বদরুদ্দিন উমর ও বাংলাদেশের ‘হিন্দু’ প্রশ্ন


কেন হিন্দু প্রশ্ন?

বদরুদ্দিন উমর সম্প্রতি বেশ কয়েকটি লেখায় বাংলাদেশে হিন্দু প্রশ্ন ও সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গ তুলেছেন। তাঁর সাম্প্রতিক দুটো লেখা গুরুত্বপূর্ণ। ‘এটা কি সাম্প্রদায়িকতা?', লিখেছেন ২৫ মে ২০১৪ সালে, যুগান্তরে; দ্বিতীয় লেখাটি হচ্ছে, ‘বাংলাদেশে প্রকৃত সংখ্যালঘু কারা?’। এটিও ছাপা হয়েছে যুগান্তরে সম্প্রতি, ৫ জুন ২০১৬ তারিখে। দেখলাম তাঁর এই লেখাগুলো বাম বলে পরিচিত অনেকে পছন্দ করে নি। যাদের মধ্যে তাঁর পুরানা অনুসারী এমনকি এখনকার অনুরাগীরাও রয়েছে। [১]

অথচ যে দুটো প্রশ্ন বদরুদ্দিন উমর তুলেছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাকে আমরা সাম্প্রদায়িকতা বলব? কিভাবে সেটা নির্ধারিত হবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, যদি আমরা সংখ্যালঘু নিয়ে কথা বলতে চাই তাহলে ‘প্রকৃত সংখ্যালঘু’ কারা? প্রকৃত সংখ্যালঘু নির্ণয়ের পদ্ধতিও বা কিভাবে ঠিক হবে?

এই প্রকার প্রশ্নের অন্তর্নিহিত জিজ্ঞাসা হচ্ছে বাঙালি জাতিবাদী রাষ্ট্রে বাঙালি হিন্দু কিভাবে সংখ্যালঘু হয়? সেতো বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ানের ভিত্তিতে জাতিবাদী ক্ষমতা তৈরির কর্তা, জাতিতান্ত্রিক ক্ষমতার শরিক এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কন্সস্টিটিউন্সি। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে হিন্দুর প্রশ্নকে সংখ্যাগুরু/সংখ্যালঘুর বিতর্কে পর্যবসিত করা অতিশয় সরলীকরণ। এর তিনটি উদ্দেশ্য রয়েছে। এক.  বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রশ্নকে গৌণ, এমনকি অদৃশ্য করে ফেলা, যেন প্রমাণ করা যায় বাংলাদেশে সংখ্যলঘুর প্রশ্ন একান্তই হিন্দুর সমস্যা। দুই, হিন্ধুর প্রশ্নকে সামনে সংখায়লঘুর সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন ভাব হাজির করবার পেছনে বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে শক্তিশালী করাই প্রধান উদ্দেশ্য এবং তিন. উগ্র হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের মধ্য দিয়ে দিল্লির ইসলাম নির্মূল অভিযানকে বাস্তবাতিত করা। সংখ্যালঘু হিশাবে হিন্দুই বাংলাদেশে প্রধান ভিকটিম, এই যুক্তিতে হিন্দুর সুরক্ষার জন্য অতএব দিল্লিকে ভূমিকা নিতে হবে এই রাজনীতি প্রবল ভাবে বাংলাদেশে হাজির। বাংলাদেশে হিন্দু প্রশ্ন মীমাংসা সে কারণে জটিল রাজনৈতিক বিষয়। যার সঙ্গে একটি ছোট ও দুর্বল দেশের সার্বভৌমত্ব অঙ্গাঙ্গী জড়িত হয়ে গিয়েছে। সেকারনে বাংলাদেশে ‘হিন্দু’ প্রশ্নকে আলাদা ভাবে পর্যালোচনা করতে হবে; সংখায়লঘু তর্কের বাইরে বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে।

বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর সম্প্রতিকালে নির্যাতন বেড়েছে, উমর তা অকপটে স্বীকার করেন। যদিও তিনি কোন তুলনামূলক পরিসংখ্যান পেশ করেছেন দেখি নি। কিন্তু তিনি এই বেড়ে যাওয়াকে তিনি সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে ব্যাখ্যা করতে মোটেও রাজি নন। কিভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে সে বিষয়ে বিভিন্ন সময় ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভূমিকা সম্পর্কে তার নানান সময়ের লেখালিখি থেকে বুঝে নিতে হবে। শুধু এই দুটি লেখা থেকে বোঝা যাবে না। আগ্রহীরা আপাতত ৪ আগস্ট ২০১৩ তারিখে যুগান্তরেই ছাপা ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ফ্যাসিবাদী হামলারই এক নগ্ন রূপ’ লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন। তাছাড়া বদরুদ্দিন উমর ভালই জানেন যে এখন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জনগণকে খেয়ে না খেয়ে ‘সাম্প্রদায়িক’ প্রমাণ করার পেছনে খুবই সুনির্দিষ্ট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত রাজনীতি কাজ করে। বাংলাদেশের ভু-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।[২]

ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রাবল্য এবং ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় হিন্দুত্ববাদী শক্তির অধিষ্ঠানের কারনে বাংলাদেশের ‘হিন্দু’ প্রশ্ন নতুন ভাবে সামনে চলে এসেছে। বিশেষত পাশাপাশি যখন বাংলাদেশের হিন্দুরা নিজেদের বাংলাদেশের নাগরিক নন, স্পষ্ট ভাবেই হিন্দু হয়ে থাকবার দাবি তুলছেন। ইতোমধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের প্রতিনিধি হিসাবে রানা দাশগুপ্ত ১৬ অগাস্ট ২০১৫ তারিখে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশে হিন্দুদের জন্য আলাদা আসন দাবি করেছেন। বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট আরও স্পষ্ট ভাবে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা, পৃথক মন্ত্রণালয় ও সংসদে ৬০টি সংরক্ষিত আসনের দাবি জানিয়েছে। (দেখুন, ১৮ জুন বাংলা ট্রিবিউন) । অস্বীকার করবার উপায় নাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে হিন্দু প্রশ্ন নতুন রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়েছে। বদরুদ্দিন উমরের লেখা এবং সেই লেখা নিয়ে বিতর্ক সে কারণে খুবই সময়োচিত হয়েছে।

মার্কস-লেনিনের ধ্রুপদি চিন্তার জায়গায় দাঁড়িয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিচারকে শ্রেণি রাজনীতির অধীনে বিবেচনার তাগিদ থেকে বাংলাদেশের হিন্দু প্রশ্ন মীমাংসার ক্ষেত্রে উমর আমাদের চিন্তার অভিমুখ পদ্ধতিগত ভাবে বদলাবার প্রস্তাব করছেন। যেন জাতিবাদী ও ফ্যাসিস্ট বয়ান থেকে বেরিয়ে আমরা আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও সমাজে দ্বন্দ্বসংঘাতের চরিত্রকে সঠিক ভাবে বুঝতে পারি। কেবল তখনই সমস্যার সমাধানের জন্য সঠিক নীতি ও কৌশল অবলম্বন সম্ভব । উমরের তত্ত্বগত অনুমান কিম্বা সাম্প্রদায়িকতার সামাজিক ভিত্তি বাংলাদেশে আছে কি নাই তা নিয়ে তর্ক হতেই পারে। কিন্তু আমাদের চিন্তার অভিমুখ বদল ও হিন্দুর নির্যাতন মাত্রই সাম্প্রদায়িকতা প্রমাণ করবার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসার প্রস্তাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি তাঁর লেখা নিয়ে তর্ক আন্তরিক ও ইতিবাচক দিকেই আমাদের নেবে।

মার্কস-লেনিনের ধ্রুপদি চিন্তার জায়গায় দাঁড়িয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিচারকে শ্রেণি রাজনীতির অধীনে বিবেচনার তাগিদ থেকে বাংলাদেশের হিন্দু প্রশ্ন মীমাংসার ক্ষেত্রে উমর আমাদের চিন্তার অভিমুখ পদ্ধতিগত ভাবে বদলাবার প্রস্তাব করছেন। যেন জাতিবাদী ও ফ্যসিস্ট বয়ান থেকে বেরিয়ে আমরা আসলেই সমস্যার সমাধানের জন্য সঠিক নীতি ও কৌশল অবলম্বন করতে পারি। তাঁর তত্ত্বগত অনুমান কিম্বা সাম্প্রদায়িকতার সামাজিক ভিত্তি বাংলাদেশে আছে কি নাই তা নিয়ে তর্ক হতেই পারে। কিন্তু আমাদের চিন্তার অভিমুখ বদলাবার এই প্রস্তাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি তাঁর লেখা নিয়ে তর্ক আন্তরিক ও ইতিবাচক দিকেই আমাদের নেবে। তার লেখা পড়ে বামদের মতো আমাদের ভিমরি খাবার এবং তাকে অন্যায় ভাবে সমালোচনা করার কোন দরকার নাই।

 হিন্দু প্রশ্নের বিচারে এক শ্রেণির বামের হীনমন্যতা

বাংলাদেশের যে সকল বামেরা তাকে অন্যায় ভাবে সমালোচনা করছে তাদের মূল সমস্যা হচ্ছে চরম হীনমন্যতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা। এদের ধারণা বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক প্রমাণ করতে না পারলে বুঝি বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে হিন্দু বা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের আর কোন ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশের সমাজকে দোষী সাব্যস্ত করে আন্তর্জাতিক কাঠগড়ায় না তুলে তারা স্বস্তি পায় না। হিন্দু যে কারণেই নির্যাতীত হোক তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের হাতে সংখ্যালঘু হিন্দুর অত্যাচার নির্যাতন হিসাবে ব্যাখ্যা করতেই হবে। সেভাবেই দেখতে হবে। একে উমর তাঁর কোন এক লেখায় বলেছেন এটা শ্রেণি বিশ্লেষোণের পদ্ধতি বাদ দিয়ে বামদের সাম্প্রদায়িক চিন্তার পাটাতনে বন্দী থেকে সাম্প্রদায়িকতাকে বোঝার চেষ্টা। নিরন্তর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তির অভ্যস থেকে এই কঠিন রোগের তৈরি হয়। এই এক বিচিত্র ও বিকৃত মানসিকতা! বাংলাদেশে হিন্দুর ওপর নির্যাতনকে সাম্প্রদায়িকতা হিসাবে স্বীকার না করলে বুঝি হিন্দুর ওপর নির্যাতন অস্বীকার করা হয় ! মোটেও তা নয়।

বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ। বামদের হীনমন্যতার কারনে তারা মনে করে বাংলাদেশে ‘সাম্প্রদায়িকতার সামাজিক ভিত্তি নাই’ বলা মানেএই দেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের অকুল সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া, তাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ বাদ দেওয়া। এখানেই বামদের বুদ্ধিবৃত্তির চরম অসততা ও দীর্ঘদিনের চিন্তাহীনতার আবর্জনা। এই ময়লা সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে বামেরা বয়ে বেড়ায়। অথচ বদরুদ্দিন উমরের দুটো লেখার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে অত্যাচার নির্যাতন, মন্দির ভাঙা, জমি-সম্পত্তি দখল করে নেওয়া ইত্যাকার দুর্বৃত্তপনা ও লুন্ঠনবাজী রোখা। আমরা রুখব কি করে? সেটা রুখতে হলে বিদ্যমান ফ্যসিস্ট রাষ্ট্রব্যস্থার বিরুদ্ধে লড়তে হবে, বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে নয়। যারা নিজেরাই ফ্যসিবাদের দ্বারা নিপীড়িত ও অত্যাচারিত। বলে রাখা দরকার বদরুদ্দিন উমর এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন মুক্তি কাউন্সিলই বামদের মধ্যে সম্ভবত একমাত্র দল যারা ফ্যসিবাদ ও ফ্যসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামকে প্রধান গণ্য করে সনিষ্ঠ এবং নিজেদেরর চিন্তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রাজনীতি করে থাকেন। সাম্প্রদায়িকতার সামাজিক ভিত্তি নাই, কথাটা উমরের সামগ্রিক রাজনীতির আলোকেই বলা। এর উহ্য দিকটি হোল সাম্প্রদায়িকতার রাজনৈতিক ভিত্তি না থাকলেও ফ্যাসিবাদের সামাজিক ভিত্তি প্রবল। আর, ফ্যসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামকে আড়াল করবার জন্যই সাম্প্রদায়িকতাকে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হাজির করা ফ্যাসিবাদীদের জন্য জরুরী হয়ে পড়ে। এর মধ্য দিয়ে ফ্যসিবাদীরা একমাত্র নিজেদেরকেই হিন্দুর রক্ষাকর্তা হিসাবে নিজেদের হাজির করতে পারে।

উমর বলছেন উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের কারণে “হিন্দুরা বাংলাদেশীদেরই অংশ। হিন্দুরা ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু হলেও জাতিগতভাবে সংখ্যাগুরু। কাজেই যে বাঙালিরা বাংলাদেশে শাসন ক্ষমতায় রয়েছে তাদের মধ্যে বাঙালি হিন্দুরাও আছে। এটা মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশে মুসলমানদের শাসন বলে যদি কিছু থাকে তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল বাঙালিদের শাসন’। শাসন ক্ষমতার চরিত্র বিচার করলে বাংলাদেশে মুসলমানরা শাসক নয়, বাঙালিরাই শাসক আর হিন্দুরা শাসক শ্রেণির অংশ। “এদিক দিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতি এবং সাঁওতাল,গারো, হাজং,রাখাইন ইত্যাদি জাতিগত সংখ্যালঘু ও উর্দুভাষী অবাঙালি সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনকারী। বাংলাদেশের সর্বত্র যে শোষণ-নির্যাতন চলে সে শোষণ-নির্যাতন ধর্ম নির্বিশেষে হিন্দু-মুসলমান বাঙালিরা একত্রেই করে থাকে”। তাহলে জাতিবাদী বাঙালি শাসকদের অংশ হিন্দুরা স্রেফ ধর্মের পার্থক্যের কারণে বাংলাদেশে ‘প্রকৃত সংখ্যালঘু’ হতে পারে না। বাঙালি জাতির অংশ হিসাবে তার সম্প্রদায়গত অবস্থান বরং নিপীড়কের, নির্যাতীতের নয়। যে হিন্দু নির্যাতীত হচ্ছে সে হিন্দু বলে নির্যাতীত হচ্ছে না, সে গরিব ও মেহনতি জনগণের অংশ বলেই শোষিত ও নির্যাতীত। কিন্তু উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির হিন্দু বাঙালি সুবিধাভোগী। ফ্যাসিবাদী ক্ষমতার সুবিধা ও স্বাদ সে শগোল আনা উপভোগ করছে। এদেশের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তাই ‘প্রকৃত সংখ্যালঘু’। বদরুদ্দিন উমর যেভাবে সিদ্ধান্ত টেনেছেন তার পর্যালোচনা হতে পারে, কিন্তু সেই ক্ষেত্রে তাঁর তোলা প্রশ্নের গভীরতার সঙ্গে পর্যালোচনার দূরদৃষ্টির সম্মিলন ঘটা জরুরী।

উমর বলছেন, এই পরিস্থিতিতে “সাম্প্রদায়িকতার কারণ ও রাজনৈতিক চরিত্র বিষয়ে যারা অজ্ঞ, তারাই কোনো সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর যে কোনো ধরনের আক্রমণকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে থাকে। মতলববাজরা যে এ কাজ করে থাকে এটা সবারই জানা”। তাঁর লেখা মতলববাজদের বিরুদ্ধে। মতলববাজরা হচ্ছে ‘আওয়ামী ঘরানার কিছু বুদ্ধিজীবী’, সংবাদপত্র ও কিছু কিছু ব্যাক্তির বক্তৃতা-বিবৃতি ও প্রচারণা। তিনি স্বীকার করেন যে “হিন্দুসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ আগের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে”। কিন্তু তার কারন সাম্প্রদায়িকতা নয়। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা কোন হাওয়াই জিনিস নয়, তার ‘সুনির্দিষ্ট সামাজিক ভিত্তি’ থাকে। সেটা ব্রিটিশ ভারতে ছিল, পাকিস্তানের প্রথম দিকে থাকলেও তা ধীরে ধীরে অপসারিত হয়। “অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিকশিত হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে তার সামাজিক ভিত্তি বিনষ্ট হয়”। অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চর্চার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আবির্ভাবই উমরের কাছে প্রমাণ যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার আর্থ-সামাজিক ভিত্তি নাই। সাম্প্রদায়িকতার কোন আর্থিক ভিত্তি না থাকলে উমর তাকে সাম্প্রদায়িক বলতে নারাজ।

