নারীর মুক্তি: কতিপয় বাস্তবিক প্রসঙ্গ
মানুষ কে যে কোন একসময় সকল কর্মের হিসাব দিতে হয়; এটা জীবনের এমন এক অকাট্য সত্য যা নানান জাতির নানান ভাষায় প্রবাদ বাক্য হয়ে টিকে আছে। ইংরেজিতে বলে ' As you sow, so you reap' । খুব সম্ভবত বাইবেলের Old Testament থেকে উদ্ভূত। ইসলাম ধর্মে একে বলে ‘আমলনামা’ আর হিন্দু ধর্মে বলে ‘কর্মফল’। কর্মফলে বিশ্বাস করতে গেলে, আস্তিক হতে হবে কিম্বা বেহেস্ত-দোজখে বিশ্বাস করতে হবে, এমনটির প্রয়োজন নাই। নিউটন এই প্রাকৃতিক ঘটনাকে একটি পদার্থবিদ্যার ধর্ম (Law of Physics) হিসাবে দেখেছেন; তাই বলেছেন, Every action has an equal and opposite reaction '। ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’এই প্রাকৃতিক আইন যেমন ব্যক্তির জন্য সত্য, তেমনই এটা গোষ্ঠি বা জাতির জন্যও সত্য। তাই তো প্রভু নানান সময় নানান ধর্মগ্রন্থে নানান জাতিকে এই সত্য স্মরণ করিয়ে দেন।
প্রকৃতি লিঙ্গ ভেদাভেদহীন ভাবে নানান প্রতিভা মানব জাতির মধ্যে বিতরণ করেছে। যে ব্যক্তিকে প্রকৃতি সহজাত খেলোয়াড় হওয়ার প্রতিভা দিয়েছে তার সেটাই হওয়া উচিত; কারণ সে খেলাধূলাতে ভাল করতে পারবে, আর তার নিজের জন্য ও দেশের জন্য সুনাম অর্জন করবে। যে নারীকে প্রকৃতি লেখিকা হওয়ার প্রতিভা প্রদান করেছে, সেই নারী যদি চুল্লি-মর্জন আর আলমারি-আসবাব পত্র ধূলিহীন করণে সদা ব্যস্ত থাকে, আর সারাদিন ধরে স্বামী-সন্তানের জিহ্বাজাত তুষ্টতার খাতিরে নানান ভেরাইটিজ ডিশ তৈয়ারীকরণের গৃহস্থ কাজে নিজেকে সর্বক্ষণ ব্যস্ত রাখেন, তাহলে তার বিশেষ প্রতিভা প্রকাশ পাওয়ার কোন সুযোগ থাকে না। এক সময় সেই কর্মের ফল অবশ্যই নারী পাবে। তার বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার না করায় এক সময় সহজাত প্রতিভা হারিয়ে যাবে; সেই নারী বিষণ্ণতায় ভুগবেন, সেটা রোগের আকার ধারণ করবে।
কেননা লেখক সত্তা সাধারণের চেয়ে বেশী সংবেদনশীল হয়। তার একটা মননশীল জগত থাকে। এক সময় প্রকৃতি তাকে শুধু কামের তাড়না আর সন্তান জন্মানোর তাড়নার ডাকই নয়, অন্যরকম একটা সৃষ্টিশীল কিছু নির্মাণ করার ডাক দিয়েছিল। সেই ডাক সে শুনেও শোনেনি। সে নিজেকে বলেছে, তার সময় নেই। সময় তখন তাকে ঝাড়পোছ করতে দেখে চলে গেছে, ফিরে তাকায়নি।
আজ সেই নারী সাধারণ নারী হওয়ার ভান করতে সফল, কিন্তু সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। নিজের প্রকৃত সত্তার সাথে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। তার প্রকৃত সত্তা বিভাজনে ভুগে ভুগে আজ দ্বিখণ্ডিত। আধ্যাত্মিক গুরু ভগবান রজনীশ (অশো) এর ভাষ্যমতে, সে এমন এক বীজের মত যেটা পরিমিত জল, রোদ বা মাটি না পেয়ে বড় হতে পারেনি। বিশাল বটগাছ হবার কথা যার, সে হয়েছে খাটো কোন গাছ। তার ছায়াতলে মানবকিম্বা পশু কী আর আশ্রয় নেবে, তার নিজের অস্তিত্বটাই নড়বড়ে। বেশী বাতাস বইলে তার জন্য ঝুঁকি, আর ঝড় হলে তো কথাই নেই। অশোর মতে এমন একজন মানুষ যে নিজের সর্বোচ্চ উচ্চতাতে পৌঁছাতে পারেনি, সে পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষ। উপরের আলোচনা আধ্যাত্মিক বিদ্যার অংশ, এবং কর্মফল ধর্ম নির্বিশেষে আধ্যাত্মিক বিদ্যারই একটি প্রধান অংশভাগ।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ধর্মও হয়ে গেছে পিতৃতান্ত্রিক, অনেক সময় নারীবিদ্বেষী, আধ্যাত্মিক আইন থেকে বিভক্ত। তখন সমাজের প্রগতিশীলরা ধর্মে বিশ্বাস হারিয়েছেন। নারীবাদিরাও ধরে নিয়েছেন ধর্মের সাথে বিভাজন হওয়াটাই নারীমুক্তির পথ। ধর্মের নৈতিক গুরু হয়ে গেছে খ্রিস্টান পাদ্রী আর মুসলমান মৌলভি। যেহেতু আমরা ধর্মকে বোঝার অধিকার তাদের উপর ছেড়ে দিয়েছি। ফলে পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটেছে।
ফলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যুগ যুগ ধরে ঘটে আসছে নারীর শৃঙ্খলায়ন ও একাকী করণ, এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ থেকে নারীকে বঞ্চনা করা। ফলে নারীর মধ্যেও রাজনৈতিক চেতনার অভাব ঘটেছে, এবং নিজের এই বঞ্চনা অনুভব করলেও সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করার চেতনা, মানসিকতা বা সুযোগ নারীর মধ্যে সহজে জন্মায় নি। যখনই জন্মেছে তখনই নারীবাদি আন্দোলন হয়েছে।
বিবাহ ও বিবাহ বাজার
যুগ যুগ ধরে বিবাহই নারীর অর্থনৈতিক চাহিদা মিটাবার এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার একমাত্র ক্ষেত্র ছিল; সে কারনে নারীর জন্য যুবতী ও সুন্দরী হওয়াটা তার বিবাহ-বাজারে টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য ছিল, পূর্বে কি পাশ্চাত্যে। বিবাহ একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যার মাধ্যমে একটি সমাজব্যবস্থা সন্তান-জন্ম, লালন-পালন, এবং শ্রম- বন্টনের মধ্য দিয়ে সমাজের বৈষয়িক ভিত্তি টিকিয়ে রাখে। তবে একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বংশের সংজ্ঞা এইভাবে দেয় যে বংশ হচ্ছে পুরুষ-বীর্য জনিত; এখানে বংশ পরিচয়টা মৌলিক এবং তার ধারাবাহিকতা বাঞ্ছনীয়। তাই বংশের শুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য নারীর চলাফেরা সীমিত করা হয়। এবং নারীকে ভোগ, সৌন্দর্য্য ও মাতৃত্বের প্রতীক হিসেবেই শুধু দেখা হয়, ‘ব্যক্তি’ হিসেবে দেখা হয় না।
