র‍্যাব ও আমাদের অসুখ


‘র‌্যাব’ হচ্ছে ইংরেজি 'র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন' কথাটির সংক্ষিপ্ত রূপ। এর বাংলা করলে দাঁড়ায় জলদি কাম খতম করার সংঘ। ব্যাটালিয়ন কথাটা সামরিক। ‘সামরিক’ কথাটি বাংলা ‘সমর’ বা যুদ্ধ থেকে তৈরি। অর্থাৎ যা যুদ্ধ সম্পকির্ত। র‌্যাব সেই দিক থেকে যুদ্ধ সম্পর্কিত ধারণা বলা যায়। রাষ্ট্রের এই ধরণের সশস্ত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনে অনুমান হচ্ছে সমাজে এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে যার সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতি তুলনীয়। প্রথাগত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা সম্ভব নয়। অতএব র‌্যাপিড একশান ব্যাটেলিয়ন দরকার।

কিন্তু যুদ্ধ তো আমরা করি শত্রুর বিরুদ্ধে। দুষমনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য। যদি একটি জনগোষ্ঠি মনে করে তারা শত্রুর দ্বারা আত্রুান্ত, তখন নিজেকে রক্ষার জন্য তার যুদ্ধ ন্যায্য। ন্যায্য যুদ্ধের বাইরে অন্যায় যুদ্ধ আছে। হানাদার বা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো তা আমাদের চোখের সামনেই অন্যায় যুদ্ধ করে এবং করছে। এ মুহূর্তে, এ লেখা যখন লিখছি, জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ার যুদ্ধ করছেন ইরাকি জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে। তাহলে নিজেকে রক্ষা বা অন্যের ওপর প্রভূত্ব কায়েমের জন্য যুদ্ধ একটি বাস্তবতা। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধও ন্যায়সঙ্গত।

দেশের অভ্যন্তরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দরকার পুলিশ যার কাজ শত্রুর নিধন নয়, সংবিধান ও আইনের মধ্যে থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা। পুলিশ এই কাজটি সাধারণত করে জনগণের মধ্যে থেকে। বিপরীতে সামরিক বাহিনীকে জনগণ থেকে দুরে রাখাই দস্তুর। ফলে পুলিশের চরিত্র আর সামরিক বাহিনীর চরিত্র এক নয়; আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্ভবের বিচার করলে দেখা যায়, এই দুটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উদয় ও বেড়ে ওঠার ইতিহাসও আলাদা। যদিও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সমাজের ওপরে বসে সমাজেরই ওপর বল প্রয়োগের ক্ষমতা ও কাঠামো গড়ে ওঠার ইতিহাস দিয়েই উভয়কে বোঝা দরকার। সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের সঙ্গে বল প্রয়োগের এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পর্ক এবং সামগ্রিকভাবে শাসক শ্রেণীর হাতে কেন্দ্রীভুত রাষ্ট্রের এই একচ্ছত্র বল প্রয়োগের ক্ষমতার চরিত্র ও ব্যবহার দেখে একটি রাষ্ট্রকে যেমন চেনা যায়, তার শাসক শ্রেণীর চরিত্রও বোঝা যায়। যেমন,  তারা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের হুকুমে চলে,  নাকি তারা সংবিধান ও আইনের অধীনস্থ; তারা কোনো স্বাধীন বিভাগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কিনা কিম্বা সংবিধান ও আইনের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য কিনা, ইত্যাদি।

খুবই সাধারণভাবে বুঝলেও নাগরিকরা বোঝেন যে, সামরিক বাহিনীর কাজ হচ্ছে বাইরের শত্রুর আত্রুমণ বা হামলা থেকে জনগোষ্ঠির সুরক্ষা। আর পুলিশের কাজ হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা। উভয়ের উদ্দেশ্য যেমন ভিন্ন, তাদের চরিত্রও আলাদা। এখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দায়িত্ব পাওয়া বাহিনী থাকা সত্ত্বেও তার বিপরীতে জলদি কাম খতম করার ব্যাটালিয়ন বা বাহিনী বানানোর চিন্তা এবং বাংলাদেশে তার বাস্তবায়ন কিভাবে আমরা বিচার করব?

