‘বাচ্চাবাজি’, শরিয়া এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আফগান জনগণের বিজয়
এক
এখানে আফগানিস্তান নিয়ে আমরা একটু ভিন্ন ভাবে আলোচনা করব, যেন বাঁধিগৎ তর্কাতর্কি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি।
বাঁধিগৎ তর্কাতর্কি নানান ধরনের হতে পারে। যেমন, তালেবানরা হানাদার ও দখলদার মার্কিন বাহিনীর চোখে সন্ত্রাসী বা ‘টেররিস্ট’। তাদের ইসলাম , বিশেষত ‘শরিয়া আইন’ পাশ্চাত্যের লিবারেল বা উদারবাদী চিন্তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ফলে আফগানিস্তানের আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে কোন আলোচনা আসলে আফগানিস্তানে কি ঘটছে বা কি ঘটল সেই দিকে নিবিষ্ট না থেকে সেটা ইসলাম ও ‘শরিয়া’ আইন নিয়ে তর্কে পর্যবসিত করা হয়। যার পরিণতি শেষাবধি ইসলামের একতরফা নিন্দা। সেই সকল তর্ক বা কুতর্কের অনুমান ও সিদ্ধান্ত শেষাবধি সাম্রাজ্যবাদী হানাদারি ও দখলদারির পক্ষে সাফাই গাওয়ার অধিক কিছু পয়দা করে না। তর্কটা তখন আফগানিস্তানে বাস্তবে কি ঘটছে সেটা বাস্তবোচিত ভাবে জানার চেয়ে তালেবান এবং তালেবানি শাসন কতো খারাপ সেই বিবাদে লম্ফ দিতে থাকে।
বিপরীতে, বলাবাহুল্য, সরবে বা প্রচ্ছন্ন ভাবে প্রমাণের চেষ্টা চলে যে হানাদার ও দখলদার বাহিনী খুব ভাল, কারন তারা নারীদের ইসলামী দুঃশাসন থেকে মুক্ত করবার জন্য যুদ্ধ করছে। এই ধরণের ‘নারী’ নিয়ে তর্ক ‘নারী’ নামক বর্গকে চিরায়ত বা শাশ্বত ধারণায় পর্যবসিত করে। কিন্তু নারী নিছক বায়লজি নয়, বরং সামাজিক-ঐতিহাসিক নির্মাণ সেটা বাঁধিগৎ তর্কাতর্কিতে অস্বীকার কিম্বা এড়িয়ে যাওয়া হয়।
এই বিপদ এড়ানোর উপায় কি? ‘নারী’ নামক বর্গকে কেন্দ্রে বসিয়ে পর্যালোচনার চেয়েও পুরুষতন্ত্র, পুরুষতন্ত্রের বিভিন্ন ঐতিহাসিক রূপ এবং বিভিন্ন সামাজিক-ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে পুরুষতন্ত্র মোকাবিলার সঠিক রণনীতি ও রণকৌশল পর্যালোচনা। সেটাই অধিক ফলদায়ক। পুরুষতন্ত্র উৎখাতের কর্তব্য বাদ দিয়ে আধুনিক ‘অধিকারবাদ’ – নারীর অধিকার নিয়ে কোলাহল করতে ভালবাসে। শেষাবধি নারী পর্যবসিত হয় পুঁজির বাজারে কামোদ্দীপক পণ্যে। রপ্তানিমুখি পোষাক তৈরি কারখানায় সস্তা নারী শ্রমের যথেচ্ছ ব্যবহার উন্নয়ন ও প্রগতির নামে কবুল করা হয়। বুঝি পুরুষতন্ত্র পুঁজিতান্ত্রিক কলকারখানায় অনুপস্থিত।
তথাকথিত ‘অধিকার’ আধুনিক রাষ্ট্রের দ্বারাই শুধু বলবৎযোগ্য – সেই ‘অধিকার’ রাষ্ট্র, অর্থাৎ বল প্রয়োগের প্রতিষ্ঠানের দ্বারা বাস্তবায়িত করার ধরণ আদতে পুরুষতন্ত্রেরই আধুনিক রূপ মাত্র। কারণ আধুনিক রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার রূপ পুরুষতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয়ত পুরুষতন্ত্রের যেমন প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক চরিতে রয়েছে – যেমন, দাস, ট্রাইবাল বা গোত্রবাদী সমাজ কিম্বা সামন্ততন্ত্রে, তেমনি তার পুঁজিতান্ত্রিক রূপও রয়েছে। এ নিয়ে পুরুষতন্ত্র বিরোধী নারী আন্দোলনের সামনের সারির চিন্তকরা বিস্তর লেখালিখিও করেছেন ; দেখুন, (Mies, 1986), (Sheila Rowbopthan , Stephanie Linkogle, 2001).
নারী ও পুরুষতন্ত্র স্রেফ আধুনিক বুর্জোয়া কিম্বা আধুনিক কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাসম্পন্ন পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দ্বারা নারীর ‘অধিকার’ কায়েমের তর্ক নয়। পুঁজিতান্ত্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক সম্পর্ক উৎখাত বা বিলয়ের রণনীতি ও রণকৌশল নির্ণয়ের তর্ক। আফগানিস্তানের আলোচনায় মূল বিষয় বাদ দিয়ে তখন বিমূর্ত তর্কের জগতে একদিকে ‘নারী’ এবং অন্যদিকে ‘অধিকার’-এর তর্কে আমরা ঢুকে পড়ি। এর সুবিধা হচ্ছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আফগানিস্তানের জনগণের লড়াইকে একট খোপের মধ্যে ফেলে দিয়ে চমৎকার ইসলাম বিদ্বেষ এবং ‘শরিয়া’ বিরোধী প্রপাগান্ডা চালানো যায়, যা আদতে হানাদারি ও দখলদারির পক্ষে যুক্তি ও ন্যায্যতা প্রমাণের অধিক কিছু না। আফগানিস্তানের জটিল বাস্তবতার সরলীকরণ আমাদের সমস্যার গোড়ায় নজর নিক্ষেপ করতে দেয় না। সেই কারণে বাঁধিগৎ তর্কাতর্কি আমরা এই আলোচনায় পরিহার করে একটি অপরিচিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি।
নারীর প্রশ্ন নিয়ে সুনির্দিষ্ট আলোচনা হতেই পারে, কিন্তু তাকে হতে হবে আফগানিস্তানের বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে। বিমূর্ত নারীবাদ কিম্বা বিমূর্ত ‘অধিকার’-এর তর্ক তুলে হানাদার ও দখলদারদের বিরুদ্ধে আফগান জনগণের যুদ্ধকে ম্লান করে দেওয়া, কিম্বা তাদের বিজয়কে কার্যত অস্বীকার করার চেষ্টা বাঁধিগৎ তর্কাতর্কির অন্তর্গত। প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ এবং নানান পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবশ্যই অবস্থান নেওয়া সঠিক, কিন্তু সেটা যখন হানাদারি ও দখলদারির বিরুদ্ধে আক্রান্ত জনগোষ্ঠির লড়াই ও বিজয়ের তাৎপর্যকে অস্বীকার করায় পর্বসিত হয় তখন সেটা মূলত সাম্রাজ্যবাদ এবং তথাকথিত আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার পক্ষাবলম্বন মাত্র। দখলদার ও হানাদার সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দালালদের সম্প[অর্কে অতএব সাবধান ও সতর্ক থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বাঁধিগৎ তর্কাতর্কি হচ্ছে দেশকালপাত্র নির্দিষ্ট বাস্তবতা থেকে কোন বিষয়কে বিচ্ছিন্ন বা আলাদা ভাবে বিচার করার চর্চা বা অভ্যাস। আফগানিস্তান সম্পর্কে এই ধরণের তর্কের ছড়াছড়ি আমরা দেখে থাকি। যেমন ‘শরিয়া’ নিয়ে তর্ক। পাশ্চাত্য লিবারেল বা তথাকথিত উদারবাদী প্রপাগান্ডা সবসময় প্রচার করে ‘শরিয়া’ আইন খুবই মন্দ ব্যাপার। যেহেতু তালেবানরা শরিয়া আইনের আলোকে তাদের সমাজের নৈতিক ভিত্তি ও শাসন কায়েম করতে চায়, তাই ‘শরিয়া’র বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর অর্থ ক্ষমতার লড়াইয়ে শাসক হিশাবে তালেবানদের ন্যায্যতা আগাম নস্যাৎ করে দেওয়া। এটা হানাদার ও দখলদারদের যুদ্ধ নীতির অংশ। আফগানিস্তানে শরিয়ার ভূমিকা এতো সরল নয়। আফগানিস্তান বিভিন্ন ট্রাইবাল বা জনজাতি গোষ্ঠির দেশ। প্রতিটি গোষ্ঠির নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং চর্চা রয়েছে। ফলে সামাজিক ও গোট্রবাদী বিরোধও এই সমাজে প্রবল। কিন্তু প্রতিটি গোষ্ঠি আবার মনে করে শরিয়া তাদের নিজস্ব গোষ্ঠ সংস্কৃতি থেকে আলাদা কিছু না। যার ফলে শরিয়ার সঙ্গে স্থানীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও চর্চার সম্পর্ক আফগানিস্তানে যথেষ্ট জটিল। অন্যদিকে আরেকটি স্তর হিশাবে রয়েছে রাষ্ট্রীয় আইন, অর্থাৎ বিভিন্ন সময়ে গৃহীত আধুনিক আফগানিস্তানের কন্সটিটিউশান বা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। ফলে শরিয়ার প্রশ্নকে আমরা বাইরে থেকে যতো সরল বিষয় গণ্য করি আফগানিস্তানের বাস্তবতা মোটেও তা নয়। বাস্তবতা আরও অনেক জটিল।
