টেকনলজির বাহাদুরি বনাম শহিদ হবার সামর্থ্য
জিহ্বা কাটা পড়বেই...
ফেইসবুকে মাঝে মধ্যে চলমান বিষয়ে তাৎক্ষণিক মন্তব্য করবার সুযোগ নিতাম। কিন্তু ফেইসবুক গণতন্ত্রের মানসকন্যা বন্ধ করে দিয়েছেন। ইন্টারনেটে যেতে পারি, কিন্তু ফেইসবুক খুলতে পারি না। এতে আমার বিশেষ ক্ষোভ আছে বলব না। তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’ নামক ব্যবস্থায় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া, কিম্বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার গীত গাওয়া যে আসলে উলুবনে হনুমানের চিৎকার সেটা এখন থিওরি কপচিয়ে মানুষকে বোঝাতে হবে না। তাই কি?
তথাকথিত আধুনিক বা উদার গণতন্ত্রে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার ইত্যাদি বিস্তর হাবিজাবি কথা বলা হয় কিন্তু এই প্রকার কথা ডুমুরের ফুল জাতীয় বস্তু। আধুনিক রাষ্ট্রে তাদের অস্তিত্ব কক্ষনোই ছিল না, কক্ষনো থাকবেও না। এমন নয় যে গণতন্ত্র অন্যের কথা বলার অধিকার শুধু ইমার্জেন্সি বা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হরণ করে। থুক্কু, মোটেও না। স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এটাই গণতন্ত্র করে; ইহাকেই ‘গণতন্ত্র’ আখ্যা দেওয়া হয়। আমরা ভুলে যাই গণতন্ত্র রাষ্ট্রের একটি ধরণ। আর রাষ্ট্রই সার্বভৌম; ব্যাক্তির স্বাধীনতা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব দ্বারা সব সময়ই সীমিত।
যারা দীর্ঘদিন ধরে এইসব বিষয়ে আমার লেখালিখিতেও মনস্থির করতে পারেন নি তাঁরা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’ পড়ে দেখতে পারেন। সংবিধান সেখানে পরিষ্কারই বলে রেখেছে ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে’ যিনি ক্ষমতায় থাকেন তিনি আপনার জিহ্বা কেটে নিয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ তথাকথিত কথা বলবার অধিকার হরণ করবার পূর্ণ ক্ষমতা সংবিধান ক্ষমতাসীনদের দিয়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের যিনি প্রধান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারনে তিনি যা ‘যুক্তিসঙ্গত’ গণ্য করবেন, সেটাই সংবিধান অনুযায়ী যুক্তিসঙ্গত বলে বিবেচিত হবে। আপনি আপনার মাথায় দুনিয়ার সকল প্রকার যুক্তিবিদ্যার জাহাজ বোঝাই করে যুক্তির আলাকজাণ্ডার হতে পারেন, ওতে কোন কাজ হবে না। যিনি ক্ষমতায় আছেন, তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন। এই হোল, ‘যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ’-এর মাজেজা। যিনি ক্ষমতায় আছেন তিনি আইন করে আপনার চিন্তা, বিবেক, মতপ্রকাশ ইত্যাদির ‘অধিকার’ হরণ করবেন। তারপরও আপনি যাত্রার বিবেকের মতো ‘অধিকার’ ‘অধিকার’ বলে মুখস্ত ডায়ালগ বলতে পারবেন বটে, তবে সেটা বিনোদন ছাড়া আর কিছু হবে না। এমনকি আফসোস, আপনি মূল স্ক্রিপ্টের অভিনেতাও নন। হায় বিবেক! হায় অধিকার!
তাই আমার ক্ষোভ অন্যত্র। আমরা কবে ক্ষমতা, শাসন, আইন, রাষ্ট্র ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে ফালতু প্রচলিত অনুমান ও ধ্যান ধারণাকে প্রশ্ন করতে শিখব? এইসব কেচ্ছাকাহিনী বাদ দিয়ে কিভাবে ক্ষমতা সম্পর্কে নতুন ভাবে ভাববার হিম্মত অর্জন করবো? কিভাবে আমাদের সীমা ও সম্ভাবনা নিয়ে নতুন করে ভাববো? আমি নিশ্চিত নই আমরা সব কিছু নতুন করে ভাববার সজ্ঞান স্তরে পৌঁছাতে পেরেছি কিনা।। সারা দুনিয়ায় অবশ্য এইসব নিয়ে ভাবাভাবি শুরু হয়ে গিয়েছে অনেক আগে। বাংলাদেশে আমরা এখনও ছাগলের বাচ্চা হয়ে আছি। আমাদের লাফানো থামছে না। আমার ক্ষোভ এখানে।
কাল নিরবধি হতে পারে, কিন্তু গণতন্ত্রের মানসকন্যার ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। কিন্তু আমাদের চিন্তার অক্ষমতা আমাদের জন্য ভবিষ্যতে কী পরিণতি বয়ে আনে, সেটাই আমার চিন্তার বিষয়।
