সব বাড়ে শ্রমিকের মজুরি বাড়ে না
গ্যাসের দাম বাড়ে, বিদ্যুতের দাম বাড়ে, বাড়ী ভাড়া বাড়ে, শুধু গার্মেন্ট শ্রমিকের মজুরী বাড়ে না। রানা প্লাজায় শ্রমিকদের জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল। যদি স্রেফ বেঁচে থাকা আর মজুরির তুলনা করা হয় তাহলে বলতে হয় গার্মেন্ট মালিকরা তিলে তিলে নিত্যদিনই শ্রমিকদের মারে। সে্টা কম ভয়াবহ নয়। রানা প্লাজার পাঁচ বচর পর্যালোচনা করতে এসে শ্রমিক নেতারা এই সময়ের গার্মেন্ট শ্রমিকদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যে মজুরি সেটাই বারবার জোর দিয়ে বললেন।
বর্তমানে গার্মেন্ট শ্রমিকরা যে বেতন পায় বাড়ী ভাড়া তার চেয়েও বেশি। দু’বছর আগে শ্রমিকদের জন্য সর্বনিম্ন যে মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা হলো ৫৩০০ টাকা। এই টাকা থেকে বাড়ি ভাড়া দিতে হচ্ছে চার হাজার টাকা। সেক্ষেত্রে বাড়ী ভাড়া দেয়ার পর তাদের হাতে বাড়তি কোন টাকা থাকে না। বিদ্যুৎ, গ্যাস, খাবার দাবার ও অন্যান্য জিনিষপত্রের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। শুধু তাই নয় বছরে তিন থেকে চারবার বাড়িভাড়া বাড়ছে। শ্রমিকেরা এরকম একটা অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এখনও অনেক জায়গায় শ্রমিকদের এই সর্বনিম্ম বেতনই দেয়া হয় না। গ্যাসের দাম বাড়ে, বিদ্যুতের দাম বাড়ে, বাড়ী ভাড়া বাড়ে, শুধু গার্মেন্ট শ্রমিকের মজুরী বাড়ে না।
২৪ এপ্রিল ২০১৩ রানা প্লাজা ধসে গিয়ে শ্রমিকদের জীবন্ত কবর দেওয়ার ভয়াবহ ট্রাজেডির পাঁচ বছরে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ এপ্রিল, ২০১৮ নারীগ্রন্থ প্রবর্তনায় বিকাল চার টায় এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গার্মেন্ট ফেডারেশনের প্রতিনিধিবৃন্দ এবং শ্রমিকেরা এ কথাই তুলে ধরেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন শামীমা নাসরীন, স্বাধীন বাংলা গার্মেন্ট শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন, রফিকুল ইসলাম সুজন, বাংলাদেশ গার্মেন্টস এন্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশন, সিরাজুল ইসলাম রনী, বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগ,মীর শাহনেওয়াজ,রোকাসানা আক্তার, বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগ,রেহানা বেগম, গার্মেন্ট শ্রমিক। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সেলিনা রশিদ,তামাক বিরোধী নারী জোট, রুবিনা রহমান, লেখিকা এবং রোকেয়া বেগম, স্বাস্থ্য আন্দোলন।
নারীগ্রন্থ প্রবর্তনায় রানা প্লাজার ভয়াবহ দুর্ঘটনা এবং বর্তমান শ্রমিকদের অবস্থা নিয়ে আলোচনা
দেশের রপ্তানী আয়ের সবচেয়ে বড় খাত পোশাক শিল্প। এই সেক্টরে ৪০ লাখেরও বেশী শ্রমিক কাজ করে যাদের বেশীর ভাগ নারী শ্রমিক। প্রায় ৫ হাজার পোশাক কারখানার মধ্যে অনেক কারখানায় ন্যূনতম মজুরী কাঠামো এখনও বাস্তবায়ন করা হয় নাই। দীর্ঘ শ্রমিক আন্দোলনের পরে ২০১৩ সালের ৪ নভেম্বর শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরী পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারিত হয়। ঘোষিত মজুরী অনুযায়ী প্রথম গ্রেড ৮ হাজার ৫০০ টাকা। দ্বিতীয় গ্রেড ৭ হাজার টাকা। তৃতীয় গ্রেড ৪ হাজার ৭৫ টাকা। চতুর্থ গ্রেড ৩ হাজার ৮০০ টাকা। পঞ্চম গ্রেড ৩ হাজার ৫০০ শত ৩০ টাকা। ষষ্ঠ গ্রেড ৩২ শো ৭০ টাকা এবং সপ্তম গ্রেড ৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অধিকাংশ কারখানায় এখনও ৭ম গ্রেড ছাড়া অন্য কোন গ্রেড অনুসরণ করা হচ্ছে না।