এবারের ঈদ


আজ ঈদ। ঈদ মোবারক।

বাংলাদেশের জনগণ বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে বন্দী রেখে ঈদুল ফিতর পালন করছে। এ এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা। রাজনৈতিক সংবেদনা ও উপলব্ধির দিক থেকে অস্বস্তির।

আইন প্রণেতা ও আইন বাস্তবায়নকারীর মধ্যে যখন ফারাক লুপ্ত হয়, তখন আইন, অধিকার বা ন্যায় বিচারের তর্ক অর্থহীন। জনগণকে এই সহজ সত্যটুকু বোঝাবার কার্যকর কোন চেষ্টা বিএনপি করে নি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় শুধু আইনী পদ্ধতিতে ন্যায়-অন্যায় মীমাংসার রাজনীতি আত্মঘাতী চিন্তা। যার পরিণতি খালেদা কেন, বাংলাদেশের বহু নাগরিক ভোগ করছেন। অথচ পাশাপাশি দরকার ছিল এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার সুস্পষ্ট রাজনীতি ও গণআন্দোলন।

দিল্লির মসনদে উপমহাদেশের ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজ শক্তি ক্ষমতায়, যার বিরুদ্ধে ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণ লড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে নির্বাচন ঠিকঠাক হোক এই মিনতি নিয়ে নরেন্দ্র মোদী ও কতিপয় গুরুত্বহীন ভারতীয় থিংক ট্যাংকের কাছে বিএনপির একটি অংশের ধর্না ও প্রার্থনা এই দেশের মানুষের রাজনৈতিক অনুভূতিকে তুমুল আহত ও ক্ষুব্ধ করেছে। ভারতীয় সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের ধরনে বোঝা যায় ভারতের গণমাধ্যমও বিস্মিত হয়েছে। এই তৎপরতার প্রতি খালেদা জিয়ার সমর্থন আছে এ্টা জনগণ বিশ্বাস করে না। দিল্লির আগ্রাসী নীতি এবং মোদীর হিন্দুত্ববাদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। বিএনপি যদি জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা মানে তাহলে মনে রাখা দরকার ১৯ দফার প্রথম দফাই হচ্ছে, "সর্বতোভাবে দেশের স্বাধীনতা,অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা"।

'সর্বতোভাবে' শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্যণীয়, যার মধ্যে গণপ্রতিরক্ষা ও সামরিক প্রস্তুতিও অন্তর্ভূক্ত। যার কারণে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসন বিরোধী জনগণের নিরংকুশ সমর্থন পেয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, সৈনিক ও জনগণের গণতান্ত্রিক মৈত্রীর প্রতীকও হয়ে উঠেছিলেন জিয়া। কিন্তু বিএনপি আঞ্চলিক ও বিশ্ব রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে জিয়ার এই ভাবমূর্তির তাৎপর্য আজ অবধি জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয় নি। শেখ মুজিবর রহমানের বিপরীতে তাঁকে স্বাধীনতার ঘোষক হিশাবে প্রমাণ করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ গণ্য করেছে, ফলে জিয়াউর রহমানের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বাঙালি জাতিবাদী রাজনীতির বয়ান ও ফাঁদের মধ্যে অনাবশ্যক বিতর্ক হয়ে পড়ে রয়েছে। রাজনীতির সুবর্ণ মূহূর্তগুলো তুলনামূলক ভাবে গৌণ ইস্যুতে ব্যয় করেছে। আজ ১৯ দফা রাজনৈতিক কর্মসূচির তাৎপর্য কর্মীদের না বোঝানো এবং তা বাস্তবায়নের চেষ্টা না করার পরিণতি হয়েছে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া এবং ফেলানির গুলি খাওয়া লাশ ঝুলে থাকা। আর এখন ভারতের থার্ড ক্লাশ থিংকট্যাংকের কাছে ধর্না দিয়ে বলা হচ্ছে অতীতে বিএনপির রাজনীতি ভুল ছিল! আফসোস, তাহলে তো ১৯ দফা সমেত জিয়াউর রহমানই ভুল ছিলেন।