টেকনিকালি ফেইসবুক ব্যবহার বন্ধ হয় নি, কিন্তু নিজে যেন অপরাধ করছি এই বোধ নিয়ে প্রক্সি বদলাবার এপ্লিকেশান দিয়ে ফেইসবুক ব্যবহার করবার ইচ্ছা বোধ করি না। অথচ আমার জন্য ফেইসবুক বন্ধ হওয়া বেশ বড় ধরণের ক্ষতির কারন। পাঠকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখবার উপায় ছিল ফেইসবুক। সেই সুবিধাটুকু সরকার হরণ করে নিয়েছে।
তবু কিছু আশার কথা বলি। আগে এই আশা ঘটেছিল দাবি করব না। কিন্তু আজকাল অনেক তরুণকে দেখছি শুধু ফেইসবুকে কথা চালাচালি করে তারা সন্তুষ্ট থাকতে চায় না; যে বিষয়ে তাদের আগ্রহ তারা তার গভীরে যেতে চায়। সেটা পাঠচক্রে ও কর্মশালায় কিছুটা শৃংখলার সঙ্গে ঘটে। কিন্তু এর বাইরে দেখা সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে হালকা আলাপ থেকে গভীরে যাবার ঘটনাও ঘটে। এই দিকটা আজকাল বেড়েছে। এটাই আমাম্র সাম্প্রতিক সময়ের অভিজ্ঞতা। সমাজের ক্ষত ও সংকটের যে গভীরতা তাতে এটাই স্বাভাবিক। বাস্তবতা যতো জটিল ততোই তাকে নিয়ে ভাববার চ্যালেঞ্জও কঠিন হবে, কিন্তু হিম্মতও বাড়বে। এর ফলে উপলব্ধির গভীরতাও বাড়তে বাধ্য। ফেইসবুকে সময় দেওয়া কমে যাবার ফল যদি নিজেদের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ বৃদ্ধি পাওয়া ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তর্ক ও পর্যালোচনা হয়ে ওঠে তার ফল খারাপ হবে না। এই আশা নিয়ে একটি বিষয় নিয়ে আজ কথা বলব।
সন্ত্রাসের বিচার নীতিবিদ্যার বিষয় নয়
ইদানীং আইসিসের কর্মকাণ্ড কেন্দ্র করে একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ বা ধারণা আবার ঘনিষ্ঠ মনোযোগ ও তর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। সেটা হোল ‘সন্ত্রাস’। এই শব্দটিকে কেন্দ্র করে আমরা আজ কিছু প্রাথমিক আলোচনা করব। বুঝবার চেষ্টা করব কিভাবে ধারনাটি আমাদের অনেক গভীরতর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়, আমাদের বহু অনুমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে; এর ফলে অনেক কিছুই নতুন ভাবে ভাবতে আমরা বাধ্য হই।
খেয়াল করল দেখব, আমরা প্রায় কক্ষনোই‘সন্ত্রাস’ শব্দটি সজ্ঞানে ব্যবহার করি না। শব্দটি যখন তখন ব্যবহার করা ঠিক কিনা সেটা আমরা ভেবে দেখি না। এই শব্দটি ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে আমরা কোন গোষ্ঠির রাজনৈতিক স্বার্থ উসুল করছি কিনা সেটা ভেবে দেখারও প্রয়োজন বোধ করি না। এটা ঠিক কোন সহিংস ঘটনা দেখলে কিম্বা সহিংসতা ও রক্তপাতের যে কোন সম্ভাবনার অনুমানও আমাদের মধ্যে আতংক তৈরি করে। এটা একটা জৈবিক প্রবৃত্তি। হয়তো সন্ত্রাসের ভিকটিমের মধ্যে আমরা আমাদের সম্ভাব্য পরিণতি দেখতে পাই। ফলে এর একাট্টা বিরোধিতা বা নিন্দা প্রবৃত্তিগত ভাবেই আমাদের মধ্যে ঘটে। কিন্তু এটা যে আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি তাকে আমরা আবার স্বীকারও করতে চাই না। প্রবৃত্তিগত এই প্রতিক্রিয়াকে ন্যায্য প্রমাণের জন্য আমরা সন্ত্রাসকে নৈতিক ভাবে নিন্দা জানাই। অর্থাৎ যা আমাদের মধ্যে আতংক বা ভয় সৃষ্টি করে তাকে নিন্দিত করবার জন্যই আমরা ‘সন্ত্রাস’ শব্দটি ব্যবহার করি। শব্দটির মধ্যেই নিন্দা নিহিত রয়েছে।
আতংকবোধ থেকে জাত জৈবিক প্রবৃত্তিগত প্রতিক্রিয়া দিয়ে জীবের মনস্তত্ত্ব বোঝা যেতে পারে, কিন্তু রাজনীতিতে ‘সন্ত্রাস’ নামক যে ধারণার উৎপত্তি ও প্রয়োগ চলছে তাকে বোঝা যাবে না। সন্ত্রাস ও সহিংসতার নিন্দা করেও নয়। নিন্দার পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারে। নিজেরা ভয় পাই বলে নিন্দা, অথবা নীতিবাগীশতা। প্রবৃত্তিজাত আতংক বোধ আর নীতিবাগীশ নিন্দা আলাদা ব্যাপার। নীতিবাগীশ ধর্মের দোহাই দিয়ে বলতেই পারেন অহিংসা পরম ধর্ম। কক্ষনই হিংসা ও সন্ত্রাসে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। বুদ্ধ অহিংসা পরম ধর্ম বলেছেন। আলবৎ। সত্য এই যে মায়ানমারের মঠে মঠে নিত্যদিন বৌদ্ধ পুরোহিতরা এই অহিংসারই জপ করে আসছেন। তাঁদের ধর্মচর্চায় – বিশেষত অহিংসার বাণী প্রচারে কোন ঘাটতি ছিল না। হাজার বছর ধরে অহিংসার জপ করবার পরও মঠের এই বৌদ্ধ পুরোহিতরাই মায়ানমারের রাজনীতিতে রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। সেটা আমরা দেখেছি।