মত প্রকাশের স্বাধীনতা বনাম চিন্তার স্বাধীনতা: একটি তৎপর চিন্তার পত্রিকা দরকার
[এই লেখাটি ৮ অগাস্ট ১৯৯১ সালে চিন্তা প্রথম প্রস্তুতি সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। বাংলাদেশে 'পাক্ষিক চিন্তা'র মতো একটি পত্রিকা বের করার পেছনে কী ধরণের ইচ্ছা কাজ করেছিল তার কিছুটা হদিস এই লেখায় পাওয়া যাবে। চিন্তা পত্রিকা এবং চলমান সাপ্তাহিক চিন্তা পাঠচক্রকে বুঝতে হলে এই লেখাটি গুরুত্বপূর্ণ। চিন্তা পাঠচক্রের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান হচ্ছে সক্রিয় ও সজীব চিন্তাকে 'মত' বা ছকে বাঁধা আদর্শ থেকে আলাদা গণ্য করা। একে আমরা সজীব ও সক্রিয় চিন্তার পর্যালোচনার সঙ্গে মতাদর্শিক বিশ্বাসের পার্থক্য হিশাবেও গণ্য করতে পারি। চিন্তা গ্রুপের স্বাতন্ত্র্য বা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বাংলাদেশে পর্যালোচনার (Critique) সামর্থ্য গড়ে তোলা।
বাংলা ভাষায় পর্যালোচনাকে আরও সহজ ভাষায় বলা হয় 'বিচার'। সজীব ও সক্রিয় 'চিন্তা'র সঙ্গে 'মত প্রকাশ'-এর ভেদ নির্ণয়ের মধ্য দিয়ে চিন্তা এগোয়। আমরাও সেই ভাবেই অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে আসছি এবং করছি। যাঁরা চিন্তা পাঠচক্রে নিয়মিত আসেন এবং যাঁরা আমাদের অনুসরণ করছেন তাঁরা লেখাটি পড়লে আমাদের তৎপরতা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা আপনারা পাবেন - ফম]
পাক্ষিক চিন্তা প্রকাশ উপলক্ষে চিন্তা সম্পর্কে কিছু কথা মনে জেগেছে। বিশেষত সজীব ও সক্রিয় চিন্তা এবং তার প্রক্রিয়ার ফলাফল হিশাবে সিদ্ধান্ত বা ‘মত’ যে এক কথা নয়, সেটা প্রায়ই আমরা মনে রাখি না। আমরা মতকে চিন্তা এবং চিন্তাকে মত হিশাবে এলোমেলো বিচ্ছিন্ন ভাবে ব্যবহার করি। সে বিষয়ে কিছু কথা বলা জরুরি হয়ে পড়েছে।
গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের উৎসাহ ও লড়াকু মনোভাবের একাট খ্যাতি আছে। যদিও গণতন্ত্র আসলে কি সেটা সম্পর্কে আমরা খুব যে একটা ভাবনা চিন্তা করি তা নয়। পাক্ষিক চিন্তা গণতন্ত্রের পক্ষের একটি পত্রিকা হবে এটা আশা করা যায় নিশ্চয়ই। কিন্তু ‘গণতন্ত্রের পক্ষের পত্রিকা’ বা ‘গণতান্ত্রিক পত্রিকা’ ইত্যাদি কথার মানে কি? কিভাবে আমরা সেটা নির্ণয় করব? বাংলাদেশে আমরা সবাই গণতন্ত্রের জন্য লড়ছি, ধরা যাক গণতন্ত্র বুঝি বা না বুঝি তার জন্য যার লড়ছি -পাক্ষিক ‘চিন্তা’ তাদের সকলেরই মত কিম্বা চিন্তার আদানপ্রদানের পত্রিক হবে। যেন গণতন্ত্র সম্পর্কে আমামদের রাজনোইতিক ধ্যান ধারণা স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। প্রস্তুতি সংখ্যা হিশাবে এই সরল ও সহজ প্রস্তাব মেনে নিতে আমাদের কোন অসুবিধা হবার কথা নয়।
‘সকলেরই পত্রিকা’ এই কথা কানে শুনতে যতো ভাল লাগে কথাটা পরখ করতে বসলে নানান খুঁত বের হয়। যেমন, ‘সকলের পত্রিকা’ কথাটার মানে কি? কোন পত্রিকার পক্ষেই সকলের পত্রিকা হওয়া সহজ কাজ নয়। তবুও এর একটা মানে হতে পারে যে এটি সকল মতামতের পত্রিকা। তার মানে নানান মত ও চিন্তার জন্যে পত্রিকাটিকে জায়গা করে দিতে হবে।
যদি তাই হয় তাহলে কেউ যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস না করে তাকেও কি জায়গা করে দিতে হবে? এই প্রশ্নটা মুখিয়ে উঠলেই মনে খচখচি শুরু হয়। আসলে গণতন্ত্র বলতে সকল মত ও পথের সহাবস্থান, পরমতসহিষ্ণুতা, প্রভৃতি বিষয়কে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে যাতে গণতন্ত্র এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে গণতন্ত্র বিরোধীদের তৎপর ও সক্রিয় থাকার একটা চমৎকার কৌশল। যে ব্যক্তি গণতন্ত্র বিরোধী তাকেও গণতন্ত্র মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে গণতন্ত্রের বিরোধিতা ও তার ধ্বংস সাধন করার সুযোগ করে দেয়।
