কমরেড ও প্রগতিশীল ভাইবোনেরা, দৌড়ান!!
এক জায়গা থেকে সরিয়ে শাড়ি পরা দেবি থেমিসকে আবারও আদালত প্রাঙ্গনে পুনর্স্থাপন করা হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেছেন, ‘গ্রিক দেবী থেমিসের এই প্রতীককে চিরতরে পরিত্যাগ করতে হবে”। কারন হিসাবে বলেছেন, শাড়ী পরা দেবি থেমিসকে ‘জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে’ স্থাপন করা হয়েছে। আদালত প্রাঙ্গনে শাড়ি পরা থেমিসের মূর্তি কোন প্রত্নতাত্ত্বিক বা ঐতিহাসিক ভাস্কর্য নয় যে একে রক্ষা করবার কোন প্রত্নতাত্ত্বিক কিম্বা ঐতিহাসিক যুক্তি আছে। আদালত প্রাঙ্গনে এই প্রকার কোন দেবিমূর্তি বসাবার কোন ইচ্ছা বাংলাদেশের জনগণ ব্যক্ত করে নি। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের বিরোধী এই দেবিকে বাংলাদেশের কোথাও স্থান দেয়া যাবে না। ‘গণমানুষের সকল আবেদন নিবেদন এবং শান্তিপুর্ণ দীর্ঘ আন্দোলন’কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে থেমিসের পুনর্স্থাপন এটাই প্রমাণ করে, ‘এদেশের মানুষের সম্মিলিত আকাংখা’কে সরকার বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিচ্ছে না’। তার মানে দেবি থেমিস নিয়ে বিতর্ক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বীজ পরাপুরি রয়ে গেলো। যাহা বাহান্ন তাহাই তেপ্পান্ন। সরানোই বা কেন, আবার বসানোই বা কী উদ্দেশ্য?
যারা হেফাজতে ইসলামের বিশ্বাস বা মতাদর্শের বিরোধী তারা দেবিমূর্তির তর্ককে তাদের ভাষায় স্রেফ ‘মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরোধিতা'র তর্কে পরিণত করছেন। যেহেতু হেফাজতে ইসলাম বিরোধিতা করছে অতএব শিল্পের দিক থেকেও নিকৃষ্ট মানের এই আবর্জনা রক্ষার পক্ষে থাকার অর্থ হচ্ছে নিজেকে অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল প্রমাণ করা। এতে মূর্তির পক্ষাবলম্বনকারীদের শৈল্পিক রুচি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিরোধীদের মতাদর্শ মোকাবিলার জন্য তথাকথিত সেকুলার ও প্রগতিশীলদের কোন প্রস্তুতি নাই, সেটাও এখন পরিষ্কার। তারা অতিশয় পুরানা, ফালতু ও ক্লিশে তর্কে নিজেদের অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার নির্লজ্জ পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। যেমন, ইসলামে মূর্তি হারাম, ইসলাম শিল্পকলা ও ভাস্কর্যের বিরোধী, মৌলবাদিরা মূর্তি আর ভাস্কর্যের ফারাক জানে না – ইত্যাদি। ধর্মনিরপেক্ষওয়ালা ও বামপন্থিদের মধ্যে চিন্তা ও পর্যালোচনার অভাব প্রকট ভাবে ধরা পড়ল।
মার্কস লেনিন মাওজে দং চিন্তাধারা জাতীয় নানান ফেরকা ও মজহাব শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাসের অধিক কিছু নয়, সেটা এদের ইসলাম বিদ্বেষ ও মৌলবাদ বিরোধী আস্ফালন দেখে স্পষ্ট। বিশ্বাস এবং গোঁড়ামির দিক থেকে ইসলামপন্থিদের চেয়ে তথাকথিত সেকুলার ও প্রগতিশীলরা কয়েক কাঠি চড়া। চতুর্দিকেতাদের হাওয়াই আস্ফালন দেখে অনায়াসেই বোঝা যায়। শাহবাগের করুণ পরিণতির পরও এদের শিক্ষা হচ্ছে না। এরা দাবি করে জনগণের জন্য নাকি তারা কাজ করে। তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে এদের কোন ধারণাই নাই। এরা ইসলাম সম্পর্কে যেমন কিছুই জানে না, তেমনি বাংলাদেশে বিভিন্ন ইসলামি মত বা দলের মধ্যে নানান ধারা ও চিন্তার ভিন্নতা সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল নয়। তার কোন হদিসই তারা রাখে না।
হেফাজতে ইসলামের জন্য এটা ভালো হয়েছে। অনেকটা খালি মাঠে গোল দেওয়ার মতো ব্যাপার। তারা তাদের যুক্তিগুলো যথাসাধ্য স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন ভাবে হাজির করছে। এতে জনগণের সমর্থন বাড়ছে এবং রাজনৈতিক দল না হলেও জাতীয় রাজনীতিতে তাদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। বামপন্থি এবং সেকুলাররা বুঝতে পারছে না, তাদের দুর্বলতা, অক্ষমতা এবং ধর্মের প্রতি বিদ্বেষের কারণে বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলামের মতাদর্শিক প্রভাব বাড়ছে বৈ কমছে না। দেবি থেমিসের মূর্তি নিয়ে তারা শুরু থেকে যে সকল বিবৃতি দিয়ে আসছে তা প্রধান প্রধান গণমাধ্যম উপেক্ষা করলেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
