জরিপের রাজনীতি
ইন্টারনেশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউট ( বা আই আর আই) বাংলাদেশে অফিস খুলেছে ২০০৩ সালে। কী চায় তারা বাংলাদেশে? তাদেরই দাবি, তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে চায়। কিভাবে তারা সেটা করবে? আমরা অসভ্য, গণতন্ত্র বুঝি না, গণতান্ত্রিক আচার আচরণ করি না, অতএব তারা আমাদের গণতন্ত্রের ট্রেনিং দেবে। তার জন্য আমাদের প্রশিক্ষণ দেবে তারা।
সকলকে দেবে কি? যেমন ধরুন আওয়ামি লীগ, বিএনপি কিম্বা অন্য কোন রাজনৈতিক দলকে? ধরুন তারা খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা কিম্বা এই স্তরের নেতা নেত্রীদের গণতন্ত্রের ট্রনিং দিল। তাতে খারাপ কি? না এটা তাদের উদ্দেশ্য নয়। দিলে খারাপ কি ভালো হোত জানি না, পাঠকগণ নিজেরা নিজেদের বুদ্ধি মোতাবেক ভেবে নেবেন। কিন্তু ইন্টারনেশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউটের এই রকম কোন প্রজেক্ট নাই। সেটা তারা করবে না। তো তারা কিভাবে আমাদের গণতন্ত্র শিক্ষা দেবে?
তাদের টার্গেট হচ্ছে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ। আপনি তো তরুণ। আর আপনি রাজনীতি পছন্দ করেন না, কোন দল করতে চান না। তো আপনাকেই ট্রেনিং দেবে তারা। শেখাবে বাংলাদেশের কোন দলের মধ্যে কোন গণতন্ত্রই নাই। বাংলাদেশ অসভ্যদের দেশ। এই দেশকে সভ্য করবে ‘তরুণ প্রজন্ম’। গণতন্ত্র ট্রেনিং নিয়ে চর্চা করতে হয়। তো তারা বলছে, তোমাদের আমরা ট্রেনিং দিয়ে শেখাবো কিভাবে গণতন্ত্র করতে হয়। কিন্তু কোন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বা কোন দলীয় কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নয়। তোমরা ইয়ুথগণ গণতন্ত্র শিখবে আর তা প্রয়োগ করবে। তার জন্য বিশাল বিশাল ইয়ুথ ফেস্টিভালের আয়োজন করে ইন্টারনেশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউটের মতো নানান বিদেশি সংস্থা।
বাংলাদেশে যদি গণতন্ত্রই না থাকে তো তাকে তো শক্তিশালী করবার প্রশ্ন ওঠে না। আগে গণতন্ত্র কায়েম করা দরকার, সেটা রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের ব্যাপার। তার ফলাফল সবসময় ইতিবাচক হবে ইতিহাস তা বলে না। কিন্তু ইনটারনেশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউট গণতন্ত্র কায়েমের জন্য কোন সহায়তা বাংলাদেশের জনগণকে করবে না। যদি করতো তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ শুরুর পরপরই তাদের বাংলাদেশে আসার কোন দরকার ছিল না। খোদ ওয়াশিংটনে বসেই বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন নীতি পরিবর্তন করার কাজ করতো তারা। কিন্তু তারা এসেছে মার্কিন নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য।
এই ধরণের সংস্থার ভূমিকা বিচার করলে আমরা দেখব, পরাশক্তিগুলোর নীতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। যদি তারা গণতন্ত্র চাইতো তাহলে তারা বাংলাদেশের জনগণকে গণতন্ত্র কায়েমের সংগ্রামে সহায়তা করত। কিন্তু এই ধরনের সংস্থা বাংলাদেশে গণতন্ত্র কায়েমের জন্য আসে না, বলাই বাহুল্য। তারা তাদের নীতি বাস্তবায়নের জন্যই আসে। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশে লড়াই-সংগ্রাম থেমে থাকে নি। থাকবেও না। কিন্তু সেটা ভিন্ন ইতিহাস।
