‘স্বাতন্ত্র্য’ ও ‘গঠন’: ধারণা ও রাজনৈতিক অস্পষ্টতা


[এক]

বাংলাদেশের আগামি রাজনীতির অভিমুখ সঠিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে দুটো ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে নিজেদের ‘স্বাতন্ত্র্য’ সঠিক ভাবে নির্ণয়, উপলব্ধি এবং তা কার্যকর ভাবে প্রকাশ করবার সঠিক ভাষা ও রণধ্বণি আবিষ্কার। অর্থাৎ কেন জনগোষ্ঠি হিসাবে আমরা স্বতন্ত্র সেই উপলব্ধি এবং তা প্রকাশের উপযুক্ত ভাষা আমাদের থাকা চাই। একই ভাবে অন্য জনগোষ্ঠির সঙ্গে আমাদের পার্থক্যও বোঝা দরকার। যেমন, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বাঙালি, কিন্তু তারপরও পশ্চিম বাংলার যে বাঙালি নিজেকে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে ‘ভারতীয়’ গণ্য করে, আমরা তাদের চেয়ে ভিন্ন। কিন্তু আমাদের ভাষা সংস্কৃতি এমনকি বেড়ে ওঠার ইতিহাসে বিস্তর মিল আছে। তেমনি এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ‘মুসলমান’ ; ইসলাম তাদের ধর্ম। কিন্তু আমরা সৌদী, ইরানি কিম্বা তুরানি নই। বাংলাদেশে ইসলামের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং ইতিহাস আছে। বাংলাদেশে আরও নানান ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রয়েছে; ইসলাম ছাড়াও আরও নানান ধর্ম সম্প্রদায় বাস করে। বাংলাদেশী হিশাবে তাদেরও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষিক, সাংস্কৃতিক কিম্বা ধর্মীয় জনগোষ্ঠির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রচনার সংকল্প ও চরিত্রের ওপর সবাই মিলে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা নির্ভর করে। দেশ বা রাষ্ট্রের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও সম্পর্ক রচনার সংকল্প ও চরিত্রের ওপর। হাওয়ায় বা বাষ্পে কিছুই দাঁড়ায় না। স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠি হিশাবে নিজেদের বিকাশের জন্য কেন সমষ্টিগত স্বাধীন রাজনৈতিক সত্তা জরুরি, সেটা এই স্বতন্ত্র উপলব্ধি থেকেই তৈরি হয়। অন্যদের কাছেও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় যে ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে নিজেদের ইতিহাস ও মর্ম সঠিক উপলব্ধির নিরিখে নিজেরা নিজেদের ‘গঠন’ (Constitute) করতে পারার ধারণা।। তার জন্য দরকার জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে একটি ‘গঠনতন্ত্র’ (Constitution) প্রণয়ন এবং সেই গঠনতন্ত্রকে রূপ দেবার জন্য যথোপযুক্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ, কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়া, বিধিবিধান প্রণয়ন এবং আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক বিকাশের জন্য উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক শর্ত তৈরি, ইত্যাদি । বাংলাদেশ আবির্ভাবের প্রথম দিন থেকেই এই দুটি ধারনার সম্যক উপলব্ধির ক্ষেত্রে আমাদের চিন্তা চেতনায় মারাত্মক ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। এই ঘাটতি মেটেনি। নিজেদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে বিশ্ব ব্যবস্থায় বর্তমান করা ও বর্তমান রাখার ক্ষেত্রে আমামদের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার মারাত্মক অভাব রয়েছে। এই অভাব বা ঘাটতি নিয়েই আমরা আজ অবধি চলছি।