এ জাতীয় বাহিনী নতুন কোনো ব্যাপার নয়। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সংবিধান ও আইনের মধ্যে চলার কথা বলে, কিন্তু আসলে ক্ষমতায় থাকা না থাকার বিষয়টা স্থির হয় বল প্রয়োগের ক্ষমতা দিয়েই। সেই কারণে সাংবিধানিকভাবে পুলিশ ও আইনের ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট থাকার পরও ক্ষমতাসীন শাসক ও শোষক শ্রেণীকে বারবারই বল প্রয়োগের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংবিধান ও আইনের বাইরে প্রয়োগ করতে দেখা যায়; যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে সংবিধান ও আইনের বাইরে রাখা যায় এমন সশস্ত্র প্রতিষ্ঠান তাকে গড়তেই হয়। নিজ শ্রেণীর বা নিজ দলের ক্ষমতা সুরক্ষিত রাখা নইলে সম্ভব নয়। একদিকে সংবিধান, আইন বা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির কেচ্ছা আর তার বিপরীতে নিজের একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ ও প্রয়োগের চর্চা- এই দুই টানাপোড়েনের মধ্যেই এ জাতীয় বাহিনীর উদয় ঘটে।

ইংরেজিতে এই ধরনের বল প্রয়োগের হাতিয়ারকে Paramilitary Force বলা হয়। সীমান্তে নজরদারি রাখা বা দেশ রক্ষার জন্য স্থায়ী সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত বাহিনীও Paramilitary Force। সেটা আক্ষরিক অর্থে। তারা প্রথাগত সেনাবাহিনীরই অংশ, শুধু কর্মবিভাগ ভিন্ন। কিন্তু রক্ষীবাহিনী বা র‍্যাব ধরনের যে প্যারামিলিটারি ফোর্সের কথা আমরা বলছি তার চরিত্র আলাদা । সেনাবাহিনী, পুলিশ, আমলা, বিচার বিভাগ ইত্যাদি প্রথাগত বল প্রয়োগের হাতিয়ারের বাইরে র‍্যাব জাতীয় ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী গড়ে তোলার বিভিন্ন কারনের মধ্যে প্রধান দুটি কারণ হচ্ছে: ১. একটি দেশের অভ্যন্তরে জাতিগত নিপীড়ন বৃদ্ধি এবং ২. পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফলে একটি দেশে ধনী ও গরিবের ব্যবধান মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়া। যার ফলে শাসনব্যবস্থা ক্ষয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। অন্যদিকে শাসক শ্রেণীর সঙ্গে পাতিবুর্জোয়া শ্রেণীর একটা দুরত্বও তৈরি হতে থাকে। যারা শ্রমিক বা কৃষকের মতো উৎপাদক নয়, আবার পুঁজির মালিকও নয়, তাদেরকেই পাতিবুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত ইত্যাদি পরিভাষায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান শনাক্ত করে। এই শ্রেণী সমাজের ভাঙন, সন্ত্রাস, হত্যা, গুম-খুন, বোমাবাজি, গ্রেনেডবাজি ইত্যাদির আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কারণ বুঝতে সাধারণত অক্ষম থাকে, কিংবা বুঝতে চায় না। সমস্যার সরলীকরণের প্রতিই তাদের আগ্রহ বেশি থাকে। প্রতিদিনের পুঁজিবাদী সমাজে প্রতিযোগিতার মুখে সে সর্বহারায় পরিণত হওয়ার চাপের মধ্যে খাবি খায়। ফলে সমাজের সংকটের প্রতি তার মুল্যায়ন ও সমাধান দেয়ায় পদ্ধতিও এই আতঙ্ক থেকেই তৈরি হয়। এই শ্রেণীর মধ্যে তখন এ ধরনের ধারনা দানা বাঁধে যে, সন্ত্রাসীকে ধরে দল বেঁধে পিটিয়ে মেরে ফেললেই দেশে সন্ত্রাস কমবে কিংবা র‌্যাব জাতীয় কোনো ট্রিগারহ্যাপি সংস্থা দিয়ে কুকুর-বেড়ালের মতো সন্ত্রাসীদের গুলি করে সাফ করলেই সমাজ সন্ত্রাসমুক্ত হয়ে যাবে। বিপ্লবী রাজনীতি ও আর্দশের ঘাটতির কারনে সমাজে এ ধরণের চিন্তা- ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে। তখন পাতিবুর্জোয়া আতংক বল প্রয়োগের শক্তির কাছে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চায়। এর ফলে যে বিশেষ ধরণের রাষ্ট্রীয় রূপ জনগণ সমর্থন করতে শুরু করে তাকে অনেক সময় ফ্যাসিবাদ বলা হয়। ছিনতাইকারী বা ডাকাত সন্দেহে কাউকে ধরে পিটিয়ে মারা আর র‌্যাবের ক্রসফায়ারে সন্ত্রাসী মারা একই মুদ্রার এই পিঠ আর ওই পিঠ।

