গোপাল ভাঁড়ও এভাবেই রাজার সমালোচনা করতেন
এই লেখাটি ৭ জুন ২০১৪ দৈনিক যুগান্তরে উপসম্পাদকীয় হিশাবে ছাপা হয়েছে। 'গোপাল ভাঁড়' রসিক সন্দেহ নাই, গোপাল শুধু হাসায় না, দার্শনিক আগ্রহও জাগায়। কিন্তু গোপাল নিয়ে মনের মতো কিছু লেখা হোল না। এই লেখাটি কবে লিখেছিলাম নিজেই ভুলে গিয়েছি। মোহাম্মদ রোমেল মনে করে দিয়েছেন এবং জোগাড়ও করে দিয়েছেন। রোমেলকে অশেষ ধন্যবাদ।
সাম্প্রতিক কালে 'ভাঁড়', বিশেষত রাজকীয় ভাঁড়ামির দার্শনিক তাৎপর্য নিয়ে নতুন করে ভাবা জরুরী হয়ে পড়েছে। রাজা যখন একই সঙ্গে শাসক, আইনদাতা ও বিচারক তখন কিভাবে আপনি আপনার কথা পেশ করবেন? আপনাকে তখন ভান করতে হবে, আপনি সিরিয়াসলি কিছু বলছেন না, আপনার উদ্দেশ্য একান্তই রাজার বিনোদন, রাজাকে আনন্দ দেওয়া। রাজার দিন গত হলেও আধুনিক রাষ্ট্রে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাও একই পরিস্থিতি তৈরি করে। একটি সমাজে দৃশ্যমান বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা যখন রাজার বিনোদনে নিষ্ঠ, তখন সেটা একই সঙ্গে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার চরিত্রও বটে। আপনি ভাঁড়ামিকে আধুনিক কেন্দ্রীভুত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে আলাদা করলে ভুল করবেন। বুঝতে হবে এমন এক চরম কেন্দ্রীভূত 'রাজকীয়' শক্তি অধিষ্ঠিত রয়েছে যার সম্পর্কে সত্য কথা বললে আপনার গর্দান যেতে পারে।
আপনি গোপনে রাজার বিরুদ্ধে অনেক কথাই বলতে পারেন, যেমন ধরুন ফেইক ফেইসবুক আইডি নিয়ে ক্ষমতাসীনদের কষে গালিগালাজ করলেন। ডিজিটাল আইন বা ৫৭ ধারা আপনাকে স্পর্শ করলো না। এর দ্বারা সমাজ বিশেষ অগ্রসর হয় না। তাই আধুনিক 'দৃশ্যমান বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা' বলতে আমরা বোঝাতে চাইছে আধুনিক কালে রাজার দরবারে সবার সামনে 'ভাঁড়ামি' করবার পরিসর। বঙ্গীয় পরিমণ্ডলে গোপাল যে পরিসরে ভাঁড়ামি করেছিলেন, তাকে রাজার দরবার বলে গণ্য করি, তবে তার বাড়তি অর্থ এতোটুকুই গোপালের গল্প আম জনতা জানতে পারে। । নইলে আমরা গোপাল ভাঁড়ের গল্প পেলাম কোথা থেকে? আধুনিক কালে সেই ভুমিকাটা পালন করে গণমাধ্যম। গণমাধ্যমই এই ক্ষেত্রে 'রাজার দরবার'। ব্যাপারটা সম্যক উপলব্ধি করতে চাইলে টেলিভিশনের যে কোন একটি 'টক শো' দেখে নিতে পারেন।
গোপাল ভাঁড় সিন্ড্রোম নিয়ে আলোচনা আসলে ক্ষমতার সঙ্গে বুদ্ধির চর্চা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতার সম্পর্ক নিয়ে তর্ক। এই তর্ক ক্ষমতা বিচারের তর্ককে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ স্তরে নিতে পারে। লেখাটি আবার ছাপার উদ্দেশ্য আসলে ঐ তর্কে ফিরে যাওয়া। আপাতত পুরানা লেখাটি এখানে পেশ করছি - ফ.ম।
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
