ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বহুজাতিক কর্পোরেশান


মার্কিন নির্বাচনী ব্যবস্থার নিয়মেই ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে বিজয় লাভ করেছেন। তিনি কোন কারচুপি করেন নি। গণতান্ত্রিক ভাবেই, এমনকি বিরূপ গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জয়ী হয়েছেন। বলা হচ্ছে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে যোগ্য ব্যক্তি নন। এমনকি তাকে পাগল প্রমাণ করবারও চেষ্টা চলছে। কয়েকজন সাইকোলজিস্টের বরাতে বলা হয়েছে তাঁর আচরণের মধ্য দিয়ে নাকি প্রমাণিত হচ্ছে তিনি মানসিক ভাবে অসুস্থ। এগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির আভ্যন্তরীণ খেয়োখেয়ির গল্প। দিল্লি কা লাড্ডু। আপনি খেলে পস্তাবেন, না খেলে মজা লস করবেন।

আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নই, এবং আমরা মার্কিন নাগরিকও নই। মার্কিন দেশের রাজনীতির আভ্যন্তরীণ খেয়োখেয়ির প্রতি নজর রাখার দরকার আছে, কিন্তু অতি উৎসাহিত হবার কোন যুক্তি নাই। ভাববার কোন কারন নাই যে হিলারি ক্লিনটন এলে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির বিশেষ হেরফের হোত। যারা ভাবেন হিলারি ক্লিনটন এলে ডক্টর ইউনুসের বন্ধু বলে শেখ হাসিনাকে কষে শায়েস্তা করবেন, বোঝা যায় তাঁরা মুড়ি খেতে খেতে গালগল্প করতে ভালবাসেন। রাজনীতি – বিশেষত বিশ্ব রাজনীতি এতো পান্তাভাত না।

তাছাড়া ট্রাম্পের বিপরীতে হিলারিকে পছন্দ করবার কোন কারন নাই। যুদ্ধবাজ হিসাবে হিলারির কুখ্যাতি আছে, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ও হত্যাযজ্ঞের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা রয়েছে। বারাক ওবামার আমলেও ড্রোন হামলায় নিরীহ নারীপুরুষ হত্যার সংখ্যা কম নয়। তাঁর আমলেই আইসিসের উত্থান ঘটেছে এবং সিরিয়া কেন্দ্র করে যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বিচার করতে গেলে নানান দিক থেকে বিচার করতে হবে। সামগ্রিক ভাবে বিচার করবার সামর্থ অর্জন করা দরকার। কালো মানুষ হিসাবে বারাক ওবামাকে মার্কিন দেশের কৃষ্ণাঙ্গদের লড়াই-সংগ্রামের আলোকে আমরা দেখি, সেটা অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু ভুলে যাই তিনি কালোদের নেতা নন, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। হিলারি ক্লিনটনকে যতোই নারী বলে মনে রাখি না কেন ইনি একই সঙ্গে যুদ্ধবাজ, ইসরাইল বান্ধব এবং মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার পক্ষপাতী। ডোনাল্ড ট্রাম্প ভিন্ন হবেন এটা দাবি করছি না, কিন্তু হিলারির প্রতি আমাদের বিশেষ পক্ষপাতের কারন আছে বলে মনে করার কারন নাই। এতোটুকুই শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছি।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ে গরিব ও পুঁজির প্রান্তসীমার দেশগুলোর কি হাল হতে পারে সেটাই আমাদের জন্য বাস্তবসম্মত প্রশ্ন হতে পারে। ট্রাম্পের প্রতি আমাদের বিশেষ ভালবাসা থাকার কথা নয়, বাংলাদেশে বিশ্বপুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রান্ত সীমার একটি দেশ। ট্রাম্পের ইসলাম বিদ্বেষ এবং ক্ষমতায় আসার পরপরই সাতটি মুসলিম প্রধান দেশ থেকে অভিবাসীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা ট্রাম্পের প্রতি আমাদের নজর আরও ঘনিষ্ঠ করতে বাধ্য করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যারা লিবারেল বা উদার রাজনৈতিক রীতিনীতি পছন্দ করেন তারা ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি নিয়ে ক্ষুব্ধ। এর আড়ালে অনেকে আছেন যারা বিশ্বব্যবস্থার বৈপ্লবিক রূপান্তর চান। পুঁজি ও পণ্য যদি অবাধে চলাচল করতে পারে তাহলে মানুষের আসাযাওয়ার ওপর রাষ্ট্রগুলো বাধা দেয় কেন? এটা র‍্যাডিকেলদের একটি পুরানা তর্ক। বাধা দেবার মধ্য দিয়ে একালের আধুনিক রাষ্ট্রের চরিত্র আমরা কিছুটা হদিস করতে পারি।