অনেকে বলবেন, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ ছাড়া গণতন্ত্র হয় কি করে? খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে বেসামাল হয়ে যেতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে গণতন্ত্রের শক্রদের গণতন্ত্র বিরোধী মত প্রকাশের জন্য অনেকে জায়গা না করে দিয়ে পারা যায় না। এর পক্ষে যুক্তিটা খুব সহজ। গণতন্ত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সকলের আছে, অতএব যারা গণতন্ত্র চায় না, গণতন্ত্রকে যারা ধ্বংস করতে চায়, তাদের মতটাও প্রকাশ করার অধিকার গণতন্ত্রে থাকা চাই। নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারবার এই নীতিটা ভাল করে খেয়াল করতে হবে। না করলে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ নামক কথাটার পেছনে ধ্বংসাত্মক অগণতান্ত্রিকতা কি করে ঘাপটি মেরে থাকে সেটা সহজে বোঝা যায় না। অথচ গণতন্ত্রে অবশ্যই চিন্তার বিতর্ক, মত ও পথের বিতণ্ডা ও দ্বন্দ থাকা চাই। মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে সেই সেই বিতর্ক ও মতের দ্বন্দ্বের মীমাংসা কিভাবে সম্ভব? দেখা যাচ্ছে এক্ষেত্রে একটা অস্পষ্টতা বা গলদ থেকে যাচ্ছে। ফলে এ বিষয় কিছু কথা অতি সংক্ষেপে চিন্তার প্রস্তুতি সংখ্যায় বলা দরকার। যদিও পাক্ষিক চিন্তায় এই সকল গভীরতর প্রশ্ন নিয়ে আরো দীর্ঘ আলোচনা হবে বলে আমরা আশা করি।
গলদটা শুরু হয় ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ আর ‘চিন্তার স্বাধীনতা’ এই দুইয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য সম্পর্কে অস্পষ্টতার কারণে। কারো একটি মত থাকতে পারে যা সে ‘বিশ্বাস’ করে। সে বিশ্বাস সরাসরি গণতন্ত্রের বিরোধীও হতে পারে। যেমন, নাৎসিরা বিশ্বাস করতো যে বিশুদ্ধ রক্তের সূত্রে দুনিয়ায় তারাই শাসক জাতি। অন্যান্য জাতি তাদের মতো বিশুদ্ধ নয়, তাদের রক্তে আর্য্য আভিজাত্যের যে ধারা প্রবাহমান সেটা অপরাপর নিম্ন জাতির মধ্যে নাই। অতএব পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলতে ও বাসযোগ্য রাখতে হলে অন্যান্য অশুদ্ধ ও নিম্ন স্তরের জাতিদের মেরে কেটে সাফ করে ফেলতে হবে। এই মতের বাস্তবায়নের জন্য লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। নাৎসিদের এই বীভৎস হত্যাযজ্ঞ যে ‘মত’–এর ওপর প্রতিষ্ঠিত সেটা প্রকাশ করার স্বাধীনতা কি তাহলে গণতন্ত্রে আছে?
বাংলাদেশ থেকে একটি উদাহরণ দেয়া যাক। বাংলাদেশ জামাতে ইসলামী খুবই পরিষ্কার ভাষায় বলে যে তারা যদি ক্ষমতায় যায় তাহলে গণতন্ত্র নয়, বাংলাদেশকে তারা ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ বানাবে। বাংলাদেশে ইসলামি শরিয়াহ আইন বাস্তবায়ন এই দলের উদ্দেশ্য। জামাতের রাজনোইতিক লক্ষ্য হচ্ছে "রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের মাধ্যমে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা"। এই ধরণের রাষ্ট্রে শুধু ‘বিধর্মী’দের নাগরিক অধিকারই ক্ষূন্ন হবে না, সকল নাগরিকেরই নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন হবে। এই ভাবে পরিষ্কার ভাবে গণতন্ত্র ধ্বংস করা নীতি, মত ও পথের যারা অনুসারী,তাদের মত প্রকাশের অধিকার কি গণতন্ত্রে থাকতে পারে?