গোপাল ভাঁড়ের কথা মনে পড়ছে। ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম কাতর কণ্ঠে বলছেন, শামীম ওসমানের কাছে কি আমাদের ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে? (An Apology to Shamim Osman?, ডেইলি স্টার, ৫ জুন ২০১৪)। গণমাধ্যমের করুণ পরিস্থিতি সম্পর্কে তার লেখা। চক্ষু ছলছল, আকুতিতে ভরা। আর দুর্ভাগ্য আমার, এই লেখা পড়ে আমার গোপাল ভাঁড়ের কথা মনে পড়ছে! গণমাধ্যমের স্তুতি, সমর্থন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মুকুট পরেই তো ক্ষমতা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে বর্তমান সরকার।
বাংলাদেশে দ্রুতবেগে অনেক কিছুই ঘটছে। কী ঘটছে এবং তার সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে সেটা আন্দাজ করা কঠিন নয়। ক্ষমতা ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। ভাঙন আরও ত্বরান্বিত হবে। এটা অনিবার্যই ছিল। কিন্তু মূলস্রোতের গণমাধ্যমগুলোতে সে বিষয়ে আলোচনা করা কঠিন। মূলস্রোতের বাইরে ফেসবুকে, ব্লগে আলোচনা যে হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু তার আঁচ এখনও দৃশ্যমান হয়নি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আকারে-ইঙ্গিতে-ইশারায় বলাই নাকি রীতি।
দার্শনিকদের মধ্যে এ বিষয়ে অবশ্য দ্বিমত আছে। একদল আছেন যারা বলেন, যখন রাজা একই সঙ্গে আইন প্রণেতা, বিচারকর্তা এবং রায় বাস্তবায়নকারী, সেই সময় রাজার সঙ্গে ভাঁড়ামির ছলনায় যদি কিছু বলা যায়, হয়তোবা বলা যেতেও পারে। এ ছাড়া রাজাকে উদ্দেশ করে কিছু বলার আর কোনো উপায় নাই। শূলে চড়বার ভয় থাকে। রাজা যখন একাই সবকিছু, তখন আইন-টাইন বিচার-টিচার কিচ্ছু নাই, কিচ্ছু থাকে না। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির মতো। রাজা বললেন শূলে চড়াও, অমনি শূলে চড়িয়ে দেয়ার লোকের অভাব হবে না।
কিন্তু জনগণকে অবশ্যই হক কথা বলা যায়। কিন্তু তখন তার মানে দাঁড়ায় রাজার বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করা। সেটা তো তখন আর ভাঁড়ামি থাকল না। সিরিয়াস ব্যাপার হয়ে উঠল। যারা ক্ষমতাসীনদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য মৌলবাদ দমন, আইনের শাসন, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতার পরিবর্তন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের কথা বলে এই আধুনিককালেও রাজতন্ত্র বা রানীতন্ত্র কায়েম করেন, তারা শেষ অবধি কাতর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন। ইন্টারেস্টিং হল, যদি এখন বিএনপি ক্ষমতায় থাকত তাহলে বাংলাদেশ ফেইল্ড স্টেইট ফেইল্ড স্টেট বলে ইতিমধ্যে ডংকা বাজতে থাকত। নাহ, মাহফুজ আনাম বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়েছে ,এটা আর ফেরি করছেন না।
অথচ দরকার বাংলাদেশের কাঠামোগত সংকটটা বোঝা এবং তার বাস্তবোচিত সংস্কারের জন্য কাজ করা। নিদেনপক্ষে একটা উদার রাজনৈতিক ব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়ানো। কিন্তু সেটা কি আমরা করি? ফলে আমাদের ভূমিকা হয়ে ওঠে গোপালের মতো। যে রাজতন্ত্র আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের নামে কায়েম করি, তার সামনে ভাঁড় হয়ে দাঁড়াই। গলায় গামছা বাঁধা ভাঁড়ের ভূমিকা ছাড়া আর কীইবা এখন করা যাবে?
