১৬. করোনাভাইরাস, জীবানু মারণাস্ত্র এবং বৈশ্বিক নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ


13 May 2020

এখন চতুর্দিকে যেমন মার মার কাট কাট যুদ্ধের আওয়াজ শুনছি, বিলগেইটসও মনে করেন মহামারির মোকাবিলা রীতিমতো একটা যুদ্ধই বটে। প্রথাগত যুদ্ধে সৈনিকের হাতে থাকে বন্দুক বা মারণাস্ত্র। পার্থক্য হচ্ছে বিল গেইটস সিরিঞ্জ হাতে নেমেছেন। তিনি লড়বেন ভ্যাকসিন আর সিরিঞ্জ নিয়ে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বারবার বলেছেন সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে কার্যকর পথ হচ্ছে শক্তিশালী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা। শুধু আমাদের মতো গরিব দেশের জন্য নয়, ধনি গরিব সব দেশের জন্য। কিন্তু বিল গেইটস সেটা চান না। তিনি চান ভ্যাকসিন। তাই মহামারীকে তিনি আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, প্রাণ ও পরিবেশের ধ্বংস, খাদ্য চক্রের বিনাশ, জলবায়ু বিপর্যয়, যুদ্ধ বিগ্রহ ইত্যাদির পরিণতি হিশাবে দেখতে একদমই নারাজ। মহামারী হচ্ছে কোভিড-১৯ নামক একটি নতুন ভাইরাসের প্রাকৃতিক আবির্ভাব ও আক্রমণ। আর তাকে মোকাবিলার একমাত্র পথ হচ্ছে মেলিন্দা ও গেইটস ফাউন্ডেশানের ভ্যাকসিন ও সিরিঞ্জ।

এই যে বিস্তৃত, বৃহৎ ও জটিল সমস্যাকে স্রেফ একটা ভ্যাক্সিনের সিরিঞ্জে ঢুকিয়ে ফেলা – এই মতাদর্শ নিয়ে আমাদের কিছু কথা বলতেই হবে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে মহামারি পর্যবেক্ষণের নামে বিশ্বব্যাপী সারভেইল্যান্স সিস্টেম বা শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা যা বিগ ডাটা ও ডিজিটা্ল এলগরিদম ইত্যাদি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। বলা বাহুল্য সেটা থাকবে মাইক্রোসফটের বিল গেইটসেরই হাতে। তাই বিল গেইটসের ভ্যাক্সিন বানানো এবং মানুষকে ভ্যাক্সিন দেবার পরিকল্পনা নিয়ে আমরা কয়েক কিস্তিতে আলোচনা করব। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা টেকনলজির নির্বিচার বিরোধিতা আমাদের উদ্দেশ্য নয়; আমাদের কাজ হচ্ছে যে বৈশ্বিক বাস্তবতার মধ্যে আমরা কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলা করছি সেই বাস্তবতা যথাসম্ভব বোঝার চেষ্টা করা।

পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বে বাস করছি আমরা, সেটা সকলে জানি। ভালমন্দ সেটা ভিন্ন তর্ক, কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের নির্ধারক শক্তি বা তার গতির নির্ধারক দিক হচ্ছে মুনাফার প্রতিযোগিতা। এই দিকটাও আশা করি আমরা বুঝি। প্রতিযোগিতার মাঠে ভ্যাক্সিন বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকারের বলে বিল্গেইটস কিম্বা তাঁর নির্বাচিত বহুজাতিক কোম্পানিরই একচেটিয়া পণ্য হবে।

বর্তমান বৈশ্বিক পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের অভূতপূর্ব বিপ্লব ঘটেছে। বিশেষভাবে কমিউনিকেশান, ইন্টারনেট, নানান ডিজিটাল টেকলজি, বিগ ডাটা, ইত্যাদি। এর সুবিধা ভোগ করছি আমরা অবশ্যই। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা আমাদের নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণও হারাচ্ছি, আমাদের চিন্তার পদ্ধতি, লেখালিখির স্টাইল, এমনকি খোদ আচার-আচরণ ও ব্যবহারেরও পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। অনেকটাই ঘটে আমাদের অজান্তে, খানিকটা আমাদের সজ্ঞান ইচ্ছায়। আমরা ভাবি আমামদ্র 'ইচ্ছা' বলে কিছু আছে। কিন্তু যা আছে তা আসলে কোম্পানির বিজ্ঞাপন। বিল গেইটসের ক্ষেত্রে তার তত্ত্ব, চিন্তা ও পরকল্পনার বিপুল প্রচার। আমরা প্রচার ও বিজ্ঞাপনের তোড়ে আমামদের ইচ্ছাকে সঁপে দিতে অভ্যস্ত হয়ে পরেছি। আমরা কিছু বুঝে উঠবার আগেই এক্সময় আবিষ্কার করি, আমরা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং প্রাইভেসিও হারিয়েছি।

