নদিয়ার ভাব ও লালন শাহ


এক

ফকির লালন শাহ তিরোধান করেছিলেন পহেলা কার্তিকে। বাংলা বছর ১২৯৭ আর ইংরেজি ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর। এই বছর পহেলা কার্তিক ১৪২২ (১৬ অক্টোবর ২০১৫), ফকির লালন শাহের ১২৫তম তিরোধান দিবস। 

তিরোধান দিবস হবার কারনে দিনটি শোকের দিন হিশাবে তাঁর অনুরাগী ও অনুসারীরা পালন করে থাকেন। তাদের জন্য এটা কান্নাকাটির দিন। কিন্তু এখন এই দিনটিকে একধরণের উৎসবে পরিণত করা হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে দেখছি পহেলা কার্তিকে ছেঁউড়িয়াকে একটা মেলায় পরিণত করা হয়। এর নানা কারন আছে।  লালন ফকিরের ধাম যাদের 'টাঁকশাল' সেই সাধকরা কার্যত তাদের নিজেদের ধাম থেকেই বিতাড়িত। তাঁরা ধামের রক্ষা বা ব্যবস্থাপনায় নাই। যাঁরা আছেন তাঁরা এই ধারার কেউ নন, হয়তো অনেকে লালনের ভাবেরও বিরোধী। লালন একাডেমি নামে যে সরকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে পদাধিকার বলে আমলারাই তার নির্বাহী কর্তা। এর দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় ভাবে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর ন্যস্ত, জেলা প্রশাসকই লালনের মাজারের মূল সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারী। যাদের ধাম সেই লালন অনুসারী ও অনুরাগী ফকির দরবেশরা এর দায়িত্ব নাই। বাস্তবতা হোল ফকির-দরবেশ সাঁইজীর ‘মাজার’ থেকে বিতাড়িত। এটা কোন 'মৌলবাদ' বা সাম্প্রদায়িক শক্তি করে নি, করেছে আধুনিক সেকুলার রাষ্ট্র।  ছেঁউড়িয়ায় ধীরে ধীরে এমন সব লোকজনের উৎপাত বেড়েছে যাদের সঙ্গে নদিয়ার সাধনার ধারার কোন দূরবর্তী সম্পর্ক নাই।  অথচ বাংলার ভাবান্দোলন ও ভাবচর্চার সবচেয়ে উর্বর ক্ষেত্র কুষ্টিয়া ও তার সন্নিহিত অঞ্চল, ১৯৪৭ সালের আগে সীমান্তের দুইপাশের ভূখণ্ড নিয়ে যা ‘নদিয়া’ নামে খ্যাত ছিল। ‘নদিয়ার ভাবের কথা, অধীন লালন জানে কি তা?’ – এই প্রশ্ন ও আকুতির ওপর ভাবচর্চার যে পরিবেশ এই অঞ্চলের সাধুগুরুরা সারাজীবনের ত্যাগ ও তিতীক্ষার বিনিময়ে গড়ে তুলেছিলেন তার কিছুই প্রায় আর অবশিষ্ট নাই।ছেঁউড়িয়া গেলে আমরা দেখি আমলাদের বাণী খোদাই করে রাখা হয়েছে। নন্দলাল বসুর এক বিরাট মুরাল বানিয়ে রাখা হয়েছে যা লালনের ছবি না, শিল্পীর কল্পনা।