এখানে আমার উদ্দেশ্য হেফাজতে ইসলাম তাদের বিভিন্ন বিবৃতিতে কেন তারা দেবি থেমিসের মূর্তির বিরোধিতা করছে তা ধরিয়ে দেওয়া। তাদের আপত্তির জায়গা বোঝা। বুঝতে গিয়ে আমরা দেখব তথাকথিত বাম বা স্বঘোষিত সেকুলাররা হেফাজতে ইসলামের চিন্তাচেতনার তুলনায় কোথায় পিছিয়ে আছে।
আদালতের কাজ দেবিমূর্তি বসানো - সরানো নয়
শুরুতে দেবি থেমিস বসানো সরানো নিয়ে আদালতের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার। বিচার বিভাগ নিজেই বলে তারা স্বাধীন নয়, অবশ্য এটা তারা বলে তাদের পেশাগত স্বার্থে। তাদের চাকরিবাকরি যেন আমলা কিম্বা জাতীয় সংসদ দ্বারা নির্ধারিত না হয়। কিন্তু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবার জন্য বিচার বিভাগের 'স্বাধীন' ভূমিকা পালনের মারাত্মক ব্যর্থতা নিয়ে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই কথা হচ্ছে। দেশে বিদেশের মানবাধিকার সন্সথাগুলো নাগরিক ও মানবিক অধিকারে বিপর্যয়ের জন্য বিচার বিভাগকেই বিশেষ ভাবে দায়ী করছে। বিচার বিভাগ ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে পারছেন এই অভিযোগের কোন উত্তর বিচারবিভাগের কাছে নাই। অথচ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা – বিশেষত নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষাই এখনকার প্রধান গণদাবি। সেই কাজ বাদ দিয়ে গ্রিক ন্যায়ের দেবিকে শাড়ী পরিয়ে উচ্চ আদালত প্রাঙ্গনে বসানো হচ্ছে জনগণের সঙ্গে চরম তামাশার নামান্তর।
বিচারবিভাগ দেবি মূর্তি বসায় আর সরায়, আবার বসায় এবং অবশ্যই অচিরে আবার বাংলাদেশ থেকে এই দেবিমূর্তিকে চিরতরে বিদায় করতে হবে। শাড়ী পরা দেবি থেমিস বসানো সরানোই কি বিচার বিভাগের কাজ? বিচার বিভাগ যখন দেবিমূর্তি বসানো সরানোর কাজে নামে বুঝতে হবে এটা রাজনীতি। এর সঙ্গে বৈচারিক কাজ বা দায়দায়িত্বের কোন সম্পর্ক নাই। নাগরিক ও মানবিক অধিকার নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের ব্যর্থতা এড়াবার জন্য কোথাকার কোন শাড়িপরা দেবিমূর্তি নিয়া বাংলাদেশে দাঙ্গাহাঙ্গামা লাগাবার চেষ্টা মাত্র। আর কিনা সেই দেবিমূর্তি রক্ষার জন্য সেকুলার প্রগতিশীলরা মরণপণ লড়াইয়ে নিয়োজিত হয়ে গিয়েছে! বুঝুন এবার।
যারা বাংলাদেশে আসলেই প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ ঘটাতে চান তাদের উচিত ছিল সমাজকে দ্বিখণ্ডিত করবার এই আচমকা উৎপাতের বিরোধিতা করা। সাধারণ মানুষের আবেগ, চেতনা ও উপলব্ধির বোঝা খুবই জরুরী কাজ যেন তাকে ইতিবাচক শক্তিতে রূপান্তর করা যায়। অতএব শহরের মুষ্টিমেয় শিক্ষিত ভদ্রলোকদের বিপরীতে জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে একটা গণঐক্যের পাটাতন তৈরি খুবই জরুরি। গণশক্তিতে বলিয়ান হয়ে বিচার বিভাগকে তার দায় দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করার জন্য চাপ তৈরি করাই প্রধান কর্তব্য। কেবল তখনই বিচার বিভাগকে মিউজিয়ম কিউরেটারের দায়িত্ব না নিয়ে, ন্যায়বিচারে মনোযোগী হবার জন্য জনগণ বাধ্য করতে সক্ষম হবে।
গণঐক্যের পাটাতন গড়ে তোলা গেলে ইসলামের ধূয়া তুলে ভাস্কর্য ও শিল্পকলা বিরোধীদের যেমন অনায়াসেই মোকাবিলা ও উচিত শাস্তি দেওয়া সম্ভব হবে। ঠিক তেমনি দেবিমূর্তি নিয়ে শিবসেনারা বাংলাদেশকে যেভাবে কুরুক্ষেত্র বানাতে চায় তাদেরও উপযুক্ত জবাব দেওয়া যাবে। বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতি প্রিহার করে বাংলাদেশের জনগণের ঐক্যের পাটাতন নির্মাণের দিক আমাদের ভাবতে হবে।
হেফাজতে ইসলামের মূল আপত্তিটা আসলে কী?