ইতিহাসে দেখা যায়, দমন- পীড়নের প্রয়োজন থাকলেও আলাদাভাবে প্যারামিলিটারি ফোর্স গঠন করার প্রয়োজন পড়ে না। ক্ষমতাসীন শাসক ও শোষক শ্রেণী প্রয়োজনে অভ্যন্তরীণ দমন-পীড়নের জন্য তো খোদ সেনাবাহিনী বা বিশেষভাবে সশস্ত্র সেনাবাহিনীকেই কাজে লাগায়। লাগাতে পারে। পাকিস্তান আমলে তো আমরা তাই দেখেছি। কিন্তু র‌্যাবের মতো প্যারামিলিটারি ফোর্সের দরকার হয় কেন তাদের? সশস্ত্র সেনাবাহিনী দিয়ে দমনপীড়ন এখনও আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির যোগসাজশে ঘটে; কিন্তু আগের মতো অতটা দৃশ্যমান বা ব্যাপকভাবে নয়। কিন্তু পাকিস্তানের শাসক তো এখনো সেনাবাহিনীই আছে।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় তৃতীয় বিশ্বের সেনাবাহিনীর ওপর ভর করেই মার্কিন হানাদার পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়ন হয়েছিল। মার্কিন দেশেই সবচেয়ে নিষ্ঠুর জেনারেলদের প্রশিক্ষণ হয়ে থাকে এবং এখনো সেই রেওয়াজ আছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পুলিশ একাডেমি বা যাকে অন্তর্ঘাতমুলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য সিআইএর খুনি এজেন্ট বানানোর ‘কারখানা’ বলা হয় সেই ধরনের ‘কারখানা’ এখনো চালু আছে। লক্ষ্যে বদল না ঘটলেও তাদের উপযোগিতার মাত্রায় বদল ঘটেছে। পুঁজির পরিধির দেশগুলোকে শোষণ করার জন্য এখন বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মতো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান আছে। তবে আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের শৃঙ্খল যেখানে কার্যকর, সেখানে পুরনো পন্থায় সরাসরি ক্ষমতায় বসানোর প্রয়োজনীয়তা আর আগের মতো নাই। এ পরিপ্রেক্ষিতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রধান দুটো হাতিয়ার হয়ে উঠেছে আমলা এবং অর্থ মন্ত্রণালয়, সেনাবাহিনী নয়।

এ দিকটা আমি তুলছি এ কারণে যে, নাগরিকদের দিক থেকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন ব্যাপারটাকে বিচার করার দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে সে দিকটা পরিচ্ছন্ন করা দরকারে। বল প্রয়োগের জন্য শাসন শ্রেণীর রাষ্ট্রীয় সব সংস্থাই গরিব ও খেটে- খাওয়া মানুষের দুশমন। সত্যি বলতে কি আমাদের আমলাতন্ত্র দেশ ও দশের যে ক্ষতি করতে পারে আর আমাদের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দাসানুদাস বহু আমলা যত সহজে দেশকে বিক্রি করে দিতে সক্ষম তার তুলনায় অধিক ক্ষতিকর কিছুই হতে পারে না। যদি তাই হয়, তাহলে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিনের প্রয়োজন হলো কেন বাংলাদেশে? এটা কি বিএনপির নতুন রক্ষীবাহিনী? এমন একটি বাহিনী যাকে তারা ক্ষমতায় থেকে ব্যবহার করতে পারবে? কিন্তু অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমার অনুমান র‌্যাব ব্যবহৃত হবে বহুজাতিক কয়েকটি কোম্পানি এবং বাংলাদেশের তাদের সঙ্গে যারা একটা সাময়িক আঁতাত করছে তাদের প্রাইভেট বাহিনী হিসেবে। অন্যান্য দেশে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো হিসাব করে দেখেছে যে, পিচ্চি হান্নানের মতো সন্ত্রাসী পোষার চেয়ে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়া সংঘবদ্ধ প্রাইভেট আর্মি রাখাই অধিক বুদ্ধিমানের কাজ। অস্ত্র চোরাচালান, ড্রাগ স্মাগলিং বা অন্যান্য উপায়ে যে টাকাটা আয় হয়। তা দিয়েই একটি বিশাল বাহিনী পোষা যায় সেই টাকার ভাগ তাহলে পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর, সুব্রত বাইনদের দেয়া কী দরকার? আর বাংলাদেশের মতো একটা দেশে এই রকম মাথাভারি সেনাবাহিনী আর পুলিশ পোষারও দরকার কী? র‌্যাব জাতীয় একটা আধা আর্মি আধা পুলিশ থাকলেই যথেষ্ট।