‘নদিয়া’ কথাটা অবশ্য কখনই ভৌগলিক অর্থে ব্যবহার করা হোত না। বরং একটা ঠিকানা বা ভাবচিহ্নের মতোই জারি ছিল, যার উৎপত্তি ঐতিহাসিক ভাবেই ঘটেছিল সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে। দাবি করা যেতে পারে এটা অনিবার্য ভাবেই ঘটেছিল। বাংলার মুসলমান সুলতানদের আমলে ইসলাম জাতপাত বিরোধী সামাজিক আন্দোলনকে যেমন অনুপ্রাণিত করেছিল, তেমনি প্রশ্রয়ও দিয়েছিল। উচ্চ বর্ণের জাতের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণ ও নিম্নকোটির মানুষের লড়াই সুলতানরা ক্ষমতায় না থাকলে সম্ভব হোত কিনা সন্দেহ। সুলতানি বঙ্গে ইসলামের ইতিহাসের আবহে সমাজের ক্ষমতার সম্পর্কে যে রূপান্তর ঘটছিল তার পরিণতি হিসাবে নদিয়ার তিন পাগল বা তিন ফকিরের আবির্ভাব: চৈতন্য, নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতাচার্য: ‘তিন পাগলে হোল মেলা নদে এসে’। সেই আবির্ভাবের আখ্যান আমরা আন্দাজ করতে পারি, কিন্তু পুরাপুরি ইতিহাস আজও জানা নাই। নদিয়ার বিপ্লব সুলতানি আমলেই ঘটেছিল। অতএব সেই সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাস পাঠ না করে চৈতন্যের বৈপ্লবিক ভূমিকার উৎপত্তি কারণ এবং তার ভাবগত চরিত্রের বৈশিষ্ট্য কখনই বোঝা যাবে না।

কিন্তু আধুনিক ইতিহাস রচনা সাম্প্রতিক কালের আবিষ্কার।  আমরা যখন ইতিহাস চর্চা একটু আধটু করতে শিখেছি তখন বাংলাভাষী জনগোষ্ঠি ঔপনিবেশতার কুফলে দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে গিয়েছে।  ফলে নদিয়ায় চৈতন্যের নেতৃত্বে যে সামাজিক ও ভাবগত বিপ্লব ঘটেছিল সেটা আজ অবধি সাম্প্রদায়িক ভাবে দুই চোখের দুই প্রকার খণ্ডিত দৃষ্টি দিয়েই দেখা হয়। মুসলমান মুসলমানের চোখ দিয়ে দেখে, হিন্দু হিন্দুর। সেভাবেই অতীতকে দেখতে ও বিচার করতে বাংলাভাষীরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। বাংলাভাষী হিসাবে সামগ্রিক ভাবে নিজেদের ইতিহাসের যুগান্তকারী মুহূর্তগুলো বোঝা ও বিশ্লেষণ তাদের সাধ্যের বাইরে চলে গিয়েছে। আমাদের ভাষিক অস্তিত্ব কোন প্রকার ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতিবাদী ধারণা থেকে বলছি না, বরং ভাবচর্চার ক্ষেত্র থেকে বলছি। আমরা আমাদের নিজ নিজ ভাশার মধ্যেই বাস করি। যা এখব প্রায় অসাধ্য হয়ে গিয়েছে আবার তাকে সাধ্যাধীন করা রীতিমতো নতুন রাজনৈতিক সংগ্রামের ব্যাপার।

গুরুত্বপূর্ণ বোঝাবুঝির দিক হোল বাংলাভাষীদের মধ্যে ধর্ম বলি, ঐতিহ্য বলি কিম্বা ইতিহাস বলি নিজেদের বৈচিত্রের গৌরব উপলব্ধির শক্তি যেমন তারা হারিয়ে ফেলেছে একই ভাবে ঐক্যের ক্ষেত্র ও ভাবচর্চার বৈপ্লবিক বাঁকগুলির ইতিহাসও এখন আর সাফ নাই, আবছা হয়ে গিয়েছে। প্রায় অস্পষ্ট বলা যায়। আশার কথা এতোটুকুই যে সুলতানি আমল -- বিশেষত আলাউদ্দিন হোসেন শাহ যদি প্রশ্রয়দাতা হয়ে থাকেন তাহলে নদিয়ার ভাবের গুরু চৈতন্য, নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতাচার্য -- ছেঁউড়িয়া এখনও এই সত্যেই অবগাহন করে। নদিয়ার ভাবের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটেছে লালন সহ নদিয়ার পাঁচ ঘরকে কেন্দ্র করে। লালন ছাড়া বাকি চার ঘর সতী মা, পাঞ্জু শাহ, চৌধুরী ও দেলবার শাহ। তবে, বলা বাহুল্য, ভাব ও প্রকাশের শক্তির দিক থেকে ফকির লালন শাহ যে পরিমান দৃশ্যমান , অন্যরা অতোটা নন। কিন্তু অন্যেরা কোন অংশেই ভাবচর্চা দিক থেকে লালনের চেয়ে কমতি নন। তাঁরা লালনের ঘরে তাই 'গদি মান্য'।