অহিংসা পরম ধর্ম এই ধর্মবাক্য জপ করেও মায়ানমারের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সন্ত্রাস ও সহিংসতার পক্ষাবলম্বন করেছেন। সেই ক্ষেত্রে ের কারন নির্ণয়ের জন্য বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে এর উত্তর খুঁজলে হবে না। মায়ানমারের সামাজিক-ঐতিহাসিক বাস্তবতা, বিভিন্ন জনগোষ্ঠির পারস্পরিক সম্পর্ক এবং আভ্যন্তরীণ রাজনীতি দিয়েই বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কেন গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নিলো সেটা বুঝতে হবে।
গুরুগম্ভীর ও নীতিবাগীশ শব্দ ও বয়ান সন্ত্রাস ও সহিংসতার রাজনৈতিক চরিত্র আড়াল করে রাখে। রাজনৈতিক সন্ত্রাস ব্যখ্যা করতে গিয়ে ধর্মকে যুক্ত করা – যে পক্ষই করুক -- দুইপক্ষের সহিংসতার রাজনৈতিক মর্ম আড়াল করার অধিক কিছু নয়। এটা তাহলে ধর্ম নয়, রাজনীতি। যেসকল তরুণ নতুন ভাবে সন্ত্রাস, সহিংসতা ইত্যাদি অতি পরিচিত বিষয় নিয়ে নিয়ে ভাবতে চাইছেন, এই সরল সত্যটুকু তাদের চোখে পড়ার কথা। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের গণহত্যায় ভগবান বৌদ্ধ, কিম্বা বৌদ্ধ ধর্মকে নিন্দা করে ফায়দা নাই। ধর্ম ধর্মের কথাই বলে, কিন্তু রাজনীতির জগত আলাদা। সেটা বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে যেমন সত্য, ইসলামের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু দেখা যায় আজকাল সন্ত্রাস নিয়ে কথা উঠলেই ইসলামকে জড়াতে আমাদের প্রভূত আনন্দ হয়। আর যারা ক্ষীণ ঈমান নিয়ে চলে, ইসলামের নামে কেউ কোন ঘটনা ঘটালে তার জন্য তারা ইসলামের পক্ষ হয়ে মাফ চাইতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাতারাতি তারা ইসলামের মুখপাত্র বনে যায়। এটা হীনমন্যতা। আগেই বলেছি, প্রবৃত্তিগত আতংক দোষের কিছু নয়, হয়তো জীব হিসাবে মানুষের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই প্রবৃত্তি আমরা রপ্ত করেছি। এটা সন্ত্রাস ও সহিংসতা পরিহার করা বা জীবজীবনের সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে আগাম দূরে থাকার সতর্কতা।
কিন্তু হীনমন্যতা ভয়ানক। হীনমন্যতা একটি জনগোষ্ঠির মেরুদণ্ড চিরকালের জন্য ভেঙ্গে দিতে পারে। এই কারনে সন্ত্রাস ও সহিংসতার সঙ্গে ইসলামকে জড়াবার বিরুদ্ধে আমি সবসময়ই নিরাপোষ ও দৃঢ। বর্তমান বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও সহিংসতার চরিত্র বিশ্বব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের রাজনৈতিক ভাবেই বুঝতে হবে। প্রবৃত্তির তাড়নায় বা নীতিবাগীশতা দিয়ে নয়।
সন্ত্রাসকে নৈতিক দিক থেকে নিন্দনীয় করে তোলার পেছনে দুটো উদ্দেশ্য থাকে। প্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্ত্রাসকে নিন্দা জানিয়ে নিজের নৈতিক মানের উচ্চতা সম্পর্কে প্রমাণ দাখিল করা এবং সমাজের নৈতিক কর্তৃত্বের জায়গায় স্থান করে নেবার প্রতিযোগিতায় নামা। দ্বিতীয়ত সন্ত্রাসকে নিন্দার মধ্য দিয়ে আমাদের অজান্তেই আমরা আমাদের জৈবিক প্রবৃত্তির অন্তর্নিহিত উৎকন্ঠা প্রকাশ করি। সহিংস ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যারা জীবন হারায় কোনদিন আমাদেরও একই দশা ঘটুক আমরা চাই না। সন্ত্রাসের নিন্দা করে আমরা তারই জানান দিয়ে থাকি।