সহজে বোঝার জন্য স্বাতন্ত্র্য উপলব্ধিকে একটি জনগোষ্ঠির আত্মসচেতন হয়ে ওঠাও বলতে পারি। এটা একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। এটা স্রেফ ব্যক্তির আত্মসচেতনতা নয়, বরং এই উপলব্ধি ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির সম্বন্ধ বোঝার ক্ষেত্র বলা যায়। এই উপলব্ধি ও ক্ষেত্র গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় সমাজ নানানভাবে অংশ গ্রহণ করে। ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, ভূগোল, পরিবেশ, উৎপাদন সম্পর্ক, সামাজিক সম্পর্ক – অর্থাৎ সমাজের সকল ক্ষেত্র এই ‘স্বাতন্ত্র্য’ নির্ণয়ে ভূমিকা রাখে। সাধারণত একটি দেশের ধর্ম, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ, শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদি সবকিছুই নানা ভাবেএই প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে। ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি যেমন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য প্রকাশের ক্ষেত্র, তেমনি তারা স্বাতন্ত্র্যকে রূপ দেবার সৃষ্টিশীল কাজটিও করে। আধুনিক কালে পাশ্চাত্যে ধর্মকে ব্যক্তিগত ব্যাপারে পর্যবসিত হয়েছে বলে দাবি করা হয়, কিন্তু স্বাতন্ত্র্যবোধ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা তাতে গৌণ হয়ে যায় না। পাশ্চাত্যের আধ্যাত্মিকতা, দর্শন, শিল্প বা সাহিত্যে খ্রিস্টিয় অনুমান বা চিন্তা পুরা মাত্রায় জারি রয়েছে।

তবে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য উপলব্ধি এবং তার সামাজিক প্রকাশ শক্তিশালী হলে সেটা অনিবার্য ভাবেই রাজনৈতিক রূপ নেয় এমন কোন কথা নাই। কারণ মানুষ নিজের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে অন্যান্য স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠির সঙ্গে একই রাজনৈতিক পরিসরে বা পরিমণ্ডলে বাস করতে সক্ষম। রাজনৈতিক পরিমণ্ডল বা পরিসর যতো বড় ও বিস্তৃত হয় ততোই বড় পরিসরের সুবিধা অন্তর্ভূক্ত প্রতিটি জনগোষ্ঠি ভোগ করে। তাছাড়া স্বাতন্ত্র্য কোন স্থিরনির্দিষ্ট বা চিরায়ত ব্যাপার না। সমাজের বিবর্তন ঘটে, উপলব্ধিরও বদল হয়। বিভিন্ন জনগোষ্ঠির মধ্যে ভাষা, ভাব ও সংস্কৃতির আদান প্রদান বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের শর্তও তৈরী করে।

স্বাতন্ত্রবোধ শ্বাশ্বত বা চিরায়ত কোন ব্যাপার না। স্বাতন্ত্রবোধ উপলব্ধিরও রূপান্তর কিম্বা বিবর্তন হয়। কিন্তু একটি জনগোষ্ঠি যদি নিজের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা কঠিন বলে মনে করে, কিম্বা অন্য জনগোষ্ঠির দ্বারা নিপীড়িত বোধ করে তাহলে স্বাতন্ত্র্য বোধ রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহণ করে। অন্য জনগোষ্ঠির সঙ্গে সম্পর্ক তখন স্রেফ শত্রুমিত্রের সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। রাজনৈতিক হওয়ার অর্থ এই দিক থেকে শত্রুমিত্রে বিভক্ত হওয়া। পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের জনগণের ভাষিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ‘রাজনৈতিক’ রূপ পরিগ্রহণ করেছিল, যার ফলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণকে আর ধরে রাখা সম্ভব হয় নি। রাজনৈতিকতা আমাদের স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত করেছিল। আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করি নি।