শ্রী চৈতন্য নদিয়ায় অবতীর্ণ হয়েও নদিয়া ছেড়ে গিয়েছেন বলে নদিয়ার সাধকদের অভিমান আছে। তারপরও যাঁরা নদিয়ার ভাবের খোঁজে ভাবের মানুষগুলোকে  খুঁজে বেড়ান, প্রায় বিলুপ্ত সেই রকম কোন 'রসিকজন'-এর  সাক্ষাৎ মিললে নদিয়ার উৎসমুখের হদিস তাঁরা এখনও পেতে পারেন। অর্থাৎ গৌরাঙ্গের প্রেরণায় হোসেন শাহীর বাংলায় যে একটা ভাবের বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল সেটা সহজেই তাঁরা চাইলে এখনও অনুমান করতে পারেন। বুঝতেও পারবেন। এটা নিশ্চিত। নিদেন পক্ষে এটা তাঁরা আন্দাজ করতে পারবেন যে পুরানা তান্ত্রিকতা বা দেহকে উপায় মাত্র গণ্য করে নানান কিসিমের শক্তিশালী যেসকল তান্ত্রিক সাধনার ধারা চৈতন্যের আগে এই অঞ্চলে বলবৎ ছিল তার সঙ্গে নদিয়ার আসলে ছেদ ঘটে গিয়েছে অনেক আগেই। চৈতন্যের সময় থেকেই। তারপরও তার জের রয়ে গিয়েছে। কেন এই জের থেকে গেল, ফকির লালন শাহের সাধনার ক্ষেত্রে এর সুনির্দিষ্ট ভূমিকা কী – সেইসব আসলে গভীর গবেষণা বা বিস্তারিত আলোচনার বিষয়। খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পরিশ্রমে আমাদের প্রবল অনীহা। এই ক্ষেত্রে আমরা খুব একটা অগ্রসর হতে পারি নি।

আপাতত এই দিকটা বোঝা যথেষ্ট যে লালনকে ‘বাউল’ বা ‘বাউল সম্রাট’ আখ্যা দিয়ে নেশা দ্রব্য গ্রহণ, নানান গুহ্য দেহবাদী চর্চার ধারা জারি রাখা এবং জগত-সংসার থেকে পলাতক উদাসীন জীবন যাপনের রোমান্টিকতা ইত্যাদিকে সহজেই ন্যায্য ও বলবৎ রাখা যায়। কিন্তু তিনি চিন্তা বা ভাবের ক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্যের পরে কিভাবে আরেকটি বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটিয়েছেন সেতা তাঁর সাধনার ধারা সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে অনুমান করা সম্ভব নয়। নদিয়ার ভাবের বিপ্লবকে হৃদয়ঙ্গম করা ও বোঝা কঠিন এবং বেশ বড়সড় কাজ। লালনকে স্রেফ 'বাউল' বানাবার ঘোরতর বিপদতা এখানেই।

