নতুন বছর, নতুন চিন্তার আহ্বান


নতুন ঈসায়ী নববর্ষে সবাইকে ভালবাসা

আজ ২০১৫ সালের শেষ দিন। আর একটি ঈসায়ী সাল চলে যাচ্ছে। আরেকটি ঈসায়ী সাল সামনে। ইসলামের নবী-রসুলদের মধ্যে যিনি ঘৃণা ও হিংসার বিপরীতে প্রেমের অভূতপূর্ব নজির স্থাপন করে অমর হয়ে আছেন তিনি হজরত ঈসা (আ:)। তিনি রুহুল্লা। প্রেমের প্রতীক। ইসলামে তাঁর মর্যাদা অসামান্য। তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে বলে ইসলাম মনে করে না। তিনি আবার প্রত্যাবর্তন করবেন কি করবেন না তা নিয়ে নানান তর্ক ও ব্যাখ্যা থাকলেও হজরত ঈসার (আ:) প্রতীকী তাৎপর্য হচ্ছে প্রেম বা আশেকানিকে ক্রুশবিদ্ধ করা অসম্ভব। একই সঙ্গে হজরত ঈসার (আ:) প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতির মধ্যে এই সত্যের ওপরই জোর দেওয়া হয় যে যুদ্ধ, হানাহানি, হত্যা ও রক্তপাতের ইতিহাস পরিসমাপ্ত হতে পারে প্রেমে, মানুষের পরস্পরের প্রতি সদয় পারস্পরিকতায়। মেহেদি যদি প্রত্যাবর্তন করেন তবে তিনি প্রেমের রূপ নিয়েই হাজির হবেন।

নতুন ঈসায়ী বছরের আগে কথাগুলো মনে হোল। দয়া, প্রেম, ভালবাসা এবং ও অপরের সঙ্গে সজ্ঞান ও সচেতন সম্পর্ক রচনার তাগিদ ছাড়া কিভাবে মানুষের সমাজ গড়া সম্ভব! আর এটাই মানুষ হারিয়ে ফেলছে। মানুষের ইতিহাস যদি প্রাকৃতিক ইতিহাস না হয়ে থাকে তাহলে প্রকৃতিজাত প্রবৃত্তি, হিংসা ও হানাহানির উর্ধে ওঠার হিম্মত অর্জন করা ছাড়া কিভাবে প্রকৃতিকে জয় করা যাবে? এখন যাকে আমরা ইতিহাস বলে বুঝি তা তো আসলে প্রাকৃতিক ইতিহাসের অধিক কিছু নয়। প্রবৃত্তিজাত তাড়না থেকে তৈরি ইতিহাস প্রকৃতিরই ইতিহাস, এর মধ্যে দিব্য কিছু নাই যেখানে মানুষকে তার স্বরূপে চেনা যায়।

এটুকু বুঝতে পারলে ইসলামে দয়া কেন এতো কেন্দ্রীয় বিষয় তাও খানিকটা টের পাওয়া যায়। আল্লা মানুষের প্রভু, মানুষ তাঁর দাস। কিন্তু ইসলাম আল্লাকে ‘প্রভু’ না ডেকে নিত্য সেই নামে ডাকতে নির্দেশ দেয় যে নামে তিনি দয়ার দয়া। তাঁর সেই ‘ইসম’ই মধুর যেখানে তিনি রাহমানির রাহিম। বাংলার ভাবচর্চার ধারার গোড়ায় রয়েছে এই শিক্ষা। যে কারণে বঙ্গের সাধুগুরুদের কাছে তিনি ‘দয়াল’ – তিনি দয়ার সাগর। রাহমানুর রাহিমের এই বঙ্গীয় অনুবাদ সব সময়ই এ দেশের সাধারণ মানুষকে শিহরিত করে। ইসলাম কিভাবে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে নিজেকে কায়েম করতে চায় তার ইঙ্গিতও হয়তো এর মধ্যে আমরা পেতে পারি। সেটা সম্ভব যদি নিজের ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের মধ্যে ইসলামের শিক্ষাকে আমরা এমন ভাবে আত্মস্থ করি যা প্রাকৃতিক প্রবৃত্তির ইতিহাস অতিক্রম করে যাবার সহায় হয়। জীবের জীবনের অভিমুখ পরমার্থের প্রতি নিবেদন করা যায়।

