ওমর মুখতার ও উপনিবেশবিরোধী যুদ্ধ
“হয় জিতবো নয় মরবো” -ওমর মুখতার
“অবিচার নিপীড়িত মানুষকে নায়ক করে তোলে। প্রতিরোধের একজন আইকনিক নেতা হিসেবে লিবিয়ার জনগণ আজও স্মরণ রেখেছে ওমর-আল-মুখতারকে ( ১৮৬২-১৯৩১ ), যিনি তার জীবনের শেষ বিশ বছর নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন ইতালির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। লিবিয়াবাসীদের কাছে আল-মুখতার মৃত্যুর ছিয়াশি বছর পরেও, সমষ্টিগত চেতনায় জীবিত ; তিনি বেঁচে আছেন আমাদের মধ্যেও। শুধুমাত্র একজন প্রতিরোধ যোদ্ধা হিসেবেই নয় বরং তার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব এবং তার ট্রেডমার্ক এর মতো চোখের সেই চিকন ফ্রেমের চশমার কারণেও” --ঠিক এভাবেই গত ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ওমর-আল-মুখতারের ছিয়াশিতম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ওমর আল-মুখতারকে, ‘মরুভূমির সিংহ’ নাম দিয়ে, ‘দ্য মিডল ইস্ট মনিটার’ পত্রিকায় লেখা হয়।
সংবাদটা পড়ার সাথে সাথে আমাদের মনে পড়ে যায়, “লায়ন অফ দ্য ডেজার্ট ” ছবির শেষ দৃশ্যের কথা। যেখানে ওমর মুখতারের চরিত্রে এ্ন্থনি কুইন ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে; তার হাতে শক্ত ধরে রাখা সরু ফ্রেমের চশমা। এই চশমার প্রতীকী ব্যবহার ছবির বিভিন্ন জায়গায় আমরা দেখতে পাই।
ছবিটা সম্পর্কে আলোচনার আগে ওমর মুখতার এবং তার সময়কার লিবিয়া সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেয়া যাক।
১৯১১ সালের অক্টোবর মাস -- অ্যাডমিরাল লুইগি ফারাভেলির নেতৃত্বে ইটালির নৌসেনারা লিবিয়ার ত্রিপোলি শহরের সমুদ্রতীরবর্তি এলাকায় তুর্কি অধিকৃত অঞ্চলে পৌঁছে যায়। তারা তুর্কি এবং লিবিয়ানদের আত্মসমপর্নের হুমকি দিলে, তুর্কি এবং লিবিয়ার অধিবাসিরা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। ইটালিয়ান সেনারা তিন দিন ধরে সেখানে এবং ত্রিপোলি, বেনগাজি সহ বিভিন্ন শহরে অবিরাম গোলাবর্ষণ করে দেশটা দখল করে নেয়। ১৯১২ থেকে ১৯২৭ পর্যন্ত লিবিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চল, ‘ইটালিয়ান নর্থ আফ্রিকা’ নামে এবং ১৯২৭ থেকে ১৯৩৪ পর্যন্ত আরো দুইটা অঞ্চল ‘ইটালিয়ান সাইরেনিকা’ এবং ‘ইটালিয়ান ত্রিপোলিনিয়া’ নামে পরিচিত ছিল। অর্থাৎ ইটালিয়ানরা লিবিয়ায় শুধু উপনিবেশ স্থাপনই করে নাই, দেশের নামটা পর্যন্ত পাল্টে দিয়েছিল। সেই সময়ে প্রায় দেড় লক্ষ ইটালির অধিবাসী, লিবিয়ায় স্থায়ী নিবাস গড়ে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০% হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক এই সময়েই ওমর মুখতারের মতো একজন শক্তিশালী নেতার আর্বিভাব ঘটে। সামান্য একজন মাদ্রাসা শিক্ষক থেকে যিনি তার দেশকে ঔপনিবেশিক দখলদারদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্যে গেরিলা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যার নাম শোনা মাত্র, “ চে গেভারার ” নামের মতো পশ্চিমা শক্তি এক সময়ে ওমর মুখতারের ভয়ে প্রকম্পিত হতো। যার নামে, এখনো লিবিয়ায় তাদের দশ দিনার নোটের উপর মুখতারের ছবি ছাপা হয়।