লালন নিজেকে কখনই ‘বাউল’ বলেন নি। বাংলা ভাবজগতে বাউলদের অবদান আছে নিঃসন্দেহে। বাউলের জীবন ভাল কি মন্দ সেটাও সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিতর্ক, সেখানেও ভিন্ন ভিন্ন ধারা ভিন্ন ভিন্ন স্রোত রয়েছে। সব কিছুকে এক ঝুড়িতে রাখবারও কোন যুক্তি নাই। নৈতিক বিচারের মানদণ্ড দিয়ে মানুষের বিচিত্র ও বিভিন্ন জীবনযাপনকে আমরা কোন দিনই বুঝব না। কিন্তু যিনি তাঁর সাধনার কোন পর্যায়ে কিম্বা তাঁর রচনার কোত্থাও নিজেকে 'বাউল' বলেন নি, তাঁকে ‘বাউল’ বানাবার চেষ্টা খুবই অন্যায়। এবার ছেঁউড়িয়ায় ফকির লালন শাহের তিরোধান দিবসে দেখছি, তাঁকে লালন একাডেমি ‘বাঊল সম্রাট ফকির লালন শাহ’ হিসাবেই উদযাপন করছেন। বাউল্রা তাঁর গান করেন, তাঁকে ভালবাসেন। অবশ্যই। অথচ কীসে তিনি বাউলদের সম্রাট হলেন? তার কোন ভিত্তি নাই। এখন দেখছি সিলেটের শাহ আবদুল করমকেও 'বাউল সম্রাট' বলা হচ্ছে।  আশা করি লালন একাডেমি এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটির প্রতি ভবিষ্যতে নজর দেবেন। তাঁরা তাঁদের আমন্ত্রণ পত্রে যে ছবি ছেপেছেন, সেটাও লালনের নয়, নন্দলাল বসুর আঁকা ছবি। তাতে দোষ নাই, যদি বলে দেওয়া হোত, এটা লালনের ছবি নয়। অথচ যাঁরা জানে না তাঁরা ধরে নেবেন নন্দলালের আঁকা ছবিটিই বুঝি লালন শাহের ছবি। সত্য হোল এই যে লালনের কোন ছবি নাই, তিনি কোন ছবি রেখে যান নি। তাছাড়া লালনপন্থী সাধনায় ছবি পূজা বা মাজার পূজার কোন বিধান নাই। এই ধারা গুরু ভজনা করে, নিজ নিজ গুরুর রূপ ছাড়া তারা অন্য কোন রূপ ভজনা করে না। ছেঁউড়িয়ায় ফকির লালন শাহের ভাবের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা খুবই দরকার। আশা করি সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনও এই ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা নেবেন।