নতুন ঈসায়ী নববর্ষে সবাইকে ভালবাসা।

আজ প্রশংসা করি তাঁর যাঁর মাধ্যমে আল্লাহ জানিয়েছেন তিনি সকল জাতির জন্যই পথ প্রদর্শক পাঠিয়েছেন এবং সকল নবী-রসুল ও আল্লার তরফে আসা পথ প্রদর্শকদের জীবন থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে বলেছেন। প্রশংসা করি তাঁদের যারা মানুষে মানুষে বিভেদ ও বিভাজনের চেয়েও যুগে যুগে মানুষের সঙ্গে মানুষের ঐক্য ও আত্মিক বন্ধনের উপর জোর দিয়েছেন। প্রশংসা করি সেই শিক্ষকদের যারা আমাদের অপরের কথা আন্তরিক ভাবে শুনবার এবং বিরোধী চিন্তার প্রতি যথার্থ সম্মান দেওয়া শিখিয়েছেন। যারা সব সময় বলেছেন সক্রিয় ও সজীব চিন্তা সবসময়ই একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির ভূমিকা থাকে বটে, কিন্তু সেটা শুধু একজন ব্যক্তির অনুমান ও মতের ওপর নির্ভরশীল নয় বরং তার উদয় সমাজের বিভিন্ন ব্যাক্তির পারস্পরিকতা ও সম্পর্ক চর্চায়।

কিছুই দীর্ঘস্থায়ী নয়

আজ ভোরে দেখছি কুয়াশা রাস্তা অধিকার করে রেখেছে; জানি কিছুই দীর্ঘস্থায়ী নয় এবং কুয়াশা হিমঋতুর বৈশিষ্ট্য মাত্র। রোদ উঠলেই এই অপরিচ্ছন্ন ছায়াচ্ছন্নতা পালাবে। মনে মনে একটি দীর্ঘ কারাভাঁর ছবি আঁকতে চেষ্টা করি। বারবারই পুরানা একটি প্রবাদ মনে পড়তে থাকে: কাফেলা এগিয়ে যায়, কিন্তু পেছনে পড়ে থাকে কাপুরুষদের খিস্তি খেউড় আর তাদের পোষা নেড়ি কুকুরগুলোর চিৎকার।

আসলে যারা এগিয়ে যেতে চায় তারা পিছিয়ে পড়ে কি? এগিয়ে যাবার ইচ্ছা নৌকার দাঁড়ের মত। যা শক্ত হাতে ধরে রাখতে হয়। নইলে মাঝ দরিয়ায় ঘুরপাক খেতে থাকতে হবে। মানুষের জীবন এক দীর্ঘ পদযাত্রা। যেখানে বিরতি, অবসর ও বিশ্রাম আছে বটে, এমনকি সময়ে অসময়ে দুই এক কদম পিছু হটে আসাও ঘটে। কিন্তু যারা এগিয়ে যেতে চায়, তারা এগিয়ে যায়।

বাংলাদেশের জনগণও এগিয়ে যেতে চায়। তারা দুর্দশার মধ্যে পড়ে না তা নয়। কিন্তু নানান দুর্দশা ও বিপর্যয় এড়িয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশও পিছিয়ে পড়েনি।

ধরুন, অন্যেরা যখন প্রবল ভাবে হতাশ এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত তারা বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ে নি কথাটাকে নিছকই কথার কথা হিসাবে নিতে পারেন। কিন্তু কথাটা ভেবেই বলছি। আজ ঈসায়ী নববর্ষ সামনে রেখে ২০১৫ সালের শেষ দিনটিতে কেন মনে করি আমরা পিছিয়ে নাই, এগিয়ে যাচ্ছি, তা নিয়ে দুই একটি কথা বলব।