পুঁজির সস্তা শ্রমিক দরকার, ফলে অভিবাসন অনিবার্য। কিন্তু তাহলে বাধা কেন? কারা বাধা দিচ্ছে? পুরা ব্যবস্থার চরিত্রের দিকে নজর ফেরাবার জন্যই র‍্যাডিকেল এই প্রশ্ন। কিন্তু এই র‍্যাডিকেল চিন্তা উদারবাদী রাজনীতির আড়ালে ক্ষীণ হয়ে আছে বটে, সামনের সারিতে আমার উদারবাদীদেরই দেখছি। তারা আইনী প্রক্রিয়ায়া অভিবাসী ও শরণার্থীদের মার্কিন দেশে প্রবেশের আন্তর্জাতিক অধিকারের পক্ষে। কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার রূপান্তর তাদের বিক্ষোভের প্রণোদনা নয়। তবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ দেখছি তা হচ্ছে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের অন্তর্গত দ্বন্দ্বের প্রকাশ মাত্র। সামগ্রিক ভাবে বিশ্ব অর্থব্যবস্থায় ব্যাংক ও অল্প কয়েকটি বহুজাতিক কর্পোরেশানের আধিপত্যে পুরানা উদার রাজনীতিকে খাদায় ঠেলে দিচ্ছে। খাপে মিলছে না। অসঙ্গতি প্রকট হয়ে উঠছে। খোদ ব্যবস্থার এটা মীমাংসা নয়। এতে আমাদের অতি উৎসাহিত হবার কিছু নাই।

কিন্তু লিবারেলিজম মার্কিন সমাজের বর্ণবাদ এবং যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের ওপর লিপস্টিক মাখে। তারচেয়ে খোলামেলা ডোনাল্ড ট্রাম্প আমাদের জন্য খারাপ না। তাঁর দক্ষিণপন্থি চিন্তা মার্কিন লিবারেল বা উদারবাদীদের দুশ্চিন্তার কারন বটে, কিন্তু একই সঙ্গে সেটা পঁচে যাওয়া লিবারেলিজম সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে। আমাদের প্রথাগত অনুমানগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সমাজ সংস্কৃতি রাষ্ট্র বিশ্বব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। সে কারণে মার্কিন দেশে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা অর্জন সম্প্রতিকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ধর্ম, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এই ‘বিজয়’ গুরুত্বপূর্ণ মেরুকরন ও পরিবর্তনের সূচনা।

