নতুন রাজনৈতিক দিশা চিহ্নিত করবার বছর


সবাইকে ঈসায়ী নববর্ষের শুভেচ্ছা। নতুন বছরের শুরুতে অল্প কিছু কথা বলব। বরং সবাইকে বলব, ভাবুন, আমরা কোন্‌দিকে যাচ্ছি।

চরম দুর্নীতি, লুটপাট, নাগরিক ও মানবিক অধিকার লংঘন এবং ভোটের তামাশা সত্ত্বেও আমি মনে করি না বাংলাদেশের জনগণ ভুল পথে যাচ্ছে। গত বছরের (২০১৫) শেষে পৌর সভার নির্বাচন গিয়েছে। নির্বাচনের কারচুপি ঘটেছে, একে কোন অর্থেই নির্বাচন বলা যায় না। ইসির ভূমিকা নিন্দনীয়। বিএনপি যথারীতি তা প্রত্যাখ্যান করেছে।

পৌর নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির চরিত্রে বদল ঘটল কিনা অনেকে সেই প্রশ্ন তুলছেন। আদৌ কোন বদল হয়েছে কিনা বুঝতে পারব কি? আমার ধারণা, বুঝব। কিন্তু সবার আগে বুঝতে হবে শেখ হাসিনার অধীনে বিরোধী রাজনৈতিক জোটের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু এরপর রাজনীতিতে নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠতে হলে কী ধরণের নীতি ও কৌশল দরকার খালেদা জিয়া সেই ক্ষেত্রে তাঁর দলের ভেতর থাকে কারো সহযোগিতা পান নি। বরং একটি ধারা গড়ে উঠেছে যারা নির্বাচন বর্জনের ছুতা ধরে দলের অভ্যন্তরে বিরোধ তৈরি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাতের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত এদের চাপেই খালেদা জিয়া পৌর নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছেন। অন্য যুক্তি হচ্ছে তৃণমূলে কর্মীদের রাজনীতিতে সক্রিয় রাখারও দরকার ছিল। কিন্তু এখন স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত, স্রেফ নির্বাচন দিয়ে অবৈধ ক্ষমতাকে মোকাবিলা করা হাস্যকর। সেটাই পৌর নির্বাচনে প্রমাণিত হোল। ক্ষমতাসীনরা সুষ্ঠ নির্বাচনী পন্থায় ক্ষমতা ছাড়বে না। এটা নিশ্চিত। পশ্চিমা লিবারেলিজমের ছক অনুযায়ী তথাকথিত অহিংস, উদার ো নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পরিসর বাংলাদেশে আদৌ এখন অবশিষ্ট আছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু এরপরও জাতীয় নির্বাচন বর্জনের জন্য বিএনপিকে দোষারোপ করে যারা বিএনপিকে কোনঠাসা করতে চাইছে, পৌর নির্বাচনে নগ্ন কারচুপি ও তামাশা তাদের জন্য খালেদা জিয়ার উত্তর হিসাবে আমরা পাঠ করতে পারি। এরপরও ফ্যাসিস্ট শক্তির পক্ষে দালাল সাফাই গানে ওয়ালাদের অভাব হবে না। তাতে আমাদের চিন্তিত হবার কিছু নাই।

পৌর নির্বাচনে কী ঘটেছে তার পুরা ছবি আমাদের কাছে নাই। এই অভাব বাংলাদেশের জনগণের এখনকার রাজনৈতিক মানসিকতা বোঝার ক্ষেত্রে বড় ধরণের কোন বাধা নয়। সন্দেহ নাই পৌর নির্বাচনে এক ধরণের নির্বাচনী তামাশা হয়েছে। কিন্তু সত্য হোল, এটাই যে ঘটবে এ ব্যাপারে আগাম কোন সন্দেহ ছিল না। বিএনপি এই নির্বাচনে নগ্ন কারচুপি হবে সে ‘আশংকা’ ব্যাক্ত করেই অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু এই নির্বাচন থেকে তারা কী অর্জন করতে চেয়েছে এবং তারা তা পেরেছে কিনা সেটা একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারবে।