একটি ‘স্বতন্ত্র’ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে বাংলাদেশের হাজির হওয়া একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। বাংলাদেশের আবির্ভাব ঐতিহাসিক ভাবে অনিবার্য ছিল কিনা তা নিয়ে তর্কবিতর্ক হতে পারে, কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে বাংলাদেশ এখনও বাস্তবেই বর্তমান রয়েছে। এটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। তাহলে বিশ্ব ব্যবস্থায় বাংলাদেশের টিকে থাকার প্রশ্ন মূলত নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে সচেতন ও সজ্ঞান হওয়ার প্রশ্ন। বিশ্বের অন্যান্য রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির বিপরীতে বাংলাদেশের জনগণের ‘স্বাতন্ত্র্য’ কোথায়? কেন তাকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিশাবে স্বীকৃতির জন্য লড়তে হোল? কেন তা টিকিয়ে রাখতে হবে? ভারতের সঙ্গে তার যুক্ত হয়ে গেলে কী অসুবিধা? কিম্বা পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ গড়তে হোল কেন? সচেরতন ও সজ্ঞান হওয়ার জন্য ইত্যাদি খুবই গুরুতর প্রশ্ন। এই প্রশ্নগুলোকে আমরা খুব হাল্কা চালে গ্রহণ করি। এর উত্তর সন্ধান মানে কোন একটা তত্ত্ব খাড়া করা নয়। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এই স্বাতন্ত্র বোধ আদৌ আছে কিনা, নাকি আমাদের ‘বাঙালি’ হওয়া বা ‘বাংলাদেশী’ হওয়া নিছকই মেকি, অন্তঃসারশূন্য দাবি -- এই জিজ্ঞাসাগুলোকে খোলা মনেই আমাদের বিচার করতে হবে।

বাংলাদেশের ‘স্বাতন্ত্র্য’ আমরা কে কিভাবে বুঝি বা ব্যাখ্যা করি? আধুনিক জাতিবাদের যুগে একে আমরা ‘জাতি’ বলি। একাত্তরে আমরা দাবি করেছি আমরা ‘বাঙালি’ জাতি। সেটা করেছি ভাষা এবং সংস্কৃতির পাটাতনে দাঁড়িয়ে। আধুনিক জাতিবাদের খোপের মধ্যে পুরে দিয়ে আমরা ভেবেছি আমরা বুঝি নিজেদের চিনে ফেলেছি। সেটা ঠিক না। বাংলাদেশে ফ্যসিবাদের শক্তিশালী মতাদর্শিক ভিত্তি হচ্ছে ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক ‘বাঙালি জাতিবাদ’, যে জাতিবাদী ধারণার মধ্যে ধর্ম, বিশেষ ভাবে ইসলাম অনুপস্থিত। যে কারণে ‘বাঙালি জাতিবাদ’ অনায়াসে ইসলাম নির্মূলের রাজনীতি হয়ে উঠতে পেরেছে।

বাঙালি জাতিসত্তার মর্ম আমরা নৃতাত্ত্বিক ভাবে নির্ণয় করি নি। করেছি ভাষা ও সংস্কৃতির সূত্রে। করি নি কারণ ‘বাঙালি’ কোন বিশুদ্ধ নৃ-গোষ্ঠি নয়। সে মিশ্র। তার রক্তের মধ্যে মুণ্ডা, সাঁওতালসহ নানান জনজাতির রক্ত এসে মিশেছে। মিশ্র শোণিত বাঙালির জন্য সৌভাগ্যের, কারণ বাঙালির লড়াই একই সঙ্গে হাজার হাজার বছর ধরে নিপীড়িত, বঞ্চিত বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তারও লড়াই। তাহলে ‘স্বাতন্ত্র্য’ কথাটার একটা মানে আমরা হাতের কাছেই পাচ্ছি। বাঙালি হওয়ার অর্থ শুধু নিজের ‘বাঙালী’ সত্তা ধারণ করা নয়, একই সঙ্গে ক্ষুদ্র ও নিপীড়িত জাতিসত্তার আকাংখাও ধারণ করা, তাদের অস্তিত্ব ও অধিকার স্বীকার করে নেওয়া। তাদের সঙ্গে একসঙ্গে একই রাজনৈতিক পরমণ্ডলে বাস করবার সংকল্প ও সাধনা।

