২০. করোনাভাইরাস, জীবানু মারণাস্ত্র এবং বৈশ্বিক নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ


কোভিড-১৯ ভাইরাসকে বলা হচ্ছে ‘নোভেল’, মানে এই ভাইরাস আগে শনাক্ত হয় নি, কিম্বা আগে ছিল না। এর আগে কোভিড-১৯ মহামারী বিশ্বের মানুষ মোকাবিলা করে নি। এই ভাইরাস সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানও অপ্রতুল; বিশেষত সংক্রমণ বিস্তারের চরিত্র এবং সম্ভাব্য চিকিৎসার তথ্য। ফলে মহামারী মোকাবিলার পরিকল্পনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুমানের ওপর নির্ভর করে নির্ণয় করা হয়েছে। অল্প কিছু ধনি দেশ অর্থনীতি, সামরিক শক্তি এবং বিজ্ঞানের ওপর দখলদারির কারনে দরকারি গবেষণা করতে পারছে, তারা প্রতিদিন নিজের এবং অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা যাচাই বাছাই করতে সক্ষম। তারা নতুন তথ্য ও গবেষণার ভিত্তিতে মহামারি মোকাবিলা পরিকল্পনায় অদল-বদল ঘটাচ্ছে, পদ্ধতির সংস্কার করছে কিম্বা বদলাচ্ছে। বিতর্কিত বিষয় নিয়ে তর্কবিতর্কও চলছে। আমরা পারছি না। কারণ আমাদের সেই হিম্মত নাই।

কোভিড-১৯ সংক্রমণ শুরু হবার পর থেকেই কঠোর ভাবে সামরিক কায়দায় ধুমাধুম মহামারী নিয়ন্ত্রণ চলছে, নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির জাল বিছিয়ে অদৃশ্য ভাইরাসকে যেভাবে পারা যায় ঘিরে রাখার ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে, যেন সংক্রমণ ছড়িয়ে যেতে না পারে। সেসবের সমালোচনাও চলছে। এখন দেখা যাচ্ছে সব দেশ একই রকম পদ্ধতি অনুসরণ করে নি। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে যেটা এখন স্পষ্ঠ সেটা হোল গত কয়েক দশক ধরে বিল গেইটস মহামারী মোকাবিলার যে মডেল ও পরিকল্পনা তৈরি করেছেন, বিশ্ব ব্যাপী সেটাই বাস্তবায়িত হচ্ছে।

বিল গেইটসের মডেল ও পরিকল্পনা চ্যালেঞ্জ করতে হলে সঠিক তথ্য জোগাড় দরকার। কিন্তু তথ্য তৈরি এবং বিশ্লেষণের যে পদ্ধতি সেটাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিল গেইটসের। যেমন অন্য কোন শারিরীক জটিলতা নাই, কিন্তু শুধু কোভিড-১৯ সংক্রমণে কোথায় কিভাবে কতোজন মানুষ মারা গেছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান এখনও নাই। বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত কিছু তথ্য আছে। যারা মারা গেছে কিম্বা সংক্রমণে মারাত্মক অসুস্থ হয়েছে তাদের অন্য কি কি অসুখ ছিল, কোভিড-১৯ সংক্রমণে সেই অসুখ মৃত্যু কিম্বা অসুস্থতার ক্ষেত্রে কি মাত্রায় ভূমিকা রেখেছে তার কোন তথ্য বা বিশ্লেষণ এখনও নাই।

কোভিড-১৯ সংক্রমন আসলে কখন কোন অবস্থায় ভয়ংকর, সেটা মোকাবিলার জন্য আমাদের বিল গেইটসের সিরিঞ্জ-শিশি-ভ্যাক্সিন মার্কা তথ্য ছাড়া কোথায় ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায় সেটা একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। কারণ অধিকাংশ গবেষণারই অর্থায়ন আসে মেলিন্দা ও বিল গেইটস ফাউন্ডেশান থেকে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার গবেষণার ক্ষেত্র থেকে স্বাধীন ভাবে যখন আমরা মহামারী বিশ্লেষণ করি তখন ভিন্ন চিত্র বেরিয়ে আসে।

যেমন এবার কোভিড-১৯ সংক্রমণের খবর বেরুবার পর থেকেই বিজ্ঞানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠেছে এই সংক্রমণে মানুষ কিছু কিছু দেশে এবং শহরে অধিক হারে মরছে কেন? তারা বিল গেইটসের মতো ধরে নেন নি যে ভাইরাস সংক্রমণ হলেই মানুষ মরবে। আতংক না ছড়িয়ে তাঁরা ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করছেন।