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ভাষা ও নৃগোষ্ঠিগত বৈচিত্র্য। সূত্র National Geographic। আফগানিস্তান ও সন্নিহিত অঞ্চলের গোত্র-গোষ্ঠবাদী বা ট্রাইবাল সমাজসহ ভাষা, সংস্কৃতি এবং নৃ-গোষ্ঠিগত জটিলতা বোঝা ছাড়া আফগানিস্তানের বাস্তব পরিস্থিতি বোঝা অসম্ভব।
কয়েক দশক ধরে একের পর এক বিদেশী হানাদারি ও দখলদারির শিকার হয়ে আফগানরা বুঝে গিয়েছে তাদের ভুগতে হয়েছে সেইসব অপরিণামদর্শী বহিরাগতদের দ্বারা যারা মনে করে তাদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আইন কিম্বা সংবিধান গায়ের জোরে জবরদস্তি পরাধীন রাখা আফগানদের ওপর তারা চাপিয়ে দিতে পারে। এই কারণে, যেকোন সর্বগ্রাসী ও সর্বব্যাপী আইন যাকে ইংরেজিতে ‘Totalizing’ বলা হয় – বাংলায় যাকে আমরা বলতে পারি দেশকালপাত্র বিবেচনায় না নিয়ে ‘ধরো তক্তা মারো পেরেক’ জাতীয় আইন – হোক তা ইসলামিক কিম্বা অনৈসলামিক – আফগানরা ওপর থেকে আরোপ করা সেইসকল আইনের বিরোধিতা করেছে। যেহেতু আফগানিস্তানে ইসলাম সবসময়ই একটি সার্বজনীন জীবনব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত, তাই একে তাদের নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকে আলাদা গণ্য করে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কাটছাঁট বিমূর্ত আদর্শ হিশাবেও আফগানরা মেনে নেয় নি। তাছাড়া ইসলাম এভাবে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কাটছাঁট ইডিওলজি নয় যে জবরদস্তি তা কায়েম করা যায়।
যারা আফগানিস্তান নিয়ে গবেষণা করেছেন তারা আফগানিস্তানের একটি বৈশিষ্ট্যের প্রতি বিশেষ ভাবে নজর রাখবার কথা বারবার বলেছেন। অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো আফগানিস্তান দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনস্থ থাকে নি। ঔপনিবেশিক শক্তির বিপরীতে কোন জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ দানা বাঁধে নি, তাছাড়া পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের তোড়ে দ্রুত ও আকস্মিক অর্থনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়েও আফগানিস্তান যায় নি। অন্যান্য মুসলিম দেশে আমরা যেভাবে নগরায়ন দেখেছি, আফগানিস্তানে সেভাবে নগরায়ন ঘটে নি। এর ফলে যেসব বিষয় অন্যান্য মুসলিম সমাজে বা দেশে বিতর্কের জন্ম দেয় আফগানিস্তানে সেই সকল বিষয় ক্ষীণ প্রতিধ্বনি তুলেছে হয়তো, কিন্তু বিশেষ কোন গুরুত্ব লাভ করে নি। নারী প্রশ্ন তেমনি একটি বিষয়। কারন হানাদার ও দখলদারদের কাছে আফগান পুরুষদের হাত থেকে আফগান নারীদের উদ্ধার করা যতোটা জরুরি, আফগান সমাজে সেই প্রকার নারী অধিকার সংক্রান্ত বিতর্কের বিতর্কের প্রাসঙ্গিকতা নাই বললেই চলে। ।
কিন্তু আফগানরা নিজেদের ইসলাম ধর্মাবলম্বী হিশাবেই দেখে, কারন তারা একটি মুসলিম দেশে বসবাস করে। সেই ক্ষেত্রে গোত্র, গোষ্ঠ, ভাষা এবং নিজ নিজ গোত্র সংস্কৃতির অধীনস্থ থেকেও ইসলাম তাদের একটা রাজনৈতিক সূত্রে বেঁধে রাখে। তারা বারবার বাইরের আক্রমণের শিকার হয়েছে, কিন্তু বিদেশী শত্রুদের তারা পরাস্ত করতে পেরেছে। প্রতিটি বিজয় তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় নিরাপদ রেখেছে। একই ভাবে ইসলাম সম্পর্কে তাদের নিজস্ব বোঝাবুঝিও। তাই আফগানিস্তানকে কোন একটা খোপে বা ছকে ফেলে বোঝা যাবে না। আফগানিস্তানে শরীয়াহ একটি বৃহৎ মোজাইকের সঙ্গে সম্পৃক্ত, বৃহৎ পরিসরে সামাজিক জীবনের অংশ হয়ে আছে (Barfield, 2012 (Winter))।
পাশ্চাত্য তার হানাদারি ও দখলদারির পক্ষে ন্যায্যতা তৈরির জন্য যে প্রপাগান্ডা চালায় তার সারকথা হচ্ছে আফগানিস্তানে পাশ্চাত্যের আদলে একটি আধুনিক রাষ্ট্র কায়েম করলেই আফগানিস্তানের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। হানাদার ও দখলদাররা তাদের অধীনে একটি নির্বাচন দিইয়ে তাদের কলাবোরেটরদের ক্ষমতায় বস্যে দাবি করে তারা আফগান্সতানে গণতন্ত্র কায়েম করছে। তারা ন্যাশন বিল্ডিং বা জাতিগঠনে ব্যাস্ত। তারা নির্বাচন মার্কা ‘গণতন্ত্র’(?) কায়েম করতে চায় হানাদারি ও দখলদারির মাধ্যমে। ইউরোপের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মতো আফগানিস্তানের জনগণের ভেতর থেকে গড়ে ওঠা কোন গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নয়। আফগানিস্তান হাজার বছরের গোষ্ঠবাদী, গোত্রবাদী বা ট্রাইবাল সমাজ। সমাজের অধিপতি হিশাবে যারা বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাগোষ্ঠিতে বিভক্ত আফগানদের শাসন করে তারা প্রায় প্রত্যকেই স্থানীয় ‘ওয়ারলর্ড’, বা সশস্ত্র শাসক। এই সশস্ত্র স্থানীয় প্রভুদের বড় একটি অংশ আফিম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কিন্তু তারাই আবার মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর হানাদারি ও দখলদারির সহযোগী। এদের নিয়েই হানাদার বাহিনী আফগানিস্তানে একটি আধুনিক লিবারেল রাষ্ট্র বানাবার কেচ্ছা আমাদের শুনিয়ে আসছে, যে কেচ্ছার মূল অর্জন নাকি তালেবানদের হাত থেকে নারীদের মুক্ত করা । সেই কেচ্ছাকে মধুর করবার জন্য তারা ক্রমাগত ইসলামি ‘শরিয়া’র বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালায়। যদি আফগানিস্তান সম্পর্কে পাশ্চাত্যের বহুল প্রচারিত গল্প বা ন্যারাটিভগুলো আমরা শুনি তাহলে মনে হয় মার্কিন ও ন্যাটোবাহিনীর পুরা যুদ্ধই চলেছে শরিয়া উচ্ছেদ করে নারীদের ইসলামের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে -- আধুনিক পাশ্চাত্য লিবারেল রাষ্ট্র কায়েম করবার লক্ষ্যে।
‘শরিয়া’ যে কোন আইনের মতোই একটা আইন। ফলে আধুনিক আইন ব্যবস্থা সহ যে কোন আইনেরই ঐতিহাসিক পর্যালোচনা জরুরী, যাতে যে কোন আইনের সঙ্গে সন্ত্রাস ও শাসনের সম্বন্ধ আমরা বুঝতে পারি, নীতি-নৈতিকতা বনাম আইনের ফারাকও আমরা বুঝি। তাহলে আইনের পর্যালোচনা করতে চাইলে শরিয়া ও আধুনিক আইন ব্যবস্থা সহ সকল আইনেরই পর্যালোচনা হতে পারে। কিন্তু পাশ্চাত্য প্রপাগাণ্ডায় সেটা করা হয় না। শরিয়াকে হাজির করা হয় আলাদা ভাবে, যেন শুধু শরিয়াই মুসিলিম সমাজকে পিছে টেনে ধরেছে। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে যে দাবি করা হয় সেটা হোল মুসলমানরা শরিয়া ত্যাগ করে আধুনিক আইন বরণ করলেই তাদের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