সাম্প্রতিক বিবৃতিতে শাহ আহমদ শফী যেটা স্পষ্ট করেছেন সেটা হোল, “থেমিস সুপ্রিম কোর্টের সামনে থাকবে, নাকি পিছনে থাকবে, এইটা কোন ইস্যু কখনোই ছিলো না। নামাজের সময় কালো কাপড়ে মুড়ে দেয়া হবে কি হবে না; এইটাও ইস্যু ছিলো না। ইস্যু ছিলো, থেমিস থাকবে কি থাকবে না। এইখানে মধ্যপন্থা নেয়ার কোন সুযোগ নাই”। অর্থাৎ আদালতের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বেওয়া তো দূরের কথা এই শাড়ি পরানো গ্রিক দেবিকে বাংলাদেশের কোত্থাও রাখা যাবে না।
বাংলাদেশে মতাদর্শিক লড়াইয়ের দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি হেফাজতে ইসলাম বলছে সেটা হোল, “ইসলামে ইনসাফ বা ন্যায়ের ধারণা একটি মৌলিক ধারণা বা গুরুত্বপূর্ণ বিধান। এমনকি ইনসাফ কায়েম ছিলো বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতা ঘোষণার ঘোষিত লক্ষ্যও। সেই ন্যায়ের বা ইনসাফের কোন প্রতীকায়ন যদি গ্রীক ঐতিহ্য থেকে ধার করা হয়, তবে প্রকারান্তরে এটাই ধরে নেয়া হয় যে, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যে ও ধর্মে ন্যায়ের কোন ধারণা বা অবস্থান ছিল না। এটা উপনিবেশিক ভাবাদর্শ’। তাহলে দেখা যাচ্ছে উপনিবেশিক ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় দেবি থেমিসের মূর্তি অপসারণের দাবি উঠেছে। ‘আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইউরোপের ইতিহাসকে বাংলাদেশে আত্মীকরণ করানোর অপচেষ্টা’ রুখে দেয়াই এই ক্ষেত্রে হেফাজতে ইসলামের প্রধান উদ্দেশ্য। যদি ইউরোপের ন্যায়ের ধারনাই আমাদের আদর্শ হয়, তাহলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরই বা দরকার কি। একে বিদেশী শক্তির হাতে তুলে দিলেই হয়।
মূর্তি বা ভাস্কর্যের ফারাক নিয়া তুলকালাম ফালতু তর্ক কিম্বা ইসলামে মূর্তি হারাম কিনা সেই সকল ক্লিশে তর্ক এখানে মুখ্য বিষয় নয়। আলেম ওলেমাদের মধ্যে সেই তর্ক আছে, সেটা ধর্মতাত্ত্বিক তর্ক। জাতীয় পর্যায়ে গণবিতর্কে – যেখানে অন্যান্য ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষ ছাড়াও বামপন্থি বা সেকুলার গোষ্ঠিও আছে -- হেফাজতে ইসলাম তাদের ধর্ম বিশ্বাস কিম্বা ধর্মতাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত সকলের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে না। দেওবন্দি ধারারা ধারাবাহিকতায় তারা এমন একটি যুক্তি দিচ্ছে যার ভিত্তিতে ঔপনিবেশিক মনমানসিকতা থেকে জনগণকে মুক্ত করবার লড়াই জোরদার হয়।
আপাতত দেবি মূর্তি পুনর্স্থাপিত হলেও এটা স্পষ্ট যে দেবি থেমিস নিয়ে বিতর্কে হেফাজতে ইসলামের মতাদর্শিক বিজয় ঘটেছে। ফলে আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের জমিন থেকে এর উৎখাত সময়ের ব্যাপার মাত্র। হেফাজতে ইসলাম রাজনৈতিক দল নয়। ফলে এই বিজয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কি রূপ নেবে আমরা তা জানি না। তবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক তর্ক বিতর্কে হেফাজতে ইসলাম তাদের নিজেদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান আদায় করে নিল, সেটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। টেলিভিশানে একজন হেফাজতে ইসলামের প্রতিনিধিকে চারপাঁচজন যেভাবে হামলে পড়ে নস্তানাবুদ করতে চাইছে, কিন্তু পালটা নিজেরা নিজেদের স্টুপিড প্রমাণ করছে সেটা দেখে সত্যি করুণা হয়। ইসলাম সম্পর্কে গণ্ডমূর্খদের কোন ধারণা নাই। তা না থাকুক, কিন্তু হেফাজতে ইসলাম কি বলছে তার কিছুই তারা জানে না। হাওয়ায় ছড়ি ঘুরাচ্ছে। ইসলামপন্থিদের তুলনায় ঔপনিবেশিক শিক্ষা ও ঔপনিবেশিক বদ্ধ চিন্তার পরিণতি সাধারণ মানুষ দেখছে। এতা হেফাজতে ইসলামের বিজয়।
দেবি থেমিসের মূর্তি বিচার বিভাগ থেকে অপসারণের মধ্য দিয়ে বিচারবিভাগ কুতর্কের দায় থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারত। বোঝা গেল, দেবি থেমিসের মূর্তি অপসারণের দাবির মুখে বিচার বিভাগ স্রেফ ছলনার আশ্রয় নিয়েছে মাত্র। এর উদ্দেশ্য কি শুধু হেফাজতে ইসলামের দাবিকে উপেক্ষা করা? সেকুলারদের কিছুটা তুষ্ট রাখা? সকল দিক রক্ষা করা? নাকি সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা উসকে দেওয়া এবং উত্তপ্ত করে তোলা? কেন? দেবি মূর্তি নামানো সরানোই কি বিচার বিভাগের কাজ?