২০০৯ সালে মুয়ামার গাদ্দাফি রোমে সরকারি সফরে গেলে মুখতারের বন্দী দশার আঁকা একটা ছবি বুকে ধারণ করে যান। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১, লিবিয়ায় গৃহ যুদ্ধ শুরু হলে, ওমর মুখতার লিবিয়ার স্বাধীনতা এবং ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠেন। জাতীয় পতাকা এবং বিভিন্ন পোস্টারে মুখতারের ছবিতে ছেয়ে যায়। সেখানে একটা বিদ্রোহী দলের নামই রাখা হয় “ ওমর মুখতার ব্রিগেড ” নামে। তাছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেমন ফ্লোরিডার টাম্পা শহরে ওমর আল-মুখতার নামে মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে। কুয়েত সিটি, গাজা সিটি, কায়রো, দোহা, তিউনিসিয়া, রিয়াদ, জর্ডানের ইবরেদ ইত্যাদি শহরগুলোতে ওমর মুখতারের নামে রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। কাজেই আমরা বুঝতে পারছি, ওমর মুখতার নামের এই বিপ্লবী বীর, শুধু তার দেশেই নয়, পুরা পৃথিবীতে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। সিরিয়ান-আমেরিকান প্রযোজক এবং পরিচালক মোস্তফা আল আক্কাদ ( ১৯৩০ -২০০৫ ) ১৯৮১ সালে , ওমর মুখতারের উপর “ লায়ন অফ দা ডেজার্ট ” নামে সিনেমা নির্মাণ করেন।
উপনিবেশ বিরোধী যুদ্ধে ধর্ম, বিশেষ ভাবে ইসলামের ভূমিকা সবসময়ই উপেক্ষিত থেকেছে। এর ফলে ধর্মের ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পর্কে প্রকট অজ্ঞতা বাংলাদেশ যেমন বিরাজ করে, তেমনি অবস্থা বিশেষে উপনিবেশ বিরোধী যুদ্ধে ধর্ম যে বিপ্লবী ভূমিকা রাখে ও ইতিহাসে রেখেছে – এই সত্য ডাহা অস্বীকারও করা হয়। চিন্তা পাঠচক্রে আমরা এই তর্কটা সামনে নিয়ে আসতে চাই। এই তর্কটি প্রশস্ত করবার সহজ পথ হিশাবে ওমর মুখতারকে নিয়ে তৈরি ছবি 'লায়ন অব দ্য ডেজার্ট' নিয়ে এই আলোচনা।
বাংলাদেশে ধর্মের ভূমিকা সম্পর্কে অজ্ঞতার আরেকটি বিশেষ রূপ রয়েছে। যেমন, সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়েদ্দারদের ইংরেজ বিরোধী লড়াইয়ের ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দু সাম্প্রদায়িক চেতনা প্রবল ভাবে কাজ করেছিল। ঔপনিবেশিক বাস্তবতা এবং প্রাথমিক জাতিবাদি চেতনার স্ফূরণের মধ্যে ধর্মের এই ভূমিকা একদমই স্বাভাবিক। কিন্তু হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু চেতনার ভূমিকাকে সম্পূর্ণ আড়াল করে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠনের প্রয়াসকে সেকুলার ও জাতিবাদি জোব্বা পরানো হয়। অন্যদিকে তীতুমীর ও হাজি শরিয়তুল্লাহদের উপনিবেশবিরোধী লড়াইকে দেখা হয় মুসলমানদের 'সাম্প্রদায়িক' লড়াই হিশাবে। সেই লড়াইয়ের উপনিবেশবিরোধী চরিত্রের চেয়ে তার ধর্মীয় চরিত্র বা ধর্মীয় বয়ানটাই প্রধান হয়ে ওঠে। এই বিষয়গুলোকে আমাদের আরও কঠোর পর্যালোচনার অধীনে আনা জরুরী। লিবিয়ার মুক্তিযোদ্ধা ওমর মুখতার অবলম্বনে তৈরি করা ফ্লোরা সরকারের আলোচনাটি এ কারনে জরুরি।
