রামপাল বন্ধ হোক, কিন্তু রূপপুর? অথবা শেখ হাসিনা আল গোর বিতর্ক


ধরুন, আপনি জানেন আপনি মন্দ কাজ করছেন। তখন কি আপনি ধর্মের কাহিনী শুনবেন? ভাল কাজে স্বর্গবাস, মন্দ কাজে দোজখ – এই সকল কেচ্ছা শুনে আপনার কি লাভ? আপনি রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র করবেন তো করবেনই, তো এতে বাঘ মরল কি গণ্ডার পুড়ল – আপনি কি শুনবেন? না, শুনবেন না।

দাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামে ক্লাইমেট চেইঞ্জের ‘পাদ্রি’ আল গোর শেখ হাসিনাকে ধর্মকথা শোনাতে চেয়েছিলেন। শেখ হাসিনা শুনলেন না। মুখের ওপর বলে দিলেন, ‘আমি বুঝতে পারি না কয়লা বিদ্যুত প্রকল্প নিয়ে কেন মানুষ কথা বলে ... আমার মনে হয় যারা রামপালে বিরোধিতা করছেন তাদের মানুষের প্রতি দরদ নাই, বরং তারা সুন্দরবন ও রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়েই বেশী উদ্বিগ্ন’। মানুষের প্রতি দরদ? আল গোর আইনবহির্ভূত হত্যাকান্ড, গুম খুন, হেফাজতে মৃত্যু ইত্যাদি নিয়ে লেকচার দিতে পারতেন, তবে তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেকর্ড এতোই খারাপ যে কিছু বলার সুযোগ ছিল না।

বিল ক্লিন্টন যখন প্রেসিডেন্ট আল গোর তখন মার্কিন মুল্লুকের ৪৫ নাম্বার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি কর্পোরেট মার্কিন সাম্রাজ্যও চান আবার আকাশ ফুটা করা গ্রিন হাউসের ক্ষতিও রোধ করতে চান। আসমান ফুটা হওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেন বলে আল গোরের পরিবেশ বান্ধব ভাবমূর্তি আছে। মার্কিন মূলধারার রাজনীতির অধীনে থেকে যতোটুকু সম্ভব পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে আল গোর কথা বলেন, কাজ করেন, তাকে খাটো ভাবে দেখা ঠিক না। একসময় তিনি ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইন্সটিটিউটের বোর্ড অফ ডিরেক্টর্সে ছিলেন; এখন নিজের প্রতিষ্ঠিত ‘এলায়েন্স ফর ক্লাইমেট প্রটেকশান’-এর প্রধান। জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে কাজের স্বীকৃতি হিসাবে ২০০৭ সালে ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ-এর সঙ্গে নোবেল পুরষ্কারও পেয়েছিলেন। ফলে তার মুখের ওপর কথা বলে আসা খুব চাট্টিখানি কথা নয়।

দাভোসের কংগ্রেস সেন্টারে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘লিডিং দ্য ফাইট অ্যাগেইনস্ট ক্লাইমেট চেঞ্জ’ শিরোনামের প্লেনারি সেশনে পাশাপাশি বসা দুই জনের বক্তব্য উপভোগ করেছি। কে ঠিক কে বেঠিক সেই তর্ক এখানে অবান্তর। যুক্তিতে নয়, দুইজনেরই উদ্দেশ্য ছিল নিজেকে উচ্চ স্তরের নীতিবান প্রমাণ করে প্রতিপক্ষের তুলনায় নিজ নিজ শ্রোতাদের অধিক প্রশংসা আদায় করা। একজন পরিবেশবাদী, অপরজন উন্নয়নবাদী। আফটার অল, দুজনেই রাজনীতিবিদ, তাদের নিজ নিজ কন্সটিটিউন্সির সমর্থন মজবুত করাই তাদের উদ্দেশ্য হবে তাতে অবাক হবার কিছু নাই। শেষাবধি তর্কে পরিবেশ ও উন্নয়নের বিরোধটাই আরও প্রকট হয়ে উঠল। এই লেখার উদ্দেশ্য এই প্রকটতার চরিত্রটি বোঝার চেষ্টা করা।

