১৩. করোনাভাইরাস, জীবানু মারণাস্ত্র এবং বৈশ্বিক নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ


মার্চের তিরিশ তারিখে নিউইয়র্ক টাইমসের একটি খবরের শিরোনাম হচ্ছে এরকম: For Autocrats, and Others, Coronavirus Is a Chance to Grab Even More Power। একনায়কতান্ত্রিক সরকার এমনিতেই অবারিত ক্ষমতা ভোগ করে। করোনাভাইরাসের সুবিধা নিয়ে তারা আরও ক্ষমতা হস্তগত করবে। যারা ইতোমধ্যেই একনায়কতান্ত্রিক শুধু তারা না, অন্যেরাও আরও ক্ষমতা কব্জা করবে। একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা আরও পোক্ত ও সম্প্রসারিত হওয়ার পাশাপাশি নতুন একনায়কী ক্ষমতা উৎপাদিত হবে। মার্চের ১৩ তারিখ থেকে এই সিরিজটি লিখছি। কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা আমাদের উদ্দেশ্য। তার মধ্যে আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বৈশ্বিক নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। আমরা কিভাবে খাঁচায় বন্দী হয়ে যাচ্ছি এবং একই সঙ্গে কিভাবে সেই বন্দীত্বকে আমরা ব্যবহারিক, নৈতিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক ভাবে সঠিক, কল্যাণকর ও ন্যায্য মনে করি, সেই দিকগুলো নিয়ে আলোচনার জন্যই এই সিরিজ লেখা।

এপ্রিলের চার তারিখে ব্রিটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে: Authoritarian leaders may use Covid-19 crisis to tighten their grip। এর আগে মার্চের আট তারিখে ওয়াল স্ট্রিট জর্নাল লিখেছে, চিন যে রকম কঠোর ভাবে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করেছে এবং আংশিক ভাবে ইটালির কিছু কিছু জায়গাতে, সেই কড়াকড়ি এখন অন্যত্র আরোপ করবার দরকার হয়ে পড়েছে। চিনের কড়াকড়ি বলতে শুধু একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতার প্রয়োগ বোঝানো হয় নি। একই সঙ্গে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণে কৃৎকৌশলগত ব্যবস্থার কথাও বলা হয়েছে। নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিশ্ছিদ্র করার জন্য চিন ‘ড্রোন, মানুষ আর বিগ ডাটা’ ব্যবহার করেছে। ওয়াল স্ট্রিট জর্নাল মূলত নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের সার্বিক ব্যবস্থা তৈয়ার ও আরোপ করার পক্ষেই ওকালতি করেছে। এইসকল কড়াকড়ি, নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কোভিড-১৯ মহামারী শেষ হলে আপনা আপনি বাতিল হয়ে যাবে সেটা ভাববার কোন কারণ নাই, মহামারীর পেছন পেছন ধেয়ে আসছে বিশ্ব মন্দা। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা্ আসন্ন মহা অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠা এবং টিকিয়ে রাখবার জন্য আমাদের চোখের সামনেই গড়ে ওঠা একনায়কতন্ত্র, নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থাকেই প্রাণপণ আরও পাকাপোক্ত করবে। এই সিরিজ লিখবার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে সেই ভয়াবহ সম্ভাবনা সম্পর্কে সবাইকে আগাম সতর্ক করা।

হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী এখন নির্বাহী আদেশ দিয়ে শাসন পরিচালনা করতে পারেন, পার্লামেন্টে কোন আইন পাশ করতে হবে না।

ব্রিটেন থেকে একটা নতুন রাজনৈতিক পরিভাষা শিখলাম। সেটা হোল, ‘eye-watering power’। সেটা কেমন? সেটা হোল মন্ত্রীরা এখন চাইলে যে কোন নাগরিককে আটকাতে পারবে এবং সীমান্ত বন্ধ করে দিতে পারবে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এক কাঠি চড়া। তিনি কোর্ট-কাচারি বন্ধ করে দিয়েছেন। আদালত বন্ধ। বিচার নাই। কোর্টাকাচারি বন্ধ করে দেবার উদ্দেশ্য হচ্ছে বেনিয়ামিন নেতাইয়ানহুর বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির মামলায় আদালতে হাজিরা দেওয়ার বিড়ম্বনা এড়ানো।