দুই

এই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রাচীন তান্ত্রিক ধারার সঙ্গে শ্রীচৈতন্যের আমলেই কিভাবে ছেদ ঘটেছে বা ছেদ তৈরি জরুরী হয়ে উঠেছিল তা আমাদের বুঝতে হবে। এই বিষয়ে নানান দিক থেকে বিস্তর গবেষণার দরকার আছে। কিভাবে ছেদ ঘটল বুঝতে চাইলে নদিয়া শক্তির উপাসনার বিপরীতে ভক্তির ধারা কেন মেনে নিল সেই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান একটা পথ হতে পারে। জীব-শরীর পরমকে পাবার ‘উপায়’ বা ‘হাতিয়ার’ মাত্র নয়, বরং মানুষজের দেহ জীব ও পরমের যুগল লীলা মাত্র – নদিয়া কেন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাল সেই সওয়ালের জবাব খোঁজা আরেকটি পথ। জীব ও পরম অদ্বৈত – তারা দুই নয় এক; কিন্তু অন্য দিকে তাদের মধ্যে ফারাকও রয়েছে, কিন্তু উভয়ের সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ণয় চিন্তা বা বুদ্ধির নির্ণয় নয়। তা ‘অচিন্ত্য’ --  অর্থাৎ যা চিন্তার অগম্য, অচিন্তনীয় বা অধরা। কেন শ্রীচৈতন্য এই প্রকার ‘অচিন্ত্যভেদাভেদ’ তত্ত্বে এসেছিলেন তা নদিয়ার বর্তমান ভাবান্দোলনের আলোকেই বুঝতে হবে। এরপর দেখা দরকার ফকির লালন শাহ কিভাবে, কতোটুকু এই ভাব বহন করেছেন, এবং কোথায় তিনি আলাদা হয়ে নতুন ভাবের জগত তৈরি করেছেন। এই দিকটি স্পষ্ট না হলে নদিয়ার ভাবান্দোলনের সঙ্গে গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্ব চর্চার – অর্থাৎ নদিয়ার সঙ্গে বৃন্দাবনী গোস্বামীদের মিল ও ফারাক শনাক্ত করবার শর্ত তৈরি হবে না। কিম্বা তন্ত্রের পর্যায় থেকে নদিয়া কিভাবে রসতত্ত্বে প্রবেশ করলো ভাবচর্চার সেই ইতিহাস জানবার শর্তও তৈরি হবে না। সেই শর্ত তৈরি হলেই কেবল রসতত্ত্ব থেকে ভাবের চর্চা অবধি বাংলার ভাবান্দোলনের যে অভিযাত্রা তার পথরেখা, বাঁক ও মোড়গুলো আমরা আরো ভাল ভাবে বুঝব। এই গুরুত্বপূর্ণ পরিক্রমা শুরু করতে হলে লালনকে খামাখা বাউল বানাবার চেষ্টা অবশ্যই বন্ধ করা দরকার।

যিনি এখনও তন্ত্র চর্চা করেন তিনি শক্তির উপাসক হতে পারেন, জীবাবস্থা থেকে মুক্তির জন্য জীবদেহে অলৌকিক শক্তি সঞ্চারের ইচ্ছা বা সংকল্প তাঁর থাকতেই পারে, কিম্বা হতে পারে স্রেফ তুরীয়ানন্দ অবস্থা প্রাপ্তিই তাঁর সাধনার লক্ষ্য। এই ক্ষেত্রে একদিকে তার ইচ্ছা বা কামনা আর অপর দিকে তাঁর উদ্দেশ্য বা কাম্যবস্তু পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুটো বিচ্ছিন্ন জগত হিসাবে হাজির হয়। আর, দুইয়ের মাঝখানে তাঁর শরীর বা দেহ। নিজের উদ্দেশ্য বা কামনা বাস্তবায়িত করতে হলে তিনি নিজের বা অপরের শরীরকে অনিবার্য ভাবেই হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন। নিজের ইচ্ছা বাস্তবায়িত করবার জন্য শরীরকে তিনি স্রেফ উপায়ে পর্যবসিত করেন। শরীর কি স্রেফ ব্যবহার্য ‘হাতিয়ার’ মাত্র? যন্ত্র? যদি তাই হয় তবে তিনি নিজেকে নিজের কামনা, ইচ্ছা বা আগাম নির্ধারিত একটি উদ্দেশ্যের অধীন করে ফেলছেন। নিজেকে নিজের কামনা-বাসনার দাসে পরিণত হয়েছেন। প্রাচীন তন্ত্র সম্পর্কে এখানেই নদিয়ার আপত্তি। বিভিন্ন গুহ্য সাধনার ধারা বিভিন্ন বাউল নামধারী চর্চা জারি রাখলেও, ফকির লালন শাহ নির্বিচারে এই পথকে তাঁর নিজের পথ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন – এই দাবি সত্য নয়। তিনি সরবে তা বলেও গিয়েছেন: “ভাব দিয়ে ভাব নিলে পরে তবেই রাঙ্গা চরণ পায়’। ভাব যদি না থাকে তন্ত্র কি ভক্তি কিছুই কাজে আসে না। রসতত্ত্ব থেকে নদিয়ার ভাবান্দোলনে প্রবেশের এটাই প্রধান ফটক। এরপর বিচার করা যেতে পারে তিনি ‘করণ’ কর্ম হিসাবে শিষ্যদের  কি ধরণের বিধিশৃংখলার চর্চা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

