রুশ বিপ্লবে নারী
“নারী শ্রমিকরা বিপ্লবের সময় দারুন ভূমিকা রেখেছে। তারা না হলে আমরা জয়ী হতে পারতাম না”
-- ১৯২০ সালে ক্লারা জেটকিনের সাথে আলাপকালে লেনিন
রুশ বিপ্লবের শত বার্ষিকী পালন হচ্ছে। এই বিপ্লবের সঙ্গে আমাদের অনেক আবেগ, কল্পনা ও আশা জড়িয়ে ছিল। আমরা বিপ্লব দেখি নি, তার গল্প শুনে বড় হয়েছি। স্বপ্ন দেখেছি আমরাও পুরানা সমাজ ভেঙে নতুন ধরনের সমাজ বানাবো, যেখানে পুরুষতন্ত্র আমাদের টুঁটি টিপে ধরে রাখবে না। সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে পড়ার পর সেই কল্পনার জগতও ভেঙে পড়েছে। আশাভঙ্গ গত শতাব্দির সবচেয়ে বেদনাজনক দিক। আজ যে বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে আমরা খাবি খাচ্ছি তা যতোটা আমাদের কাবু করে তার চেয়ে অনেক বেশি কাবু করে আশাভঙ্গের বেদনা। আমরা সামনে দৃশ্যমান কিছু রেখে আর কাজ করতে পারছি না। কিন্তু এর ভাল দিক হচ্ছে নতুন ভাবে ভাবতে বাধ্য হওয়া এবং ইতিহাসের ভুলত্রুটি থেকে শিখে নতুন ভাবে কাজ করা। কোন ছক বা নকশা নয়, বরং বাস্তব অবস্থার বাস্তব সমাধানের পথ ধরে আমাদের এখন অগ্রসর হতে হবে।
রুশ বিপ্লব দেখি নি বটে, কিন্তু বিশ্বব্যাপী শতবার্ষিকী উদযাপন দেখে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। বিশ্ব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বাদ না দিয়ে তাকে পর্যালোচনার অধীন করা দরকারি কাজ। শত বার্ষিকী পালনের সময়ে বিপ্লবের পর্যালোচনা করতে কিংবা অন্যের পর্যালোচনা শুনতে বা পড়তে ভাল লাগছে। বলাবাহুল্য, রুশ দেশের এই বিপ্লব বাংলাদেশের প্রগতিশীল মানুষের মধ্যে অনেক প্রভাব বিস্তার করেছে। আমরা বড় হয়েছি এই বিপ্লবের কথা শুনে। মার্কস-লেনিনের কথা শুনলে মনে হয় তারা যেন আমাদেরও নেতা। তাদের আদর্শ ও দর্শন আমরা ধারণ করে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখি। কিন্তু নির্বিচারে সব কিছু মেনে নেওয়া তাঁদের দর্শন ছিল না। আমরা সেটা ভুলে যাই। তাহলে তাদের যোগ্য মর্যাদা দিতে হলে তাদের চিন্তা ও কাজেরও পর্যালোচনা একালে জরুরী। ইতিহাস এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আমাদের দিয়েছে।
বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের একজন সাধারণ কর্মী হিশেবে প্রশ্ন জাগে রুশ বিপ্লবের নেতৃত্ব কি শুধু পুরুষরাই দিয়েছিলেন? নিশ্চয়ই না। কারণ আমরা বেশ কয়েকজন নারীর কথা জানি যারা সরাসরি বলশেভিক পার্টির সাথে জড়িত ছিলেন, লেনিনের সাথে কাজ করেছেন। যেমন নাদেজদা ক্রুপস্কায়া, আলেকজান্দ্রা কল্লনতাই, ইনেসা আরমান্দ প্রমূখ। তাদের ভূমিকা কি শুধু লেনিনের সহযোগী হিশেবে? কিম্বা নারীর ভূমিকা স্রেফ পুরুষ কমরেডদের সহযোগিতা মাত্র?