দৈনন্দিন যে সকল শব্দ আমরা ব্যবহার করি সেই সকল শব্দগুলোর ওজন আমরা প্রায়ই ধরতে পারি না। ‘সন্ত্রাস’ তেমনি একটা শব্দ। ওজন ধরতে না পারার অর্থ হচ্ছে এই একটি শব্দকে কেন্দ্র করে সারা দুনিয়ার রাজনীতি, নীতিনৈতিকতা ও সংস্কৃতি কিভাবে আবর্তিত হচ্ছে তার গভীরতা ধরতে ও বুঝতে না পারা; ফলে শব্দটিকে নিছকই নৈতিক দিক থেকে নিন্দনীয় ধারণা হিসাবে বোঝা। পৃথিবীতে খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে যারা নীতিগত ভাবে সন্ত্রাসের পক্ষে কথা বলবেন। কিন্তু সন্ত্রাস বিরোধিতার নৈতিক অবস্থান দিয়ে সন্ত্রাসকে ঘিরে রাজনীতির বোঝা সম্ভব নয়। অর্থাৎ নৈতিকতা মান্দণ্ড সিয়ে সন্ত্রাসের বিচার সন্ত্রাসের রাজনীটি বোঝার সহায়ক নয়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সন্ত্রাসের নৈতিক বিরোধিতা আর সন্ত্রাসকে রাজনৈতিক ও আইনী দিক থেকে বোঝার মধ্যে ফারাক বিস্তর।
তাহলে একথা স্বীকার করে নেওয়া যাক: সন্ত্রাস ও সহিংসতার বিচারের জন্য সস্তা ও ফালতু নীতিবাগীশতার বাইরে বেরিয়ে আসা দরকার। এরপর দরকার মুসলিম দেশগুলোর বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের যুদ্ধনীতির বিচার। সন্ত্রাস ও ইসলামকে যুক্ত করবার একটা পরিকল্পিত পাশ্চাত্য নীতি রয়েছে। সেই প্রপাগান্ডার অংশীদার হওয়ার চেয়ে আহাম্মকি আর কিছু হতে পারে না। নীতিবাগীশতা সেই পরিকল্পনার পক্ষে সাফাই গায়, ন্যায্যতা প্রতিপাদন করে। এ কারনেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধনীতির সমর্থকরা তাদের প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসের নিন্দা করতে গিয়ে অতিরিক্ত নীতিবাগীশ হয়ে ওঠে। কিন্তু তাদের নিজেদের সামরিক ও রাষ্ট্রী সন্ত্রাস সম্পর্কে নিশ্চুপ থাএ। নীতিবাগীশতার পেছনে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করবার জন্য রাষ্ট্রের সকল সহিংস ও সন্ত্রাসী ক্ষমতা ও যুদ্ধের হাতিয়ার তারা ব্যবহার করে। এই ব্যবহারের পেছনে রক্তপিপাসু বাসনা চিনতে পারা মোটেও কঠিন কিছু নয়। রক্তের পিপাসা নিয়ে হঠাৎ তাদের প্রবল মানব দরদী হয়ে ওঠাকে অট্টহাসি দিয়ে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশেও এই প্রকার মানব দরদীর অভাব নাই। এরা এই যুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য শক্তির স্থানীয় বরকন্দাজ। এদের হাল্কা ভাবে নেবার উপায় নাই।
এ কারনে বোঝা দরকার সন্ত্রাস বিরোধী নীতিনাগীশতা ভয়ানক জিনিস। এরা ইসলামি সন্ত্রাসের বিরোধী কিন্তু পাশ্চাত্য সামরিক শক্তির সর্বব্যাপী সন্ত্রাসী যুদ্ধের সমর্থক। শুধু সমর্থক নয় স্থানীয় ভাবে তারা তাদের পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সামরিক বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সকল প্রকার হাতিয়ার নিয়ে পাশ্চাত্যের পক্ষে তাদের নিজ দেশের নাগরিকদের হত্যা, গুম, নির্যাতন ও দমন করছে। নিজেদের দেশেই তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ইসলামী সন্ত্রাসের সহযোগী হিসাবে চিহ্নিত করে হত্যা ও দমন পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। এই নীতিবাগীশতা যারপরনাই ভাঁড়ামি ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু ভাঁড়ামি হলেও মেনে নেওয়া যেতো। কিন্তু আসলে এটা যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ‘সন্ত্রাস’ একটি ধারণাগত হাতিয়ার যাকে বর্ম বানিয়ে এই যুদ্ধ চলছে। নীতিবাগীশ ভাঁড়ামি যুদ্ধের নিষ্ঠুর ও নির্মানবিক সত্য আমাদের কাছ থেকে আড়াল করে।
নীতিবাগীশতা ভাঁড়ামি। আলবৎ। সন্ত্রাসের বিরোধিতা করতে গিয়ে এই ভাঁড়েরা জীবনের কথা বা প্রাণের মূল্যের কথা বলে। মানুষের জীবন বা যে কোন প্রাণের প্রতি সংবেদনা ইতিবাচক সন্দেহ নাই, যদি সকল জীবন বা নির্বিশেষে সকল প্রাণের মহিমা স্বাধীন ভাবে উপলব্ধির আকুতি থেকে সে কথা বলা হয়। মানুষ সে কথা তখন উপলব্ধি করে ও বলেও বটে। কিন্তু সন্ত্রাস বিরোধীরা মোটেও সেই উপলব্ধি থেকে নয়, বরং তার উলটা বা বিপরীত জায়গা থেকে জীবনের মূল্য নিয়ে কথা বলে। তারা আসলে দাবি করে তারা নিজেরা এবং তাদের সমর্থকদের জীবনেরই শুধু মূল্য আছে, কিন্তু তারা যাদের ‘সন্ত্রাসী’ বলে ট্যাগ লাগায়, নির্মূল করবার জন্য চিহ্নিত করে – তাদের প্রাণের কোন মূল্য নাই। নীতিবাগীশ ভাঁড় প্রতিপক্ষের রক্ত পান করে মানবতার জয়গান গায়।