দুই
এটা তাহলে বোঝা যাচ্ছে গণতন্ত্রের কথা বললেও গণতন্ত্রের জন্য ঢাকায় ইন্টারনেশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিউটের অফিস খোলা হয় নি। তাহলে খোলার কারণ কি? কারণ বাংলাদেশ ভূকৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত ১৬ কোটি মানুষ দক্ষিণ এশিয়া সহ সারা বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। বাংলাদেশের নব্বই ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী হবার কারণে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ যে মুলত ইসলাম কিম্বা মুসলমান প্রধান দেশগুলোর বিরুদ্ধেই চলছে এটা বোঝে। অনাহারে অর্ধাহারে অপুষ্টিতে ভোগা বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের এটা বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না। এর ফলে অধিকাংশ মানুষের মনে মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্রোধ তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। একে প্রশমনের উপায় খোঁজা দরকার। বাংলাদেশের প্রতি ইন্টারনেশনাল রিপাব্লিকান ইন্সটিটিউটের অতি আগ্রহের এটা একটি প্রধান কারন।
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার দিক থেকে আরেকটি কারনও আছে। বিশ্ব ব্যবস্থার অর্থনৈতিক ও ক্ষমতার সম্পর্কের ক্ষেত্রে অসাম্য প্রকট। তদুপরি দুর্বল দেশকে ধনি দেশগুলোর ক্রমাগত লুন্ঠনের নীতি বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে যারপরনাই গরিব ও চরম হতাশাগ্রস্ত করে তুলবে। বাঁচার তাগিদে তারা মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে বিদেশে পাড়ি জমাতে চাইবে। ভয়াবহ অভিবাসী সংকট তৈরি হবে। ভারত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ফেলানিদের গুলি করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রেখে এর সমাধান করছে। অন্যান্য দেশ কী ধরণে ব্যবস্থা নেয় বা নিতে বাধ্য হয় তার কিছু কিছু নমুনা কিছুদিন আগে মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে আর এখন ইউরোপগামী মানুষের প্রবাহ দেখে আমরা টের পাচ্ছি। এই বাস্তবতা নতুন ধরণের নিরাপত্তা সংকট তৈরি করেছে। বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ শুধু সে কারণে নয়, বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠি চাইলে যে কোন মুহূর্তে আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরিস্থিতি পালটে দিতে পারে। এই আশংকা সবসময়ই বিরাজ করে। ফলে বাংলাদেশীদের মন মানসিকতা, ভাবভঙ্গি, প্রবণতা ইত্যাদির সতর্ক নজরদারি পরাশক্তিগুলোর জরুরী কাজ হয়ে উঠেছে। ইন্টারনেশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউট ঢাকা শহরে সক্রিয় আরও অনেক সংস্থার মতোই একটি সংস্থা। সকলেরই নজর নিরাপত্তা ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিজ নিজ দেশের স্বার্থের অনুকুল রাখা। এই ক্ষেত্রে দিল্লী কিম্বা মার্কিন নীতি নির্ধারকদের প্রশংসা না করে পারা যায় না। তারা আগামির জন্য আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। আমরা বিশ্ব ইডিয়ট হয়ে আর কতোদিন থাকব, আল্লাই মালুম।