ইতিহাস পুরুষ দ্বারা রচিত – কথাটা ক্লিশে শোনাতে পারে, কিন্তু ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে নারীর অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পুরুষকেন্দ্রিক চিন্তা ও পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার অভিপ্রকাশ তাতে কোন সন্দেহ নাই।। রুশ বিপ্লবের ইতিহাস রচনার মধ্যেও তার প্রকশ আমরা দেখি। অথচ রুশ বিপ্লবের ইতিহাসে নারীদের ভুমিকা ও অবদান জানা জরুরী।সেই ক্ষেত্রে কাজ হয়েছে খুবই কম। জানা দরকার শুধু নারীর অবদানের যথাযোগ্য স্বীকৃতি ও নারীর প্রতি সুবিচারের জন্য নয়, বিপ্লবী কালপর্বের মধ্যে নারী-পুরুষ সম্পর্কের বাস্তব ধরণ পর্যালোচনা অতীতের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার জন্যই দরকার। আমরা ব্রিটিশ বিরোধি আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও নারীকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখেছি। নারী ভুতুড়ে কারনে সমাজ বা ইতিহাস থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
রুশ বিপ্লবের প্রেক্ষিত একদিনে তৈরি হয়নি। উনিশশ’ সতেরো সালের বিপ্লবের আগে জার শাসনামলে রাশিয়াতে নারীর অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। তাদের কোন অধিকার ছিল না, পুরুষরা তাদের দাসী মনে করতো, স্বামী স্ত্রীকে পিটাবে এটাই ছিল স্বাভাবিক, তাদের স্কুলে পাঠানো হোত না। কোন মেয়ে স্কুলে যেতে শুরু করলেও তাকে ১ বছরের মাথায় ঝরে পড়তে হোত। মেয়েদের স্বাক্ষরতার হার ১৮৯৭ সালের প্রতিবেদনে ছিল মাত্র ১৩%। অল্প বয়সী মেয়েদের (মাত্র ১২ – ১৪ বছর বয়স) দিয়ে ঘরের কাজ, কৃষি কাজ এবং ফ্যাক্টরীতে কাজ করানো হোত। নামমাত্র মজুরিতে তাদের ১৮ ঘন্টা খাটতে হোত। এই ছিল শ্রমজীবী নারীদের অবস্থা, যাদের অংশগ্রহণ এবং যাদের অবস্থা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন স্বয়ং পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং বিপ্লবের সুনির্দিষ্ট রূপ নিয়ে ভেবেছেন। (আগ্রহীরা আরও জানার জন্য Marie Frederiksen-এর সাম্প্রতিক লেখা ‘রুশ বিপ্লবের আগে ও পরে নারী’লেখাট পড়তে পারেন)।
তবে রাশিয়ার সব নারীদের অবস্থা একরকম ছিল না। ধনি পরিবারের নারীদের সীমিত হলেও শিক্ষার সুযোগ ছিল। শ্রেণী বৈষম্যের কারণে নারীদের একাংশ কিছুটা শিক্ষাসহ অন্যান্য সুবিধা পেলেও বিপ্লবের আগে কোন শ্রেণীর নারীরই ভোটের অধিকার ছিল না, এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কোন রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োজিত হবেন তার সুযোগও ছিল না।
উনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে গ্রাম থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নারীরা শহরে আসতে শুরু করেন কারখানা কিংবা বাসাবাড়ীতে গৃহস্থালী শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্যে। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ্বের (১৯১৪) সময় বড় বড় কারখানায় সারা দেশ থেকে অনেক বেশি সংখ্যক গরিব নারী শ্রমিক হয়ে কাজে যোগ দেন। বিশেষ করে বস্ত্র কারখানায় বেশির ভাগ শ্রমিকই ছিলেন নারী। মেটাল কারখানায় মেয়েদের সংখ্যাও বাড়ছিল। শ্রমিক নারীদের সংখ্যাবৃদ্ধির কারণে তারা বিপ্লবের বিশাল শর্ত হয়ে ওঠেন। যদিও কারখানার কাজের পরিবেশ অত্যন্ত কঠিন ছিল, তবুও গ্রামে নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক আচরণের কারনে কারখানার কাজকে নারীরা অনেক বেশি স্বাধীন বলে গ্রহন করেন। একইভাবে কারখানার কাজ করতে এসেও পুঁজিতান্ত্রিক শোষণের কারণে নারী শ্রমিকদের মধ্যে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চিন্তা গড়ে ওঠে। বিপ্লবে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সেই সোশাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট শুরুতেই নারী শ্রমিকদের নিয়ে পাঠচক্র করেন এবং সেখানে নারীদের অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য বিপ্লবী রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনা ১৮৮০ সাল থেকে শ্রমিক নারী এবং শিক্ষিত নারীদের মধ্যে জনপ্রিয় হতে শুরু করে। সেই সময় মার্কসের চিন্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও তাঁরা নিজেদের কমিউনিস্ট না বলে সোশ্যাল ডেমক্রাট বলতেন। যেসব নারী উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন তাদের অনেকেই সোশাল ডেমক্রেটিক চিন্তা ধারা গড়ে তোলা এবং শহরে শ্রমিক নারীদের সাথে সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন। এদের মধ্যেই অনেকে পরবর্তী সময়ে বলশেভিক নেত্রী হিশেবে পরিচিত হয়েছিলেন। এইবিপ্লবী নেত্রীরা রবিবার ছুটির দিনে অল্প সংখ্যক শ্রমিক নারীদেরমধ্যেগ্রুপে গ্রুপেআলোচনা করতেন। তাঁরা শ্রমিক নারীদের দুর্দশার কথা শুনতেন। এই ধরণের পাঠচক্র স্কুল এবং কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়েও হোত। কিন্তু শ্রমিক নারীদের সাথে কাজ খুব দ্রুত ফলাফল বয়ে আনে। ১৮৯০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বস্ত্র কারখানায় ধর্মঘট হতে শুরু করে।
নারী নেত্রীদের গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন কনকরদিয়া নিকোলাভনা সামোইলোভা (Konkordiia Nikolavna Samoilova –১৮৭৬-১৯২১), যার কোড নাম ছিল ‘নাতাশা’; নাদেজদা ক্রুপস্কায়া(NadezhdaKrupskaia) এবং ইনেসা আরমান্দ(Inessa Armand) প্রমুখ। এরা ১৯১৪ সালে সদ্য ঘোষিত নারী দিবস উপলক্ষে রাশিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক নারীদের পত্রিকা রাবোনিৎসা বা‘নারী শ্রমিক’(Rabotnitsa ,The Woman Worker) প্রকাশ করেন। এই পত্রিকা শ্রমিক নারীদের অবস্থা তুলে ধরে ।
১৯১৭ সালের মার্চ মাসে পেট্রোগ্রাডে রাশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নারীদের মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এই মিছিলে ৪০,০০০ নারী অংশগ্রহণ করেছিলেন; নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাশিয়ার প্রথম মহিলা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এবং লীগ ফর উইমেনস ইকুয়েল রাইটস এর সভানেত্রী পলিক্সেনাশিসখিনা-লাভিয়েন(PoliksenaShishkina-Iavein)। একই (১৯১৭) বছর জুলাই মাসে ২০ বছরের অধিক বয়সী নারীদের ভোটের অধিকার দেয়া হয়। এই অধিকার নারীরা প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন নভেম্বর মাসে গণপরিষদের(Constituent Assembly) নির্বাচনের সময়। নারীরা ভোটের অধিকার প্রয়োগে এতই উৎসাহী ছিলেন যে অনেক স্থানে ভোট দেয়ার জন্যে পুরুষের তুলনায় নারীদের সংখ্যাই বেশি ছিল।