বিএনপির মধ্যে কিছু মধূর স্মৃতি কাজ করে থাকতে পারে। মনে আছে কিনা যে ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩ আসন পেয়েছিল। তবে ২০০৮ সালে তারা মাত্র ২৯ আসন পেয়েছিল। কিন্তু ভোটের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে তা কোন বিপর্যয় ছিল না। আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৪৯%; বিপরীতে বিএনপি ভোট পেয়েছিল শতকে ৩৩.২% ভাগ। ক্ষমতার আসার ৫ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতার ভিত্তি পোক্ত করে নিতে সক্ষম হয়েছিলো। সেটা প্রধানত সন্ত্রাস এবং বল প্রয়োগের ক্ষমতা। কিন্তু দুর্নীতি, মানবাধিকার লংঘন, একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট শাসনকে সাংবিধানিক চরিত্র দেবার কারণে তার বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভও ছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলো আওয়ামী সেকুলার রাজনীতির ইসলাম বিদ্বেষ। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে বিবর্তিত হয়ে আসা আওয়ামী লীগের ধ্রুপদী চরিত্রের সঙ্গে যা ছিল একদমই বেমানান। সেকুলারিজম ও মুক্তিযুদ্ধের নামে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চড়ে একটি হীন শক্তি বাংলাদেশকে বিভক্ত ও বিভাজিত করে চলেছে। এই শক্তির ওপর ভর করে আওয়ামি লীগ কওমি মাদ্রাসা কেন্দ্রিক ইসলামি আন্দোলনের বিরুদ্ধে যেভাবে যুদ্ধে নেমে পড়েছিল তাতে আওয়ামি লীগ ইসলাম বিরোধী শক্তি হিসাবে নিজেকে জাহির করেছে। এই কলংক থেকে আওয়ামী লীগের মুক্তি পাওয়া কঠিন। শেখ হাসিনা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের সেনাপতি হিসাবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন। এই ভাবমূর্তি নিয়ে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে নিষ্ক্রান্ত হবেন। এর অন্যথা হবার সম্ভাবনা খুবই কম।

কিন্তু এর কিছুই বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট নিজের পক্ষে ব্যবহার করতে পারে নি। বিএনপির জোটের মধ্যে জামায়াতে ইসলামি সহ ইসলামপন্থি দলগুলো থাকা সত্ত্বেও ইসলাম প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান ছিল দোদুল্যমান। আওয়ামি মার্কা ইসলাম বিদ্বেষের বিপরীতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শক্তি হিসাবে বিএনপি তার ভাবমূর্তি রক্ষা করতে পারে নি। জামাতে ইসলামির সঙ্গে তার সম্পর্কটাকেই আওয়ামি প্রচারণা প্রধান করে তুলতে পেরেছে। কিন্তু কওমি মাদ্রাসা কেন্দ্রিক দেওবন্দী ধারার ইসলামপন্থী দলগুলোও বিরোধী দলীয় জোটে ছিল। ঔপনিবেশিক ইংরেজ বিরোধী এবং বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের পক্ষের এই ধারার সমর্থন পেয়েও বিএনপি তাকে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারে নি। বাংলাদেশে ইসলামপন্থি বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারার ইতিহাস, তাদের মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক বিরোধ, সর্বোপরী শ্রেণিভিত্তি সম্পর্কে বিএনপি নেতৃত্বের আদৌ কোন ধারণা আছে কিনা সন্দেহ। এখানে মনে রাখা দরকার যে হাফেজ্জী হুজুর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে বলছিলেন জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই। ইসলামের জায়গা থেকে জাতীয়তাবাদী বিকারে পদস্খলিত না হয়ে মজলুমের পক্ষে বাংলাদেশের বহু আলেম ওলামা দাঁড়িয়েছিলেন, ইতিহাসের এই অধ্যায় বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা সফল ভাবে মুছে ফেলতে পেরেছে। এই আলেম ওলামাদের বড় অংশ জামায়াত বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের সমর্থক ছিল। কিন্তু বিএনপি একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকার ভার বহন করতে আওয়ামি প্রচারণার মুখে নিজেকে খামাখা বিপর্যস্ত হতে দিয়েছে।