এই ভাঁড়ামিকে বোঝাতে তাই সরল ভাষায় বলা যায়, গোপাল ভাঁড় পরিস্থিতি। নাসিরউদ্দিন হোজ্জার উদাহরণ এখানে খাটবে না। ভাঁড় ব্যাপারটা রাজকীয়, রাজারাজড়ার দরবারের জন্যই প্রযোজ্য। গোপাল রাজার ভাঁড় ছিলেন, জনগণের বিনোদন তার কর্তব্য ছিল না। রাজাকে উচিত কথা শোনানোর জন্য তাকে ভাঁড়ামির আশ্রয় নিতে হয়েছে। ভান করতে হয়েছে যে, তিনি যা কিছুই করছেন সবই শুধু রাজাকে হাসানোর জন্য, রাজার বিনোদনই তার রাজকীয় কর্তব্য। তার কথা সিরিয়াস কিছু নয়। তার কাহিনী এখন আমরা হাসির গল্প আকারে পড়ি। কিন্তু তিনি আমাদের হাসানোর জন্য কিছুই করেননি। তার উদ্দেশ্য ছিল রাজার বিনোদন। রাজকীয় আনন্দ উৎপাদন। এর বেশি কিছু নয়। মাহফুজ আনামের লেখা শেখ হাসিনা কিভাবে পড়বেন জানি না। তবে এই লেখায় অনেক আনন্দের খোরাক আছে।
রাজকীয় ভাঁড়ামির অনুমান হচ্ছে, কোনোভাবেই রাজাকে অপসারণ বা উৎখাতের কোনো প্রণোদনা তৈরি করা যাবে না। কিছুতেই না। সেটা গোপালের উদ্দেশ্য হতে পারবে না, কর্তব্য তো নয়ই। এমনকি রাজাকে হেয় করাও ভাঁড়ামির মনোবাসনা নয়। রাজকীয় শক্তির বৈধতা নিয়ে গোপালের কোনো আপত্তি নাই, মাথাব্যথাও নেই। রাজা তো রাজাই। রাজার প্রতি ভালোবাসাও অপার ও অফুরন্ত। গোপালের প্রতি রাজার প্রেমও কম নয়। এই রাজকীয় সম্পর্কের মধ্যে ভাঁড়ামির ছলনায় রাজাকে কিছু বলার চেষ্টা। ব্যস।
দুই
মাহফুজ আনাম বলছেন, গণমাধ্যম জয়নাল হাজারীর বিরুদ্ধে যখন লিখছিল, তখন তো তারা ভুলই করছিল। গণমাধ্যম জয়নাল হাজারীর মতো একজন রাজনীতিকের সঠিক মূল্যায়ন করেনি। তার অবদানের স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। যখন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয়া বন্ধ করল, আর গণমাধ্যম যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ালো, সেটাও ছিল ভুল। মাত্র শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে পাওয়া প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা এই জাতির হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? ৪০ বছরের সময়সীমা বেঁধে দেয়া ছাড়াও ১০ বছরের একটি অতিরিক্ত সময়সহ ঋণশোধের জন্য মোট ৫০ বছর সময় দেয়ার সুবিধাসহ পাওয়া ঋণটি বাংলাদেশ হারিয়েছে। এ রকম সহজ শর্তে পাওয়া ঋণ খুবই দুর্লভ হলেও গণমাধ্যম মহান দেশপ্রেমিক আবুল হোসেনের পক্ষে দাঁড়ায়নি। একজন দেশপ্রেমিকের সম্মান রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণকে তো মূল্য দিতেই হবে। তাই না! সেটা দেয়াও হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং দেশপ্রেমিকের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। আর কিনা গণমাধ্যমগুলো ভুল করে দুর্নীতিকে দুর্নীতিই বলল।
এখন গণমাধ্যমের কর্মীরা আবারও একই ভুল করছে। শামীম ওসমান আর তার পরিবার নিয়ে ব্যাপক পরিমাণ লেখালেখি ঠিক হয়নি। অধিকাংশ সংবাদপত্র যেসব তথ্যবহুল তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী সেগুলোর সবই ভুল। জাতীয় সংসদে ওসমান পরিবার নিয়ে বিস্তর প্রশংসা করা হয়েছে। সংসদে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, যেখানে অন্যদের বড় বড় অন্যায় নিয়ে কোনো কথাই বলা হয় না, সেখানে তাদের পরিবারের (ওসমান পরিবার) ছোট ছোট ভুলকে সব সময় বিশাল করে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। আসলেই গণমাধ্যম ঠিক করছে না।