ইতিহাসবিদগণ একটি বিষয়ে একমত যে ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে পেট্রোগ্রাদে ২৩ ফেব্রুয়ারি নারীদের বিক্ষোভ মিছিলের মধ্য দিয়ে।এই তারিখ রুশ দেশে পুরানা কায়দার সনতারিখের পঞ্জিকার হিসাবে। আধুনিক বা গ্রেগারিয়ান ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী যা আসলে ৮ মার্চ। ঐ তারিখে হাজার হাজার নারী রুটি এবং সৈন্যদের জন্যে রেশন বাড়ানোর দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ্বের সময় অনেক পরিবারের পুরুষ সদস্য যুদ্ধে গিয়েছিল। পুরুষবিহীন পরিবারে নারীদের ওপরই সংসারের ভার ছিল। নারী দিবসে তাদের মৌলিক চাহিদার দাবি তাই রাজনৈতিক ভাবে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। নারী দিবসে নারীরা সকাল সকাল রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে এবং মিছিল সংগঠিত করে। তারা মিছিলে অংশ নেয়ার জন্য পুরুষদেরও আমন্ত্রণ জানায়।
তেইশ ফেব্রুয়ারি নারীদের ডাকে কমপক্ষে ১ লক্ষ মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল। তাদের দাবী ছিল “রুটি”। তাদের দাবী ছিল ভাল রেশন দিতে হবে এবং যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। বলশেভিক নেত্রী আলেকজান্দ্রা কল্লনতাইএই বিক্ষোভ সভায় বক্তৃতা করেন।
রাশিয়ার রাজধানী পেট্রোগ্রাদের মানুষ ক্ষুধার্ত ছিল। নারীদেরই রুটির যোগান দিতে হচ্ছিল। তারা তীব্র শীতের মধ্যে ঘন্টার পর ঘন্টা রেশনের লাইনে একটু রুটি পাওয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতেন; অনেক সময় এতো কষ্ট করেও রুটি পাওয়া যেতো না। যুদ্ধই তাদের এই দুর্দশার জন্যে দায়ী। কাজেই যুদ্ধ্ শেষ করা তাদের প্রধান দাবী হয়ে উঠেছিল। তারা যুদ্ধ বিরোধী শ্লোগান দিয়েছিলেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হওয়া নারীদের সম্পর্কে পুলিশের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, তারা পুলিশের দিকে লক্ষ্য করে উচ্চ কন্ঠে বলেছেঃ
“তোমরা আর বেশি দিন আনন্দ করার সুযোগ পাবে না – শীঘ্রই তোমাদের গলায় ফাঁসির দড়ি পড়বে”
"You don't have long to enjoy yourselves - you'll soon be hanging by your necks!"
(Anna Hilyar, Jane McDermid, 20000, p. ১৫২)
কিন্তু এখানেই নারীদের অবদান থেমে থাকে নি। শ্রমিক নারীরা এবং বলশেভিক পার্টির কর্মীরাঅক্টোবর বিপ্লব পর্যন্ত অনেক ধর্মঘট ও মিছিল অনুষ্ঠিত করেছিলেন।
বলশেভিকমূখপত্র পত্রিকা প্রাভদা লিখেছিল “বিপ্লবের প্রথম দিন ছিল নারী দিবস...... নারীরাই সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলেছিল সৈন্যদের ভাগ্যে কি আছে; তারা ব্যারাকে যায়, সৈন্যদের সাথে কথা বলে, এবং শেষে এসে বিপ্লবে যোগদান করে। নারী, তোমাদের সালাম জানাই।”
