তৃণমূল না বামফ্রন্ট: পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন
আবার এক ঝলকে ভারতের কিছু রাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। ভারতের প্রাদেশিক সরকারের নির্বাচনকে রাজ্যের (রাজ্যসভা নয়) নির্বাচন বা বিধানসভা নির্বাচন বলা হয়। আগামী ৪ এপ্রিল থেকে এই ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের চার রাজ্য ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এভাবে মোট পাঁচ বিধানসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে ভারতের নির্বাচন কমিশন। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জইদি জানিয়েছেন, আসামে ২ দফা এবং কেরালা, তামিলনাডু ও পণ্ডিচেরিতে এক দফা করে ভোট নেয়া হলেও পশ্চিমবঙ্গে তা নেয়া হবে ৬ দফায়। এমনকি দিনের হিসাবে সাত দফায় ভোট হবে পশ্চিমবঙ্গে। ফলে প্রায় এক মাস ধরে চলবে এই ভোট পর্ব। পশ্চিমবঙ্গে ২৯৪টি আসনে মোট ৭৭ হাজার ২৪৭টি ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে ভোট নেয়া হবে। আর সব রাজ্যের সবখানে ভোট নেয়া শেষে আগামি মাসে একই দিন ১৯ মে, পাঁচ রাজ্যের ভোটের ফলাফল ঘোষণা করা হবে। পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফায় সেই ভোট গ্রহণ করা হয়েছে বিগত ৪ এপ্রিল।
কী করলে নির্বাচনে জেতা যাবে ভারতের রাজনৈতিক দলের আচরণ ও তৎপরতার ভিত্তি সেটাই। এই বিচারে ভারতের রাজনীতি মূলত নির্বাচনকেন্দ্রিক। সত্য-মিথ্যা আধা সত্য ইত্যাদি মিলিয়ে যেটা বললে ভোটের বাক্স ভরে উঠবে তাই বলতে হবে, করতে হবে, এটাই হয়ে গেছে ভারতের রাজনীতি। এটাই ভারতের সব রাজনৈতিক দলের রাজনীতি পরিচালনের মৌলিক নীতি। এর বাইরে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর অন্য কোন নীতি বা অবস্থান নাই। এবার একসাথে পাঁচ জায়গায় বিধান সভা নির্বাচন হলেও দুইটা হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের সীমানার দুই প্রান্তে – আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে। তাই ঠিক ২০১৪ সালের কেন্দ্রের নির্বাচনের মতো মোদি এবারও নির্বাচনী বক্তৃতা করতে এসে গেছেন। আর ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতোই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিষ উগরে দেয়া বক্তৃতা করছেন। এর প্রধান ইস্যু হল, বাংলাদেশ থেকে তথাকথিত অনুপ্রবেশ ইস্যু। বিশেষত আসামে এই ইস্যু নিয়ে প্রপাগান্ডা ও অনুপ্রবেশকারী হঠাওয়ের দামামা বাজানো প্রবল। ভাষা ব্যবহার লক্ষ্য করার মতো। মুখে বলা হয় বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারি, কিন্তু ব্যাতিক্রমহীনভাবে বুঝানো হয় ‘মুসলমান’। এ নিয়ে তাঁরা নিয়মিত কথা বলছেন, হুঁশিয়ারি ও হুঙ্কার দিচ্ছেন। এ ছাড়া মোদি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং পুরো সীমান্ত সিল করে দেয়ার হুমকি ইতোমধ্যে দিয়েছেন। কিন্তু মজার কথা হল, সেই গত ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরের দু’বছর মোদি বা তার সরকার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশ নিয়ে আর কোন কথা বলেনি। ফলে অনেকে আশা করতে পারেন যে, এবারও বিধানসভার নির্বাচনের আগে অনুপ্রবেশ নিয়ে মোদি ও তার দল হয়ত চিৎকার করবেন কিন্তু ভোটের পর সম্ভবত আর কোনো কথা তুলবেন না, ভুলে যাবেন। এটাকেই ভারতের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি বলে। এ কারণেই এখনও অবধি দেখা যায় অভ্যন্তরীণ নির্বাচনী রাজনীতিতে কোনো দল যেসব কথা বলবে তার সাথে সরকারের বিদেশ নীতি বা পড়শির প্রতি নীতিতে দৃশ্যমান কোন ছাপ পড়বে না। এর সাথে কোনো সম্পর্কও সাধারণত দেখা যায় না।