‘লায়ন অফ দ্য হার্ট’ ১৯৮১তে তৈরি। মুস্তফা আক্কাদ ছিলেন পরিচালক। লিবিয়ার কর্নেল মহাম্মদ গাদ্দাফির নেতৃত্বাধীন সরকার এর জন্য টাকা দেয়।
ছবির মূল কাহিনী শুরু হয় ১৯২২ সাল থেকে, যখন ইটালিতে বেনিতো মুসোলিনি নামে ইতিহাস কুখ্যাত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপ্রধান ইটালির শাসন ক্ষমতায় আসেন। ওমর মুখতার নামে বেদুইন মানুষটি ততদিনে ইটালির শাসকদের কাছে একটি আতঙ্কের নাম হিসেবে ছড়িয়ে গেছে। কারণ ওমর তার প্রিয় মাতৃভূমি থেকে বিদেশি শাসনের অবসানের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে বিভিন্ন খণ্ড যুদ্ধে অনেক ইটালিয়ান সেনাবাহিনীকে ধরাশায়ী করেছেন। মুসোলিনি তখন ইটালির আরেক রক্তপিপাসু সেনাপ্রধান, জেনারেল রডলফো গ্রেজিয়ানিকে লিবিয়ার গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করেন ওমরকে শায়েস্তা করার জন্য এবং বলেন “ গত বিশ ধরে একটা খামোখা যুদ্ধে আমাদের অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে, পাঁচ পাঁচটা গভর্নর সেখানে নিয়োজিত থেকেও ওমর মুখতারের বিপ্লবকে ধরাশায়ী করতে পারলো না।। আশাকরি তুমি সেই কাজটি করতে পারবে”। ছবির এই অংশে ওমর মুখতারের চরিত্র সম্পর্কে দর্শকের কিছুটা হলেও ধারণ হয়ে যায়। প্রথম দৃশ্যে আমরা দেখি ওমর একটি মক্তবে শিশুদের কোরআন পাঠের শিক্ষা দিচ্ছেন। কোরআন পাঠের একটি জায়গায় ভারসাম্যের প্রসঙ্গ এলে ওমর শিশুদের জিজ্ঞেস করেন “ এখানে ভারসাম্যের কথা কেন এসেছে?” উত্তরটি তিনি নিজেই দেন --“কারণ ভারসাম্য না হলে সবকিছু ধ্বসে যায়”। আর তখনই আমরা বুঝতে পারি ভারসাম্যহীন লিবিয়ার ভারসাম্য আনয়ন, অর্থাৎ যার যার দেশ তার তার শাসনের অধিকার কায়েমের প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর জন্যে তিনি কোরআনের একটি আয়াত তুলে ধরছেন। ইতিমধ্যে তার কাছে নতুন জেনারেল গ্রেজিয়ানির নিয়োগের খবর এলে ওমর বলেন “এরা সিংহের মতো আসে আর ইঁদুরের মতো চলে যায়”। ঠিক পরের দৃশ্যে তুলনামূলক বৈষম্য প্রদর্শনের জন্যে পরিচালক মোস্তফা আক্কাদ অত্যন্ত মুনসিয়ানার সঙ্গে বেনগাজিতে বল নাচের মনোরম দৃশ্যে জেনারেল গ্রেজিয়ানির অভিষেক অনুষ্ঠান দেখান। ওমরের গ্রাম সেনুসির বিপরীতে বেনগাজি শহরের জাঁকজমকপূর্ণ অভিষেক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের পরজীবী ছবিটি ফুটে ওঠে। ঔপনিবেশিক শাসকেরা তাদের দম্ভ, হঠকারিতা এবং ফাঁপা আভিজাত্য দেখানোর জন্যে এভাবেই জাঁকজমকের আয়োজন করে; সাধারণ জনগণ এসব দেখে ভয়ে দূরে দূরে থাকে। এই ঔপনিবেশিক চরিত্রই আমরা আবার দেখি যেকোনো স্বৈরাচার কর্তৃক শাসিত রাষ্ট্রে, যেখানে শো ডাউন ছাড়া দেশ শাসন এবং শোষণ করা হয়না। গল্পের গতি এভাবেই এগিয়ে যায়।
