৪. ইউক্রেন: এক-কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা এবং তার মতাদর্শ


পশ্চিমা মিডিয়া সাড়ে পনেরো আনা মিথ্যুক। তাদের মিত্থ্যাচার সম্পর্কে আমাদের কিছুটা হলেও অভিজ্ঞতা আছে। ইউক্রেনের পরিস্থিতি যদি আমরা শুধু পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রপাগান্ডা দিয়ে বূঝতে চেষ্টা করি, তাহলে কিছুই আসলে বুঝব না। তারা যেটা হামেশা প্রচার করছে সেটা হোল রাশিয়া একটি সার্বভৌম দেশের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। সম্প্রসারণবাদী রুশদের খায়েশ মেটাতে রাশিয়া ইউক্রেন নিজের দখলে নিতে চায়। এর ফলে শুধু ইউক্রেন নয় একই সঙ্গে ইউক্রেনের প্রতিবেশী দেশসহ পূর্ব ইউরোপের আঞ্চলিক অখণ্ডতাও হুমকির মুখে পড়েছে, ইত্যাদি। এই যুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো জোটভূক্ত ইউরোপীয় দেশগুলো যে রণধ্বণি তুলছে ও ইউরোপের জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছে সেটা হোল রাশিয়াকে শাস্তি দেবার এটাই ভাল সময়। ইউরোপের উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো বাহিনী নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়া এবং রাশিয়ার আগ্রাসী খায়েশের উচিত শিক্ষা দেওয়া।

কিন্তু বাস্তবে কি ঘটছে বুঝতে হলে রাশিয়ার দিক থেকেও বিষয়টিকে বিবেচনা করতে হবে। পুরানা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত অনেক রাজ্য স্বাধীন দেশ হিশাবে আলাদা হয়ে গিয়েছে। এই বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে রাশিয়াকে খাড়া থাকতে হচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে রাশিয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচিত হয়েছে নিরাপত্তা। কিন্তু সেই ক্ষেত্রেও দেখা গেছে পারমাণবিক অস্ত্রসহ বিভিন্ন গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো জোটভূক্ত রাষ্ট্রগুলো রাশিয়াকে ঘিরে ফেলছে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর উচিত ছিল সামরিক ব্যয় কমানো। দরকার ছিল গোলকায়নের সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অভিবাসনের সম্পর্ক বাড়ানো, যাতে যুদ্ধ অসম্ভব হয়ে ওঠে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো জোটভূক্ত ইউরোপীয় দেশগুলো সেই পথ অনুসরণ করে নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক বিভিন্ন দেশে হামলা চালিয়েছে। রাশিয়াও দেখল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো জোটভূক্ত দেশগুলো তাকে পূর্ব দিকে ঘিরে ধরেছে। রাশিয়া ভেঙে আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশে পরিণত হোক, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ সেটা চেয়েছে। তারই প্রতিক্রিয়ায় রুশদের মার্কিন নেতৃত্বাধীন এক-কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মধ্যে বহুকেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার ধারণা দানা বাঁধে। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ করবার লক্ষ্যে নতুন চিন্তাভাবনা গড়ে ওঠে।

বরং পাশ্চাত্য প্রপাগান্ডা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর আগ্রাসন এবং যুদ্ধবাজ নীতি আড়াল করতে চাইলেও লুকিয়ে রাখতে পারছে না। এই ডামাডলে রাশিয়া তার পুরানা গৌরব ফিরে পেতে চায় কিনা সেই বাসি তর্ক দ্বারা ইউক্রেনের জটিল ইতিহাস ও রাজনৈতিক বাস্তবতা আমরা বুঝব না। আমরা এর আগে আমাদের আরেকটি লেখায় দেখিয়েছি যে এই যুদ্ধকে বুঝতে হবে মার্কিন নেতৃত্বাধীন এককেন্দ্রিক যে বিশ্ব ব্যবস্থা সারা দুনিয়ার ওপর স্নায়ু যুদ্ধের অবসানের পরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, সারা দুনিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সারা দুনিয়ায় পুলিশি করে বেড়াচ্ছে তাকে চ্যালেঞ্জ করা। এক-কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বহু-কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার লড়াই একালের খুবই গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। একই কারণে ফেব্রুয়ারির চার তারিখে রুশ-চিন ঘোষণা, সমঝোতা বা চুক্তিও আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এক-কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে চিন-রাশিয়ার মধ্যে সমঝোতাও গড়ে উঠেছে। ইউরোপ ও এশিয়াকে মার্কন আধিপত্য থেকে মুক্ত করার জন্য নতুন ভাবে ইউরেশিয়ার পুনর্বিন্যাসের কথা উঠেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের জনগণই শুধু দুনিয়ায় বাস করে না, বরং তার চেয়ে বেশী মানুষ তার বাইরে বাস করে। তারা মার্কিন ও ন্যাটো জোটভূক্ত দেশকে নির্বিচারে সমর্থন করবে তার কোন যুক্তি নাই। মার্কিন আধিপত্য বা এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বৈশ্বিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠার শর্তও ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে। ইউক্রেনের যুদ্ধকে নিউ লিবারেল বিশ্ব প্রপাগাণ্ডার বাইরে প্রত্যকেই যার যার নিজের স্বার্থের জায়গা থেকে বোঝার চেষ্টা করছে এবং অবস্থান নিচ্ছে।