আরেকটি দিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তরুণদেরই বেশি বোঝা উচিত। সেটা হোল প্রথাগত কূটনীতির অবসান ঘটেছে অনেক আগে। এখনকার কূটনীতিকে বলা হয় স্মার্ট ডিপ্লোমেসি। পুরানা কায়দায় রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক শুধু দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে আর হচ্ছে না। এখন দূতাবাসগুলো প্রকাশ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে, ‘চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র’ যা করার করে। অর্থাৎ তাদের স্বার্থ আদায়ের জন্য যা করার কর্তব্য সেটা তারা করে, কিন্তু স্বাভাবিক পথে না। সেটা কূটনৈতিক পথে ঘটে না। যেমন, বিদেশিদের কোন প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে পাশ না হলে ক্ষমতাসীনদের কোন না কোন নেতাকে দিয়ে ঝামেলা তৈরি করা, একই ভাবে মন্ত্রীদের দফতরে কিছু আটকা পড়লে সেই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ, ইত্যাদি।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জনমত নিয়ন্ত্রণ করা। স্মার্ট ডিপ্লোমেসির দিক থেকে সমাজের দুটো শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক হচ্ছে শিক্ষিত তরুণ সমাজ, যাদের অধিকাংশই শহুরে আর দুই গণমাধ্যম। এ কারনেই বাংলাদেশে আমরা ইয়ুথ নেটওয়ার্ক, ইয়ুথ ফেস্টিভালসহ নানান ইয়ুথ প্রকল্পের ছড়াছড়ি দেখি। বাংলাদেশে শাহবাগের ঘটনাবলী ঘটানোর পেছনে স্মার্ট ডিপ্লোমেসির সবচেয়ে সফল চর্চা হয়েছিল এটা অনায়াসেই বলা যায়। শাহবাগের পেছনে একদিকে ইয়ুথ আর অন্যদিকে মিডিয়ার ভূমিকা এই দিক থেকে বোঝাবুঝির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। স্মার্ট ডিপ্লোমেসির সঙ্গে শহুরে তরুণদের সম্পর্ক সুনির্দিষ্ট ভাবে বিচার করবার জন্য গবেষণার দরকার আছে। তবে ইসলাম বিদ্বেষী তথাকথিত সেকুলার ‘তরুণ প্রজন্ম’ নামক ধারণা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা থেকে আলাদা কিছু নয়।
ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে নির্বাচনের বিষয়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সমাজের রাজনৈতিক মতামত প্রভাবিত করবার জন্য জনমত জরিপ করে। এই ধরনের জরিপ সাময়িক জনমত প্রভাবিত করতে ভূমিকা রাখে। আজ তাদের একটি জরিপ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। দৈনিক প্রথম আলোর হেডিং হচ্ছে, ‘মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপ:সরকারের সমর্থন বেড়েছে দুর্নীতি নিয়ে উদ্বেগ’। অর্থাৎ জনগণ দুর্নীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন তবে শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন আগের চেয়ে বেড়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন অব্যাহত আছে, কিন্তু তা থাকলেও জরিপ জানাচ্ছে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন বেড়েছে। যারা নিত্যদিন জনগণের সঙ্গে কথা বলেন, নানান কাজে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের পক্ষে জরিপের এই ফলাফল মেনে নেওয়া কঠিন। এটাও অবাস্তব মনে হয় দেশের চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে লোকজনের মনোভাব ইতিবাচক। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ নাই, তা বলা যাবে না। কিন্তু সেটা শর্ত সাপেক্ষে। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশের জন্য একটি শক্তিশালী অবস্থান অর্জনের ওপর তা নির্ভর করছে। বলাবাহুল্য, জরিপ করে এই ধরনের কথা প্রতিষ্ঠা রাজনীতিমুক্ত নয়। গত ২৩ মে থেকে ১০ জুন ১৮ থেকে বেশি বয়সের ২ হাজার ৫৫০ জন নারী-পুরুষের ওপর জরিপ চালিয়ে ষোলকোটি মানুষের পক্ষে এই বক্তব্য ক্ষমতাসীনদের পক্ষেই যায়। এই রাজনৈতিক প্রচারকে ‘জরিপ’ দাবি করা কতোটুকু সমীচিন সেটা পাঠকদের ওপরই আমি ছেড়ে দিচ্ছি। তবে জরিপের খবর ছাপতে গিয়ে প্রথম আলো নিজে পক্ষপাতী হয়ে শিরোনামটি করে নি, সংস্থাটি শিরোনাম যেভাবে দিয়েছে তা অনুবাদ করেছে মাত্র।
সংস্থাটির জরিপ কিছুটা বিস্তৃত আলোচনা দাবি করে, বিশেষত তাদের আগের জরিপগুলোসহ। জরিপের প্রয়োজন নাই, বা তার কোন ইতিবাচক ভূমিকা নাই, এটা আমার দাবি নয়। তবে যে কোন সংস্থার জরিপের উদ্দেশ্য, প্রতিক্রিয়া বা প্রভাব বিচার সুনির্দিষ্ট ভাবে করা জরুরী। বর্তমান জরিপ নিয়ে প্রয়োজনে অন্যত্র আলোচনা করব। তবে ডেইলি স্টার জরিপের খবর গ্রাফ এঁকে দর্শনীয় ভাবে যেভাবে ছেপেছে সেটা বেশ ইন্টারেস্টিং। জরিপের শিরোনাম ক্ষমতাসীনদের প্রতি পক্ষপাতী হলেও জরিপের কয়েকটি সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সকল সিদ্ধান্ত বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি করে।
অনেক কিছু কাণ্ডজ্ঞানেই বলা যায়। যেমন, গণতন্ত্রের ভুলত্রুটি আছে, কিন্তু তারপরও গণতন্ত্র চাই – জরিপে এটাই নাকি জনগ্ণের মত। ভাল। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ চরম ভাবে সেনা বাহনী, গণমাধ্যম , সুশীল সমাজ ও র্যা পিড একশান ব্যাটেলিয়নের ভক্ত – এটা অবাক করবার মতো জরিপ বটে। জরিপ এটাই প্রমাণ করতে চাইছে। জরিপের ভাষায় এই ভক্তিকে বলা হয় ‘এপ্রুভাল রেটিং’ – অর্থাৎ এদের ভূমিকার প্রতি জনগণের সম্মতি রয়েছে। তাই কি? শতকরা ৮৬ ভাগ সেনাবাহিনী, র্যা বের জন্য ৭৬, সুশীলদের জন্য ৮০ আর গণমাধ্যমের প্রতি সম্মতি রয়েছে ১০০ জনে ৮৩ জনের। এটা অবাক করে বলা ঠিক নয়, হতভম্ব করা জরিপ। পাশাপাশি যখন বলা হয় কিন্তু রাজনৈতিক দলের প্রতি জনগণের সম্মতি দুর্বল, তখন গুরুতর প্রশ্ন তৈরি হয়। বাংলাদেশ কি তাহলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে নিজের রূপান্তর ঘটাবার ইচ্ছা পোষণ করে না? জরিপওয়ালারা কি সেটাই বোঝাতে চাইছেন? বোঝাতে চাইছেন এক এগারোর মতো সুশীল-মিডিয়া-সেনাবাহিনী-র্যা ব মিলে নতুন কোন শক্তির অভ্যূদয় ঘটুক? জনগণ কি আসলেই সেটাই চাইছে। নাকি এই ধরণের কিছু ঘটবার শর্ত তৈরি হয়েছে তারা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছেন? নইলে রাজনৈতিক দল নয় – বাংলাদেশের জনগণের ভন্তি সেনাবাহিনী, র্যা ব, গণ্মাধ্যম ও সুশীল সমাজের ওপর। এই জরিপের মানে কি? জরিপের এই সিদ্ধান্ত কী বোঝাতে চাইছে সেটা খুব বড়সড় অস্বস্তির কারণ হয়ে রইল।
তিন