‘মানবসত্তা’ বা ‘মানবিকতা’ নামে মানুষের মধ্যে এক প্রকার সার্বজনীন সারবত্তার অনুমান আমরা করে থাকি। এ ধরণের কোন বিমূর্ত সারবত্তার কোন সত্য আছে কিনা তা নিয়ে দার্শনিক তর্ক হতে পারে। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ‘মানবিক’ করে তোলার প্রণোদনা তৈরির জন্য তার উপযোগিতা নিশ্চয়ই আছে। আমাদের ইহলৌকিক সম্পর্ককে নির্বিশেষ আত্মিক স্তরে উন্নীত করবার তাগিদও এর পেছনে কাজ করে বলে অনুমান করা ভুল নয়। এই ধরণের বিমূর্ত ধারণার মধ্য দিয়ে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ণয় মানুষের অভ্যাস বা সহজাত কিনা সেটা নিয়েও তর্ক চলতে পারে। কিন্তু মুশকিল হয় যদি এ ধরণের অনুমানের কার্যকারিতা আমরা অস্বীকার করি তাহলে খোদ ‘সমাজ’ কথাটিরই কোন কার্যকর অর্থ নির্ণয় কঠিন হয়ে পড়ে। সমাজ, সামাজিকতা, জনগোষ্ঠি, মানবসমাজ ইত্যাদি শব্দবন্ধ বা ধারণারও আর কোন মানে থাকে না।
তাহলে ধরে নিতে পারি প্রত্যেক সমাজেরই মানবিক তাগিদ আছে, মানুষের মর্ম বা সারবত্তা নিয়ে অনুমান ও সিদ্ধান্ত আছে। সামাজিক সম্পর্ক, রীতিনীতি, আইন, বিধিবিধান ইত্যাদির মধ্যে প্রত্যাক সমাজই নিএকে সেই সকল অনুমান ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সাজায়। দুনিয়ায় এমন কোন ধর্ম নাই যার মধ্যে মানুষের সঙ্গে মানুষের জাগতিক কিন্তু আধ্যাত্মিক সম্পর্ক নির্মাণের তাগিদ নাই। আধাত্মিকতা যদি মানুষের চেতনা ও চৈতন্যের কারবার হয় তাহলে তা ইহলৌকিক ব্যাপার। রক্তমাংসের মানুষ আসমানে বাস করে না। ইহলোকই তার বাড়ি ঘর। ধর্মের পর্যালোচনা করে তার মর্ম উদ্ধার, উপলব্ধি ও সকলের বোঝার সুবিধার জন্য ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ভিন্ন ব্যাপার।
আতংকের বশবর্তী না হয়ে এবং নৈতিক নিন্দার নীতিবাগীশগিরি বাদ দিয়ে বিশ্বব্যাপী চলমান যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তথাকথিত সন্ত্রাস ও সহিংসতাকে পাশ্চাত্যের যুদ্ধ ও যুদ্ধনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বোঝার প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর জন্যই এই লেখা। পাশ্চাত্যের যুদ্ধনীতির দিকে থেকে ‘সন্ত্রাস’কে বুঝলে আমরা কিভাবে এই যুদ্ধ দেশে দেশে তথাকথিত সন্ত্রাস ও সহিংসতার বিস্তার ঘটাচ্ছে তা বুঝবো। বুঝব কিভাবে বৈশ্বিক বাস্তবতা বদলাচ্ছে, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের ধারণায় বদল ঘটছে। পাশ্চাত্যের প্রবল সামরিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও এই যুদ্ধে কেন প্রতিপক্ষকে কতার দমন করতে পারছে না সেই দিকগুলোও আমরা আরও সহজে বুঝব। পরে আরও বিস্তৃত ভাবে বুঝবার আগ্রহ তৈরির জন্য এখানে তারই দুই একটি নজির দেবার জন্য এই লেখা।
‘যুদ্ধবন্দী’ সংক্রান্ত আইনী ধারনার বদল
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে অনন্ত যুদ্ধ’ চলছে তা রাজনৈতিক। স্পষ্টতই এটা যুদ্ধ, অতএব একে যুদ্ধ হিসাবে কিম্বা যুদ্ধের অনুষঙ্গেই আমাদের বুঝতে হবে। যুদ্ধ হিসাবে বোঝার অর্থ হচ্ছে যুদ্ধের পুরানা চরিত্রের দিক থেকে বর্তমান চলমান যুদ্ধের চরিত্রগত পার্থক্য ঘনিষ্ঠ ভাবে অনুধাবন করা। এই যুদ্ধের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর দুষমন কোন রাষ্ট্র নয়। এই যুদ্ধের জয় পরাজয় কিভাবে নির্ধারিত হবে তার কোন অভিজ্ঞতা মানবেতিহাসে নাই। ফলে কিভাবে তার শেষ হবে তাও কারো জানা নাই। বাংলাদেশে আমরা চাই বা না চাই এই যুদ্ধে জড়িয়ে রয়েছি ও জড়িয়ে পড়েছি। আগামিতে এই জড়িয়ে পড়া গভীর ও বিস্তৃত হবে। কারন এই খোপ থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা সমাজে খুবই ক্ষীণ। পাশ্চাত্য যুদ্ধের প্রকৃতি না বুঝে যেভাবে ইসলামকে একটি সন্ত্রাসী ধর্ম হিসাবে নির্বিচারে আমরা হাজির লরি, তার ফলে আমরা নিজেদের আদতে পাশ্চাত্যের পদাতিক বাহিনীতে পরিণত করি। এই অবস্থা থেকে বের হতে হলে ‘সন্ত্রাস’ কিম্বা ‘সন্ত্রাসী’ ইত্যাদি শব্দবন্ধ ও ধারণাকে নির্মোহ ভাবে পর্যালোচনার হিম্মত অর্জন করতে হবে।