পরিস্থিতি বদলাচ্ছে

ট্রাম্প জিতলে দ্রুত কিছু পরিবর্তন ত্বরান্বিত হবে যারা বলেছিলেন তাদের ট্রাম্প আশাহত করেন নি। তিনি প্রেসিডেন্ট গদিতে বসবার এক সপ্তাহের মধ্যেই একটা মেমরেন্ডামে স্বাক্ষর দিয়েছেন যাতে Trans-Pacific Partnership চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিযুক্ত হয়। ব্রেক্সিটের পর বিলাতের সঙ্গে মার্কিনীদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক কি হতে পারে সে বিষয়ে ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী থেরেসা মে-র সঙ্গে তিনি ইতোমধ্যেই কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছেন। জাতিসংঘে তার নতুন দূত নিকি হালি ইতোমধ্যেই জাতিসংঘের সংস্কারের কথা বলেছেন। সবাইকে এই বলে শাসিয়েছেন যে যারা আমাদের পেছনে নাই আমরা তাদের নাম টুকে নিচ্ছি। সেই পুরানা বুশীয় হুমকি ধামকি! তোমরা হয় আমাগো লগে নইলে আমাগো দুষমনদের খাতায় – মাঝখানে কোন অলিগলি নাই। তো এইসব গরম গরম ঘটনা ঠাণ্ডা হবার আগেই তিনি আরেকটি বোমা ছুঁড়লেন। মার্কিন দেশে মুসলমান প্রবেশ করতে পারবে না। সাতটি দেশের নামও তার নিষিদ্ধ তালিকায় রেখেছেন। এইসব দেশে বোমা মেরে যুদ্ধে লক্ষ ক্ষ মানুষ হত্যা করা, ড্রোন উড়িয়ে আকাশ থেকে গুলি বোমা চালিয়ে নিরীহ মানুষ খুন এবং বিপুল শরণার্থী সংকট তৈরি করেছে মার্কিনীরাই। এতে দুনিয়া জুড়ে সমালোচনা চলছে। মার্কিন এয়ারপোর্টে বৈধ ভিসা বা গ্রিনকার্ড ওয়ালাদের মার্কিন ইমিগ্রেশান ঢুকতে না দেওয়ায় বিক্ষোভ হচ্ছে। সমালোচনার মুখে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সাফাই গাইতে হচ্ছে। এই নির্বাহী আদেশ, মার্কিনী পরিভাষায় ‘এক্সট্রিম ভেটিং’ বলে পরিচিত। তবে ফেডারেল কোর্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই নির্বাহী আদেশ স্থগিত রেখেছে।

বলতে চাইছি, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গালি দেওয়া সহজ। কিন্তু বিশ্বব্যবস্থার এই নয়া সিম্পটম বোঝা ততো সহজ নয়। সেটা বুঝতে হলে পুরা ব্যবস্থাকে বোঝার দরকার পড়ে। সেটা গবেষণার বিষয় বটে। তবে এতোটুকুই আপাতত বলা যে পুঁজির প্রান্তের দেশে বসে হলেও এই সিম্পটম নিয়ে বিস্তর গবেষণার দরকার আছে। ট্রাম্প মার্কিন দেশে হাওয়া খেয়ে জয়ী হয়ে আসেন নি, তার সমর্থক আছে। তারা কম নয়। তাদের শক্তিও কম নয়। ট্রাম্প বিশ্বে রসিকতা করবার জন্য হাজির হন নি। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা আছে বলে আমাদের বোঝা উচিত মার্কিন গণমাধ্যম ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যেসব প্রচার প্রপাগান্ডা চালায় তাকে বাছবিচার করেই আমাদের বুঝতে হবে। তাদের ভূমিকাও বাংলাদেশের গণমাধ্যমের তুলনায় বিশেষ ভিন্ন নয়। ট্রাম্প মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার দোস্তালি পান নি, তাকে সোশাল মিডিয়ার ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। ট্রাম্পের বিজয় একদিক থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তি সম্পর্কেও আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। ট্রাম্প একে সফল ভাবেই ব্যবহার করেছেন।

কথাগুলো বলা দরকার এ কারনে যে প্রপাগান্ডা বা বাহ্যিক খবরাখবরের বাইরে অনেক তথ্য ও সত্য আছে যা নির্মোহ গবেষণা করেই খুঁজে বের করা দরকার। ট্রাম্পের বর্ণবাদী সিদ্ধান্ত, নারী অধিকার বিরোধিতা, মুসলিম বিদ্বেষ কিম্বা মার্কিন সংবিধান বিরোধী অবস্থানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের নিজস্ব রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। কে সঠিক কি বেঠিক সেই বিচার সাময়িক লড়াইয়ের দিক থেকে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যেদিকে বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া দরকার সেটা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং তার সঙ্গে বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব ও মিলের জায়গাগুলোর প্রতি। বিশ্ব ব্যবস্থার সিম্পটম হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বুঝতে হলে বিশ্বব্যবস্থা কোথায় যাচ্ছে, তার সম্ভাব্য পরিণতি কি হতে পারে সে ব্যাপারে কিছু আগাম বোঝাবুঝি সম্পন্ন করা জরুরী। সামগ্রিক ভাবে বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে কোথায় কী ঘটছে এবং তার সঙ্গে ট্রাম্প নামক উপসর্গের উৎপত্তি কিভাবে সেই সকল প্রশ্ন তোলার আগ্রহ তৈরি করার কথা বলাই আজকের লেখার উদ্দেশ্য। এই দিকটি বোঝা গেলে একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের তাৎপর্য বোঝা সহজ হবে।

