রমজান ও রুহানিয়াত
আপনাতে আপনি ফানা
হলে তারে যাবে জানা।
সিরাজ সাঁই কয় লালন কানা
স্বরূপে রূপ দেখ সংক্ষেপে।।
-- ফকির লালন শাহ
প্র: ধর্ম সম্পর্কে আপনার জানাশোনা, দৃষ্টিভঙ্গী এবং অবস্থান আলাদা, কিন্তু দেখা যায় আপনি রোজা রাখেন এবং রমজানের শেষ দশদিন আপনার আচার আচরণে লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন দেখা যায়। এরপর আপনার কবিতা, চিন্তা ও লেখালিখির মধ্যে নতুন চিন্তা বা ভাবের স্ফূরণ দেখা যায়। এর কারন কি?
উ: উপবাস, রোজা রাখা শুধু ইসলাম ধর্মের বিধান তাতো না। অন্য ধর্মেও উপবাস থাকার বিধান আছে। পৃথিবীতে এমন কোন ধর্ম নাই যেখানে উপবাস, রোজা, কৃচ্ছসাধন বা নিজের শরীর ও আত্মার দিকে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন চিত্তে ফিরে তাকানোর বিধান নাই।
রমজান আমাদের ত্যাগ করতে শেখায়, এটা আমরা সকলেই কমবেশী জানি। মানুষের শরীর ও আত্মা পরস্পর থেকে আলাদা নয় রমজান সেই ইহলৌকিক সত্যও সারাদিন শরীরকে খাদ্য ও পানি থেকে বঞ্চিত করে শেখাতে চেষ্টা করে। সকল প্রকার ভোগ থেকে বঞ্চিত করে আমাদের বুঝিয়ে দেয়। মানুষ পারলৌকিক বিমূর্ত কোন সত্তা না; মানুষের শরীর আছে, এবং যাকে আমরা 'আমি' বলি তিনি আমার শরীরে বাস করেন। শরীরের যত্ন না নিলে শরীর নাশ হয় এবং 'আমি' নামক সত্তাও ইহলোকে টিকে থাকতে পারে না। আমরা যে শারিরীক বা ইহলৌকিক সত্তা সেটা রোজা বা উপবাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়। পাশাপাশি অন্য মানুষও জীব এবং মানুষ মাত্রেরই শরীর আছে, সেটা আমরা উপলব্ধি করতে পারি, ফলে সকল মানুষের ইহলৌকিক প্রয়োজনের কথাও আমরা সহজে আমরা বুঝতে পারি। রমজান আমাদের ইহলৌকিক করে তোলে।
উপলব্ধির দিক থেকে বিচার করলে রমজানের প্রধান ভূমিকা নিজের 'আমি' বা আত্মার যত্ন নেওয়া। একে সহজে বোঝাবার জন্য আমরা রুহানিয়াতের চর্চা বলতে পারি। শরীরের যেমন যত্নের প্রয়োজন হয়, তেমনি 'আমি' বা আত্মারও যত্নের দরকার পড়ে, নইলে মানুষ অমানুষ বা জীবমাত্রে পর্যবসিত হয়। কারণ 'আমি' বা আত্মার যত্ন না নিলে সত্য উপলব্ধি সম্ভব না। শরীর না, শরীরের অন্তর্গত 'আমি' নামক কর্তাই জগত উপলব্ধি করে, সেই সকল উপলব্ধি বুদ্ধির পরিসরে প্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা জগতকে জানি। সেই জানা ভুল হয় যদি আমরা নিজেক্র যত্ন না করি। নিজেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে না তুলি। নিজেকে সাফসুতরো করে তোলা সব ধর্মেই আছে। ইসলাম ব্যতিক্রম কিছু না।
