীমিত। একইভাবে যেমন ট্রানজিটের বিষয়টাও এমনই – এটাও হাসিনার দেওয়া কাগুজে অনুমতিপত্রের মত বিষয় নয়। বরং এর চেয়ে বড় নির্ধারক ব্যাপার রয়েছে। সেটা হচ্ছে, ট্রানজিট বিষয়টা আসলে বাণিজ্যিকভাবে ভায়াবেল ইনফ্রাষ্ট্রাকচার গড়ে তোলার একটা প্রকল্প – এই হিসাবেই এটা বাস্তব হতে পারে। ফলে হাসিনার উপদেষ্টা মশিয়ুর রহমান যদি বলেন ভারতের কাছে “ট্রানজিট ফি চাওয়া অভদ্রতা” এই কথা অর্থহীন। কারণ ট্রানজিট আসলে অর্থনৈতিক প্রকল্প, ফলে দুই পক্ষেরই অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া না পাওয়ার বাস্তবতা রয়েছে। কাগুজে অনুমতিপত্রে দিয়ে দেওয়ার মত বিষয় মাত্র এটা। সম্ভাব্য বিনিয়োগ যার কাছ থেকে আনব তার কাছে আগে প্রমাণ করতে হবে এই বিনিয়োগের টাকা উঠিয়ে এনে ঋণ পরিশোধ সম্ভব। অর্থাৎ ট্রানজিট ব্যবহারকারি ফি দিবে শুধু নয়, এমন পরিমাণ ফি দিবে যেটা ১৩-১৫ বছরের মধ্যে বিনিয়োগকৃত সমুদয় অর্থ সুদ সহ পরিশোধ করা যায়। । যদি “ফি চাওয়া অভদ্রতা” হয় এর অর্থ বিনিয়োগকৃত সমুদয় অর্থ সুদ সহ পরিশোধ করার মত কেউ নাই। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে কোন বিনিয়োগ কর্তা থেকে বিনিয়োগ পাবারও কোন সম্ভাবনা নাই। আবার যদি ধরে নেই হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার স্বার্থে বাংলাদেশের অর্থনীতি মানে জনগণ বিনিয়োগকৃত সমুদয় অর্থ সুদ সহ পরিশোধ করবে? সেটা কি সম্ভব। সেটা অসম্ভব। কারণ আমাদের অর্থনীতির সে মুরোদ নাই। থাকলে করা উচিত কিনা তা নিয়ে কথা আপাতত তুললাম না।
এসকল অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণেই বলছি যে হাসিনা ভারতকে অনুমতি হিসাবে বা অসম চুক্তিতে দিয়ে দিতে পারে এমন বিষয় এখন খুব কমই আছে। যেমন বলা হচ্ছে এবার ঢাকা হয়ে আগরতলা-কলকাতা রুটে বাস চলাচলের অনুমতি দিয়ে দেয়া হবে। ভারতের আমলা-গোয়েন্দাদের খাসিলত হল বাংলাদেশ থেকে নিবার বিষয় বা ইস্যুগুলোর বাণিজ্যিক দিকটা কোন পক্ষ কিভাবে পুরণ করবে হবে সেটা উহ্য রেখে চুক্তিগুলো হাজির করা। ভাবটা এমন যেন এদিকটা নিয়ে চুপ থাকলে এটা আপনাআপনি বাংলাদেশের কাঁধেই বর্তাবে। দোস্তের সাথে চা খেতে গেলে চায়ের বিল দোস্তের কাঁধে এভাবে চাপিয়ে দেয়া গেলেও আন্তঃরাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এমনভাবে ঘটবার সম্ভাবনা একেবারেই নাই। কারণ এটা দু’দশ টাকার চায়ের বিল নয়, কয়েক বিলিয়ন ডলারের ইনফ্রাষ্ট্রাকচারে বিনিয়োগ বিলের মামলা।
হাতে গুনে হিসাব বা থাম্বরুলের হিসাবে এই রূট চালু হলে অচিরেই এটা প্রতিদিন আপ-ডাউন ১০০ গাড়ি চলাচলে পৌছাবে। প্রতিটা বাস ৩৬ সিটের ধরলে প্রতি ওয়ানওয়ে রুটে মোট মাত্র ১৮০০ যাত্রী ধরবে। এখন বাংলাদেশের রাস্তায় নতুন এই একশটা দুরপাল্লার গাড়ি যোগ হলে এটা নিঃসন্দেহে ট্রাফিক কনজেশন, গাড়ি পিছু রাস্তার প্রাপ্যতার সমস্যা অনুভুত হতে থাকবেই। (এই বক্তব্যের মধ্যে বাংলাদেশের যে রাস্তাঘাট আছে এর