অনেকে বলবেন এই ধরণের অগণতান্ত্রিক ধারাকে গণতন্ত্রে সক্রিয় থাকতে দেয়া যাবে না কেন যাবে না? কারণ এগুলো হচ্ছে বিশ্বাস। কিন্তু ব্যাপারটা এতো সহজ নয়। কারণ গণতন্ত্রও তো একটা বিশ্বাস, একটা সিদ্ধান্ত। কমিউনিজমও একটা বিশ্বাস। যে মত আমার কাছে সত্য বলে মনে হয় তাকেই তো আমরা বিশ্বাস করি। যদি নাৎসিদের বা জামায়াতে ইসলামীর মতপ্রকাশের অধিকারকে আমরা অধিকার হিসাবে স্বীকার না করি তাহলে সে ব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলা যাবে কি? যদি মত প্রকাশের অধিকার আমরা স্বীকার না করি তাহলে তাহলে গণতন্ত্রী কিম্বা কমিউনিস্টদের মত প্রকাশের অধিকারও তো রক্ষা করা যায় না। এই মুশকিল তো সহজে নিরসন করার নয়।
অতএব আরো গোড়ার দিকে তাকাতে হবে।
আমরা যখন কোন মতে পৌঁছাই, কিম্বা কোন মতকে সত্য বা বিশ্বাস হিসাবে আঁকড়ে ধরি, সেই অবস্থায় আমরা দুভাবে পৌঁছাতে পারি। এক হতে পারে অন্যের কাছে আমরা সেই মত শুনেছি এবং আমামদের তা যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। কিম্বা সেই মত বা বিশ্বাসের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আমরা বড়ো হয়েছি। ফলে সেই মত বা বিশ্বাস আমাদের কাছে স্বাভাবিক বা স্বতঃস্ফুর্তভাবেই সত্য মনে হয়। দ্বিতীয় যে প্রকারে আমরা একটা মত বা বিশ্বাসে পৌঁছাই সেটা হচ্ছে যখন কোন বিষয় নিয়ে আমরা ভাবি বা চিন্তা করি তখন একটা চিন্তা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা সিদ্ধান্তে পোঁছাই। অর্থাৎ চিন্তার ফলাফল হিসাবে একটা মতে বা বিশ্বাসের একটা অবস্থানে এসে আমরা দাঁড়াই। যে অবস্থান আমাদের সত্য বলে মনে হয়। এখন, এই যে দুই ভাবে সত্যে পৌঁছাবার পথ উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক আছে। কোন চিন্তা না করে প্রথম ধরণের সত্যে পৌঁছানোর পেছনে কোন চিন্তা নাই ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। যেমন, কার্ল মার্কসের চিন্তা সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত না হয়েও এবং সমাজ বা অর্থনীতি বিষয়ে নিজে কিছু ভাবনা চিন্তা না করে মার্কসের মতো একই সিদ্ধান্তে না পৌঁছেও – অর্থাৎ খুব কম জেনেও অনেকে ‘মার্কসবাদী’ হতে পারে। সেটা হতে পারে বন্ধুদের প্রভাবে, পুঁজিপতিদের পছন্দ করে না বলে, কিম্বা যে সংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তারা বড়ো হয়েছে তার বদৌলতে। পুরানা সমাজ যখন ভাঙে তখন পুঁজির প্রতি এক ধরণের পেটিবুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীলতা কাজ করে, সেটা পুরানা অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রতি পক্ষপাত থেকে তৈরি হয়। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের তীব্র প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা মেনে নেওয়া সহজ নয়। কিন্তু তারপরও বলা যায় কার্ল মার্কস না পড়েও তাঁর মতের প্রতি পক্ষপাত কারো মধ্যে তোইরি হতেই পারে। তাহলে নিজে সরাসরি কোন চিন্তা না করে কোন মতে বিশ্বাস স্থাপন করা মানে সেই মতের পেছনে কোন চিন্তা নাই এই কথা ঠিক নয়। যেমন, যে চিন্তা কার্ল মার্কস করে গিয়েছেন, কেউ নিজে চিন্তা না করে কার্ল মার্কসের সেই চিন্তায় অনায়াসেই আস্থা স্থাপন করতে পারে। অর্থাৎ নিজে চিন্তা না করলেও অপরের চিন্তার ওপর মানুষ বিশ্বাস স্থাপন করতেই পারে। তাহলে