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরীর ক্ষেত্রে চরম অবস্থা বিরাজ করছে। সবচাইতে কঠিন অবস্থা বিরাজ করছে বাড়ি ভাড়ার কারণে দিশেহারা শ্রমিকেরা। এ পর্যন্ত শ্রমিকদের বাড়ি ভাড়া প্রায় ২৫০০-৩০০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনি অবস্থার মধ্য দিয়ে শ্রমিকরা দিন যাপন দুঃসহ হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশে গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়। দ্বিতীয়ত সমাজে শ্রমিকদের অধিকারের প্রশ্নে চরম সংবেদনহীনতা বিরাজ করে। সব মিলিয়ে বলা যায় এক চরম বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। রানা প্লাজা উপলক্ষে শ্রমবিকাশের সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের প্রত্যকেই একমত যে বর্তমান দুঃসহ পরিস্থিতির প্রধান কারন বাড়ি ভাড়ার কারণে দিশেহারা শ্রমিক। স্রেফ বেঁচে থাকার জন্য যে ন্যূনতম মজুরি অবাধ বাজার ব্যবস্থার যুগে শ্রমিকের দরকার, সেটা কারখানার মালিক যেমন জেনেও জানতে চায় না, সরকারের দিক থেকেও সংবেদনা নাই বললেই চলে। পর্যন্ত শ্রমিকদের বাড়ি ভাড়া বাবদ প্রায় ২৫০০-কোন প্রকার মজুরি বৃদ্ধি ছাড়া শ্রমিকরা দিন যাপন করছে।
গার্মেন্ট সেক্টরে দেখা যাচ্ছে এখন প্রতি ৫ বছর পর পর শ্রমিকদের পে-স্কেল ঘোষণা হচ্ছে। কেবলমাত্র ঘোষণা হয়েছে যে গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরী বোর্ড গঠন করা হবে। গার্মেন্ট মালিকরা নিজেরাই ঘোষণা দিয়েছেন। শ্রমিকদের মধ্যে যাতে মজুরী বোর্ড গঠনের পূর্বে কোন রকম আন্দোলন,সংগ্রাম না হয়। আলোচকরা বলেন, এটা গার্মেন্ট মালিকদের একটা কৌশল। নতুন মজুরী বোর্ড গঠনের ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথেই এখন বাড়িওয়ালারা তোড়জোড় করে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বাসা ভাড়া বৃদ্ধি করে দিয়েছে। সরকার যখন পে-স্কেল ঘোষণা করে, সাথে সাথে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বাড়ি ভাড়াও বেড়ে যায়। বাড়ি ভাড়া এতটাই বাড়ে যে তা শ্রমিকদের নাগালের বাইরে চলে যায়।
গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু
গার্মেন্ট ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দরা বলছেন,শ্রমিকদের বেতন মজুরী হওয়া উচিত ১৫ হাজার টাকা থেকে ১৬ হাজার টাকা। শ্রমিকদের মজুরী শুধু সমাধান নয়, এখানে বাড়ীভাড়া নিয়ন্ত্রণের যে আইন রয়েছে তা প্রয়োগ করা জরুরী হয়ে পড়েছে। যাতে মজুরী বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ীওয়ালারা শ্রমিকদের হাত থেকে বাড়ী ভাড়া বাবদ টাকাটা নিতে না পারে। গার্মেন্ট শ্রমিকদের অনেকদিনের দাবী তাদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু রাখা হোক। যাতে শ্রমিকেরা রেশন পেয়ে ডাল,ভাত খেয়ে বাঁচতে পারে।
রানা প্লাজা ট্রাজেডির ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২৬ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে নারীগ্রন্থ প্রবর্তনায় শ্রমবিকাশ কেন্দ্র আয়োজিত মতবিনিময় সভার আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি তুলে ধরেন। রানাপ্লাজায় শ্রমিকদের জীবন্ত কবর দেওয়র ট্র্যাজেডির ৫ বছর পরে এখনও অনেক আহত শ্রমিক চিকিৎসার অভাবে মানবেতন জীবন যাপন করছে। গার্মেন্ট শ্রমিকদের দাবী এই অসহায় আহত শ্রমিকদের চিকিৎসার ভার সরকার কে নিতে হবে এবং এপ্রিল মাসের ২৪ তারিখ গার্মেন্ট শ্রমিক শহীদ দিবস এবং সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা করতে হবে।