তৈরি খরচ এবং এর রক্ষনাবেক্ষণের খরচের কথা তুলি নাই।) অর্থাৎ এটা কারও বাড়ি থেকে হঠাৎ এক মগ পানি চেয়ে নিয়ে খাওয়া না, একেবারে কয়েক ড্রাম পানি চেয়ে এনে নিজের বাড়ি চালানোর মত ঘটনা। এগুলো পেটি মধ্যবিত্তের দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা। তাহলে কি হতে যাচ্ছে এটা? মোদি আসবেন, হাসিনা বাস চলার অনুমতিও দিবেন। কিন্তু বাস্তবে কয়েক মাসের মধ্যে ঐ রুটের রাস্তা অচিরেই ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েরই যানবাহন চলাচলের অনুপযুক্ত হবে। মূলত যেটা সাতভাই রাজ্যের ট্রাফিক মুভমেন্টের সমস্যা সেটা তখন আমাদেরও সমস্যা হয়ে হাজির হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষতি কি হবে সেসব প্রশ্ন তুলি নাই। আবার দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন জানাচ্ছে, বাস চলাচলের অনুমতি দিলে ট্রাক চলাচলও কি বন্ধ থাকবে?
তাহলে মোদির সফরে এত ঢাকঢোল পিটানো কেন? হাসিনা ও মোদি দুজনের দুদিক থেকে দুটো কারণ আছে। সাথে ভারতের আমলা-গোয়েন্দাদের কিছু উস্কানি, প্রভাবিত করার চেষ্টা, সর্টকার্ট চিন্তার আছরও আছে।
মোদির দিক থেকে বাংলাদেশ সফর
মোদির নির্বাচিত হবার পরে গত একবছর ধরে গ্লোবাল ও রিজিওনাল অর্থে ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপুর্ণ এমন সব রাষ্ট্রই মোদি সফর করেছেন। সেইসব সফর শেষ করেই তিনি বাংলাদেশে আসছেন। বাংলাদেশ সফর বাকি আছে। স্বল্পতম সময়ের ভিতর এত সফরে ভারত সরকারের নানান খুটিনাটি বিস্তারিত অবস্থান, নীতি জাহির ও প্রতিষ্ঠা করার দিক থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদির অর্জন বিশাল সন্দেহ নাই। অল্প সময়ে দক্ষতার সাথে প্রচুর কাজের সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তা করে দেখাতে পারেন মোদি সেটা দেখিয়েছেন। এতে তাঁর সরকারের ডিরেকশনাল বা নীতি নির্ধারণী অভিমুখ তৈরির সব কাজই সমাপ্ত বলা যায় – কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্র ছাড়া। এর কারণ আগের কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশকে স্রেফ সার্কাসের পাপেটের মত ব্যবহার করে গেছে, কোন ন্যূনতম প্রতিশ্রুতি পালন বা রাষ্ট্রীয় দায়ও পালন করেই নাই। এমনকি বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কূটনৈতিক জটিলতা কেলেঙ্কারিও তৈরি করে রেখে গেছে। সেসব সংশ্লিষ্ট হবার আগে মোদিকে অনেক কিছু বকেয়া বা খেলাপী হয়ে থাকা কাজ করে আসতে হবে।
কেউ বড় ব্যবসায়ী কিনা এর লক্ষণ হল সে ছোট বড় সব পার্টনারের স্বার্থের দিকেও খেয়াল রেখে নিজে খাওয়ার কথা চিন্তা করে, নিজের স্বার্থেই। এটা উদারতা নয়, ব্যবসায়িক বাস্তবতা। একাউন্টিংও বলা যেতে পারে। একাউন্টিং মানে আবার এক অর্থে একধরণের জবাবদিহিতাও বটে। মোদি “সবকা সাথ সবকা ‘বিকাশের” রাজনীতি নিয়ে এসেছেন। একথাটা তিনি বিশেষত আঞ্চলিক সার্ক পড়শিদের বেলায় অন্তত একটা ইম্প্রেশনের মত হাজির রাখতে চান।