পাঁচটি বিধানসভার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গের চলতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায়। তাঁর দল তৃণমূল-কংগ্রেস ক্ষমতায়। পাঁচ বছর আগে বা ২০১১ সালে মমতা প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। মানে এর আগে রাজ্য-সরকারে কমিউনিস্ট সিপিএমের বামজোট ক্ষমতায় ছিল এবং একটানা ৩৪ বছর ধরে তারা ক্ষমতায় ছিল। ফলে অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, বামজোট কী এবার আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবে, সেই সম্ভাবনা কতটুকু? একমাত্র নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে। । তবে এর আগেই একটা ঘটনা হল, খোদ সিপিএমই যেন খোদ আমাদেরকে আগাম জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা এই নির্বাচনে জিতে ফিরে আসছে না। কিভাবে তা জানিয়েছে? না, অবশ্যই সিপিএম বা বামফ্রন্ট এ কথা ঘোষণা দিয়ে বলেনি। বলেছে কাজ তৎপরতায় আর নিজের আচার-আচরণে তা প্রকাশ করে। যেমন সিপিএম, মানে জোটবদ্ধ বামফ্রন্ট এবার একা নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস-বামফ্রন্ট মিলে জোটে, সিট ভাগাভাগি করে নির্বাচনে অংশ নিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিপিএম এর নিজের দলের অভ্যন্তরীণ বাধা এবং কংগ্রেসের বেলায় তাদের কলকাতা স্থানীয়সহ কেন্দ্রিয় নেতৃত্বকে এব্যাপারে রাজি করানোর নানান অনিশ্চয়তা কাটিয়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি তৎপর সিপিএমের নেতা সীতারাম ইয়েচুরির চেষ্টা-তদবির শেষে সফলতার মুখ দেখেছে।
কংগ্রেস-বামফ্রন্টের গাঁটছড়া এর আগে অনেকবারই হয়েছে, তবে সবসময় তা কেবল কেন্দ্রের ক্ষমতা বা নির্বাচনকে লক্ষ করে হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় রাজ্যপর্যায়ের নির্বাচনে কংগ্রেস-বামফ্রন্টের গাঁটছাড়া এই প্রথম। ইতোমধ্যে নির্বাচনের আগেই কংগ্রেসের সাথে আসন ভাগাভাগির পর্যায়ে জোটবদ্ধতাও কার্যকর হয়ে গেছে। তাই এখন কংগ্রেসের সাথে বামফ্রন্টের আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তটাই প্রমাণ করে যে, তাদের নিজের সম্পর্কে নিজস্ব মূল্যায়নটা কী! তারা মনে করে একা বামফ্রন্ট হিসেবে তারা সম্ভবত জিতবে না। তার সম্ভাবনা এখনো কম। একনাগাড়ে ৩৪ বছর শাসনের পর তারা তৃণমূলের কাছে ২০১১ সালে প্রথম হেরে গিয়েছিল। সে ঘটনা এখন পাঁচ বছরের অতীত ঘটনা হয়ে গেলেও, জনগণের মনোভাব এখনো তাদের দিকে যথেষ্ট সদয় হয়ে ফেরেনি। এটাই সিপিএম এর মুল্যায়ন, এটাই তাদের নিজেদের সম্পর্কে রিডিং। এই রিডিংয়ের কারণেই এবার কংগ্রেসের সাথে দ্বিধা ছেড়ে আগেভাগে জোট বেঁধে বামফ্রন্ট নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে। কংগ্রেসের সাথে তার জোটবদ্ধতার তাৎপর্য এটাই।
এটা শুধু বামফ্রন্টের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী শরিক সিপিএমের নিজের সম্পর্কে নিজস্ব মূল্যায়নই নয়। কংগ্রেসেরও পশ্চিমবঙ্গে তাদের নিজস্ব দশা সম্পর্কে নিজের মূল্যায়ন। সিপিএমের ক্ষমতাচ্যুতির দশা মাত্র পাঁচ বছরের। বিগত ১৯৭৭ সাল থেকে একটানা ৩৪ বছর ক্ষমতার রমরমাতে ছিল বামফ্রন্ট। অর্থাৎ ওই ৩৪ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের অবস্থাও এমনই শোচনীয় ছিল। মানে একমাত্র ১৯৭৭ সালের আগেই কেবল পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের রমরমা অবস্থা ছিল। সে দিক থেকে কংগ্রেসের দুরবস্থা এবার ২০১৬ সালের নির্বাচনে নতুন কিছু নয় হয়ত।
কিন্তু অন্য বিচারে কংগ্রেসের জন্য এটা অবশ্যই নতুন দশা। কেন?