দ্বিতীয়ত, আমাদের সকলের জীবন যেসব প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা, নীতি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে রাষ্ট্র। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা আমাদের আগে থেকেই চেনা, কারন রাষ্ট্র দৃশ্যমান ক্ষমতা চর্চার প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের পুলিশের সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিনই মোকাবিলা হয়। কিন্তু ক্ষমতা শুধু আধুনিক রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীভূত, এই ধারণা বর্তমান বিশ্ববাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ভুল। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বে কোন রাষ্ট্রেরই বৃহৎ পুঁজির স্বার্থের বাইরে সিদ্ধান্ত নেবার কোন ক্ষমতা নাই। যতোটুকু ছিল তা এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল কেড়ে নয়েছে, বাকিটুকু নিয়ে গিয়েছে আন্তর্জািতিক বাণিজ্য সংস্থা। তাই আমরা দেখি রাষ্ট্রের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্র ক্রমে ক্রমে সংকুচিত হয়ে গিয়েছে। প্রধান নির্ধারক ভূমিকা রাখছে বহুজাতিক কর্পোরেশান। সেটা হতে পারে ব্যাংক, ইন্সুরেন্স কোম্পানি, তেল ও গ্যাস কোম্পানি, মারণাস্ত্র কোম্পানি বা মিলিটারি-ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স, এগ্রোইন্ড্রাস্ট্রি বা বিষ ও বীজ ব্যবসায়ী, ইত্যাদি।

তবে গত কয়েক দশকে অতি দ্রুত যেসব কোম্পানি সামনের সারিতে উঠে এসেছে তাদের ক্ষেত্র হচ্ছে কমিউনিকেশান ও ডিজিটাল টেকনলজি – বিশেষত প্রোগ্রাম, সারভেইলেন্স টেকনলজি ও বিগডাটা। বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতি নানান কারণে এদের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। একটা পর্ব গিয়েছে যখন বৃহৎ বহুজাতিক কর্পোরেশানের ওপর তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ মজবুত ছিল। কিন্তু সেটা এখন শিথিল। বিভিন্ন পুঁজির মধ্যে প্রতিযোগিতা যেমন তীব্র হয়েছে, তেমনি পুঁজি বৈশ্বিক হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে প্রতিটি রাষ্ট্রই পুঁজির বৈশ্বিক স্ফীতি ও পুঞ্জিভবনের বাধাগুলো অপ্সারণ বা ভেঙ্গে ফেলতে গিয়ে বদলাচ্ছে। রাষ্ট্রের পুনর্বিন্যাস ঘটছে। এখন রাষ্ট্র যতোই রিপাবলিক বা গণতান্ত্রিক হোক, নাগরিকদের মানবিক ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে অক্ষম। রাষতের কাজ পুঁজির স্বার্থ পাহারা দেওয়া। রাষ্ট্র সকল ক্ষেত্রে সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম এটি এখন নিতান্তই প্রাচীন কল্পনা বা ইউটোপিয়া।

ফলে রাষ্ট্র সমূহের আন্তর্জাতিক সংস্থারও গুণগত রূপান্তর ঘটেছে। জাতিসংঘ যেমন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো নিরংকুশ ক্ষমতাধারী, এটা আমরা এতদিন দেখেছি। সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন কোথায় ঘটছে সেটা বাইরে থেকে দেখে বোঝা যাবে না। বোঝা যাবে জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ বেড়ে যাবার মাত্রা দেখে।। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেমন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ক্রমে ক্রমে বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েছে।

এই সকল বাস্তব দিক মনে রাখলে আমরা অনায়াসেই বুঝব মহামারী এবং মহামারী মোকাবিলা সম্পর্কে যে সকল তত্ত্ব, মতাদর্শ বা বৈজ্ঞানিক বয়ান আমরা শুনি তা বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় মূলত বহুজাতিক কোম্পানির চিন্তা, বাসনা ও মুনাফা পরিকল্পনার রঙ্গে রঙিন। সেই বয়ানগুলো পর্যালোচনার ভাল উপায় হচ্ছে মহামারী সম্পর্কে বিল গেইটসের চিন্তা ও পরিকল্পনা পর্যালোচনা।

আমরা মনে করি না, বিল গেইটসের বয়ান শুধু তাঁর একার। না, মোটেও তা নয়। বর্তমান বাস্তবতায় একই তত্ত্ব আমাদের মাথা থেকেও তৈরি হবার কথা, যদি চিন্তা ও পর্যালোচনা করতে আমরা না শিখি এবং পালটা পরিকল্পনার হিম্মত আমাদের না থাকে। বিলস গেইটস জাতীয় সিরিঞ্জবাদ আমরাও প্রচার করতাম। একই পরিকল্পনা ও মহামারী নির্মুল কৌশল আমরাও বানাতাম। ফারাক বিশেশ থাকত না। একই বাস্তবতার মধ্যে বাস করি বলে বিল গেইটসের চিন্তা আমাদের কাছেও বিজ্ঞান ও যুক্তি সম্মত মনে হতে পারে। ভাগ্য ভালো যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ক্ষমতা আমাদের নাই, কিন্তু মেলিন্দা ও বিল গেইটস ফাউন্ডেশানে্র আছে। তাহলে আমরা আসলে বিল গেইটস নিয়ে শুধু নয়, আলোচনা করতে চাইছি আমাদের নিজেদেরই তত্ত্ব, চিন্তা বা মতাদর্শ – যা আমরা আমাদের অজান্তে লালন করি। সহজে মুক্ত হতে পারি না।

বিল গেইটস যে বাস্তবতায় বাস করেন, আমরা তার বাইরে আসতে শিখিনি। আমাদের প্রায় প্রত্যেকের মধ্যেই একজন মেলিন্দা এবং একজন বিল গেইটস বাস করে।

#Covid19_Capital_Surveillance


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।