প্রধানমন্ত্রী ভাবনা উসকে দেয়ার মতো কিছু নতুন পরিভাষা নির্মাণ করেছেন। যেমন রাজনৈতিক পরিবার। তো তিনি বলছেন, কোনো পরিবার, যারা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছেন, তারা কোনো না কোনো অপরাধ অবশ্যই করেছেন। কোনো অপরাধ করেননি এমন রাজনৈতিক পরিবার খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। শেখ হাসিনা অপরাধের দায় থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য এই রাজনৈতিক তত্ত্ব হাজির করেছেন। মাহফুজ আনাম বলছেন, এই তত্ত্বটা লোহার বর্মের মতো তিনি ব্যবহার করতে চাইছেন। তিনি চাইছেন, আমরাও যেন খুব সাধারণ ও স্বাভাবিকভাবে সব রাজনৈতিক পরিবারের অপরাধ মেনে নিই। তার ও তার পরিবারের অপরাধ তো অবশ্যই। একে গণনার মধ্যে আনাও ঠিক না।
শামীম ওসমানের বড় ভাই ও জাতীয় পার্টির প্রয়াত সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের প্রতি শেখ হাসিনার শ্রদ্ধা এতটা গভীর জানা ছিল না। গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আইন নিজস্ব পথেই চলবে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে কোনো পরিবার যেন হেয় না হয় এবং ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ধ্বংস না হয়ে যায়, সে ব্যাপারে জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে। এ কথার সূত্র ধরেই মাহফুজ আনাম বলছেন, শামীম ওসমান ও তার পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের কাছে এখন আমাদের ক্ষমা চাইতে হবে। অর্থাৎ গণমাধ্যমের উচিত শামীম ওসমানের কাছে মাফ চাওয়া।
প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় রাজনৈতিক পরিভাষা হচ্ছে দেশপ্রেম। আমরা যেভাবে দেশপ্রেম বুঝি সেভাবে বুঝলে হবে না। গত বছরের ত্বকী হত্যা, সম্প্রতি সাত ব্যক্তির হত্যা, ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে বিভিন্ন অবৈধ কার্যকলাপ ও অপরাধী কার্যক্রমের বিষয়ে ক্রমাগত প্রকাশিত হতে থাকা প্রতিবেদন- এ সবকিছুই নারায়ণগঞ্জের জনপ্রিয় পরিবারটিকে ধ্বংস করার চক্রান্তেরই অংশ। অতএব গণমাধ্যমের এই ভূমিকা কিছুতেই দেশপ্রেম নয়। এতে অবশ্য নারায়ণগঞ্জবাসীর দেশপ্রেম নিয়েও ঘোরতর সন্দেহ উপস্থিত হয়। তারা যে এত দেশদ্রোহী হয়ে গিয়েছে, এটা অবশ্য আমারও জানা ছিল না। কারণ তারা নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে শামীম ওসমানকে ভোট দেয়নি, সিংহভাগই ভোট দিয়েছে সেলিনা হোসেন আইভীকে। খুবই খারাপ কথা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ওসমান পরিবারের অবদানের স্বীকৃতি তারা দেয়নি। এটা কিছুতেই দেশপ্রেমের লক্ষণ হতে পারে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী শামীম ওসমান নগণ্য ভোট পেয়ে আইভীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন কিভাবে? দেশপ্রেমের