দেবি থেমিসকে উচ্চ আদালতের যে কোন প্রাঙ্গনে স্থাপন করে রাখা ক্ষমতাসীনদের অবস্থানকেও চ্যালেঞ্জ করা। অর্থাৎ কেউ চাইছে বিচার বিভাগের ও নির্বাহী বিভাগের বিদ্যমান দ্বন্দ্বকে আরও বড় করা। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নিজের ঘাড়ে অনেক বড় দায় নিলেন। বাংলাদেশের গণবিচ্ছিন্ন ইসলাম-বিদ্বেষী সেকুলারদের মনোরঞ্জন করতে গিয়ে তিনি কিভাবে বিচারবিভাগের আসল কাজ – অর্থাৎ নাগরিকদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন সেটা একমাত্র তাঁর ভগবানই জানে। দেবি থেমিসকে সরানোতে সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেয়েছিল, কিন্তু তিনি পুরানা অস্বস্তিকে শুধু পুনর্স্থাপনই করেন নি, ক্ষতস্থানে মরিচ দেবার ব্যবস্থা করলেন। তাঁর কাজ ন্যায়বিচার নিশ্চিত জরা, মূর্তি বসানো আর সরানো নয়।
এখন স্পষ্ট হচ্ছে, দেবি থেমিসকে উচ্চ আদালত প্রাঙ্গনে বসানোই হয়েছে রাজনৈতিক মন্দ উদ্দেশ্যে – অর্থাৎ বাংলাদেশকে রাজনৈতিক ভাবে অস্থিতিশীল করা ছাড়া বাংলাদেশে দেবি থেমিসকে বিচার বিভাগের সামনে স্থাপন করার য়ার কি মতলব থাকতে পারে? এ নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ হবে প্রধান বিচারপতির তা না জানার কথা নয়। যেহেতু ইসলামপন্থিরা এটা মেনে নেবে না, তখন পুরানা খেলাটা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের ময়দানে মহানন্দে খেলা যাবে। যথা, ইসলাম একটি বর্বরদের ধর্ম; তারা শিল্প-সংস্কৃতি মূর্তি-ভাস্কর্য ইত্যাদির দুষমন, আফগানিস্তানের তালেবানরা হাজার বছরের বৌদ্ধ মূর্তিগুলো ভেঙ্গেছিল, অতএব যারা বাংলাদেশেকে তালেবানি রাষ্ট্র বানাতে চায় তারা মূর্তি ভাঙবার দাবি তুলবে। তখন বলা যাবে বাংলাদেশ তালেবানদের দেশ হয়ে যাচ্ছে, অতএব দিল্লি-ওয়াশিংটনকে বাংলাদেশ রক্ষা করবার জন্য ছুটে আসতে আহ্বান জানানো যাবে। বাংলাদেশের ইসলামি বর্বরদের হাতে চলে গিয়েছে এখন দেশটিকে আর বাংলাদেশিদের হাতে রেখে দেওয়া যায় না, ইত্যাদি আসবে সামনে।
বাংলাদেশের জনগণকে এতো বোকা ভাবা কি ঠিক? ঠিক না। তারা এইসব বোঝে। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, মিশরে কি হচ্ছে সেইসব বোঝার ক্ষমতা শহরের মুর্খ সেকুলারদের চেয়ে তারা অনেক বেশী সহজে বোঝে। যদি না বুঝত তাহলে বাংলাদেশ এতোদিনে সিরিয়া হয়ে যেতো এবং সেটা দ্রুত পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়ত। বিচারপতি সিনহা কি আসলে তাই চান?
বিচারবিভাগের দিক থেকে শাড়ী পড়া দেবি থেমিস নিয়ে কুতর্ক সৃষ্টি সমাজ ও রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করবে। প্রধান বিচারপতি মনের খবর আমরা জানি না। কিন্তু যেটা দেখছি সেটা হোল সমাজ ও রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করবার দায় তাঁর কাঁধে এসে পড়বে। মূর্তি সরানা বসানো প্রধান বিচারপতির ভূমিকা নয়।
প্রধান মন্ত্রী বনাম প্রধান বিচারপতি
বাংলাদেশে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগ চরম ভাবে ব্যর্থ। দেশে আইনের শাসন নাই, সেটা প্রধান বিচারপতি নিজেই স্বীকার করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি সংসদে বলেছেন, আমি জানি না আমাদের চিফ জাস্টিস কীভাবে বললেন- আইনের শাসন নাই, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নাই! ইত্যাদি। অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে একটা ভয়ংকর দ্বন্দ্ব চলছে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মামলা সওয়াল জওয়াবের দুই পক্ষের বাদানুবাদে সেটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রধান বিচারপতিকে মিনতি করে বলি, দেবি থেমিস নিয়ে আপনি কি সমাজে তর্ক তৈরি করবেন? নাকি এই দ্বন্দ্ব নিরসন করবেন? কোনটা আপনার কাজ?