বাহ্যিক ঘটনাঘটন এবং তার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দিয়ে ট্রাম্পকে বোঝা যাবে না। কেন বোঝা যাবে না তার যুক্তি হিসাবে বলা যায় ট্রাম্প আপাত দৃষ্টিতে এ যাবতকাল চলে আসা নিউ লিবারেল ইকনমিক পলিসি বা যাকে বাংলায় আমি কাছাখোলা অবাধ বাণিজ্য নীতি বলে থাকি – তার বিরুদ্ধের লোক। এটা তথাকথিত বামপন্থী নীতি বা অবস্থান। যেমন বামরাই ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপের বিরুদ্ধে ছিলেন। এখন সাদা বর্ণবাদ বা জাতিবাদী অবস্থান থেকে ট্রাম্প টিপিপির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। দ্বিতীয়ত সাদাদের বর্ণবিদ্বেষ নতুন কিছু নয়, লিবারেলিজম যার ওপর স্যুট টাই পরিয়ে ভদ্রলোক করে রাখে। সেই দিক থেকে যারা মার্কিন দেশের আদিবাসীদের হত্যা করে সেটলার আমেরিকা গড়ে তুলেছে বর্ণবাদ সেই মার্কিন সভ্যতা ও রাষ্ট্রের ভিত্তি। কিন্তু বোঝা দরকার বর্ণবাদ বা জাতিবাদ দিয়ে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় অর্থনৈতিক ভাবে টিকে থাকা কঠিন। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকে থাকতে হলে সস্তা শ্রমের যোগান দরকার, অভিবাসীরা সেই চাহিদা মেটাচ্ছিল। তাহলে মার্কিন অর্থনীতিতে কী এমন ঘটনা ঘটেছে যাতে এর প্রয়োজনীয়তার কথা জেনেও ট্রাম্প সাদা ‘মধ্যবিত্ত’ শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বিদেশী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন?

সাদা চোখে আমরা বুঝি প্রেসিডেন্ট হিসাবে ট্রাম্পের বিজয় সাদা আমেরিকার দক্ষিণপন্থি বর্ণবাদী মানুষদের বিজয়। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধং দেহি রণমূর্তি, নারীদের নিয়ে রংতামাশামূলক অপমনজনক কথাবার্তা – এগুলো তো আমরা জানি। এগুলো মিথ্যা নয়। কিন্তু এগুলো বাইরের দিক। ভেতরের দিকটা একাট্টা কিছু নয়, তাকে নানান দিক থেকে বোঝার দরকার আছে।

যে দিকটার ওপর বিশেষ ভাবে নজর দেবার দরকার সেটা হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি। আজ শুধু তার দুই একটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করব যাতে সাদা ও বর্ণবাদী মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিদেশি – বিশেষ ভাবে বিদেশী শ্রমিকদের অভিবাসন বিরোধিতার কারণ আমরা কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। তাদের বোঝানো যায় বহুজাতিক কোম্পানি নয়, বরং বিদেশী শ্রমিকদের কারণেই সাদা শ্রমিকদের আয় বাড়ছে না। মার্কিন অর্থনীতিতে বহুজাতিক কোম্পানি বিনিয়োগ করছে না। অধিক মুনাফার জন্য পুঁজির নিজস্ব কারনে তারা চিনে বা অন্য দেশে বিনিয়োগ করছে। ট্রাম্পের ধারণা তিনি নির্বাহী আদেশ দিয়ে পুঁজির ধর্ম ঠিক করতে পারবেন। অর্থাৎ তিনি কোম্পানিগুলোকে আদেশ দিলেই তারা চিন দেশে কম দামে পণ্য উৎপাদন না করে মার্কিন দেশে উচ্চ হারে মুজুরি দিয়ে বিনিয়োগ করবে। এটা যে তারা করবে না ট্রাম্প সেটা জানেন না তা নয়, তিনি বাতাসে বড় হন নি। আসলে শেষাবধি তিনি মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থই রক্ষা করতে চাইছেন, তাদের অতি মুনাফা মার্কিন দেশে চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত ও শ্রমিকের আয়-উপার্জনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তিনি তা জানেন, কিন্তু সচেতন ভাবেই সেটা আড়াল করতে চান। মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়েই ট্রাম্প বহুজাতিক কোম্পানিকে দোষারোপ না করে অভিবাসন বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। পুঁজির চরিত্র আমলে না দিয়ে হুকুম দিয়ে মার্কিন অর্থনৈতিক অবস্থা বদলাতে চাইছেন। এই সার কথাটা আমরা বুঝলে মার্কিন রাজনীতির আর্থ-সামাজিক দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রটা খানিক ধরতে পারব।