এইটুকু যদি বুঝি তাহলে প্রথমে বোঝা দরকার এক কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থাকে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ করা এবং সার্বজনীন রূপ দেওয়ার জন্য যে সকল মতাদর্শ ফেরি করা হয় সেই সকল মতাদর্শ সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক ধারণা অর্জন করা। আমাদের প্রথমেই সেই সকল প্রচলিত ধ্যান ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে শিখতে হবে যার দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভুত্ব টিকিয়ে রাখা হয়। সবার আগে যে শিক্ষা ও সচেতনতা আমাদের দরকার সেটা হোল কোন মতাদর্শই ভু-রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন বা আলাদা কোন গল্প না। রাশিয়া এবং চিনও এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখবার মতাদর্শ নানাভাবে চ্যালেঞ্জ করছে। মতাদর্শিক তর্ক বিতর্ক থেকে আমাদেরকেও শিখতে হবে। ইউক্রেন যুদ্ধের মতাদর্শিক মর্ম বুঝলে বিভিন্ন মতাদর্শের ভু-রাজনৈতিক তাৎপর্য বোঝা আমাদের জন্য সহজ হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শ এবং যুদ্ধবাজ ইউরোপীয় মতাদর্শগুলো এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তার মর্মও ক্রমশ আরও পরিচ্ছন্ন হবে। এটা নিশ্চিত। রাশিয়ার দার্শনিকরাও সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী বিভিন্ন মতাদর্শ পর্যালোচনা করছেন। তাদের পর্যালোচনা এখনও জাতিবাদী জায়গা থেকে হবার কারণে সেই সকল মতাদর্শের সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। কিন্তু পর্যালোচনার গোড়ার সূত্রগুলো সেই সকল সমালোচনার মধ্যেও আমরা আবিষ্কার করতে পারি।

যেমন, তাঁরা বলছেন সার্বজনীন মতাদর্শ বা সকল অবস্থায় সত্য নামক সোনার পাথরবাটি কোত্থাও নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান থেকে যা ঠিক রাশিয়ার দিক থেকে তা ঠিক হবে এমন কোন কথা নাই। একই ভাবে সেটা আফ্রিকা বা দক্ষিণ এশিয়ার মতো হবে সেটাও ঠিক না। একই পাজামা সবাইকে পরতে হবে এই স্টুপিডিটি বাদ দিতে হবে। মতাদর্শকে এতোকাল আমরা শুধু বুদ্ধির দ্বারা পর্যালোচনার বিষয় হিশাবে গণ্য করেছি। কিন্তু এটা নিছকই বুদ্ধির কায়কারবার না। তার বাস্তব বা বৈষয়িক দিক আছে। ভুগোল, ঐতিহ্য, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি সেই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ একদিকে মায়ানমার, অন্যদিকে ভারতের মাঝখানে পিষ্ট। দুটোই শত্রু রাষ্ট্র। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। সেই সাগরের ওপর বাংলাদেশের কার্যকর অধিকার নাই, যতোটুকু আছে তা আদায় করবার হিম্মত বাংলাদেশের নাই। তাহলে এই ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিকাশ এবং বিশ্ব রাষ্ট্র সভায় টিকে থাকবার মতাদর্শ কি হতে পারে সেটা ভাবা এবং সঠিক ভাবে নির্ণয়ের জন্য বাংলাদেশকে ভাবতে হবে। কোন সার্বজনীন সবার জন্য একই পাজামা টাইপের চিন্তা চলবে না। ভূগোল, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য যদি আরও বৃহৎ পরিসরের অন্তর্গত হয় তাহলে সেই বড় পরিসরের কথা বলতে হবে। বাংলাদেশ তো কখনই এমন খণ্ডিত ছিল না। তার ভুগোল অনেক বিস্তৃত। কি ধরণের জাতিবাদী চিন্তা ও ধর্মীয় বিভাজনের কারণে এই ক্ষুদ্রত্ব ঘটল। কি ধরণের ভুল চিন্তার কারণে আমরা ক্ষুদ্র একটি ভূখণ্ডকে বাংলাদেশ বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি, ইত্যাদি।

