ঘাস
থাইল্যান্ডের রাজকুমারী মহাচক্রী সিরিধরন চট্টগ্রামে ঘাস রোপন করছেন, এই ছবিটি আমার মনে গভীর ভাবে দাগ কেটেছে। ঘাস রোপন করা যে একটি রাজকীয় কর্ম হতে পারে রাজকুমারির বিন্না ঘাস রোপন দিয়ে বুঝতে পারছি। কিন্তু এই রাজকীয় বার্তা সবার কাছে এবং সর্বদিকে ঠিকমতো পৌঁছালো কিনা হলফ করে বলতে পারব না। আমার ভাল লাগছে। প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করি বলে ঘাসের প্রতি আমার মমতা অতিশয় গভীর, রীতিমতো আধ্যাত্মিকতার স্তরের মায়া বলা যায়। তাই এখন তুচ্ছ ঘাস নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করব।
ঘাস রোপন 'বিন্না ঘাস উন্নয়ন কেন্দ্র' উদ্বোধনের অংশ। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বিন্না ঘাস ব্যবহার করে পাহাড়ে ভূমিক্ষয় রোধ করা। চট্টগ্রামের টাইগারপাস এলাকায় বিন্না ঘাস উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় 'বিন্না ঘাস উন্নয়ন কেন্দ্র' রাজকুমারী সিরিধরন উদ্বোধন করেছেন। রাজকুমারী টাইগার পাসের বাটালি হিল মিঠা পাহাড়ের পাদদেশে এক অনুষ্ঠানে অতিথিদের হাতে বিন্না ঘাস তুলে দেন। তারপর পাহাড়ের পাদদেশে বিন্না ঘাস প্রদর্শনী প্লট ঘুরে দেখেন। পাহাড়ের পায়ের দিকে বিন্না ঘাসের চারা রোপন করে তিনি বিন্না ঘাস উন্নয়ন কেন্দ্র উদ্বোধন করছেন সেই ছবি পত্রিকায় এসেছে। অঞ্চলভেদে বিন্না ঘাসের আরও নাম আছে। যেমন, বেনা ঘাস, গন্ধবেনা, বেনামূল, ইত্যাদি। অন্যন্য দেশে 'খুশখুশ' নামেও ঘাসটি পরিচিত। অনুষ্ঠানটির মর্মে রাজকীয়তার চেয়েও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ও উন্নয়ন সহযোগিতার রেশই প্রধান। থাইল্যান্ডের সাইপাট্টানা ফাউন্ডেশন বিন্না ঘাস উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপনে সহায়তা দিচ্ছে, তাই রাজকুমারির করস্পর্শ সঞ্জাত ঘাস রোপনের অনুষ্ঠান। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।
বিন্না ঘাস (Vetivera zizanioides অথবা Chrysopogon zizanioides) লাগানো একটি 'প্রযুক্তি'। তাই এই প্রকল্পের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগকে যুক্ত দেখছি। এটা তাহলে 'গ্রিন টেকনলজি' বা সবুজ কারিগরি। যান্ত্রিক বা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কারিগরির সঙ্গে এর ফারাক হচ্ছে সপ্রাণ প্রকৃতিকে নিষ্প্রাণ বস্তু, কাঁচামাল বা উৎপন্নে পর্যবসিত করা নয়, বরং প্রাণ ও প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ও শক্তিকে কাজে লাগাবার কারিগরি। বিন্না ঘাস দেখতে শনের পাতার মতো কিন্তু এর শেকড় অনেক লম্বা হয় আর মাটি ভেদ করে চলেও যেতে পারে বহু দূর। ঘাসের এই প্রাকৃতিক শক্তির ফলে মাটীর ক্ষয় রোধ হয়। খুবই