আল গোর কিছু তথ্য দিয়েছেন যা কমবেশী আমাদের জানা। তার মুখ থেকে শোনার অর্থ হচ্ছে সারা বিশ্বে বিষয়গুলো নিয়ে কথা হচ্ছে; এটা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত সৌরশক্তির প্যানেল স্থাপনকারী দেশ ছিল। আল গোর বলেছেন, তার গতি এখন ধীর হয়ে গেছে। তার মানে বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে বাংলাদেশ ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তা থামিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করতে চাইছে। তিনি শেখ হাসিনাকে বলেছেন, “আমার পরামর্শ হলো, পরিবেশ দূষণকারী ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ বন্ধ করুন। এর পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের হার দ্রুত করতে দ্বিগুণ উদ্যোগে কাজ শুরু করুন; ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে মুহাম্মদ ইউনূসের সংগঠনসহ বাংলাদেশের অন্যান্য বেসরকারি সংস্থা নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে”।

দেখা যাচ্ছে আল গোর শুধু নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের জন্য মন্তব্য করেন নি। তাঁর দাবি, সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প দ্রুত গতিতে স্থাপিত হওয়ার কৃতিত্ব ক্ষুদ্র ঋণ ওয়ালাদের, বিশেষত গ্রামীন ব্যাংকের। আমরা জানি ডেমক্রেটরা ডক্টর ইউনুসের বন্ধু বা মিত্র। অতএব আল গোরের কথায় অবাক হবার কিছু নাই। কিন্তু আল গোর সৌর বিদ্যুতের জন্য ফটোভল্টাইক প্যানেল চাইছেন ব্যাপারটা এতো সিধা সরল না। তিনি চান ক্ষুদ্র ঋণ। তার পরামর্শ হোল সৌর প্যানেল স্থাপন ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে এনজিওদের সহায়তায় হোক। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ঋণ আর এনজিওদের দিয়ে বিদ্যুতের অভাব পূরণ করুক। রামপাল না, বাংলাদেশ বিদ্যুত সংকটের সমাধান করুক, ক্ষুদ্রৃণোয়ালাদের মাধ্যমে সলার প্যানেল বসিয়ে। সেটাই আল গোর চাইছেন। দারুন পরামর্শ!

রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রের যারা বিরোধী তারা শেখ হাসিনার বিপরীতে আল গোরকে পেয়ে যে মাত্রায় খুশি আমি সেই মাত্রায় খুশি হবার কোন কারন দেখি নি। এই জন্য নয় যে আল গোর ভুল বলছেন, কিম্বা অযৌক্তিক কিছু বলছেন, কিন্তু তিনি আংশিক বলেছেন। পুঁজিতান্ত্রিক ভোগী জীবনব্যবস্থার সঙ্গে প্রকৃতি ও প্রাণের বিনাশের অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ রয়েছে। হয়ত অতি ভোগের কথা আল গোর বলেন, আমি তার লেখার সনিষ্ঠ পাঠক, দ্রটা দুই এক জায়গায় দেখেছি। কিন্ত ভোগী জীবনের সঙ্গে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের সম্বন্ধ বিচার করবার মানুষ আল গোর নন। সেটা বলাই বাহুল্য। রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিতা বাঘ আর সুন্দরবন বাঁচাবার বিরোধিতা, বড়জোর একটি বিশেষ ধরনের টেকনলজির বিরূপ সমালোচনা। কিন্তু খোদ ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল জীবনব্যবস্থাই তো গড়ে উঠেছে কয়লা জ্বালানির ওপর ভিত্তি করে। তার বেলা? তাহলে এই জীবাশ্মভিত্তিক তথাকথিত সভ্যতার সমালোচনা ও পর্যালোচনা ছাড়া বাঘ আর সুন্দরি গাছের জন্য আন্দোলন প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষার রাজনীতি নয়। যে কারনে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন শহুরে রোমান্টিসিজমের অধিক অগ্রসর হতে পারে নি, এর পক্ষে সারা দেশের মানুষের সমর্থন পাবার সমস্ত শর্ত থাকলেও এর সঙ্গে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত। এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সিপিবি ও বামপন্থি দলগুলোর আন্দোলন। যারা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছেন এই গুরুত্বপূর্ণ লড়াইকে তারা বাংলাদেশের প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষার সামগ্রিক স্তরে নিতে পারেন নি। ইস্যুর চেয়ে এখানে সংকীর্ণ রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রবল। আন্দোলনের মধ্যে আওয়ামি লীগ পন্থি বামদের আধিপত্য প্রবল। বিএনপি এই আন্দোলনে সমর্থন জানালেও সেই সমর্থনকে আন্দোলনকারীরা ভাল ভাবে নেয় নি, একে উল্টা দায় মনে করেছে। বিএনপি ও তার সমর্থক জোটের প্রতি কঠোর সমালোচনা বজায় রেখেও এই ধরণের জাতীয় ইস্যুতে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই হোত সঠিক কৌশল। এখন দেখছি আন্দোলনকারীরা আওয়ামি লীগের সমর্থন চাইছেন। ফলে তাদের আওয়ামি প্রীতিটাই শেষমেষ আরও প্রকট হয়ে উঠল।