নারীদের যে মিছিল বিপ্লবের সূচনা ঘটিয়েছিল
রুশ বিপ্লবে নারীর ভুমিকাকে শ্রেণির দিক থেকে বোঝার দরকার রয়েছে। নারী বলেই তদের চিন্তা, রাজনৈতিক অবস্থান ও ভূমিকা এক রকম ছিল না। বলা বাহুল্য, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে (১৯১৪ থেকে ১৯১৮) রাশিয়ার অংশগ্রহণের কারণে রাশিয়ার আর্থ-সামাজিক অবস্থা রাজনীতিতে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। নারীদের বেশিরভাগই পারিবারিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। অনেক পরিবারের পুরুষ সদস্যরা সৈনিক হিশেবে যুদ্ধে গিয়েছিলেন এবং তাদের অনেকেই নিহত হয়েছিলেন। তার নেতিবাচক প্রভাব নারীদের ওপর খুব জোরালোভাবে পড়ে। রাজনৈতিকভাবে দেখা যায় রাশিয়ার সোশাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির দুটি অংশ বলশেভিক (সংখ্যাগুরু) এবং মেনশেভিক (সংখ্যালঘু) দুভাবে যুদ্ধ সম্পর্কে অবস্থান নিয়েছিল। বলশেভিক পার্টি যুদ্ধের বিপক্ষে এবং মেনশেভিকরা যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়। যুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান শ্রেণীগতভাবেও নারীদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়। বুর্জোয়া নারীরা মেনশেভিকদের অবস্থানের সাথে এবং শ্রমিক নারীরা বলশেভিকদের সাথেই যুদ্ধের বিরোধিতা করে। অন্যদিকে, বুর্জোয়া নারীদের একটি অংশ উইমেনন্স ব্যাটালিয়ন গঠন করে। তারা২৫ অক্টোবর লেনিনের বলশেভিকদের রুশ সরকারের ওপর আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়।বিপ্লবে নারীর ভূমিকা বুঝতে হলে শ্রেণির দিকটিকে উপেক্ষা করা চলে না। (দেখুন, 'রুশ বপ্লবে মেয়েদের স্মৃতিকথা' )।
তবে ঐতিহাসিকদের দাবি যে রুশ বিপ্লবে নারীদের ভুমিকা “দাই মায়ের” বা ইংরেজীতেমিডওয়াইফ-এর ভুমিকার মতো– এর পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। দাই মায়েরা সন্তান জন্মের শুরু থেকে প্রসব পর্যন্ত সকল পর্যায়ে পাশে থাকেন, তেমনি রুশ বিপ্লবের প্রতিটি পর্যায়ে নারীর অবদান খুঁজে পাওয়া যায়, যদিও পরবর্তীকালের লিখিত ইতিহাসে সে অবদানের উল্লেখ খুবই স্বল্প। এ বিষয়ে জেন ম্যাকডারমিড এবং আনা হিলিয়ার বিস্তারিত পর্যালোচনা করেছেন (Jane McDermid, Anna Hilayar, 1999)। এই গ্রন্থ রুশ নারী আনার দেয়া তথ্যের ওপর রচিত। রুশ বিপ্লবের সময় এবং তারপর পরবর্তীকালে নারীর অবদানের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এখানে আছে। বইটি লেখার সময় আনা যুক্তরাজ্যে ছিলেন।