যে মতে সে বিশ্বাস স্থাপন করলো সেটা তার নিজের চিন্তা না হলেও সেটা আসলেই চিন্তা ক্রিয়ারই একটা ফল, একটা অবস্থান। নিজে চিন্তা করলাম না, কিন্তু অন্য চিন্তা প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্তে আস্থা স্থাপন করলাম এটা তো হতেই পারে। তবে এই ক্ষেত্রে যেটা বিশেষ ভাবে মনে রাখা দরকার সেটা হোল নজে সক্রিয় ও সজীব ভাবে চিন্তা করতে পারা আর তা না করে অন্য কারো চিন্তার সিদ্ধান্ত মেনেন নেওয়া বা বিশ্বাস করা – এই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। অর্থাৎ চিন্তার সজীব ও সক্রিয় প্রক্রিয়া আর চিন্তার সিধান্ত বা ‘মত’ এক কথা নয়। চিন্তা নয় বা চিন্তা প্রক্রিয়া নয় মত মানে আসলে চিন্তার বিরতি বা সিদ্ধান্ত। খোদ চিন্তা ক্রিয়াকে নয়,বা সজীব ও সক্রিয় চিন্তাকেও নয়, চিন্তার ফলাফলকেই আমরা মত বলে আখ্যায়িত করি।
ধর্মের পেছনেও চিন্তা আছে। চিন্তা থাকে। কিন্তু আমরা যখন কোন ধর্ম গ্রহণ করি বা ধর্মীয় সিদ্ধান্ত মানি তখন সেটা আমাদের নিজের চিন্তার প্রক্রিয়া থেকে জাত সিদ্ধান্ত নয়। চিন্তা এই ক্ষেত্রে নিজের সম্পর্কে সচেতন নয়। ধর্ম মনে করে বা তার প্রধান অনুমান হচ্ছে চিন্তাটা এসেছে চিন্তার বাইরে থেকে। ওহি হিশাবে নাজিল হয়েছে এবং নবিরসুলদের আমরা সত্যবাদি বলে বিশ্বাস করি। তাহলে ধর্মীয় চিন্তা সজীব ও সক্রিয় চিন্তার ফল বা মানুষের চিন্তা থেকে জাত নয়। ধর্মীয় চিন্তা সম্পর্কে এই অনুমান প্রবল। এই অর্থে সজীব ও সক্রিয় চিন্তার বিপরীতে ধর্মীয় চিন্তাকে আমরা ‘বিশ্বাস’ বলে থাকি। বিশ্বাস মানে কোন না কোন মতে বা সিদ্ধান্তে বিশ্বাস । সেটা নিজের চিন্তা প্রক্রিয়ার ফল নয়। মানুষের চিন্তা বা চিন্তা প্রক্রিয়ার বাইরের অন্য কোন আধ্যাত্মিক বা ঐশ্বরিক উৎস থেকে ধর্মীয় সিদ্ধান্তের জন্ম, ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে এটাই আমাদের সাধারণ অনুমান।
চিন্তার এই ধর্মীয় পর্যায় – অর্থাৎ যখন সিদ্ধান্ত আমাদের সজীব ও সক্রিয় চিন্তার সিদ্ধান্ত নয়, বাইরের থেকে তৈরি সিদ্ধান্ত, তখন চিন্তার প্রক্রিয়াকে আমরা বুঝি না, বা বুঝতে পারি না। বুঝতে না পারাটা অন্যায় কিছু নয়, কারন চিন্তা নিজের সম্পর্কে নিজে সচেতন হয়ে ওঠার ঘটনা বিশাল ঐতিহাসিক অর্জন। ধর্ম বিশ্বাস বলা যায় চিন্তার শৈশবাবস্থা। ধর্ম এই অবস্থায় সরাসরি নিজেকে চিন্তার বিপক্ষে দাঁড় করায়। যে সত্য বা বাক্যে ধর্ম বিশ্বাস করে সেটা যে মানুষেরই ঐতিহাসিক বিকাশের একটা পর্যায়ের ভাবনা সেটা ধর্ম একেবারেই অস্বীকার করে। ধর্মীয় সিদ্ধান্তকেই সার্বজনীন সিদ্ধান্ত বা সত্য হিশাবে দাবি করে। এ কারণে সজীব ও সক্রিয় চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের বিরোধ খুবই গোড়ার একটা গোলমাল।
এখন,যদি খোদ চিন্তা বা সজীব ও সক্রিয় চিন্তা প্রক্রিয়ার প্রতি খেয়াল না করে কেবল চিন্তার ফলাফল বা সিদ্ধান্তের ওপরই আমাদের নজর থাকে যে কোন ‘মত’ বা চিন্তাজাত বিশ্বাসকেই আমরা চিন্তা বলে ভুল করব। মত, তবাদ, ধারণা বা চিন্তাজাত বিশ্বাস হচ্ছে চিন্তার বা চিন্তা প্রক্রিয়ার ফলাফল। এরা খোদ চিন্তা প্রক্রিয়া নয়, চিন্তার ফসল মাত্র। তাহলে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ বলতে সক্রিয় ও সজীব চিন্তার স্বাধীনতা বোঝায় না, শুধু বোঝায় কোন একটা সময়ের কোন এক বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে চিন্তা যে একটি সিদ্ধান্তে এসেছিল সেই সিদ্ধান্ত বা ‘মত’ প্রকাশের স্বাধীনতা।