গুরুত্বপূর্ণ গুণ। চট্টগ্রাম নগর করপোরেশান তাহলে পাহাড়ের ক্ষয় রোধ করবার জন্যই বিন্না ঘাস প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই ঘাসের সুবিধা হচ্ছে চার থেকে ছয় মাসের মধ্যেই আট থেকে দশ ফুট মাটির গভীরে ঘাসের শিকড় চলে যায়। একটি শিকড়ের সহনশক্তি ইস্পাতের ছয় ভাগের এক ভাগ। প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও বিন্না ঘাসের বেঁচে থাকার ক্ষমতা অসাধারণ। পাহাড়ের ক্ষয় রোধ করার জন্য সবুজ কারিগরি হিশাবে বিন্না ঘাস তাহলে মন্দ নয়। জবরদস্ত।
কিন্তু চট্টগ্রামের জন্য এই সবুজ কারিগরি শেষাবধি পা কেটে ক্রাচে হাঁটবার টেকনলজি। কারন পাহাড় কেটে ফেলার দুর্দশা ঘটতে দিয়ে এবং পাহাড়ের স্বাভাবিক প্রাণবৈচিত্র্য ও ব্যবস্থাপনা ধ্বংস হবার পর এখন ভূমি ধ্বস ঠেকানোর জন্য বিন্না ঘাস লাগানো হচ্ছে। গরু মেরে জুতা দান। দেখা যাচ্ছে এই প্রকল্পের কারিগরি নির্দেশক হচ্ছেন ইঞ্জিনিয়ার, কোন ইকোলজিস্ট নন; অর্থাৎ প্রাণ, প্রাণের বসত ও ব্যস্থাপনায় অভিজ্ঞ কোন বিজ্ঞানী নন। তবুও বলি, ইঞ্জিনীয়াররা ঘাসকে কারিগরির হাতিয়ার হিশাবে ভেবেছেন তার জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জা্নাচ্ছি। শুধু তাই নয়, আমি অভিভূত কারন ইঞ্জিনিয়ারির বাইরে এসে ঘাসের মতো তুচ্ছ জিনিসকে পাহাড়ের ক্ষয় রোধে ব্যবহার করা যায় এটা তারা ভেবেছেন। অন্তত লোহালক্কড় দিয়ে যান্ত্রিক ভাবে ঠেক দিয়ে ভূমিধ্বস সমাধানের কথা ভাবেন নি। চাট্টিখানি কথা নয়। নিজেদের কাজের ক্ষেত্রের ওপর তাঁদের পারদর্শিতাই এখানে প্রমাণিত হচ্ছে।
অথচ সিটি কর্পোরেশানের মূল কাজ ছিল এবং এখনও হচ্ছে শুরু থেকেই পাহাড় রক্ষা করা। চট্টগ্রামের প্রাণ ও প্রকৃতি সরাসরি পাহাড়কেন্দ্রিক। পাহাড় ছাড়া চট্টগ্রামকে ভাবা যায় না। অতএব এই ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশানের প্রধান কাজ বন, ঝোপ, গাছপালা, পাহাড়ি নানান জাতের ঘাস, লতা, ভূমিলগ্ন উদ্ভিদ ইত্যাদি সংরক্ষণ এবং তাদের বিকশিত হবার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করা। কিন্তু একদিকে পাহাড় কাটা হচ্ছে, ভূমি ধ্বসে মানুষ মারা যাচ্ছে, প্রাকৃতিক পরিবেশ ইতোমধ্যেই বিনষ্ট -- অতঃপর সেখানে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মত এখন থাইল্যান্ডের রাজকুমারিকে দিয়ে বিন্না ঘাস প্রকল্প চালু করছেন তারা।
বিন্না ঘাস লাগানো পাহাড়কাটা রোধ করার সমাধান নয়। বরং, অতিশয়োক্তি হলেও বলি, এটাই যেন বল যে তোমরা পাহাড় কাটো আর আমরা বিন্না ঘাস লাগিয়ে ক্ষয় রোধ করব! দ্বিতীয়ত, থাইল্যাণ্ড আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশী। সেই দেশের রাজকুমারিকে বিন্না ঘাস লাগাতে দিয়ে তার ছবি তোলা ও প্রকাশের মধ্য দিয়ে একটা ভাবমূর্তি তৈরি হয়। থাইল্যাণ্ডের জনগণ কিভাবে সেটা নেবেন আমি জানি না। কারন আমি নিশ্চিত ঘাস লাগানোকে তাঁরা আমার মতো রাজকীয় কাজ বলে গণ্য করবেন না।