র‌্যাবে অনেক ভালো মানুষ আছেন। এখানে কথাগুলো ব্যক্তি হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে নয়। বাস্তবতার বাইরে আলাদা করে ‘ভালোমানুষি’ ভিন্ন তর্কের বিষয়। তারা নিংসন্দেহে দেশ সন্ত্রাসমুক্ত হোক এটা চান, কিন্তু সন্ত্রাস দিয়ে সন্ত্রাসের হাত থেকে মুক্তি ঘটা অসম্ভব এটা বুঝতে পারেন না। আমি আলোচনা করছি পুঁজির স্বভাব এবং তার রাজনীতি নিয়ে। অন্যান্য দেশে এ ধরনের প্যারামিলিটারি ফোর্সের ভূমিকার ক্ষেত্রেও তো আমরা এটাই দেখেছি; কিন্তু র্যা বকেও বুঝতে হবে সন্ত্রাসীদের ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করলেই সমাজ সন্ত্রাসমুক্ত হয় না।

তাহলে কী র‌্যাব রতন টাটার মতো বিনিয়োগকারীদের রক্ষা করার জন্যই আসলে তৈরি হয়েছে? সম্পরতি টাটা বাংলাদেশে বিনিয়োগের বাসনা ব্যক্ত করেছে। আইন-শৃঙ্খলার নিশ্চয়তা না পেলে বা সন্ত্রাস দমিত না হলে বাংলাদেশে যে বিনিয়োগের ইচ্ছার কথা টাটা বলছে সেই বিনিয়োগ অসম্ভব। এটা তো শুধু গ্যাসের দাম পাওয়া বা না পাওয়া নয় গ্যাস লুট করার ‘বিনিয়োগ’ প্রস্তাব। টাটার প্রস্তাব হচ্ছে গ্যাস যদি ইন্ডিয়ায় না যায় তো বাংলাদেশেই থাকুক - এখানে এসেই টাটা তা ব্যবহার করবেন। সুন্দর।

কিন্তু বিনিয়োগ তো নিছকই অর্থনৈতিক ব্যাপার নয়, এটা রাজনৈতিকও বটে। রতন টাটার সঙ্গে আমরা ব্যবসা করব কিনা সেটা রাজনৈতিক প্রশ্ন। রাজনৈতিক প্রশ্ন বাংলাদেশে আদৌ গ্যাস অন্যের কাছে বিক্রি করবে কি করবে না সেই অর্থনৈতিক প্রশ্ন থেকে আলাদা। তারপর আছে বিদেশী বিনিয়োগ মাত্রই ভালো সেই ভুয়া প্রপাগান্ডা -- জাতিসংগের আঙ্কটাড (UNCTAD) বিদেশি বিনিয়োগ মানেই ভালো এই ধারণার বিরুদ্ধে বহু গবেষণাপত্র বহু সুপারিশমালা তৈরি করেছে: কিন্তু সেসব তর্ক আমি এখানে করার এখন ফুরসত পাব না। আমি শুধু আমার কথার পিঠে সম্ভাব্য নজির দেয়ার জন্যই রতন টাটার তথাকথিত ‘যুগান্তকারী বিনিয়োগ প্রস্তাব’ নিয়ে বাংলাদেশে যে কথাবার্তা চলছে তাকে উদাহরণ হিসাবে বললাম। ভবিষ্যৎই আমার কথার সত্যমিথায় বোঝ যাবে। র‌্যাব মূলত জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের প্রাইভেট আর্মি গড়ে তোলার প্রাথমিক পদক্ষেপ।