অভাবে। মাহফুজ আনাম বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে এটাই প্রমাণ হয় যে ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে করা হিংস্র ষড়যন্ত্রের অংশের সর্বজনীন শিকার নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা। বহু মামলার তদন্ত চলছে, যেগুলোর তীর কোনো না কোনোভাবে এই ওসমান পরিবার ও পরিবারটির বহু সদস্যের দিকেই নির্দিষ্ট। প্রধানমন্ত্রী তাই জনসম্মুখে ওসমান পরিবারের পাশেই দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জাতীয় সংসদে সেই ঘোষণাই দিয়েছেন।
আসলেই। শামীম ওসমানের কাছে গণমাধ্যমের অবশ্যই ক্ষমা চাওয়া উচিত।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশের বিদেশী বন্ধুদের সম্মানিত করতে যে স্বর্ণপদক দেয়া হয়েছিল, সেখানেও দুর্নীতি। সবাই ছি-ছিক্কার করলেও ভেজাল স্বর্ণপদক নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোটেও শরমিন্দা হননি। হওয়ার কথা কি? তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, মূল বিষয় এটাই যে তাদের আমরা সম্মানিত করেছি। ওই পদকগুলোতে কত তোলা স্বর্ণ থাকার কথা ছিল আর কী পরিমাণ স্বর্ণ বাস্তবে পাওয়া গেছে, সেসব লেখার মাধ্যমে আমরা শুধুই নিজেদের ছোট করছি। লেখালেখির মাধ্যমে গণমাধ্যম এ ধরনের সেনসিটিভ ইস্যুতে খুবই ভুল করছে। তাছাড়া এসব বিষয়ে কোনো না কোনোভাবে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা আছে। প্রধানমন্ত্রীর এই সন্দেহ মোটেও অমূলক নয়। তাই না?
গণমাধ্যমের অপরাধের শেষ নাই। শেখ হাসিনা বলেছেন, খালেদা জিয়ার শাসনামলে তথাকথিত অপারেশন ক্লিন হার্ট অভিযানের সময় প্রায় ১৫০ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর ২০০৪ ও ২০০৫ সালে অভিযান চালিয়ে র্যাব হত্যা করেছিল আরও হাজারাধিক ব্যক্তিকে। সে সময় তাদের বিরুদ্ধে কেন কোনো আওয়াজ তোলা হয়নি। এখন কেন এত কথা বলা হচ্ছে? হুম!! প্রধানমন্ত্রী আসলে ভুলে গিয়েছেন, সেই সময় অনেকেই প্রতিবাদ করেছিলেন। তবুও প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছেন, তখন তার কথাই ছহি। নাহ, কেউ প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু এখানে পাঞ্চলাইন, অর্থাৎ গণমাধ্যমের নাক বরাবর ঘুষিটা কোথায় মারছেন প্রধানমন্ত্রী?
মারছেন এভাবে যে, বিএনপির আমলে র্যাবের হত্যার বিরুদ্ধে যদি প্রতিবাদ না হয়ে থাকে, তাহলে এখনও প্রতিবাদ করা যাবে না। র্যাব কয়টা মানুষ মারল, কীভাবে মারল, পেট কোথায় ফুটা করল কিংবা কোন নদীতে কবর দিল এসব কিছুই গণমাধ্যম বলতে পারবে না। তখন কোনো প্রতিবাদ হয়নি, কাজেই এখনও কোনো প্রতিবাদ করা যাবে না। যুক্তিসঙ্গত কথা।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই বার্তা পেয়ে মাহফুজ আনামের প্রায় ভেঙে পড়ার জোগাড়। তিনি করজোড়ে জানাচ্ছেন, যদি বিএনপির আমলে র্যাব এত লোককেই মেরে ফেলে থাকে, তাহলে তার তদন্ত ও বিচার হচ্ছে না কেন? সে সময় থেকেই র্যাব উন্মত্ত আচরণ করতে শুরু করেছিল, তাহলে আবারও কি সেই আগের মতোই উন্মত্ত হয়ে র্যাব একই ঘটনা ঘটাতে পারে না?