বাঙালির ইতিহাসের দ্বিতীয় দিক হচ্ছে বর্ণাশ্রম প্রথা ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে দলিত বা নিম্ন বর্ণের মানুষের লড়াই। সেই লড়াইয়ে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাদের লড়াই একই সঙ্গে দলিত বা নিম্ন বর্ণের লড়াই। উপমহাদেশে বর্ণাশ্রম প্রথার কারণে সমাজের নীচে পড়ে থাকা মানুষগুলোরও লড়াই। একাত্তরে বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে ‘বাঙালি’ ধারণার মধ্যে এই তাৎপর্য নিহিত ছিল। বাঙালি হাওয়া থেকে জন্ম লাভ করে নি। এই তাৎপর্য স্পষ্ট করে তোলাই ছিল প্রধান রাজনৈতিক কাজ। কিন্তু আমরা তা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি।

না করতে পারার কারণ ছিল। আমরা তিনটি বিশাল নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা বদ্বীপে আমাদের ইতিহাস, ভূগোল, পরিবেশ, জীবন ব্যবস্থা এবং সাধারণ মানুষের ভাব ও ভাষাকে গুরুত্ব দেই নি। আমরা গুরুত্ব দিয়েছি পশ্চিম বাংলার উচ্চ বর্ণের ভদ্রলোক শ্রেণী ও বাবুদের। যারা ইংরেজ আমলে জমিদার ও মহাজন হয়ে শোষণ করেছে। তাদের সাহিত্য ও চিন্তায় তারা ‘বাঙালি’ বলতে যা বুঝেছে ‘বাঙালি’ বলতে আমরাও তাই বুঝেছি: বর্ণ হিন্দুর বাঙালিত্ব। তাদের তৈরি ‘বাঙালি’ধারণার মধ্যে আমাদের বেড়ে ওঠার কারনে আমাদের চারটি প্রধান ঐতিহাসিক সূত্র, স্বাতন্ত্র্য বা ‘লিগেসি’ গায়েব করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। তারা হচ্ছে:

ক. আদিবাসী, জনজাতি কিম্বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লড়াই ও অবদান
খ. নমঃশূদ্র, শূদ্র বা দলিতদের সংগ্রাম ও অবদান এবং
গ. ইসলাম, বিশেষত উপমহাদেশে ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য
ঘ। নারীর লড়াই। স্বতন্ত্র রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে ইসলাম, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং দলিতদের সংগ্রামের মধ্যে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীর সংগ্রাম সমান্তরালে হাজির। পুরুষতান্ত্রিক নিগড় থেকে নারীর মুক্তি সর্বব্যাপী আন্দোলন। তার প্রকাশ দেশকালপাত্র ভেদে ভিন্ন। একটি জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক মুক্তি মানে একই সঙ্গে নারীর মুক্তিও বটে। আমাদের স্বাতন্ত্র্যের এই বিভিন্ন দিক নিয়ে আমাদের আরও প্রচুর কাজ করতে হবে। আমাদের সমস্যার সমাধান আসমান থেকে ফেরেশতা এসে করে দেবে না। এটা নিশ্চিত। মীমাংসা আমাদেরকেই করতে হবে।

[দুই]

নিজেদের স্বাতন্ত্র্য নির্ণয় ও উপলব্ধি এবং রাজনৈতিক ভাবে নিজেদের গঠন – দুটো ধারণাই আমাদের মধ্যে যারপরনাই অস্পষ্ট। এই অস্পষ্টতার জন্য মোটা দাগে আমরা দুটো পরিণতি ভোগ করছি। একটি হোল নিজেদের মধ্যে মারাত্মক বিভাজন ও বিভক্তি। কারণ নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে কোন সামষ্টিক ধারণা আমাদের নাই। কখনও আমরা বাঙালি, কখনও মুসলমান; কখনও আমরা হিন্দু বাঙালির সংস্কৃতিকে আমাদেরই সংস্কৃতি বলে মানি, আবার অন্য সময় হিন্দু বিদ্বেষ আমাদের পরিচয় প্রতিষ্ঠার প্রধান মাপকাঠি হয়ে ওঠে। আমাদের চিন্তা যেমন বিশৃংখল, তেমনি কাজে কর্মেও আমাদের ঐক্যের অভাব মারাত্মক। অর্থাৎ কী চাই, কেন চাই, কিভাবে তা অর্জন সম্ভব এইসব নিয়ে আমাদের বিশেষ মাথাব্যথা নাই। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে পরস্পরের প্রতি দায় ও জবাবাদিহিতার কোন ব্যবস্থাও আমরা গড়ে তুলতে পারি নি।