যারা উমরের সমালোচনা করেছেন তাদের কাছে এই জায়গাটি হচ্ছে সবচেয়ে আপত্তির জায়গা। উমরের বক্তব্য নাকচ করে দিয়ে তারা বলতে চান রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা আছে। অতএব উমর ঠিক বলেন নি। কিন্তু পুরা সমাজ নিয়ে উমর কথা বলছেন। হিন্দুর ওপর অত্যাচার নির্যাতন কিম্বা হিন্দুর জমি দখল ইত্যাদি বাংলাদেশের সমাজ আদৌ সঠিক গণ্য বা বরদাশত করে কি? তাহলে একে অন্যের জমি লুন্ঠনকারী বা ভূমিদস্যুদের কাজ না বলে এবং তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রতিরোধ তৈরি না করে তাকে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন বলছি কেন? দুবৃত্ত ও ভূমিদস্যুদের বিরোধিতা না করে কেন তার ওপর সাম্প্রদায়িকতার রঙ চড়ানো? হাওয়ায় তলোয়ার ঘুরানো কেন সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

তদুপরি মূল ইস্যু ও বাস্তব সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেবার জন্য জামাতে ইসলামি, বিএনপি এবং বাঙালি জাতিবাদীদের রাজনীতির যারা বিরোধী তাদের দোষারোপ করাই বা কেন? এদের সঙ্গে প্রগতিশীলতার লড়াইয়ের চরিত্র ভিন্ন। উমর বলছেন, জামাতে ইসলামী কে হিন্দুর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে দেখা যায় নি, শুরু থেকেই তাদের আক্রমণের লক্ষ্য গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও সমাজতান্ত্রিক শক্তি। জামাতের আক্রমণের যারা মূল লক্ষ্যবস্তু তাদের বিপুল ও অধিকাংশ মানুষই মুসলমান পরিবারের সদস্য। হিন্দু না। বরং যারা ইসলামী শাসন এবং ইসলামী আইন প্রবর্তন ও কার্যকর করার বিরোধী। তাহলে হিন্দু নির্যাতনের অপরাধ জামাতে ইসলামির ওপর চাপিয়ে দেওয়া মূলত গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও সমাজতান্ত্রিক শক্তির বাস্তব লড়াইয়ের চরিত্র অস্বীকার করা। লক্ষ্য করেছি যারা উমরের সমালোচনা করেছেন তারা এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি এড়িয়ে গিয়েছেন। এখানেও বামদের বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা ধরা পড়ে।

প্রশ্ন হচ্ছে হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মালম্বিদের বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান তাদের সমাজের অন্তর্গত মনে করে কি? নাকি তাদের দুষমন গণ্য করে? এবং স্রেফ সাম্প্রদায়িক কারণে হিন্দুদের ক্ষতি করতে চায়? দুষমনির মাত্রা কতোটুকু হলে পুরা সমাজকে আমরা সাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত করতে পারি? বিশ্বজিতকে যখন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের খুনিরা প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করল তাকে কিভাবে বিচার করব? বিশ্বজিৎ বারবার বলেছিল আমি হিন্দু, তারপরও তাকে হত্যা করা হয়েছে। তাহলে কি আওয়ামি লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠন একটি সাম্প্রদায়িক দল?

হিন্দুরা সম্প্রদায় হিসাবে বিশেষ ভাবে নির্যাতীত হচ্ছে সেটাও ভুল। উমর বলছেন “দেশে সাধারণভাবে যে নৈরাজ্য এবং আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, তাতে সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষকে নির্যাতন করা হচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা বিপন্ন হচ্ছে, অনেকে আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকারি লোকদের দ্বারা অপহৃত ও নিহত হচ্ছেন। এদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যাটি সব থেকে বেশি, কারণ দেশে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে তারাই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু হিন্দুরা বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি অংশ, শতকরা নয়-দশ ভাগের মতো। কাজেই সাধারণভাবে দেশে সরকারি ও বেসরকারি ক্রিমিনালদের দ্বারা মানুষের ওপর যে নির্যাতন হচ্ছে, তার দ্বারা জনগণের অংশ হিসেবে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে এটাও বলা দরকার যে, হিন্দুদের জনসংখ্যার তুলনায় এ সংখ্যা অল্প। কিন্তু এক্ষেত্রে যা লক্ষ করার বিষয় তা হচ্ছে, মুসলমানরা অনেক অধিক সংখ্যায় ক্ষতিগ্রস্ত, এমনকি নিহত হলেও কেউ বলে না যে, মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বা সাম্প্রদায়িকভাবে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। কিন্তু কোনো হিন্দু এভাবে নির্যাতনের শিকার হলেই কিছু লোক সমস্বরে বলতে থাকে, ‘হিন্দুদের’ ওপর নির্যাতন হচ্ছে!” সাধারণ ভাবে বাংলাদেশের জনগণ যেভাবে নিপিড়ীত হচ্ছে গুম হচ্ছে খুন হচ্ছে তাকে ধামাচাপা দিয়ে হিন্দুর ওপর নির্যাতনের প্রচারকে উমর অশনি সংকেত হিসাবে দেখেছেন।