শুধু তাই না, বেনিয়ামিন নেতাইয়ানহু আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এজেন্সিকে তাদের নাগরিকদের সেলফোনের পুরানা কথাবার্তার যেসব ডাটা জমা আছে সেইসব অপ্রকাশিত তথ্যভাণ্ডারে ঢুকবার অনুমতি দিয়েছে। এই তথ্যভাণ্ডার কাউন্টার টেররিজম মোকাবিলার ছুতায় গড়ে তোলা হয়েছিল। এখন এজেন্সিগুলো সেইসব ডাটা খুঁজে খুঁজে দেখবে কে কোথায় কবে গিয়েছিল। বলা হচ্ছে, তাদের গতিবিধি পর্যালোচনা করে সংক্রমণের সম্ভাবনা ও সম্ভাব্য বিস্তার নির্ণয়ই এর উদ্দেশ্য। যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তাদের গতিবিধির ওপর নজরদারি পোক্ত করা এবং যারা সংক্রমিতদের সংস্পর্শে এসেছে যেন তাদের কোয়া্রেন্টাইন করা যায়। তাদের সঙ্গদোষ ঘটেছে। তাছাড়া যারা ঘরবন্দী থাকতে চায় না, তাদের শাস্তির ব্যবস্থাও এতে করা যাবে। ঘরে থাকার কথা, কিন্তু ঘরে ছিলনা কেন সেটা মোবাইল ডাটাতেই ধরা পড়বে। দোষীদের ছয়মাস সাজা দেওয়া যাবে। (David M. Halbfinger, Isabel Kershner and Ronen Bergman, 2020)।

চিলিতে কিছুদিন আগেও যে পাবলিক স্কোয়ারে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে, সেই জায়গা এখন সামরিক বাহিনী সদর্পে পাহারা দিচ্ছে।

নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক সেলাম গেব্রেকিদান (Selam Gebrekidan) বলছেন এই বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলার জন্য অনেক অস্বাভাবিক পদক্ষেপ নিতে হবে, এ নিয়ে কোন তর্ক নাই। তাদের সীমান্ত বন্ধ করতে হতে পারে, মানুষকে ঘরবন্দী বা কোয়ারেন্টাইন করতে হতে পারে, সংক্রমিতদের চিহ্নিত ও আলাদা করবারও দরকার হতে পারে। যারা আইন নিয়ে ভাবেন, তারা জানেন আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে থেকেই এইসব পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে তা কিন্তু ঘটছে না। বেশ কিছু সরকার কোভিড-১৯ মহামারীর অজুহাতে আইনসম্মত ভাবে যতোটুকু করবার সেটা না করে এই সুযোগে আরও ক্ষমতা কব্জা করে নিচ্ছে। ক্ষমতা, নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে যেভাবে শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভুত করছে তার সঙ্গে মহামারি মোকাবিলার সম্পর্ক সামান্যই। এমনকি কোন ফাঁকফোকরও থাকছে না যাতে ক্ষমতার এই কেন্দ্রীভবনের অপপ্রয়োগ রোধ করা যায়। এমন কোন গ্যারান্টিও থাকছে না যে অবস্থার পরিবর্তন হলে আগের গণতান্ত্রিক অবস্থা ফিরে আসবে। সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হচ্ছে মহামারির মধ্যে মানুষের পক্ষে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এবং নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের অধীনস্থ করবার বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধেরও সুযোগ সামান্যই। অর্থাৎ কোন প্রতিরোধ ছাড়াই এই ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।

জাতিসংঘের কাউন্টার টেররিজম ও মানবাধিকারের রিপোর্টার ফিউন্লা নি আওলাইন (Fionnuala Ni Aolain) বলেছেন, “যদি স্বাস্থ্য মহামারীর পায়ে পায়ে সেটা না হয়ে থাকে তাহলে তার সমান্তরালে এই একনায়কী কর্তৃত্ব আমাদের ঘনিষ্ঠ ভাবেই অনুসরণ করছে। নতুন আইনকানুন, বিধি বিধান নজরদারি, নিয়ন্ত্রণ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য মানুষকে আটকে রাখার ক্ষমতা, মানুষের কন্ঠ রোধ করে রাখা, সভা সমাবেশ বন্ধ করা ইত্যাদি জনজীবনের চরিত্র আমূল বদলে দেবে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও আমূল বদলে যাবে।

এমনকি নীতিনৈতিকতার সংজ্ঞাও বদলে যাচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুর কোভিড-১৯ মহামারী নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সফল, সন্দেহ নাই। সেটা সম্ভব হয়েছে মারমুখি (invasive) নজরদারির জন্য, স্বাভাবিক অবস্থায় সেটা শুধু আইনবহির্ভূত বলে গণ্য হোত তা নয়, এমনকি নীতিনৈতিকতার দিক থাকেও গর্হিত বলা হোত। রাস্তায় ধরে ধরে মানুষ অসুস্থ কিনা কিম্বা অসুখ বয়ে বেড়াচ্ছে কিনা সেটা স্বাভাবিক অবস্থায় অনৈতিক গণ্য করা হোত। সেটা করা সম্ভব হোত না। কিন্তু এখন উল্টা এই নীতিনৈতিকতা বিরোধী মারমুখি নজরদারিকে সবাই প্রশংসা করছে (Natasha Singer, Choe Sang-Hun, 2020)। চীন যেভাবে মারমুখী কায়দায় পুরা শহর লকড ডাউন ও ঘরবন্দী করেছিল, তার বিরুদ্ধে যারা শুরুতে যারপরনাই নিন্দা জানিয়েছিল, পরে তাদের ভাষা ও নীতিবোধ দুয়েরই বদল ঘটেছে। অর্থাৎ কোভিড-১৯ মহামারী মানুষের নীতিবোধেরও বদল ঘটিয়েছে। আরও ঘটাবে।