প্রধান বিচারপতির কথাই আমরা ধরি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন ‘বিচারিক স্বাধীনতা মানে কোনো ধরনের প্রভাব বা হস্তক্ষেপ ছাড়া বিচারকের ক্ষমতা প্রয়োগ করা’। বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার মূল ও ঐতিহ্যগত অর্থ হলো- সরকারের রাজনৈতিক শাখাগুলো থেকে বিশেষত নির্বাহী সরকার থেকে বিচারকদের সামষ্টিক ও স্বতন্ত্র স্বাধীনতা। ব্যক্তিগতভাবে একজন বিচারকের পরিপূর্ণ স্বাধীনতার উপাদানগুলো হল- ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, পারিপার্শ্বিক স্বাধীনতা এবং অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা। বেশ তো। তাহলে নিজে যা বিশ্বাস করেন তা বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগ দিন। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করুন। আমরা চাই না নিজের কাজ বাদ দিয়ে উচ্চ আদালত শাড়ী পড়া দেবি থেমিসের মুর্তি সংরক্ষকের কাজ করুক। এটা আদালতের কাজ নয়।
হেফাজতে ইসলামের আপত্তি বাদ দিন। ধরুন, বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলাম নাই। ধরুন এই দেশে ইসলাম বলে কিছু নাই (নাউজুবিল্লাহ!), আছে শুধু শিল্পকলা, স্থাপত্য ও ভাস্কর্য (এখন অট্টহাসি দিতে পারেন) । তাহলে শিল্পকলার সর্দাররা কি বলছে দেখুন। তারা বলছে, “শিল্পের বিচারে শুধু এটাই নয়, (অর্থাৎ দেবি থেমিসের মূর্তি শুধু নয়) ঢাকা শহরের ৯০ ভাগ ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়া উচিত। এত নিম্নমানের, লজ্জাজনক, কী বলব। আমি একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম ঢাকা শহরের অধিকাংশ সড়কদ্বীপ, রাস্তার ওপরে, রাস্তার মধ্যে, যেসব ভাস্কর্য আছে, অধিকাংশের দিকে তাকানো যায় না, নিম্নমানের, কুরুচিপূর্ণ”। এটা বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন, নিসার হোসেন।
তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে মাননীয় প্রধান বিচারপতি শিল্পকলা বা স্থাপত্যের কি এমন মহৎ জিনিস রক্ষার জন্য ‘নিম্নমানের, কুরুচিপূর্ণ ও লজ্জাজনক’ মূর্তিটি উচ্চ আদালতের এক জায়গা থেকে সরিয়ে আরেক জায়গায় স্থাপন করলেন?”। এর পেছনে কোন শৈল্পিক বিবেচনা নাই। তাহলে কোন বৈচারিক বিবেচনায় তিনি এই কাজ করলেন?
প্রধান বিচারপতি দেবি থেমিসের মূর্তি সরানোর পর নির্বাহী ও বিচার বিভাগের চলমান দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে প্রধান বিচারপতির সমর্থনে একটি মন্তব্য করেছিলাম। তখন যতোটুকু তথ্য আমার হাতে ছিল তার পরিপ্রেক্ষিতেই আমার মনে হয়েছিল যে যুক্তিতে দেবিমূর্তিটি সরানো হয়েছে তা বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মর্যাদার জন্য জরুরী। দ্বিতীয়ত প্রধানবিচারপতি প্রধান মন্ত্রীর নির্দেশে দেবি থেমিস সরিয়েছেন, সেটা প্রধান বিচারপতির জন্য চরম অবমাননাকর। তাই আমি লিখেছিলাম, দেবি থেমিস সম্পর্কে শেখ হাসিনা তাঁর অভিমত প্রকাশ করেছেন ঠিকই, এমনকি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে এ বিষয়ে কথাও বলেছেন, কিন্তু মূর্তি প্রধান মন্ত্রীর নির্দেশে সরানো হয় নি। প্রধান বিচারপতি স্বয়ং নিজ সিদ্ধান্তে এই মূর্তি সরিয়েছেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার আওয়ামী লীগ বারবার দাবি করছে থেমিস সরানো বা না সরানো একান্তই সুপ্রিম কোর্ট – অর্থাৎ প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব। এখানে রাজনীতির দিকটা হোল, সেকুলার কিম্বা ইসলামপন্থিদের খেপানো কিম্বা খুশি করারা দায় তারা প্রধান বিচারপতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিল। কাজ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভাস্কর্য অপসারণের বিষয়টি সরকারের এখতিয়ারে নাই। এটি সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত।