পাশ্চাত্যে সৌন্দর্যের প্রতীক ও কামনার পাত্রী হওয়ার ইতিহাস থেকে নারীর অবস্থান আমরা পর্যালোচনা করতে পারি ইউরোপে শত শত বছর থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অভিজাত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারীদের নানান প্রশিক্ষণ নেওয়ার রেওয়াজ ছিল যাতে বিবাহ-বাজারে তাদের দর বাড়ে এবং তারা ভাল পাত্র পান। এর মধ্যে ছিল গান-বাজনা ও নাচ শেখা, খাবার খাওয়া ও পরিবেশন করার কলা শেখা, সামাজিক কথোপকথন, ইত্যাদি; এমনকি কন্ঠ , হাঁটাচলার ধরণ, অঙ্গ ভঙ্গী ইত্যাদিকে পরিশীলিত করারও চর্চা হোত। তাই মেয়েদের জন্য আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল যেগুলোতে তাদের পড়াশোনার সাথে সাথে এইসব শেখানো হত ।
নারী ও পুরুষের জগতটাই আলাদা ছিল, তাই নারীপুরুষের সমশিক্ষার (co-education) কোন প্রশ্নই আসতে পারত না। নারীদের পোষাক পরার ব্যপারটা এবং শৃঙ্গারকে সামাজিক বিষয় হিসাবে আলোচনায় অন্তর্ভূক্ত করার ব্যপারটা ছিল সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাদের পোষাকের কয়েকটা স্তর থাকত; পরিধান করার জন্য অভিজাত নারীরা একজন সহচরীর এবং মধ্যবিত্তরা একজন সাধারণ গৃহকর্মীর সাহায্য নিতেন। এই তুলনায় আমাদের বাংলা বা ভারতবর্ষের অন্য জায়গায় নারীদের পোষাক সুন্দর ও সুচারু হলেও এবং শৃঙ্গার নিয়ে সামাজিক তর্ক তৈরি তুলনায় কিছুটা সময়সাপেক্ষ হলেও পাশ্চাত্যের তুলনায় এই দেশীয় নারীর অনেক সহজ ব্যাপার সব সময়ই ছিল; যেমন, পোষাক-আশাক অন্যের সাহায্য ছাড়াই পরিধান করা যেত।
প্রখ্যাত ফরাসী ছোটগল্প লেখক গি দে মোপাসাঁ (Guy de Maupassant) একটি গল্প লিখেছেন যেটাতে এক নারী পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন একজন ব্যচেলারের সাথে এবং একটি নির্দিষ্ট এবং অল্প সময়ের জন্য তারা প্রায়শই মিলিত হন ব্যচেলরের কোয়ার্টারে যখন সেই নারীর স্বামী থাকেন না। সমস্যাটা হয়ে দাঁড়ায় যে প্রেমিকার পোশাক খোলা এবং আবার পরিধান করার জন্য এত বেশী সময় দরকার হয়ে পড়ে যে তাদের মিলনের সময়টা খুবই অল্প হয়ে পড়ে। ব্যাচেলর প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বস্ত্র খুলতে সাহায্য করেন, কিন্তু পুনরায় তা পরিধান করতে সাহায্য করেন না। এতে প্রেমিকাকে বেকায়দায় পড়তে হয়; প্রেমিকও তার প্রেমিকার এই অগোছালো কোনভাবে পোশাক পরিধানের দৃশ্য দেখে দেখে প্রেমের রোমাঞ্চ হারিয়ে ফেলেন এবং শেষে তাদের ওই প্রণয়ের সম্পর্ক আর টিকে থাকেনা।
নারীর সৌন্দর্য বর্ধনের বর্তমান সংস্কৃতি
বিয়ের বাজার না হলেও, নারী যখনই বহির্জগতে প্রবেশ করছে, তার রূপ, রঙ, আকৃতি আর বয়স মুখ্য হয়ে যাচ্ছে। নগরের পেশাজীবী নারীদের ক্ষেত্রে এটা এক বড় সমস্যা যে তাদের গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায় তাদের বেশভূষণ এবং আকর্ষণীয়তা। পুঁজিবাদী সমাজ গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে সর্বত্র নারীর এই সদা সুন্দর আর তরুণ হওয়ার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরছে সংক্রামক ভাবে। অসম্ভব একটা আদর্শে পৌঁছবার জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে তার মানসে। তার মধ্যে উস্কে দিচ্ছে নানান পণ্য ব্যবহার করে কৃত্রিম ভাবে যৌবন টিকিয়ে রাখার চেষ্টা। নারীর সমস্ত মনোযোগ আর বুদ্ধিমত্তাকে এই বাহ্যিক আর মিথ্যে প্রয়াসের দিকে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে । মেগাজিন আর দৈনিকগুলো দামী পোশাক-আশাক পরা, মেকাপ-করা মডেলদের চিত্রে, সৌন্দর্য্য-বর্ধন নিয়ে লেখালেখিতে ভরে যাচ্ছে; এগুলো কিশোরী আর যুবতীদের উঠতি বয়সে তাদের মনন কে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। সৌন্দর্য্য প্রতিযোগিতা গুলিও নারীর তারুণ্য এবং অনুপাতে মাপা শারিরীক গঠনের প্রতি এক নতুন উন্মত্ততার সৃষ্টি করছে। এক হৈ হৈ রৈ রৈ দিয়ে মডেল আর নায়িকারাও এই শাড়ি, অলংকার, মেকাপ আর শরীরের গঠন জাহির করার ব্যাপারকে উন্মাদনার এক নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিচ্ছেন। চলছে মেয়েমানুষের শরীর নিয়ে এক নির্লজ্জ ও স্থূল খেলা। পুরুষও এই পণ্যকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতা-চক্রের শিকার হচ্ছেন এই পণ্যসামগ্রীর ক্রয়ক্ষমতা যোগাড় করার চাপে। এবং নিজ সত্তা ও শরিরেও একই ভাবে এই পণ্যসমূহ ব্যবহার করার তাগিদ অনূভব করছেন।
ঐতিহাসিক ও আইনগত প্রেক্ষাপটে দেখা যায় কিভাবে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীকে শোষণ করে তার নিজের লক্ষগুলো অর্জন করার উদ্দেশ্যে নারীর পায়ে যুগ যুগ ধরে নানান অজুহাতে শিকল পরিয়ে দিয়েছে। একদিকে তাকে ভোগের বস্তু হিসেবে দেখা হয়েছে বলে তার রূপ, তার শরীরের মাপ ও গঠন, তার চলাফেরার স্বাধীনতা তার ব্যবহারের ধরণ ইত্যাদিকে গ্রহণযোগ্যতার নির্ধারিত সংজ্ঞায় ফেলা হয়েছে, অন্যদিকে তাকে সাবালক হিসেবে দেখা হচ্ছেনা, তাকে সম্পত্তি মালিকানার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের অধীনস্থ রাখা হচ্ছে। এমন অধীনস্থ অবস্থায় নারীর বুদ্ধিমত্তা, ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতা কখনো সুঠোম ও শক্তিশালী হয়ে গড়ে উঠতে পারেনা, নারীরা পুরুষের ভাল সাথিও হতে পারেন না। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের এই সমস্যা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন জারমেইন গ্রিয়ার তার বহুল আলোচিত বই, The Female Eunuch ( ১৯৭০) এ।