বৈশ্বিক পরিসরে ভাবতে গেলে এটা পরিষ্কার আমাদের মতো দেশগুলোর আত্মবিকাশের আদর্শ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘লিবারেলিজম’ হতে পারে না। প্রতিটি দেশের আত্মবিকাশের পথ অন্বেষণ করতে হলে বুঝতে হবে সার্বজনীন কোন মতাদর্শ নাই যা সকলের ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযোজ্য। প্রতিটি মতাদর্শের পর্যালোচনা ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে বুঝতে হবে। ‘পুতিনের মগজ’ বলে খ্যাত আলেকজান্ডার দুগিন (Alexander Dugin) এবং তাঁর সমর্থকদের লেখালিখিতে আমরা এ ধরণের আরও অনেক গুরুতর বিষয়ের আলোচনা দেখছি। তাঁদের লেখালিখিও আমাদের পড়তে হবে এবং পর্যালোচনা করতে হবে। ভূ-রাজনীতি চিন্তা ও দর্শনের বিষয়। ইউক্রেন যুদ্ধ এই সত্য উপলব্ধিকে রাতারাতি সামনে এনে দিয়েছে। আশা করি আগামি লেখালিখিতে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ পাব।

এক-কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলবার পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের মতাদর্শগুলো সম্পর্কে আপাতত কিছু ধারণা দিয়ে রাখা যাক। যেমন, লিবারেলিজম বা উদার রাজনীতির বয়ান। একে পাশ্চাত্য সার্বজনীন মতাদর্শ বলে প্রচার করে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের ভিত্তিও এর মধ্যে নিহিত। এই মতাদর্শের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে নিরন্তর প্রচার করা হয় যে সমাজতন্ত্র, কমিউনিজম ইত্যাদি আদর্শের পতন ঘটে গেছে, ইতিহাসে সত্যমিথ্যা তর্কের দিন শেষ (End of History) , জয়ী হয়েছে ‘লিবারেলিজম’। এখন কাছাখোলা পুঁজিতন্ত্র এবং তার ‘লিবারেলিজম’-কেই মানবেতিহাসের শেষ ও চরম পরিণতি বলে ভাবতে হবে, মেনেও নিতে হবে। সোজা কথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভুত্ব মেনে সকলকে চলতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের ধর্মতত্ত্ব হচ্ছে লিবারেলিজম।

লিবারেলিজম সুন্দর সুন্দর কথা বলে। যেমন, ব্যক্তির অধিকার, স্বাধীনতা, যারা শাসন করবে তাদের শাসিতদের সম্মতি নিতে হবে। অর্থাৎ নির্বাচন লাগবে। আইনের চোখে সবাই সমান। লিবারেলিজম মূলত পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে যুক্তিসঙ্গত ও দার্শনিক ভিত্তি দান করে। তাই সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা এই আদর্শের গোড়ার কথা। অর্থাৎ জমি থাকবে জোতদারের, ব্যাংক থাকবে ব্যাংক মালিকদের, কারখানা থাকবে পুঁজিপতিদের। যারা পুঁজিতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকবে না, সর্বহারা বা ফকির হয়ে যাবে তারা জমি, টাকা, কারখানার মালিকদের দাস হবে। দাস হলেও তারা স্বাধীন ব্যক্তি। স্বাধীন ব্যাক্তি হিশাবেই তারা তাদের শ্রম পুঁজিপতিদের কাছে বেচে মুজুরি দাসত্বের শৃংখল মেনে বেঁচে থাকেব। এই হোল লিবারেলিজম। এটাই ব্যাক্তি স্বাধীনতা। দাসত্বকেই লিবারেলিজম ‘স্বাধীনতা’ বলে দাবি করে।‘ ফ্রিডম’ নিয়ে বড়াই করে। কারণ ফিউডাল বা সামন্তবাদের মতো জোর করে পুঁজিতন্ত্র আমাদের দাস করে না। পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই অল্পকিছুকে ধনি আর বাকিদের সর্বহারায় পরিণত করে। তখন আমরা সর্বহারা বলে নিজেদের শ্রম বিক্রি না করে বেঁচে থাকতে পারি না।

