সুন্দরবন রক্ষা না হলে ভাবমূর্তিও রক্ষা পাবে না


দেশে যখন দুই বিদেশি নাগরিক হত্যাকে কেন্দ্র করে নানা রঙের (তার মধ্যে লাল অন্যতম) অ্যালার্ট বা সতর্কবার্তা জারি হচ্ছে, তখন সরকার নিজেই জনগণের একটি ন্যায্য দাবিতে পুলিশ দিয়ে লাঠিচার্জ ও হামলা করে নিজেদের ভাবমূর্তি নিজেরাই ক্ষুণ্ণ করছে। পরপর দুই বিদেশি হত্যার ঘটনা (একটি ঢাকায় এবং অন্যটি রংপুরে) বিদেশিদের মধ্যে একটা আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে, এতে কোনো সন্দেহ নাই। পাশাপাশি কিছু হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের মানুষ নিয়েও ঘটেছে সে ব্যাপারে কোনো অ্যালার্ট জারি হয়নি বটে, কিন্তু সবার মধ্যে কেমন একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কী হচ্ছে দেশে? কেউ বলতে পারছে না। দেশের মধ্যেও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। মানুষ নিরাপত্তা চায়। তাই সরকার এখন রাজন হত্যাকারী কামরুল, সৌরভকে গুলি মারার জন্য সংসদ সদস্য লিটন আর নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে তৎপর হয়ে উঠছে। এতে মানুষের মনে ক্ষোভ হয়তো কিছুটা কমবে; কিন্তু ভাবমূর্তি রক্ষার প্রশ্নে বড্ড দেরি হয়ে গেছে।

মজার ব্যাপার হলো, বিদেশি হত্যা কেন হলো এবং আসল দোষী কারা সেটা খোঁজার আগেই মূল কারণ হিসেবে দেখা হলো কারা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চায় সেটা খোঁজা। কারণ এ কাজ তারা ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। সে কারণে যেদিকে আঙুল তোলা দরকার সেদিকে সরকারের প্রধান থেকে শুরু করে, মন্ত্রী এবং সরকার দলের যত নেতাকর্মী, 'দলীয়' সাংবাদিক সবাই একই কথা দিনের পর দিন বলে যাচ্ছেন। এক কথা বারবার বললে 'সত্য' হয়ে যায়, এমন থিউরিতে বিশ্বাসী সরকার সদা সত্য কথা বলবে, এমন বাক্যে আস্থা রাখে না। এতে ক্ষতি হচ্ছে শুধু এটাই যে, প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়ছে না, আর পড়লেও আসলেই সে হত্যাকারী কিনা জনগণের মনে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। সরকার অপরাধীদের ধরার চেয়ে তাকে যেভাবে রাজনৈতিক রঙ দিচ্ছে  তাতে সমাজে নিরাপত্তাহীনতা আরও বাড়বে। সকারের ভাবমূর্তি রক্ষা করতে চাইছে, সেটাও সম্ভব হবে না।

ভাবমূর্তি অন্য কেউ ক্ষুণ্ণ করতে পার, কিন্তু সেটা খুব বেশিদিন টেকে না। সরকার যদি নিজের কাজ ঠিক মতো করে যেতে পারে তাহলে ভাবমূর্তি রক্ষা অবশ্যই হবে। কিন্তু সরকারের নিজের কাজেই যদি ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় তাহলে তা রক্ষাএ আএ কোন উপায় থাকে না।  অন্য কেউ কি তা রক্ষা করতে পারবে? এই প্রশ্ন সরকারকে কে করবে?