পাশ্চাত্য সমাজকে আমরা মনে করি উর্ধগামী; নারীর বেলায় কিন্তু একই ভাবে সেইসব সমাজও নারীকে সৌন্দর্য্য ও মাতৃত্বের প্রতীক হিসাবেই রেখে দিয়েছে। গৃহবন্দী করেছে তাকে সন্তান লালন এবং গৃহে দেখাশোনার কাজের জন্য, সীমিত করেছে বাইরের জগতে তার কাজের পরিধি, নারীকে সম্পত্তি মালিকানা থেকে, আইন দিয়ে বঞ্চিত করেছে, বঞ্চিত করেছে ভোটাধিকার থেকে এবং নাগরিক হিসেবে সমাজ এবং রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করা থেকেও। তুমুল আন্দোলনের ফলে সেই শিকলগুলো অনেকটা খুলেছে। আন্দোলন এখনো চলছে।
নারীর বহির্জগতে অনূপ্রবেশের জন্য আন্দোলন
ইউরোপের নারীবাদীরা সর্বপ্রথম আন্দোলন করে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন যে, নারীর জায়গা ঘরেই নয়, বাইরেও আছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের নারীবাদীরা এগিয়ে ছিলেন। তখনকার যুগে এটাকে বলা হত গার্হস্থ্য পরিমণ্ডল বনাম বহির্জগত পরিমণ্ডলের বিতর্ক (domestic sphere versus public sphere debate)। প্রথম প্রজন্মের নারীবাদীরা অভিজাত শ্রেণি থেকে এসেছিলেন এবং তারা বহির্জগতে নারীর অনুপ্রবেশ ঘটাতে চেয়েছেন। উল্লেখযোগ্য যে আঠারশ শতাব্দির মধ্যবর্তি সময়, যখন থেকে উনারা কাজ শুরু করেন, শিল্পবিপ্লব তখন ঘটে গেছে এবং সহস্র নারী গ্রাম ছেড়ে নগরে এসে শিল্পকারখানা গুলোতে কাজ করতে শুরু করেছেন। তাই এই অভিজাত নারীরা একটা বিশেষ শ্রেণির নারীর জন্য আন্দোলন করছিলেন; আন্দোলন হচ্ছিল শিক্ষিত ‘ভদ্রঘরের’ মেয়েদের জন্য। উনারা সংগঠন করে আর প্রবন্ধ লিখে নারীর সীমিত পরিমণ্ডলকে প্রশ্ন করেছেন। আন্দোলন করে নারীর অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন বহির্জগতের কর্মক্ষেত্রে, সেটা অর্থ উপার্জনের জন্যই হোক, আর হোক কোন সম্মানজনক পদ; যেমন, তাদের এলাকায় স্থানীয় সরকারে অংশগ্রহণ বা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা। কালজয়ী পুরুষ সাহিত্যবিদরাও তখন তাদের সাহিত্যকর্মে নারীমুক্তি প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন, যেমন নরওয়ের প্রখ্যাত নাট্যকার ইবসেন আর আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ।
ইবসেন তার নাটক ‘Doll' s House’ মেয়েদের সামাজিক স্থান কেন্দ্র করে লিখেছেন। উনি মূল নারীচরিত্রকে দিয়ে এক সময়ে বলান যে গৃহের চার প্রাচীর যেন একটা পুতুলের ঘর, যেটার ভেতরে তার সমস্ত অস্তিত্ব নিহিত। জর্জ বার্নার্ড শ হয়ত সব যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ নারীবাদীদের মধ্যে একজন। উনার সব নাটকেই নারী চরিত্রগুলো শক্তিশালী চরিত্র হয়ে থাকে, এবং উনি দেখান যে নারীসত্তা তার বুদ্ধি, সাহস, ও আত্মিক শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে কি ভাবে নানান পরিস্থিতিতে জয়ী হয়ে আসেন। তার একটি নাটকে এক জদ্দাল প্রকৃতির নারীচরিত্র তার হবু স্বামীর উপর ক্ষেপে তাকে সিঁড়ি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দুই পা ভেঙে দেন। পরে এই নারীই একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করান তার বুদ্ধিমত্তা আর কর্মোদ্যম দিয়ে। শ এই নাটকে বোঝাতে চেয়েছেন যে একজন প্রতিভাবান নারীকে তার কাজের জন্য ক্ষেত্র দিতে হবে, সে শুধু নমনীয়তার মূর্তি হয়ে বসে থাকবে, এটা আশা করা বৃথা, কারণ শক্তিধর নারীরা নমনীয় হননা। কাজের ক্ষেত্রের মাধ্যমে প্রতিভাশীল নারীর শক্তিগুলো বিকাশিত হবে আর মানুষের কাজেও আসবে। নারীমুক্তির এই আন্দোলনের ফলে নারীরা কেবল পুরুষের অধীনস্থ না থেকে, নিজের পরিচয়ে ঘরের বাইরে বের হয়ে আসতে থাকেন।
আমাদের দেশে নারীর বহির্জগতে অনুপ্রবেশের আবশ্যকতা এবং অন্যান্য বঞ্চনা নিয়ে লিখেছেন প্রখ্যাত লেখিকা বেগম রোকেয়া।
বিংশতাব্দিতে কর্মক্ষেত্রে নারীদের সর্বত্র অনুপ্রবেশ
ভারতবর্ষ তখন যুক্তরাজ্যের একটা উপনিবেশ ছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর যখন দেশ গড়ার কাজ শুরু হয় তখন পাশ্চাত্যে নারীরা সামাজিক ক্ষেত্রে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করছেন এবং নারীমুক্তি নিয়েও পাশ্চাত্য সচেতন। সদ্য প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ তখন সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র এবং অন্যান্য সমধিকারের দলিল উপস্থাপন করছে এবং সর্বত্র গৃহিত করাচ্ছে। এদিকে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশগুলোকে পাশ্চাত্যের কাছ ঠেকে আর্থিক প্রয়োজনে আশির্বাদ নিতে হচ্ছে, এবং সেটার সাথে সাথে নানান শর্ত মেনে নিতে হচ্ছে যেগুলোর মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিল নানান ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহন ও ক্ষমতায়ন। তাই এই প্রেক্ষাপটে স্বাধীন ভারত আর পাকিস্তানে যখন সংবিধান আর অন্যান্য আইন রচনা করা হয়, সেখানে প্রথম থেকেই নারীদের সমান অধিকারের কথা থাকে। কিন্তু কলমের আঁচড় দিয়েই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়না!! শত শত বছর ধরে লালিত বিশ্বাস আর প্রচলিত রীতি নিয়ে কাজ করতে হয়।