গ্রন্থটির নামকরণের মধ্যে বিপ্লবে নারীর ভূমিকা নতুন ভাবে দেখবার একটা পদ্ধতি লক্ষ্য করা যায়। নারীর ভূমিকাকে মায়ের সাথে তুলনা না করে দাইমায়ের সাথে তুলনা করা হয়েছে। সন্তান সম্ভবা নারীর পাশে দাই মা যেমন সার্বক্ষণিক সেবা করেন এবং সন্তান প্রসব এবং প্রসব পরবর্তী সময়ে নবজাতক ও প্রসুতি মায়ের সেবা করে তাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা হয়, তেমনি রুশ নারী বিপ্লবীরাও রাশিয়ার সমাজ গঠনে ভূমিকা রেখেছিলেন। তারা একদিকে সাধারণ নারীদের সমস্যা চিহ্নিত করেছেন অন্যদিকে উচ্চ পর্যায়ের বুদ্ধিজীবী নারীদের ভুমিকাও তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে বলশেভিক নারী এবং নারী শ্রমিকদের সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। নারীর ভুমিকা দেখাতে গিয়ে এই দুইজন কোন প্রকার বাড়াবাড়ি না করে দেখিয়েছেন নারীরা রুশ বিপ্লবের অখণ্ড অংশীদার ছিলেন, তারা শুধু পুরুষদের বিপ্লবের আগুনে তেল ঢালেন নি(Jane McDermid, Anna Hilayar, 1999, p. ২৩৯)।
শুধু তাই নয়, বিপ্লবের পরে ১৯১৯-২০ সালে রাশিয়ার গৃহ যুদ্ধের সময়ও নারীদের ভুমিকা উল্লেখ যোগ্য ছিল। বলশেভিক সরকার নারীদের জীবনে বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন। নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক সকল আইন বাতিল করা হয়, তাদের স্বাধীন চলাচলে বাধাগুলো দূর করা হয়। সম্পত্তির সম্পর্কে পরিবর্তন আনা হয়, এবং জমির মালিক হওয়ার অধিকার দেয়া হয়। পরিবারে বাবার মূখ্য ভুমিকা পরিবর্তন করা হয়, নারী নিজেই পরিবার প্রধান হতে পারেন।
আলেকজান্দ্রা কল্লনতাই জনপ্রতিনিধি হিসেবে এবং বলশেভিক সরকারের প্রথম নারী কর্মকর্তা ( People's Commissar of Social Welfare) নিয়োজিত হয়েছিলেন। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় আলেকজান্দ্রা সক্রিয় ছিলেন। তিনি বিশ্বের প্রথম নারী মন্ত্রী হয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে ফেমিলি কোড ১৯১৮ প্রণীত হয় যেখানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত হয়। ধর্মীয় আইনের বাইরে বিয়ে (secularised marriage) বা চার্চের বাইরে রেজিস্ট্রেশানের মাধ্যমে পরস্পরের সম্মতিতে বিয়ের নিয়ম করা হয়। স্বামী বা স্ত্রী পরস্পরের নাম গ্রহণ করার বিধান করা হয়। বিবাহ বিচ্ছেদ সহজ করা হয়, এবং গর্ভপাত বৈধ করা হয়। আলেকজান্দ্রা কল্লনতাই, ইনেসা আরমান্দ ও নাদেজদা ক্রুপস্কায়ার নেতৃত্বে নারী শ্রমিকদের মধ্যে বিপ্লবের কথা প্রচার করা এবং তাদের জনজীবনে এবং বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করাবার জন্যে ঝেনোটডেল (Zhenotdel) বা উইমেন্স ব্যুরো ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আধুনিক কালে নারী অধিকার আন্দোলনে গর্ভপাতের সুযোগের অধি্কার অনেক পরে এসেছে, কিন্তু রুশ দেশে বিপ্লবের পরেই তা নিশ্চিত করা হয়। জারজ সন্তানের ধারণা বিলুপ্ত করা হয় যেন সকল শিশু পূর্ণ সামাজিক মর্যাদাসহ অন্য শিশুর সঙ্গে সকল সামাজিক অধিকারসহ সমানভাবে লালিত পালিত হতে পারে। গর্ভবতী নারী এবং সদ্য সন্তান প্রসব করেছেন এমন নারী শ্রমিকের রাতের কাজ নিষিদ্ধ করা হয়। হাসপাতালে বিশেষ মেটারনিটি ওয়ার্ড তৈরী করা হয়।