আসলে ধর্ম বিদ্বেষী কিম্বা তথাকথিত ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ না হয়েও কী ধরণের রাজনৈতিক চর্চা বিএনপিকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভাবে গ্রহণ যোগ্য দল হিসাবে স্বীকৃতি দিতে পারে সে সম্পর্কে বিএনপির মধ্যে চিন্তা ভাবনার অনুপস্থিতি অবিশ্বাস্যই বলতে হবে। বিএনপি জামায়াতে ইসলামির সঙ্গে জোট বেঁধে চলে, ইসলামপন্থিদের তার সঙ্গে রাখে। অথচ এর নীতিগত ভিত্তি সম্পর্কে বিএনপির সুস্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা নাই। কেন এই জোট বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় জরুরী তার কোন সঙ্গত ব্যাখ্যা আজ অবধি বিএনপি দিতে পারে নি। উপমহাদেশে ইসলামের ভূমিকা ব্যখ্যার মধ্য দিয়েই উপনিবেশ বিরোধী মুক্তি সংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারার সঙ্গে বিএনপি নিজেকে যুক্ত রাখতে পারত। কিন্তু বিএনপির বুদ্ধিজীবী বা প্রচারকদের মধ্যে সেই বুদ্ধিবৃত্তিক হিম্মত আমরা দেখিনি ফলে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের সঙ্গে আঁতাত করা একটি দল হিসাবে নিজের পরিচয়কে বাড়তে দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে কোন কার্যকর পালটা প্রচার আজও গড়ে তুলতে পারে নি।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট মূলত নির্বাচনী জোট, পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে তা না-জায়েজ কিছু নয়। কিন্তু এই জোট নিয়েই বিএনপি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন নয়, আন্দোলন করেছে; হরতাল ডেকেছে, রাস্তায় লড়েছে। দুই পক্ষের হানাহানিতে মানুষ মরেছে, মানুষ পুড়েছে। বিএনপি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে বিএনপির জোট নির্বাচনী জোট নয়, এটা আন্দোলন-সংগ্রামের রাজনৈতিক জোট। কিন্তু এই জোটের নৈতিক ভিত্তি কী? বিএনপি স্পষ্ট করে নি। ফলে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির সঙ্গে জোট কেন? দ্বিতীয়ত ইসলামপন্থিদের সঙ্গেও বা তার জোটের আদর্শিক ভিত্তি কি? বিএনপি ইসলামকে কী চোখে দেখে? একাত্তর ও ইসলাম দুই প্রশ্নেই বিএনপি অস্পষ্ট। এই দুইয়ের একটির ক্ষেত্রেও বিএনপির সুস্পষ্ট জবাব নাই। এই সকল প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিএনপি রাজনীতি করতে চেয়েছে। তার ফল ভাল হয় নি।

মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো লণ্ডন থেকে জিয়াউর রহমানের বরাত দিয়ে তারেক রহমান বললেন: “ধর্মকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান সময়ে যখনই রাজনীতি করা হয়েছিল সেটা বিফল হয়েছে। সফল হচ্ছেনা বাংলাদেশেও। ধর্মের অবদান থাকতে পারে রাজনীতিতে, কিন্তু রাজনৈতিক দল ধর্মকে কেন্দ্র করে হতে পারে না”। এটা ছিল একটি স্ববিরোধী মন্তব্য। ইসলামপন্থীদের সঙ্গে জোট বেঁধে রাজনীতিতে ধর্ম চাই না কথাটা বলার কোন অর্থ নাই।

তারেকের এই বক্তব্যের নানান মানে হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্ম কেন্দ্র করে রাজনীতি হতে পারে না কেন? অবশ্যই হতে পারে এবং হচ্ছেও বটে। সারা দুনিয়াতে হচ্ছে, বাংলাদেশেও ধর্ম রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। সেটা ইসলামপন্থী হতে পারে, নাও হতে পারে। এমনকি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর বয়ান অনুযায়ী ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’ও হতে পারে। দ্বিতীয়ত ঔপনিবেশিক আমলে এই দেশের জনগণের আন্দোলন-সংগ্রাম ঐতিহাসিক কারনে ধর্ম কেন্দ্র করেই হয়েছিল। সেটা সফলও হয়েছিল। দেশের মানুষ জমিদার মহাজনদের হাত থেকে মুক্তি চেয়েছিল। পাকিস্তান আমলে তারা তা পেয়েছেও বটে। তদুপরি পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পারতো না। দিল্লীর অধীন একটি রাজ্য হিসেবে থাকতে হোত যেখানে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যালঘু।