বিংশতাব্দিতে কর্মক্ষেত্রে নারীদের সর্বত্র অনুপ্রবেশের জন্য বছরের পর বছর ধরে নারীবাদীরা আন্দোলন করেছেন। এর পরে বিংশ শতাব্দির প্রথম দশকের পরেই শুরু হয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যে যুদ্ধে বেশীর ভাগ পুরুষ নিয়োজিত হন। তখন পরিবারের দেখাশোনা ও অর্থ উপার্জনের কাজ বাধ্যতামূলক ভাবে নারীদের করতে হয়। এই ভাবে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের কর্মক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ ঘটে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ নিঃশেষ হওয়ার পরে অর্থনৈতিক ভাবে ইউরোপ দূর্বল হয়ে পড়ে এবং তার সমাজব্যবস্থায় আর অভিজাত শ্রেণির প্রভাব পূর্বের মত থাকে না। নারীপুরুষ নির্বিশেষে নতুন করে ইউরোপ গঠন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং নারীদেরকে কর্মক্ষেত্রে তাদের পাশে পেয়ে পুরুষরা নারীদেরকে তাদের সহকর্মী হিসেবে মেনে নেন। নারীরা পুর্বের তুলনায় অনেক বেশী আরামদায়ক আর ব্যবহারোপযোগী পোষাক পরিধান করা শুরু করেন, এবং চুল ছোট করে কেটে ফেলেন যাতে সময়সাপেক্ষ কেশবিন্যাসের সমস্যা না থাকে।
ভারতবর্ষ তখন যুক্তরাজ্যের একটা উপনিবেশ ছিল। দেশ স্বাধীনের পর যখন দেশ গড়ার কাজ শুরু হয় তখন পাশ্চাত্যে নারীরা সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহন করছেন এবং নারীমুক্তি নিয়ে পাশ্চাত্য সচেতন। সদ্য প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ তখন সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র এবং অন্যন্য সমধিকারের দলিল উপস্থাপন করছে এবং সর্বত্র গৃহিত করাচ্ছে। এদিকে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশগুলোকে পাশ্চাত্যের কাছ ঠেকে আর্থিক প্রয়োজনেঢ় আশির্বাদ নিতে হচ্ছে, এবং সেটার সাথেইরমেনে নিতে হচ্ছে নানান শর্ত। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিল নানান ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন। তাই এই প্রেক্ষাপটে স্বাধীন ভারত আর পাকিস্তানে যখন সংবিধান আর অন্যান্য আইন রচনা করা হয়, সেখানে প্রথম থেকেই নারীদের সমান অধিকারের কথা থাকে। কিন্তু কলমের আচড় দিয়েই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়না!! শত শত বছর ধরে লালিত বিশ্বাস আর প্রচলিত রীতি নিয়ে কাজ করতে হয়।
সম্পত্তি- মালিকানা এবং নারীর অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য
একটি পুঁজিবাদী সমাজে সম্পত্তি ব্যক্তিমালিকানার অধীনে থাকায় পিতৃতান্ত্রিক শোষণ এক বিশেষ রূপ ধারণ করে যেটাতে নারীর একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে টিকে থাকাটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ইউরপে আইন ছিল যে বিবাহিত নারী কোন সম্পত্তির মালিক হতে পারবেনা। সে যদি তার পৈত্রিক সুত্রে কোন সম্পত্তি পেত , যদি তার মা-বাবা বা অন্য কেউ তাকে উইল করে সম্পত্তি দিত, তাহলে বিবাহের পর সে সম্পত্তির মালিক হতেন তার স্বামী। অন্যদিকে ইংরেজ সহ ইউরোপের অন্যন্য জাতি ও দেশ সমূহের উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী সব সম্পত্তির মালিক হতেন অগ্রজ পুত্র। কোন লোকের যদি পুত্র সন্তান না থাকত তাহলে তার নিকটতম পুরুষ আত্নীয় সেই সম্পত্তি পেতেন। তার মানে তার স্ত্রী- কন্যারা নিঃস্ব হতেন। অপরদিকে ভদ্রলোকের মেয়েদের জন্য অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাতে বাসার বাইরে কাজ করাটা অভাবনীয় ছিল। শুধুমাত্র গ্রহণযোগ্য ছিল ধনিক ঘরে বাচ্চাদের গভার্নেস বা ধনী গৃহিনিদের সাথি ( lady' s companion) হিসেবে একটা চাকুরি নেওয়া। সেটা সামাজিকভাবে কিছুটা গ্রহণযোগ্য হলেও গভার্নেসকে বা lady' s companion কে একজন নিছক অধীনস্থ হিসেবে হীন মনে করার প্রবণতা ছিল।
অর্থনৈতিক প্রশ্নটা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন কারণ এর ওপর নির্ভর করে একজন নারীর স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে বেঁচে থাকা। নারী বা পুরুষকে যদি সর্বদা আরেকজনের ইচ্ছার উপরে থাকতে হয় তাহলে হয়ত তার অর্থনৈতিক সমস্যাটা সমাধান হতে পারে কিন্তু এতে ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্রের প্রশ্ন সমাধান হবে না। আরেকজন যদি রাষ্ট্র হয়, তাহলে তার মাথার উপর কারাগারে বন্দি হবার ভয়টা থাকবে, আবার একই ভাবে আরেকজন যদি তার বাবা, স্বামী বা ভ্রাতা হন, তাহলে স্বাধীনভাবে চলাচল করা ও চিন্তা করা এবং সেই চিন্তাকে প্রকাশ করাটা নারীর জন্য দুরূহ হয়ে পড়বে। কারণ কর্তাকে খুশি করে তাকে চলতে হবে। এই খুশি করে চলার মোসাহেবি ব্যাপারটা একজন মানুষের অন্তরে ঢুকে তার স্বতন্ত্র চিন্তাশক্তিকে শুষে ফেলে।