ফলে নতুন ইম্প্রেশনে তিনি শুরু করতে চান। গত চল্লিশ বছর ধরে ডিফল্টার বা খেলাপী হয়ে থাকা ভারত এবার স্থল সীমান্ত চুক্তি পাশ করায় মোদি বাংলাদেশ সফরে আসার উপযোগী মুখরক্ষার অবস্থায় আসার সুযোগ পেয়েছেন। ফলে মোদির খুব ইচ্ছা তিনি যে আলাদা করে মোদি – কংগ্রেস, প্রণব অথবা ভারতের পুরানা কোন নেতা কেউ নন – এমন একটা ইম্প্রেশন নিজের মত করে হাজির করতে চান। সেই সুযোগ এবার তিনি পেয়েছেন, তিনি সেটা নিতে চান। বাস্তববাদি ব্যবসায়ী বলে তিনি সরাসরি জানেন মমতাকে নিজের সিদ্ধান্তের পক্ষে আনবার সহজ উপায় হল, কেন্দ্র থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ মমতার রাজ্য সরকারের হাত দিয়ে ব্যয়ের ব্যাবস্থা করে দেয়া। এরকম কোথায় কোন অস্ত্র কাজের হবে জট খুলতে কাজ করবে তা খুঁজে বের করা অবশ্য প্রধানমন্ত্রীরই কাজ। এগুলো প্রণব জানতেন না তা নয়। কিন্তু তিনি মনে করেন বাংলাদেশকে কোন কিছু না দিয়েই এসব অর্জন সম্ভব। তাই তিনি বরং মমতাকে বাংলাদেশকে তিস্তার পানি না দিয়ে এক মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিবার দলে ভিড়াতে চেয়েছিলেন। মমতা মিথ্যা প্রতিশ্রুতির দায় নিতে আগ্রহ দেখান নাই। তাই বিগত মনমোহনের সফরে প্রণবের পানি না দিয়েই কোনরকমের তিস্তা চুক্তির দায়ে মমতা জড়িত হতে চান নাই। মমতার লক্ষ্য নগদ অর্থ। তাঁর ভাষায় কমপেনসেশন, কেন্দ্র থেকে কয়েক হাজার কোটি রুপীর থোক বরাদ্দ।
মোদি কাজের লোক, ট্রাবল শুটার, বুদ্ধিমান বড় ব্যবসায়ী, ডায়নামিক লিডার – এসব পরিচয়গুলো তিনি বাংলাদেশ এসে প্রতিষ্ঠা করতে চান। এগুলোই হল মোদির দিক থেকে বাংলাদেশ সফরের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য। তিনি নিজের ভাবমূর্তি গড়ার কাজেই বাংলাদেশ সফরে আসছেন।
কিন্তু এগুলো চাঁদের কলংকের দিক নয়, বরং আলোর অংশের কথা বললাম। ওর কলঙ্ক বা গ্রহণ লাগা অংশের হিসাব আলাদা সেগুলো আবার শুধু গ্রহণই নয় কিছু আন্ডার কারেন্ট বা বিপরীত স্রোতের ঝোঁকও আছে। আগের লেখায় আমরা দেখেছি, মোদির রাজনৈতিক নেতৃত্ব আর ভারতের আমলা-গোয়েন্দাদের ভাবনা ও তৎপরতার মধ্যে একটা ফারাক আছে – এমন রিডিং আমি সব সময় করেছি, লিখে রেখেছি। অথচ এই দুটোর মিলিত প্রভাবই হল বাংলাদেশের প্রতি ভারতের নীতি বা ভারতের বাংলাদেশ নীতি। মোদির আন্ডারকারেন্ট হল ভারতের আমলা-গোয়েন্দা চক্র।
ভারতীয় আমলা-গোয়েন্দাদের ভাবনা তৎপরতার দিক থেকে বললে,মোদির এই সফরটাকে তাঁরা দেখছেন থেমে যাওয়া মনমোহনের সফর আবার সচল করা হিসাবে। লোভনীয়ভাবে বাংলাদেশকে আবার বাগে পাবার সুযোগ। নতুন উপায় হাতে পাচ্ছে তারা। বিগত ২০১০ সালে হাসিনার প্রথম ভারত সফরের পর ২০১১ সালে মনমোহনের সফর ছিল ফিরতি সফর। বাস্তবের ইকোনমিক ভায়াবিলিটির ট্রানজিট নয়, তবে কাগজপত্রের অনুমতি হিসাবে ট্রানজিট হাসিল মনমোহনের সেই সফরে হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মিথ্যা ভাবে তিস্তাচুক্তির ছলনা