ইন্টারনেশনাল রিপাববলিকান ইন্সটিটিউটের জরিপ। যারা এই সংস্থাটি সম্পর্কে জানেন, তাঁদের অস্বস্তি হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষত যাঁরা হাইতির ইতিহাস কিছুটা জানেন। এই সংস্থাটির বিরুদ্ধে নির্বাচিত সরকারকে অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে উৎখাতের অভিযোগ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগের মতো সেনাবাহিনী দিয়ে অভ্যূত্থান ঘটায় না। নতুন স্মার্ট ডিপ্লোমেসির চরিত্রই হচ্ছে ষাটের দশকের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসা কূটনীতি। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলা আর অন্যদিকে সেনাবাহিনী দিয়ে ক্ষমতা দখল ভাল দেখায় না। অন্য দেশের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের নতুন কৌশল হচ্ছে সেনাবাহিনী, গণমাধ্যম, রাষ্ট্রের বল প্রয়োগের প্রতিষ্ঠান এবং সুশীল সমাজ মিলে নতুন অক্ষ শক্ত তৈরি করে অপছন্দের সরকার উৎখাত করা। বাংলাদেশের জনগণ শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন করে এটা অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে বলেই আমি তাদের জরিপের ভেতরের দিকটা বোঝার চেষ্টা করছি। এই শিরোনাম একটি ছল হতে পারে। বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্র চায়, কিন্তু তাদের আস্থা রাজনীতি বা রাজনৈতিক দলে নয়, তাদের আস্থা সেনাবাহিনী, র্যা ব, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম। ক্ষমতাসীনদের ওপর আস্থার ইঙ্গিত দিয়ে জরিপ ইঙ্গিত দিচ্ছে ভিন্ন দিকে। গণতন্ত্র কায়েমের জন্য বাংলাদেশের জনগণ অরাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ওপর নির্ভর করে। জনগণ কি তাহোলে এক এগারোর মতো সেনাবাহিনী-সুশীল-গণমাধ্যমের সংঘবদ্ধ শক্তির ওপর গঠিত ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিন ধরনের সরকার চাইছে? ইন্টারনেশনাল রিপাববলিকান ইন্সটিটিউটের জরিপের এটাই তো মানে দাঁড়ায়।
ইদানীং ক্ষমতাসীনদের মুখে বারবারই শুনছি, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে। এমনকি তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে সেটাও অনেকে প্রকাশ্যে বলছেন। এগুলো সত্য না মিথ্যা জানি না। কিন্তু এই ধরণের জরিপ আমাদের ঘোর অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর একটি জনগোষ্ঠিকে ভয়াবহ বিপদের মুখে ফেলে দিতে পারে। এক এগারোর পরিণতি কি হয়েছে তা আমরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এই ধরণের সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের কোন কথা বলাও সঙ্গত নয়, কারণ এই ধরণের বক্তব্য অরাজনৈতিক ভাবে ক্ষমতা বদলের পক্ষে ন্যায্যতা তৈরি করে। আমি সব সময় ঘোরতর ভাবে এই ধরণের তৎপরতার বিরোধিতা করি।
ইন্টারনেশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউটের বিরুদ্ধে ক্যু কানেকশান বা অভ্যূত্থানের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার অভিযোগ কেন ওঠে? বাংলাদেশের জরিপকে একটি উসকানি গণ্য করলে বোঝা যায় অভিযোগ কেন ওঠে। হাইতিতে জাঁ-বারতান্দ আরিস্তিদ সরকার ২০০৪ সালে উৎখাত হয়। আরিস্তিদেরও আওয়ামি মার্কা বামপন্থি বাগাড়ম্বর ছিল। জনপ্রিয়তাও কম ছিল না। কিন্তু বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অত্যাচার নির্যাতন করবার ক্ষেত্রেও আরিস্তিদ সরকারের জুড়ি ছিল না। তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দানা বাঁধে। সেই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে আরিস্তিদ ক্ষমতা ছেড়ে মার্কিন সরকারের দেওয়া উড়োজাহাজে দেশ থেকে পালান।