রুশ বিপ্লবে নারীর অবদানের স্বীকৃতি এবং অর্জন এটা প্রমাণ করে যে বিপ্লবে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা শুধুমাত্র জারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়েন নি, তারা একই সঙ্গে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও চিন্তা চেতনার বিরুদ্ধেও লড়েছেন। তাই বিপ্লবের পরে সেই ব্যবস্থাকে শোধরাবার সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপও তারা নিয়েছেন। এর জন্যে অবশ্য বলশেভিকনেত্রীরা এবং লেনিন নিজে খুবই সচতন ছিলেন বলেই সম্ভব হয়েছে। যে পদক্ষেপ তারা প্রায় ১০০ বছর আগে নিয়েছেন সেই পদক্ষেপের কথা ইওরোপ ও আমেরিকা মাত্র ৫০-৬০ বছর আগে ভাবতে শুরু করেছে, কার্যকর করাতো দূরের কথা। বর্তমান বিশ্বে রুশ নারীবাদীদের কথা শোনা না গেলেও নারীমুক্তির ভিত্তি তাঁরাই তৈরী করে দিয়েছেন। এখানেই যেমন রুশ বিপ্লবের গৌরব, একই সঙ্গে তা নারীর মুক্তির লড়াইয়ের ঐতিহাসিক কালপর্ব। এই স্বীকৃতি আজ তাদের দিতেই হবে। রুশ বিপ্লবের একশ বছর পালন করতে গিয়ে কমিউনিস্ট নারীদের এই বৈপ্লবিক অবদান স্বীকার ও পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই বিশ্বব্যাপী নারী মুক্তি আন্দোলনের ধারার বিকাশ সম্ভব।
কিন্তু রাশিয়ার পরবর্তী ইতিহাস নারীর জন্যে খুব সুখের নয়। বিপ্লব অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছিল কিন্তু ধরে রাখতে পারেনি। স্টালিনের শাসন আমলে বিপ্লবে অর্জিত নারীর প্রগতিশীল ভূমিকা খর্ব করা হয়। নারী নেত্রীরা যে সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর কর্মসূচী ও পদক্ষেপ নিয়েছিলেন আমলাতান্ত্রিক শাসনের জন্যে তা অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছে। পুরানা পুরুষতান্ত্রিকবুর্জোয়া পরিবারের ধারণা টিকিয়ে রাখাটাই জরুরি ছিল। তারা ঘোষণা দিয়ে দিলেন সমাজতন্ত্র কায়েম হয়ে গেছে, কাজেই আর বিশেষ সুযোগ সুবিধা রাখার দরকার নাই।
প্রথমত, রুশ সরকার ঝেনোটডেল (Zhenotdel)বা উইমেন্স ব্যুরো ১৯৩০ সালে ভেঙ্গে দেয়। যার প্রধান ভুমিকা ছিল নারী অধিকার রক্ষার সকল আইনী ও প্রসাশনিক বিষয়ে নজরদারি করা। সরকার মনে করেছে তাদের দায়িত্ব সম্পূর্ণ হয়েছে। এর ফলে ১৯৩০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে দেখা যায় সমাজ এবং পরিবারে পুরানা সামন্তীয় ও পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা আবার ফিরে আসে। বিশেষ করে গর্ভপাত অবৈধ ঘোষণা করা হয়, স্বাভাবিক এবং জারজ সন্তানের পার্থক্য বলবৎ করা হয়, বিবাহ বিচ্ছেদ আবার জটিল হয়ে পড়ে। নারীকে পু্নরায় পরিবারের মূখ্য করা হয় এবং স্বামীর স্বার্থে সব কিছু ত্যাগ করায় গৌরবান্বিত করা হয়। নারীর মাতৃত্বের ভুমিকাই প্রধান হয়ে ওঠে। তবে স্টালিনের মৃত্যুর পর ১৯৫৫ সালে গর্ভপাত পুনরায় বৈধ করা হয়। ১৯৭৭ সালের সোভিয়েত সংবিধানে জন জীবন এবং পারিবারিক জীবনে নারীর অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে। তবে motherhood বা মাতৃত্ব রাশিয়ার সংবিধানে নারীর যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তা পুরুষতান্ত্রিক চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ।