তাই যে সব সমাজে চিন্তার স্বাধীনতাকে রোধ করা হয় সেই সব সমাজ বা গোষ্ঠি কখনোই মানব সভ্যতার খাতায় সাহিত্য, দর্শন, কলা বা অন্য কোন সৃষ্টিশীল অর্জনে উল্লেখযোগ্য নাম লেখাতে পারেনা। বরঞ্চ পশ্চাতপদ থাকে। ইউরোপের নারীবাদীরা সর্বপ্রথম আন্দোলন করে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন যে, নারীর জায়গা ঘরে নয়, বাইরেও আছে। এটাকে তখনকার যুগে বলা হত domestic বনাম public sphere এর বিতর্ক। নরওয়ের প্রখ্যাত নাট্যবীদ ইবসেন তার নাটক Doll' s House লিখেছেন মেয়েদের সামাজিক স্থান নিয়ে বিতর্ক কেন্দ্র করে। অর্থাৎ বহির্জগতে নারীর অনুপ্রবেশ ঘটুক, তার প্রস্তাবনা মঞ্চে নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে পেশ করবার চেষ্টা করেছেন। এই বহির্জগত বলতে উনারা বুঝাতে চেয়েছিলেন যে কোন একটি সুনির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্র। সেটা অর্থ উপার্জনের জন্যই হোক, কিম্বা কোন সম্মানজনক বেসরকারী বা সরকারী পদই হোক; যেমন তাদের এলাকায় স্থানীয় সরকারে অংশগ্রহন বা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা। এই আন্দোলনের ফলে নারীরা কেবল পুরুষের অধীনস্থ না থেকে, নিজের পরিচয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসতে থাকেন।
সম্পত্তি মালিকানা ও নাগরিক অধিকার সমূহঃ ইউরোপীয় ও যুক্তরাষ্ট্রের নারীবাদীদের দ্বিতীয় আন্দোলন ছিল ভোটাধিকার এবং সম্পত্তি মালিকানার অধিকার নিয়ে। এই আন্দোলনটা বেশ বিতর্কিত ছিল। প্রথম অবস্থায় অভিজাত শ্রেণির ইংরেজ নারীবাদীরা এই আন্দোলনের বিরোধিতা খোদ করেছিলেন। তখনকার সময়ে যে ব্যক্তির সম্পত্তির মালিকানা নেই তার ভোটাধিকার থাকতনা। যেহেতু নারীদের আইন দ্বারা সম্পত্তির মালিকানা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল, অতএব নারী ভোটাধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলেন। উনবিংশ শতাব্দির শেষ অর্ধাংশ থেকে যুক্তরাজ্যে suffragettes রা এই আন্দোলন করেছিলেন ব্যাপকভাবে এবং সরকারের কাছ থেকে সম্পত্তির মালিকানার অধিকার ও ভোটাধিকার ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিবাহিত নারীর সম্পত্তি আইন ১৮৭০, ( Married Women' s Property Act 1870) দ্বারা যুক্তরাজ্যে নারীরা ব্যক্তিসম্পত্তির মালিক হওয়ার এবং উত্তরাধিকার সুত্রে সম্পত্তি পাবার অধিকার প্রথম পান, এবং Equal Representation Act 1918 দ্বারা ৩০ বছরের উর্ধের নারীরা ভোটাধিকার প্রথম পান। এইভাবে যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়াতে নারীরা আন্দোলন করে ভোটাধিকার ছিনিয়ে নেন।
ভারতবর্ষে ইংরেজরা হিন্দু নারীর সীমিত পরিসরের সম্পত্তি অধিকারকে অধিক পোক্ত করার তাগিদে Hindu Married Women' s Property Act 1937 পাস করলেন, এতে হিন্দু বিধবা তার জীবদ্দশায় তার মৃত স্বামীর সম্পত্তি ভোগ করার অধিকার পেলেন, কিন্তু এই শর্তে যে উনি বিবাহ করবেন না বা যৌনসম্পর্কে জড়াবেন না। কিন্তু এই সম্পত্তি আবার বিক্রি বা কোনভাবে হাত বদল করাবার অধিকার তার নেই, কারণ এই সম্পত্তি তার স্বামীর বংশধরদের। কন্যা সন্তানরা তাদের বাবার সম্পত্তির ভাগ নানান ভাবে পেতেন। তবে কোন কন্যা যদি বিবাহ- বহির্ভূত ভাবে যৌন সম্পর্কে জড়ান, উনি এই অধিকার হারাবেন! এইভাবে হিন্দু আইন নারীর যৌনতা কে কড়া শিকল পরাবার জন্য সম্পত্তি- অধিকারের সাথে নারীর যৌণ অধিকারকে প্রত্যক্ষ ভাবে বেঁধে দিল। এই হিন্দু আইন বাংলাদেশে এখনও বিরাজমান। তবে ভারতবর্ষে এখন আদি হিন্দু আইনের সংশোধন হয়েছে বলে কন্যা এবং স্ত্রীরা সম্পত্তির অংশ পেয়ে থাকেন।
মুসলিম আইনে প্রথম থেকেই স্ত্রী আর কন্যা সম্পত্তির অংশ পান। তবে কন্যা সন্তান ছেলে সন্তানের তুলনায় অর্ধেক পান তাই বলা হয় যে মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বৈষম্য মূলক। তবে বিধবা যদি দ্বিতীয় বিবাহ করেন, বা যৌন সম্পর্কেও জড়ান, অন্তত আইনগত ভাবে উনি সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন না। একই ভাবে কন্যারা যদি বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সম্পর্কে জড়ান, তাদের অন্য কোন সাজা হলেও, সম্পত্তি থেকে উনারা বঞ্চিত হবেন না, যেমনটি হিন্দু আইনে আছে। একইভাবে বিবাহিত নারীর পরবর্তি যৌনজীবনের সাথে অথবা কোন অপরাধ করার সাথে তার সম্পত্তি মালিকানার অধিকার ইসলাম ধর্ম বেঁধে দেয় নি।
হিন্দু সমাজের মত মুসলিম সমাজেও পুরুষরা কর্তার ভূমিকায় থাকেন বলে সম্পত্তির রক্ষক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন প্রায় সব সময়েই। এবং প্রায়শই রক্ষক থেকে ভক্ষক হয়ে যান। প্রায়শই ভাইরা বোনদেরকে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তির প্রাপ্য ভাগ থেকে বঞ্চিত করে থাকেন। আইনে অধিকার থাকলেও এই দেশে আইনের কাছে পৌছে ন্যায়বিচার ও পরিত্রান পাওয়ার ব্যপারটা দূরূহ। কারণ আইন থাকলেও আইনের প্রায়োগিক ব্যাপারগুলো অত্যন্ত জটিল, কূটিল, দূর্নিতিতে জড়ানো, ব্যয়হবহুল আর সময়সাপেক্ষ। তাই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে কন্যারা তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি এবং বিধবা নারীরা তাদের মৃত বাবা বা স্বামীর সম্পত্তি পাচ্ছেন না। বাংলাদেশের নারীবাদিরা কিন্তু আন্দোলন করছেন সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকারের জন্য, যেটা ওদেরকে দেশের মৌলবাদী শক্তির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত করছে। কিন্তু তাঁরা সক্রিয় ভাবে বিদ্যমান অধিকার পাওয়ার জন্য আন্দোলন করছেন না। তাদের আন্দোলনটা সমস্যায় জড়ানো। এখানে শত শত বছর ধরে চলে আসা একটা প্রথা পরিবর্তন করে আরেকটা পরিস্থাপন করায় ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপার আছে। বিশেষ করে যখন সেই মানুষগুলো তাদের বিদ্যমান অধিকার থেকেই বঞ্চিত।