বিশ্বর্থনীতি ও বহুজাতিক কর্পোরেশান

গত তিন দশকব্যাপী বিশ্ব অর্থনীতির ফলাফল হিসাবে যে দিকটায় অর্থনীতির গবেষকরা জোর দিচ্ছেন সেটা হোল কর্পোরেশানগুলোর মুনাফার অবিশ্বাস্য স্ফীতি। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বাইরে থাকা বিভিন্ন দেশে – যেখান প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক কিছুটা হলেও অবশিষ্ট ছিল – তারা পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিস্তারের মুখে ছারখার হয়ে গিয়েছে। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিস্তারও ঘটেছে অসম্ভব দ্রুততায়। সাধারণ মানুষ অনিশ্চয়তায় ভুগেছে, বিভিন্ন দেশ তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সচল রাখতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে, কিন্তু এই সময় করপোরেশান – বিশেষত বহুজাতিক কর্পোরেশানগুলোর জন্য ছিল রমরমা অবস্থা। তাদের সামনে নতুন নতুন বাজার খুলে গিয়েছে, অথচ অন্যদিকে কর্পোরেট ট্যাক্স, টাকা ধার নেবার খরচ কিম্বা ঋণের মূল্য বা সুদ, শ্রমিকের মজুরি, মেশিনপত্র ও টেকনলজি সবকিছুরই দাম বেড়েছে হু হু করে।

শুরুতেই সাধারন পাঠকরা মনে রাখতে পারবেন এমন একটি পরিসংখ্যান দিয়ে শুরু করি ১৯৮০ সালের পর থেকে ধনি ও শিল্পোন্নত দেশের জাতীয় আয় থেকে শ্রমিক ও সাধারণ জনগণের প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে আনুপাতিক হ্রাস ঘটেছে তার একটি চিত্র। ম্যাকিনসি গ্লোবাল ইন্সটিটিউটের তথ্য থেকে পাঠকের বোঝার সুবিধার জন্য এই সংখ্যাচিত্রটি তৈরি করেছি।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের আয়ে গত দুই দশকে আনুপাতিক হ্রাস।

graph


অর্থাৎ ১৯৮০ মার্কিন জনগণের শ্রমজীবী জনগণ যদি জাতীয় আয়ের একশ ডলারের মধ্যে ৭০ ডলার পেয়ে থাকেন, এখন তার ভাগ্যে জুটছে মাত্র ৬৪ ডলার। তাদের চামড়া পোড়ে এমন পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। ট্রাম্পকে কেন্দ্র করে যে বর্ণবাদী রাজনীতি গড়ে উঠেছে, তার শেকড়ের সূত্রটা এখানে। ট্রাম্প তাই বলছেন, তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বাঁচাতে চান। সাদা মধ্যবিত্ত শ্রেণি সেই ডাকে সাড়া দিয়েছে। সাড়া দেবার অর্থনৈতিক শর্ত যে রয়েছে সেটা এই ছোট পরিসংখ্যানেই আমরা বুঝি। এই পরিসংখ্যান থেকে আমরা বুঝতে পারি বর্ণবাদ ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানিতেও কেন মাথাচাড়া দিচ্ছে। এটা বাড়বে। কমবে না।