অতএব যে যুক্তিতে প্রধান বিচারপতি দেবি থেমিস সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে পত্রিকায় দেখেছি তার জন্য আমি তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। অভিনন্দন জানিয়েছিলাম স্রেফ দেবি মূর্তি অপসারণের জন্য নয়। খবরে যা পেয়েছি তাতে মনে হয়েছে প্রধান বিচারপতি যে যুক্তিতে দেবি থেমিস অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটা বিচার বিভাগকে বিতর্কের উর্ধে রাখা এবং বিচার বিভাগের নৈতিক বৈধতা সুরক্ষার দরকারে। দৈনিক প্রথম আলোর খবরেই দেখেছি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ জানিয়েছেন, সরকারের নির্দেশে নয়, প্রধান বিচারপতি নিজে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্যটি সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মওদুদ আহমদ জানিয়েছেন “প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ভাস্কর্য সরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ২৫ মে তারিখ বৃহস্পতিবার উচ্চ আদালতের জৈষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে সভা করেন। সেখানে আইনজীবীরা তাঁকে এটি সরানোর জন্যই পরামর্শ দেন। কেন চান না তার পক্ষে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কারণ এই ভাস্কর্য নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকুক বা প্রধান বিচারপতিকে বিতর্কিত করা হোক এটা আইনজীবীরা চান না’। খবর পড়ে মনে হয়েছিল উচ্চ আদালতের কোন বিচারক বা আইনজীবী চাননা দেবী থেমিস নিয়ে সমাজের বিতর্ক বিচার বিভাগ কিম্বা প্রধান বিচারপতিকেও বিতর্কিত করুক। এটা কোন আইনী মামলার বিষয় নয়। আইন ও বিচার ব্যবস্থার পরিমন্ডলের বাইরে বিতর্কে জড়ালে বিচার ব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তি এবং মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবার বিপদ ঘটে। বিচারক ও আইনজীবীরা যদি তা বুঝে থাকেন তাহলে সেটা সঠিক উপলব্ধি। সে কারণে প্রধান বিচারপতি ও বিচারকদের অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি আমি উচ্চ আদালতের জৈষ্ঠ আইনজীবীদেরও আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম।
কিন্তু এখন যখন আবার ‘নিম্নমানের, কুরুচিপূর্ণ ও লজ্জাজনক’ মূর্তিটি উচ্চ আদালতের এক জায়গা থেকে সরিয়ে আরেক জায়গায় স্থাপন করা হোল, তখন মনে হোল প্রধান বিচারপতি আদালতকে বিতর্কের উর্ধে রাখতে আগ্রহী নন, বরং বিতর্কিত করে রাখতেই যেন অধিকতর উৎসাহী। নৈতিক ও আইনী বৈধতা টিকিয়ে রাখতে হলে বাজে, নিস্ফল ও ন্যায়বিচারের প্রশ্ন – বিশেষত আদালতের ভূমিকাকে ধোঁয়াশা করে সেই প্রকার তর্ক থেকে অবশ্যই বিচার বিভাগকে প্রতিষ্ঠান হিসাবে উর্ধে রাখা প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব। কিন্তু তিনি বিতর্ক টিকিয়ে রাখলেন। বিতর্ক টিকিয়ে রাখার সঙ্গে আইনের শাসন মজবুত করা কিম্বা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার সঙ্গে কী সম্পর্ক? দেবি থেমিসের পক্ষে বিপক্ষে কে সঠিক কিম্বা কে বেঠিক সেটা নির্ণয় করা বিচার বিভাগের কাজ না। আদালত দেবি থেমিস সংক্রান্ত কোন মামলার রায় দিতে বসে নি। একে কেন্দ্র করে সমাজে ব্যাক্তি, শ্রেণি ও গোষ্ঠির চিন্তা ও অবস্থানের যে ভেদ ও বিভাজন সেটা সমাজের ডাইনামিজম বা গতিশীলতার লক্ষণ। কিন্তু এতে জড়ানো বিচারবিভাগের কাজ না। এর বাইরে বিচার বিভাগকে নিয়ে আসাই সঠিক ছিল। কিন্তু প্রধান বিচারপতি স্বেচ্ছায় নিজেকে আপদে জড়ালেন
আদালত গণপূর্ত বিভাগ না। তাহলে আদালত প্রাঙ্গন প্রধান বিচারপতির এখতিয়ারে নাকি নির্বাহী বিভাগের তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। অতএব কার এখতিয়ার বা সিদ্ধান্তে দেবি থেমিসকে আবার আদালত এলাকায় পুনপ্রতিষ্ঠা করা হোল তা জানবার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এটা অনুমান করতে পারি যে প্রধান বিচারপতির অনুমতি ছাড়া পুনর্স্থাপন সম্ভব হোত না।
হেফাজতে ইসলামের মতাদর্শিক বিজয় হয়েছে বলছি কেন?
দেখা যাচ্ছে উচ্চ আদালত প্রাঙ্গন থেকে থেমিস মূর্তি সরানোর ক্ষেত্রে হেফাজতে ইসলাম শেষাবধি জয়ী হতে পারে নি। এই পরিস্থিতিতে তারা আগামি দিনে কি করবে সেটা তাদের বিষয়। ইতোমধ্যে হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফি বলেছেন, “গ্রীক দেবীকে পুনঃস্থাপন করায় আমরা বিস্মিত হতবাক, বাকরুদ্ধ’।