'শস্য শ্যামল বাংলা'র কথা বলতে গিয়ে আমরা প্রায়শই মূর্ছা যাই, কিন্তু বাংলার গাছ পালা উদ্ভিদ লতাপাতার প্রতি আমাদের আগ্রহ খুবই কম। ফেইসবুকে বৃক্ষপ্রেমিকদের বেশ কয়েকটি গ্রুপ বা পাতা আছে, কিন্তু সেখানে কার বারান্দায় কী ফুল সেইসকল আলংকারিক, অর্থাৎ বাগান বা ঘর সাজানোর ছবিতেই ভরা থাকে। বোঝ যায় যারা সরাসরি কোন উৎপাদনে জড়িত নন তাদের কছে প্রকৃতি নিতান্তই টবের ফুলের গাছ, বারান্দায় রাখা ঘর সাজানোর অলংকার। সেখানে ফুল গাছকেই মানায়।
তবুও মন্দের ভাল। অনেকে কোন গাছ চেনেন না বলে ছবি দিয়ে অন্যদের কাছে তার নামসাকিন জানতে চান। এই তৎপরতাকে উৎসাহিত করা দরকার, তবে যেসব গাছপালা উদ্ভিদ লতাপাতা তুলনামূলক ভাবে উপেক্ষিত অথচ কৃষিতে, ওষুধে, গোখাদ্যে, পাখি ও অন্যান্য বুনো প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সেইসকল গাছপালা উদ্ভিদ সম্পর্কে আমাদের জানার আগ্রহ খুবই কম। অবশ্য যারা সরাসরি কৃষি কাজে বা প্রকৃতি সংলগ্ন কোন উৎপাদনের কাজে জড়িত নন, প্রকৃতির সপ্রাণ উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাদের কোনই ধারণা না থাকারই কথা। যে কারণে প্রকৃতি বিনাশী নগরায়ন, কিম্বা নিত্য দিনের অভ্যাস, যেমন প্লাস্টিকের জিনিসপত্র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আমরা কিভাবে প্রকৃতি ধ্বংসের কাজ করি সে সম্পর্কে সংবেদনা নাই বললেই চলে। নাগরিক বর্জ্য বাংলাদেশের নদি, মাঠ ঘাটকে বিষাক্ত করছে, সে ব্যাপারে আমাদের হুঁশ নাই। এই অজ্ঞানতার পরিণতি মারাত্মক। যা আজকাল মধ্যবিত্তের ড্রইং রুমে কিছুটা আলোচিত হয়।
প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতার আরও অদ্ভূত পরিণতি আছে। যেমন শহরের মানুষ বিশ্বাসই করতে চায় না যে রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ছাড়া ফসল ফলানো সম্ভব, কিম্বা একর প্রতি ফলন বৃদ্ধির কারিগরিও প্রকৃতি বা খোদ গ্রামীন পরিমণ্ডলের প্রাকৃতিক উপাদান থেকে অনায়াসেই তৈয়ারি করা যায়। সবুজ শ্যামল বাংলাদেশে সেটা আসলেই সহজ কাজ। সাধারণ ভাবে প্রকৃতির এবং সুনির্দিষ্ট ভাবে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও গাছ পালার নানাবিধ উৎপাদনমূলক ভূমিকা এবং গুণাবলী সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা নাই। আমরা বিজ্ঞানের নামে প্রপাগাণ্ডায় বিশ্বাস করি, নিজেরা বিজ্ঞান চর্চা করি না। এই পরিস্থিতিতে ফসলের রোগবালাই দমন করবার জন্য প্রকৃতির মধ্যেই কোন না কোন উদ্ভিদ বা গাছপালার