এর আগে শেখ হাসিনার প্রাইভেট আর্মি গড়ে তোলার প্রয়াসটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়। তিনি রতন টাটার এই বিনিয়োগ প্রস্তাবের মজা ভোগ করতে পারলেন না। তিনি তার আমলে জয়নাল হাজারীদের যেভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন সেটা ছিল ভুল চর্চা। কিন্তু আওয়ামী লীগ একবার রক্ষীবাহিনী গড়ে তুলে যে দাগা খেয়েছে সেরকম আবার র‌্যাব জাতীয় কিছু একটা করবে সেটা ছিল অসম্ভব। বিএনপি শুরু করেছিল আর্মিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে। অপারেশন ক্লিনহার্ট ছিল সে প্রক্রিয়ার অংশ। সে অপারেশন ব্যর্থ হয়নি, কিন্তু সেনাবাহিনীকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার রাজনৈতিক মুশকিল আছে। সেটা সেনাবাহিনীর সদস্যরাও চাইবেন না। বেগম খালেদা জিয়া তথাকথিত মানবাধিকার লংঘনের ভয়ে সেই পরিকল্পনা বাদ দিয়েছেন বলে আমার মনে হয় না। আর বাদ দেয়ার প্রয়োজনও ছিল ননা। বাংলাদেশের সংবিধানের মধ্যেই এ ধরনের অপারেশনে কোনো অন্যায় ঘটে থাকলে সেই অন্যায় থেকে দায় মুক্তির বিধান আছে। ফলে তিনি ভয় করেননি; কিন্তু তার দরকার প্রাইভেট আর্মি। নতুন রক্ষীবাহিনী। সেনাবাহিনীকে এতটা নিচে নামাতে খালেদা জিয়া সাহস করেননি। কিন্তু র্যানব গঠনের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যবহারের নতুন কটা পথ তিনিই খুলেছিলেন।

কিন্তু নতুন যে জাতীয়তাবাদী রক্ষীবাহিনী বিএনপি গড়ে তুলেছে সেটাই, আমার ধারণা, তার কাল হয়ে দাঁড়াবে। শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য সেটা বিষধর সাপের মতো কাজ করেছিল। সে বিষের নীল আজও আওয়ামী লীগ নিজের গা থেকে খসাতে পারেনি। অপারেশন ক্লিনহার্টের পর বিএনপির প্রাইভেট আর্মি গড়ে তোলার প্রথম পরিকল্পনা ধরা পড়ে বাংলাভাই বাহিনীর প্রতি তার রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সমর্থনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু হ্যারি কে টমাস সেখানে বাদ সাধলেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাভাই বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বলাবলি শুরু করার কারণে সেই পরিকল্পনা বাদ দিতে হলো। সেই কারণেই যে প্রাইভেট বাহিনী গড়ে তোলা হচ্ছে তার আবির্ভাব ঘটাতে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে।