উমরের লেখা থেকে যা বুঝেছি তা হোল তিনি কোন পরিভাষা বা সংজ্ঞা ব্যবহারের আগে তাকে কোন অর্থে কী বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহার করছেন সেই বিষয়ে পরিচ্ছন্ন থাকতে চান। এর মূল কারণ হচ্ছে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক দেশ হিসাবে প্রমাণ করবার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিপদ সম্পর্কে তিনি সজ্ঞান ও সতর্ক। বাস্তবে সাধারণ মানুষের ওপর যে নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চলছে হিন্দুদের নির্যাতন বাংলাদেশের সেই সামগ্রিক পরিস্থির অবনতির সঙ্গে যুক্ত, আলাদা কিছু নয়। তুলনায় যারা তার সমালোচনা করেছেন তাদের কাছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতা গৌণ। তাদের সমালোচনা উমরের কথাই প্রমাণ করে। তারা বাস্তবে কী ঘটছে তা বিচার না করে কোনো সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর যে কোনো ধরনের আক্রমণকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে থাকে। তারা ‘মতলববাজ’। দিল্লী ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নই তাদের লক্ষ্য। উমরের প্রশ্নের পরিপ্রক্ষিত ও আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক বাস্তবতা এড়িয়ে ‘সাম্প্রদায়িকতাকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক একটা তাৎপর্য দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায় না বলে’ যারা উমরের সমালোচনা করছেন , তারা মতলববাজদের দলেই ভিড়লেন। তারা দাবি করছেন ‘সাম্প্রদায়িকতা এখানে শক্তিশালীভাবেই দৃশ্যমান’। কিন্তু সেটা বাস্তবে নাকি প্রচার প্রপাগাণ্ডার ফলে তাদের লেখা থেকে সেটা বোঝার কোন উপায় নাই। এই ক্ষেত্রে হিন্দুর সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের দুর্বলতার কথা বলছেন। তাঁদের এই দাবির ভিত্তি দুর্বল। কারন বাংলাদেশে ক্ষমতার চরিত্রে বাঙালি জাতি ও জাতীয়তাবাদের আধিপত্য এবং আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসাবে হিন্দুত্ববাদী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের হিন্দুর শক্তির সম্পর্ক বিচার করলে সম্প্রদায় হিসাবে এমনকি ব্যাক্তি হিসাবেও বাংলাদেশে হিন্দু শক্তিশালী ও শাসক শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত।

কিছু কিছু তত্ত্ববাগীশ এই ক্ষেত্রে আবার উমরের তত্ত্বকে ইকননমিক রিডাকশানিজমের দোষে দোষী বলেছেন। তারা সম্ভবত প্রাচীন উপরকাঠামো/ভেতরকাঠামোর তর্ক সামনে আনতে চান। ভাল। আমরা এই সুযোগে কার্ল মার্কসকে আবার অন্যত্র পড়ে নেবো। কিন্তু উমর যখন শ্রেণি ও ফ্যসিবাদের কথা বলেন তখন তিনি অর্থনীতির দ্বারা সব নির্ধারিত হয় এই দাবি কোথাও করেছেন বলে দেখি নি। তিনি সাম্প্রদায়িকতার ‘সামাজিক ভিত্তি’র কথা বলেছেন। ‘সামাজিক ভিত্তি’ কথাটার মানে তিনি উল্লেখিত দুটো লেখায় স্পষ্ট করেন নি। সেটা তাঁর অন্যান্য লেখা থেকে আমাদের বুঝে নিতে হচ্ছে। তাঁর কাছে আরো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা আমরা চাইতে পারি। কিন্তু তিনি অর্থনীতিবাদী রিডাকশানিজম করেছেন এই অভিযোগ ঠিক না। ইকোনমিক রিডাকশনিজম ওল্ড স্কুল মার্কসবাদের পুরনো অসুখ – এটা মানতে আমাদের অসুবিধা নাই। কিন্তু যে নিউ লেফটের বরাতে উপরি কাঠামোতে সাম্প্রদায়িকতা হাজির থাকার দাবি করা হচ্ছে তথাকথিত নিউ লেফটের সেই একই চিন্তা পদ্ধতি দিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে ‘হিন্দুর উপর হামলা মানেই সাম্প্রদায়িকতা’ এই ডিস্কোর্স ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত দুর্বল বাংলাদেশে কোন শ্রেণী বা কোন শক্তির স্বার্থে তৈরি হয় ও প্রবল হয়ে ওঠে? এই বয়ানের উপকারভোগী কে? ফ্রাংকফুর্ট স্কুলের তত্ত্ববাগীশরা এই আদত প্রশ্নটা করছেন না। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল কেন্দ্রিক নিউ লেফট নিয়ে আমরা সুযোগ ও সময়মতো অন্যত্র আলোচনা করব। কিন্তু এই তর্কে উমরেরই জিত। কারন কোন শ্রেণি কেন এবং কিভাবে তার শ্রেণির পক্ষে বয়ান তৈরি করে উমরের লেখা সেই দিকেই আমাদের নজর ফেরাতে সহায়তা করে। অপ্রাসঙ্গিক তত্ত্ববাগীশতা এই ক্ষেত্রে ফ্যসিবাদের পক্ষের বয়ানের ন্যায্যতা প্রমাণে কাজে লাগতে এর অধিক কিছু নয়।