তাহলে ‘মত’ বা ‘সিদ্ধান্ত’ আর সজীব ও সক্রিয় চিন্তা দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস – এই বিশাল ফারাক আমাদের সবার আগে পরিষ্কার বুঝতে হবে। এই ফারাক বোঝা কঠিন কিছু নয়। সাময়িক ‘সিদ্ধান্ত’ বা ‘মত’ সজীব ও সক্রিয় চিন্তা যে কোন সময়ই পর্যালোচনা বা বিচার করতে পারে, পুরনা সিদ্ধান্ত বা মত বাতিল, সংস্কার কিম্বা নতুন যুক্তি যোগ করতে পারে। তাহলে সজীব ও সক্রিয় চিন্তার বিপরীতে মত বা সিদ্ধান্তের সার্বজনীনতার দাবি সবসময়ই সক্রিয় ও সজীব চিন্তার অধীন। চিন্তার পরবর্তী বিকাশে যে কোন প্রাচীন, পুরানা বা বদ্ধমূল সিদ্ধান্তকে চিন্তা যে কোন সময়ই নতুন করে পর্যালোচনা করতে পারে। একই বিষয়ে চিন্তা আবার ভেবে দেখতে পারে, আরো অগ্রসর অবস্থান নিতে পারে। চিন্তার বিকাশ সজীব ও সক্রিয় চিন্তার অর্ন্তনিহিত স্বভাবেরই অন্তর্গত।
‘চিন্তার স্বাধীনতা’র দাবি যখন তোলা হয় তখন সেটা আর ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ থাকে না। কারণ, চিন্তার স্বাধীনতা মানে ভুল, অসম্পূর্ণ, অবিকশিত ইত্যাদি সকল ‘মত’কে নাকচ করে দেবার স্বাধীনতাও বটে। কিন্তু ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ দাবি করে যেসব মত ও সিদ্ধান্ত চিন্তা তার নিজস্ব বিকাশের কারণে নিজস্ব যুক্তিতে অসত্য, বাতিল ও ক্ষতিকর মনে করে তাদের টিকিয়ে রাখতে হবে, কোন ব্যাক্তি সেই মত বা সিদ্ধান্ত ধারণ করলে তাদের প্রচার ও প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকতে হবে। শুধু তাই নয়,এমন কি চিন্তা প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক বিকাশ ও তৎপরতার বিরোধী সিদ্ধান্ত ও মতাদর্শ– অর্থাৎ সজীব ও সক্রিয় চিন্তা বিকাশের বিরোধী মতগুলোর প্রকাশ ও প্রচারের অধিকার মেনে নিতে হবে। কারণ তা ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকারের মধ্যে পড়ে। বাতিল ও ক্ষতিকর মত গুলোকে চিন্তা বিকাশের প্রতিবন্ধক হিসাবে খাড়া করবার অধিকারও চায় ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’র দাবিদাররা। গণতন্ত্রে সেটা ব্যক্তির অধিকার হিশাবে স্বীকৃত।
তাহলে দেখা যাচ্ছে গণতন্ত্রের সত্যিকারের কথাটা ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ নয় বরং চিন্তার স্বাধীনতা’ই গণতন্ত্রের আসল কথা। সজী ও সক্রিয় চিন্তার বিকাশই আসল কথা। আমরা যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, যে সত্যে পৌঁছাই, যে মতে অবস্থান নেই সবকিছুরই মূল উৎস হচ্ছে সক্রিয় চিন্তা বা চিন্তার সক্রিয় প্রক্রিয়া। তাহলে আমাদের বিকশিত হবার, সামনে এগিয়ে যাবার – বিশেষত ভুল,অসম্পূর্ণ ও অবিকশিত মত ও পথকে পেছনে ফেলে সম্মুখে অগ্রসর হবার শর্ত হচ্ছে চিন্তাকে সক্রিয় করা ও সক্রিয় রাখা। কোন মতের ওপর বা চিন্তার কোন ইতিহাস –নিদিষ্ট ফলাফলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে তাকেই চিন্তার শেষ গণ্য করা চিন্তার বিকাশের জন্য ক্ষতিকর। অতএব তা গণতন্ত্রের প্রাণশক্তির বিরুদ্ধে। যদি গ্ণতন্ত্র বলতে আমরা শুধ্য ব্যাক্তির অধিকার নামক সংকীর্ণ ধারণায় হোঁচট না খেয়ে সামগ্রিক ভাবে সমাজে সজীব ও সক্রিয় চিন্তা বিকাশের শর্ত বুঝি।