দেশের যে কোনো পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে সমাজের ব্যাপক সমর্থন থাকে। সবাই চায় পরিবেশ ঠিক থাকুক, কারণ এর সঙ্গে আমাদের বেঁচে থাকার সম্পর্ক জড়িত। অনেকেই হয়তো সরাসরি অংশগ্রহণ করেন না। এখন মানুষের সচেতনতা বেড়েছে; কারণ তারা তথ্য হাতের কাছেই পাচ্ছেন। যে কোনো সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞেস করেন- আপনি কি চান সুন্দরবন রক্ষা পাক, তাহলে এমন কাউকে পাবেন না যে 'না' বলবে। সবাই একবাক্যে সুন্দরবন রক্ষার পক্ষেই বলবে। যতই বিদ্যুৎ প্রকল্পের আশ্বাস দেয়া হোক না কেন, সুন্দরবন ধ্বংসের বিনিময়ে কেউ চাইবে না বিদ্যুতের বিলাসিতা করতে। অথচ এমন একটি দাবিতে করা 'গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করে সুন্দরবন রক্ষার দাবিতে যে রোডমার্চ ঢাকা থেকে বের হয়েছিল ১৬ অক্টোবর তারা সরকারের রোষের মুখে পড়েছেন। শুরুতেই তাদের ওপর লাঠিপেটা হয় মানিকগঞ্জে, পরদিন ১৭ অক্টোবর, রাজবাড়ী, গোয়ালন্দ, ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরায় পুলিশ তাদের কর্মসূচিতে বাধা দেয় এবং লাঠিপেটা করার ফলে নেতাকর্মীরা আহত হন। এতে পত্রিকার শিরোনাম যা হয়েছে তাতে সরকারের ভাবমূর্তি কোনো অবস্থাতেই রক্ষা পায়নি, বরং রোডমার্চের ব্যাপারে যারা হয়তো তেমন জানত না তারাও জেনেছে এবং ধিক্কার জানিয়েছে। একি কথা! শান্তিপূর্ণ রোডমার্চ করার অধিকার সবার আছে এবং যেখানে দেশের মানুষের স্বার্থ জড়িত সেখানে যদি কেউ কথা বলতে চায় তাহলে অবশ্যই বলতে দিতে হবে। সরকারের এ আচরণ শুধু অগণতান্ত্রিক নয়, এ আচরণের মাধ্যমে সরকারের পরিবেশবিরোধী আচরণও প্রকাশ পেয়েছে। সুন্দরবন দেশের সম্পদ। এই সম্পদ রক্ষা সরকারের প্রধান দায়িত্ব। বিভিন্ন দেশে আইন আছে, পরিবেশের ক্ষতি হয় দেশের সম্পদ ধ্বংস করে এমন কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করা যাবে না। বিদ্যুৎ পাওয়ার সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক আছে ঠিক; কিন্তু বিদ্যুৎ পেতে গিয়ে পরিবেশ ও সম্পদ ধ্বংস হলে সেটা খুবই অদূরদর্শী কাজ হবে। আমরা এখন কিছু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পেতে গিয়ে সুন্দরবন ধ্বংস করতে চাইছি। সুন্দরবনের কারণে দেশের পরিবেশগত যে সুবিধা জড়িত ছিল তার ক্ষতি হলে সেটা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাছাড়া সেখানে যেসব জনগোষ্ঠী এই সুন্দরবনের সঙ্গে জীবন-জীবিকা নিয়ে জড়িত তাদের ক্ষতি করে যে উন্নয়ন সেটা কি ন্যায্য হবে? এত প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই সরকার দিতে পারবে না, দিতেও চায় না। তারা এখন উন্নয়নের বাজি ধরেছে। তার জন্য গণতন্ত্র গোল্লায় যাক, পরিবেশ ধ্বংস হোক তাতে কিছুই যায় আসে না। এ আচরণ কি ভাবমূর্তি রক্ষায় সহায়ক হবে?

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা বিপক্ষে মত দিয়েছে। অনেকেই আশা করেছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পরিবেশ পুরস্কার 'চ্যাম্পিয়ন্স অব দি আর্থ' পাওয়ার কারণে এ প্রকল্প নিয়ে অন্তত পরিবেশবাদীদের সঙ্গে একমত হয়ে কাজ করবেন। তিনি পরিবেশের ক্ষতি হোক এমন কোনো কাজ তার আমলে আর হতে দেবেন না। কিন্তু খুবই হতাশ হয়ে দেখলাম, বিদেশি হত্যার বিষয়ে বলা হলো, প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কার পাওয়ায় যারা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে তারাই ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য এমন জঘন্য কাজ করেছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে রোডমার্চ করলে পরপর দুইদিন বিভিন্ন স্থানে যদি পুলিশের লাঠিপেটা হয়, তাহলে কি সরকারের 'চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ' ভাবমূর্তি রক্ষা পায়? তার ওপর আরও অবাক হয়ে দেখলাম, সাবেক পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ মন্তব্য করলেন যে, এ রোর্ডমার্চ নাকি পিকনিক করার শখ! অথচ তিনিও জেনেভা ভিত্তিক গ্রিন ক্রস ইন্টারন্যাশনাল নামক সংগঠনের কাছ থেকে পরিবেশ রক্ষার কাজের জন্য 'গ্রিন স্টার' পুরস্কার পেয়েছেন। তার এই নিষ্ঠুর পরিবেশবিরোধী মন্তব্য গ্রিন ক্রস ইন্টারন্যাশনাল জানলে তার প্রতি কি একই মনোভাব বজায় রাখতে পারবে? যদি তারাও এই মন্তব্য গ্রহণ করেন তাহলে বুঝতে হবে এই পুরস্কারগুলো নিছক তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়।