এক সময় জেনারেলের কাছে ওমর কর্তৃক ইটালি সেনাদের মৃত্যু সংবাদ আসে। তার পরেই দেখা যায় একটা শান্ত গ্রাম কীভাবে ইটালিয়দের দ্বারা ধ্বংস আর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়।। এভাবে একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে দিয়ে ছবির কাহিনী এগিয়ে যায়। ওমর বাহিনী বীরত্বের সঙ্গে এসব ধ্বংসযজ্ঞ প্রতিরোধের সংগ্রাম করে যায়। কোনভাবেই যখন ওমর এবং তার বাহিনীকে আত্মসমপর্নে সমর্পিত করা যায় না জেনারেলের উদ্যোগে তখন ওমরের সঙ্গে একটা সমঝোতা চুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। যে বৈঠকে মেজর তমেলি, বেনগাজির কমিশনার সহ আরও দুজন উপস্থিত থাকেন। ছবির এই অংশে পরিচালক মোস্তফা ঔপনিবেশিক শাসন এবং উপনিবেশিত মানুষের চিত্র অত্যন্ত স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল সংলাপের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপন করেন। সংলাপের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো:
মেজর : চুক্তির শর্ত আপনারা বলতে পারেন।
ওমর : আমাদের প্রথম শর্ত এখানে মুসলিম স্কুল স্থাপন করতে হবে।
মেজর : অবশ্যই। আমরা শিক্ষার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আমরা নিশ্চয়ই স্কুলগুলো আবার খোলার ব্যবস্থা করবো।
ওমর : ----- আমাদের জন্যে জাতীয় সুরক্ষার প্রয়োজন। সেইজন্যে আমাদের নিজেদের একটা সংসদ থাকা দরকার।
কমিশনার : সংসদের প্রশ্নটা রোমের বিষয়।
এই সময় ওমরকে উত্তেজিত দেখালে মেজর তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন
মেজর : তোমার শর্তটা আমি নোট করে রাখলাম। তবে এই দেশের ভূখণ্ড বাজেয়াপ্ত ভূমি হিসাবে পরিগণিত হয়ে আছে।
ওমর : বাজেয়াপ্ত ভূমি আমরা ফেরত চাই।
মেজর : না মানে --বাজেয়াপ্ত বলতে বোঝাতে চেয়েছি এই ভূখন্ডের উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা।
ওমর : উন্নয়ন ? কার দ্বারা ? ইটালি ? শোন, বিশ, চল্লিশ বা তারও বেশি যদি সময় লাগে, জেনে রেখো এই ভূমি একদিন আমাদের হবেই। -------
এভাবে আরও বাদানুবাদের পরে মেজর তোমেলি, ওমর মুখতারকে মাসিক পঞ্চাশ লিরা অবসর ভাতা প্রদানের বিনিময়ে যুদ্ধ থামানোর শর্ত দিলে ওমর মুখতার তা প্রত্যাখ্যান করে চলে যান। ওমরের কিছু বন্ধু তাকে ইটালিয়দের কাছে আত্মসমর্পনের পরামর্শ দিলে, সেটাও প্রত্যাখ্যান করা হয়।
ওমরের বীরত্বের সব থেকে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমরা দেখি তার বন্দী হবার পর জনারেল গ্রেজিয়ানির জেরা করার সময়ে Ñ
জেনারেল : তুমি কেনো তোমার দেশের সর্বনাশ ডেকে আনছো ?