নদিয়া দাবি করে শরীর উপায় মাত্র হতে পারে না, কারন শরীরের মধ্যে যিনি বাস করেন তিনি আমি। যিনি একই সঙ্গে কর্তা (কিম্বা সাংখ্যের পুরুষ বা পরম) এবং জীব – অথচ জীবদেহের বাইরে এই কর্তার আলাদা কোন অস্তিত্ব নাই। এই অর্থে তিনি পরম যে তাঁকে শুধু জীবদেহ হিসাবে পর্যবসিত করা যাচ্ছে না । মানুষ শুধু জীব নয়, একই সঙ্গে পরমার্থিক। এ এমনই এক সত্তা যা একই সঙ্গে দিব্য বা দিব্যগুণ সম্পন্ন। অথচ তার বর্তমানতা জীব হয়ে, শুধু মাত্র জীব রূপে। জীবের শরীরের বাইরে তার কোন বিমূর্ত, মিস্টেরিয়াস, গুহ্য, গুপ্ত, মারেফতি বা পরাবিদ্যামূলক অস্তিত্ব নাই। এই দিব্যতা একান্তই রক্তমাংসের মানুষ রূপে হাজির। এই কর্তা চাইলে তার জীবের চরিত্র অতিক্রম করে যেতে পারে। সেটা একমাত্র ভাব চর্চার মধ্য দিয়েই কেবল সম্ভব। ভাবচর্চার মধ্যে মানুষ  দিব্যরূপ পরিগ্রহণ করতে পারে, যা একই সঙ্গে তার নিজের ও বাইরের  জগতের সঙ্গে তার সম্পর্ক রূপান্তরের প্রাথমিক শর্ত। নিজের দিব্যতার বিকাশের মধ্য দিয়েই মানুষ নিজের স্বরূপ দেখাতে পারে। নদিয়া এই বর্তমানতা বা বর্তমানেরই ভজনা করে। নদিয়ার ভাষা যা মানুষেরই ভজনা। নদিয়া কোন কোন অনুমানের ওপর চলতে চায় না।

শ্রীচৈতন্যের অচিন্ত্যভেদাভেদের অবস্থান থেকে নদিয়া এই ক্ষেত্রে প্রস্থান করে নি। কিন্তু আপত্তি জানায় এভাবে যে পরমের আস্বাদন আকাঙ্ক্ষায় গৌড়ীয় বৈষ্ণবতত্ত্ব  জীবের প্রকৃতি বা জীবের দাবিকে অস্বীকার করে। কাম বাদ দিয়ে বিশুদ্ধ প্রেমের কথা বলে।  জীব ও পরমের যে সম্বন্ধকে চৈতন্য ‘অচিন্ত্য’ বা অচিন্তনীয় বলেছেন , তা আসলে বিষ আর অমৃতের সম্বন্ধ। ‘বিষামৃতে আছেরে মাখা জোখা’। তাই শরীরে যেখানে সাঁই বিরাজ করেন, যেখানে তাঁর বারামখানা, সেটা দেখলে ‘প্রাণ চমকে ওঠে’। দেখলে মনে হয় সাপ ফণা তুলে রেখেছে। তাই বারবার নদিয়া সাবধান করেছে কাম ছাড়া প্রেম নাই, কিন্তু শরীর বা দেহচর্চার নামে খেলা করতে নামা বিপজ্জনক। সেটা খুম কম মানুষেরই পক্ষেই সাধ্য। সেই পথের ওপর ফকির লালন শাহ রেড এলার্ট বা লালবাতি জারি করে রেখেছেন। এই বিষয়ে তাঁর বিস্তর গান আছে। অর্থাৎ গুহ্য সাধনা চর্চা মোটেও উৎসাহিত করেন নি, আবার বৈষ্ণব গোস্বামী বা ঠাকুর রাধাকৃষ্ণের মতো শুদ্ধ প্রেম বা শুদ্ধ ভক্তির ব্যাপারের সন্দেহ জারি রেখেছেন। তার দেখা যাচ্ছে প্রাচীন তন্ত্র থেকে তিনি যেমন ভিন্ন, একই ভাবে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের ধারা ও ব্যাখ্যাকেও মানেন নি। আর, গোড়ীয় বৈষ্ণবরা শ্রীচৈতন্যকে আবার ব্রাহ্মণ বানিয়ে ছেড়েছেন, নদিয়ার জাতপাত ও নারীপুরুষ ভেদ বিরোধী আন্দোলন থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন সেই অভিযোগ তো আছেই।