তবে এই পরিস্থিতিতে সুন্দরবন রক্ষায় বাগেরহাটের আইনজীবীদের সভায় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। তিনি বলেছেন, আমাদের দেশের বন কমতে কমতে বনাঞ্চল ৮ থেকে ১০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। সুন্দরবন না থাকলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাগেরহাটবাসীই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, এরই মধ্যে এ উপকূলীয় এলাকার পানিতে লবণাক্ততা বেড়েছে। কমে যাচ্ছে কৃষিজমির উর্বরতা। দেখা দিয়েছে খাওয়ার পানির সঙ্কট। সুন্দরবনের বাঘ-হরিণ শিকারি ও বন ধ্বংসকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। বিশ্বের বৃহত্তম বাদাবন, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃত সুন্দরবন সুরক্ষার সঙ্গে বাংলাদেশের পরিবেশ সুরক্ষার সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলীয় এলাকাকে রক্ষা করে থাকে এই অনিন্দ্যসুন্দর বাদাবন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কিছু লোভী মানুষের জন্য সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। তিনি আরও পরিষ্কার করে বলেছেন যে, সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে যান্ত্রিক নৌযান চলাচল এবং পরিবেশ দূষণের ঘটনা বিশ্বের বৃহত্তম বাদাবনের জন্য বিসংবাদ সৃষ্টি করছে। এর পাশাপাশি এ বনের সন্নিকটে শিল্প-কলকারখানা স্থাপন বা বায়ুদূষণের হুমকি নিজেদের পায়ে কুড়াল মারার মতো অপরিণামদর্শী হবে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এখানে বাগেরহাটের আইনজীবীরা এবং স্বয়ং প্রধান বিচারপতি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন এবং সেটা অবশ্যই সবার কাম্য। আমরা তার উদ্যোগ দেখতে চাই।

সরকার নিজের ভাবমূর্তি রক্ষায় এতই উদ্বিগ্ন যে, নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মেরে, নিজের জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করে কার মন জয় করতে চাচ্ছে সেটাও জনগণ বোঝে। কিন্তু এতে সরকারের জন্য হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ভাবমূর্তি খুবই নাজুক জিনিস। এটা বাইরের মানুষ যত না ক্ষতি করতে পারে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারে নিজেরাই। একথা সরকারের বোঝার কথা। এখন সরকার সুন্দরবন নিয়ে যা করছে তা সরকারের জন্য বড় একটা দায় হয়ে দাঁড়াবে। একথা সরকার বুঝতে যত দেরি করবে ততই তার ভাবমূর্তি রক্ষা কঠিন হবে।

ভাবমূর্তি সঙ্কটে পড়ে সরকার এখন রাজন হত্যাকারী কামরুলকে সৌদি থেকে ফেরত এনে কারাগারে পাঠিয়েছে, সৌরভকে মাতাল অবস্থায় গুলি করার কারণে সংসদ সদস্য লিটনকেও গ্রেফতার করেছে এবং নারায়ণঞ্জের সাত খুনের মূল আসামি নূর হোসেনও ফিরে আসছে। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এতে জনগণ কিছুটা আশ্বস্ত হলেও ভাবমূর্তি আর রক্ষা হচ্ছে না।

আমরা সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে সবাই ঐক্যবদ্ধ। এটা শুধু খুলনাবাসীর জন্য নয়, বাগেরহাটবাসীর  স্থানীয় বিষয় নয়, এটা সারা দেশের জন্য সমস্যা। তাই সবাই এ আন্দোলনের সঙ্গে থাকবে- এটাই আমার বিশ্বাস।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।