ফিলিপাইনের আইন পরিষদ নতুন আইন পাশ করেছে। আবার পুরানা সামরিক আইনের ভূত চেপে বসবার ভীতি তৈরি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট রডরিগ ডুয়ার্তেকে আইন পরিষদ জরুরি অবস্থার ক্ষমতা দিয়েছে , সঙ্গে মহামারি মোকাবিলার জন্য ৫ বিলিয়ন ৪০ লক্ষ ডলার। ফিলিপাইনে একটি আইন পাশ করার উদ্যোগ চলছিলো, যাতে দেশের স্বার্থে কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা যায়। সেই খসড়ার রদবদল হয়েছে। এখন তা শিথিল। প্রেসিডেন্ট ডুয়ার্তে এর আগে ফিলিপাইনের সংবিধানকে ‘টয়লেট পেপার’ আখ্যা দিয়েছিলেন। এখন তাঁর জরুরি অবস্থার ক্ষমতা পাওয়ার অর্থ একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা।

কিছু রাষ্ট্র এই সুযোগে তাদের সমালোচকদের টুঁটি টিপে ধরা্র ভাল অজুহাত পেয়েছে। না, বাংলাদেশের কথা বলবোনা, বরং জর্দানের কথাই বলি। প্রধানমন্ত্রী ওমর রাজ্জাজ বলছেন, যারা ‘আতংক তৈরির জন্য গুজব ছড়াবে, উলটাপালটা কিম্বা মিথ্যা সংবাদ ছাপবে, তাদের কোঠর ভাবে মোকাবিলা করা হবে’।

থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী প্রয়ুথ চান-ওচা কার্ফিউ জারি করা ও গণমাধ্যম সেন্সর করবার ক্ষমতা হাতে নিয়ে নিয়েছেন। থাইল্যান্ডে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। মহামারি মোকাবিলায় সরকারের সমালোচনা করার জন্য সাংবাদিকদের হয়রানি চলছে।

করোনাভাইরাসের কারনে জনগণ এমনিতেই রাস্তায় নামছে না। তাতেও চিলির সরকার সন্তুষ্ট না। চিলি ‘স্টেইট অব ক্যাটাস্ট্রফ’ বা ‘মহা বিপর্যয় পরিস্থিতি' ঘোষণা করেছে। এর পরপরই কিছুদিন আগে যেসব রাস্তায় বা স্কোয়ারে সরকার বিরোধী গণসমাবেশ চলছিল সেখানে টহল দিতে শুরু করেছে ভারি অস্ত্র কাঁধে সেনাবাহিনী (McDonald, 2020)।

মহামারি বিপর্যয় শেষ হয়ে গেলে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চলে যাবে বা অপসারিত হবে তার কোন গ্যারান্টি নাই। সন্ত্রাস দমনের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১১ সেপ্টেম্বরের পর প্যাট্রিয়ট এক্ট জারি করা হয়েছিল। সেটা এখনও বহাল তবিয়তেই আছে।

নিশ্চিত থাকতে পারেন, কিছু কিছু অতি চেনা দেশে করোনা ভাইরাস আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। খুনি, গুমবাজ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী , চোর, ডাকাত, লুটেরাদের রাষ্ট্র -- এমনকি চিনকেও হারিয়ে ২০১২ সালের পর রাতারাতি কোটিপতি হয়ে ওঠা শ্রেণি যে দেশে ১৭.৩% হারে- বেড়েছে- সেই দেশের কথা ভাবুন। সেই দেশের ক্ষমতাসীনরা নিজেদের হাতে ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত করবে যেন কেউ কোথাও টুঁ শব্দ করতে না পারে। কোন প্রকার প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ সেই দেশে করোনাভাইরাস ঠেকানো ও প্রাণ বাঁচানোর অজুহাতে একদমই অসম্ভব হবে।

এমন দেশটি কোথায় আবার খুঁজতে যাবে তুমি !!!

সকল দেশের রানি সে যে, আমার জন্মভূমি

সেযে আমার জন্মভূমি

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।