সমষ্টি বা সমাজ নয়, ব্যক্তি হচ্ছে লিবারেলিজমের সত্য। তাহলে ব্যক্তি অধিকার, নাগরিক অধিকার এবং মানবাধিকার সহ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, আইনের শাসন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা, সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থা এবং বাজার অর্থনীতি মিলিয়েই লিবারেলিজম সার্বজনীনতার কথা বলে। যা খুবই সুন্দর সুন্দর কথা, কিন্তু মোদ্দা কথা হল লিবারেলিজম পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার বিস্তৃতি এবং মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে মার্কিন আধিপত্য কায়েমের মতাদর্শ। তাকে কার্যকর করবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো জোটের মধ্য দিয়ে ইউরোপকেও সঙ্গে নিয়ে রেখেছে। লিবারেলিজম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির গুরুত্বপূর্ণ মতাদর্শিক হাতিয়ার।

আমাদের দেশে লিবারেলিজম বা উদার রাজনৈতিক আদর্শের রূপ বা প্রপাগান্ডার ধরণ কিছুটা ভিন্ন রকমের। একই কথা ভিন্ন ভাবে বলা হয়। এখানে বলা হয় আধুনিকতা ও ধর্ম নিরপেক্ষতা ভাল। কারন তার দ্বারা ব্যাক্তি স্বাধীনতা ও ব্যাক্তি অধিকার কায়েম করা যায়। কিন্তু ইসলাম ভাল না। ইসলাম দেড় হাজার বছরের পুরানা ট্রাইবাল কাল্ট, ইসলাম সহিংস ও সন্ত্রাসী। অতএব ইসলাম নির্মূল করে আধুনিকতা, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্র ইত্যাদি কায়েম করতে হবে। ইসলাম নির্মূল না করলে আধুনিকতা কায়েম করা যাবে না। গণতন্ত্র আসবে না। ইসলাম বাদ না দিলে আমরা সাহেবদের মতো সভ্য হতে পারব না। বলা হয়, ব্যক্তিতন্ত্র – অর্থাৎ ব্যক্তিই একমাত্র সত্য, সমাজ বা সমষ্টি নয়। অতএব ইসলামের বিরুদ্ধে জয়ী হতে হলে ব্যক্তি-স্বাধীনতা, ব্যক্তির অধিকারকে নির্বিচারে সমর্থন করতে হবে। কিন্তু ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষার কথা বলা গেলেও সমষ্টি এবং সমষ্টির স্বার্থ রক্ষার কথা বলা যাবে না। উম্মাহ, সমাজ বা সমষ্টির অধিকারের কথা বলা ঠিক না। ‘মানবাধিকার’- এর মানে হচ্ছে যে জালিম রাষ্ট্র ব্যক্তির অধিকার ক্ষুণ্ণ করে, সেই জালিম রাষ্ট্র ব্যবস্থাই নাকি ব্যক্তির অধিকার রক্ষা করবে করবে। অতএব ‘অধিকার’-এর কথা বলা যাবে কিন্তু ‘মানবিক মর্যাদা’র কথা বলা যাবে না, শুধু ব্যক্তির ‘অধিকার’-এর কথাই বলতে হবে। এমনকি একথাও বলা যাবে না যে বাস্তবে ব্যক্তির স্বাধীনতা একমাত্র সমাজ বা সমষ্টির মধ্যে থেকেই বাস্তবায়ন সম্ভব। অতএব বলা যাবে না ব্যক্তি নয়, সমাজ আগে, কারণ সমাজের মধ্যেই ব্যক্তির বিকাশ ঘটে। আমরা কেউ রবিনসন ক্রুসো না।