এই আন্দোলনের আরেকটি সমালোচনা আমি এর আগে আমার লেখায় করেছি। এটা খালি বাঘ বাঁচাও সুন্দরবন বাঁচাও মার্কা আন্দোলন না। এটা দিল্লি-ঢাকা অশুভ আঞ্চলিক আগ্রাসী আঁতাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। শেখ হাসিনা যখন ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতে গিয়েছিলেন তখন দিল্লির সঙ্গে যে যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছেন রামপাল প্রকল্প তারই অন্তর্গত। এটা নিছকই বিদ্যুত উৎপাদন বা উন্নয়ন প্রকল্প নয়, দিল্লির আগ্রাসী রাজনৈতিক প্রকল্পেরই অংশ। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এর জন্য ভারতের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট (এক্সিম) ব্যাংক ১৬০ কোটি ডলার দিচ্ছে। অদ্ভূত ব্যাপার হোল এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫০ শতাংশ মালিকানা দুই দেশের হলেও ঋণের পুরোটা দায়ভার থাকবে বাংলাদেশের ওপর।

লোকসান হলে বা কোনো কারণে মাঝপথে প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে কিংবা কিস্তির অর্থ দিতে ব্যর্থ হলে ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব ষোল আনা বাংলাদেশের। বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) বা বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী বিদ্যুৎ কোম্পানি এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কোম্পানির ৫০ শতাংশ করে মালিক বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) এবং ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিসি) লিমিটেড। এ প্রকল্প থেকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ শুধু মুনাফার অর্ধেকই পাবে না; পাশাপাশি ঠিকাদারি কাজ, কয়লার সরবরাহ ব্যবসা—সবই তারা পাবে। সুন্দরবন এখন ধ্বংস হচ্ছে না, চকরিয়া সুন্দরবন ধ্বংস হয়েছে অনেক আগেই। এই আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তু শুধু বাঘ আর সুন্দরী গাছ না এর মর্ম ভারতীয় আগ্রাসন ও অসম বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে ভারতীয় মুনাফা কামানো। পাশাপাশি সুন্দ্রবন্সহ পুরা এলাকার ওপর ভারতীয় নজরদারী বৃদ্ধি, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। যারা এখন রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন তাদের মধ্যে অনেকে আছেন, যারা ক্ষমতাসীন সরকারের নীতির সমর্থক কিম্বা ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক বলয়ের অন্তর্গত, বাইরের কেউ নয় । দিল্লির প্রশ্নে তাদের কণ্ঠ নীচু খাদে নেমে গিয়ে প্রায় নিঃশব্দ হয়ে যায়।

ইত্যাদি কারনে বাঘ আর সুন্দরবন বাঁচানো পেটি বুর্জোয়া রোমান্টিকতার অধিক কিছু নয়। ভারতীয় আফ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া রোমান্টিকতার পর্যালোচনা আমাদের আবেগ, কল্পনা রোমান্টিকতাকে নিন্দা করবার জন্য নয়, বরং আন্দোলনের বর্তমান পর্ব অতিক্রম করে আন্দোলনকে বেগবান করবার জন্য। আমি তাই আন্দোলনকে নিঃশর্ত ভাবেই সমর্থন করি, যাতে লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সামগ্রিকতার প্রশ্নগুলো আমরা তুলতে পারি এবং প্রাণ ও প্রকৃতির প্রশ্নে গণমানুষের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা ক্রমে ক্রমে পরিস্ফূট হতে পারে।

রামপাল বন্ধ করুন (রূপপুর থাকুক!!)