তাহলে সমস্যার জটিলতা ও নানান স্তর সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ এই মুহূর্তের দরকারি কাজ। মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর হানাদারী ও দখলদারি কিভাবে আফগানিস্তানে শিশুদের যৌন নির্যাতনকে আরও বিস্তৃত ও ব্যাপক করে তুলেছে সেই অনালোচত অধ্যায় নিয়ে তাই এখানে আমরা আলোচনা করব।
দুই
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে নিউইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদন ছাপে। এর শিরোনাম ছিল “U.S. Soldiers Told to Ignore Sexual Abuse of Boys by Afghan Allies”। অর্থাৎ আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্যদের বলা হয়েছিল তারা যেন তাদের সহযোগী স্থানীয় আফগান যোদ্ধাদের দ্বারা ছেলেশিশুদের ওপর অকথ্য অত্যাচারের কথা চেপে যায়, যেন তা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা না হয়। বিশ বছর ধরে যুদ্ধের পুরা সময় ব্যাপী আফগানিস্তানের বাচ্চা শিশুদের ওপর অকথ্য যৌন নির্যাতন চলেছিল। কিন্তু মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী যুদ্ধ নীতি হিশাবে এই সত্যটা সবসময়ই চেপে গিয়েছে। এই সত্য এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
কিন্তু ল্যান্স কর্পোরাল গ্রেগরি বার্কলি জুনিয়রের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মার্কিন হানাদার ও দখলদারদের মুখে চুনকালি মেখে দেয়। গ্রেগরি বাকলি জুনিয়র বাড়িতে তার শেষ ফোন কলে তার বাবাকে নিজের গভীর কষ্টের কথা জানিয়েছিলেন। তাঁর মানসিক কষ্টের কথা বাবাকে তিনি জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। দক্ষিণ আফগানিস্তানে তার বাঙ্ক থেকে তিনি জানিয়েছিলেন দখলদারদের ভাড়াটিয়া আফগান পুলিশ কর্মকর্তারা ঘাঁটিতে ছোট ছোট ছেলেদের নিয়ে আসে। তারপর সারারাত ধরে চলে উন্মত্ত যৌন নির্যাতন। সেই নির্যাতনে ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেগুলো চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। যুদ্ধক্ষেত্রে সামরিক ক্যম্পের বাতাস ভারি হয়ে আসে। শিশু বাচ্চাদের এই যৌন নির্যাতনের আর্তি ও হাহাকার নিয়মিতই গ্রেগরি এবং অন্যান্য সৈনিকরা শুনতে পেতেন। বাবাকে তিনি বলেন, "রাতে আমরা তাদের চিৎকার শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু আমাদের এ বিষয়ে কিছু করার অনুমতি নেই”। অর্থাৎ দখলদার বাহিনী জেনেশুনেই এই অকথ্য যৌন নির্যাতন তাদের ঘাঁটিতে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হিশাবে ঘটতে দিয়েছে। নীতিনৈতিকতার প্রশ্ন বাদ দেওয়া যাক। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রকে যখন যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে রূপান্তরিত করা হয় তখন যে কেউই এই দূরদর্শিতাটুকু অনুমান করে নিতে পারবে যে হানাদার ও দখলদার বাহিনীর দিন ক্রমেই কমে আসছে। শেষমেষ তাই হয়েছে। মার্কিন বাহিনী কার্যত আফগানিস্তান থেকে যুদ্ধে হেরে পালিয়ে এসেছে।
গ্রেগরি জুনিয়র ২০১২ সালে আফগানিস্তানের একটি সামরিক ঘাঁটিতে গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে বাবা গ্রেগরি বাকলি সিনিয়রকে সে বলেছিল যে ব্যাপারটি সে তার ওপরের অফিসারদের বলবে। বাবা সেকথা মনে করতে পারছেন। বাবা জানিয়েছেন, "আমার ছেলে বলেছিল যে তার অফিসাররা ব্যাপারটিকে অন্যভাবে দেখতে বলেছিল কারণ এই শিশু নিপীড়ন বা সমকামী যৌনতা নাকি আফগানদের সংস্কৃতি।"
উরজগান প্রদেশের চার্চিনোতে পুলিশদের মনোরঞ্জনের জন্য বাচ্চাবাজি নাচের ছবি। ছবিটি Kate Geraghty-র তোলা। ছাপা হয়েছিল The Sydney Morning Herald। লিংকটি আমরা Newslines Institute-এর একটি নিবন্ধ থেকে দেওয়া।
এখানে বলে রাখা দরকার আফগানিস্তানে শিশুদের উপর যৌন নিপীড়ন দীর্ঘকালের একটি গভীর নৈতিক ও সামাজিক সমস্যা। বিশেষত সশস্ত্র কমান্ডারদের মধ্যে নানা ভাবে এই চর্চা বিস্তৃত। শিশু নির্যাতনের এই নিষ্ঠুর অভ্যাস বা চর্চাকে বলা হয় ‘বাচ্চাবাজি’ বা বাচ্চা নিয়ে তামাশা। আমরা জানি নানান গোষ্ঠে ও গোত্রে আফগানিস্তান বিভক্ত। বিভিন্ন ওয়ার লর্ড সশস্ত্র ভাবে বিভিন্ন ভূখণ্ডের ওপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে ও শাসন কায়েম রাখে। মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী এদেরকেই তাদের স্থানীয় সশস্ত্র যোদ্ধা হিশাবে রিক্রুট করেছে। বিশেষত এরাই পুলিশে নিয়োগ পেয়েছে সহজে। সশস্ত্র কমান্ডারদের মধ্যে যাদের গ্রামীন ভূখণ্ডের ওপর অনেকাংশে আধিপত্য বিস্তৃত তারা ‘বাচ্চাবাজি’ চালিয়ে যাবার জন্য স্থানীয় জনগণের ওপর প্রচুর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। গ্রামীন আফগান জনগণের সে কারনে অস্ত্রধারী স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বাচ্চাবাজির জন্য প্রচণ্ড ক্ষোভ রয়েছে। অর্থাৎ দখলদার বা হানাদার বাহিনী একে আফগানদের ঐতিহ্য বলে হাজির করতে চাইলেও সাধারণ মানুষের কাছে বাচ্চাবাজি মূলত সশস্ত্র ওয়ার লর্ডদের ঘৃণিত চর্চা। কিন্তু আফগানদের ঐতিহ্যের ধূয়া তুলে আমেরিকান সৈন্য এবং মেরিনদের এ ব্যাপারে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হস্তক্ষেপ না করার পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। সেটা হচ্ছে যৌনতা সম্পর্কে লিবারেল পাশ্চাত্যের অবস্থান। পাশ্চাত্য এলজিবিটি বা লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল ও ট্রন্সজেন্ডারদের যৌন অধিকারের প্রতি উদার। ফলে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীকে তাদের নিজ দেশের সমাজের উদারবাদী সংস্কৃতি, আইন, অনুমান ও বিশ্বাসকে প্রশ্রয় দিতে হয়েছে। এর ফলে বাচ্চাবাজির ব্যাপারে কঠোর কোন অবস্থান গ্রহণ করা হানাদার বাহিনীর পক্ষে রীতিমতো কঠিন ছিল।
এ এফ পির (Agence France-Presse) রিপোর্টার অনুজ চোপরা ওয়াশিংটন পোস্টে ২৮ জুলাই ২০১৭ তারিখে লিখছেন:
গত গ্রীষ্মে, একজন আফগান পুলিশ কমান্ডার তার "সুন্দর" ছেলে যৌনদাসী দেখার জন্য আমাকে তার পোস্টে চায়ের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন - এবং আমি দক্ষিণ উরুজগান প্রদেশের রাজধানী তারিন কোটের উপকণ্ঠে তার কাদা ও খড় দিয়ে তৈরি ফাঁড়িতে পৌঁছালাম, তালেবানদের সাম্প্রতিক উত্থানে সে অঞ্চল টলটলায়মান। আমি আফিম চাষের খামার দিয়ে যাবার সময় বুক উঁচু পপির বস্তায় হোঁচট খেতে খেতে পৌছেছি সেখানে। এই এলাকাটা তালেবানদের উত্থানের মুখে জ্বলছে। তার খোলা ছাদে, একটি ছোট কিশোর যার যৌন দাস সেই বিশাল বপুর লোকটির পাশে বসেছিল। যখন সে চুপচাপ আমাদের চায়ের গ্লাস ভরে দিচ্ছিল ফাঁকে ফাঁকে তার বিষণ্ণ চোখের চোরা চাহনি দিচ্ছিল। তার জরিদার টুপি ভেদ করে পিঙ্গল বর্ণের কোঁকড়ানো চুলগুলো বেরিয়ে আসছিল আর তার দুধের মতো সাদা চোখে ছিল সুর্মার টান। কমাণ্ডার তাকে জাঁকিয়ে বেড়াচ্ছিল যেন সার্কাসের কোন রিং মাস্টার তার আজব কোন পোষা জন্তুর খেলা দেখাচ্ছে। কথায় কথায় তার প্রফুল্ল কন্ঠ জানান দিচ্ছিল, “দেখো কেমন সুন্দর আমার বাচ্চা’ – আর কমান্ডারের কোমরের এক পাশে ঝুলছিল বন্দুক; (দেখুন, Afghan soldiers are using boys as sex slaves, and the U.S. is looking the other way)।
যে কমান্ডারের ঘাঁটিতে বিষণ্ণ বাচ্চাকে অনুজ চোপরা দেখেছিলেন, তাঁর মতো কমান্ডাররাই মার্কিন হানাদার বাহিনীর মিত্র। আফগান স্থানীয় পুলিশ (এএলপি) এর শত শত ফাঁড়ি, যুক্তরাষ্ট্রের করদাতাদের ডলারে সশস্ত্র এবং মার্কিন করদাতাদের অর্থেই পরিচালিত। সামনের সারির বাহিনী এবং অন্যান্য সরকারপন্থী মিলিশিয়া নাচ এবং যৌন সঙ্গমের জন্য তরুণ যেসব ছেলেদের দাস বানিয়েছিল, তাদের অনেককেই অপহরণ করা হয়েছিল। এই তথ্যগুলো পাশ্চাত্য শক্তি এবং তাদের গণমাধ্যমগুলো ভালভাবেই জানতো। ইন্টারেস্টিং ঘটনা হচ্ছে পাশ্চাত্য শক্তি দুনিয়াব্যাপী তালেবানদের পশ্চাতপদতা ও সভ্যতাবর্জিত চিন্তাভাবনা নিয়ে কম প্রচার করে নি। অথচ তালেবানের আমলেই বাচ্চাবাজির বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু হয়েছিল। এর একটা বড় কারণ ছিল শরিয়া এই ধরণের শিশু নির্যাতন বরদাশত করে না। তাই ২০০১ সালে তালেবানদের পতনের পর এবং মার্কিন ও ন্যাটো সেনাবাহিনীর হানাদারি ও দখলদারি বাচ্চাবাজিকে আবার পুরাদমে আফগানিস্তানে ফিরিয়ে এনেছে। অনুজ চোপরার দাবি হচ্ছে, তালেবানের তথাকথিত ‘শরিয়া’ শাসন থেকে ‘মুক্তি’ হানাদার বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় মিলিশিয়াদের কার্যত "বাচ্চাবাজি" করার স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। যৌন দাসত্বের সাংস্কৃতিক চর্চা, ছেলেদের প্রায়শই মেয়েদের মতো সাজিয়ে গুজিয়ে রাখা এবং বাচ্চা ছেলেদের ওপর যৌন-দখলাদারি ও নিয়মিত নির্যাতনকে পাশ্চাত্য শক্তি ‘আফগান সংস্কৃতি’ বলে সব সময়ই এড়িয়ে গিয়েছে। তারা সব সবসময় দাবি করেছে বাচ্চা বা কিশোর বয়সী যৌন দাসী রাখা আফগান পুরুষদের কাছে শক্তি ও পুরুষত্বের প্রতীক বা চিহ্ন। এমনকি অনেকে এই দাবি করে থাকে যে আফগানরা মেয়েদের শুধু সন্তান উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত মনে করে। আর বাচ্চা ছেলেরা হচ্ছে যৌন আনন্দ, পুরুষালি তামাশা ও উৎসবের মজার জন্য।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যতোই অবিরাম আফগান যুদ্ধের কাদায় আটকা পড়ছিলো ততোই তারা আরও নতুন সৈন্য পাঠানোর তাগিদ বোধ করেছে। অন্যদিকে যুদ্ধের খাতিরে তারা তাদের স্থানীয় বরকন্দাজদের দ্বারা শিশুদের যৌন নির্যাতনের ঘটনাও চেপে যেতে বাধ্য হয়েছে। ব্যাপক ভাবে ফাঁড়িতে ফাঁড়িতে নিত্য চলতে থাকা বাচ্চাবাজিকে আড়াল করতে হয়েছে তাদের। লুকিয়ে রাখতে হয়েছে গণমাধ্যমের নজর থেকেও। স্থানীয় সামরিক মিত্রদের দ্বারা সংগঠিত ব্যাপক শিশু যৌন নির্যাতন তাদের মেনে নিতে হয়েছে। কার্যত তারা একে প্রশ্রয় দিয়েছে। অনুপ যথার্থই বলেছেন, এই ভয়াবহ অমানবিকতার প্রতি মার্কিন সহনশীলতা এই বার্তাই প্রতিষ্ঠা করে যে নীতি কিম্বা কৌশল যাই বলা হোক মার্কিন হানাদার বাহিনীর সমর্থিত স্থানীয় কমান্ডার ও পুলিশ বাহিনীর শিশু যৌন দাস রাখা মার্কিন ও ন্যাটো যুদ্ধ নীতির কাছে গ্রহণযোগ্য বিষয় বলেই বিবেচিত হোত।
অনুপ চোপরা এর আগে তার একটি প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন শিশুদের যৌন নির্যাতনের শক্তিশালী নিরাপত্তা প্রভাবও রয়েছে। অনুপ চোপরা নিজেই এর আগে রিপোর্ট করেছিলেন, তালেবানরা আফগান নিরাপত্তা পদে অনুপ্রবেশের জন্য বাচ্চাবাজিকে কাজে লাগাচ্ছে, শিশু যৌন দাসদের তালেবানরা ব্যবহার করছে সফল ভাবে। শিশুদের মধ্যে অনেকেই নির্মমভাবে নির্যাতিত এবং প্রতিশোধের জন্য ক্ষুধার্ত। ট্রোজান হর্স হিসাবে তালেবান এদের ব্যবহার করেছে। যার ফলে মারাত্মক অভ্যন্তরীণ হামলা চালানো সম্ভব হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাচ্চাবাজিকে গণ্য করা হয়েছে আফগান সমাজে সাংস্কৃতিকভাবে অনুমোদিত পুরুষ ধর্ষণ। এর বিরুদ্ধে কার্যত তাই কোন বাধা বা প্রতিবন্ধকতা ছিল না বললেই চলে। আইনী ও প্রশাসনিক শাস্তি ও শাসনের অনুপস্থিতিতে বাচ্চাবাজি মার্কি্ন ও ন্যাটো বাহিনীর যুদ্ধ নীতির প্রয়োজনে অবিরাম চলতে পেরেছে। জাতিসংঘ আফগানিস্তানকে অবিলম্বে বাচ্চাবাজিকে অপরাধ গণ্য করার এবং আইন প্রণয়ন করে শাস্তি ও প্রতিরোধের কথা বললেও এতে কাজ হয় নি। বাচ্চাবাজির জন্য দোষী রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের দ্রুত বিচারের আহ্বান জানিয়েও বিশেষ ফল হয় নি।
এর ফলে দুই হাজার এক সাল থেকে শুরু করে দুই হাজার একুশের অগাস্ট মাস অবধি পুরা হানাদারি ও দখলদারীর কালপর্বে বাচ্চাবাজি উপেক্ষা করবার নীতি স্থায়ী হয়েছে। বেশ কিছ সাক্ষাৎকার এবং আদালতের রেকর্ড দেখে বোঝা যায় সামরিক ঘাঁটিতেও যখন ঘটনাগুলো ঘটেছে তখন তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। স্থায়ী হবার প্রধান কারন আমেরিকান বাহিনী তালেবানদের বিরুদ্ধে আফগান ভূখণ্ড ধরে রাখবার জন্য আফগান মিলিশিয়াদের নিয়োগ ও সংগঠিত করেছে। আফগান মিলিশিয়া এতে যে ক্ষমতা লাভ করেছে তার পরিণতি ঘটেচ্ছে যথেচ্ছা বাচ্চাবাজিতে। এই অপরাধ উপেক্ষা করবার নীতি স্থায়ী হয়েছে এ কারণেই। কারণ স্থানীয় মিলিশিয়াদের ছাড়া মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারত না। এর ফলে অবশ্য সৈন্য এবং মেরিনরা ক্রমবর্ধমান সমস্যায় পড়েছে। আমেরিকান সামরিক বাহিনী যাদের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করছে এবং তাদের গ্রামের কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ করছে তারাই মূলত শিশুদের সাথে যৌন মর্যাতন করেছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস একজন স্পেশাল ফোর্সের ক্যাপ্টেন ড্যান কুইনের উদ্ধৃতি দিয়েছে। ড্যান কুইন বলেন, "আমরা এখানে এসেছিলাম কারণ আমরা শুনেছি যে তালেবানরা মানুষের সাথে কী ভয়ঙ্কর কাজ করছে, মানবাধিকার হরণ করছে।" ড্যান কুইন একজন আফগান কমাণ্ডারকে যৌনদাসী হিশাবে একটি শিশুকে বিছানায় বেঁধে রাখার জন্য আচ্ছাসে পিটিয়েছিলেন। যে কারনে তার একটা বিশেষ খ্যাতি রটেছিল। তিনি বলেছেন "কিন্তু আমরা এমন লোকদের ক্ষমতায় বসিয়েছিলাম যারা এমন সব কাজ করবে যা তালেবানদের চেয়েও অতিশয় মন্দ। গ্রামের প্রবীণরাই এই অভিযোগ আমাকে বলেছিল।"
মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী তাদের আফগান মিত্রদের দ্বারা শিশুদের ওপর অকথ্য যৌন নির্যাতন উপেক্ষা করার নির্দেশনাটি নতুনভাবে যাচাইয়ের আওতায় আনতে অবশ্য এক সময় বাধ্য হতে হয়েছে। বিশেষ করে যখন দেখা যাচ্ছে যে ক্যাপ্টেন কুইনের মতো পরিষেবা সদস্যরা বাচ্চাবাজির মতো ঘৃণ্য অপরাধ উপেক্ষা করবার নির্দেশ অমান্য করার জন্য সামরিক শৃংখলা এমনকি ক্যারিয়ার ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছেন। আফগান কমান্ডারকে মারধরের পর সেনাবাহিনী ক্যাপ্টেন কুইনকে তার কমান্ড থেকে মুক্তি দেয় এবং তাকে আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। এরপর তিনি সামরিক বাহিনী ত্যাগ করেন। চার বছর পর সেনাবাহিনী আবার জোর করে আরেকজন সার্জেন্টকে অবসর নেওয়ার জন্য বাধ্য করে। তিনি সার্জেন্ট ফার্স্ট ক্লাস চার্লস মার্টল্যান্ড। চার্লস মার্টল্যান্ড, স্পেশাল ফোর্সের সদস্য, যিনি ক্যাপ্টেন কুইনের সঙ্গে যোগ দিয়ে কমান্ডারকে মারধর করেছিলেন। "সেনাবাহিনী দাবি করে যে মার্টল্যান্ড এবং অন্যদের উচিত ছিল বিষয়টি ‘অন্যভাবে দেখা’ – অর্থাৎ উপেক্ষা করা। বিষয়টি নীতি নির্ধারকদের মধ্যে বিতর্কের জন্ম দেয়। কিন্তু সেটাও খুব একটা এগোয় নি। সার্জেন্ট মার্টল্যান্ডের ক্ষেত্রে, সেনাবাহিনী বলেছে যে গোপনীয়তা আইনের কারণে তারা এ বিষয়ে আর কোন মন্তব্য করতে পারবে না।
এই ক্ষেত্রে আমেরিকান সামরিক নীতি ঠিক কী? নিউ ইয়র্ক টাইমস এই প্রশ্ন তোলায় আফগানিস্তানে আমেরিকান কমান্ডের মুখপাত্র কর্নেল ব্রায়ান ট্রাইবস একটি ইমেইল লিখেছিলেন। তিনি লিখেছেন, “সাধারণত আফগান সামরিক বাহিনী বা পুলিশ সদস্যদের দ্বারা শিশু যৌন নির্যাতনের অভিযোগের বিচার ঘরোয়া আফগান ফৌজদারি আইনের বিষয় ”। তিনি আরও বলেছিলেন যে " এরকম কোন ঘটনা ঘটলে আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক কর্মীদের রিপোর্ট করবার কোন স্পষ্ট প্রয়োজন নাই।" অর্থাৎ বাচ্চাবাজি বা শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন মার্কিন সেনাবাহিনীর চোখের সামনেই ঘটতে পারে, কিন্তু সে অপরাধ রিপোর্ট করবার কোন দায় মার্কিন সেনাবাহিনীর নাই। তিনি বলেন আফগান পুলিশ এবং মিলিশিয়া ইউনিটের সাথে মার্কিন সেনাবাহিনীর সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্যই এটা দরকার। আফগান পুলিশ ও সহযোগী সৈন্যেরা তালিবানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রশিক্ষিত। বাচ্চাবাজি আফগানদের সংস্কৃতি, এমন একটি দেশে বাইরের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ চাপিয়ে দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় না। বিশেষ করে সমাজের শক্তিশালী পুরুষদের মধ্যে বাচ্চাবাজি খুবই সাধারন একটি ব্যাপার। তাদের দিক থেকে তরুণ কিশোরদের দ্বারা বেষ্টিত হওয়া সামাজিক মর্যাদার চিহ্নও বটে।
তিন
আমরা ‘বাচ্চাবাজি’ নিয়ে কথা বলছি। এ সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। আফগানিস্তান নিয়ে আমাদের ভিন্ন ভাবে আলোচনা শুরু করার কারণ হচ্ছে বাঁধিগৎ তর্ক পরহার করা। তালেবান বা বর্তমান আফগান আমিরাতের বিরুদ্ধে প্রপাগাণ্ডা ও প্রচারের প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নারী অধিকার কিম্বা নারীর প্রতি নির্যাতন। এই ক্ষেত্রে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ‘ইসলাম’—বিশেষ ভাবে শরিয়া। হানাদারি, দখলদারি এবং আফগানিস্তানের ট্রাইবাল ‘ওয়ারলর্ড’ সমাজের জটিল বাস্তবতা এড়িয়ে গিয়ে সরল ভাবে ইসলাম এবং ‘শরিয়া আইন”কে দায়ী করা মূলত পাশ্চাত্য যুদ্ধ নীতির অংশ। । বাংলাদেশে ‘বাচ্চাবাজি’ নিয়ে কোন প্রতিবেদন আমার চোখে পড়ে নি। ইসলামে নারীর স্থান এবং শরিয়া নিয়ে আলোচনা- তর্কবিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু আমরা পাশ্চাত্যের দুমুখো নীতির দিকে দৃষ্টি ফেরাতে আগ্রহী যাতে সেই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়। পাশ্চাত্য একদিকে দাবি করে ‘বাচ্চাবাজি’ বা pedophilia আফগান সংস্কৃতি অতএব পাশ্চাত্যের উচিত হবে না আফগানদের ওপর পাশ্চাত্য মূল্যবোধ চাপিয়ে দেওয়ার। এই দাবি বর্বাদ। এই বর্ণবাদের গোড়া গভীরে। এই বর্ণবাদী অনুয়ান ও দৃষ্টিভঙ্গী প্রমাণ করতে চায় আফগানিস্তানে জনগণ বর্বর এবং পশ্চাতপদ, কারন বাচ্চাবাজি করাই তাদের সংস্কৃতি। অতএব আফগানদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র রক্ষার জন্য শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে কিচ্ছু বলা যাবে না। দ্বিতীয়ত পাশ্চাত্যে সমকামিতা যৌন অধিকার হিশাবে স্বীকৃত। এর বিরোধিতার অর্থ পাশ্চাত্যের শক্তিশালী এলজিবিটি (LGBT) আন্দোলনের বিরোধিতা করা হবে। সমকামিতা যৌন অধিকার। যৌনতার ক্ষেত্রে ব্যক্তির এই অধিকার ক্ষুণ্ণ করা যাবে না।
বাস্তবতা হচ্ছে মার্কিন দখলদারি ও হানাদারি বাচ্চাবাজিকে আফগানিস্তানে আরও ব্যাপক, গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী করেছে। অনেকে এখন মনে করেন বাচ্চাবাজির প্রতি এই প্রশ্রয় জারি রাখা আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর পরাজয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারন। এই সংস্কৃতি বরং সশস্ত্র স্থানীয় ওয়ারলর্ডদের মধ্যেই গড়ে উঠেছে, যুদ্ধ যাকে প্রশয় দিতে বাধ্য হয়েছে। বাচ্চা বাজী – অর্থাৎ শিশু কিশোরদের নিয়ে যৌন তামাশা করার জন্য কে কয়টা ‘বাচ্চা’ পালতে পারে সেটা ওয়ারলর্ডের আভিজাত্য ও ক্ষমতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। হানাদার বাহিনী তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওয়ারলর্ডদের এই সব মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ডকে নিঃশর্তে প্রশ্রয় দিয়েছে।
এমিলি প্রে (Emily Prey) এবং কিনসি স্পিয়ার্সের (Kinsey Spears) একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন Newline Institute for Strategy and Policy প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে যথার্থই প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তান ছাড়ছে বটে, কিন্তু প্রকট ও ব্যাপ্ত যৌন নির্যাতনের শিকার ‘বাচ্চা’গুলার কি হবে? What About the Boys: A Gendered Analysis of the U.S. Withdrawal and Bacha Bazi in Afghanistan।