এটা অস্বীকার করা কঠিন যে ‘ইসলাম’ নামে একটি ইসলাম বিরোধী ধারা প্রবল ভাবে আমাদের দেশে জারি রয়েছে। যা ইসলামি আকিদার নামে কাল্টিশ ট্রাইবাল চর্চাকে দ্বীন বা ধর্ম বলে হাজির করে। অথচ ইসলাম নতুন ধরণের সমাজের ঘোষণা দিয়ে ইতিহাসে নিরন্তর নতুন বিপ্লবী সম্ভাবনা জারি রেখেছে। ইসলাম জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের জিহাদের কথা বলে, জালিমের ক্ষমতা চূর্ণ করে দেবার জন্য ধর্ম আর রাজনীতির মধ্যে কোন ফারাক মানে না। গোত্রবাদী কাল্ট ধ্বংস করবার জন্য সর্বকালের বিপ্লবী আল্লাহর রসুল সিপাহসালার মোহাম্মদ (সাঃ) নিজ গোত্র কোরেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন। মক্কা থেকে বিতাড়িত হয়ে মদিনায় বসে থাকেন নি। মক্কা জয় করেছিলেন। সেই ইসলাম কি গত হয়ে গিয়েছে? ইসলাম কি তার ঘরের আবর্জনা সাফ করতে পারবে? আজ অবধি সেটা সম্ভব হয় নি। ব্যর্থ হবার কারণে একের পর এক ইসলাম-প্রধান দেশগুলো লিবারেলিজম কায়েমের নামে যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে ধূলায় মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্যালেস্টাই্ন, সিরিয়া, লিবিয়া – অর্থাৎ মধ্য প্রাচ্যের দিকে তাকালে আমরা বাংলাদেশে আমাদের সম্ভাব্য পরিণতি আন্দাজ করতে পারি। ঘরের আবর্জনা সাফ করতে হবে আগে।

একালে সাম্রাজ্যবাদ সমাজ বিচ্ছিন্ন এবং সমষ্টির বিপরীতে ব্যক্তি ও ব্যক্তির অধিকারকে আদর্শিক হাতিয়ার হিশাবে ব্যবহার করে। এর কারন পরিষ্কার। যেন কোন সামাজিক, সামষ্টিক কিম্বা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় প্রতিরোধের চেতনা গড়ে উঠতে না পারে। সমাজের সামষ্টিক স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ বড় গণ্য করা হয়। পাশ্চাত্য ধাঁচের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক রাষ্ট্রকে গণতন্ত্র বলা এবং রাষ্ট্রকে বিশ্ব পুঁজির স্ফীতি ও পুঞ্জিভবনের হাতিয়ারে পরিণত করার মধ্য দিয়েই ‘লিবারেলিজম’ সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শের আইনী রূপ পরিগ্রহণ করে এবং তাকে বলবৎ করবার জন্য কেন্দ্রীভুত ক্ষমতা ব্যবস্থাকে ‘রাষ্ট্র’ বলে দাবি করে। রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পুঁজির হাতিয়ার হিশাবে ভূমিকা রাখে। লিবারেলিজমের সকল প্রকার অভিব্যাক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অর্থ হচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তার সর্বগ্রাসী যুদ্ধের রণনীতি ও রণকৌশলের বিরুদ্ধে লড়া।

ভূরাজনীতির আলোকে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে সকল মতাদর্শ নিয়ে আমাদের অবিলম্বে ভাবনা চিন্তা শুরু করা দরকার তার মধ্যে শুরুতেই রয়েছে ধর্মবাদী কিম্বা ধর্ম নিরপেক্ষ সকল প্রকার আধুনিক বর্ণবাদ ও আধুনিক জাতিবাদ প্রত্যাখান। যেন প্রতিটি জনগোষ্ঠি তাদের ভূগোলও আবার নতুন করে চিনতে ও বুঝতে পারে। সে আবাসের ভূ-রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য, প্রাণ, প্রকৃতি ও জীবন ব্যবস্থার সঙ্গে জনগোষ্ঠির ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সম্বন্ধ নতুন ভাবে পর্যালোচনা করা অতিশয় জরুরি হয়ে পড়েছে। ভৌগলিক এবং প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যে সম্বন্ধসূত্রে জনগোষ্ঠি গড়ে ওঠে তাকে নস্যাৎ ও নষ্ট করে দিয়ে বিমুর্ত জাতির যে কল্পনা আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক জমানায় গড়ে উঠেছে তাকে অতিক্রম করে যাওয়া এখন খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে।