আল কায়েদা কোন ভূখণ্ড দখল করে, ইসলামি খেলাফত কায়েমের রাজনৈতিক দাবি ও কর্তৃত্ব নিয়ে এতদিন লড়ে নি। কিন্তু আইসিস তা করছে। ফলে চরিত্রের দিক থেকে আল কায়েদা ও আইসিস এক নয়। আইসিসের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের যুদ্ধের চরিত্রে এর ফলে বদল ঘটতে বাধ্য। ফলে সন্ত্রাস ধারণার মধ্যেও তার প্রতিফলন ঘটবে আমরা তা আন্দাজ করতে পারি। কিন্তু সে বিষয়ে কথা বলার সময় এখনও আসে নি।
আল কায়েদা পাশ্চাত্যের চোখে নন-স্টেইট প্রতিপক্ষ (non-state enemy) । এর বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যকে লড়তে হয়েছে রাষ্ট্র হিসাবে। অ-রাষ্ট্রীয় দুষমনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের লড়াই: ইতিহাসে এই অভিজ্ঞতা নতুন। রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড আইনী দিক থেকে নাগরিকদের কাছে ন্যায্য প্রমান করবার দরকার থাকে। সে কারণে এই যুদ্ধে প্রতিপক্ষের যে সকল যোদ্ধারা ধরা পড়েছিল তারা যুদ্ধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের সুবিধা পাবে কি পাবে না সেটা গুরুত্বপূর্ণ তর্কের বিষয় হয়ে উঠেছিল।
‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ আন্তর্জাতিক আইনে পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। সন্ত্রাসের ধারণা কিভাবে আইনে পরিবর্তন ঘটায় সেটা বিচার করে দেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জর্জ বুশের অনন্ত যুদ্ধ শুরু হবার আগে প্রতিপক্ষ দেশের যোদ্ধারা ধরা পড়লে যুদ্ধ সংক্রান্ত জেনেভা কনভেনশানের আর্টিকেল ৩ অনুযায়ী যুদ্ধবন্দীদের কিছু অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত ছিল। যুদ্ধবন্দীদের একটা আইনী নাম হচ্ছে ‘লড়াকু শত্রু’ (enemy combatant)। বাংলায় আমরা একে সহজে বোঝার জন্য ‘যুদ্ধবন্দী’ বলে থাকি। শত্রু আইনী নাকি বে-আইনী ভাবে যুদ্ধে জড়িত হয়েছে। সেটা বিবেচ্য ছিল না। ধরা পড়লে তার প্রতি কিভাবে আচরণ করা হবে তার বিধান জেনেভা কনভেনশানে অন্তর্ভূক্ত ছিল। জেনেভা কনভেনশানের আর্টিকেল ৩ অনুযায়ী ‘যুদ্ধবন্দী’ কথাটার পরিষ্কার আইনী অর্থ ছিল।
কিন্তু সেপ্টেম্বর এগারোতে টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগন হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই আইনী ধারণাকে একদমই বদলে দেয়। তারা এই শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করে সম্পুর্ণ বিপরীত অর্থে। যেহেতু তালেবান বা আল কায়েদা কোন রাষ্ট্রের যোদ্ধা নয়, অতএব রাষ্ট্র সমূহের চুক্তির মধ্যে স্বীকৃত অধিকার বা সুবিধাদি তারা পাবে না। দুই হাজার আট সালের আগে যুদ্ধবন্দীর সংজ্ঞা ছিল এরকমঃ “সশস্ত্র সংঘাতে নিয়োজিত যে কোন ব্যাক্তি যাকে যুদ্ধ সংক্রান্ত আইন ও প্রচলিত বিধিবিধান অনুযায়ী বন্দী করা হয়েছে”। যুদ্ধবন্দী কোন না কোন রাষ্ট্রের পক্ষের যোদ্ধা হতে পারে, অথবা কোন দেশের গৃহযুদ্ধ বা অভ্যূথানে অংশগ্রহণকারী ‘পার্টি টু কনফ্লিক্ট’ বা সংঘাতের কোন একটি পক্ষ হতে পারে। তার প্রতি কিভাবে ব্যবহার করা হবে তার একটা আইনী নির্দেশনা জেনেভা কনভেনশানে ছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের প্রতিপক্ষ বা যারা মার্কিনীদের কাছে ‘সন্ত্রাসী’ তারাই ‘এনিমি কম্ব্যাটেন্ট’। অর্থাৎ তারা হচ্ছে অধিকার বঞ্চিত যুদ্ধ-জীব বা