মধ্যে দাওয়াই খুঁজে পাওয়া সম্ভব এবং তা একদমই কঠিন নয় এটা বোঝানো সাংঘাতিক রকম মুশকিল। এই অজ্ঞতা ভয়ংকর। ফলে প্রকৃতির প্রাণশক্তির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে আমরা নির্ভরশীল হয়েছি নিষ্প্রাণ আধুনিক টেকনলজির ওপর। সার, বিষ, ডিপ টিউবওয়েল দিয়ে পানি তোলা, হাইব্রিড বীজ ইত্যাদির ওপর। আধুনিক কৃষি প্রাণ ও পরিবেশের যে ভয়াবহ ক্ষতি করেছে সেই ক্ষতি প্রশমনের জন্য এখনকার পরিবেশ বিজ্ঞানের পরামর্শও আমরা আমলে নিতে চাই না।
এই এক দেশ যেখানে ছেলে মেয়েরা উদ্ভিদ বিজ্ঞান বা প্রাণীবিজ্ঞান বাধ্য না হলে পড়তে যায় না। অথচ এদেরই সবচেয়ে বেশী দরকার। শহরে চাকুরি পায় এমন কোন ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হতে ব্যর্থ হবার পরেই ছেলেমেয়েরা বোটানি, জু'লজির মতো বিশুদ্ধ বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে আগ্রহী হয়। যারা পড়ে তারা এমন সব বিষয় নিয়ে থিসিস করে দেশে যার কোন উপযোগিতা নাই। সেটা হয়তো কাজে লাগে কোন বহুজাতিক কোম্পানির, কিম্বা বিদেশী কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের মান রক্ষার কাজে, ক্বচিৎ দুই একটি ব্যতিক্রম থাকলেও বাংলাদেশের জনগণের কাজে লাগে না। ।
ভাবুন, যে দেশে কোন জায়গা খালি রাখলেই বছরের মাথায় 'জঙ্গল' বা 'সবুজ সার' লকলকিয়ে বাড়ে সেই দেশে জমির উর্বরতার জন্য বাড়তি রাসায়নিক সার দরকার এই চিন্তাটাই চরম বেয়াকুবি এবং অবৈজ্ঞানিক ধারণা। ক্ষেতের আইল অল্প একটু উঁচু করে বেঁধে পানি ধরে রাখা এবং আইলে সবুজ সারসহ ওষুধি, জ্বালানি ও অন্যান্য ঝোপঝাড় বৈশিষ্ট্যের উদ্ভিদ লাগানো খুবই সহজ। পানি ব্যবস্থাপনার জন্য যেমন লাগসই, তেমনি জমির উর্বরতা ব্যবস্থাপনার জন্য সবুজ সার সহজলভ্য করার জন্যও চমৎকার। এই ক্ষেত্রে রাসায়নিক সার, বিষ এবং বহুজাতিক কোম্পানির ওপর আমাদের নির্ভর করার কোন দরকার নাই।
আরেকটি গভীর অসুখে আমরা ভুগি। বিজ্ঞান এবং কারিগরি জ্ঞান ও কৃৎকৌশলের কথা শুনলেই আমরা যান্ত্রিক লোহালক্কড়মার্কা প্রাণহীন এবং প্রাণনাশী টেকনলজির কথা ভাবিন; কিন্তু প্রাণ ও প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে বিকশিত হবার জ্ঞানচর্চা যে আরও উন্নত ও অগ্রসর বিজ্ঞান, আরও কার্যুর ও টেঁকসই কারিগরি সেটা আমাদের মাথায় আসে না। কারণ সেই বিজ্ঞান অধিকাংশ সময়ই নিষ্প্রাণ ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল টেকনলজির তুলনায় গ্লামারাস বা চোখ ধাঁধানো কিছু না। নিতান্তই সিম্পল আর সহজ। এই যে ধরুন ভুমি ক্ষয় বা পাহাড়ের ভুমি ধ্বস রক্ষার জন্য বিন্না ঘাস রোপন। কঠিন কি আদৌ? মোটেও না।