রাশিয়ার নারীদের অবস্থা বর্তমানে কেমন? এক কথায় উত্তর হচ্ছে অন্যান্য দেশের তুলনায় খুব একটা ভাল নয়। রাশিয়ার নারীরা অর্থনৈতিক কাজে জড়িত কিন্তু বেশির ভাগই মজুরি পুরুষের তুলনায় কম; স্বাস্থ্য খাতে ৪০ থেকে ৫০% কম, নারী ইঞ্জিনীয়ার পুরুষের চেয়ে ৪০% কম বেতন পায়। তবুও নারীরা শিক্ষায় পুরুষের তুলনায় এগিয়ে আছে; কিন্তু প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনায় তাদের কম দেখা যায়। চাকুরীচ্যুত করার সময় নারীদের আগে করা হয় আর চাকুরিতেথাকাকালীন সময়ে বৈষমাই তো চলছেই। নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং শিশু যত্ন সেবা আইনত দিতে বাধ্য বলে কোম্পানিগুলো নারীদের চাকুরি চ্যুত করাকেই সমাধান হিশেবে বেছে নেয়। ফলে নারীদের মধ্যে বেকারত্ব বেড়ে যাচ্ছে।
পরিশেষে বলতে চাই, অক্টোবর বিপ্লবে নারীদের অংশগ্রহণ এবং নীতি নির্ধারণে তাদের প্রাধান্য রাজনীতির অন্তর্গত তাগিদেই গড়ে উঠেছিল। নারী মুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোকে সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট নারীরা সামনে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন যা সারা বিশ্বের নারী মুক্তির জন্যে উদাহরণ হয়ে আছে। পুরুষতান্ত্রিক এবং পশ্চাতপদ অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও চিন্তা সমাজ থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলা সম্ভব হয়নি বটে, তবে বিপ্লব নারীকে গৃহস্থালী কাজ থেকে মুক্তি , সমাজে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা, শিক্ষা ও সচেতনতায় অগ্রসর ভুমিকা রাখার বাস্তব শর্ত তৈরি -- ইত্যাদির মধ্য দিয়ে নারী পুরুষের সম্পর্ক নতুন ভাবে গড়বার সম্ভাবনাকে হাতে নাতে দেখিয়ে দিয়ে গেছে।
ঠিক যে, নারী মুক্তির ধারনা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির এক নয়, বিপ্লব নারী প্রশ্নকে পুরাপুরি সামাধান করে দিয়ে গেছে তাও নয়, কিন্তু অক্টোবর বিপ্লবের অভিজ্ঞতা এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিয়ে একালে নারী মুক্তি আন্দোলন এগিয়ে যেতে পারবে না। ফলে যারা নারী মুক্তির সংগ্রামে আন্তরিক তাঁরা অবশ্যই অক্টোবর বিপ্লবের এক শত বছর উদযাপনে উদ্দীপ্ত হবেন, এতে কোন সন্দেহ নাই, এটাই স্বাভাবিক। রাশিয়ার নারী নেত্রীরা এবং শ্রমিক নারীরা যে সাহস এবং দৃঢ়তা দেখিয়েছেন তা নারী মুক্তি নিয়ে স্রেফ তত্ত্ব কথা ছিল না বরং তারা বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড এবং বিপ্লবোত্তর সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে বাস্তব নজির রেখে গিয়েছেন, তাকে ধারণ করেই আগামি দিনে নারী মুক্তি আন্দোলনকে অগ্রসর হতে হবে। এড়িয়ে গিয়ে নয়। সে কাজ চলছে এবং চলবে।
২৪ অক্টোবর ২০১৭। ৯ কার্তিক ১৪২৪। শ্যামলী
... ... ...
সূত্র
Anna Hilyar, Jane McDermid. (2000)
Revolutionery Women in Russia 1870-1917: A Study in Colective Biography.Manchester: Manchester University Press.
Jane McDermid, Anna Hilayar. (1999)
Midwives of Revolution: Female Bolsheviks&Women Workers in 1917.New York: Taylor&Francis.