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা অনায়াসেই লক্ষ্য করব যে চিন্তার সজীব ও সক্রিয় তৎপরতার বিরুদ্ধে সবসময়ই কোন কোন ‘মত’ বা ‘বিশ্বাস’কে খাড়া করা হয়েছে। একসময় ব্যবহার করা হতো ধর্মকে। চিন্তার স্বতঃস্ফুর্ত ভাবনা ও সিদ্ধান্তকে ধর্ম দিয়ে একসময় দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে,এখনও করা হয়। তবে এখন ধর্মের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে নানান কিসিমের মতাদর্শ বা ইডিওলজি।
যদি চিন্তার সজীব ও সক্রিয় তৎপরতাই চিন্তা বিকাশের একমাত্র শর্ত হয় তাহলে চুড়ান্ত মত, পথ বা দর্শন বলে কিছু থাকতে পারে না, এই রকম একটা সিদ্ধান্তে ওপরের কথা থেকে অনেকেই পৌঁছাতে পারেন। সকল মত, পথ বা দর্শন তাহলে সাময়িক একটা ব্যাপার। কিন্তু চিন্তার সজীব ও সক্রিয় তৎপরতার মানে এই নয় যে একটি অবস্থান থেকে চিন্তা যখন আরো বিকশিত অবস্থানে পৌঁছায় তখন তার আগের অবস্থানটা নাকচ হয়ে যায় বা ভুল প্রমাণিত হয়। চিন্তার বিকাশ ঘটা আর ভুল চিন্তা করা এক কথা নয়। দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ করে চার না লিখে কেউ পাঁচ লিখলে সেটা ভুল। এটা সবসময়ই ভুল। কিন্তু কেউ যদি বলে সংখ্যা যোগ করবার সময় দশকে ভিত্তি করে যোগ করবার পদ্ধতির পরিবর্তে দুই সংখ্যার ভিত্তিতে বাইনারি পদ্ধতিতেও যোগ করা সম্ভব। তাহলে কোনটা ভুল বা কোনটা শুদ্ধ তাকে আমরা গণনা পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত করে ভাবতে শিখলাম। সেটা ভুল হলো না। আধুনিক গণিত বাইনারি গণনা পদ্ধতি ব্যবহার করে। আরো নানা ভাবে সংখ্যা গণনা করা যেতে পারে। বাইনারি পদ্ধতি আবিষ্কারের পর বা গণনা প্রক্রিয়া সম্পর্কে মানুষের চিন্তার বিকাশ সাধিত হবার পর কেউ যদি বলে দশকে ভিত্তি করে ধরে নিয়ে গণনার পদ্ধতিই হচ্ছে একমাত্র সঠিক পদ্ধতি তখন সেই মতটা হবে ভুল ও পশ্চাতপদ একটা মত। অর্থাৎ চিন্তার বিকাশ ঘটবার পরেও পুরনো পদ্ধতি আঁকড়ে ধরে রাখা কিম্বা তাকেই একমাত্র বা ছহি পদ্ধতি দাবি করা ভুল।
আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি। পুঁজি আত্মস্ফীতি পরায়ন, এতে টাকা খাটানো হয় মুনাফার জন্য এবং টাকা নিজের পরিমাণগত বৃদ্ধি ঘটাবার জন্য বারবারই বিনিয়োগে ফিরে যায়; পুঁজির এই চরিত্র সব সময়ের জন্যই সঠিক। পুঁজি উৎপাদন করে মুনাফার জন্য, তার পুঞ্জিভবন বা পরিমাণগত বৃদ্ধির জন্য। সত্যিকারের উৎপাদন কি হচ্ছে অর্থাৎ কি পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে – সেটা নিয়ে পুঁজির মাথাব্যথা নেই। পুঁজি খাটিয়ে বিষ উৎপাদিত হচ্ছে নাকি অমৃত – পুঁজির দিক থেকে তার বিচার নিরর্থক। উৎপাদিত পণ্য বেচা হোল কিনা এবং মুনাফা কামানো গেল কিনা সেটাই হচ্ছে আসল কথা। বিমূর্ত সংখ্যার হারে নিজের পরিমাণ গত বৃদ্ধি ছাড়া উৎপন্ন পণ্য হিশাবে কি বানানো হলো তাতে পুঁজির কিছুই আসে যায় না। এর ফলে মানুষের সত্যিকারের প্রয়োজন মেটাবার জন্য উৎপাদন হয় না, উৎপাদনের লক্ষ্য ঠিক হয় পুঁজির স্ফীতি ঘটাবার জন্য। চিন্তা যখন পুঁজির এই চরিত্রটা বুঝতে পারে তখন সেটা আর সাময়িক সত্য থাকে না। পুঁজি সম্পর্কে অতীতের ধারণা থেকে চিন্তা আরো বিকশিত ধারণায় গিয়ে পৌঁছায়। এখন কেউ যদি দাবি করে আমরা পুঁজির এই চরিত্র মানি না, পুঁজি মানে স্রেফ বিনিয়োগ, আর বিনিয়োগ না হলে অর্থনীতি টেঁকে না, ইত্যাদি। তাহলে এই ‘মত’ আসলে পুঁজি সম্পর্কে চিন্তার পর্যালোচনা বা বিকাশের বিরোধিতা করা। এই মত সচল বা চালু থাকে একান্তই পুঁজিপতিদের স্বার্থে। ‘পুঁজিবাদ’ এই ক্ষেত্রে সমাজের বিকাশ বা পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা রূপান্তরের প্রধান মতাদর্শিক বাধা হিশাবে হাজির হয়।