বাংলাদেশের জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং আত্মমর্যাদার প্রশ্ন তার ধর্ম চেতনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সাধারণ মানুষ মনে করে একাত্তরে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’র জন্য মানুষ যুদ্ধ করে নি, সেটা স্বাধীনতার ঘোষণাতেও নাই। এটা দিল্লীর চাপিয়ে দেওয়া নীতি। যার উদ্দেশ্য এ দেশের জনগণের বিশ্বাস ও চর্চা – অর্থাৎ তাদের সংস্কৃতি, ইমান ও আকিদার সরাসরি বিরোধিতা। তারা একে ইউরোপীয় এনলাইটমেন্টের প্রস্তাব হিসাবে গ্রহণ করে নি। ইসলাম বিরোধী রাজনীতির আদর্শ হিসাবে বুঝেছে।

এটা স্পষ্ট বোঝা দরকার ইসলাম এই দেশের জনগণের রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয়। একে উপেক্ষা করার সুযোগ নাই। তারেক এটাও ভুলে গিয়েছেন যে ভাসানী ন্যাপ পুরাটা নিয়েই জিয়াউর রহমান বিএনপি গড়ে তুলেছিলেন। ধর্মবাদীদেরও বাইরে রাখেন নি। ভাসানী ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক না করেও কমিউনিস্টদের সঙ্গে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুম জনগণের লড়াই-সংগ্রাম করে গিয়েছেন। মজলুমের পক্ষে ইসলাম লড়ে বলেই তিনি কমিউনিস্টদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি এর মধ্যে কোন স্ববিরোধিতা দেখেন নি। অর্থাৎ ধর্ম রাজনীতিতে কোথায় কিভাবে ব্যবহৃত হবে সেটা রাজনৈতিক বাস্তবতাই নির্ধারণ করে দেয়। ইতিহাস শিক্ষা দেয় এ ব্যাপারে কোন শিশুপাঠ্য এলজেব্রা নাই। ফর্মুলা দিয়ে সেটা আগাম নির্ধারণ করা যায় না। এই জন্যই ‘ধর্ম কেন্দ্র করে রাজনীতি হতে পারে না’ কথাটার কোন অর্থ নাই। বরং ব্যাখায় দরকার বাঙলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় ইসলাম প্রশ্নটি আসলে কী? অর্থাৎ ইসলাম বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং সর্বোপরী বাংলাদেশের জনগণকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে পরিগঠিত করে তুলবার ক্ষেত্রে কী ধরণের ভূমিকা রাখতে পারে সেই প্রশ্নের বিচার এবং উপযুক্ত ও বাস্তবসম্মত জবাব হাজির করা। কিন্তু বিএনপি সেটা করছে না। গণমানুষের ধর্ম চেতনা –যা একই সঙ্গে ভাবে ঐতিহাসিক কারনে দিল্লির আধিপত্যের বিরুদ্ধে জাতীয় সার্বভৌমত্ব চেতনা রক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত – দেখা যাচ্ছে বিএনপি জিয়াউর রহমানের এই মৌলিক রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়েছে।

যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন বলে জিয়াউর রহমানের রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য গণমানুষের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী শক্তির ঐক্য গড়ে তোলা এবং বাকশালী অর্থনীতির বিপরীতে গতিশীল অর্থনৈতিক বিকাশ ও উন্নয়ন। দ্বিতীয়ত ছোট দেশ হলেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিপরীতে দক্ষিণ এশিয়ায় বহুপাক্ষিক সম্পর্ক বিকশিত করে ভারতের সঙ্গে শক্তির অসমতা সামাল দেবার শর্ত বিকশিত করা। ভুলে যাবার কথা নয়, এই লক্ষ্যেই দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোট ‘সার্ক’ জিয়াউর রহমানই গড়ে তুলেছিলেন।