ভাইরাস আমাদের শরীরের বাইরের থেকে আসা জৈব পদার্থ। শরীরে ঢুকেই সে শরীর নষ্ট করবে, এটা মানা যায় না। ভাইরাস সম্পর্কে এই ধারণা অবৈজ্ঞানিক। এর উদ্দেশ্য স্রেফ আতংক ছড়ানো। কারণ শরীর বাইরের আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য চেষ্টা করবে। শরীর তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্যবহার এবং প্রয়োজনে বাড়াবার চেষ্টা করবে। যদি সংক্রমণ ঘটেও, তবুও তা যেন মারাত্মক কোন শারিরীক অসুস্থতায় পর্যবসিত নাহয়, সেই চেষ্টা চালাবে। কিন্তু বিজ্ঞানকে এই উত্তর পেতে হবে, নইলে আতংক যাবে না।

শরীর জীবন্ত সত্তা। বাইরের কোন ভাইরাস, জীবাণু বা ক্ষতিকর জিনিস ক্ষতি করতে চাইলে শরীর তার বিরুদ্ধে লড়াই করবার কথা। যদি জিততে ব্যর্থ হয় তাহলে তার কারণ সন্ধান করতে হবে। কোন পরিস্থিতিতে বা কোন্‌ ধরণের শরীর করোনাভাইরাসের কাছে পরাস্ত হচ্ছে?

বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি খেয়াল করেছেন, মানুষ মরছে শিল্পোন্নত বড় বড় শহরে, যেখানে বায়ু দূষণের মাত্রা অত্যধিক। এই শহরে যারা বাস করে তাদের ফুসফুস বায়ু দূষণের কারণে আগে থেকেই দুর্বল। কোভিড-১৯ দূষিত শহরের ষাটোর্ধ ব্যক্তিদের মারছে। দূষিত শহরের দূষিত বাতাস টানতে টানতে তাদের ফুসফুস ক্লান্ত, দুর্বল এবং অসুস্থ। কোভিড এদের সহজ ঘাতকে পরিণত হয়েছে।

বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে কোভিড-১৯ মানুষ মেরেছে ইটালি, স্পেইন, ফ্রান্স এবং জার্মানির ৬৬টি প্রশাসনিক এলাকায়। মোট মৃত্যুর ৭৮% ঘটেছে সেইসব শহর এলাকায় যেখানে বাতাস সবচেয়ে বেশী দূষিত। অর্থাৎ কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত ১০ জনের মধ্যে সাতজনই মরেছে দূষিত বাতাসে (Carrington, 2020)। যদি তাই হয় তাহলে ভাইরাস কিম্বা মহামারীকে পুঁজিতান্ত্রিক উন্নয়ন, নগরায়ন এবং জীবাশ্মভিত্তিক আধুনিক জীবন ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে সব দোষ ভাইরাসের বলার যুক্তি নাই। বিল গেইটস এই দিকটাই আমাদের ভুলিয়ে দিতে চান। তিনি ভ্যাকসিন বানাবেন, কিন্তু দূষিত শহরের দোষ স্বীকার করবেন না, সংস্কারের কথাও বলবেন না।

কোভিড-১৯-এর পরিপ্রেক্ষিতে শহরের দূষন নিয়ে গবেষণাগুলো সবে শুরু হয়েছে। আগামি দিনে আমরা আরও তথ্য পাবো। তাই শুরুতেই আমরা বলেছি, বিজ্ঞান অবশ্যই আমাদের দরকার, কিন্তু বিল গেইটস মার্কা কর্পোরেট বিজ্ঞান না।

এই গবেষণাটি নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (NO2) দূষণ নিয়ে। এই দূষণ ঘটে ডিজেল পোড়ানোর ফলে। এ নিয়ে আগেও অনেক গবেষণা হয়েছে। দুষিত বাতাস শহর থেকে বেরুতে পারে না, আটকে যায়। যার কুফল নানা ভাবে স্বাস্থ্যের ওপর পড়ে। তবে সবচেয়ে খারাপ প্রতিক্রিয়া হোল ফুসফুসের অসুখ। বায়ু দূষণ এবং আবহাওয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষক ইয়ারন ওগেন (Yaron Ogen) বলছেন এই গবেষণা দেখাচ্ছে দীর্ঘদিন এই দূষিত গ্যাস যারা নিঃশ্বাসে নিয়েছেন সম্ভবত তাদের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ সংক্রমণ মৃত্যুর প্রধান কারণ। বিশেষত যারা ফুসফুসের অসুখে ভুগছেন তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশী।