বাংলাদেশে যারা ক্ষমতায় রয়েছে তারা কার্যত অনির্বাচিত। বৈধ সরকার হিসাবে নিজেদের দাবি করবার নৈতিক কিম্বা আইনী ভিত্তি বর্তমানে তাদের নাই। এরপরও কিভাবে এই সরকার টিকে থাকে বা থাকতে পারছে সেই প্রশ্ন তুলে অনেকে অবৈধ ক্ষমতার পক্ষে সাফাই গেয়ে থাকেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে টিকে আছে বলেই সরকার বৈধ। কারন অন্যান্য দেশ এই টিকে থাকাকে মেনে নিচ্ছে। আসলে অবৈধ সরকার দুনিয়ায় নতুন কোন ফেনোমেনা নয়। অবৈধ ভাবে হোসেন মোহাম্মদ এরশাদও দীর্ঘদিন দেশ শাসন করে গিয়েছেন। এক এগারোর সরকারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সীমা পেরিয়ে যাবার পর অবৈধ ছিল। বর্তমান সরকারও অবৈধ। আগের অবৈধ সরকারের তুলনায় বর্তমান ক্ষমতাসীনদের পার্থক্য হচ্ছে এটা সামরিক একনায়কতন্ত্র নয়, বেসামরিক একনায়কতন্ত্র। শহুরে সুবিধাভোগী শ্রেণী, গণমাধ্যম এবং আইন বহির্ভূত হত্যা, গুম ও বল প্রয়োগে সিদ্ধহস্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থার গুলোর মধ্যে আঁতাত হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের শক্তির ভিত্তি। সেই অংশগুলোর সঙ্গেই আঁতাত যারা মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বিরোধী । উদার ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি যারা অসম্ভব করে তুলেছে। এরা একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্র করে একটি বিশেষ বয়ানকে তাদের পক্ষে ব্যবহার করে এবং সমাজে তার পক্ষে সমর্থনও তৈয়ার করে। যখন এ লেখা লিখছি তখন কার্যত ক্ষমতাসীনদের অধীনে অসম নির্বাচনী পরিস্থিতিতে পৌর সভার নির্বাচন চলছে। যার ফলাফল ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা আরও পোক্ত করবে।নির্বাচনের ফল কী হবে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা দেখে আগাম আন্দাজ করা যায়। ক্ষমতাসীনদের অবৈধতার মাত্রা এতে কমবে না। বরং বাড়বে।

তাহলে বাংলাদেশে আমরা পিছিয়ে নাই, এগিয়ে যাচ্ছি বলার অর্থ কি? বিশেষত যেখানে বিরোধী রাজনৈতিক দল বা জোটের ব্যর্থতা এখন দৃশ্যমান। অন্যদিক নতুন রাজনৈতিন চেতনা ও সংঘবদ্ধতার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আসলে বিরোধী দলের ব্যর্থতা গণমানুষের পিছিয়ে যাওয়া নয়। বিরোধী জোট রাষ্ট্রের কোন রূপান্তর বা সংস্কারের প্রশ্ন তুলছে না। তারা স্রেফ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায়। এতে বিদ্যমান ফ্যসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার কোন হেরফের হবে না। নির্বাচন বিদ্যমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান নয়। রাষ্ট্রের প্রশ্ন বাদ দিয়ে স্রেফ নির্বাচনের দাবিতে জনগণ সাড়া দিচ্ছে না। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশে দুর্নীতি ও লুটপাট কমবে না, আইনবহির্বভহূত হত্যাকাণ্ড বা গুমখুন কমবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা জনগণ আজ অবধি পায় নি। সামগ্রিক রাজনীতির দিক থেকে তাকালে জনগণের এই আশংকাকে নেতিবাচক ভাবা ঠিক নয়। এই আশংকা সচেতনতার লক্ষণ। এটা অগ্রগতি, পিছিয়ে যাওয়া মোটেও নয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সংস্কার, রূপান্তর কিম্বা নতুন ভাবে গঠনের প্রশ্ন বাদ দিয়ে স্রেফ নির্বাচন দিয়ে রাজনীতিতে স্থান করে নেওয়া যাচ্ছে না। রাষ্ট্রের সংস্কার বা নতুন ভাবে রাষ্ট্রের গঠন জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের বিষয়ে রূপ নিচ্ছে। যার ফল আমরা আগামিতে অবশ্যই পাবো। পাবোই। বিএনপি বা বিরোধী জোট যদি জনগণকে নতুন কোন রাজনীতি দিতে অক্ষম হয় তাহলে তাদের ক্ষয় অনিবার্য। এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এর ফল কী হতে পারে আমি তা এখন অনুমান করতে চাই না। বিরোধী জোট এই সত্য উপলব্ধি করুক ও সঠিক রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল গ্রহণ করুক এটা সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। কিন্তু তারা নিজেরা যদি তা না চায় সেটা তাদের দুর্ভাগ্য। বাঙলাদেশ তার জন্য বসে থাকবে না। এটা বলে রাখা দরকার কোন শূন্যতাই চির জীবন অপূর্ণ থাকে না। জনগণ তাদের ইচ্ছা ও সংকল্প পূরণের জন্য নতুন রাজনৈতিক প্রচেষ্টা নেবে। ইতিহাস যুগে যুগে এটাই প্রমাণ করেছে।