প্রধানমন্ত্রী তৃতীয় যে রাজনৈতিক পরিভাষা আবিষ্কার করেছেন সেটা হচ্ছে, স্থায়ী সরকারি দল। কিছু ব্যক্তি আছেন যারা সবসময়েই সরকারের লেজ ধরে থাকেন, তা সে যে দলই সরকারে থাকুক না কেন। নিজেদের রক্ষা করতে এই ব্যক্তিরা নতুন কোনো দল সরকার গঠন করলেই সেই দলে অংশগ্রহণ করে ফেলেন। কথাগুলো প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার মামলার মূল সন্দেহভাজন নূর হোসেনের প্রসঙ্গে বলছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী নূর হোসেন প্রথমে জাতীয় পার্টির লোক ছিলেন, তারপর ১৯৯১ সালে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন এবং সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। তারপরও এই ব্যক্তিকে আওয়ামী লীগের প্রথম সারিতে শেখ হাসিনা নিতেই পারেন। তাতে গণমাধ্যমের আপত্তি করার কী আছে? পরবর্তী ১৮ বছর ধরে তাকে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা হিসেবেই শেখ হাসিনা রেখেছেন। এটা ছিল তার অপরাধমূলক কার্যকলাপের জন্য লাইসেন্স অর্থাৎ অনুমতিপত্র। আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে তার পরিচয়পত্রটিই হচ্ছে খুনের লাইসেন্স। তাতে গণমাধ্যমের কী অসুবিধা? কারণ রাজনৈতিক পরিবারগুলো তো অপরাধ করবেই। রাজনৈতিক পরিবার বলতে শেখ হাসিনা তো এটাই বোঝেন। কোথায় এমন রাজনৈতিক পরিবার আছে যারা দুর্নীতি, দুর্বৃত্তপনা আর খুন-খারাবি করেনি? বলুন তো?
হ্যাঁ, আওয়ামী লীগে এরকম স্থায়ী সরকারি দল করেন এমন সদস্য আর কতজন আছেন, গণমাধ্যম তা জানতে চাইতেই পারে। তাদের নাম জানা থাকলে তাদের দেশপ্রেম সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে তাদের বিব্রত করা থেকে গণমাধ্যম বিরত থাকতে পারে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের নিরাপত্তার ছায়ায় থেকে এখনও তারা কী কী অপরাধমূলক তৎপরতা চালাচ্ছেন, সে ধরনের কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। সেটা ঠিক হবে না।
শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনজন বহিষ্কৃত র্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের জন্য কেন উচ্চ আদালতের দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি বেঞ্চ আদেশ দিলেন? ওই তিন ব্যক্তির মধ্যে একজন একটি আদালতে জবানবন্দিতে তার অপরাধ কবুল করে নিয়েছে। ওই তিনজনকে গ্রেফতার না করলে অবশ্য গণমাধ্যম হয়তো বিশেষ কিছু জানত না। অপারেশনের ডিটেল জানা কঠিন হতো। কিন্তু তারপরও প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য হচ্ছে, বিচারকরা ভুল ছিলেন এবং আইনমন্ত্রীও একদম ঠিক কথা বলেছেন- বিচার বিভাগে অরাজকতা চলছে।
এত কিছুর পরও মাহফুজ বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর এত সুন্দর কথাবার্তা থেকে ঠিক কোন বার্তাগুলো বের করে নেব সে ব্যাপারে আমরা ঠিক নিশ্চিত নই। প্রধানমন্ত্রীর এতসব বক্তব্যের ভেতর থেকে তিনি ঠিক কোনটা নেবেন তা নাকি বুঝতে পারছেন না। তিনি নিশ্চিত নন। তার লেখার এই শেষাংশে এসে আমার গোপাল ভাঁড়ের কথা মনে পড়ল।
তাছাড়া স্বীকার করতে দোষ কী যে গোপালকে আমার ভালো লাগে। আজও তার গল্প শুনতে ও পড়তে পছন্দ করি। আর এখনই তো গোপাল ভাঁড়ের হাস্যরস আস্বাদনের শ্রেষ্ঠ সময়। মাহফুজ আনামের লেখাও ভালো লেগেছে। অস্বীকার করি কী করে!!!
২৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২১। ৬ জুন, ২০১৪। শ্যামলী, ঢাকা