বিগত ২০১৪ সালের কেন্দ্রীয় বা লোকসভার নির্বাচনে কংগ্রেসের অবস্থা অতীতের যেকোনো সময় থেকে ভিন্ন রকমের এবং আরো শোচনীয়। ঐ(২০১৪) নির্বাচনের ফলাফল থেকেই মোদি প্রধানমন্ত্রী হন আর ওই নির্বাচনে জোটে অংশগ্রহণ করা বিজেপি নিজের জোট ছাড়াই একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। অথচ কংগ্রেসের অবস্থা ঠিক তার উল্টো। বিগত ২০০৪ সাল থেকে পরপর দুই টার্ম যে কংগ্রেস কেন্দ্রে জোট সরকার গঠন করে ক্ষমতায় ছিল সেই কংগ্রেস ২০১৪ নির্বাচনের ফলাফলে এতটাই শোচনীয় যে, লোকসভায় বিরোধী দলের অবস্থান পেতেও সমস্যা দেখা দিয়েছিল। অনেক কষ্টে শেষে বিরোধী দলের মর্যাদা জোটাতে হয়েছে। কারণ বিরোধী দল হবার জন্য প্রয়োজনীয় সংসদীয় আসন পায়নি। কংগ্রেসের আসন ছিল লোকসভার মোট আসন ৫৪৩-এর ১০ ভাগেরও কম, ৪৫-এর আশপাশে। শুধু তাই নয়, কংগ্রেস নিজের এই দুরবস্থা টের পেয়েছিল, তা স্বীকার এবং মনেও রেখেছিল।
দু’মাস আগের সর্বশেষ বিহার বিধানসভার নির্বাচন হয়েছিল। ওই নির্বাচনে কংগ্রেস সর্বভারতীয় দলের দাবি ত্যাগ করেছিল; যেন সে বিহারের অন্যান্য আঞ্চলিক দলের পাশাপাশি তাদের মতোই আর একটি আঞ্চলক দল। এমন মর্যাদাতেই কংগ্রেস বিহারেরই বিধানসভা নির্বাচনে এক জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। এথেকে মনে করা যেতে পারে যে, তাদের দিন শেষ হয়েছে – এটা কংগ্রেস মেনে নিয়ে আগাচ্ছে। বাস্তবতা সে আগেই মেনে নিচ্ছে। আগামীতে ভারতজুড়ে সংগঠন আছে এমন সর্বভারতীয় দল বলতে কংগ্রেস বলে আর কিছু থাকবে না – এজন্যই যেন সে তৈরি হচ্ছে। বড়জোর এক স্থানীয় আঞ্চলিক দলের অবস্থান পেয়ে অন্যান্য আঞ্চলিক দলের সাথে কোনো জোটে অস্তিত্ব ধরে রাখার চেষ্টা করে যাবে। পশ্চিমবঙ্গে এবারের কংগ্রেস সেই নতুন চেহারার কংগ্রেস। সে হিসেবেই সিপিএম বা বামফ্রন্টের সাথে পশ্চিমবঙ্গে সে জোটবদ্ধ হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের ৪ এপ্রিল থেকে ভোট শুরু হয়ে গেছে এবং প্রথম পর্বে ১৮ বিধানসভা আসনের নির্বাচন দিয়ে এই নির্বাচন শুরু হবে। ওই ১৮ বিধানসভার আসন মূলত মাওবাদ প্রভাবিত এলাকাগুলোর। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট ছাড়া আরো দুই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হল বিজেপি এবং ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রী মমতার তৃণমূল। এখন কে জিততে পারে এই প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গে বিগত ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের বিন্যাসকে ভিত্তি ধরলে – ওই নির্বাচনে তৃণমূল ভাগে পেয়েছিল ৩৯.৮ শতাংশ, বামফ্রন্ট ২৯.৯ শতাংশ, কংগ্রেস ৯.৭ শতাংশ, আর বিজেপি ১৭ শতাংশ ভোট। ইতোমধ্যে এবার কংগ্রেস-বামফ্রন্ট জোট গড়ে ফেলেছে। তাই, ২০১৪ সালের হিসাব মাথায় রাখলে একই বিচারে এবার এই জোটের ভাগের সব ভোটের যোগফল দাড়ানোর কথা ৩৯.৬ শতাংশ। আর ওদিকে সব কিছু আগের মতো থাকলে সে ক্ষেত্রে মমতার পক্ষে আসতে পারে ৩৯.৮ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় কাছাকাছি। তাই মমতার দিক থেকে দেখলে এই জোট হওয়াটা তার জন্য অস্বস্তির। কারণ পুরানা ভোটের ফলাফলের বিচারে কংগ্রেস-বামফ্রন্ট জোট ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেললে মমতার তা ভাল লাগার কথা নয়।