আফসোস, বর্তমান বিএনপির মধ্যে জিয়াউর রহমানের দূরদৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা আছে কিনা সন্দেহ। মুখে বিএনপি নিজেকে জামায়াতের রাজনীতি থেকে আলাদা বলে বারবার দাবি করেছে। কিন্তু রাস্তার আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির মূল সাংগঠনিক শক্তি জামাত ও শিবির। হেফাজতে ইসলামের ছায়ায় সাধারণ ধর্ম প্রাণ মানুষের বিশাল বিক্ষোভ ও আন্দোলনকেও বিএনপি কাজে লাগাতে পারে নি। কারন ইসলাম কিম্বা ধর্ম নিরপেক্ষতা কোন বিষয়েই বিএনপি সুস্পষ্ট নয়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের আইন ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠলেও বিএনপি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জায়গা থেকে কোন সমালোচনা-পর্যালোচনা করে নি। দুই এক কলি নাম কা ওয়াস্তে কথা বললেও তা বৈচারিক প্রক্রিয়ার কোন পর্যালোচনা ছিল না। চুপ থেকে বিএনপি ভেবেছে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির সঙ্গে ‘আন্দোলনের আঁতাত’-এর দাহ নিজের গা থেকে সহজে ঝেড়ে ফেলতে পারবে। আফসোস, সেটা ঘটে নি। এর পূর্ণ সুযোগ আওয়ামি নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিয়েছে। দল হিসাবে বিএনপির বিপর্যয় এতে ত্বরান্বিত হয়েছে। ইসলামপন্থিদের সঙ্গে জোট বাঁধার জন্য এই বিপর্যয় ঘটে নি। ইসলাম প্রশ্নে অস্পষ্টতার জন্যই এই বিপর্যয় ঘটেছে।

বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের দল। সত্য হচ্ছে এই যে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, শেখ মুজিবর রহমান নন। তবে রাজনৈতিক নেতা হিসাবে জিয়ার আবির্ভাবের কারন হচ্ছে জিয়াউর রহমান সৈনিক ও জনতার মৈত্রীর চিহ্ন হিসাবে হাজির হয়েছিলেন। দিল্লির আধিপত্যবাদ, আগ্রাসন ও বাকশালি রাজনীতির বিপরীতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে এই মৈত্রী বাংলাদেশের একমাত্র সম্বল, সাধারণ মানুষ তা বুঝেছিল।

তারেক রহমানের ‘রাজনীতিতে ধর্মের অবদান’ কথাটা বিস্তর ব্যাখ্যা দাবি করে। সেই তর্কে না হয় গেলাম না। তারেকের বক্তব্যে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলেছে, যদি তারেক ঠিকই বলে থাকেন, তাহলে অসুবিধা নাই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে বিএনপি সেই সব দলের সঙ্গে কেন জোট বেঁধেছে যারা ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনীতি করে? এই হিপক্রাসির কোন জবাব নাই। তারেকের বক্তব্য ধর্মপ্রাণ মানুষকে যেমন বিরক্ত করেছে একই ভাবে সাধারন মানুষকে বিএনপির প্রতি অবিশ্বাসী করে তুলেছে। সাধারণ মানুষের কাছে বিএনপি হাজির হয়েছে শেষমেষ একটি কপট ও সুবিধাবাদী দল হিসাবে, যারা ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির বিরোধিতার কথা বলে অথচ ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার পতনের আন্দোলন করে। এই হিপোক্রাসি জনগণ পছন্দ করে নি। করবার কথা নয়।

বিএপির বর্তমান গভীর রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সুনির্দিষ্ট তিনটি কারন রয়েছে: এক. জিয়াউর রহমানের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বুঝতে অক্ষম হওয়া এবং তার ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি হারিয়ে ফেলা; দুই. ইসলাম প্রশ্নে অস্পষ্টতা, যা একই ভাবে ধর্ম নিরপেক্ষতা সম্পর্কেও চরম অজ্ঞতা। সর্বোপরী যা আবার জাতীয় সার্বভৌমত্ব চেতনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এবং তিন. রাজনৈতিক নীতিহীনতা ও হিপক্রাসি। যার কারনে জনগণের বিশ্বাস বিএনপি ধরে রাখতে পারছে না। বাংলাদেশের জনগণ বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্তি চায়, কিন্তু খোলামনে এই সংকটের মোকাবিলা না করলে বিএনপির ওপর বাংলাদেশের জনগণ ভরসা করবে না।

গত এক দশকে নব্য আওয়ামী রাজনীতির ইসলাম বিদ্বেষ প্রকট আকার ধারণ করে। ইসলামের প্রতি আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গী আওয়ামী লীগের জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এর কিছুই বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট নতুন গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা তৈরির কাজে ব্যবহার করতে পারে নি। অর্থাৎ বিএনপি পালটা এমন কোন নীতিগত দাবি নিয়ে আসে নি যার কারণে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট বাংলাদেশকে বিকল্প পথের সন্ধান দিতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ছাড়া আর কোন রেকর্ড বিএনপির কাছ থেকে আমরা শুনিনি।