বিভক্তি ও বিভাজনের বিপরীতে ঐক্যের তাগিদ দৃঢ় হচ্ছে

দুই হাজার আট সালের নির্বাচনের পর আমার মনে হয়েছিল বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ যেভাবে জোরদার হচ্ছে তাকে মোকাবিলা করা কঠিন হবে। আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৪৯%; বিপরীতে বিএনপি ভোট পেয়েছিল ৩৩.২% ভাগ। তরুণদের একটি বড় অংশ ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণার মধ্যে বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের দিক থেকে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ছবি আঁকতে চেয়েছিল। তারুণ্যের সঙ্গে এই আকাংখা সঙ্গতিপূর্ণ। এর সঙ্গে দেশপ্রেমকে যুক্ত করবার একটা শক্তিশালী ধারাও তরুণেরা যোগ করতে চেয়েছে। তবে সেটা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ানের দলীয় ও সংকীর্ণ তথাকথিত ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’। বিদ্যমান বিশ্ব ব্যবস্থার প্রবল প্রতিযোগিতার মধ্যে বাংলাদেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করার পরিবর্তে এই সংকীর্ণ ও দলীয় বয়ান বাংলাদেশকে বিভক্ত ও বিভাজিত করেছে। এখনও বিভক্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভাজনের রাজনীতি কার্যত দিল্লির আধিপত্যবাদী স্বার্থ রক্ষা করে এবং দেশের অভ্যন্তরে নাগরিক ও মানবিক অধিকার বিরোধী ফ্যাসিস্ট ও ক্ষমতালিপ্সু শক্তিকে মদদ দেয়। আমার ধারণা, জনগণের কাছে এই সত্য ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। এর ফলও অচিরে আমরা পাবো।

বলে রাখা দরকার একাত্তর শুধু জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম ছিল না। বিশ্ব ব্যবস্থার মধ্যে প্রান্তিক দেশগুলোর জনগণের মুক্তি সংগ্রামের দিক থেকে তাকালে একাত্তর বিশ্ব ইতিহাসে ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত, ধনি গরিব নির্বিশেষে বাংলাভাষী জনগণের সদর্পে বিশ্ব ইতিহাসে প্রবেশের মূহূর্ত। পশ্চিম বাংলার উচ্চবর্ণের হিন্দুর হিন্দুত্বকে এতোকাল ‘বাঙালি’ বলে গণ্য করা হোত, কিন্তু একাত্তরে বাংলাদেশের জনগণ রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছে তাদের ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতির কোন বিরোধ নাই। ভারতীয় বাঙালিরা তাদের ধর্ম বিশ্বাসের কারণে ভারতের সঙ্গে থেকে গিয়েছে। তারা হিন্দু থাকতে চেয়েছে, জাতপাত ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালি হতে চায় নি। সেকুলারিজমের আড়ালে পশ্চিমবাংলা আজ অবধি এই হিন্দুত্ববাদী বাঙালিত্বকেই লুকিয়ে রাখতে চায়। একেই লালন পালন করে।  এই বাঙালিত্ব পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের দিল্লীর পরাধীন রাখবার ক্ষেত্রে শক্তিশালী মতাদর্শিক ভূমিকা পালন করে। দীনেশ চন্দ্র সেন যে বৃহৎ বঙ্গের স্বপ্ন দেখেছিলেন তার ধারে কাছে তারা আজও যেতে পারে নি। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণকে ধর্মের কথা বলে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড় করানো যায় নি। তারা পাকিস্তানকে পূজা করে নি। কিন্তু তারা তাই বলে ধর্ম বিরোধীও হয়ে যায় নি। বাংলাভাষা, বাঙালির সংস্কৃতি এবং ধর্ম – বিশেষত ইসলাম – পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বাংলা ভাষা, বাঙালির সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে ইসলামের যে সন্ধি-মুহূর্ত আমরা বাংলাদেশে দেখি তা একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটা যেমন আরবদের ইতিহাস নয়, ঠিক একই ভাবে তা হিন্দুত্ববাদের ইতিহাসও নয়। এটা যতোই আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে ততোই এই দেশের জনগণ এগিয়ে যাবে। যাবেই। তাদের রুখবার সাধ্য কারো নাই। একই ভাবেে এই স্পষ্টতা ও উপলব্ধি পশ্চিম বাংলার জনগণের সঙ্গে আমাদের ঐক্য ও বন্ধনের ক্ষেত্রও সুস্পষ্ট করে তুলবে। বাংলাদেশের জনগণের ওপর যেমন পাকিস্তানবাদ চাপিয়ে দেওয়া যায় নি, তেমনি বাঙালিত্বের নামে হিন্দুত্ববাদও পশ্চিম বাংলায় শেষাবধি  চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। ইসলাম শুধু আরবের ইতিহাস নয়, এই অঞ্চলে বাংলাভাষীদেরও ইতিহাস। সেই ইতিহাস হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালিকেই লিখতে হবে। অন্য কেউ লিখে দেবে না। ঔপনিবেশিক শাসন, বিভেদ নীতি ও অসম ইতিহাসের কারণে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিভেদ তৈরি হয়েছে জনগণকেই তা মোছার উদ্যোগ নিতে হবে। এই উপলব্ধির মধ্যেই বিশ্বে বাংলাভাষীদের শক্তিশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠি হিসাবে আবির্ভাবের সম্ভাবনা পুরাপুরি নিহিত রয়েছে। নিজ নিজ ভাষার মধ্যেই বিভিন্ন জনগোষ্ঠি আত্মসচেতন হয়ে ওঠে, ইতিহাসে নিজ নিজ কর্তব্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ভাষার ভূমিকা অনস্বীকার্য।

অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির দিক থেকে বাংলাদেশের আবির্ভাব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ভারত নানান ধর্ম, নানান জাতি ও নানান ভাষা ও সংস্কৃতির দেশ। বাংলাদেশ নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের প্রেরণা হয়ে উঠেছিল। দিল্লীর জন্য যা ছিল অশনি সংকেতের মতো। মুক্তিযুদ্ধ তার অনিবার্য বিজয়ের দিকে যাবার শেষ মুহূর্তে দিল্লি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের এবং মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের অবদানকে ম্লান ও খাটো করবার জন্য এই যুদ্ধকে তাদের ‘বিজয়’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে।

আমার ধারণা ইতিহাস, বিশ্ব বাস্তবতাএবং বাংলাদেশের অপরিমেয় সম্ভাবনা সম্পর্কে তরুণরা গত দুই তিন বছরে অনেক বেশী সচেতন হয়ে উঠেছে। আওয়ামি সংস্করণের বাঙালিত্ব এবং দিল্লির স্বার্থের মধ্যে বাংলাদেশের তরুণদের ইচ্ছা ও আকাংখাকে বন্দী করে ফেলার চেষ্টা সম্পর্কে তরুণরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। তারা যথার্থ ভাবেই ‘বাঙালি’ বলে গর্ব বোধ করে, কিন্তু তাকে শিবসেনা বা হিন্দুত্ববাদের তত্ত্ব হিসাবে খাড়া করতে নারাজ। উচ্চবর্ণের বর্ণবাদী হিন্দুর ব্যাখ্যার সঙ্গে একটা ঐতিহাসিক পার্থক্য আমাদের চেতনার জগতে তৈরি হয়ে গিয়েছে যাকে ধোঁয়াশা বা অস্পষ্ট করে ফেলা এখন কঠিন।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মতাদর্শিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ফ্যাসিস্ট রাজনীতি ও রাষ্ট্রের যে ভয়ংকর রূপ আমরা দেখেছিলাম, তাতে মনে হয়েছিল এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কঠিন হবে। কিন্তু এই চেতনার স্পষ্টতা যতোই বাড়ছে ততোই তা ভেঙে পড়েছে। এরপরও সামাজিক ন্যুইসেন্স হিসাবে উভয় বাংলায় বঙ্গীয় শিবসেনাদের আস্ফালন ও দিল্লি সমর্থিত ফ্যাসিবাদের স্থানীয় বরকন্দাজ বাংলাদেশে থাকবে। কিন্তু তারা তরুণদের চিন্তা ও চেতনা অধিকার করতে পারবে বলে আমি মনে করি না। এর ফল হচ্ছে একাত্তরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক অবদানকে বর্তমান ফ্যসিস্ট জাতীয়তাবাদ থেকে আমরা আলাদা কিন্তু সঠিক ভাবে বুঝতে শিখব। একই ভাবে ঔপনিবেশিক আমলে উচ্চ বর্ণের হিন্দুর হাতে তৈরি বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিকে আমরা তার যথোপযুক্ত মর্যাদা দিতেও শিখব। ইতিহাসকে বিচার করবার অর্থ তাকে অস্বীকার করা নয়। তাকে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া হিসাবে বুঝতে শেখা। কোন স্থির, চিরায়ত বা তথাকথিত আবহমান ধারণা হিসাবে নয়। ‘বাঙালি’ হাওয়ায় তৈরি হয় নি। তার ইতিহাস আছে। ইতিহাস পর্যালোচনা ইতিবাচক, কিন্তু ইতিহাস অস্বীকার ইতিহাস সচেতনতার লক্ষণ নয়। আমার অভিজ্ঞতায় আমি বুঝেছি, ঐক্য ও সংহতির পক্ষে মতাদর্শিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক শর্ত তৈরি করবার সম্ভাবনা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী।