আত্মপরিচয়ের ইতিহাস আছে: কিছুই চিরায়ত বা শ্বাশ্বত নয়

তবে বদরুদ্দিন উমর পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালপর্বে বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠির মধ্যে অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে তৈরি হওয়া বিভেদ, বিভাজন ও সামাজিক বিখণ্ডিভবন নিয়ে কিছু লিখেছেন বলে আমার চোখে পড়ে নি। তাঁর উত্থাপিত প্রশ্নের সঠিক বিবেচনার জন্য সেই দিক বিবেচনাতে নেওয়াও জরুরী। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইত্যাদি নিছকই ধর্ম বিশ্বাসজাত পরিচয় নয়। ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যে তাদের ঐতিহাসিক তাৎপর্য সীমাবদ্ধ নয়। যদিও ধর্ম বিশ্বাসীরা ইতিহাস থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন গণ্য করে অনৈতিহাসিক ভাবেই নিজেদের নিয়ে ভাবতে অভ্যস্ত। ইংরেজিতে একটা পরিভাষা আছে নিজের আত্মপরিচয়কে ‘এসেনশিয়ালাইজ’ করা। অর্থাৎ ঐতিহাসিক ভাবে আত্মপরিচয়ের উদ্ভব ও বিবর্তন বিচার না করে ধর্মীয় পরিচয়ের দ্বারা নির্ণিত পরিচয়কেই চিরায়ত, পূর্ব নির্ধারিত ও স্বতঃসিদ্ধ সত্তা গণ্য করা। উপমহাদেশে বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্ম সম্প্রদায় থেকে সঞ্জাত পরিচয় সম্পর্কে আমরা এভাবেই ভাবতে অভ্যস্ত। আরেক রূপ হচ্ছে ভাষা বা সাংস্কৃতিক পরিচয়কে শ্বাশ্বত ও চিরায়ত ভাবা। ‘আবহমান বাঙালি’র ধারণা – যেন অনাদিকাল থেকে ‘বাঙালি’ ইহ্লোকে হাজির – অনৈতিহাসিক বা ইতিহাস বিরুদ্ধ চিন্তা থেকেই তৈরি হয়।

অন্যদিকে সংখ্যাগুরু/সংখ্যালঘু বিভাজনও বিভ্রান্তি তৈরি করে। সামাজিক মানুষ ও তাদের সমাজকে নিছকই সংখ্যা দিয়ে বিবেচনার রীতি আধুনিক রাষ্ট্র এবং ভোটের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে প্রসঙ্গের বাইরে বিমূর্ত ভাবে ‘সংখ্যালঘু’ কথাটিরও অপব্যবহার ঘটে। আধুনিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা তৈয়ার ও বৈধ করবার প্রক্রিয়ার বিচার ছাড়া ‘সংখ্যালঘু’ বর্গটির যথেচ্ছ ব্যবহার প্রপাগাণ্ডা ও প্রচারের কাজেই বেশী ব্যবহার করা হয়।

ইতিহাসের খবর নেওয়া বেশ পরিশ্রমের কাজ বটে। সেই খবর নিতে হলে প্রাচীন আর্য বনাম অনার্যের দ্বন্দ্ব, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও অনার্যদের পরাজয়, বর্ণাশ্রম প্রথা ভিত্তিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা কায়েম এবং তার বিরুদ্ধে হাজার বছরের নিম্ন জাতের মানুষের লড়াই, ঔপনিবেশিক শাসন পদ্ধতির মধ্যে হিন্দুমুসলমান ভেদ নীতি, উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমন, সাম্রাজ্য ও সুলতানী প্রতিষ্ঠা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে জমিতে বিশেষ চরিত্রের ব্যাক্তিগত সম্পত্তি কায়েম এবং তার ওপর হিন্দু জমিদার ও মহাজন শ্রেণি গঠন, ঔপনিবেশিক কলকাতা ও ‘বাংলার নবজাগরণ নামক বর্ণহিন্দুর ভাষা, সংস্কৃতি ও ধ্যান ধারণার আধিপত্য, বাংলা ভাগের ইতিহাস এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনীতি – ইত্যাদি নানান বিষয় নিয়ে গবেষণা ও ভাবনা চিন্তার দরকার আছে। ফলে হিন্দু নিজেকে শ্বাশ্বত কাল থেকেই হিন্দু মনে করে। মুসলমান নিজেকে বাবা আদমের সময় থেকেই মুসলমান ভাবে। উপমহাদেশে তার সুনির্দিষ্ট ইতিহাস জানতে কেউই বিশেষ আগ্রহী নয়। এমনিকি হিন্দু কিভাবে নিজেকে অন্য সম্প্রদায় – বিশেষত মুসলমানের বিপরীতে নিজের পরিচয় নির্ণয় বা নির্মাণ করে সেই বিষয়েও হিন্দু সচেতন নয়। তেমনি মুসলমানও নয়। মুসলমান যা কিছুকে পৌত্তলিকতা কিম্বা তার ধর্মের বিপরীত চর্চা হিসাবে দেখে তার বিপরীতেই নিজেকে মুসলমান হিসাবে উপলব্ধি করে। কিন্তু নির্মাণ করে বলেই তারা সাম্প্রদায়িক হয়ে যায় না। পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য ও বৈচিত্র নানান ধরণের দ্বন্দ্ব তৈরি করতেই পারে। সেই দ্বন্দের সুনির্দিষ্ট চরিত্র বিশ্লেষণ করা ও বোঝা দরকার।