জন্তু-জানোয়ার -- যার সঙ্গে যা খুশি তাই ব্যবহার করা যায়। রাষ্ট্র সমূহের দ্বারা স্বীকৃত কোন অধিকার পাবারই তারা যোগ্য নয়। তাদের কোন আইনী অধিকার নাই। তারা আইনের বাইরে জীবজানোয়ার মাত্র। গুয়ানতানামো কারাগারে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে যুদ্ধবন্দীদের অবস্থা সম্পর্কে ইতোমধ্যে জানি। সে বিষয়ে নতুন করে ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসী’ হিসাবে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের আদৌ কোন আইনী অধিকার আছে তা স্বীকার করতে রাজি না। বাংলাদেশেও যারা কথায় কথায় সন্ত্রাস বা সন্ত্রাসী ধারণা ব্যবহার করেন এবং যখন তখন তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন তারাও সুস্পষ্ট ভাবে এটাই প্রতিষ্ঠা করতে চান যে সন্ত্রাসের দায়ে অভিযুক্তদের কোন নাগরিক ও মানবিক অধিকার থাকতে পারবে না। এই ধারণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনিমি কম্ব্যাটেন্ট ধারণারই প্রতিরূপ মাত্র। সন্ত্রাসে্র বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের আইনী ব্যাকরণ বাংলাদেশ হামেশা খাটানো হচ্ছে। আমরা প্রায়ই দেখি আইনশৃংখলা বাহিনী এই সকল ‘জন্তু-জানোয়ার’দের বন্দী করে কোমরে দড়ি ও বুকে স্টিকার লাগিয়ে গ্রেফতার করছে। যাদের কোন অধিকার সমাজ স্বীকার করে না, তারা আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে কিভাবে নির্যাতীত হচ্ছে সেটা অনুমান করা কঠিন কিছু নয়।
আইসিস যখন গুয়েনতানামো কারাগারের ব্রাণ্ড রঙ কমলা রঙের কয়েদির পোশাক পরিয়ে তাদের হাতে বন্দীদের ছুরি দিয়ে জবাই করে তখন তারা স্রেফ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারের যুদ্ধবন্দীদের ওপর চালানো বীভৎসতারই পুননির্মাণ করে। এই বাস্তবতায় সন্ত্রাসকে বুঝতে হলে আমরা বিচ্ছিন্ন ভাবে কোন সন্ত্রাসী ঘটনাকে নৈতিক ভাবে নিন্দা করে কোন কুল কিনারা পাবো না। অন্যদিকে, আইসিসের দিক থেকে এটা তাদের যুদ্ধ কৌশলের অংশ। তারা পাশ্চাত্য গণমাধ্যমের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে চায় তারা পাশ্চাত্য বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে প্রস্তুত। আল কায়েদার সঙ্গে এখানেও আইসিসের পার্থক্য। তারা পাশ্চাত্যের পদাতিক বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করছে। তাদের সঙ্গে যখন যুদ্ধের ময়দানে দেখা হবে তখন পাশ্চাত্য বাহিনীর দশা কী হবে সেটাই তারা বোঝাতে চাইছে।
তাহলে ‘সন্ত্রাস’ নিয়ে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে’র কালপর্বে কথা বলতে হলে অবশ্যই খোদ যুদ্ধ নিয়েই কথা বলতে হবে। বিচ্ছিন্ন ভাবে ‘সন্ত্রাস’ নিয়ে কথা বললে আমরা সন্ত্রাসের কিছুই বুঝবো না।
নৈতিক ও মানবিক দিক থেকে যুদ্ধের বীভৎসতা নিয়ে তর্ক করবার কিছু নাই। কিন্তু যুদ্ধকে নৈতিক মানদণ্ড দিয়ে বিচার করবার চেয়ে আহাম্মকি আর কিছুই হতে পারে না। তেমনি (রাজনৈতিক) সন্ত্রাসকেও নীতিবিদ্যা দিয়ে বোঝা যায় না। এই দিকটা পরিষ্কার বোঝা দরকার।
অনিশ্চয়তার মধ্যে রোমাঞ্চ
এই ফাঁকে আমরা কার্ল ফন ক্লৎউইৎজের বিখ্যাত কিছু কথা আবার স্মরণ করতে পারি। যেমন: “যুদ্ধ হচ্ছে অন্য উপায়ে রাজনীতি চালিয়ে যাওয়া” – এ বাক্যটি বোধহয় আমাদের অনেকেরই মুখস্থ। কিন্তু এর পরের লাইনগুলো আরও গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হোল:
“যুদ্ধ হচ্ছে অন্য উপায়ে রাজনীতি চালিয়ে যাওয়া। যদি নেতা উচ্চাভিলাশী হয়ে থাকেন এবং যদি তিনি তাঁর লক্ষ্য প্রবল হিম্মত ও ইচ্ছাশক্তি দিয়ে অনুসরণ করেন, যতো বাধাই থাকুক তিনি তাঁর লক্ষ্য অবশ্যই পৌঁছাবেন।
যদিও আমাদের বুদ্ধি সবসময়ই স্বচ্ছ থাকা ও কোন বিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্য কাতর থাকে, আমাদের স্বভাবই এমন যে আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে রোমাঞ্চ বোধ করি। যুদ্ধের সবকিছুই খুবই সরল ব্যাপার। কিন্তু এই সরল ব্যাপারটাই সবচেয়ে কঠিন। গতি ও গোপনীয়তাই বিস্ময়ের মেরুদণ্ড।