দেশে নারীর বর্তমান অবস্থান
১. নারীর প্রতি সহিংসতা: ভারতবর্ষ বা পাকিস্তানের মত বাংলাদেশেও নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বর্তমানে ভয়ানক মাত্রা ধারণ করেছে যেটার পেছনে আছে দেশের বিশেষ রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট। এই সামাজিক ব্যাধি মোকাবিলায় সরকার কিছু আইন প্রণয়ন করেছে যেমন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২, ইত্যাদি। তবে মনে রাখতে হবে যে সহিংসতা একটি সামাজিক ব্যাধি যার কারণসমূহ একটি গোষ্ঠির মানসের ভেতর থেকে উদ্ভূত হয়। এটা মানুষের বিশ্বাস, চিন্তার ধরণ, স্তর ও বিন্যাসের সাথে জড়িত। এই কারণসমূহ পৃথক ভাবে আলোচনার দাবী রাখে, তবে বলা যায়, নারীকে নিছক সেবাদাসী মনে করা, সম্পূর্ণ ভাবে সমান বা সাবালক না মনে করা, বা আইনি প্রয়োগের অভাবে কারাদণ্ড-ভীতি না থাকা, গ্রাম ছেড়ে নগরে চলে আসার ফলে সমাজ ও আপনজনের নিন্দাভয় না থাকে; তদুপরি রয়েছে রাজনৈতিক গুরুদের প্রশ্রয়,। ইত্যাদি নানান কারণে মানসের বিকৃত প্রবণতা গুলো উস্কানি পেয়ে বেড়ে উঠে সহিংসতার আকার ধারণ করে। নারীর স্বতন্ত্রতা, স্বাধীনতা বা প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে সহিংসতা একটি গুরুতর বাধা।
২. নারীর রাজনৈতিক চেতনা ও অংশগ্রহণ: নারীর রাজনৈতিক সত্তা গড়ে উঠেনি কারণ সে ঘরমুখি। তার সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ কম। ধর্মপালনে সমাবেত হওয়ার প্রচলন সকল ধর্মেই আছে। তবে ইসলামের হানাফি প্রভাবে দেশে নারীদের মসজিদে যাওয়ার প্রচলন নেই, যেখানে ওরা সমবেত হয়ে চিন্তার বিনিময় করতে পারতেন, যেখান থেকে ওরা ওদের স্বার্থের মিলের জায়গাগুলো খুজে পেতেন, যেটা নিয়ে সংঠিত হয়ে কাজ করা যেত। বাংলাদেশের নারীবাদিরাও বিদেশী ঢং অনুকরণ ও অনুসরণ করতে গিয়ে দেশজ সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টের মধ্যে থেকে কিভাবে কাজ করে বঞ্চনার জায়গাগুলো নিবারণ করা যায়, সেই দিকে নজর দেননি। দূর্ভাগ্যবশত বিদেশী অর্থে পরিচালিত প্রজেক্টসমূহে এই ধরণের মৌলিক চিন্তা করার সুযোগ নেই।
তারপরও বাংলাদেশে নানান স্তরে নারীরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীরা অংশগ্রহণ করছেন, কিন্তু নেতৃত্ব স্থানীয় পদে পুরুষের তুলনায় তাদের অনেক কম পাওয়া যায়। নারীদের নিজস্ব কন্ঠ থাকে না, তাদের নিজস্ব চিন্তা সেইভাবে তাদের কর্মক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। দুই শীর্ষ স্থানীয় নেত্রীর উদাহরণ দেওয়া হলেও মনে রাখতে হবে যে তারা দুই পরিবারের রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখার প্রতীক মাত্র। তারা তাদের পূর্বসুরি পুরুষদেরই আসলে প্রতিস্থাপন করছেন। একইভাবে সংসদে নারীদের জন্য ৪৫ টা সিট বরাদ্দ করা হলেও এই সিটগুলো নির্বাচনের মাধ্যমে নারীরা পাচ্ছেন না, এগুলো পাচ্ছেন মনোনয়নের মাধ্যমে। এই সিটগুলোতে নারীদের বসিয়ে ক্ষমাতাসীন এবং অশুভ শক্তি তার অশুভ কাজগুলোই করাচ্ছে। এই সব নারীরা হচ্ছেন অশুভ প্রভুদেরই তাঁবেদার, তারা জনগণের প্রতিনিধি নন।
৩. কর্মজীবনে যোগদানের পরিণতি: ব্রিটেনে কয়েকশ বছর আগে যে কৃষকরা লর্ডদের জমি চাষ করে দিত এবং ওই জমি চাষের বদৌলতেই, সেখানেই ঘর বেঁধে খেয়ে পরে থাকত, তাদের 'serf' বলা হত, কারণ তারা সেই জমি ছেড়ে যেতে পারত না। তারা হতেন 'tied to the soil' অর্থাৎ মাটির সাথে বাঁধা। এ দেশের নারীরাও একইভাবে তাদের সংসারের সাথে বাঁধা আছেন। তারা কর্মজীবি নারী হলেও তাদের কাছ থেকে সংসার পরিচালনার সমস্ত শ্রম আদায় করে নেওয়া হয়। সন্তান লালনপালন থেকে শুরু করে রান্নাবান্না, ও গৃহের যাবতীয় সকল কাজ তাদেরই দায়িত্বে পড়ে। স্বামীরা মনে করেন তাদের কাজ শুধু উপার্জন, স্ত্রীকে গৃহস্থ কাজে সাহায্য করা তার কর্তব্য নয়।
এইজন্য কর্মজীবি নারীদেরকে দ্বিগুণ শ্রম দিতে হয়। তাই অনেক সময় অতিরিক্ত চাপে অনেক নারী উপার্জনমূলক কর্মজীবন ছেড়ে দিতে বাধ্য হন, যেখানে স্বামী উপার্জনকারী। এর অর্থ ওরা আবারও গৃহের চারসীমাতে সীমাবদ্ধ হয়ে যান।
৪. সৃষ্টিশীল নারীর বাস্তবতা: অতিরিক্ত শ্রম দিতে গেলে অবকাশ থাকেনা। আর অবকাশ না থাকলে চিন্তার জায়গাগুলোও অবদমিত হয়ে আসে। তাই যুগ যুগ ধরে অনেক সৃষ্টিশীল নারীরা নিজের স্বাতন্ত্র বজায় রাখার জন্য এবং সৃষ্টিশীল কিছু তৈরী করতে পারার জন্য অবিবাহিত থেকে গেছেন। এদের মধ্যে অনেক প্রখ্যাত লেখিকারা ছিলেন, বিশেষ করে বিদেশে। তার একটা অর্থ এই দাঁড়ায় যে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীরা সংসার করতে পারেন নি, কারণ সংসারটাকে উনারা নির্যাতন মূলক একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেছেন। যেটা তাদের বিশেষ প্রতিভার জায়গাকে শুষে নেবে। তারা তাদের সৃজনশীলতা বিকশিত করার কোন সুযোগ পাবেন না। কিন্তু একজন নারী যদি অবিবাহিত থেকে যেতে চান, সেটার জন্যও পারিবারিক সমর্থনের প্রয়োজন হয়, সেটা আমাদের দেশে সহজে জোটে না। আবার সংসারের মধ্যে থাকলেও, একজন নারী লেখকের লেখালেখির জন্য যে আলাদা একটা সময়, সুযোগ আর ছোট একটা ঘরের প্রয়োজন হয়, এটা নিয়েই প্রখ্যাত নারীবাদী লেখিকা ভারজিনিয়া উল্ফ প্রবন্ধ লিখেছেন, ‘A Room of One' Own’ (১৯২৯).
