ভাসানী ও প্রচলিত ইসলামপন্থা


আরেকটি প্রশ্ন: বাংলাদেশে প্রচলিত ইসলামপন্হার রাজনীতির সাথে ভাসানীর পার্থক্য ও গুরুত্ব কোথায়? ('ভাসানীঃ বৈপ্লবিক চিন্তার পুনর্গঠন' দেখুন)

প্রচলিত ইসলামপন্থার অনেক ধারা। তাই তাদের রাজনীতিকে সামগ্রিক ভাবে ধরে ধরে ভাসানীর সঙ্গে তুলনা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে সাধারণ ভাবে একটা কথা বলা যায়। যে সকল আলেম মওলানা মুফতি সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানায় বিশ্বাস করেন, কিম্বা সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থাকে সমাজ গঠনের ভিত্তি মানেন, মাওলানা ভাসানী তাদের ঘো্র বিরোধী। ভাসানী দাবি করেন এরাই বাংলাদেশের মজলুম শোষিত জনগণের প্রধান দুষমন। কারন এরা মুখে বলে সব কিছুর মালিক আল্লাহ, অথচ এরাই দুনিয়াবি মালিকানার প্রতি লোভী, তাই ইসলামের নাম নেবার আগে এদের উচিত সবার আগে সম্পত্তির ব্যাক্তিগত মালিক হবার লোভ ত্যাগ করা। কিন্তু এরা উল্টাটা করে। সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে নিজেরা ধনি ও শোষক হতে চায়। আল্লার মালিকানা অস্বীকার করে তারা নিজেরাই দুনিয়ার মালিক বনে যেতে চায়। আরও অনেক পার্থক্য আছে। তবে প্রচলিত ইসলামপন্থার সঙ্গে এখানে ভাসানীর বিরোধ পরিষ্কার।

সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানায় বিশ্বাসী প্রচলিত ইসলামপন্থার আলেম ওলেমা মুফতি সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা মানেন, কিন্তু আল্লার 'মালিকানা' মানেন না, তাই কার্যত ইসলাম থেকে এরা নিজেদের খারিজ করে ফেলেছে্ন। সে কারনে ইসলামের প্রধান দুষমন হিশাবে এক শ্রেণীর আলেম মওলানা মুফতি ধর্মবেত্তাকে ভাসানী বাংলাদেশের মজলুম জনগণের শত্রু গণ্য করেছেন। তারা আল্লার মালিকানার বিপরীতে ব্যক্তি মালিকানা প্রতিস্থাপিত করেন। সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার মানে আল্লার সার্বভৌমত্বের ধারণাকেও অস্বীকার ও চ্যালেঞ্জ করা। ইসলাম এটা বরদাশত করতে পারে না। কিন্তু তারপরও এই বিষয়টি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ আভ্যন্তরীণ তর্ক হয়ে রয়েছে। কারন ধনি গরিবের দ্বন্দ্ব মুসলমানদের মধ্যেও ছিল এবং আছে।

আল্লাহ একদিকে মানুষকে তাঁর 'খলিফা' হিশাবে দুনিয়ায় পাঠিয়ে তাঁর সৃষ্টি সুরক্ষার দায়িত্ব দিয়েছেন আবার ব্যক্তিকে সীমা ও মিতাচারের মধ্যে 'ভোগ'-এর অধিকারও দিয়েছেন, তাই 'মালিকানা' এবং 'ভোগ'- অর্থাৎ সম্পত্তিতে অধিকারের পার্থক্য ইসলামে খুবই মৌলিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ ফারাক। কোন জীবকে তার 'হক' থেকে অর্থাৎ জীবন নির্বাহ করবার ধর্মীয় ও নৈতিক অধিকার থেকে কখনই বঞ্চিত করা যায় না। তাই কোন ব্যক্তিকে তার জীবন প্রতিপালন ও জীবিকা থেকে কখনই বঞ্চিত করা যায় না। এই অধিকার অলংঘনীয়। সে কারনে বলা হয় হায়াত ও মওতের মতো রিজিকও আল্লার হাতে।