জিয়াউর রহমানের ১৯ দফার শেষ দফা ছিল, "ধর্ম,গোত্র ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ করা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করা"। যারা বিভিন্ন দেশে বিপ্লবের ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত তাঁরা জানেন বিএনপির ১৯ দফা কর্মসূচির এই দফা বুর্জোয়া গণতন্ত্রেরই সার কথা। গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে এখানে বিএনপির পার্থক্য নীতিতে নয়, কৌশলে। বাংলাদেশে বুর্জোয়া শ্রেণির পক্ষে এই দফা বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব কিনা সেটাই হচ্ছে তর্কের বিষয়। জিয়াউর রহমান এই সীমাবদ্ধতা বুঝতেন, ফলে সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী বাম রাজনৈতিক ধারাকে তিনি বিএনপি গড়ার প্রক্রিয়ায় সঙ্গে নিয়েছিলেন। রাজনীতিতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পরবর্তীতে বিএনপিতে গণবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল নেতা ও চিন্তার উত্থান ঘটে। বাম গণতান্ত্রিক ধারা বিএনপি থেকে ক্রমে ক্রমে লুপ্ত হয়। "ধর্ম,গোত্র ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ করা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করা" ইত্যাদি স্রেফ কাগুজে কথাবার্তায় পর্যবসিত হয়। কেউ পড়েও না, বোঝেও না।

বিএনপি কোন বিপ্লবী দল নয়, কিন্তু বুর্জোয়া দল তো বটেই। বিএনপির গণসমর্থন তার এই বুর্জোয়া কর্মসূচীর জন্যই। আর সেটা প্রণয়ণ করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান, যিনি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার কায়েমের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারার যে সমর্থন পেয়েছিলেন বাংলাদেশের বাস্তবতায় তা ছিল যৌক্তিক। সমাজতন্ত্র ও জাতিবাদের মিশ্রণসহ যারা বাংলাদেশে ইসলাম বিদ্বেষী ফ্যাসিজম কায়েম করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য বিএনপির দরকার ছিল। এখনও আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে।

দুর্ভাগ্য যে জিয়াউর রহমানের পর র‍্যাব গঠিত হয়েছিল। আমরা অনেকেই তৎক্ষণাৎ তার বিরোধিতা করেছি। সেই আমলে বিপ্লবী রাজনীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে আইন বহির্ভূত ভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা বারবার সাবধান করেছি বন্দুকের নল ঘুরে যায়। আজ বিএনপির কর্মী ও নেতারা গুম হচ্ছে, বিচারবহির্ভূত হত্যকাণ্ড জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। বিএনপির চরম অদূরদর্শিতার মূল্য বিএনপিকে গুণে গুণে দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। কতোদিন দিতে হবে কে জানে। কিন্তু ১৯ দফা কোন ভুল ছিল না। বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে চাইলে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় ১৯ দফার নতুন ব্যাখ্যা এবং সঠিক কৌশল নির্ণয় বিএনপির জন্য রাজনৈতিক উল্লম্ফন ঘটাতে পারে। যারা ইতিহাস বোঝেন, তাঁরা আমার কথার মর্ম বুঝবেন।

কিন্তু বিএনপির কিছু নব্য নেতা বিএনপির রাজনীতি সঠিক ভাবে জনগণের মধ্যে প্রচার, চর্চা ও বিকাশের পরিবর্তে নির্বাচনী টিকিট পাওয়া আর ক্ষমতায় গিয়ে লুটপাটের অধিক কোন রাজনীতির কথা ভাবতে পারে না। ব্যবসায়ীদের কাছে রাজনীতি ব্যবসা বা মুনাফা কামানোর একটি ক্ষেত্র মাত্র। তারা আগামি নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়া এবং লুটতরাজের আশায় নরেন্দ্র মোদীর সাহায্য চাইছে। ভারতের জনগণের কাছে নয়। এরা ভুলে যায় বাংলাদেশকে ভারত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে, বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত পৃথিবীর অন্য যে কোন সীমান্তের তুলনায় অধিক রক্তাক্ত ও গুলি খেয়ে মরা লাশের গোরস্থান। বাংলাদেশের মর্যাদা দিল্লির কাছে উপনিবেশের অধিক কিছু নয়।