৫. বাসস্থান: নিরাপদ বাসস্থানের নিশ্চয়তা নারীমুক্তির এক অন্যতম বিষয়: অপরিহার্য ও মৌলিক প্রয়োজন। বিবাহ একজন পুরুষের সামাজিক অবস্থান কে পরিবর্তন করে এবং তার উপর কিছু বাড়তি অর্থনৈতিক চাপ নিয়ে আসে, কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে তার সমস্ত জীবন-বৃত্তটাই পরিবর্তন হয়ে যায়। পুরুষ তার পূর্বের বাসস্থানেই থেকে যান, কিন্তু নারীকে তার বাসস্থান ছেড়ে আসতে হয়, তার পূর্বের যোগাড় করা সারা জীবনের ছোট ছোট আসবাবপত্রও ফেলে আসতে হয়। বিবাহ-সম্পর্কে কোন ছেদ ঘটলে সে তার পূর্বের জায়গায় সহজেই ফিরে যেতে পারেনা । একাধিক কারণে। তার মা বাবার কাছেও সে আগের মত গ্রহণযোগ্য থাকে না, তাঁরাও হয়ত তাদের ছেলেসন্তানের উপর নির্ভরশীল থাকেন, আর মাবাবার অবর্তমানে তো সমস্যা আরো প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। তখন বিবাহিত নারীকে ধারাবাহিক চাপে থাকতে হয়। একজন অনাকাংখিত অনুপ্রবেশকরীর মত। আত্নীয়রা তাগিদ দিতে থাকে স্বামী ও শশুড়বাড়ির সাথে মিটমাট করার জন্য। এই সব ব্যাপার তার আত্নসম্মানবোধ এবং তার মানসিক স্বাস্থ্যকেও মারাত্নক ভাবে প্রভাবিত করে। তখন অনেক সময় শারিরীক ও মানসিক নিরযাতনের আশংকা থাকা সত্তেও নারী তার শ্বশুরবাড়ি ফিরে আসেন, শুরু হয় আবার সেই নির্যাতন। এই ক্ষেত্রে নারীর দাঁড়াবার কোন জায়গায়ই নেই, আইনি লড়াই করার জন্য বা পরিত্রান পাওয়ার জন্য তার ন্যূন্তম অবস্থানও নেই।
নারী আলাদা বাসদা নিতে পারেন। কিন্তু একজন নারীর পক্ষে একক আবাসনের সামাজিক অগ্রহণযোগ্যতা প্রবল। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এই দেশে একজন নারী যদি একা এককভাবে একটি বাসা ভাড়া নিতে যান, তাকে অনেক ধরণের প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়; সচরাচর তাকে ভাড়া দেওয়া হয় না। প্রথমেই প্রশ্ন উঠবে তার স্বামী, মা বাবা, ভাই এর অস্তিত্ব নিয়ে। তার একাকী জীবন কৌতুহলের বিষয় হয়ে উঠবে। আশংকা করা হবে উনি ভাড়া দিতে পারবেন কিনা। তার অস্তিত্বটাই হয়ে যাবে কৌতুহল, সংশয় আর সন্দেহের বিষয়। তার চলাফেরার উপর নজরদারি হবে, তাকে হয়ত যৌন হয়রানির শিকার হতে হবে। এটা অদ্ভুদ একটা ব্যাপার যে, যে সমাজে কর্মজীবি অযুগল বা একা নারীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে, সেখানে এখনও তার অস্তিত্বের এই ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা আসেনি।
ছাত্রী বা কর্মজীবি নারীর জন্য কিছু সরকারি হোস্টেল আছে, তবে এগুলোর পরিমাণ খুবই অল্প। তাই অনেক নারী বেসরকারী হোস্টেল বেছে নিয়েছেন। তবে এইসব হোস্টেল সরকারি হোস্টেলের মত নিরাপদ না, বা হঠাৎ ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হবেনা তারও কোন নিশ্চয়তা নাই। একটা অত্যন্ত শোচনীয় ব্যাপার হল যে, জাতীয় উৎসবগুলোর সময়, যেমন ঈদুল ফিতর বা কোরবানীর ঈদে, এই হোস্টেল গুলো বন্ধ হয়ে যায়, আর তখন ছাত্রীদের হোস্টেল ছাড়তে বলা হয়। অনেক ছাত্রী আছেন যাদের যে কোন কারণে পরিবারের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন, তখন তাদের যাওয়ার জায়গা থাকেনা। এই সব চর্চাগুলো অগ্রহণযোগ্য এবং এখানে সরকারি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
আমাদের দেশে নারীরা প্রতিনিয়ত কোন না কোন শারিরিক ভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছেন বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বেশিভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতনকারীর সাথে একই বাসায় তাকে থাকতে হচ্ছে। এইসব ক্ষেত্রে নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য তার ওই বাসা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোন বাসস্থান নারীর প্রয়োজন হয়, তাই সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশের অস্থায়ী আশ্রয় যথেষ্ট পরিমানে থাকা বাঞ্ছনীয়।
নারীমুক্তি ও প্রাসঙ্গিক বিষয়
সোভিয়েত ইউনিয়নে বোলশেভিক বিপ্লবের পরে নারীকে রান্নার ও অন্যান্য গৃহকর্মের আবশ্যক শ্রম থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। প্রত্যেক বাড়ির সাথে পৃথক রান্নাঘর থাকেতনা, তার পরিবর্তে কয়েক পরিবার মিলে একটি মাত্র পাকঘর থাকত, আবার সরকার পরিচালিত ক্যফেটেরিয়াগুলোতে খাওয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, যেগুলোকে 'স্তলোভায়া' বলা হত। নারীদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য তাদেরকে গৃহকর্ম থেকে অবসর দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়।
প্রখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল এর প্রবন্ধ- গ্রন্থ 'Principles of Social Reconstruction' এ একটা প্রবন্ধ আছে ' Architecture and Social Questions.' এই প্রবন্ধে উনি বলছেন যে নারীর গৃহে গোলামী একটি অণুপরিবার আর স্থাপত্যজনিত সমস্যা। রাসেল বোঝাবার চেষ্টা করছেন যে স্ত্রীরা সারা দিন ধরে গৃহকর্মে লিপ্ত থাকেন। রান্নাবান্না, শিশুদের নাওয়া-খাওয়া, স্কুলে পাঠানো, পড়াশোনা দেখা, ঘর পরিষ্কার, কাপড় পরিষ্কার করা, ইত্যাদি। দিন শেষে ক্লান্ত হয়ে স্বামী যখন বাসায় আসেন তখন দেখেন তার স্ত্রী ক্লান্ত, মেজাজ খিটখিটে, বাচ্চারা হৈচৈ, চেঁচামেচি করছে। স্ত্রী হয়ত এরই মধ্যে আবারও রান্না করছেন। তখন স্বামী টিভির সামনে বসে যান। যে কোন অজুহাতে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এইভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকলে বিবাহিত জীবনের রোমাঞ্চজনক মুহূর্ত বিরল হয়ে পড়ে, থাকে শুধু কষ্ট আর শ্রম। শ বলছেন, স্থাপত্য কে একটু বুদ্ধি করে সাজালে বৈবাহিক জীবনের এই পরিণতি হয়না। কয়েকটা পরিবার আলাদা এপার্টমেন্ট বা গৃহে আছে, কিন্তু রান্নাটা ওরা এক সাথে একটা রান্নাঘরে করাবে, একজন রাঁধুনিকে শ্রমের অর্থ দিয়ে। সবাই মিলে খরচ বহন করলে খরচ পড়বে কম, রান্না হবে বাসার মত, আর নিছক অপ্রয়োজনীয় শ্রম থেকে সবাই রেহাই পাবেন। প্রতিদিনের খাওয়া দাওয়ার জন্য আলাদা ভাবে কেনাকাটা করা, কুটাকুটি করা, আর পাক করা সময়ের কত বড় অপচয়! এই সময়ে বই পড়া যায়, বা কোন না কোন সৃষ্টিশীল কাজ করা যায়।
অবশ্য যারা চাইবেন তারা রান্নার জন্য ছোটখাট ব্যবস্থা তাদের নিজেদের বাসায় রাখতেই পারেন। যখন বিশেষ কিছু রাঁধতে মন চাইবে, তাই করবেন। কিন্তু এই রান্না হবে শখের বসে, আবশ্যক শ্রম নয়!