সংক্ষেপে হলেও আল গোর জাতীয় পরিবেশ সচেতনতা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। যাতে পাশ্চাত্যের পরিবেশ চিন্তার সঙ্গে মৈত্রী ও বিরোধ উভয় দিকটাই খেয়ালে রাখা সম্ভব হয়। খেয়াল করতে হবে, দাভোসে শেখ হাসিনার সঙ্গে বিতর্কের সময় আল গোর একবারও রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা বলেন নি। কেন? যিনি রামপাল নিয়ে উদ্বিগ্ন, তিনি রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প সম্পর্কে নিশ্চুপ। এ কেমন কথা?


দাভোসে পরিবেশবাদ বনাম উন্নয়নবাদ বিতর্ক


পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের প্রস্তাবটা পুরানা। তবে সম্প্রতি ২০০৯ সালের বাংলাদেশ সরকার আবার রাশিয়ার সাথে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের কথাবার্তা শুরু করে আর একই বছরের ১৩ই ফেব্রুয়ারি দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক বা MOU (Memorendum of Understanding) সই করে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য ২০১০ সালের ২১ মে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ ও রাশিয়ান ফেডারেশনের মধ্যে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার বিষয়ক একটি Framework চুক্তি মস্কোতে সই করেছে। এরই ফল হচ্ছে ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫ সালে পাবনার রূপপুরে দুই হাজার চারশ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার জন্য রাশিয়ার এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই করা। চুক্তি বাস্তবায়নের সময়কাল ধরা হয়েছে সাত বছর। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ২০২৩ সালে প্রথম ইউনিট এবং ২০২৪ সালের অক্টোবরে দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদনে সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মেয়াদকাল হবে ষাট বছর।

নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের প্রথম প্রস্তাব করা হয় ১৯৬১ সালে পাকিস্তান আমলে। ইসলামি পারমাণবিক শক্তি বৃদ্ধির প্রকল্প হিসাবে। এ সময় সরকার ২৫৩ দশমিক ৯০ একর জমি বরাদ্দ দেয়। ১৯৬৪ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য যন্ত্রপাতি বাংলাদেশের উদ্দেশে জাহাজে করে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেই জাহাজ আর সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে আসে নি। চট্টগ্রাম বন্দরে না ভিড়ে জাহাজ করাচিতে ভিড়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিষয়ে আলোচনা হলেও কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি। তো ইসলামি প্রকল্পই এখন রুশ প্রকল্প হয়ে ভোল বদলে ফিরে এসেছে।

যেখানে সারা পৃথিবীতে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের বিরোধিতা চলছে সেই ক্ষেত্রে আল গোর সুন্দরী গাছ আর বেঙ্গল টাইগারের জন্য যতোটা উদ্বিগ্ন, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের বিপর্যয়ে বাংলাদেশের জনগণের সমূহ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা নিয়ে মোটেও বিচলিত নন। কেন? না, অবাক হওয়ার কিছু নাই। তিনি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পক্ষের লোক। তাঁর একটি বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি। তিনি বলছেন, “আমি যদিও নিউক্লিয়ার পাওয়ারের বিরোধী না, এবং পারমানবিক শক্তির ব্যবহার কিছুটা বাড়ুক সেটা আমার প্রত্যাশা, কিন্তু প্রায় সব দেশেই পারমাণবিক শক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, আমার তাতে সংশয় আছে”। ( While I am not opposed to nuclear power and expect to see some modest increased use of nuclear reactors, I doubt that they will play a significant role in most countries as a new source of electricity – ‘A planetary Emergency’ by Al Gore 18 September 2016)