প্রতিবেদনে যেটা পরিষ্কার সেটা হোল, তালেবানদের পক্ষে গণসমর্থন বৃদ্ধি এবং তাদের রাজনৈতিক উত্থানে বাচ্চাবাজি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে, ইসলামপন্থী বিদ্রোহীদের হাতে ক্ষমতা, অর্থ এবং অস্ত্র এসে যায়। কিন্তু যুদ্ধের পর আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। এক প্রকার ‘ভাঙা ভাঙা অনুমান’ কাজ করছিল। আসন্ন গৃহযুদ্ধে, বিভিন্ন বিদ্রোহী দল দেশে কাজ করবার যথেষ্ট সুযোগ পেয়ে যায়। তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছিল; সেই দিক থেকে তাদের প্রতি সাধারন জনগণের সমর্থন তৈরি হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলদারির কালপর্বে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তা জনপ্রিয় না হওয়ায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কিন্তু সোভিয়েতের পতনের পর বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপ ও সরকারপন্থীদের মধ্যে এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।
এই দ্বন্দ্ব ও গৃহযুদ্ধের সময় ‘বাচ্চাবাজি’ সবকিছু ছাপিয়ে সামনে উঠে আসে। বিদ্রোহী কমান্ডারদের মধ্যে বাচ্চাবাজি বা "চা ছেলে"-দের নিয়ে যৌন তামাশা ব্যাপক হয়ে ওঠে । সোভিয়েত বাহিনী যখন দেশে প্রবেশ করে এবং বিদ্রোহ শুরু হয় তখন বিদ্রোহী যোদ্ধারা আফগানিস্তানের কিছু সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নিয়মকে উপেক্ষা করতে শুরু করে। অর্থাৎ যে সকল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সংস্কার দরকার হয়ে পড়েছিল যুদ্ধের মুখে তা গৌণ হয়ে পড়ে। বাচ্চাবাজি অধিক হারে ঘটতে থাকে। সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে যারা অংশ গ্রহণ করে সেই সকল বিদ্রোহীদের বড় একটি অংশ ক্রমে ক্রমে বাচ্চাবাজির প্রতি ঝুঁকে পড়ে। বিদ্রোহী যোদ্ধাদের অনেকে বাচ্চাদের অপহরণ করতে শুরু করে। অল্পবয়সী ছেলেদের অপহরণ করে তাদের সামরিক ক্যাম্পে রাখা হোত, বলা হোত এরা ‘পোর্টার’ বা চা পরিবেশনের জন্য আনা পোলাপান। অথচ বাস্তবে প্রায় প্রতিটি শিশু কিশোরই ছিল পুরুষ প্রভু বা কমান্ডারদের যৌন দাস।
বাচ্চাবাজি প্রথাকে জনসংখ্যার বড় অংশই অপছন্দ করতে শুরু করে। অন্যদিকে এই সময়ে গৃহযুদ্ধে বাচ্চাবাজির বিরুদ্ধে তালেবানদের কঠোর অবস্থান তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ায়। তালেবানের শক্তি বৃদ্ধি এবং জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হিসাবে বাচ্চাবাজির বিরুদ্ধে তাদের কঠোর অবস্থান নেওয়াকে বিশ্লেষকরা বড় একটি কারন বলে গণ্য করেন।
বাচ্চাবাজি কতোটা বিকৃত রূপ নিয়েছে সেটা কান্দাহারে পশতুনদের একটি জনপ্রিয় প্রবাদ দেখে বোঝা যায়। প্রবাদটা হচ্ছে কান্দাহারের উপর দিয়ে এমনকি কাউয়া উড়ে যাবার সময় একটি ডানা দিয়ে পাছা আগলে রাখে – যদি না কেউ পাছা মেরে দেয়!”।
এই পরিপ্রেক্ষিতে তালেবানদের পক্ষে স্থানীয় সমর্থন বিপুল ভাবে বাড়ে যখন তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমর একটি বাচ্চা শিশুকে দুই জন যৌন নিপীড়ক মিলিশিয়া কমান্ডারের হাত থেকে উদ্ধার করে। এটি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা যা তালেবানদের অন্য সকল বিদ্রোহী গ্রুপ থেকে ভিন্ন করে দেয় এবং তাদের গণসমর্থনের ভিত্তি বাড়িয়ে দেয়। সশস্ত্র মিলিশিয়াদের পুরুষালি পায়ুকামিতা থেকে শিশু-কিশোরদের উদ্ধার তালেবানদের জনপ্রিয়তার বড় একটি কারন হয়ে ওঠে। এতে পরিষ্কার বোঝা যায় যায় আফগান সমাজকে সমকামি বা পায়ুকামী সমাজ হিশাবে চিত্রিত করবার পাশ্চাত্য প্রপাগান্ডা আগাগোড়াই বর্ণবাদী। যার কোন ভিত্তি নাই। মোল্লা ওমরের শিশু উদ্ধারের ঘটনার পর তালেবানরা আরও ব্যাপক ভাবে শিশু-কিশোরদের বাচ্চাবাজির হাত থেকে উদ্ধার করতে থাকে। বাচ্চাবাজি কেন্দ্র করে স্থানীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত মীমাংসার দিকেও তারা মনোযোগ দেয়। এর মধ্য দিয়ে তালেবানরা তাদের আদর্শিক ও নৈতিক স্বাতন্ত্র্য জনগণের কাছে আরও স্পষ্ট ভাবে হাজির করতে সক্ষম হয়। বিদ্রোহী গ্রুপের মধ্যে যারা বাচ্চাবাজি চর্চা বন্ধ করতে সক্ষম হয় নি কিম্বা নিজেরাও জড়িত থেকেছে, তাদের বিপরীতে তালাবানদের জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে থাকে। বাচ্চাবাজির প্রতি মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর নীরব সমর্থন, কিম্বা বিরোধিতা না করে চোখ বুঁজে থাকার নীতি তাদের হানাদারি ও দখলদারি চরিত্রকে জনগণের সামনে আরও উদাম করে দেয়।
এখানে শিক্ষণীয় দিকটা কী? বাচ্চাবাজির বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বিচ্ছিন্ন ভাবে নারীর স্বাধীনতার কথা ব্যাপক আফগান জনগণের কাছে কোন আবেদন সৃষ্টি করে নি। তাদের বুঝতে অসুবিধা হয় নি যে একদিকে সমকামিতাকে সমর্থনের নামে বাচ্চাবাজিকে প্রশ্রয় দেওয়া আর একই মুখে নারী অধিকারের কথা বলা ছিল চরম হিপোক্রাসি। বলাবাহুল্য দুই হাজার এক সালে মার্কিন হানাদারি ও যুদ্ধের ফলে তালেবানরা যখন ক্ষমতাচ্যূত হয় বাচ্চাবাজি তখন আরও ব্যাপক ভাবে বেড়ে যায়। বিশেষত পশতুন অঞ্চলে এর প্রকোপ মারাত্মক ভাবে বাড়ে। কিন্তু যুদ্ধে অন্যান্য ইসলামপন্থি জিহাদিদের তুলনায় বাচ্চাবাজির প্রশ্নে শক্ত অবস্থান থাকার কারনে তালেবানদের পক্ষে স্থানীয় সমর্থন বৃদ্ধি পায়। এখন দীর্ঘ বিশ বছরের হানাদারি ও দখলদারির বিরুদ্ধে যুদ্ধের জয়পরাজয় বাচ্চাবাজির প্রতি তালেবানদের অবস্থানের রণনীতিগত গুরুত্বই বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হোল। বাচ্চাবাজরা পরাজিত হয়েছে। শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে যারা লড়েছে তারাই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। এতে বোঝা যায় গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে পাশ্চাত্যের কাছ থেকে শেখা নারী অধিকারের কথা বিমূর্ত ভাবে তোলা কিম্বা তোতাপাখির মতো আওড়ানো চরম হিপোক্রাসি ছাড়া আর কিছুই নয়।