কার্ল মার্কস পুঁজি সম্পর্কে যে কথা বলে গেছেন সেটাই পুঁজি সম্পর্কে শেষ কথা নয়। মানুষের বৈষয়িক উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন সম্পর্কে তাঁর আবিষ্কার যেখানে দাঁড়ানো সজীব-চিন্তার অন্বেষণ ও তৎপরতা সেখান থেকে আরো বহুদূর এগিয়ে যাবে এবং যাচ্ছেও বটে। চাইলেই আমরা চিন্তার বিকাশ ঠেকিয়ে দিতে পারি না। নিউটনের পদার্থতত্ত্বের পথ ধরে আলবার্ট আইনস্টাইন আপেক্ষিক তত্ত্বের যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছেন তাতে নিউটনের তত্ত্ব ভুল হয়ে যায় নি। প্রকৃতি জগৎ সম্পর্কে চিন্তার ধ্যানধারণার বিকাশ ঘটেছে মাত্র।কিন্তু চিন্তা যাকে ভুল বলে মনে করে তা সব সময়য়ের জন্যই ভুল। পদার্থ বিজ্ঞানের ‘ঈথার তত্ত্ব’ একটি ভুল তত্ত্ব। ওটা সব সময়ের জন্যই ভুল। পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের অধীনে মানুষ নিজের শ্রমশক্তি বিক্রি করে, শ্রমিক মানুষ এখানে দাসদের মতোই পুঁজির দাস। কেউ যদি দাবি করে এই পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কটাই একটা আদর্শ তাহলে সেটা হবে একটি ভুল তত্ত্ব, একটি ভুল অবস্থান। এই সম্পর্ক ইতিহাসের বর্তমান পর্যায়ে জারী আছে, এটা চিরদিন থাকবে না, থাকতে পারে না।
অতএব দেখা যাচ্ছে চিন্তার ভুল আর চিন্তা তার একটি অবস্থান থেকে অন্য একটি অবস্থানে বিকশিত হয়ে উঠছে এই দুটো সম্পুর্ণ আলাদা ব্যাপার। গণতন্ত্র যখন ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’র কথা বলে তখন তার মধ্যে ভুল মত প্রকাশের স্বাধীনতাও অন্তর্ভুক্ত থাকে। কিন্তু চিন্তার স্বাধীনতা মানে ভুল মত প্রকাশের স্বাধীনতা হতে পারে না। ধর্মের মধ্য দিয়ে যে চিন্তা প্রকাশিত হয় তার উৎস ধর্মীয় উপলব্ধি বা ধর্মীয় চিন্তার দাবি অনুযায়ী ‘ঐশ্বরিক’। ‘ঐশ্বরিক’ মানে চিন্তা মনে করে ধর্ম চিন্তা মানুষের চিন্তার ফল নয়, বরং মানুষের চিন্তার বাইরে থেকে নাজিল হওয়া সত্য। ধর্মীয় চিন্তার উৎস মানুষ নিজে নয়, অর্থাৎ ধর্মচিন্তা মানুষের চিন্তার অন্তর্গত কোন সিদ্ধান্ত নয়, বরং মানুষের বাইরের ঐশ্বরিক সূত্র থেকে আসা। চিন্তা নিজের উৎস নিজে শনাক্ত করতে না পারাটা এক ধরণের ভুল। তেমনি ধর্মের অনেক দাবিও ভুল। যেমন, পুরুষদের পাঁজর থেকে মেয়েদের পয়দা করা হয়েছে দাবি করা হয়, ধর্মের এই দাবি ভুল। ঠিক এ কারণেই চিন্তার স্বাধীনতার সঙ্গে ধর্মের বিরোধ মৌলিক। এর মীমাংসাও সহজ নয়। ধর্মের যুগ অতিক্রম করে মানুষের নিজের চিন্তার কাছে নিজের ফিরে আসাটা দীর্ঘ লড়াইয়ের পথ।
অথচ মত প্রকাশের স্বাধীনতা হিসাবে গণতন্ত্রকে যখন ব্যাখ্যা করা হয় তখন ধর্মীয় মত প্রকাশ ও প্রচারের স্বাধীনতাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গণতন্ত্রে ধর্ম একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার হিসাবে থাকতেই পারে। তথাকথিত সেকুলারিজম এটাই কিন্তু দাবি করে। ধর্মীয় আদর্শের প্রকাশ ও প্রচারের স্বাধীনতা মানে ভুল চিন্তার প্রকাশ ও প্রচার। তাই না?