পারমানবিক শক্তি কেন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে না সেটা টেকনলজি বা মানবিক বিপর্যয়ের ভয়াবহতা নয়। আল গোরের কাছে সেটা একান্তই বিপুল খরচের সমস্যা। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট খুবই ব্যয়সাপেক্ষ বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। সব দেশের পক্ষে তার যোগান সম্ভব নয়। সে কারনেই তিনি এর ব্যবহার সীমিত হবে বলে মনে করেন। ( দেখুন, ‘Al Gore: nuclear power will play 'limited role' in future energy mix’)। আল গোরের বাবা সেনেটর আল গোর, সিনিয়র ‘জয়েন্ট কমিটি অন এটমিক এনার্জি’র সদস্য ছিলেন। একবার তিনি একটা বিল পাশ করতে চেয়েছিল সেখান তাঁর প্রস্তাব ছিল এটমিক এনার্জি কমিশন বেশ কয়েকটি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করুক, যাতে বিনিয়োগকারীরা এই টেকনলজির বাণিজ্যিক সম্ভাবনার প্রতি আগ্রহী হয়। তিনি টেনেসির সিনেটর ছিলেন। টেনেসি ব্যালি অথরিটিকে নিউক্লিয়ার প্লান্ট স্থাপন করবার ক্ষেত্রে তার অবদান রয়েছে।

শেখ হাসিনাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করবার কোন পরামর্শ দেন নি।ীটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এখন রামপালের ব্যাপারে তাঁর পরামর্শকে আপনি কতোটা সিরিয়াসলি নেবেন, সেটা আপনার ব্যাপার। তিনি বলছেন, “বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (বাদাবন), বেঙ্গল টাইগারের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল সুন্দরবনে পরিবেশ দূষণকারী একটি নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। হাজার হাজার মানুষ এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে। আমার পরামর্শ হলো, পরিবেশ দূষণকারী ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ বন্ধ করুন। এর পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের হার দ্রুত করতে দ্বিগুণ উদ্যোগে কাজ শুরু করুন” । আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের হার বাড়াতে হবে, এতে কোন সন্দেহ নাই। তবে শুধু রামপাল নয়, আরও সর্বনাশ ও বিপর্যয়ের সম্ভাবনাপূর্ণ রূপপুর আণবিক প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রাণ ও প্রকৃতিবাদীদের দাঁড়াতে হবে। এর অন্যথা হবার সুযোগ নাই।

পরিবেশবাদ বনাম উন্নয়নবাদ

বলছিলাম, পরিবেশবাদ ও উন্নয়নবাদ – আমরা এই দুইয়ের একটা আন্তর্জাতিক মহড়া দেখলাম। কোন পক্ষই জীবাশ্ম ভিত্তিক সভ্যতা কিম্বা আধুনিক ভোগী জীবনের বিরুদ্ধে কিছু বলেন নি। কেউই এর বিরুদ্ধে নন। পাশ্চাত্য দেশগুলোর অতি ভোগই যে আসমান ফুটা হবার কারন এটা এখন অস্বীকার করা কঠিন। কিন্তু ভোগ বা ভোগী হচ্ছে পুরা ভোগী ব্যবস্থার প্রান্তসীমার ব্যাক্তি। তাহলে ভোগীকে যখন আমরা দোষারোপ করি তখন আসলে পুরা ব্যবস্থাকে নজরের আড়ালে নিয়ে যাই, ব্যবস্থাকে রক্ষা করবার জন্য। যাতে মুনাফালোভী কর্পোরেশানের স্বার্থ কিম্বা বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কমবেশী অক্ষত রেখে বিজিনেস এজ ইউজুয়াল চলতে পারে। শেখ হাসিনা কিম্বা আল গোরের মধ্যে ব্যবস্থার প্রতি এমন কোন আপত্তি নাই যার কারনে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাঠামোগত সংকটের পর্যালোচনা করতে তারা তাগিদ বোধ করেন।