কিন্তু ঘাস লাগানো আসলেই রাজকীয়, কারণ এই সহজ কারিগরির মধ্যে এমন এক প্রাকৃতিক রাজকীয়তা আছে যা আপনার প্রাণকে স্পর্শ করবে। আপনি ঠিকই বিন্না ঘাস সম্পর্কে নতুন করে ভাববেন এবং নতুন উপলব্ধি করবেন যে আপনার হাতের স্মার্ট ফোনের চেয়েও এই টেকনলজি কম অগ্রসর নয়। দৃষ্টিবান হলে প্রজ্ঞা আপনার চোখে ঝলক দিয়ে উঠবেই। বিজ্ঞান সম্পর্কে করপোরেট প্রপাগান্ডা বাদ দিয়ে আপনি যদি আসলেই বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে থাকেন তাহলে গাছ পালা উদ্ভিদ ও প্রকৃতি জগত সম্পর্কে আপনার এক প্রকার অনুভূতি তৈরি হবে যা বিজ্ঞানের বদ্ধমূল যান্ত্রিক পরিমণ্ডলের বাইরে মানুষের সৃষ্টিশীলতার সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের সম্ভাবনার য়ামামদের জন্য উন্মোচন করে। বিজ্ঞানের নামে বাজে প্রপাগান্ডায় আপনি নিশ্চয়ই আর বিশ্বাস করবেন না। বিশেষত যে কৃৎকৌশল প্রকৃতির প্রাণশক্তিকে ধ্বংস করে তার পক্ষে দাঁড়াতে চাইবেন না। বুঝতে পারবেন বিজ্ঞানের যে ধারণা এখন প্রবল তা একান্তই কর্পোরেট মতাদর্শ, যার উদ্দেশ্য শুধু পুঁজির মুনাফা বাড়ানো, কিম্বা সুনির্দিষ্ট ভাবে বহুজাতিক কর্পোরেশানের ভাড়া খাটা। বিজ্ঞান নামক ধারণা দিয়ে মানুষের অপরাপর সৃষ্টিশীল বৃত্তিকে গৌণ করবার ধারার সঙ্গে আমরা পরিচিত, বিজ্ঞানকে ধর্মের দুষমন হিশাবে হাজির করার মতাদর্শ সম্পর্কেও আমরা পরিচিত। কিন্তু এখানে মতাদর্শ হিশাবে বিজ্ঞান কিভাবে সার, বিষ, কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবসায়ীদের স্বার্থে সরাসরি ব্যবহৃত হয় সেই দিকেই নজর ফেরাতে বলছি।
নজর ফেরাতে সক্ষম হলেই আমরা বুঝব জ্ঞানবিজ্ঞানের বিরোধী হওয়া আমাদের সাধনা না, বরং সত্যকারের জ্ঞান অর্জন ও বিজ্ঞানচর্চাই আমামদের অন্বিষ্ট। তাই বিন্না ঘাস ( Vetivera zizanioides বা Chrysopogon zizanioides ) সম্পর্কে আমরা প্রচুর গবেষণা দরকার প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি বিজ্ঞানের অভিমুখ ফেরানো আমাদের কর্তব্য হয়ে ওঠে। আমরা জানি এটি Poaceae পরিবার বা ঘাসের পরিবারের সদস্য। এই পরিবারের আরেক প্রকার ঘাসের ওপর আমাদের খাদ্য ব্যবস্থা নির্ভরশীল সেটা হোল ধান (Oryza sativa)। এই প্রাথমিক জানা থেকে আমরা পুরা ঘাসের পরিবার সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠি। শুধু ভূমির ক্ষয় রোধ নয়, এর শেকড় থেকে খুবই দামি তেলও তৈরি হয়। ওষুধি কাজে তার ব্যবহার রয়েছে। আমরা আরও আবিষ্কার করি এই ঘাসের মধ্যে নানান কীটপতঙ্গ পোকামাকড় বাস করে। তাদের আবাস যদি আমরা অক্ষত রাখি তারা আমাদের অন্য ফসল নষ্ট করে না। নিজের বসত ত্যাগ করে যা নিজের বসত নয় সেখানে কী্টপতঙ্গও 'রিফিউজি' হতে চায় না। এটা কাণ্ডজ্ঞানেই বোঝা যায়। বিন্না ঘাস অনেক কীটপতঙ্গের বসতি। তাহলে