শান্তি নিশ্চিত করবার অর্থ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া। যুদ্ধ শুধু রাজনৈতিক কাণ্ডই নয়, একই সঙ্গে সত্যিকারের রাজনৈতিক হাতিয়ার, রাজনৈতিক সম্পর্ক চর্চার ধারাবাহিকতা, একই উদ্দেশ্য ভিন্ন উপায়ে চরিতার্থ করা” (On war, Carl Von Clausewitz) )। ক্লসউইৎজের (১৭৮০-১৮৩১) উদ্ধৃতি দিচ্ছি যুদ্ধকে যুদ্ধ হিসাবে বিচার করবার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করবার জন্য।
তাহলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের পরিণতি কী হবে? আমি গণক বা ভবিষ্যৎ বক্তা নই। তবে এটা পরিষ্কার তালেবান ও আলকায়েদার হাতে পাশ্চাত্যের সামরিক পরাজয় ঘটেছে। এই পরাজয় যে অবশ্যম্ভাবী সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করবার গৌরব যদি কাউকে দিতে হয় তিনি চার্লস উইলিয়ামস মেয়নেস (Charles, William Maynes )। চার্লস (১৯৩৮-২০০৭) ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন কূটনীতিবিদ। তিনি দীর্ঘদিন বিখ্যাত ‘ফরেন পলিসি’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। তিনি ১৯৯৫ সালে তাঁর একটি লেখায় লিখেছিলেন:
“যুদ্ধপ্রযুক্তির দিকে থেকে উন্নত দেশের সঙ্গে উন্নত দেশগুলোর যুদ্ধে অগ্রসর দেশগুলো বারবারই একটা শিক্ষা পেয়েছে, সেটা হোল রাজনৈতিক সংকল্পের সঙ্গে প্রযুক্তির সামর্থের তারতম্য থেকেই যায়। হত্যা করবার সামর্থ পাশ্চাত্যের বিপুল, কিন্তু মরবার সামর্থ খুব কম। পাশ্চাত্য যাদের ওপর ক্রুদ্ধ এই সমীকরণ তাদের ক্ষেত্রে একদমই বিপরীত। প্রযুক্তিগত সামর্থ আর রাজনৈতিক সংকল্পের সঙ্গে ফারাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র টের পেয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধে, ফরাসিরাও সেই শিক্ষা পেয়েছে আলজিরিয়ায়, আর রাশিয়ানরা পেয়েছে আফগানিস্তানে। সোমালিয়ার অভিযানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই শিক্ষাকে উপেক্ষা করেছে” (Relearning Intervention)।
চার্লস উইলিয়ামস মেয়নেসকে আমি ভবিষ্যদ্বাণী করবার গৌরব দিচ্ছি এ কারণে যে রাজনৈতিক সংকল্প আর টেকনলজির বাহাদুরির তারতম্যই হচ্ছে একালে যুদ্ধের জয়পরাজয় নির্ণয়ের আসল জায়গা, এটা তিনি ১৯৯৫ সালেই স্পষ্ট করে বুঝেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তার পরামর্শও তিনি এই অবস্থান থেকেই দিয়েছিলেন। কিন্তু আফসোস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিম্বা টেকনলজির গরিমায় অন্ধ পাশ্চাত্য কোন শিক্ষা গ্রহণ করে নি।
আমার লেখায় উদ্দেশ্য যদি কিছু থাকে তাহলে সেটা হচ্ছে এই যুদ্ধে কোন পক্ষ না নিয়ে একালের যুদ্ধের চরিত্র বোঝার প্রতি আগ্রহ তৈরি করার চেষ্টা । এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। দ্বিতীয়ত এটাও ভেবে দেখা দরকার দুই পক্ষই স্যামুয়েল হান্টিংটনের ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশান তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠা করছে কিনা। এটাই আসলে মুখ্য বিষয়। হান্টিংটনের তত্ত্বের মর্মকথা হচ্ছে এই যে ইসলামি সভ্যতা ও পাশ্চাত্য সভ্যতা পরস্পরের এতোই বিপরীত যে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য। এটা ঠিক ইসলামি জিহাদিরা মতাদর্শিক ভাবে পাশ্চাত্য লিবারেলিজমের ফাঁপা দিকটা খোলাসা করে দিয়েছে। কিন্তু মতাদর্শিক ভাবে পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে ইসলাম কোন ভাবেই মিশবে না দুই পক্ষের কেউই সেই হান্টিংটনীয় চিন্তার বাইরে নয়।
আসলেই কি তাই? আর কি কোন বিকল্প নাই? এই প্রশ্ন পাঠকের জন্য রেখে শেষ করছি।
৪ ডিসেম্বর ২০১৫। ২০ অগ্রহায়ন ১৪২২। শ্যামলী।