রিজিক বা জীবিকাকে আল্লার হাতে সোপর্দ করে কারো রিজিক হরণ করবার অধিকার ইসলাম রাজা কিম্বা রাষ্ট্র বা কারো হাতেই দেয় না। এই অর্থেও ইসলামে আল্লা সার্বভৌম। খ্রিস্টিয় সার্বভৌমত্বের ধারনা ইসলাম নাকচ করে। অর্থাৎ পাশ্চাত্যে ঐতিহাসিক ভাবে আল্লার সার্বভৌমত্ব গির্জায় এবং গির্জার সার্বভৌমত্ব আধুনিক রাষ্ট্রে যেভাবে ধারাবাহিক চলে এসেছে, সেই ধারাবাহিকতা বহন করবার কোন অনুমান, ধারণা বা দায় ইসলামে নাই। ভাসানীর রবুবিয়াত হচ্ছে শাসনবাদের বিপরীতে পালনবাদের ধারণা । এই ধারণা ইসলাম থেকেই এসেছে যে ইসলামে আল্লার সার্বভৌমত্বের বিপরীতে কোন কেন্দ্রীয় ক্ষমতাসম্পন্ন সার্বভৌম রাষ্ট্রের ধারণা নাই। কোন ভ্যাটিকান বা কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম নাই যার কথা শুনতে সবাই বাধ্য। ইসলামকে তাই আলাদা করে গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের কথা বলতে হয় না। ক্ষমতা গণমানুষের, যারা ধর্ম প্রাণ, ন্যায়নীতিতে বিশ্বাসী, তারা পরস্পরের রিজিক হরণ করে না, প্রাণ প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করা দূরে থাকুক প্রকৃতির সুরক্ষা যাদের ঈমানী কর্তব্য ইত্যাদি -- এখানেই ইসলাম জীবন্ত হয়ে ওঠে। ঢাকা শহরের এক ব্যাক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রেখে 'ক্ষমতার মালিক জনগণ' বলবার তামাশা ইসলাম করে না। এই ব্যবস্থা উৎখাত করে গণমানুষের খেলাফত -- অর্থাৎ আল্লার খলিফা হিশাবে রুহানি জীবন যাপন ব্যবস্থা কায়েম -- ভাসানী এই ইসলামের কথাই বলেছেন। ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতার ফলে বেকুবেরা নানা কথা বলে থাকে।

ইসলামে তাহলে রিজিকের দিকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আল্লার সার্বভৌমত্বের ধারণার সঙ্গে যা যুক্ত, যেখান থেকে রবুবিয়াত বা শাসনবাদের বিপরীতে পালনবাদের ধারণা ভাসানী নির্মান করতে চেয়েছেন। অতএব রিজিকের অধিকার ও নিশ্চয়তা দেবার লক্ষ্যে সম্পত্তির 'অধিকার' ইসলাম মানে, কিন্তু সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত 'মালিকানা' মানে না। কারণ সমাজের সম্পদ ভোগের অধিকার সকলের আছে, সম্পত্তিতে ব্যাক্তগত মালিকানা ব্যবস্থা থাকলে অল্পকিছু ধনী এবং নিরানব্বই ভাগ মানুষ গরিব ও সর্বহারায় পরিণত হবে। অন্যদিকে এক শ্রেণীর কমিউনিস্টদের সম্পত্তিতে সাধারণ ভাবে ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদের দাবিও ইসলাম বরদাশত করে না। কারন এই দাবির দ্বারা তারা আসলে সম্পদ ও সম্পত্তিতে ব্যক্তির অধিকারও হরণ করতে চায়।

সারকথা হচ্ছে, আবাব্রও বলি, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ইসলাম মানে। কিন্তু সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার পক্ষে দাঁড়িয়ে আল্লার সার্বভৌম মালিকানা বা আল্লার সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করা ইসলাম বরদাশত করতে পারে না। এই ফারাক বোঝা গুরুত্বপূর্ণ, বলাবাহুল্য, সম্পদ ও সম্পত্তিতে 'অধিকার' (হক) আর সম্পত্তিতে মালিকনা ইসলামে সমার্থক নয়।