শেখ মুজিবুর রহমান যখন রক্ষীবাহিনী করেছিলেন সেটাও তো রাষ্ট্রীয় বাহিনীই ছিল; কিন্তু সেটা ছিল শেখ মুজিবের নিজেরই বাহিনী। আওয়ামী লীগের বাহিনী। তার হাতে একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হবার প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন করবার জন্যই তখন তিনি এ ধরনের প্রতিভাবান পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলেন। দেশের বিনাশ যেমন তিনি ত্বরান্বিত করেছিলেন, নিজের মৃত্যুকেও কাছে ডেকে এনেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতাই ভোগ করছেন। এমন সময় তিনি এই একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা ভোগ করছেন যখন সত্যি বলতে কি তার পক্ষে জনসমর্থন নাই। বিএনপির সমর্থকরা এতে মনঃক্ষুণ্ণ হতে পারেন -- কিন্তু ২১ আগস্টের ঘটনার পর তিনি তো গ্রেনেডবাজ আর হত্যাকারীদের ধরতে পারেননি। একুশে আগস্ট একটি গুরুতর জাতীয় ঘটনা। এ ধরনের গ্রেনেডবাজি ও হত্যাকাগু সংঘটিত করে যারা রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে পঙ্গু করতে তৎপর, অথচ তাদের টিকিটাও ধরা গেল না – এই যদি অবস্থা হয় তাহলে র্যা ব দিয়ে আমরা কী করব? প্রধানমন্ত্রী কি র‌্যাবকে দিয়ে হত্যার প্রদর্শনী দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে সমর্থন আদায় করতে চান? র‌্যাবের অভিযান শুরুর চার মাসের মধ্যে ‘ক্রসফায়ারে’ ৪১ জন মানুষ খুন করা হয়েছে। তথাকথিত ‘ক্রসফায়ারে’। এভাবে রাষ্ট্র চলতে পারে না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার দলের মধ্যেই, আপনার দলীয় এমপি- মন্ত্রীদের মধ্যেও কি সন্ত্রাসী নাই? এবার তাহলে ক্রসফায়ারে তাদের দু-একজনকে মারুন, আমরা দেখি, তখন আমরা হাততালি দেব। পিচ্চি হান্নান জাতীয় সন্ত্রাসীদের, যারা আসলে বিএনপি-আওয়ামী লীগের নিছকই ভাড়াখাটা খুনি -- আজ এ দল তো কাল ওই দল -- তাদের পুলিশ হেফাজতে রেখে -- এমনকি গুলিতে আহত অবস্থায় থাকার পরেও মারা হয়েছে। এতে আপনার ভাবমুর্তি উজ্জল হয় না। যুদ্ধেও আহত শত্রুকে এভাবে নির্বিচারে হত্যা আইনি বিধিবিধান, বিবেক এবং মানবিক আচরণের বিরোধী। এমনকি ধর্মীয় নীতি নৈতিকতারও বিরোধী।

বিএনপি সন্ত্রাস দমনের কথা বলে ক্ষমতায় এসেছিল। ব্যর্থ হয়েছে। ২১ আগষ্টের পর জোট সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের চেষ্টা হয়েছে। জনগণ সেই ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করেনি। এর কারণ হলো আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ব্যর্থতা আর মার্কিন-ভারত-ইসরায়েলি অক্ষশক্তির হাতে বাংলাদেশকে তুলে দেয়ার মধ্যে যে একটা ফারাক আছে জনগণ সে পার্থক্য করতে সক্ষম হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিদেশীদের ডেকে এনে তদন্ত করার যে দাবি আওয়ামী লীগ তুলেছিল, তাতেও জনগণ সায় দেয়নি। জোট সরকারকে ক্ষমতা থেকে না সরানো আসলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আবার দেখার অনাগ্রহ ছাড়া আর অধিক কিছু নয়। এটা জোট সরকারের প্রতি সমর্থন নয়।

এফবিআই এসেছে। এফবিআই গিয়েছে। তারা তাদের কাজ সেরে নিয়েছে; কিন্তু গ্রেনেডেবাজ হত্যাকারীদের জোট সরকার ধরতে পারেনি। সরকারি তদন্ত কমিশন বলেছে বিদেশী শক্তি জড়িত। ভালো কথা কিন্তু গ্রেনেড মারল কারা? তারা এখনো ধরা পড়ল না কেন? বিদেশী শক্তি জড়িত বললে কি একটি দেশকে আমরা আমাদের আদালতে গ্রেনেড ছোঁড়া ও হত্যাকাণ্ডের জন্য বিচার করতে পারব? তাহলে যেটা পারব না সেটা সরকারিভাবে বলছি কী উদ্দেশ্য?

একারণেই আমি র‌্যাবের হত্যাকাণ্ডকে মূল জাতীয় প্রশ্ন আড়াল করার জন্য হত্যার প্রদর্শনী বলার পক্ষপাতী। এই ক্ষেত্রে বিএনপি সাময়িক সফল হবে এ অর্থে যে আমি অনেককে বলতে শুনেছি, এ ধরনের নির্বিচারে ‘ক্রসফায়ার’ করে হত্যার ফলে নাকি সন্ত্রাস কমবে। সন্ত্রাসীদের বিচার ছাড়া আইন-আদালতের তোয়াক্কা না করে খুন করার কারণে নাকি জনমনে ‘স্বস্তি’ ফিরে এসেছে! সমাজে যখন ফ্যাসিবাদী প্রবণতা প্রবল থাকে তখন এ ধরনের প্রপাগাণ্ডা মনমানসিকতারও জন্ম হয়।

