কলা আর ছাগল, ধর্ম নয়: গ্রামে জীবিকার দ্বন্দ্ব
পদ্মার চর সংলগ্ন কল্যাণপুর গ্রামে গরিব নারীদের প্রধান আয়ের উৎস ছাগল পালন। এই গ্রামে ২৫ থেকে ৩০ টি পরিবার ছাগল পালন করেই সংসার চালান। এদের জায়গা জমি নেই। এই সব পরিবারের পুরুষরা ইটের ভাটায় অথবা ভ্যান চালানোর কাজ করে। গ্রামটি কুষ্টিয়া জেলায় কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নে অবস্থিত। ইতিমধ্যে গ্রামটি মিডিয়াতে পরিচিত হয়ে গেছে ‘ফসলের ক্ষেতে নারীদের যাওয়া নিষেধ’ এই শিরোনামে। এদিকে এই গ্রামের কৃষকের প্রধান ফসল কলার আবাদ। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কৃষকেরা কলার আবাদ করে। বাণিজ্যিক চাষে কৃষকদের কলা চাষে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে হয়। কাজেই কলার বাগানে কোন প্রকার সমস্যা হলে তাদের বড় লোকসান গুনতে হয়।
ছাগল পালনের জন্য আলাদা কোন তৈরী খাদ্যের জন্য খরচ করতে হয় না ঠিকই, কিন্তু এই ছাগলকে অবশ্যই খাওয়াতে হয়। ছাগলের একটি প্রিয় খাদ্য হচ্ছে কাঁঠাল পাতা। কিন্তু কল্যাণপুরে কাঁঠাল গাছ খুব কম, নেই বললেই চলে। গাছ বলতে আছে মেহগনি গাছ, যা এতো উঁচু যে নারীরা সহজে নাগাল পায় না যে ছাগলের জন্য পাতা সংগ্রহ করবে; পতিত জায়গাও খুব কম যেখানে ছাগল বেঁধে খাওয়াবে বা ঘাস কাটবে। তাই তাদের একমাত্র ভরসা এই কলার পাতা। সারি সারি কলা গাছ থেকে পাতা এনে এই নারীরা তাদের ছাগলকে খাওয়ায়। অনেক সময় কলা গাছে দুই একটি পাতা রেখে সব পাতা কেটে নিয়ে আসে। কলার মোচা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই কেটে নিয়ে আসে ছাগলকে খাওয়ানোর জন্য। এতে কলার গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে এমনকি মারা যায়। অনেক গাছে কলা ধরে না আবার অনেক গাছে দুর্বল কলা ধরে। এতে কৃষকের ক্ষতি হয়।
এই দুই ভিন্ন জীবিকার লড়াইয়ে কৃষক এবং ভূমিহীন ছাগল পালন কারী নারীদের মূখোমুখি অবস্থান। কৃষক তার কলার বাগান রক্ষা করার জন্যে উদ্যোগ নিয়েছে। এই ঘটনা এবার শুধু নয়, বেশ কয়েকবছর ধরে চলছে। ছাগলকে খাওয়ানোর জন্যে কলার পাতা ও গাছ কাটা প্রতিরোধের জন্য প্রতি বছর সমাজের কিছু মানুষ, বিশেষ করে কৃষক, তাদের ফসল রক্ষার্থে পালাক্রমে ফসলের মাঠ পাহারা দেন। এবং আরো একটু শক্তভাবে বন্ধ করার জন্যে মসজিদের মাইকের সাহায্যে ঘোষণা দেন “আগামী দুই বা এক মাসের মধ্যে কোন নারী ক্ষেতে যেতে পারবে না”। এই ধরণের ঘোষণা আগেও দেয়া হয়েছে। এভাবে কড়াকড়ি ঘোষণা দিলে কিছুদিন কম থাকে। ফসল উঠে যাবার পর আবার নারীরা মাঠে যেতে পারে। গত ৭/৮ বছর ধরে আশে পাশে কয়েকটি গ্রামে এভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়। মোট কথা হচ্ছে বিষয়টা মেয়েদের মাঠে যাওয়া কেন্দ্রিক নয়, কৃষকের কলার বাগান ছাগল পালনকারী নারীদের হাত থেকে রক্ষার জন্যে করা হয়েছে। ঘোষণাটি একেবারে সাময়িক সময়ের জন্যে। ছাগল পালন কারী নারীদের কষ্ট হলেও তারা বিষয়টা বোঝেন এবং গ্রামীণ সমাজের অন্তর্ভূক্ত বলে সংঘাতেরক্ষেত্র সম্পর্কে তাঁরা অবহিত, এর মনে করে এর মীমাংসা তাঁর সমাজেই সম্ভব। কয়েক মাস ছাগল সামলে রাখা সামাজিক মীমাংসার অংশ।
এবার ঘটনায় বিষয়টি এমন ভাবে প্রচার হয়েছে যেন মনে হতে পারে নারীদের ফসলের মাঠে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে। নারীদের ফসলের মাঠে যাওয়া নিষেধ করা হয়েছে মসজিদে মাইকিং করার মাধ্যমে। এমন কথা শুনতেও ভয়াবহ লাগে। এটাও তো গরিব নারীর জীবিকার ওপর হস্তক্ষেপ। এটা কাণ্ডজ্ঞানেই বোঝা যায় কোন অবস্থাপন্ন পরিবারের নারীর মাঠে গিয়ে কাজ করার নিশ্চয়ই প্রয়োজন পড়ে না। তাহলে এমন ঘোষণা স্পষ্টতই গরিব নারীর বিরুদ্ধ্বে। এটা শুধুমাত্র নারীর বিষয় নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে শ্রেণীর প্রশ্ন। কিন্তু দোষ দেবো কাকে?