এটা ঠিক অতীতে আফগান সমাজে নাচুনে কিশোর এবং বয়স্কদের মধ্যে সমকামী যৌন সম্পর্ক ঘটত। তাবে সেটা মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর হানাদারি ও দখলদারির কালপর্বে আরও প্রকট ও ব্যাপ্ত হয়েছে। বাচ্চা বাচ্চা কিশোরদের মেয়েদের পোশাক পরিয়ে নাচা সাংস্কৃতিক দিক গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু সেটা ছিল সামাজিক সীমার মধ্যে নির্দিষ্ট। কিন্তু ১৯৯০ সালে ক্ষমতায় আসার পর তালেবানরা বাচ্চাবাজি নিষিদ্ধ করে এবং প্রকাশ্যে বাচ্চাবাজির জন্য শাস্তি দিতে শুরু করে। দুইহাজার এক সালে তালেবান শাসনের পতনের পর বাচ্চাবাজি ব্যাপক হতে শুরু করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ছেলেদের অপহরণ, পাচার, এবং ধর্ষণ। আজকের আফগানিস্তানে, এটি ধনী বা ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের নিত্য চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে বিশেষ করে যারা নর্দার্ন এলায়েন্স এবং আফগান ন্যশনাল সিকিউরিটি ফোর্স (ANFS)-এএনএসএফ – এর সঙ্গে যুক্ত।
আফগান ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্সের মধ্যে ব্যাপক ভাবে বাচ্চাবাজি প্রচলিত, এটা মার্কিন হানাদাররা খুব ভাল করেই জানত। এএনএসএফ -এর অংশীদারদের মধ্যে বাচ্চাবাজির বিস্তার সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই জানে। এটা এখন সর্বজনবিদিত যে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ দুইহাজার নয় সালের মধ্যেই বাচ্চাবাজির ব্যাপকতা এবং শিশু নির্যাতনের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা সম্পর্কে পুরাপুরি অবহিত ছিল। মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে বাচ্চা ও কিশোররা যে প্রায় সব সময়ই জবরদস্তি ধর্ষিত হয় এটা তারা খুব ভাল ভাবেই জানত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে যেন মার্কিন বাহিনী এবং আফগান ন্যশনাল সিকিউরিটি ফোর্সের যৌথ সম্পর্ক এবং সহযোগিতা মজবুত হয়। যেন পুরো আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা যায়। এখন প্রতিবেদনের পর প্রতিবেদন এই অভিযোগ তুলে প্রকাশিত হচ্ছে যে নিরাপত্তা খাতের সহায়তা পরিকল্পনার উন্নয়নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ঘাঁটিতে শিশুদের যৌন নির্যাতন সহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপ এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক ঘটনাকে উপেক্ষা করেছে। কিছু অঞ্চলে বাচ্চাবাজির প্রচণ্ড প্রকোপ আফগান নাগরিকদের চোখে আফগান সরকারকে বৈধতার ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তদুপরি ওয়াশিংটনের সুনাম এবং আমেরিকার বহুপক্ষীয় আন্তর্জাতিক সম্পর্কে যুক্ত মিত্রদের ভাবমূর্তি মারাত্মক ভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করার পর এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বর্তাবে। বাচ্চাবাজিকে হানাদারি ও দখলদারির পুরা কালপর্বে যেভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে তার কুফল আগামি দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র শক্তিকে ভোগ করতে হবে।
দশকের পর দশক ধরে আফগানিস্তানে হানাদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত এএনএসএফ এবং নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের সঙ্গে রণকৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখার স্বার্থে বাচ্চাবাজির প্রতি চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। বাচ্চাবাজি আফগান সংস্কৃতির অন্তর্গত একথা মার্কিন হানাদারদের স্থানীয় সহযোগী নর্দার্ন এলায়েন্স এবং আফগানাল ন্যাশনাল সিকিউরীটির কর্তাব্যাক্তিরাই মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের ক্রমাগতই বুঝিয়েছে। এখন সেই পাপ ষোল কলায় পূর্ণ হয়ে ফিরে এসেছে। এমিলি প্রে এবং কিনসি স্পিয়ার্স তাদের প্রতিবেদনে ঠিকই বলেছেন যে বাচ্চাবাজির ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক নজির থাকলেও হানাদারদের স্থানীয় সহযোগীরাই একে শিশু অপহরণ, শিশু পাচার, ধর্ষণ এবং শিশূদের অকথ্য যৌন নির্যতনের কারবারে পরিণত করেছে। এটা হানাদারি যুদ্ধের পরিণতি। আর সেটা পুষ্ট হবার নেপথ কারণ ছিল মার্কিন ডলার। যুদ্ধের একে কোন ভাবেই আর আফগান সমাজের সামাজিক প্রথা হিশাবে বরদাশত করবার সুযোগ নাই। আফগানিস্তানে বাচ্চাবাজি মার্কিন নিরাপত্তা পরিকল্পনার অংশ হিশাবেই ষোল কলায় পূর্ণ হয়ে বিকট রূপ লাভ করেছে। নিরাপত্তা পরিকল্পনার স্বার্থেই বহু অপরাধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জেনেশনেই চেপে যাবার চেষ্টা করেছে। মানবাধিকার লংঘনের বহু কুৎসিত ঘটনা যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উপেক্ষা করেছে, তেমনি একই ভাবে শিশুদের ওপর আফগানিস্তানে যৌন নির্যাতনকেও আমলে নেয় নি।
আফগানিস্তান ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্স তালেবানদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের লড়াইয়ে এবং দেশকে স্থিতিশীল করার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পার্টানার বা সহযোগী। গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সহযোগীদের দ্বারা মানবাধিকার লংঘনের তদন্তের জন্য ২০১৫ সালে মার্কিন কংগ্রেস অনুরোধ জানায়। কংগ্রেসের অনুরোধের মধ্যে ছিল মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে যে ধরণের অপরাধ ঘটে এবং তার বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় সে সম্পর্কে কঠোর ভাবে তত্ত্বতালাশ করা। মার্কিন কংরেস বুঝে গিয়েচিল অপরাধ এড়িয়ে গেলে আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত পুনর্গঠন এবং স্থিতিশীলতা প্রচেষ্টা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কৌশলগত সুবিধা এবং নিরাপত্তার রক্ষার স্বার্থে মানবাধিকার লংঘন করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চড়া মূল্য দিতে হবে। শেষাবধি মার্কিন সেনাবাহিনীর আফগানিস্তান থেকে কার্যত পলায়নের ব্যাখ্যা কংগ্রেসের এই প্রকার উদ্বেগের মধ্যে দিয়ে আসলে আগেই ধরা পড়ছিল বলা যায়।