বাংলার ভাবের জগতে এ সবই নতুন অনুমান বা প্রস্তাবনা। এর বৈপ্লবিক চরিত্র ধরা পড়বে যদি মনে রাখি চৈতন্যের আমলে  প্রধান বা অধিপতি ধারার মূল অনুমান হচ্ছে মানুষ আগের জন্মে পাপ করেছে বলেই এই জন্মে মানুষ হিসাবে জন্ম গ্রহণ করেছে। মনুষ্য জন্ম একটি শাস্তি, পাপের প্রায়শ্চিত্য। মানুষের মোক্ষ বা মুক্তির উপায় তাহলে একটাই - জন্মসূত্রে  নমঃশূদ্র, শূদ্র বা অন্য নিপীড়িত বা নিপীড়ক যে বর্ণই হোক তাকে অমোঘ বলে গণ্য করা, বর্তমান অবস্থাকে মেনে নেওয়া। বর্তমানকে মেনে নিয়ে উচ্চবর্ণ বা অভিজাতদের বিধিবিধান বিনা বিচারে মেনে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়াই কাজ, যাতে আবার জন্মগ্রহণ করতে না হয়। নদিয়ার এই অনুমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। জাতপাত, নারীপুরুষ ভেদবিরোধী লড়াইয়ের গোড়া এখানে।

মুসলমান ঐতিহাসিকরা চৈতন্য ও তাঁর আন্দোলনকে ইসলাম বিরোধী গণ্য করলেও সাম্প্রতিক গবেষণায় বোঝা যায়, সুলাতানি আমলে ইসলামের সরাসরি প্রভাব ছাড়া জাতপাত বিরোধী আন্দোলন নদিয়ায় গড়ে উঠতে পারতো না। নদিয়ায় ভাবের বিপ্লব ঘটাও সম্ভব ছিল না। শ্রীচৈতন্য নদিয়া ছেড়ে যাওয়ার পর অন্যত্র যে সামাজিক, বর্ণাধিপত্য ও ধর্মতাত্ত্বিক আধিপত্যের মধ্যে পড়েছিলেন তার ফল – নদিয়ার চোখে – ভাল হয় নি। সেই দিকগুলো বোঝা যেমন জরুরী, পাশাপাশি দেহকে উপায় গণ্য করে গড়ে ওঠা নানান কিসিমের প্রাচীন তান্ত্রিক চর্চার ধারা থেকে নদিয়ার রূপান্তর কিভাবে ঘটল সেটা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে শ্রীচৈতন্যের আন্দোলনের প্রভাব স্পষ্ট।