উমর বলছেন, “হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করে তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করার যে চেষ্টা বিভিন্ন জায়গায় এখন দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনো সম্পর্ক নেই। এই আক্রমণকে দেশে বিরাজমান লুটপাট, ভূমিদস্যুতা এবং অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার করতে হবে”। একে তিনি সবার মতই অবশ্যই সমস্যা হিসাবে দেখছেন। কোন ফারাক নাই। কিন্তু অন্যদের সাথে তাঁর দেখার ফারাক হল যে তিনি এটাকে আদৌ বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা - হিসাবে দেখছেন না। তাঁর ক্যাটাগরি খেয়াল করতে হবে। হিন্দুদের উপর হামলা নির্যাতন মানেই তা সাম্প্রদায়িক নয়। হিন্দুদের উপর আক্রমণকে তিনি সাম্প্রদায়িক বলে মানতে রাজি নন। পরিষ্কার বলছেন। “এক্ষেত্রে এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, এ ধরনের আক্রমণ শুধু হিন্দুদের ওপরই হচ্ছে না, এটা আরও বড় আকারে হচ্ছে মুসলমানদের ওপর, যার রিপোর্ট প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় দেখা যায়। হিন্দুরা বাংলাদেশের সমগ্র জনসংখ্যার একটি অংশ। কাজেই দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে জনগণের ওপর যে আক্রমণ হচ্ছে, তার অংশ হিসেবে হিন্দুদের ওপরও আক্রমণ হচ্ছে”। তাছাড়া আক্রমণ শুধু হিন্দুদের ওপরই হচ্ছে না। আরও অনেক বেশি করে হচ্ছে বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিসত্তার লোকজনের ওপর। উত্তর বাংলার সাঁওতালদের ওপর এই আক্রমণ হচ্ছে। এছাড়া রাখাইন, গারো সহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতিসত্তার লোকদের ওপরও এটা হচ্ছে”।

একে মোকাবিলার জন্য বদরুদ্দিন উমর জনগণকে নিয়ে ‘প্রকৃত প্রতিরোধ’ গড়ে তুলতে চান। ভূমিদস্যু, লুটপাটকারী দুর্বৃত্তদের কথা না বলে পুরা সমাজকে সাম্প্রদায়িকতার দোষে অভিযুক্ত করা ও কুৎসা রটনার মধ্যে উমর ভয়ানক বিপদ দেখেন। তখন এ হামলার বিরুদ্ধে কোনো প্রকৃত গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলাও সম্ভব হবে না। তাঁর প্রস্তাবঃ “প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে অসাম্প্রদায়িক জনগণের বিরুদ্ধে নয়, এটা করতে হবে ভূমিদস্যু ও লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে”। একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে উমর খুবই দরকারী কাজের কথা বলছেন, কোন বিমূর্ত তত্ত্ব নয়। এখানেই তাঁর সঙ্গে অন্য বামদের পার্থক্য। সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে তাঁর যে সংজ্ঞা ও বিবেচনা তা সুনির্দিষ্ট ভাবে ভূমিদস্যু ও লুন্ঠনকারী দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে গণ প্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক। এই ক্ষেত্রে তাঁকে সমর্থনই সঠিক এবং এখনকার কর্তব্য।

বাংলাদেশে হিন্দু প্রশ্ন ও দিল্লির আগ্রাসন

বদরুদ্দিন উমর হঠাৎ এই প্রশ্ন তোলেন নি। বাংলাদেশকে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রেখে ক্রমাগত সীমান্তে হত্যাকান্ড চালিয়ে দিল্লী ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তকে দুনিয়ার সবচেয়ে রক্তাক্ত সীমান্তে পরিণত করেছে। দিল্লীকে চিনতে আমাদের আর অসুবিধা হবার কথা নয়। দিল্লির আগ্রাসনের চরিত্র উপমহাদেশের রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি নির্ণয়ের গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই আগ্রাসন, বলা বাহুল্য, নিত্য নিত্যই বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির দ্বন্দ্ব সংঘাতের সুযোগ নেয়, নিচ্ছে ও নেবে। সেই ক্ষেত্রে হিন্দু নির্যাতন, সাম্প্রদায়িকতা, মন্দির-মঠ ভাঙা ইত্যাদি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রচারের মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। দুনিয়াব্যাপী ইসলামভীতি ও ইসলাম বিদ্বেষের কারণে বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক দেশ হিসাবে প্রমাণ করা সহজ হয়ে ওঠে। আই এসের নামে কুপিয়ে হত্যাকেও কেবল হিন্দুদের উপর আক্রমণ বা সাম্প্রদায়িক সমস্যা হিসাবে দেখানোর চেষ্টা চলছে। এইসব উদ্দেশ্যমূলক। এই সবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন মাত্রা পাচ্ছে এবং নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে। সেইসব নজর করা দরকার। অন্যান্যদের সাথে হিন্দুদের উপরও হামলাকে “সাম্প্রদায়িক” না বলতে পারলে হীনমন্যতার কিছু নাই। হিন্দুদের উপর হামলা মানেই সাম্প্রদায়িক হামলা নয়। সাম্প্রদায়িক না বললে সমস্যা বা সংকট মোকাবিলা করা যাবে না তাও নয়। বরং আসলে কারা এই সকল হত্যাকান্ডে জড়িত তাদের বরং আড়াল করা হচ্ছে। দিল্লীর আগ্রাসনের অজুহাত ও ভিত্তকেই বরং মজবুত করা হচ্ছে।