দুই হাজার তেরো সালে গ্রামের গরিব, ধর্মপ্রাণ, নিপীড়িত ও মজলুম জনগণের প্রতিরোধের মুখে শহর ও গণমাধ্যম কেন্দ্রিক ফ্যাসিবাদের উত্থান মার খায়। সাংগঠনিক শক্তি ও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার কারণে তার ফল জনগণ পায় নি। কিন্তু এতে ফ্যাসিবাদের মতাদর্শিক ভিত্তি ভেঙ্গে পড়ে। এখন তা টিকে আছে একান্তই নগ্ন বল প্রয়োগের ক্ষমতার জন্য। তরুণদের মধ্যে যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য বুঝতে সক্ষম তারা দুই হাজার তেরো সাল থেকেই ফ্যাসিস্টদের কাছ থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখা জরুরী মনে করতে শুরু করে। তারা ইতিমধ্যেই স্বাধীন ও নিজস্ব অবস্থান নিয়ে সরে এসেছে। দুই হাজার তেরো সাল ছিল জনগণের প্রতিরোধের মুখে ফ্যাসিবাদের দৃশ্যমান পরাজয়। এটা সত্যি যে এই প্রতিরোধ বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গড়বার রাজনীতিতে পরিণত হতে পারে নি। কিন্তু নতুন রাজনীতি উদ্ভবের শর্ত বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নাই। বাংলাদেশের রাজনীতি ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ইতিহাসের দিক থেকে এটা বিশাল অগ্রগতি।

এই অগ্রগতির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। একাত্তরের পর থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা ইসলামকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিপরীতে দাঁড় করিয়ে ইসলামকে গৌণ কিম্বা নির্মূল করবার যে চেষ্টা চালিয়ে আসছিল তা দুর্বল হয়ে গিয়েছে। হতে পারে উভয়ের সঙ্গে ইতিবাচক ও সৃষ্টিশীল সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে এখনও কোন স্পষ্ট বা পরিচ্ছন্ন ধারণা গড়ে ওঠে নি, কিন্তু সম্পর্ক রচনার কর্তব্য সম্পর্কে মানুষ আগের তুলনায় অনেক বেশী সতর্ক ও ওয়াকিবহাল। এটা বড় অগ্রগতি; বড় পরিবর্তন। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান বিষয় ধর্ম বনাম ধর্ম নিরপেক্ষতা নয়, বরং বাংলাদেশের জনগণের ঐক্য ও সংহতির ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করা । নতুন রাজনীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে ইসলামপন্থাকে দাঁড় করানো নয়। সেটা ধর্ম বিরোধী বা ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতির বিপরীত মূদ্রা ছাড়া আর কিছুই হবে না। বরং ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির পারস্পরিক সম্পর্ক – এমনকি দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে একটি জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ও ভবিষ্যৎ অভিমুখ কিভাবে গড়ে ওঠে সেই দিকেই এখন আমাদের মনোযোগ নিবিষ্ট করতে হবে।

নতুন ঈসায়ী বছরে সেই নতুন রাজনীতি বিকাশের ক্ষেত্রে অবদান রাখবার জন্য সবাইকে আহ্বান জানাই।

৩১ ডিসেম্বর ২০১৫। ১৭ পৌষ ১৪২২।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।