দ্বিতীয় পরিণতি আরও ভয়ংকর। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিভক্তি ও বিভাজন এতো প্রবল যে একটি অলিখিত ও ঘোষিত গৃহযুদ্ধ কার্যত জারি রাখা হয়েছে। এই বিভাজন বাংলাদেশকে আভ্যন্তরীণ দিক থেকে যেমন, তেমনি বাহ্যিক ভাবেও চরম সংকটাপন্ন করে রেখেছে। গোড়ার অসুখ নিরাময় না করলে বাংলাদেশ আদৌ টিকে থাকবে কিনা সেই সন্দেহ উপস্থিত হয়েছে।

কথাগুলো নতুন না। আগেও আমি আমার নানান লেখায় এইসব বলেছি। এখন আবার বলছি এ কারণে যে বাংলাদেশ আরেকটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য সম্প্রতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এটা অনেকটা এরশাদ শাহীর পতনের আগের অবস্থা। সেই সময় শ্লোগান উঠেছিল ‘এক দফা এক দাবি এরশাদ তুই কবে যাবি’।

এরশাদ গিয়েছে বটে, কিন্তু বাংলাদেশ আরও গভীর খাদের মধ্যে পড়েছে। খাদের গহ্বর গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। কারন হোল কোন ব্যাক্তিকে সরালে ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না। যে দুটী ধারণার অভাবের কথা বলেছি সেটাও পূরণ হয় না। লোক সরল। তাতে কি? কিন্তু গড়ার প্রশ্ন মীমাংসা না হলে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে আমরা আসলে কারা সে ব্যাপারে আমাদের অস্পষ্টতা আরও বাড়তেই থাকে।

বাংলাদেশ মূলত দিল্লীর অধীনস্থ একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা কেবল। এক দফা এক দাবি এরশাদ তুই কবে যাবি ছিল মূলত সেনাবাহিনীর একজন সেনা নায়ককে সরাবার রণধ্বনি, যাকে সেনাবাহিনী স্বয়ং আর সমর্থন দিতে রাজি ছিল না। কিন্তু এখন ‘এক দফা এক দাবি অমুক তুই কবে যাবি’ জাতীয় শ্লোগান মূলত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে পাশ্চাত্যের সবচেয়ে আস্থাভাজন শক্তিধর ব্যক্তিকে সরাবার রণধ্বণি, যার শক্তির ভিত্তি শুধু দিল্লী না, মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্র সহগ পুরা পাশ্চাত্য। বাংলাদেশের বিদ্যমান গৃহযুদ্ধ এতে আরও প্রকাশ্য, আরো গভীর এবং বিস্তৃত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এর জন্য বাংলাদেশের জনগণকে যথেষ্ট প্রস্তুত করা গিয়েছে কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। আমরা সম্পূর্ণ নতুন ধরণের বাস্তবতা মোকাবিলা করছি। এটা নব্বই দশক নয়। যদি আমরা ভুল করি, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিশাবে টিকে থাকবে কিনা সন্দেহ।

বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এখনও ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই রাজনীতি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা বুঝতে অভ্যস্ত। রাষ্ট্র ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা আসলে কী জিনিস, এটা তাদের বোঝানোর কোন চেষ্টাই আমরা করি নি। কিম্বা করলেও তা আজ অবধি ব্যার্থ হয়েছে। তাহলে এক দফা এক দাবি এখন যারা কৌশলগত রণধ্বণি আকারে তুলছেন তারা রণনীতি নিয়ে আদৌ ভেবেছেন কিনা আমি সন্দেহ করি। রণনীতিগত চিন্তার পরিসরে প্রবেশ করতে হলে আমাদের অবশ্যই গোড়ার দুটি প্রশ্নের মীমাংসা করে আসতে হবে, কিম্বা কিভাবে মীমাংসা করব তার নীতিগত দিক পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।

রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে ‘গঠন’ (Constitute) কথাটা আমরা কামাল হোসেন ও পদ্মশ্রী আনিসুজ্জামানের কারণে বাংলাদেশ জন্ম হবার শুরু থেকেই গোলমাল পাকিয়ে বসে আছি। একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির উপযুক্ত ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ন মানে একজন উকিলের মুসাবিদা অনুযায়ী ‘কনস্টিটিউশান’ নামক আইনের বই লেখা না। এই ইংরেজি শব্দটিকে পদ্মশ্রী আনিসুজ্জামান আক্ষরিক অনুবাদ করেছেন ‘সংবিধান’। অথচ ‘গঠন’ একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বর্গ। যার ঘনিষ্ঠ বাংলা অনুবাদ ‘গঠনতন্ত্র’। ‘গঠনতন্ত্র’ আইনের বই না, একটি জনগোষ্ঠির সদস্যদের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় অনুযায়ী তাদের স্বাতন্ত্র্য উপলব্ধির ভিত্তিতে পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক বা সম্বন্ধের ভিত্তি বা দলিল। সরলার্থে এর মানে দাঁড়ায় ‘রাষ্ট্র গঠন’। একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি যদি আসলেই তাদের স্বাতন্ত্র্যের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বোঝে তাহলে বিশ্ব ব্যবস্থার অন্তর্গত একটি ‘রাষ্ট্র’ হিশাবে নিজেদের স্থান চাওয়ার অর্থ তারা বিশ্বাস করে বৈশ্বিক ভাবে সকল মানব গোষ্ঠিকে তাদের ‘স্বতন্ত্র’ কিছু দেবার রয়েছে, যা অন্য কোন রাজনৈতিক গোষ্ঠির পক্ষে দেওয়া সম্ভব না।

ইংরেজি ‘কন্সটিটিউশান’ শব্দটির ‘সংবিধান’ অনুবাদ করার মধ্য দিয়ে কামাল হোসেন ও আনিসুজ্জামান যে ধারণা দিয়েছেন তা ঘোরতর ঔপনিবেশিক। ঔপনিবেশিক শক্তি মনে করে পদানত বা অধীন জনগোষ্ঠিকে ‘শাসন’ করবার জন্য একটা ‘সর্বোচ্চ আইন’ বা ‘সংবিধান’ দরকার। সংবিধান মানে এই ক্ষেত্রে পদানত জনগোষ্ঠিকে শাসন করার ঔপবেশিক হাতিয়ার। বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীন বটে, কিন্তু তাদের যারা শাসন করবে সেই শাসক শ্রেণী নিজেরা ঔপনিবেশিক মন মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে পারে নি। তাই তারা নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসকদের মতো শুধু ‘শাসক’-ই ভেবেছে। অতএব তাদের দরকার হয়ে পড়েছিল যারা ‘শাসিত’ হবে তাদের শাসন করবার জন্য একটি সংবিধান।