অর্থনীতি বিষয়ে কিছু গবেষণাজাত পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। যদি ১৯৮০ থেকে ২০১৩ সালকে একটি অর্থনৈতিক কালপর্ব ধরি তাহলে বড় বড় বহুজাতিক কম্পানির আয় তিনগুন বেড়েছে। এটা সুদ ও আয়কর দেবার আগে। বিভিন্ন দেশে তার হারও আলাদা। যদি বিশ্ব অর্থনীতির গড় প্রবৃদ্ধির আনুপাতিক হিসাবে ধরা হয় তাহলে ১৯৮০ সালে ছিল ৭.৬% , এই অনুপাত ২০১৩ সালে এসে ১০% -এ দাঁড়িয়েছে। যদি সুদ খাজনা ইত্যাদি বাদ দেওয়া হয় তাহলে বহুজাতিক কোম্পানি নীট লাভ বিশ্ব অর্থনীতির গড় প্রবৃদ্ধির অনুপাতের হিসাবে ১৯৮০ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে বেড়েছে ৭০%। অর্থাৎ বিশ্বজুড়ে বহুজাতিক কর্পোরেশানের আর্থিক শক্তি বেড়েছে বিপুল ভাবে। সারা দুনিয়ার যে প্রবৃদ্ধি হয় তার ১০০ টাকার ১০ টাকাই পুঞ্জিভূত হয় বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। যেসব কোম্পানি এই বিপুল মুনাফা কামাচ্ছে তাদের হেড অফিস কোন না কোন ধনি দেশে, যাদের আমরা ‘পরাশক্তি’ বলে চিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে সকল বহুজাতিক কোম্পানির হেড অফিস দেখা যায় গড়ে তারা ১৯৮০ সালে মোট বিক্রি থেকে ৫.৬% হারে মুনাফা কামাতো। সেটা ২০১৩ সালে ৯% হয়েছে। মুনাফার হারের এই উল্লম্ফন বিশ্ব অর্থব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ সূচক। মনে রাখতে হবে আমরা মুনাফার হার নিয়ে কথা বলছি, পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতিতে পুরা ব্যবস্থার মধ্যে মুনাফার হারই নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। ইউরোপের শহরগুলোতে হেড অফিস আছে এমন কোম্পানিগুলোও তারাও ১৯৮০ সালের সময় থেকে ভালই করছিলো। তাদের মন্দা দেখা দিয়েছে ২০০৮ সালের পর থেকে। চিন, ভারত, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কোম্পানিগুলোও মন্দ করে নি, তবে আয়ের দিক থেকে তাদের বৃদ্ধি ঘটেছে, তুলনায় মুনাফার হারে অতোটা নয়।

মুনাফার বৃহৎ অংশই গিয়েছে বড় বড় কর্পোরেশানের ভাগে, যাদের বছরে বিক্রি এক বিলিয়ন ডলার স্পর্শ করে বা ছাড়িয়ে যায়। বেচাবিক্রির ৬০ ভাগই তারা করে। তাদের মার্কেট ক্যাপিটাইজেশানের অনুপাত শতকরা ৬৫ ভাগ, আর সব কোম্পানি মিলে যতো মুনাফা কামায় তার ৭৫ ভাগই যায় তাদের খাতায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বছরে বেচাবিক্রি ১০ বিলিয়ন ডলার, তারা ১৯৯০ সালে বহুজাতিক কম্পানিগুলোর মোট মুনাফার ৫৫% ভাগ আত্মসাৎ করেছে, আর ২০১৩ সালে করেছে ৭০%। দুনিয়াতে যতো কোম্পানির নাম আমরা জনসাধারণ চিনি, জানি কিম্বা তাদের তালিকা পাই তাদের একশটির মধ্যে মাত্র দশটি কোম্পানির ভাগই যায় দুনিয়াব্যাপী পুঞ্জিভূত মুনাফার শতকরা আশি ভাগ। অর্থাৎ একশ টাকা মুনাফার ৮০ টাকা পায় মোট কোম্পনির মাত্র শতকরা দশটি। এদের ওপরের চাঁইগুলোকে হিসাবে ধরলে দেখা যায় একশ ডলার মুনাফার ৮০ ডলারই তাদের পকেটে যায়।

বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের নতুন প্রবণতা ইন্টারেস্টিং। তারা তাদের আয় বা মুনাফা ফের বিনিয়োগ করতে চাইছে না। বরং তাকে তরল রাখছে। সুবিধা হচ্ছে এতে ডলার নগদনগদি শেয়ার মার্কেটে খাটানো যায় এবং দ্রুত মুনাফা কামানোর সুযোগ পাওয়া যায়। সেই সুযোগ বেড়েছে। এর ফল হয়েছে এই যে ধনি ও শিল্পোন্নত দেশগুলোতে কলকারখানা বাড়ে নি, শিল্পোন্নয়নের অগ্রগতি তুলনামূলক ভাবে কমেছে, বিনিয়োগের ক্ষেত্র সরে গিয়েছে তৃতীয় বিশ্বের মতো দেশে। এর পরিণতি হিসাবে বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফার হার বাড়লেও সেখানে শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের আয়ের কোন উন্নতি হয় নি। তাদের কাজের অবস্থারও কোন উন্নতি হয় নি।