এক শ্রেণীর কমিউনিস্টের সমাজতন্ত্রের নামে মানুষের সম্পত্তির অধিকার হরণ ইসলাম বরদাশত না করার যুক্তি আল্লার সার্বভৌমত্বের ধারণা থেকে আসে। অন্যদিকে আল্লা কাউকে রেজিস্ট্রি করে জমির স্বত্ব লিখে দেন নাই। আবুল আলা মওদুদীর সঙ্গে ভাসানী তাই ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকনার প্রশ্নে একমত হবেন না। যারা আরো গভীরে যেতে চান মওদুদীর 'ভূমি মালিকানার বিধান' বইটি পড়তে পারেন।

আবারও বলি, মনে রাখতে হবে 'ব্যক্তিগত সম্পত্তি' আর 'ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থা' এক কথা না। মানুষের বাসস্থান তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি, যা মানুষ তার আবাস হিশাবে ব্যবহার করে। ইসলাম এই অধিকার বা হক কেড়ে নেবার কোন ক্ষমতা কাউকে দেয় না। যে সমাজ বস্তিপূর্ণ, ঘরহারা মানুষের হাহাকারে বিদীর্ণ। অল্প কিছু পরিবারকে ধনী তৈরি করতে গিয়ে নিরানব্বই ভাগ মানুষের রিজিক বা জীবন ও জীবিকা যে ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয় , যে দেশের মানুষ দলে দলে অন্যায় ও অত্যচারে দেশ ছেড়ে দেশান্তরী হয়, রিজিক থেকে বঞ্চিত সেই সমাজ কখনই ইসলামের দাবিদার হতে পারে না।

জমি কৃষকের ব্যক্তিগত সম্পত্তি, তেমনি হাতিয়ার বা উৎপাদনের উপায়ও শ্রমিকের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। উৎপাদকের সঙ্গে তার উৎপাদনের উপায়ের সম্বন্ধ অলংঘনীয়। -- সম্পত্তির সঙ্গে ব্যক্তির এই সম্বন্ধ ছিন্ন করবার অধিকার ইসলাম কাউকে দেয় না। উৎপাদককে তার উৎপাদনের উপায় থেকে আলাদা করা জুলুম। রিজিক থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা, উৎপাদনের উপায়হীন সর্বহারায় পরিণত করা ইসলাম না।

নশ্বর মানুষ দুনিয়ার কোন কিছুরই 'মালিক' না। মৃত্যু তার প্রমাণ। আইনী মালিকানা বা সম্পত্তিতে ব্যাক্তিগত মালিকানার জোরে সম্পত্তির যথেচ্ছা বেচাবিক্রি, মুনাফা কামানো, উৎপাদনে কোন ভূমিকা না রেখে মালিকানার জোরে খাজনা ভোগ ইসলামে নিষিদ্ধ। যে কারণে সম্পত্তির মালিকানার জোরে জমির ভাড়া বা খাজনা ভোগ যেমন হারাম, তেমনি টাকা খাটিয়ে সুদ খাওয়াও হারা্ম। টাকা বিনিময়ের মাধ্যম, সামাজিকতার সূত্র। কিন্তু টাকাকে পুঁজি বানানো, টাকা ভাড়া খাটানো, সুদ খাওয়া ইত্যাদি ইসলামে হারাম।

রিজিক অর্জনকে সামাজিক উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত করে সাজাতে হবে যেন পুরা সমাজের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন নিশ্চিত করা যায়।

সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার তর্ক তাই ভাসানীর কাছে ইসলামের গোড়ার তর্ক। কারণ এই তর্ক সমাজ গঠনের এবং সামাজিক সম্পর্ক রচনার গোড়ার বিষয়। হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব। এই তর্কের মীমাংসা ছাড়া 'ইসলাম মানুষের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান' -- স্রেফ কথার কথা। হাওয়াই আওয়াজ। এর কোন সামাজিক-ঐতিহাসিক অর্থ দাঁড়ায় না।