তবে পশ্চিমবঙ্গের এবারের নির্বাচনে অন্য আরো অনেক ফ্যাক্টর আছে। যেমন ফ্যাক্টর নম্বর এক: বিগত ২০১১ সালের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রাপ্ত মোট ভোট ছিল ৪ শতাংশ, আর ২০১৪ সালে সেখান থেকে বেড়ে গিয়ে মোদি নামের জোয়ারে তা হয়েছিল ১৭ শতাংশ। এবারের নির্বাচনে প্রাপ্ত মোট ভোটে সেটা আবার কমে ৪ শতাংশে ফিরে যাবে বলে বিজেপি বিরোধী অথবা পক্ষের অনেকেই অনুমান করছেন। যদি তাই হয় তবে সে ক্ষেত্রে বিজেপির অবশিষ্ট বা বের হয়ে যাওয়া ভোট কংগ্রেস-বামফ্রন্ট জোট আর তৃণমূলের মধ্যে ফিরে চলে যাবে তা স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে পারি। কিন্তু কিভাবে কী অনুপাতে সেটা কংগ্রেস-বামফ্রন্ট জোট আর তৃণমূলের মধ্যে ভাগ হবে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এনিয়ে জল্পনা-কল্পনা ও পরিসংখ্যান নাড়াচাড়া শুরু হয়ে গেছে। এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি থেকে এবার মুখ ফিরিয়ে নেয়া বা ফেরত চলে আসা ভোটারদের মাত্র ২০ শতাংশ যদি তৃণমূলের ভাগে এসে যায় তাহলেই তৃণমূল আবার জিতে যাবে। মানে সে ক্ষেত্রে ২০১৪ সালে প্রাপ্ত মোট ভোটের ১৭ শতাংশ যা বিজেপির ছিল তা এবার কমে ৪ শতাংশ হয়ে গেলে – অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের ফেরত চলে যাওয়া ভোট হবে মোট মোটের ১৩ %। অর্থাত সেক্ষেত্রে গতবারের বিজেপির পাওয়া মোট ভোটের ১৭% ভোট এবার ভাগ হবার কথা – বিজেপি ৪%, কংগ্রেস-বামফ্রন্ট ৪.৫৫% (১৩% এর ৩৫%) আর তৃণমূলের ভাগে ৮.৪৫% (১৩% এর ৬৫%) – এভাবে অর্থাৎ ৩৫ঃ৬৫ ভাগ হলেই দেখা যাচ্ছে মমতার তৃণমুল জিতে যাবে। কারণ সেক্ষেত্রে অর্ধেকের বেশি বিধানসভা আসন তৃণমূল নিজের পক্ষে পেয়ে জিতে যাবে। আর যদি বিজেপির কমে যাওয়া ভোটের ৩৫% এর জায়গায় মাত্র ১৫ শতাংশ তৃণমূলের পক্ষে আসে তাহলে কংগ্রেস-বামফ্রন্টের জোট তৃণমূলের চেয়ে বেশি আসন পেয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসবে। অতএব, বিজেপির কমে যাওয়া ভোটের কত অংশ তৃণমূল নিজের দিকে টানতে পারবে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মুসলমান ভোটার পশ্চিমবঙ্গে আরেক বিরাট ইস্যু; বিশেষ করে সাচার কমিশনের রিপোর্টে মুসলমানদের দুরবস্থার কথা ফুটে উঠতে শুরু করার পর থেকে। বিগত ২০১১ সালের নির্বাচনের পর থেকেই “মুসলমান ভোট” ইস্যু হয়ে উঠতে শুরু করে। সবার নজর পড়ে যে, পশ্চিমবঙ্গে মোট ভোটারের ২৮ শতাংশ মুসলমান এবং এটা এখন প্রতিষ্ঠিত যে, পশ্চিমবঙ্গের মোট মুসলমান ভোটারের প্রায় ৯০ শতাংশ ভোটারই মমতার দলের পক্ষের ভোটার হয়ে গেছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে। মমতার তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান কমিউনিটির সাথে রাজনৈতিক আঁতাত এবং বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করে ফেলেছে। এর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের দিক হল, এর আগে সেই ১৯৪৭ সালের পর থেকেই মুসলমান ভোটাররা প্রথমে কংগ্রেসের ভোটব্যাংক হয়েছিল, এরপর ১৯৭৫ সালের পর থেকে তা বদলে গিয়ে পরের ৩৪ বছর ধরে বামফ্রন্টের ভোটব্যাংক হিসেবে ছিল। কিন্তু দুই জায়গাতেই মুসলমানেরা ছিল সেকুলার জামা গায়ে দিয়ে নিজের মুসলমান পরিচয় ঢেকে ঢুকে আড়াল করে। সে তুলনায় মমতার দলে এসে এবার তাঁরা ভোটার হয়েছে খোদ মুসলমান পরিচয়েই, কোনো আড়াল লুকাছাপা না করেই। ফলে এটা বিজেপির জন্য চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিগত ২০১৪ সালের নির্বাচনের ফলাফলে ক্ষমতায় আসার পরপরই কয়েক মাসের মধ্যে বর্ধমান বোমাবাজির ইস্যু তুলে বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ – মুসলমানেরা জঙ্গি, তারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে, অনুপ্রবেশকারি, তারা জেএমবি ইত্যাদি নানা প্রপাগান্ডার ঝড় তুলে ফেলেছিল। সেই মিথ্যা প্রপাগান্ডায় পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকা লিড ভূমিকা নিয়েছিল আর তা বিস্তৃত হয়ে বাংলাদেশের প্রথম আলো আর ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি – আনন্দবাজারের রিপোর্টের বরাতে রিপোর্ট করে ওই মিথ্যা প্রপাগান্ডায় শামিল হয়েছিল। দাবি করেছিল এগুলো জামায়াতের কাজ। কিন্তু হঠাৎ করে মোদির প্রধানমন্ত্রীর অফিস বিজেপির অমিত শাহের প্রচার-প্রপাগান্ডার তথ্যকে অনুমোদন না দিয়ে খোদ মোদির সরকার পিঠ ফিরে দাঁড়িয়ে যায়। লোকসভায় দাঁড়িয়ে মোদির এক মন্ত্রী বিবৃতি দিয়ে সেটা অস্বীকার করেছিল। ফলে সেই থেকে বর্ধমান ইস্যু বা মুসলমান-জঙ্গি ইস্যু আস্তে আস্তে চাপা পড়ে যায়। এমন হওয়ার মূল কারণ বিজেপি হিসাব করে দেখেছিল যে, নিজেদের ওই প্রপাগান্ডা সফল হলে তৃণমূল হয়তো ঘায়েল হবে কিন্তু এর ফলাফল বিজেপির পক্ষে আসবেই না; বরং না এসে তা কংগ্রেস-বামফ্রন্টের পক্ষে চলে যাবে। কারণ তখনকার বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান সিপিএমের বিমান বসু খোদ বিজেপির অমিত শাহের ভাষ্যের সাথে মিল রেখে প্রায় একই ভাষায় তৃণমূলকে বাংলাদেশের জামায়াতের পৃষ্ঠপোষক ও জঙ্গি সংগঠন বলে প্রপাগান্ডা চালিয়েছিল। তাই মোদির হঠাৎ করে ওই পিঠটান দেয়া।
মোদির এই পিঠটান দেয়া নীতির আলোকে সেই থেকে মমতা গত দুই বছর মোদি সরকারের বিরুদ্ধে দুই সংসদেই (লোকসভা ও বিশেষ করে রাজ্যসভাতে) বিরোধিতার কোনো ইস্যুতে যোগ দেয়নি; অথবা কোনো বিরোধী জোটে যোগ দিয়ে বিরোধিতা করেনি। যা করেছে তৃণমূল আলাদা করে করেছে। মোদির বিজেপি, কলকাতায় তৃণমূলের ক্ষমতায় ফিরে আসার চেয়ে বামফ্রন্টের ফিরে আসার বিরোধী বেশি। তাদের ধারণা, সিপিএমকে আর আরেকটি পাঁচ বছরের টার্ম পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে পারলে বামফ্রন্ট চিরদিনের মতো ক্ষমতায় ফিরে আসার সক্ষমতা হারাবে। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির লক্ষ্য এটাই। তাই এই নীতির আলোকে বিজেপির লক্ষ্য হল এবারের বিধানসভা নির্বাচনও মমতার হাতে চলে গেলে তা যাক। এভাবে ছেড়ে দিয়ে এরও পরের বার মানে ২০১৯ সালের লোকসভা এবং ২০২১ সালের বিধানসভার নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে কৌশল সাজানো। এতসব হিসাবকিতাব এর কারণে সব মিলিয়ে মমতার তৃণমূল খুব সম্ভবত মার্জিনালি হলেও আবার নির্বাচিত হয়ে জিতে সরকার গঠন করতে সম্ভবত সক্ষম হতে যাচ্ছে। তবে মমতার বিরুদ্ধে বিজেপির অন্য এক কামনা ও করণীয় আছে। বিষয়টি বাইরে থেকে মানে বাংলাদেশ থেকেও সুনির্দিষ্টভাবে খেয়াল না করলে বোঝা সম্ভব নয়। বিষয়টি হলো মমতার তৃণমূল ভোট কারচুপির দিকে ঝুঁকছে বলে বিজেপিসহ সব বিরোধীর অভিযোগ ও অনুমান। বাংলাদেশে বসে এর সত্যতা নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু না বলতে পারলেও ভারতের নির্বাচন কমিশনের অ্যাকশন ও তৎপরতার বিরুদ্ধে মমতার আপত্তি চিৎকার ক্রমশ বাড়ছে – সেটা লক্ষ্য করা যায়। যেমন মমতার খাতিরের পুলিশ অফিসার বা প্রশাসনিক আমলার বিরুদ্ধে কমিশন ক্রমান্বয়ে বদলির আদেশ দিলেই মমতা তাতে হইচই করে উঠছেন। যেমন কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার অথবা আমলা আইপিএস অফিসার ভারতী ঘোষকে নির্বাচন কমিশনের বদলি করা নিয়ে মমতা কঠিন আপত্তি তুলেছে, যদিও মমতা তা ঠেকাতে পারে নাই। তবে মমতা যে ভাষায় হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তাতেই মমতার বিরুদ্ধে কারচুপির সন্দেহের সত্যতা প্রবল হচ্ছে।
ভারতের নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে আমাদের যতই ইতিবাচক ধারণা থাক মমতার আমলে বিগত বছরগুলোতে মেয়র-কাউন্সিলর ধরণের স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে মমতার বিরুদ্ধে ভোটকেন্দ্র দখলের সীমাহীন কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল। এগুলো বর্তমানে বাংলাদেশের মতো মানের নির্বাচন হয়েছে বলে মনে করার কারণ আছে। এ কারণে এবার নির্বাচন কমিশন আরো কড়া কিছু পাল্টা কঠোর অ্যাকশনে গেছে। আর এরই বিরুদ্ধে মমতা সোচ্চার হয়েছেন। সোচ্চার হলেও হয়তো সেটা তেমন কিছু হতো না কিন্তু তিনি যা বলছেন তা থেকে মমতার বিরুদ্ধে মারাত্মক সব অভিযোগের পাল্লাই ভারী হয়।
মমতা পাবলিক মিটিংয়ে এ নিয়ে কী বলছেন তা আনন্দবাজার থেকে কোট করছি, “ইলেকশন আসলে অনেক কেন্দ্রীয় বাহিনী আসবে। ইলেকশন কমিশনের অবজার্ভার আসবে। কোনো দিন তাদের ভুল বুঝবেন না। যত্ন করবেন, আদর করবেন। তারা আমাদের অতিথি। অতিথিকে যত্ন করা আমাদের কাজ। তারা কিছু বললে চুপচাপ শুনবেন। কিন্তু মনে রাখবেন, কেন্দ্রীয় বাহিনী বা কমিশন তিন দিনের জন্য, তারপর আমরাই থাকব। কমিশন চলে গেলে তৃণমূলই থাকবে এলাকায়। ভোটারদেরও তৃণমূলকে সঙ্গে নিয়েই থাকতে হবে”। মমতার এই হুমকি মমতাকে নির্বাচনে জিততে সাহায্য করবে হয়তো কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লাকেই আরো মজবুত করবে। সাদা কথায় কারচুপির অভিযোগ মমতার ইমেজকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।