থাকার কারনে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক কারনে তা থেকে থমকে গিয়েছিলেন। বিরত থাকা উচিত মনে করেছিলেন । মিথ্যা ভাবে বলছি এজন্য যে কাগুজে চুক্তি একটা হয়ে যাবার পর মমতার আপত্তিতে কেন্দ্র চুক্তি বাস্তবায়নের কোন কথা মুখে না এনে ফেলে রাখবে এই ছিল প্রণব-মনমোহন পরিকল্পনা। কিন্তু মমতা এই ছলনার পথের সাথে খামোখা নিজেকে জড়িত করতে রাজি হয়নি। মমতার বরং আগ্রহ আপত্তির কথা তুলে কম্পেনশেশন হিসাবে কেন্দ্র থেকে থোক বরাদ্দ লাভ, যেটা এখন আমরা দেখছি। আজও প্রচার করা হয়, মমতার আপত্তিতে নাকি সেসময় তিস্তা চুক্তি হয় নি। না হওয়ার সব দায় মমতার এই প্রচার চলছে।
যাহোক সেকথা । ভারতের আমলারা আবার দেখাতে চায় বা ইম্প্রশন তৈরি করতে চায় যে যেন এটা আবার দুই দেশের মধুচন্দ্রিমার সময় যেটা ২০১১ সাল থেকে আটকে আছে। হাসিনা তো আমাদেরই, আমরা যা চাই তা পেতে পারি, করতে পারি এমনই এক সরকার এটা। ফলে হাসিনা সরকারকে রাজনৈতিক সমর্থন যেন মোদির সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব মেলে ধরেন ঠিক যেমন প্রণবের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেকালে দিয়েছিল – মোদির কাছে এই সুপারিশ করতে চায় ভারতের আমলা-গোয়েন্দারা।
ইতোমধ্যে ২০১১ সালের পর অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে। যেমন ট্রানজিটের প্রবল সমর্থক প্রথম আলো/ ষ্টার গ্রুপ সতর্ক ও হতাশ হয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে বাংলায় বললে চুপচাপ কেটে পড়েছে। সিপিডি জাতীয় প্রতিষ্ঠান ও প্রবক্তরা কেটে পড়ার সুযোগ নিয়েছে। একটা কথা সবাইকে মনে করিয়ে দিবার লোভ সামলাতে পারছি না। ২০০৭ সালের প্রথমার্ধের কথা। সিপিডি লীড নিয়েছে – প্রথম আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বলে বেড়াচ্ছে ট্রানজিট দেয়া কেন উচিত। সোনার গাও হোটেলে বিশাল সেমিনার ডেকেছে। ভারতীয় হাইকমিশনার মিষ্ট মোলায়েম ভাষায় বিশাল জ্ঞানের কথা বলবার মত করে বলছেন, ট্রানজিট ব্যাপারটা অর্থনৈতিক বিবেচনা থেকে দেখা দরকার। আমাদের দীর্ঘদিনের ইতিহাস রাজনীতির কথা মনে রেখে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্ররোচিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া ত্যাগ করা উচিত। অথচ এখন তামাশা বা ভাগ্যের পরিহাস হল আজ ভারতের আমলা-গোয়েন্দারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হাসিনাকে প্রভাবিত করে, তাকে ক্ষমতায় থাকার সমর্থন যোগানোর বিনিময়ে এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক বিবেচনাগুলোকে দূরে সরিয়ে ভায়াবিলিটির কথা পাস কাটিয়ে ট্রানজিটের জন্য মরিয়া। ট্রানজিটকে অনুমতিপত্র জ্ঞান করছে তারা। অর্থাৎ নিজে বিশ্বাস করে কোন কথা এরা বলে না।