দক্ষিণ এশিয়া ইংরেজ শাসক গোষ্ঠির কলমের খোঁচায় দ্বিখণ্ডিত হয়েছে, ভারত ভূখণ্ড ভূগোল, ভাষা, সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের পার্থক্যের ভিত্তিতে ভাগ হয় নি। ভাগ হয়েছে হয়েছে হিন্দু মুসলমানের ধর্মীয় পার্থক্যের ভিত্তিতে। দক্ষিণ এশিয়ার জাতিবাদ সেই কলোনিয়াল বিকৃতির ওপর এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ঔপনিবেশিক কলমের খোঁচা থেকে দক্ষিণ এশিয়া আজও বের হয়ে আসতে পারে নি। ফলে জাতিবাদী ধর্মীয় পার্থক্যই চাষাবাদ, খাদ্য ব্যবস্থা, পোষাক আশাক এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের চেয়েও প্রধান হয়ে উঠেছে। এর পালটা আমরা দেখি কিভাবে আধুনিকতা এবং ব্যাক্তিতান্ত্রিক ভোগী পাশ্চাত্য সংস্কৃতি বিভিন্ন জনগোষ্ঠির বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য ধ্বংস করে দিয়ে তাদের পুঁজি ও পাশ্চাত্য সভ্যতার গোলামে পরিণত করছে। তাহলে আধুনিক বর্ণবাদ ও জাতিবাদ প্রত্যাখান করে নিজেদের পুনরাবিষ্কার করা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আধুনিক জাতিবাদের বিকট সব ধর্মবাদী ও সেকুলার আবর্জনা সাফ করা প্রধান একটি কাজ। তারা নানান বিকৃত রূপ নিয়ে জমাট বেঁধে আছে। তাই বর্ণবাদ, জাতিবাদ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো অতিশয় গুরত্বপূর্ণ কর্তব্য

সকল প্রকার বর্ণবাদ এবং জাতীয়তাবাদ নাকচ করে দেওয়া জরুরি। কারণ হচ্ছে ইউরোপের আধুনিকতাকে মানুষের সার্বজনীন প্রগতির ইতিহাস হিশাবে দাবি করার অর্থ অন্য সকল সভ্যতাকে বর্বর বা পশ্চাতপদ গণ্য করা। যা আসলে বর্ণবাদেরই শামিল। এই সর্বজনবাদী আদর্শ আসলে ঔপনিবেশিক ইতিহাসেরই ধারাবাহিকতা। তাহলে আধুনিক জাতিবাদের মানদণ্ড দিয়ে যখন অন্যান্য ধর্ম, সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যকে বিচার করা হয় সেই পদ্ধতি কার্যত বর্ণবাদী পদ্ধতি। তার দ্বারা এটাই প্রতিষ্ঠিত হয় যে পাশ্চাত্যই সেরা। তাদের জ্ঞানকাণ্ড এবং রাজনৈতিক আদর্শের আলোকে অন্য সকল সভ্যতাকে বিচার করতে হবে। এর দ্বারা পাশ্চাত্যের – বিশেষ ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েমের চর্চাই নিশ্চিত করা হয়।

এই আদর্শিক প্রেক্ষাপটেই ইউরেশিয়া ধারণা তৈরি হয়েছে। সার্বজনীনতার প্রতি পশ্চিমের একচেটিয়া দাবির কোন ভিত্তি নাই। দরকার তথাকথিত পাশ্চাত্য সভ্যতার কাছে নতি স্বীকার না করা, এর আধিপত্য প্রত্যাখ্যান করা । সত্যের উপর একচেটিয়া অধিকার কারো নাই।

তাহলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের প্রপাগান্ডাও নির্বিচারে মেনে নেবার কোন যুক্তি নাই। যুদ্ধের আমরা নিন্দা করি। সর্বোপরি মানুষের দুর্ভোগ ও দুর্দশা মোচনের প্রতি আমাদের সংহতি সব সময়ই দৃঢ় রাখতে হবে। যুদ্ধ আমাদের অমানুষ করে তোলে। কিন্তু পাশ্চাত্য প্রপাগান্ডার বিপরীতে রুশ বাস্তবতাও আমাদের মনে রাখতে হবে। তাদের ভাষ্যও শুনতে হবে। সামরিক সরঞ্জাম ও বিপুল মারণাস্ত্র নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর সদস্যভূক্ত দেশগুলো রাশিয়াকে যেভাবে ঘিরে ধরবার পরিকল্পনা এঁটেছে তাকে আগেভাগেই রুখে দেবার জন্য রাশিয়া বাধ্য হয়েই এই যুদ্ধ শুরু করেছে। পরে আমরা দেখব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর জোটে অন্তর্ভূক্ত দেশগুলোর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ শুধু রাশিয়া করছে না। মার্কিন ও ইউরোপীয় খ্যাতিমান ঐতিহাসিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে যারা কাজ করেন তারাও রাশিয়ার কথা বলছেন। এমনকি মার্কিন নীতিনীর্ধারণী পরিসরে কাজ করেছেন এমন অনেকে একই ইঙ্গিত দিয়েছেন। এই যুদ্ধের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো জোটভূক্ত দেশগুলোর উস্কানি প্রধানত দায়ী।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।