প্রশ্ন হচ্ছে এরপরও আমি একে হেফাজতে ইসলামের মতাদর্শিক বিজয় বলছি কেন? এর কারণ হচ্ছে শুরু থেকেই হেফাজতে ইসলাম দেবি থেমিসের মূর্তি অপসারণ চেয়ে ক্ষান্ত হয় নি। তারা বলেছে বাংলাদেশের কোথাও এই মূর্তি থাকুক তারা চায় নি। তার যে যুক্তি তারা দিয়েছে তা ছিল পরিণত, সংযত এবং নতুন। ইমান আকিদার জায়গা থেকে ইসলাম সুরক্ষার লড়াই সম্পর্কে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান বাংলাদেশের তরুণদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। এটা এখনি হয়তো বোঝা যাবে না, কারন হেফাজতে ইসলামের বিবৃতি ও বক্তব্য কেউই ভাল করে পড়ে নি। শতকরা নিরানব্বই ভাগ ব্যক্তি যারা উঠতে বসতে হেফাজতে ইসলামকে গালিগালাজ করে বেড়ায় তারা হেফাজতে ইসলামের কোন বিবৃতি বা ভাষ্য এক বাক্য পড়েও দেখে না। প্রসঙ্গ ছাড়া একটা কি দুইটা বাক্য নিয়েই হৈ চৈ শুরু করে দেয়। প্রধান প্রধান গণমাধ্যম তাদের বক্তব্য বিবৃতি পারতপক্ষে প্রচার করে না। শুধু নিন্দা করবার কিছু থাকলে করে। গণমাধ্যম মনে করে অন্ধ হয়ে থাকলে প্রলয় বন্ধ থাকবে।
হেফাজতে ইসলামের মতাদর্শিক বিজয় একারনে যা হেফাজতের অবস্থান মোকাবিলার কোন বুদ্ধিবৃত্তিক বিরোধিতা করবার হিম্মত দূরে থাকুক, সেটা বোঝার ক্ষমতাও বিরোধী শিবিরে কারো মধ্যে দেখা যায় নি। না লেখালিখিতে না টকশোর ভাঁড়ামিতে। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এটা ইন্টারেস্টিং নতুন উপাদান। দেখা যাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম চিন্তাচেতনার দিক থেকে সেকুলার ও তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’দের চেয়ে অনেক অনেক অগ্রসর। মতাদর্শিক তর্কে তথাকথিত ‘সেকুলার’ ও ‘প্রগতিশীল’রা হেফাজতে ইসলামের আসল আপত্তি না বুঝেই খামাখা ঘেউ ঘেউ করে বেড়াচ্ছে। উচ্চ আদালতের কাছ থেকে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা এবং বিচার ব্যবস্থার বিপর্যয়ের জন্য জবাবদিহি দাবি করার কর্তব্য বাদ দিয়ে আদালত প্রাঙ্গনে দেবি থেমিস মূর্তি থাকবে কি থাকবে না তা নিয়েই তারা তর্ক করছে। এটা স্রেফ ইসলাম বনাম মূর্তি, কিম্বা মূর্তি নামক ভাস্কর্য ইত্যাকার প্রাচিন ও ফালতু তর্ক। পুরানা ও পঁচা যুক্তি। এখান তথাকথিত শিক্ষত শহূরে শিক্ষিত শ্রেণির চেতনার মাত্রা সম্পর্কে আমরা অনায়াসেই ধারণা করতে পারি। আধুনিক রাষ্ট্র ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের জ্ঞান আর কতোটুকুই বা থাকবে?
হেফাজতে ইসলামের আপত্তিটা আসলে কোথায়? সেই আপত্তির কোন্ কোন্ বক্তব্য একালে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, আর কোন্ কোন্ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য? নিদেন পক্ষে বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কোন্ কোন্ ইস্যু নিয়ে সকল পক্ষের মধ্যে আলাপ আলোচনা সম্ভব – সেই সবের পর্যালোচনার অভাব মারাত্মক। খেয়ে না খেয়ে হেফাজতে ইসলামের বিরোধিতা সেকুলার-প্রগতিবাজদের হনুমানগিরি মাত্র – অর্থাৎ কিছু না বুঝে এক ডাল থেকে আরেক ডালে লাফানো। একটি শ্রেণির ইসলাম বিদ্বেষ এতো প্রবল যে ইসলামপন্থিরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু বললেও সেটা তারা শুনিতে চায় না। তাদের যুক্তি ইসলাম মানেই খারাপ জিনিস, আর আলেম ওলেমারা ‘পশ্চাতপদ’। এরপরও হাসতে হয় কারন টেলিভিশানে দেখি হেফাজতের একজন প্রতিনিধিকে ঘায়েল করবার জন্য চার পাঁচজন শেয়ালের মতো মুখিয়ে থাকে।
ইসলাম মূর্তি পূজা করে না, কিম্বা ইসলাম মূর্তি বা ভাস্কর্যের বিরোধী – সেই সব ক্লিশে – অর্থাৎ জীবনানন্দের ভাষায় অতি ‘ব্যবহারে ব্যবহারে ব্যবহারে শূয়রের মাংস’ হয়ে যাওয়া – এই প্রকার আপত্তি হেফাজতের আপত্তি না। ইনিয়ে বিনিয়ে এই আপত্তিটাই সেকুলাররা ব্যবহার করে। ব্যবহার করতে করতে সেকুলাররা এই ক্লিশে প্রচারকে এমনই চটকিয়েছে যে বলা যায় সেই যুক্তি দেওয়া এখন কার্যত ‘হারাম’ হয়ে গিয়েছে। ফালতু তর্ক। থার্ড ক্লাস। অবশ্য হেফাজতে ইসলামের অফিসিয়াল বক্তব্যের বাইরে অনেক আলেম ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন মন্তব্য করে থাকেন যার দোষ হেফাজতে ইসলামের ঘাড়ে এসে পড়ে এবং পড়ছে। সেই দায় হেফাজতে ইসলামকেই নিতে হবে। দেখা যাচ্ছে দুই তিনটা কেন্দ্র থেকে বিবৃতি দেওয়া হয় যা হাটহাজারির বিবৃতির সঙ্গে অনেক সময় সঙ্গতিপূর্ণ হয় না। এইগুলো হেফাজতে ইসলামের বিপজ্জনক সাংগঠনিক দুর্বলতা।