কিন্তু আমরা নিদেনপক্ষে একটি রাষ্ট্র চাই যেখানে আইন আছে, আদালত আছে, বিচার আছে, শাস্তি আছে। আমরা নৈরাজ্য চাই না; কিন্তু নৈরাজ্যই তো চলছে। সন্ত্রাসী ধরে যারা কোন আইনের নিয়ম না মেনে বিচার ছাড়া ‘ক্রসফায়ারে’ মেরে বীরত্ব প্রকাশ করে ‘সন্ত্রাসী’ মারা গেছে বলে দাবি করছেন, তারা হয়তো নিজেরাই এ কর্মকাণ্ডের ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনছেন। একটি দেশের জন্য, একটি রাষ্ট্রের জন্য এর কুফল কী হতে পারে তা তারা জানেন না। তারা তা অনুমান করতেও অক্ষম। তারা যেন ধরেই নিয়েছেন, কাউকে সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত করলে এবং তাদের সফটওয়্যার ‘থার্ড আই’ দিয়ে ডাটাবেজ বানালে সে লোকটিকে বিচার ছাড়া গুলি করে মেরে ফেলা যায়।

মানুষের বিবেকের সুবিধা হচ্ছে এই যে, যার মধ্যে বিবেক আছে বিবেক তাকে ছেড়ে যায় না; উভয়ের বিচ্ছেদ ঘটে না। কিন্তু বন্দুকের অসুবিধা হচ্ছে তার হাত বদল আছে। আজ যিনি ট্রিগার হ্যাপি, কাল তিনিই ট্রিগারের শিকার হতে পারেন। বন্দুকের এ বিচিত্র স্বভাব যারা জানেন তারা বন্দুক দিয়ে নিজের ক্ষমতাকে পোক্ত করার কথা বলেন না, নীতি নৈতিকতা বিবেক চর্চার মধ্য দিয়েই নিজেদের নায্যতা সমাজে প্রতিষ্ঠা করেন।

আমি মনে করি না নির্বিচার হত্যাকাণ্ড সন্ত্রাস দমনের পথ হতে পারে। সন্ত্রাসের বিস্তৃতির এবং বাংলাদেশের সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার আর্থসামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণ আছে। সে কারণগুলো শনাক্ত করা এবং তার মীমাংসার জন্য উপযুক্ত নীতি দরকার। ‘সন্ত্রাস’ কোনোমতেই একটি ক্রিমিনাল ইস্যু নয় যা শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ র্যা বের মতো সংস্থার ব্যাপার। সন্ত্রাসের প্রশ্নে আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক নীতি আগে, তারপর আসে অপরাধী ধরা, বিচার করা অথবা অপরাধ প্রতিরোধ বা দমনের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিধিবদ্ধ ভূমিকা নিশ্চিত করা।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন সেনাবাহিনীও নয়, পুলিশও নয়। দুটোকে মিশিয়েই এই বাহিনী করা হয়েছে। র‌্যাবের বিপক্ষে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামীপন্থীদের সমালোচনা আমরা পত্রপত্রিকায় পড়েছি। তারা বলেছে, র‌্যাব বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানোর জন্য তৈরি হয়েছে। অথচ র্যা বের হাতে যারা ধরা পড়েছে বা মারা যাচ্ছে তাদের অনেকে সরাসরি বিএনপির সঙ্গেও যুক্ত। আর আওয়ামী লীগ যদি আসলে কথাটা মন থেকেই বলে থাকে তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি আওয়ামী লীগের কমীদের মধ্যে প্রায় সকলেই সন্ত্রাসী বা বাংলাদেশের শীর্ষ খুনি বা হত্যাকারী। আওয়ামী লীগের স্বীকারোক্তি সেদিক থেকে অত খারাপ না। আমরা মেনে নেব, কথাটা সত্য। তবে আওয়ামী লীগ যে কথাটা বলেনি বা বলতে চাইলেও বলতে পারবে না সেটা হচ্ছে জলদি কাম খতম করার বাহিনীটি আসলে রক্ষীবাহিনীরই নতুন সংস্করণ।