কিন্তু একটি স্বাধীন জনগোষ্ঠির‘গঠনতন্ত্র’ রচনার ধারণা ঔপনিবেশিক ‘সংবিধান’ ধারণার বিপরীতে সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা। প্রথমত ‘গঠনতন্ত্র’ স্বাধীন জনগণের ইছা ও অভিপ্রায় ধারণ করে। এই ইচ্ছা ও অভিপ্রায়, বলা বাহুল্য, জনগণের স্বাতন্ত্র্য বোধ বা উপলব্ধির, অর্থাৎ তাদের সংগ্রামের স্মৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। সেই স্মৃতি ও ঐতিহাসিক সংগ্রাম জনগণের মধ্যে কিছু আদর্শিক ঐক্যের বীজও বপন করে। তখন গুরুতর প্রশ্ন হয়ে ওঠে কিভাবে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে আমরা বুঝব এবং ব্যক্ত করব, যাতে সকলে সহজে বুঝতে পারে জনগণের ইচ্ছা ও আকাংখার কথাই আমরা বলছি। কিভাবে স্মৃতি ও ইতিহাসের সারসত্তা আমরা এমন ভাবে ছেঁকে আনতে পারি যাতে জনগণ বুঝতে পারে এটা তাদের অভিপ্রায়েরই সারার্থ, ইত্যাদি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজেদের ‘গঠন’ করবার প্রক্রিয়ায় যথাসম্ভব সকলকে অংশগ্রহণ করানো এবং গঠনতন্ত্র (Constitution) নামক দলিলে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঠিক সন্নিবেশনা। ‘গঠনতন্ত্র’ কথাটার গভীর তাৎপর্য কামাল হোসেন ও আনিসুজ্জামানদের হাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়ার গোড়াতেই নিহত হয়েছে। বাহাত্তরেই তার কবর রচনা করে হয়েছে, যার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে একটি মৃত কাঠামো। এই মৃত কাঠামোর থাম্বা ধরেই পরবর্তীতে গড়ে তোলা হয়েছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ক্ষমতা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

দেখা যাচ্ছে কনস্টিটিউশানকে ‘সংবিধান’ অনুবাদ করা নিছকই অনুবাদের মামলা নয়। এটি একটি লক্ষণ। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় বলতে আমরা কী বুঝি এবং সেই বোঝাবুঝিতে ভুল থাকলে একটি জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক পরিণতি কি হতে পারে সেই বিষয়ে সমাজে সচেতনতার মারাত্মক অভাব । ‘কনস্টিটিউশান’ পাশ্চাত্যে গড়ে ওঠা আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ বর্গ। পোস্ট-কলোনিয়াল রাষ্ট্র হিশাবে আমরা আমাদের প্রাক্তন প্রভুদের নকল করছি মাত্র। সেই জন্যই কনসস্টিটিউশান অনুবাদের প্রশ্ন ওঠে, কিন্তু সেটাও আমরা ঠিক ভাবে রপ্ত করতে শিখি নি। নতুন ভাবে ভাববার কিম্বা গড়বারও কোন হিম্মত আমাদের নাই। ‘কনস্টিটিউশান’-এর অনুবাদ ‘গঠনতন্ত্র’ না করে ‘সংবিধান’ করার পেছনে যে ঔপনিবেশিক চিন্তা, শাসক শ্রেণীর অহংকার এবং শাসিতকে আইন দ্বারা পদানত রাখার ফ্যাসিস্ট ইচ্ছা ব্যক্ত, সেটা অতএব স্রেফ অনুবাদের মামলা নয়। আরও গভীর বিষয়। যা নিয়ে আমাদের সমাজে আলোচনা নাই বললেই চলে। কিন্তু শক্ত দাঁড়াতে হলে গভীরে যেতে হবে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ধারণ করে একটি ‘গণরাষ্ট্র’ বা ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ কিভাবে গঠন করতে হয় সেটা আমরা এখনও জানি না। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশের উৎপত্তির গোড়ায় এই অজ্ঞানতা ঘোরতর পাপ হয়ে রয়েছে, যেদিকে সঠিক ভাবে নজর দিতে না পারলে আমরা এক কদমও সামনে এগিয়ে যেতে পারব না।

০৯ মার্চ ২০২১।। শ্যামলী

 

(‘সাম্প্রতিক দেশকাল’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এখানে কিছুটা পরিমার্জনা করা হয়েছে)

 

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।