মানুষ দিব্যশক্তিশম্পন্ন এবং তার দেহেই পরম বা মনের মানুষের বাস। নিজের বাইরে তার সন্ধানের কিছু নাই, মানুষের নিজের বাইরে বিমূর্ত উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নির্মাণের বিপদ আছে। – নদিয়ায় দেহ মুখ্য, কারণ দেহই বর্তমান – যা একই সঙ্গে জীব এবং পরম – অথবা পুরুষ ও প্রকৃতি। দেহের ঐক্যই পুরুষ ও প্রকৃতির ঐক্য। এই বৃহত্তর অর্থেই দেহ বাদ দিয়ে নদিয়ার কোন সাধনা নাই। এই দেহবাদ প্রাচীন তন্ত্র ও নানাবিধ গুহ্য সাধনা থেকে আলাদা। দেহ এখানে শুধু মানুষের দেহ নয়, এই দেহ প্রকৃতির অংশ, একই সঙ্গে প্রকৃতি বা ব্রহ্মাণ্ড। দেহকে যদি শুধু আমাদের ভোগ বাসনার উপায় মাত্র গণ্য করি তাহলে আসলে আমরা নিজেকে শুধু নয়, প্রকৃতিকেও ধ্বংস করি যা মানুষের বাসভূমি। ধ্বংস করি পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণের বৈচিত্র। যে কারণে দাবি করা যায় নদিয়ার ভাব সরাসরি একালের পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্র সুরক্ষার লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত। নদিয়া দেহবাদী তাতে কোন সন্দেহ নাই, কিন্তু তার অনুমান, সিদ্ধান্ত ও করণকর্ম আলাদা। ভাবের এই বৈপ্লবিক মুহূর্তগুলো কোন ভাবেই আমাদের হারিয়ে যেতে দেওয়া উচিত হবে না।

আমার জীবনের দীর্ঘ সময় নদিয়ার ভাবের সঙ্গে অতি অন্তরঙ্গ সংস্পর্শে দিন কাটিয়েছি এবং কাটছে।  দিনকে দিন টের পাই কিভাবে মৃত কালিগঙ্গার মতো নদিয়ার ভাব নানান কারনে শুকিয়ে যাচ্ছে। কালিগঙ্গা এখন বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। একদিন এই ভাবচর্চার জমিনের ওপরও বিস্মৃতির আস্তরণ পড়বে, চাপা পড়ে যাবে নদিয়ায় কাব্য ও ভাবচর্চার বৈপ্লবিক ইতিহাস। যা আর কোনদিন ফিরে আসবে না।

চোখের সামনেই দেখি, দীর্ঘদিন ধরে ছেঁউড়িয়ায় অনুষ্ঠান হচ্ছে লালন সাঁইজীর তিরোধান দিবসে কিম্বা দোলে – কিন্তু এই দুটি দিনের মর্যাদা বিন্দুমাত্র রক্ষা হয় না। দেখি, কিভাবে নদিয়ার ভাবের সর্বোচ্চ প্রকাশ লালনের ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে, গাঁজায়, কল্কি, সিদ্ধি এবং নানান গুহ্য সাধনার ইতিবৃত্তে। এটা করা হচ্ছে লালনকে ‘বাউল’ আখ্যা দিয়ে। ‘বাউল সম্রাট’ আখ্যা দিয়ে লালনকে যেমন খুশি তেমন ব্যবহার করা যায়। অথচ বারবার বলছি লালন কখনই ঘূণাক্ষরেও নিজেকে বাউল বলেন নি। বাউল ভালো কি মন্দ সেটা ভিন্ন তর্ক। কিন্তু যিনি নিজেকে সবসময়ই ‘ফকির’ বলেছেন, তাঁকে ‘বাউল’ বানাবার রাজনীতিটুকু আমাদের বোঝা দরকার। বোঝা দরকার, নদিয়ার ভাবের বিপ্লব থেকে খসিয়ে ফেললে তাঁর কী দশা ঘটতে পারে।

সকলকে এই মিনতিটুকু জানাই -- ছেঁউড়িয়ার পরিবেশ সাধকের উপযোগী করে তুলুন।

১৬ অক্টোবর ২০১৫। ১ কার্তিক ২০১৫। নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি। ছেঁউড়িয়া,


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।