ওমর: সর্বনাশ আমরা ডাকিনি। তোমরা ডেকেছো। তোমরা আমাদের ভূখণ্ড দখল করেছো। আমরা তোমাদের ভূখণ্ড দখল করিনি। এক মুহূর্তের জন্যেও তোমাদের কোন অধিকার নেই আমাদের ভূখণ্ড দখলে রাখার।
জেনারেল : অবশ্যই আছে। এবং শুধুমাত্র ইটালিরই সর্বস্ব অধিকার আছে তোমাদের ভূখণ্ডের ওপর। অন্য কারোর নয়। যেমন অধিকার আছে ইংল্যান্ডের ইজিপ্টের ওপর, যেমন আছে ফ্রান্সের তিউনিসিয়ার ওপর, স্পেনের মরক্কোর ওপর। আমাদের একশ বছরের দখলদারিত্বের অধিকার আছে এই লিবিয়ার ওপর। ------
একশ বছর বলতে জেনারেল সেই জুলিয়াস সিজারের সময়ের কথা ওমরকে আবার স্মরণ করিয়ে দেন। জেনারেলের মাত্র একটি সংলাপের মধ্যে দিয়ে পরিচালক আমাদের ঔপনিবেশিক দখলের চিত্র এঁকে দেন। আত্মসমর্পনের প্রসঙ্গ উঠলে ওমরের সরাসরি উত্তর: “ আমরা কখনোই আত্মসমর্পন করবো না। আমরা হয় জিতবো না হয় মরবো। এর জন্য যদি প্রজন্মের পর প্রজন্মের প্রয়োজন হয়, আমরা সেই প্রয়োজনে লাগবো তবু মাথা নোয়াবো না তোমাদের কাছে”। জেনারেল তাকে ফাঁসীর ভয দেখালে ওমর বলেন, “ তোমাদের ন্যায় বিচারের দড়ি সব সময় আমাদের ফাঁসী কাষ্ঠে ঝোলানোর জন্যে তৈরী হয়ে থাকে”। এভাবেই ওমর মুখতার বীরের বেশে ফাঁসী মঞ্চে নিজেকে সমর্পন করেন।
ফাঁসীর মঞ্চে সব থেকে যা স্মরণীয় হয়ে থাকে, সেটা হলো ওমরের হাতে শক্ত করে ধরে রাখা তার চশমা। ছবিতে চশমা অত্যন্ত কাব্যিক এবং প্রয়োজনীয় একটি প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। চশমার এই ব্যবহার প্রথম আমরা দেখি ছবির মাঝামাঝি সময়ে যখন একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থানে ওমর এবং তার সঙ্গীরা যুদ্ধ জয়ের পরে সেখানে যায়। ছোট একটা বালক, যে সদ্য পিতৃহারা হয়েছে তার সঙ্গে ওমরের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ওমরের সঙ্গে বসে কথা বলার সময় বালক সেই চশমাটা ওমরের কাছ থেকে নিয়ে খেলার ছলে চশমাটা পরে। তারও পরে ওমরকে যখন জেনারেলের কাছে নিয়ে আসা হয় তখন জেনারেল সেই চশমা তাকে ফেরত দেয়। ছবির শেষে ফাঁসীর মঞ্চে সেই বালকের সঙ্গে ওমরের আবার দৃষ্টি বিনিময় হয়। সেই দৃষ্টি যেন বলে দিচ্ছিলো, এই যে ছেলে চশমাটা রেখে গেলাম তোমার জন্যে। এই চশমার ঠিক ঠিক ব্যবহার তুমি করতে পারবে আশাকরি। এবং ফাঁসী কার্যকর হবার পর যখন মঞ্চ খালি হয়ে যায়, বালকটা দৌঁড়ে এসে চশমাটা নিয়ে নেয়। অসাধারণ এই দৃশ্যায়নের মাধ্যমে পরিচালক যেন আমাদের একটি মহান বার্তা পৌঁছে দেন আর সেটা হলো এই: যে চশমা দিয়ে ওমর মুখতার লিবিয়ার শোষিত জীবন দেখতে পেতেন, যে চশমা দিয়ে লিবিয়ার ভবিষ্যত দেখতে পেতেন, সেই চশমা এই বালকটিকে দেয়ার মধ্যে দিয়ে তাকেও দেখার সুযোগ করে দিলেন। “ দ্য মিডল ইস্ট মনিটর ” পত্রিকায় আমরা তাই দেখতে পাই সঠিক ভাবেই সেই চশমার উল্লেখ করা হয়েছে। রিলের রেসের মতো চশমার প্রজ্জ্বলিত শিখাটা সেই ছোট্ট ছেলেটার মধ্যে দিয়ে যেন বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রজন্মে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং হতে থাকবে।
ওমর আল মুখতারের নাম চিহ্নিত ফ্লোরিডার মসজিদ