দিল্লীতে হিন্দুত্ববাদী ক্ষমতার অধিষ্ঠান সাময়িক নয়, ফলে ভারতে শক্তিশালী হিন্দুত্ববাদী ক্ষমতার আগ্রাসন কমবে না। বাড়বে। ভারতে হিন্দুত্ববাদের অধিষ্ঠানকে যারা সাময়িক ভাবেন তারা গোলকায়নের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদের ঐতিহাসিক ও অনিবার্য মৈত্রীকে আড়াল করেন। আধুনিক রাষ্ট্র ও রাজনীতির অনুষঙ্গে সিপিএম বা কংগ্রেস মার্কা রাজনীতির পোষাক আধুনিক ভারতে হিন্দুত্ববাদকে আড়াল করে রাখতে পেরেছিল। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই যুগে নব্য হিন্দুত্ববাদের সেটা আর লুকিয়ে রাখার দরকার নাই। ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির এই গুণগত রূপান্তরের আলোকে বাংলাদেশের হিন্দু প্রশ্নের মীমাংসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।

হিন্দুদের রক্ষা করা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দিল্লীর সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের সবচেয়ে সহজ ও বিশ্বাসযোগ্য অজুহাত হয়ে উঠতে পারে। আসলে ‘প্রকৃত সংখ্যালঘু কারা? – এই লেখায় বদরুদ্দিন উমর ঠিক এই আশংকা ব্যাক্ত করেই তাঁর লেখা শুরু করেছেন। তিনি বলছেন, “বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ও তাদের পিতৃসংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) জন্য খুব বেশি দরকার। চরমপন্থী সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে ভারতে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী রাখার জন্যই এটা তাদের দরকার। কাজেই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বলতে যা বোঝায় সেটা না থাকলেও সেই পরিস্থিতি তৈরির জন্য বিজেপি বেশ পরিকল্পিতভাবেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে’। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামায় বাংলাদেশ ও ভারতের হিন্দুত্ববাদী শক্তি তৎপর। এই বিপদ মোকাবিলা শুধু মুখে নিজেকে অসাম্প্রদায়িক দাবি করার মধ্যে কুলাবে না। বাংলাদেশে হিন্দু প্রশ্ন মীমাংসার সঙ্গে কিভাবে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের মধ্যে পরিগঠিত উপমহাদেশের নব্য হিন্দুত্ববাদ ও আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদী উপশক্তি হিসাবে দিল্লীর উত্থান ও রক্তাক্ত আগ্রাসনের প্রশ্ন জড়িত তার বিবেচনা ও মীমাংসা এ কারণেই জরুরী। সে কারনে সাম্প্রদায়িকতা মানে কি, প্রকৃত সংখ্যালঘু কারা এই সকল প্রশ্ন স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন ভাবে তুলে বদরুদ্দিন উমর বাস্তবোচিত ও অগ্রসর চিন্তার নজির রাখলেন। তাঁর লেখার আন্তরিক ও ঘনিষ্ট পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশে হিন্দু প্রশ্নের মীমাংসাকে য়ারেকটি গুণগত পর্যালোচনা স্তরে উন্নীত করতে পারি। কিন্তু যেসব বামপন্থী – এমনকি যারা এককালে তাঁর অনুসারী ছিল তারা তাঁর লেখার প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করতে গিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল সমালোচনার অধিক কিছু করতে সক্ষম হন নি।

নদিতে বাঁধ দিয়ে ও পানি সরিয়ে বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারার নীতি, ইসলামি জঙ্গি মোকাবিলার নামে দিল্লী ও পাশ্চাত্য শক্তি যেভাবে ক্ষমতাসীনদের দ্বারা বাংলাদেশে একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরী করে রেখেছে তার কুফল পুরা উপমহাদেশে ছড়াবে। বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের সেই যুদ্ধের উপাদান ও দাহ্য পদার্থ হিসাবে ব্যবহারের পরিণতি শুভ হতে পারে না। অনিবার্য পরিণতি হিসাবে চিরতরে বাংলাদেশের জনগণকে দিল্লীর পদানত রাখার পরিকল্পনা কাজ করবে বলা যায় না, কিন্তু উপমহাদেশকে প্রবল অস্থিতিশীলতার দিকেই দিল্লী ঠেলে দিচ্ছে। ভারতে নিশ্চয়ই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষের অভাব নাই। তাঁরা আশা করি এই সকল বিষয়ে ভাববেন। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের সচেতন ও সজ্ঞান মানুষদের অবিলম্বে সচেতন হয়ে ওঠা জরুরী। এই সকল বাস্তবতা শুধু বাংলাদেশ নয় পুরা উপমহাদেশের জন্যই ভয়ংকর বিপদ তৈরী করেছে।

মধ্য প্রাচ্যের সহিংসতা, যুদ্ধবিগ্রহের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে যে বিপদ ত্বরান্বিত করবার জন্য দিল্লী ও বিজেপি তৎপর তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার তাগিদ থেকেই বদরুদ্দিন উমর প্রশ্নগুলো তুলেছেন। এখানেই তাঁর লেখার গুরুত্ব।

১৭ জুন ২০১৬। ৩ আষাঢ় ১৪২৩। শ্যামলী।

(যুগান্তর ১৮ জুন, ২০১৬)

----

[১] বদরুদ্দিন উমরের সাম্প্রতিক লেখাগুলোর লিঙ্ক: ‘এটা কি সাম্প্রদায়িকতা?’, লিখেছেন ২৫ মে ২০১৪ সালে, যুগান্তরে; দ্বিতীয় লেখাটি হচ্ছে, ‘বাংলাদেশে প্রকৃত সংখ্যালঘু কারা?’ ।  ৪ আগস্ট ২০১৩ তারিখে যুগান্তরে ছাপা হয়েছে ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ফ্যাসিবাদী হামলারই এক নগ্ন রূপ’


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।