বলা বাহুল্য, সম্পত্তির এই সকল তর্ক ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ আভ্যন্তরীণ তর্কবিতর্কের সিলসিলার সঙ্গে যুক্ত। যারা মোটা দাগে ভাসানীর সঙ্গে আলেম-ওলেমাদের কিম্বা ভাসানীর আদর্শের সঙ্গে ইসলামপন্থার পার্থক্য জানতে চান তাদের এ বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাতের জন্য কথাগুলো আপাতত জানিয়ে রাখছি। কেন ভোগী আলেম সমাজ এবং পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের অধীন মওলানা মুফতি মৌলবিগণ ভাসানীকে অপছন্দ করেন সেটা ভাসানীর এই অবস্থান দ্বারা বোঝা যায়।

একই যুক্তিতে ভাসানী একশ্রেণীর কমিউনিস্টদেরকেও জনগণের দুষমন গণ্য করেন। কারন বাংলাদেশে তারাও মালিকানার নামে জনগণের সম্পদ হরণ করা তত্ত্ব ফেরি করে বেড়ায়। রাষ্ট্রের নামে তা ভোগ করতে তারাও আগ্রহী। বিশেষত সেইসব কমিউনিস্ট, যারা তত্ত্বে ব্যক্তিগত মালিকানার বিরোধিতা করে, কিন্তু কাজেকর্মে ও ব্যক্তিগত জীবনে তা বিশ্বাস কিম্বা চর্চা করে না, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানার নামে জনগণের সম্পদ হরণ করতে তারা আগ্রহী। জনগণের ওপর পার্টীর ক্ষমতা চর্চা করে তারা ধনী হতে চায়।

এই দুই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইকে ভাসানী তাঁর রাজনীতির মূল জায়গা মনে করতেন। তাই গরিব মজলুমদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের তিনি ততোটুকুই কাছে রেখেছিলেন যতটুকু মজলুমের জিহাদ ও অধিকার আদায়ে দরকার ছিল। কিন্তু তাদের রাষ্ট্রতত্ত্বে তিনি কখনই বিশ্বাসী ছিলেন না। যে কারণে শেষ বয়সে 'হুকুমতে রাব্বানি'র ধারণা পেশ করেছেন।

ভাসানী তাই আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্পত্তির মালিকানার প্রশ্নে মার্কসকে তিনি পুরাপুরি বুঝেছেন বলা যাবে না, সেটা ভিন্ন তর্ক। সেটা করা যাবে। কিন্তু তারপরও ব্যবহারিক রাজনৈতিক চর্চায় বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা নয়, বরং মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী মার্কস, লেনিন ও মাওয়ের চিন্তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাই তাঁকে মার্কস, লেনিন ও মাওয়ের আলোকে পড়তে ও বুঝতে হবে। তবে বলা বাহুল্য, সেই ক্ষেত্রেও ভাসানী বাড়তি চ্যালেঞ্জ হয়ে আছেন। কারন ইসলাম না জানলে, ইসলামের ইতিহাস না বুঝলে ভাসানীকে পাশ্চাত্য, রুশ বা চিনা বিপ্লবি তত্ত্ব দ্বারা কিছুই বোঝা যাবে না।

সার কথা হচ্ছে ইসলাম প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বাংলাদেশে বিপ্লবের চিন্তা অবাস্তব, এটা ভাসানীর কাছ থেকে যেমন বোঝা দরকার, ভাসানীর সফলতা ও ব্যর্থতা থেকে আগামি দিনে বৈপ্লবিক রাজনৈতিক পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে গোড়ার সূত্রগুলোও সহজে ধরা ও উপলব্ধি করা জরুরি। ইসলামের প্রচলিত ন্যারেটিভের সঙ্গে তার মিল ও অমিল চিহ্নিত করাও জরুরী কাজ। এটাই আমাদের দাবি।

ভাসানী বৈপ্লবিক চিন্তার নতুন ফেনোমেনা -- সেভাবেই তাঁকে বুঝতে হবে। কোন খোপে ফেলে বোঝা যাবে না। বিপ্লব, সমাজ ও সামাজিক প্রতিপালন সম্পর্কে এবং প্রতিপালনের নীতি অনুসরণ করে সমাজ গঠনের গোড়ার কিছু তর্ক তিনি তুলেছেন যা আমাদের আগামি দিনে দিশা দেবে।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।