শেখ হাসিনার প্রকট ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের অধীনে থেকেও আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০১১ সালে বিএনপি পৌর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার জাতীয় চরিত্র অক্ষূণ্ণ রাখতে পেরেছিল। ২৩৬টি পৌরসভার মধ্যে বিএনপির সমর্থকেরা ৯২টি আর আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা ৮৮টি পৌরসভায় জয়ী হয়েছিলেন। আর এখন তা উল্টে দাঁড়াল ১৭৮ বনাম ২২। তখন অধিকাংশ পৌরসভায় নির্বাচন হয়েছিল তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ। দুই হাজার এগারো সালের সফলতার পেছনে ছিল বিএনপির ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা’ । ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনেও বিএনপি এভাবে বিপর্যস্ত হয়নি। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে বিএনপি কতটা ভালো করেছে, সেই পরিসংখ্যান তুলে ধরেছিলেন। পৌরসভার নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে সন্দেহ নাই। আওয়ামী লীগ ধরে নিয়েছে বিএনপিকে রাজনীতি করার সুযোগ না দিয়ে এভাবেই তারা ‘নির্বাচন’ নামক প্রহসন চালিয়ে যাবে।

বিএনপির ওপর জনগণের হতাশা স্থায়ী কিছু বলে আমি মনে করি না। দ্বিতীয়ত, বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার বিপরীতে জাতীয় রাজনীতিতে মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর জোটের গুরুত্বকে কোন ভাবেই হাল্কা করে ভাবা উচিত নয়। বিরোধী জোটের কঠোর সমালোচনা দরকার। কিন্তু আমি মনে করি না বিএনপি দুর্বল বা বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে তাতে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কোন উপকার হবে। এতে হাততালি দেবার যেমন কিছু নাই। হতাশ হবার কোন কারণ দেখি না। এর কারন খুবই সোজা। আগামি দিনে যে রাজনীতি প্রবল শক্তি নিয়ে সামনে আসবে তা তিনটি প্রশ্নের মোকাবিলা করবার জন্যই আসবে।

এক. সার্বভৌমত্ব বোধের সঙ্গে সৈনিকতা এবং নাগরিকতার মৈত্রী – আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য যা জরুরী। জিয়াউর রহমানের ঐতিহাসিক উত্থান ও তাৎপর্য ব্যাখ্যার মধ্যে বিএনপি তা এখনও বোঝাতে সক্ষম।

দুই. ইসলাম প্রশ্নে স্পষ্টতা অর্জন, যা একই ভাবে ধর্ম নিরপেক্ষতার পর্যালোচনা। ইসলামকে ধর্ম ও ধর্মতত্ত্ব হিসাবে না বুঝে উপমহাদেশে ইসলামের ইতিহাস মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করা। ধর্ম প্রসঙ্গে সেই অবস্থানই জরুরী আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে যা খামাখা অন্য রাষ্ট্র বা অন্য রাষ্ট্রের জনগণের মনে কোন সন্দেহ বা আশংকার সৃষ্টি না করে। নীতিগত দিক অস্পষ্ট রেখে শক্তিশালী রাষ্ট্রের সমর্থনের জন্য দালালী করলে কোন ফল নাই, এটাও বোঝা দরকার; এবং তিন. রাজনৈতিক নীতিহীনতা ও হিপক্রাসি পরিহার।

এই তিনটি দিকে বিএনপি মনোযোগী হবে কিনা আমরা জানি না। কিন্তু ফ্যাসিস্ট রাজনীতি ও রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে জনগণের একটি লড়াই চলছে, তা বিএনপি বা তার জোটভূক্ত দলের অধীন নয়। এই রাজনীতি দুর্বল হবার কোন সম্ভাবনা নাই। বিএনপি ‘জাতীয়তাবাদ’ বলতে যদি এই ধারাটিকে সঠিক ভাবে শনাক্ত করতে পারে এবং জনগণের রাজনৈতিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ওপর দাঁড়ায়, জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসাবে বিএনপির ফিরে আসা কয়েক মাসের ব্যাপার মাত্র।

আমি নিশ্চিত ২০১৬ সাল হবে নতুন রাজনৈতিক দিশা চিহ্নিত করবার বছর।

১৮ পৌষ, ১৪২২, ১ জানুয়ারি, ২০১৬/ শ্যামলী

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।