ফসলে কীতপতঙ্গের অত্যাচার দমনে বিন্না ঘাসের ভূমিকা আছে। আবার ফসলের কাণ্ড ফুটা করে এমন পোকাগুলো দমনের জন্যও এই ঘাসকে আমরা কৃষিতে ব্যবহার করতে পারি। এরপর আবিষ্কার করি বাঁশও আসলে ঘাস। কোথায় ধান আর কোথায় বাঁশ ! অথচ তারা উভয়েই একই পরিবারের সদস্য। এই জানাজানির মধ্য দিয়ে প্রকৃতিকে আমরা আরও গভীর ভাবে জানি। ধীরে ধীরে প্বুঝতে পারি প্রকৃতির নিজস্ব শক্তি বিকাশের জন্য আমরা মনুষ্য প্রজাতি অনায়াসেই সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারি। সৃষ্টির প্রণদনা আমাদের আনন্দিত করে, ধ্বংস নয়।
বিজ্ঞান 'প্রকৃতিকে জয় করে' অর্থাৎ প্রকৃতির বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে, বিজ্ঞান সম্পর্কে এই আরেকটি ভালগার বা ইতরোচিত মতাদর্শ। বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রকৃতি জয় করবার আলেকজাণ্ডারি মাস্তানি এখনও প্রবল। কিন্তু একালে বিজ্ঞানের সাধনা হচ্ছে প্রকৃতির বিপরীতে মানুষকে আলেকজাণ্ডারের মতো দিগ্বিজয়ী হিশাবে হাজির করা না। বরং নিজেদের কিভাবে মানুষকে প্রকৃতি-স্বরূপ করে তোলা যায় সেই চর্চা করা। এটাই একালের বিজ্ঞানের সাধনা। আমরা প্রকৃতির মধ্যে বাস করি। যে ঘরে আমরা বাস করি সেই ঘরকে মজবুত রাখাই আমাদের কাজ, দিগ্বিজয়ের দাপটে সেই ঘরের ভিত্তি ধ্বংস একমাত্র আহাম্মকই করে, বিজ্ঞান সেটা করতে পারে না।
সহজেই বোঝা যায়, 'প্রকৃতিকে জয় করবার মতাদর্শ' একমাত্র পুঁজিতান্ত্রিক সমাজেই দানা বাঁধতে পারে, যেখানে প্রকৃতি পুঁজির কাছে মুনাফা কামানোর কাঁচামাল ছাড়া কিছু নয়। প্রকৃতি থাকল কি ধ্বংস হোল তাতে পুঁজির কিছু যায় আসে না। পুঁজির হিশাব মুনাফার, কী বাঁচল বা মরলো সেই ক্যালকুলেশান পুঁজি করে না। তাহলে পুঁজিতান্ত্রিক কালপর্ব অতিক্রম করে যেতে হলে বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রকৃতি-বিনাশী ধ্যানধারণা বা মতাদর্শ আমাদের ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু বিজ্ঞান বা জ্ঞা্নচর্চা ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। অতএব পুঁজিতান্ত্রিক মতাদর্শের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিজ্ঞানের বিরোধিতা আমাদের সাধনা হতে পারে না। বরং আমাদের কাজ পুঁজি্তান্ত্রিক সম্পর্ক থেকে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানচর্চাকে মুক্ত করা। নিজেরা মুক্তি লাভ করা। এর জন্যই পুঁজির কার্যকর প্রতিষ্ঠান বহুজাতিক কর্পোরেশানের দাসত্ব থেকে বিজ্ঞানকে মুক্ত করা একালের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতি। বিজ্ঞান বা জ্ঞানচর্চা ছাড়া সেই মুক্তি সম্ভব নয়। প্রকৃতির মধ্যে প্রকৃতিরই শক্তি হিশাবে মনুষ্য প্রজাতিকে আবার সজ্ঞানে অন্তর্ভূক্ত বা লীন করা বা প্রকৃতি স্বরূপে নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার বিজ্ঞান বা জ্ঞানচর্চারই বিষয়। প্রকৃতি থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন 'মানুষ' একটা মিথ, একটা উৎকল্পনা, একালের দার্শনিকরা একথা নানান ভাবে বলছেন।