নিউ লাইন ইন্সটিটিউটের নীতি নির্ধারণী প্রস্তাবে বলা হয়েছে আফগানিস্তানে ইনসাফ এবং মানবাধিকারকে গৌণ বিষয়ে পর্যবসিত করা উচিত নয়। কারণ আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতার জন্য মানবাধিকারের নিয়ে উদ্বেগ যথার্থ। মানবাধিকার এবং স্থিতিশীলতার সংযোগ অবিচ্ছেদ্য। সেটা খুবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে তালিবানরা বাচ্চাবাজিকে তাদের যুদ্ধ কৌশল হিশাবে ব্যবহার করছে। তারা ধর্ষিত ও নির্যাতীত শি শুকিশোর এবং তাদের পরিবারদের লড়াইয়ে সম্পৃক্ত করেছে, যাতে তারা তাদের ওপর নির্যাতনের প্রতিশোধ নিতে পারে। নির্যাতীত বাচ্চাদের নিয়োগ আফগান ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্সকে আরও সহিংসতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তালেবানরা বাচ্চাবাজিকে নানান ভাবে যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। সেটা ছিল আফগান জনগণের সঙ্গত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। যাইহোক, এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে আমেরিকান ডলার আফগানিস্তান যুদ্ধের পর ক্রিটিকাল ভূমিকা রাখতে পারে। আফগানিস্তানের দীর্ঘমেয়াদী তহবিলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। বিশেষত যে সকল অনুদান আফগানিস্তানের জনসাধারণের ব্যয়ের প্রায় ৭৫% ভাগের অর্থায়ন করবার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এমিলি প্রে এবং কিনসি স্পিয়ার্স প্রশ্ন তুলেছেন , " যখন আমরা আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনীর প্রস্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, নারী ও কিশোরী মেয়েদের জন্য তার অর্থ কী দাঁড়াবে? -- বিশেষত তালেবানের অধীনে তাদের জীবন কেমন ছিল সেই বিবেচনায় -- সেই দিক থেকে মেয়েদের প্রতি যর্থার্থই মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আফগান সমাজে শিশু-কিশোরদের গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি ভুলে গিয়ে এবং তালেবানরা নিজস্ব ইসলামী আদর্শ এবং ধর্মীয় নৈতিক অবস্থানের যে গল্প তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে সেই সবের উপেক্ষা মার্কিন নীতিনির্ধারকরা চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ ঘাটতি। এই ঘাটতিটাই মার্কিনদের চলে যাবার পর আফগানিস্তানের লড়াইয়ের অনুঘটক হিশাবে কাজ করবে” ( দেখুন, “What About the Boys: A Gendered Analysis of the U.S. Withdrawal and Bacha Bazi in Afghanistan”)।
তালেবানরা কঠোর ভাবে বাচ্চাবাজি বা শিশুদের যৌন নির্যাতনের বিরোধী। সেটা তারা করতে পেরেছে ‘শরিয়া’ কায়েম বা শরিয়ায় সমাকামিতা নিষিদ্ধ করার বিধান বাস্তবায়িত করে। তালেবানদের গণসমর্থনের একটা প্রধান ভিত্তি হচ্ছে বাচ্চাবাজি কঠোর ভাবে বন্ধ করা। মার্কিন নীতি নির্ধারকরা সেটা সম্প্রতি আবিষ্কার করতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন প্রতিবেদনে সেটা পরিষ্কার। ইসলাম সমকামিতা বরদাশত করে না। তাছাড়া সাধারণ ভাবে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন ঘোর মানবতাবিরোধী কাজ। কিন্তু পাশ্চাত্য বিশ বছর ধরে আফগান যুদ্ধে এই মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দিয়ে গিয়েছে, অথচ অন্যদিকে নারী অধিকার নিয়ে তালেবান ও ইসলামের বিরুদ্ধে দুনিয়াব্যাপী প্রবল প্রপাগাণ্ডা জারি রেখেছে।
আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে, ‘শরিয়া’কে আমরা যেভাবে দেশকালপাত্র বিযুক্ত ‘আইন’ হিশাবে দেখি, সেভাবে দেখার মধ্যে মারাত্মক গলদ আছে। আফগানিস্তানের বাস্তবতায় ‘শরিয়া’র ভূমিকা ছিল ইতিবাচক। মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ‘শরিয়া’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আফগানিস্তানের জনগণের হানাদারী ও দখলদারির বিরুদ্ধে যুদ্ধে শরিয়া সম্পর্কে তালেবানদের ব্যাখ্যা, অবস্থান এবং শরিয়া বাস্তবায়নের ধরণ পুরা যুদ্ধের জয়-পরাজয় বিচারের জন্য জরুরী। এ নিয়ে আলাদা ভাবে দীর্ঘ আলোচনার দরকার আছে। এ ব্যাপারে Foreign Policy জর্নলের একটি প্রতিবিদনের উদ্বেগ প্রণিধানযোগ্য। প্রতিবেদনটি যথার্থই দাবি করেছে “আফগানিস্তানের এই অবমাননাকর এবং ক্ষতিকারক শিশুদের যৌন নির্যাতন (pedophilia) বিশ্বের মানবাধিকারের সবচেয়ে ভয়াবহ লংঘনের একটি। বয়স্ক পুরুষদের সাথে যৌন সম্পর্কের জন্য প্রস্তুত কিশোর -কিশোরীদের তাদের পরিবার থেকে কিনে নেওয়া হয় - অথবা, কিছু ক্ষেত্রে, অপহরণ করা হয় - এবং তাদের এমন এক জগতে ঠেলে দেওয়া হয় যা তাদের পুরুষত্বের পরিচয় ছিনিয়ে নেয়। এই ছেলেদের প্রায়ই মেয়েদের পোশাক পরানো হয়, মেকআপ করা হয়, এবং পুরুষদের দলের জন্য নাচ করানো হয়। তারা অনেক বয়স্ক সুইটারের সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হবে বলে ধরে নেওয়া হয়। তারা প্রায়শই দীর্ঘ সময় ধরে পুরুষ বা কোন গোষ্ঠীর যৌনদাসত্বের অধীনস্থ থাকে”। (Bacha Bazi: An Afghan Tragedy, by Chris Mondloch, Foreign Policy, October 28, 2013)।
ফরেন পলিসিও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে ২০০১ সালে তালেবানদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত এবং দুই দশক ধরে যুদ্ধ আফগানিস্তানে ‘বাচ্চাবাজি’কে পাশ্চাত্য ভয়াবহ মানবাধিকার লংঘনের বিকট অপরাধে পর্যবসিত করেছে। কিন্তু এরাই যখন আবার মানবাধিকার – বিশেষ ভাবে ‘নারী’ অধিকারের কথা বলে তখন তা প্রকট তামাশা মনে হয়। পাশ্চাত্যের ‘লিবারেল’ বা ‘অধিকারবাদী’ ধারণা মোকাবিলা করতে হলে ইসলামকে অবশ্যই নারীর প্রশ্ন মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু সেটা ভিন্ন তর্ক। এখানে আমরা সেই আলোচনায় প্রবেশ করি নি। আগে মানবাধিকার নিয়ে পাশ্চাত্যের কপট দরদ ও স্ববিরোধিতা আমাদের বুঝতে হবে।
বাচ্চাবাজির প্রতি তালেবানদের অবস্থা স্পষ্ট। যখন তারা কঠোর ভাবে দেশব্যাপী শরিয়া আইন প্রণয়ন করেছিল, তখন বাচ্চাবাজিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে তালেবানদের জনপ্রিয়তার এটা একটা বড় কারন। ২০০২ সালে লন্ডনের হলমার্ক টাইমস প্রবন্ধ "কান্দাহার কামস আউট অফ দ্য ক্লোসেট" সহ কিছু প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে তালেবানদের ক্ষমতায় ওঠার মূল উস্কানির মধ্যে একটি বাচ্চাবাজি বা ‘পেডোফিলিয়া’র বিরুদ্ধে তাদের প্রবল ক্ষোভ। তারা ক্ষমতায় এলে বাচ্চাবাজি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। বলা বাহুল্য তালেবানদের বিজয় একই সঙ্গে শিশুদের যৌন নির্যাতনের অবসান। পাশ্চাত্য যা প্রশ্রয় দিয়ে টিকিয়ে রেখেছিল। আশা করি নতুন বিপ্লবী আফগান সরকারের আমলে তা অচিরেই উৎখাত হবে।
গ্রন্থসূত্র
Barfield, T. ]. (2012 (Winter)). Sharia'a in Afghanistan. THE REVIEW OF FAITH & INTERNATIONAL AFFAIRS, 46-52.
Mies, M. (1986). Patriarchy and Accumulation on a World Scale. New Jersey: Zed Books Ltd.
Sheila Rowbopthan , Stephanie Linkogle. (2001). Women Resist Globalization" Mobilizing for Livelihood and Rights. London: Zed Books Ltd.
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১। শ্যামলী।