তবে যারা আসলেই সেকুলারিজম কিম্বা বাংলাদেশে চিন্তার বিকাশ ঘটুক সেই অর্থে প্রগতিশীলতা বোঝেন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে তাদের ইতিবাচক মতাদর্শিক তর্কে যুক্ত হবার বিস্তর ক্ষেত্র ছিল এখনও আছে। পুরানা ক্লিশে কোলাহল দেখে মনে হয় সেই প্রকার জীব বাংলাদেশে লুপ্তপ্রায় বটে। যাই হোক, ইতিবাচক তর্কের জায়গাগুলো ধরিয়ে দেবার জন্য হেফাজতে ইসলামের বিবৃতি থেকে কয়েকটি প্রসঙ্গ পেশ করে লেখাটি শেষ করব।
দেবি থেমিস ‘বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, গণমানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী... ‘আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইউরোপের ইতিহাসকে বাংলাদেশে আত্মীকরণ করানোর অপচেষ্টা’।
কেন হেফাজতে ইসলাম তা মনে করে তার যুক্তি হিসাবে বলা হয়েছে ‘ইসলামে ইনসাফ বা ন্যায়ের ধারণা একটি কেন্দ্রীয় ধারণা। এমনকি ইনসাফ কায়েম ছিলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষিত লক্ষ্যও। সেই ন্যায়ের বা ইনসাফের কোন প্রতীকায়ন যদি গ্রীক ঐতিহ্য থেকে ধার করা হয়, তবে প্রকারান্তরে এটাই ধরে নেয়া হয় যে, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যে ও ধর্মে ন্যায়ের কোন ধারণা ছিল না। আমাদের ভাবাদর্শ যেন এতোই গরীব, যে কারণে নিজেদের উপনিবেশিক ভাবাদর্শে পুষ্ট করতে হবে। স্বাধীনচেতনা দেশপ্রেমিক কোন নাগরিকের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না’। অর্থাৎ হেফাজতে ইসলাম ঔপনিবেশিক মনমানসিকতা – বিশেষত নিজেদের ইতিহাস, চিন্তাচেতনার প্রতি হীনমন্যতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলছে।
হেফাজতে ইসলাম চাইছে সেকুলার বা প্রগতিশীলরা এই প্রশ্নটা ঔপনিবেশিক ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে তাদের মতাদর্শিক লড়াই হিসাবে তুলবেন। সেখানে বিরোধ যেমন থাকবে, মিলও থাকবে। আমার ধারনা মিল থাকারই বিশেষ সম্ভাবনা। ইসলামপন্থিদের কাজ হচ্ছে তাদের ‘ঈমান ও আক্বিদার জমিনে দাঁড়িয়ে এই ধার করা উপনিবেশিক ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে’ কথা বলা। সামাজিক তর্কেবিতর্কের মধ্য দিয়ে ঔনিবিশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্য নির্মাণের সুযোহ হয়তো তৈরি হতে পারে। এই ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশ্ন তোলা যায় তাহলে ইসলামের ইনসাফের ধারণার সঙ্গে স্বাধীনতার ঘোষণায় গৃহীত ইনসাফ বা ‘সামাজিক ন্যায় বিচার;-এর ধারণার আদৌ কোন বিরোধ কিম্বা অসঙ্গতি আছে কিনা? সেকুলার প্রগতিবাজরা এই ধরণের সামাজি তর্কে চরম ভাবে অক্ষম। এখানেই বাংলাদেশের বিপদ নিহিত।
হেফাজতে ইসলাম আরও বলছে,“গ্রীক পুরাণ মতে, থেমিস সোশ্যাল অর্ডার বা সামাজিক শৃংখলাও রক্ষা করে। সে শুধু ন্যায় বিচারই করে না, সে শক্তি প্রয়োগে সামাজিক শৃংখলাও রক্ষা করে। থেমিসের হাতের তরবারি সেই শক্তি প্রয়োগের প্রতীক। আধুনিক রাষ্ট্র সামাজিক শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব বিচার বিভাগকে দেয় না, বরং তা রাখে নির্বাহী বিভাগের হাতে। তাই, ঠিক কোন যুক্তিতে নিজেদের আধুনিক ও প্রগতিশীল দাবী করা বাম স্যেকুলারেরা থেমিসের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন সেটা আমাদের কাছে ছিলো এক বিস্ময়ের বিষয়” -- ‘এমনকি আধুনিক রাষ্ট্র ধারণায় বিচার বিভাগের যে অবস্থান, দেবী থেমিস তারও পরিপন্থী। কারণ থেমিস গ্রীক সংস্কৃতির ডিভাইন ল’ বা তাদের ঈশ্বরের ঐশ্বরিক আইনের প্রতীক। যে রাষ্ট্র নিজেকে আলাদাভাবে সেক্যুলার বলে পরিচয় দিয়ে নিজের কৌলিন্য জারি করে, সে কীভাবে গ্রীক ঐশ্বরিক আইনের প্রতীককে নিজের বলে গ্রহণ করতে পারে?’ – এবার ঠ্যালা সামলান।
তাই বলি, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রিয় কমরেড, প্রগতিশীল ভাই ও ভগিনী এবং বন্ধু কি শত্রু সেকুলারগণ, আপনারা হেফাজতে ইসলামের উপলব্ধি, চিন্তার ক্ষমতা ও ইতিহাস চেতনার তুলনায় কয়েক শ বছর পিছিয়ে আছেন!!
দৌড়ান!!! নইলে এই উপলব্ধির জায়গায় আসতে আপনাদের আরও কয়েকশ বছর লেগে যাবে।
২৯ মে ২০১৭। ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৪। শ্যামলী।