এই জন্যই ভূমি ধস ও ভূমির ক্ষয় রোধ করারা জন্য ঘাস লাগানো এমন এক বৈজ্ঞানিক কলাবিদ্যা যাকে সবুজ কারিগরি বললে তার অন্তর্নিহিত আবেদন পুরাপুরি উপলব্ধি করা যায় না। যদি ধর্মীয় ক্যাটাগরি বা মিস্টিক রোমান্টিকতায় পর্যবসিত না করে এই সজ্ঞান বাসনা ও জ্ঞানকে আমাদের আরাধ্য গণ্য করি তাহলে তাকে স্পিরিচুয়াল বা আধ্যাত্মিক উপলব্ধি বলাই সঙ্গত। মুশকিল হচ্ছে আধাত্মিকতার আমরা নেতিবাচক অর্থ করি, বাস্তবিকতা বা বস্তুবাদিতার বিপরীতার্থক পরিভাষা হিশাবেই এর চল ঘটেছে। ইংরেজিতে Spirit বা জর্মন ভাষায় Geist যে দ্যোতনা বহন করে আধ্যাত্মিকতা সেই দ্যোতনা বহন করে না। সে যাই হোক যখন বলি ঘাসের প্রতি আমার মমতা অতিশয় গভীর,রীতিমতো আধ্যাত্মিকতার স্তরের মায়া তখন সেটা ইতিবাচক অর্থেই বলি। সেখানে প্রকৃতির শক্তির মধ্যে লীন হবার কিম্বা খণ্ড থেকে অখণ্ডে বিলীন হবার আকুতি আছে। কিন্তু সেটা জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার পথ ধরে, সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে উদাসী হয়ে নয়। আমি নদিয়ার ভাবের ভাবুক, অতএব বর্তমানবাদী। অনুমানে বিশ্বাস করিনা।
ডিজিটাল বটে, কিন্তু আমরা এখন জ্ঞানচর্চাকেন্দ্রিক এবং জ্ঞানভিত্তিক একটা কালপর্বে আছি, যে কালপর্বে যান্ত্রিক ছকবাঁধা চিন্তার বাইরে মানুষের কামনা বাসনা ইচ্ছা অভিপ্রায়ের আধ্যাত্মিক উন্মেষের প্রতি মানুষ সজ্ঞান ও সচেতন হয়ে উঠতে চাইছে। পাশ্চাত্য যে যান্ত্রিক ও ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কালপর্বের মধ্য দিয়ে জ্ঞানচর্চাকেন্দ্রিক পর্বে প্রবেশ করেছে, তার সুবিধাটুকু আমাদের নিজেদের মতো করে আত্মস্থ করতে হবে। মানবেতিহাসের ভবিষ্যৎ গোলকব্যাপী হতে বাধ্য, স্থানীয় হবে না আর। এক বিপুল দুনিয়া দানা বাঁধছে আমাদের চোখের সামনে। একই সরলরেখা অনুসরণ করে এবং একটা স্তর পার হয়ে পাশ্চাত্যের মতো হয়ে আমাদের পাশ্চাত্যের কাতারে দাঁড়াতে হবে তার কোন যৌক্তিক বা ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই। অতীতের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে আমাদের উল্লম্ফনের সম্ভাবনা বিপুল ভাবে বেড়েছে।
এই উল্লম্ফনের জন্যই আমি ঘাস ফড়িং হয়ে ঘাসের জগতে বিচরণ করতে ভালবাসি। নয়াকৃষি আন্দোলনের কারবার এই ঘাস লতাপাতা উদ্ভিদের নিখিলে বাসা বাঁধবার জন্যই।
নইলে আর কী!!
১ জুন ২০১৮। শ্যামলী।