দুই দুইবার নির্বাচিত আরিস্তিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ গড়ে তোলার পেছনে যারা ছিল দেখা যায় তারা ইন্টারনেশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউটের কাছ থেকে ডেমোক্রেসির ট্রনিং পেয়েছিলেন। যেসব নেতারা আরিস্তিদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সংঘটিত করছিলেন, ২০০২ থেকে ২০০৩ সময়কালে তারা প্রশিক্ষণ পান। টাকা দিয়েছে মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডি। ডমিনিকান রিপাবলিক ও মায়ামিতে গণতন্ত্র শেখাবার জন্য অসংখ্য ‘পলিটিকাল ট্রেনিং’ হয়। প্রায় ছয় শ জন হাইতির রাজনৈতিক নেতা প্রশিক্ষণ পান। ইন্টারনেশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউটের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে তাদের স্মার্ট ডিপ্লোমেসি বা গণতন্ত্রের টেনিং দেওয়ার উদ্দেশ্যই ছিল আরিস্তিদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা। ভালোই গণতন্ত্রের টেনিং।
ইন্টারনেশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউটের এই জরিপ সম্পর্কে আমার অস্বস্তির কারন হাইতি ছাড়াও কম্বডিয়া এবং আরও কয়েকটি ল্যাটিন আমেরিকার দেশে তাদের ভূমিকা। ফলে বাংলাদেশে তাদের জরিপের সিদ্ধান্তগুলো পক্ষপাতদুষ্ট বলে আমার অস্বস্তি লাগে নি, বরং সামগ্রিক ভাবে জরিপ যে ইঙ্গিত দিতে চেয়েছে সেটাই অস্বস্তির কারণ হয়েছে। রাজনৈতিক দিক থেকে এই জরিপ অর্থপূর্ণই। এর বেশী আপাতত বলার কিছু নাই।
জরিপটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রকাশিত হোল। আগামী ১১ই সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চতুর্থবারের মতো নিরাপত্তা সংলাপে বসছে বাংলাদেশ। দুই দেশের বিদ্যমান নিরাপত্তা সহযোগিতার সার্বিক দিক নিয়ে সেখানে আলোচনা হবে। সংলাপের এজেন্ডা এখনও চূড়ান্ত হয় নি। নিরাপত্তা সম্পর্কিত যে কোন ইস্যুতে বিভিন্ন সময়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয়, ফলে এটা নতুন কিছু নয়। সর্বশেষ নিরাপত্তা সংলাপ হয়েছিল ২০১৪ সালের ২২-২৩ এপ্রিল ঢাকায় । দুই দিনের সেই আয়োজনে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন, নিরাপত্তা ও মানবিক সহায়তা, যৌথমহড়া, প্রশিক্ষণ, দুর্যোগ মোকাবিলায় পারস্পরিক সহযোগিতা এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছিল। বলা বাহুল্য জরিপটি সেই আলোচনায় পরিবেশ তৈরির গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হবে। ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতিই সমস্যা, তাদের ক্ষমতায় থাকার ন্যায্যতা নয়। জনগণের সমর্থনই এই ক্ষেত্রে মানদণ্ড। ক্ষমতাসীনরা এতে নিশ্চয়ই খুশি।
কিন্তু সেটা ছলনা হতে পারে। কারন রাজনৈতিক দল নয়, এক এগারোর মতো সেনাবাহিনী-সুশীল-গণমাধ্যমের সংঘবদ্ধ শক্তির ওপরই জনগণের আস্থা ইন্টারনেশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউটের জরিপ সেই দিকটাও বলে রেখেছে। দরকারে তার ব্যবহার হয়, বাংলাদেশে আমরা তা অতীতে দেখেছি।
ক্ষমতাসীনরা খুশি হোক, অসুবিধা নাই। কিন্তু আমাদের অস্বস্তি যাবে না। কারন ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। তাই না?
৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫। ২০ ভাদ্র, ১৪২২। নবপ্রাণ আখড়াবাড়ী, কুষ্টিয়া