অথচ ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণ চায় দিল্লির ক্ষমতাসীনরা সহ উপমহাদেশে সকল কিসিমের ফ্যাসিস্টদের হাত থেকে ্সকলের মুক্তি। আমাদের দরকার উপমহাদেশের সকল গণতান্ত্রিক জনগণের ঐক্য। ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণ আমাদের মিত্র। নতুন ভাবে দক্ষিণ এশিয়ার পুনর্গঠনের জন্য সেই মৈত্রীর চর্চা করা ছাড়া কোন বিকল্প নাই। সেই স্বপ্ন ধারণ করেই জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল সার্ক (South Asian Association for Regional Cooperation)। কিন্তু বিএনপির নিজের অর্জন নিজেই গিলে খেয়ে বসে আছে।

অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। আজ এই অবস্থানটুকুই ব্যক্ত করা দরকার যে জিয়াউর রহমানের রাজনীতি ভুল ছিল না, ১৯ দফায় এখনও নতুন বাংলাদেশ গড়বার সার কথাগুলো মজুদ রয়েছে। হতে পারে  ১৯ দফার ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক মর্ম জনগণকে বোঝাবার ক্ষেত্রে বিএনপি চরম ভাবে ব্যর্থ। কিম্বা ১৯ দফা বাস্তবায়নের উপযুক্ত কৌশল নির্ণয়েও বিএনপি কখনই সফল হয় নি। দফাগুলো কাগুজে ঘোষণা হয়ে আছে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের দিক থেকে এখনও উনিশ দফাই একমাত্র জাতীয় ক্ষেত্রে পরিচিত কর্মসূচি যার ভিত্তিতে জনগণকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রতি অনুপ্রাণিত ও সচেতন করা সম্ভব। ঐক্যবদ্ধ করাও সম্ভব।

দল বা সংগঠন ম্লান বা বিলীন হয়ে যেতে পারে, কিন্তু সঠিক অথচ অ-বাস্তবায়িত আদর্শ ও রাজনীতির বীজ ও শক্তি সমাজে থেকে যায়। কেউ না কেউ কোথাও না কোথাও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের রাজনৈতিক কর্মসূচি হিশাবে জিয়াউর রহমানের ১৯ দফাকে এই সময়ে জন্য যথেষ্ট গণ্য করে নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, অর্থাৎ "ধর্ম,গোত্র ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ করা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করা"র প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবার ঝাণ্ডা উর্ধে তুলে ধরতেই পারে। সেটা কি সম্ভব? বিএনপিতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিএনপির যেসকল কর্মী কাজ করেন সেই সকল নেতা ও কর্মীরাই এর ভাল উত্তর দিতে পারবেন।

খালেদা জিয়া কারাগারে। একচ্ছত্র ও নিরংকুশ ক্ষমতা বাংলাদেশের ভবিষ্যত অনিশ্চিত করে তুলেছে। কার্যকর বিরোধী দল হিশাবে ভূমিকা রাখবার ক্ষেত্রটুকু বিলুপ্ত হলে একটা ভয়ংকর বাংলাদেশ আমরা প্রত্যক্ষ করব।

রাজনীতির এই কালপর্ব আমরা অতিক্রম করে যেতে সক্ষম হবো, এই প্রত্যাশায় ঈদে বেগম খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা জানাই। সুস্থ থাকুন।

এবং শেখ হাসিনাকেও।

সকলকে আবারও ঈদ মোবারক।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।