এই অবস্থাটাও বহুজাতিক কোম্পানির পক্ষে গিয়েছে, তাদের বিনিয়োগে আগ্রহী করবার জন্য কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো হয়েছে, তারা কর সুবিধা পেয়েছে বিপুল। অন্যদিকে একদেশের শ্রমিককে অন্যদেশের শ্রমিকের বিরুদ্ধে সময়ে অসময়ে লাগিয়ে দিয়ে তারা মজুরির দামও কমাতে পেরেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে সাধারণ ভাবে অভিবাসন এবং বিশেষ ভাবে অভিবাসী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যে বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়া আমরা দেখছি তার পেছনে কর্পোরেট অর্থনীতির যোগ রয়েছে। এই দিকটা বোঝা খুবই দরকারী।

কিছু বিষয় আগামি বিভিন্ন লেখায় আরও স্পষ্ট করবার প্রয়োজনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আজ শেষ করি।

১. বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অল্প কয়েকটি বহুজাতিক কর্পোরেশানের মুনাফাকারী ভূমিকা নিশ্চিত করবার জন্য রাষ্ট্র – বিশেষত ধনি ও শিল্পোন্নত দেশগুলোর রাষ্ট্র, সমর ব্যবস্থা এবং মতাদর্শিক বয়ানের ভূমিকা এই কালের বিশ্ব রাজনীতি বোঝার প্রধান চাবিকাঠি। এই লড়াইয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যে হাতিয়ার ব্যবহার করে তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে মারণাস্ত্র তৈয়ারির কোম্পানি ও ব্যাংক। অর্থাৎ সমরাস্ত্র ও মুদ্রা ব্যবস্থা। এমন এক মূদ্রা ব্যবস্থা যা কার্ল মার্কসের ভাষায় ‘ফিক্টিশিয়াস’ বা ভূয়া। তাহলে ‘মূদ্রা’ ‘পুঁজি’ এবং আন্তর্জাতিক বিনিময় মাধ্যম হিসাবে ‘ডলার’ কথাটার আসলে কী মানে সেটা নতুন করে পর্যালোচনা ছাড়া বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার কিছুই আমরা বুঝব না।

২. টাঁকশালে ডলার ছাপানো এবং তাকেই বিশ্ব বিনিময়ের একমাত্র কাগজ হিসাবে বহাল রাখার সাফল্যের ওপর সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের টিকে থাকা না থাকা নির্ভর করে। আর সেটা টিকিয়ে রাখার জন্যই বিশাল মারণাস্ত্র ইন্ডাস্ট্রি ও সৈন্যসামন্ত দরকার। যুদ্ধবিগ্রহ নিত্য ঘটনা হতে বাধ্য। বর্তমান আধুনিক রাষ্ট্র এই ব্যবস্থার অধীনস্থ প্রতিষ্ঠা, ব্যাবস্থার নিয়ন্ত্রক নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প একটা যুদ্ধ লাগাবেন, কথাটা আজকাল জোরে সোরে বলা হচ্ছে। সেটা অমূলক নয়। কারন বহুজাতিক কোম্পানি যুদ্ধের মধ্যে মুনাফা দেখে, মানুষের রক্ত কিম্বা লাশ দেখে না।

৩. বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই স্বল্প কয়েক বহুজাতিক কর্পোরেশানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম থেকে আলাদা কিছু নয়। সামগ্রিক ভাবে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এটি একটি নতুন পর্ব মাত্র। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের স্বার্থেই বিশ্বব্যবস্থার দ্বন্দ্বকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে পর্যবসিত করেছে।

আশা করি এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা আরও লেখালিখি করবার ফুরসত পাবো,

১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭। ২৮ মাঘ ১৪২৩। শ্যামলী।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।