ট্রানজিট বলতে আসলে এখন ভারত নৌ না সড়ক ট্রানজিট চায় সে ভাবনাতেও বদল হয়েছে। ভারত হঠাৎ আবিস্কার করে যে নৌপথে মালামাল পরিবহণের খরচ আরও কম। আর শেখ মুজিবের আমলেই বাস্তবে তেমন ব্যবহার নাই এমন এক নৌ ট্রানজিট চুক্তি সে সময় থেকেই আছে। সেটাকেই বছরের বদলে পাচ বছরে নবয়নযোগ্য চুক্তি করা আর বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ যে কোন বন্দর যেন ভারতেরই আভ্যন্তরীণ কোন বন্দর এমন গণ্য করে বিনা অনুমতিতে শুল্ক বা অশুল্ক বাধা ছাড়া ব্যবহার করতে পারে এমন অনুচ্ছেদ ঢুকিয়ে নতুন এক নৌট্রানজিট চুক্তি এবার স্বাক্ষর করে ফেলতে চায় আমলারা।
এখন মোদি কি আমলা-গোয়েন্দাদের মাঙনায় হাসিনার থেকে যা পাওয়া যায় এমন মনোভাবের ছোট-মুদি দোকানদারের সাইজে নিজেকে পুরে দিবেন নাকি মোদি বড় ব্যবসায়ী, ‘বিকাশ’ তার স্বপ্ন --- এটা মনে রেখে সে ভুমিকায় নামবেন - সেটা দেখার জন্য আমাদের সপ্তাহ দুয়েক অপেক্ষা করতে হবে। তবে আমলা-গোয়েন্দাদের খপ্পরে মোদি অজান্তে বা জেনেশুনে যদি পড়েন তবে মোদিকে মনে রাখতে হবে জনবিচ্ছিন্ন, পাবলিক রেটিং হীন হাসিনা সরকারকে সমর্থন দিয়ে টিকিয়ে রাখার মতো কাজে তিনি নিজেকে জড়াচ্ছেন, যার রাজনৈতিক পরিণতি ভাল হবার সম্ভাবনা নাই। স্বভাবতই এর অর্থ বাংলাদেশের এমন এক সরকারের সাথে গাঠছাড়া বাঁধা যারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি নয়। তাদের নৈতিক ওবং সাংবিধানিক বৈধতার ঘাটতি রয়েছে। জনগণকে ভোট দিতে পর্যন্ত এরা দেয় নাই। এই সরকারের আকাম-কুকামের সব দায়ের শেয়ার মোদির উপরও আসব। সেটা তাকে নিতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের চোখে মোদি ভিলেন হবেন। বাংলাদেশের মানুষের ভোট দিবার ক্ষমতা হরণকারিদের দলে মোদির নাম যুক্ত হবে। কারণ মোদির সমর্থনের উপর ভর করেই পাবলিক রেটিং হীন হাসিনা সরকার নিজ বৈধতা যোগাড় করবেন, বৈধতা দাবি করবেন। সোজা কথায় হাসিনার তাবৎ রাজনৈতিক দায় মোদির উপর আসবে। মোদি কি নিজ “সবকা বিকাশের” মোদির ভুমিকায় নামবেন নাকি প্রণবের বা ভারতের আমলা-গোয়েন্দাদের সংকীর্ণ খোপে নিজেকে নামিয়ে তাদের মোদি হবেন এটা দেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি।
গত বছর মনমোহনের সরকার ক্ষমতা হারানোর পর এদিক থেকে হাসিনা এতিম হয়ে আছেন। তবু ভারতের আমলা-গোয়েন্দা চক্রের সাথে সবচেয়ে ভাল তালমিল হাসিনা সরকারের বজায় আছে। আপাতত এদের দুইয়ের আকাঙ্খা একই ওয়েবলেংথে কাজ করছে। ফলে মোদির এই সফরটাকে হাসিনা দেখেন তাঁর সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থনহীনতা বা ঘাটতির পুরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপুর্ণ পরিপূরক ও রক্ষাকবচ প্রাপ্তি হিসাবে।
মোদির বাংলাদেশ সফরে - মোদি, হাসিনা আর ভারতের আমলা – এই ত্রিমুখি তিন ধরণের গুরুত্বারোপের কারণে এটা এক মিডিয়া হাইপ তৈরি করেছে। আসলে এটা কোথায় গিয়ে শেষ হবে কি আকার আনবে পুরা জিনিষটার ফয়সালা হবে শেষে মোদির উপর আমলা-গোয়েন্দাদের প্রভাব কতখানি পড়বে নাকি মোদি উলটা আমলা-গোয়েন্দাদের উপর প্রভাব কায়েম করবেন তা দিয়ে।