গরিব নারীর দিক থেকে ঘটনাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরা সরেজমিন ঘটনাটির খোঁজ নিয়েছি। এবারের ঘটনা খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৮ই ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে শুক্রবারের দিন সমাজের ১০/১২ জন কৃষক মিলে আলোচনার মাধ্যমে মসজিদের ইমাম আলতাফ হুজুরকে দিয়ে মাইকে ঘোষণা দেন ‘আগামী দুই মাসের মধ্যে নারীরা ক্ষেতে যেতে পারবে না’। এই ঘোষণার পরিপেক্ষিতে নারীরা আর মাঠে যায়না। অর্থাৎ আগের বছর গুলোর মতোই ছাগল পালন কারী নারীরা তা মেনে নিয়েছেন। তাদের ছাগল পালন করা কষ্ট হলেও তাঁরা কৃষকের সমস্যাটাও বুঝেছেন। কিন্তু হঠাৎ ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিল। কে বা কারা এই ঘটনাকে বাড়িয়ে নারীরা মাঠে গেলে তাদের নাপাকের কারনে ফসল নষ্ট হয়,ফসল মারা যায়, কেউ কেউ বলেন নারীরা মাঠে গেলে পুরুষের দ্বারা নির্যাতিত হয়, নারীরা ধর্ষিত হয় ইত্যাদি বলে থানায় তথ্য দেয়, যার প্রেক্ষিতে ঐ গ্রামের মসজিদের দুইজন ইমাম আলতাফ হোসেন ও মুসা শেখ, মসজিদের সেক্রেটারি ও মাদ্রাসার শিক্ষক মতিয়ার রহমানসহ গ্রামের মোট ছয় জনকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। পত্র-পত্রিকায় ঘটনাটি ছাপা হয় ‘ফসলের ক্ষেতে নারীদের যাওয়া নিষেধ’। সারাদেশে যেখানে কৃষি কাজে নারীর অবদানের স্বীকৃতির জন্যে দাবী তোলা হচ্ছে, পরিসংখ্যানে পরিষ্কার দেখা যায় নারীরা কৃষি কাজের অধিকাংশ কাজ করছেন, সেখানে ফসলের মাঠে নারীদের যাওয়ার ওপর ফতোয়া দেয়া হলে অবশ্যই প্রতিবাদ করার কথা। কিন্তু ঘটনাটির গভীরে না গিয়ে না বুঝেই প্রতিক্রিয়া এসেছে।
এখানে বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। গ্রামের মানুষই ভেবে পাচ্ছে না কী এমন হোল যে এতো টেলিভিশন আসছে, সাংবাদিক আসছে! সবার মুখে একই কথা এ ঘোষণাতো প্রতিবছরই দেওয়া হয়, তবে এবার কি হলো? গ্রামের অধিকাংশ পুরুষ পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে, রাত্রে তারা নিজ বাড়ীতে ঘুমাতে পারছে না। সব নারীর মুখে একই কথা যেটা রটেছে সেটা গুজব। ইউপি সদস্য জাহানারা বেগম বলেন, নারীদের নিয়ে কোন খারাপ মন্তব্য করলে আমি একজন নারী প্রতিনিধি হয়ে ছেড়ে দিতাম না। আমরা নিজেরাও বুঝতে পারছি না এত পুলিশ,এতো সাংবাদিক কিসের জন্য আসছে! এটা শুধু মাত্র ফসল চুরি এবং গাছের ক্ষতির কথা ভেবে ঘোষণা দেওয়া। ইমাম সাহেব নিজের সিদ্ধান্তে তা করেন নি, তাঁর কোন দোষ ছিল না। তাকে এলাকার মানুষ ঘোষণা দিতে বলেছেন তাই দিয়েছেন। ইমাম সাহেবকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় ঐ মসজিদে আর ভয়ে কেউ আযান দিচ্ছে না, মানুষ নামাজ ও পড়ছে না।
অথচ ঘটনাটি ছিল দুই ধরণের জীবিকার সংঘাত। এবং বিশেষ করে গরিব নারীদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। কৃষকদের ক্ষতিও কাম্য নয়। এরা কেউই বড় কৃষক নন। তাঁরা ঋণ নিয়ে কলা চাষ করেন বিক্রি করে আবার ঋণ শোধ করেন। তার সমস্যাই বা কম কিসে? কে ভাববে কার কথা?
[ডলি ভদ্রের সরেজমিন প্রতিবেদন ( ১৪/১২/২০১৭) এর ওপর ভিত্তি করে লেখা।]