শিশু দেখাশোনার প্রসঙ্গে রাসেল বলছেন যে একই ভাবে পরিবারগুলোর নিজস্ব প্রাঙ্গনে একটি শিশুশালা থাকবে, যেটাতে অর্থের বিনিময়ে একজন শিক্ষক শিশুদের দেখা-শোনা করবেন আর তাদের নিয়ে খেলবেন আর শিক্ষা দিবেন। এরকম স্থাপত্য আর ব্যবস্থা নিলে নারী গৃহগোলামী থেকে বেঁচে যান। বহির্জগতের নানা প্রকার ও রঙের কর্মকাণ্ডের সাথে লিপ্ত হতে পারেন, ব্যক্তি জীবন পরিত্রান পায়, বৈবাহিক জীবন সুখি হয়। রাসেল এর এই অভিভাবনগুলো অত্যন্ত চমৎকার।
নারীমুক্তির জন্য নিরাপদ বাসস্থান যে একটি অপরিহার্য প্রয়োজন এই বোধটা আসতে হবে। বিদেশে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাতেও, যেখানে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ( welfare state) আছে, সেখানে নারীকে পারিবারিক সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা দেওয়ার জন্য নানা ধরণের অস্থায়ী আশ্রয় আছে, সেখানে সহিংসতার শিকার হয়েছেন বা সহিংসতার আশংকা করছেন, বা থাকার জায়গা নেই, এমন নারীরা যেতে পারেন। এই ধরণের আশ্রয় আমাদের দেশে কয়েকটি এনজিওর আছে। হয়ত সরকারি ভাবেও আছে, কিন্তু পরিসর খুবই কম। আর এইগুলোর পরিবেশ এমন যে, কোন সম্মানজনক নারী এইগুলোতে যাবেন না। তাই অধিক অস্থায়ী আশ্রয়ের প্রয়োজন। একই সাথে আরও সরকারি হোস্টেলের প্রয়োজন। আর যেসব বেসরকারি হোস্টেল আছে, ঐগুলোর তদারকি দরকার। বাসস্থানের সমস্যাটা কিছুটা সমাধান হলে পারিবারিক সহিংসতার হার অনেক কমে যাবে। নারীরা তাদের জীবনের একটা অন্তর্বর্তিকালীন সময়ে সহায়তা পাবেন আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।
সরকার অনেক সময় নারীকে সহায়তা করার জন্য আইন করেছে কিন্তু আইনি কাঠামো নেই। আদালতের কাছে কেবল মামলা করাটাই পরিত্রান নয়, অনেক সময় সমাজ কল্যাণ কর্মীদের আর সমাজসেবকদের হস্তক্ষেপটাই বেশি প্রয়োজন। পেছনে আইনের ভয় থাকলে হস্তক্ষেপে অনেক কাজ হয়। অপর দিকে অনেক নারীরা সামাজিকভাবে আর পারিবারিকভাবে এতই দূর্বল অবস্থানে থাকেন যে আইনি প্রক্রিয়ায় উনারা যাওয়ার সাহস বা শক্তি রাখেন না। তাই এ ধরণের হস্তক্ষেপ দরকার। যেখানে যৌতুকের জন্য নির্যাতন হচ্ছে, বা যে কোন ধরণের নির্যাতন চলছে, সেখানে অপ্রতিকুল পরিস্থিতিতে নারী বা তার সন্তানের স্বার্থে সমাজসেবকদের হস্তক্ষেপ মীমাংসার কাজ করতে পারে।
যেহেতু আমাদের দেশে আইনি প্রক্রিয়া ও পরিত্রান অত্যান্ত জটিল ও দূর্লভ, এই ধরণের হস্তক্ষেপ ন্যায়বিচার প্রাপ্তির জন্য, বা অপরাধমূলক আচরণ দমন করার জন্য একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রায় শোনা যায় সরকারের জনবলের অভাব। তা হলে কলেজ আর ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এই কাজে লাগানো যেতে পারে। এই বয়সের যুবক-যুবতীদের ভাল কিছু করার অনেক উদ্যম থাকে। মানবাধিকার নিয়ে এই ধরণের কাজ করলে ওরাও আরও সংবেদনশীল হবেন, সমাজের চিত্র কাছ থেকে দেখবেন আর ভবিষ্যতে দেশে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ওদের মধ্যে যোগ্যতা জন্মাবে।
আন্তর্জাতিক সনদগুলোতে সরকার বুঝে না বুঝে সই করে দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে নারীকে তার সমান অধিকার দিতে হলে সমাজের বাস্তবচিত্রকে সম্মান করেই কাজ করতে হবে। মানুষের জন্য কাজ করতে হলে মানুষের বিশ্বাসের জায়গাগুলোকে নেহায়েত অসম্মান না করে, সেই বিশ্বাসের বিপরীতে স্থান না নিয়েও কিভাবে কাজ করা যায়, সে পথটা বুঝতে হবে। বিশ্বাসের জায়গার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানুষের ধর্ম। স্বামী বিবেকানন্দ বলে গেছেন, এই দেশে রাজনীতি করতে হলে ধর্মকে বুঝতে হবে, কারণ ধর্ম ভারতবর্ষের মানুষের নাড়ির ভেতরকার জিনিস। তাই ধর্মান্ধতার অপশক্তি থেকে পরিত্রান পেতে হলে ধর্মকে বুঝতে হবে। নয়া-ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি আমাদেরকে শোষণ করার জন্য চরমপন্থি তৈরি করেছে, আর ধর্ম নিয়ে খেলছে। আর আমরা শুধু প্রতিক্রিয়াশীল, খেলাটাকে বুঝে নিয়ন্ত্রণটা নিজের হাতে নিতে পারছি না। নারীমুক্তি প্রশ্নেও আমরা ধর্মান্ধদের উৎপীড়ন করতে দিচ্ছি, আর অপর দিকে বিশ্বাস করছি যে নারীকে পিছিয়ে রাখার প্রবণতা ধর্মের মধ্যে অন্তর্নিহিত। ফলে আমরা খেলাটা হারছি।
অগ্রগতির ধারা ভেতর থেকেই আসতে হবে, কেউ উপর দিয়ে আরোপিত করলে সেটা মানুষ মেনে নিবেনা, সেটাকে প্রত্যাখ্যান করবে। অতএব দেশের প্রথা, তার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল কে সামনে রেখেই নতুন পরিবর্তন কে সামনে নিয়ে আসতে হবে।