রক্ষীবাহিনী হয়েছিল প্রধানত তিনটি উদ্দেশ্যে।

এক. বাংলাদেশের বিপ্লবী রাজনীতির নেতাকর্মীদের হত্যা এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সমূহ সম্ভাবনা নস্যাৎ করা।

দুই. মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে যে সামরিক বাহিনী গড়ে উঠেছিল এবং কাজে কাজেই একটা গণমুখী সেনাবাহিনী গড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা এবং রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল তাকেও ধ্বংস করা। রক্ষীবাহিনী তৈরি হয়েছিল সেনাবাহিনীর বিপরীতে এক হিসাবে সেনাবাহিনীরই বিরুদ্ধে।

তিন. একটা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও শক্তির বিকাশ নিশ্চিত করা যার নির্বাহী ক্ষমতার চরিত্র হবে একনায়কী। শেখ মুজিবুর রহমান সেই একনায়কী ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন আমলাদের দিয়ে। এমনকি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মীদের দিয়েও নয়, চতুর্থ সংশোধনীর মূল উদ্দেশ্য রাষ্ট্রপতিকে শুধু নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী করা নয়, একই সঙ্গে সেই ক্ষমতা প্রয়োগের চরিত্রও সুনির্দিষ্ট করা হয়েছিল। ইতিহাসের এ এক দারুণ প্রহসন যে বেগম খালেদা জিয়ার জোট সরকারও ঠিক তাই করেছেন।

বাকশালী শাসন ও রক্ষীবাহিনী গড়ে তোলার মূল্য শেখ মুজিবুর রহমান নিজের জীবন দিয়েই শোধ করেছেন; কিন্তু বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যায়নি, পিছিয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়ে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা আমরা আর পাইনি। তবুও বাকশালের মতো মারাত্মক ভুলটি তিনি করেছিলেন। যিনি এতই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বলে আমি দাবি করছি তিনি একনায়কী শাসন বাকশাল, রক্ষীবাহিনী ইত্যাদি করতে গেলেন কেন? তারই উত্তর আছে শ্রেণী-বিচারে। যে শ্রেণীর তিনি প্রতিনিধি ছিলেন সেই শ্রেণীর পক্ষে গণতান্ত্রিক হওয়া ছিল অসম্ভব। ক্ষমতার যে রূপ এই শ্রেণী দেখাতে পারে সেটা বাকশালী রূপমাত্র, এর বাইরে বা এর অধিক কিছু নয়। তার আমলের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার আমলের পার্থক্য হচ্ছে একটা লুটেরা শ্রেণীই শুধু তৈরি হয়নি, এই শ্রেণীর সঙ্গে বহুজাতিক পুঁজির আঁতাত ঘটেছে। অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সন্ত্রাসের ফলে পাতিবুর্জোয়া বা পরজীবী মধ্য শ্রেণীর সঙ্গে জোট সরকারের দূরত্ব বাড়ছে। এই দূরত্ব কমানোর জন্য কোনো আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক বা নীতি গ্রহণ করার ইচ্ছা বা ক্ষমতা কোনোটাই জোট সরকারের নাই। অতএব, তাৎক্ষণিক সস্তা রাজনৈতিক ষ্টান্ট হচ্ছে র্যা ব।

র‌্যাব আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র, বিনিয়োগ বুদ্ধি ও চেতনার একটা অসুস্থ লক্ষণ। আমার সমালোচনা শুধু র‌্যাবকে নিয়ে নয়, পাঠক খেয়াল করবেন, পিটিয়ে মানুষ মারার যে উৎসবকে আমরা প্রশ্রয় দিয়ে থাকি তার সঙ্গেই র‌্যাব তুলনীয়। জনতার পিটুনিতে ছিনতাইকারী নিহত আর র‌্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ সন্ত্রাসী মারা গিয়েছে-এই দুটো ঘটনাকে আমি একই সূত্রে আমাদের সকলেরই অসুস্থতা বলেই শনাক্ত করি। আমাদের চিকিৎসা দরকার।

১ নভেম্বর ২০০৪; ১৭ কার্তিক ১৪১১, শ্যামলী

(প্রথম আলো ১ নভেম্বর ২০০৪)


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।