এবার আমরা প্রথম কথায় ফিরে আসি। একটি গণতন্ত্রের পক্ষের পত্রিকা বা গণতান্ত্রিক পত্রিকা সকলের পত্রিকা হতে পারে কি? না পারে না। যদি আমরা চিন্তার স্বাধীনতা এবং বিকাশে বিশ্বাস করি তাহলে পাক্ষিক চিন্তা হবে তাদের পত্রিকা যারা চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। এ ধরনের পত্রিকা মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে – হোক তা সেকুলার কিম্বা ধর্মীয় – সজীব চিন্তার সক্রিয়তা ও তৎপরতার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবন্ধকতা মেনে নিতে পারে না। কিন্তু মতের প্রকাশ রুদ্ধ করাও এই পত্রিকার কাজ হতে পারে না। নানান ‘মত’ প্রকাশিত ও প্রচারিত হবে, সজীব চিন্তার সক্রিয়তার একটা অবস্থান বা একেকটি মুহূর্ত হিসাবে। কিন্তু প্রত্যেকেই জানবে মতটা এখানে মুখ্য নয়, সজীব চিন্তা তার আপনকার তৎপরতার মধ্য দিয়ে যে বিকশিত অবস্থানে পৌঁছাবার চেষ্টা করছে সেই তৎপর প্রক্রিয়ার অংশ হিশাবে চিন্তার নানান মূহূর্ত হিশাবে বিভিন্ন মত প্রকাশ করা হচ্ছে। ফলাফলটা সজীব ও সক্রিয় চিন্তার তৎপরতা রূপায়িত করা, সজীব ও সক্রিয় চিন্তাকেই খোদ হাজির করতে পারা। সেই তৎপরতার কারণে চিন্তা সবসময় তার বর্তমান অবস্থান থেকে আরো বিকশিত অবস্থানে পৌছাবার তাগিদে অবশ্যই প্রবল তর্কে, বিতণ্ডতায় বা পর্যালোচনায় মাতবে। সজীব চিন্তার মুহূর্ত হিসাবে নানান মতামতের প্রতিফলন থাকবে সেখান। কিন্তু সেখানে এমন কোন চিন্তার জায়গা থাকবে না যে সকল চিন্তা ইতোমধ্যেই ভুল বা ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ চিন্তার স্বাধীনতাকে কখনোই মত প্রকাশের স্বাধীনতা হিসাবে গুলিয়ে ফেলা হবে না। দুনিয়ার ইতিহাসের যে পর্যায়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তার সবচেয়ে বিকশিত ভাবনাগুলোকে অন্বেষণ করে বেড়াবে এই ধরণের পত্রিকা। সকল চিন্তাভাবনাকে পরখ বা পর্যালোচনা করে দেখা হবে তারা আদৌ সজীব চিন্তার তৎপর পরীক্ষার সামনে তারা টিকে থাকতে পারে কিনা।
বাংলাদেশে আজ ঠিক এধরণেরই একটি পত্রিকার দরকার। কিন্তু প্রয়োজনের কথা উপলব্ধি করা সহজ এবং দরকারের কথা গলাবাজি করে বলাও কঠিন নয়; কিন্তু করাটাই হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন কাজ। আসলে চিন্তাকে তৎপর করা যাবে কিভাবে? উত্তর হচ্ছে চিন্তা করতে শুরু করে দিয়ে।আর ঠিক এই কাজটাই-চিন্তা করার কাজটাই সব চেয়ে কঠিন কাজ।
চিন্তা করার কাজটা কঠিন বলার মানে এই নয় যে চিন্তা করা একটি কঠিন ব্যাপার।কঠিন এ কারণে যে আমরা সহজে চিন্তা করতে চাই না।বা চিন্তা করলেও চিন্তা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে যে সকল সিদ্ধান্তে ছায় সেগুলো মেনে নেবার মতো আস্থা নিজের ওপর নিজে অর্জন করতে পারি না।বিরাজমান চিন্তা,অন্যের কাছে শোনা চিন্তা, নিজের দীর্ঘদিনের অভ্যাসগ্রস্ত চিন্তা ইত্যাদির আরাম থেকে বেরিয়ে মাথা খাটাতে আমরা খুবই ভয় পাই। সে কারণে চিন্তা করা আসলেই বেশ কঠিন একটা কাজ।
কিন্তু বাংলাদেশর পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তাকে সক্রিয় করে তোলার কাজটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কাজ। আস্তে আস্তে হলেও সেই কাজে আমাদের হাত দিতেই হবে। ঠিক সেকারণেই গণতন্ত্রের পত্রিকা বা চিন্তার বিকাশকে নিশ্চিত করে তুলতে পারে এমন পত্রিকার শ্লোগান হবে খুবই বিনয়ী। খুব বড়ো কিছু করবার হামবড়ামি এখন দরকার নেই। আমাদের চিন্তা করতে শিখতে হবে।এই সময়ের জন্যে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পত্রিকার শ্লোগান অতএব ঝাঁঝাঁলো কিছু হবে না।শ্লোগান হবে এই রকম যে পত্রিকাটির তৎপর চিন্তার আধার হয়ে উঠুক,আর কিছু নয়।
আসলেই,পাক্ষিক ‘চিন্তা’ হয়ে উঠুক তৎপর চিন্তার পত্রিকা এর চেয়ে অধিক গণতান্ত্রিক পত্রিকা আর কি হতে পারে?
প্রথম প্রকাশ ৮ অগাস্ট ১৯৯১/২৩ শ্রাবণ ১৩৯৮। ঢাকা।