তাহলে আল গোরের পরিবেশবাদের বিপরীতে উন্নয়নবাদ কী জিনিস! সেটা হোল এই দাবি যে ‘আমাদের জনগণের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করতেই হবে। আমাদের দেশের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে আমরা কী করে জনগণকে বাঁচাতে পারব।’ অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাইলে প্রাণ ও প্রকৃতির ক্ষতি ঘটাতেই হবে। অথচ এর কোন যুক্তি নাই। আল গোরের পরিবেশবাদ পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংস্কার চায়, কৃৎকৌশলের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে চায়। হতে পারে পারমাণবিক বিদ্যুৎ এখন ঝুঁকি পূর্ণ, কিন্তু বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের বিকাশ এই ঝুঁকি সামলাতে বা অতিক্রম করতে সক্ষম, এটা আল গোর বিশ্বাস করেন। পুঁজিতান্ত্রিক ভোগী ব্যবস্থার যে মুশকিল সেটা সরকার ও রাষ্ট্রের নীতি ও নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে প্রশমিত করা সম্ভব – এটাও আল গোরের রাজনীতি। যে কারনে উদার ডেমক্রাটদের একটা বড় অংশ তার সমর্থক। কিন্তু এখানে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অস্পষ্ট। এখানেই উন্নয়নবাদ সংস্কারমুখী পরিবেশ চেতনার কাছে হেরে যায়।

আল গোরের মন্তব্যের জবাবে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিশ্বের সব জায়গাতেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। আমরা এটা সুন্দরবন থেকে অনেক অনেক দূরে নির্মাণ করছি। শুধু তা-ই নয়, পরিবেশ যাতে আক্রান্ত না হয়, সে জন্য আমরা সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সুপার ক্রিটিক্যাল, খুবই আধুনিক। পরিবেশ রক্ষায় আমরা সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছি।’

দিনাজপুরে বড়পুকুরিয়ায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, তাঁর সরকার ২০০০ সালে বড়পুকুরিয়ায় একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে। সেখানে দুটি ‘সাব-ক্রিটিক্যাল’ প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হয়েছে এবং বর্তমানে তৃতীয় একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু ঘনবসতিপূর্ণ এই জেলায় পরিবেশের ওপর নেতিবাচক কোনো প্রভাব পড়েনি। তিনি দাবি করেছেন, সেখানে ফসল হচ্ছে, প্রচুর গাছপালা রয়েছে, এমনকি খুব ভালো আমের ফলনও হয়। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় নির্মিত এই কেন্দ্র নিয়ে কেউ কিছু বলেনি। কিন্তু এখন সুন্দরবন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বলাবাহুল্য, এটা এগুলো নিছকই রাজনৈতিক মত। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার আগে এলাকায় পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে নিরপেক্ষ গবেষণা দরকার, তথ্যের প্রয়োজন। সেখানকার মানুষের অভিযোগ ও কষ্টের কথা প্রধান মন্ত্রী দেখছেন না। সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র তার চেয়েও বেশি আত্মঘাতী হবে। সুন্দরবন ধ্বংস হলে শুধু রয়েল বেঙ্গল টাইগার নয়, সারা বাংলাদেশই নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উপকূলীয় গরান বনের বেষ্টনীর প্রভাব পুরা ভূখণ্ড জুড়েই বিস্তৃত। কোথায় কিভাবে পরিবেশের ক্ষতি হয় সেটা কিলোমিটার দিয়ে মাপা যায় না। সুন্দরবন ধ্বংস হলে সারা দেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঠিক যেমন চকোরিয়া সুন্দরবনের বিনাশ ক্ষতি করেছে।

পরিবেশ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি সম্পর্কে একটি মন্তব্য দিয়ে শেষ করব। ধরিত্রী সম্মেলন হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। সেই সময় অতি ভোগী দেশ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুমুল সমালোচনা চলছিলো। সেই সময় সমালোচকদের জবাবে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিও বুশ বলেছিলেন, ‘মার্কিনীদের জীবনযাপন নিয়ে কোন দরকষাকষি চলবে না, ব্যস!’। ‘The American way of life is not up for negotiations. Period.’ অর্থাৎ মার্কিনীদের অতিভোগ আসমান ফুটা করে দিলেও তাদের জীবন যাপন নিয়ে কেউ কিছু করতে পারবে না মার্কিনীদের এই হুংকার বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদীদের সমালোচনার মুখে পড়েছিল। এই অবস্থা খুব একটা বদলায় নি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কালে এই দৃষ্টিভঙ্গী আরও তীব্র হবে, এটা আন্দাজ করা যায়।

প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষার আন্দোলন যারা করছেন তাদের দেশের ভেতরে ও বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই লম্বা লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধ্বে লড়াই সফল হোক।

২০ জানুয়ারি ২০১৭। শ্যামলী।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।