ইয়ারনন অগেন জার্মানির মার্টিন লুথার ইউনিভার্সিটি হালে-ভিটেনবার্গের বিজ্ঞানী। তাঁর কথা পরিষ্কার: “আমাদের পরিবেশের দূষণ মানে আমাদের নিজেদের শরীরকেই দূষিত করা। ফুসফুসের ওপর দীর্ঘমেয়াদী চাপ যখন শরীরকে সহ্য করতে হয়, তখন সংক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচাবার ক্ষমতাও শরীরের সীমিত হয়ে পড়ে” (Ogen, 2020)।

নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড নিঃশ্বাস ও ফুসফুসের যে ক্ষতি করে তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা আছে। বিলাতে বাচ্চাদের ওপর শহরের বায়ুদূষণ নিয়ে করা একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে হাজার হাজার শিশু যে পরিমাণ নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড বায়ুদূষণের কারণে নিঃশ্বাসে গ্রহণ করতে বাধ্য হয় তা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে আইনী ভাবে সাব্যস্ত গ্রহণ মাত্রার (legal limit) চেয়ে অনেক বেশী। বলা বাহুল্য এর স্বাস্থ্যগত ফল খারাপ হতে বাধ্য। ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল সভ্যতা যেহেতু জীবাশ্মভিত্তিক, ফলে ডিজেল চালিত যানবাহন শহরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই সভ্যতা অতএব নাইট্রোজেন অক্সাইড নিশ্বাসে গ্রহণ বন্ধ করতে পারে না, শিশু ও বাচ্চারা ছেলেবেলা থেকেই দূষিত বায়ু সেবন করে বড় হয়। কিন্তু সেই গ্রহণ যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে না পারে, জীবাশ্ম ভিত্তিক নগরায়ন সেটা আইন করে একটা নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু এই গবেষণা প্রমাণ করে সেটাও আসলে সম্ভব হয় না। নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের আইনী মাত্রা হচ্ছে প্রতি কিউবিক মিলিমিটারে ৪০ মাইক্রোগ্রাম, কিন্তু দেখা গেছে সেই মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। এমনকি অনেক শিশু নিয়মিত ১১৮ মাইক্রোগ্রামেরও বেশী দূষিত গ্যাস নিশ্বাসে গ্রহণ করছে ( Sandra Laville, Matthew Taylor, Helena Bengtsson and Carlo Zapponi, 2020)।

এই প্রসঙ্গে বিলাতের প্রাথমিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং লন্ডন স্কুল অফ মেডিসিনের অধ্যাপক ক্রিস গ্রিফিথ একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। শিশুদের ফুসফুসের যে হাল বা অবস্থা হয়েছে তার সঙ্গে বিষাক্ত বায়ু সেবনের সঙ্গতি পরিষ্কার। এরা দীর্ঘ সময় রোগে ভুগবে এবং তাদের অপরিণত বয়সে মরবার সম্ভাবনা রয়েছে।

এই তথ্যের গুরুত্ব শুধু বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যান বা বায়ূ দূষণের হিশাব দিয়ে বোঝা যাবে না। এটা বুঝব যদি কোভিড-১৯ সংক্রমণের আলোকে আমরা বিচার করি। যদি কোভিড-১৯-এর সংক্রমণে অসুখের মাত্রা ও মৃত্যুর হার আমরা কমাতে চাই তাহলে শহরে নাইট্রোজেন ডায়োক্সাইড গ্যাস দূষণ ছাড়াও সকল বায়ুদূষণ বন্ধ করতে হবে।

লন্ডনের কুইন্স মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জোনাথান গ্রিগ বলেছেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণে মৃত্যুর তথ্য যা প্রকাশ করছে তা হোল শহরের বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের মাত্রা কোভিড-১৯ সংক্রমণে অধিক মৃত্যুর কারণ হতে পারে, তবে বয়স এবং বিভিন্ন এলাকার পার্থক্যকেও আমলে আনতে হবে।

এতে দুটো বিষয় পরিষ্কার। যদি কোভিড-১৯ এর মৃত্যুহার শহরে বায়ুদূষণের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তাহলে মহামারী প্রতিরোধের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হবে বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণের মাত্রা অবিলম্বে কমিয়ে আনা। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে তাহলে জীবাশ্ম ভিত্তিক শহর বানানো সভ্যতা পরিহার করে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা জোরদার করা, নতুন নগরায়ন চিন্তা ও পরিকল্পনার ওপর জোর দেওয়া।

কিন্তু সেটা কি হবে? হবে না। কারন মানুষকে যদি অসুস্থ না করা যায় এবং মরবার ব্যবস্থা করে আতংকিত করা না যায় তাহলে বহুজা্তিক কোম্পানির ভ্যাক্সিন ও ওষুধ বেচার ব্যবসাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মুনাফা হবে কিভাবে?

তখন মেলিন্দা ও বিল গেইটস ফাউন্ডেশানের কি হবে?


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।