রমজান বা রমযান ( رمضان) ইসলামের বর্ষপঞ্জিকা অনুসারে নবম মাস। এ মাসেই লাইলাতুল কদর, আর এ মাসেই কুরআন নাজিল হয়েছিল। জীবের জীবনের বৃত্ত এবং সংকীর্ণ অবস্থা থেকে বের হওয়া, নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়া, বিদ্যমান জাগতিক সম্পর্ক ও ক্ষমতা ব্যবস্থার আধিপত্য থেকে নিজেকে নিজের ভেতর থেকে আলাদা করতে পারা, ভোগী আত্মা আর রুহানি কর্তার মধ্যে ফারাক করতে পারা, নিজের পরমার্থিক কর্তব্য নির্ণয়, -- অর্থাৎ নিজের রুহানি কর্তাসত্তার পরমার্থিক উপলব্ধির জন্য আমাদের নিজ নিজ 'আমি' বা কর্তাসত্তার যত্ন বা রুহানিয়াতের অনুশীলন সব ধর্মেই আছে। সব ধর্মেই রোজা, উপবাস ও একনিষ্ঠ ধর্মাচরণের বিধান আছে। নিজের 'আমি'র সেবা বা যত্ন করা খুবই প্রাচীন রুহানি বা আধ্যাত্মিক চর্চা। পাশ্চাত্যে আজকাল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচার বা শাস্ত্রীয় বিধিবিধানের বাইরে মানুষের আপন কর্তাসত্তার যত্ন নেওয়া Spirituality হিশাবে আলোচিত হয়। তবে রুহানিয়াতের তাৎপর্য আরও ব্যাপক ও গভীর।
প্র: তাহলে উপবাস করলেই হয়, রোজা রাখার কি দরকার?
উ: যারা তা চাইবেন, করবেন। সনাতন ধর্মে গ্রহ নক্ষত্রের গতিপথ ও রাশি চক্রের হিশাব কষে কখনও নির্জলা অর্থাৎ পানি ছাড়া, আবার কখনও পানিসহ উপবাসের অত্যন্ত সমৃদ্ধ খাদ্য বিধান রয়েছে। অর্থাৎ কখন কোন ঋতুতে কোন প্রহরে কি খাওয়া উচিত আর কি উচিত নয় সে সকল বিষয়ে সমৃদ্ধ সংস্কার বা ঐতিহ্য এখনও জীবন্ত। প্রাণীজ আমিষ – যেমন মাছ মাংস পরিহার করবার বিধানও রয়েছে। এমনকি ডালের মধ্যেও কোন ডাল উত্তম তার ভেদবিচার আছে। কিন্তু একই সঙ্গে কে ব্রাহ্মণ আর কে নীচু জাতের সেই বর্ণাশ্রম প্রথাও এর পাশাপাশি গড়ে উঠেছে। নিরামিষ ভোজন ব্রাহ্মণের আর প্রাণীজ আমিষ গ্রহণ নিম্ন বর্ণের খাদ্য হিশাবে চিহ্নিত হয়। বর্ণ ভেদে ধর্মের অধিকারের ক্ষেত্রেও আসাম্য ও অন্যায় জারি রাখা হয়। এ কারণে উচ্চ বর্ণ ও অভিজাত শ্রেণীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দীর্ঘ ইতিহাসও রয়েছে। তাই বেদ ও শাস্ত্রের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ভক্তির ধারাও আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে এবং আছে। যারা রুহানিয়াতের চর্চাকে জীব না থেকে মানুষ হয়ে ওঠার চর্চা বলে মনে করে। জীবাবস্থা থেকে পরমার্থিক উন্নতি বা বিকাশ যা আসলে আমাদের দেশে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে নিম্ন বর্ণের গণমানুষের বিদ্রোহ। সেই ইতিহাস বোঝা দরকার।
জাতপাতের বিধান বাদ দিলে সারা বছর ব্যাপী উন্নত খাদ্য ব্যবস্থা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে স্থানীয় সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। ভক্তি বোধের বিকাশ ও রুহানিয়াতের চর্চার দিক থেকে বাংলার ভক্তির ধারার মধ্যে সেবাবিধান, ওরশ ইত্যাদির চল এখনও শক্তিশালী।
রুহানিয়াত সবসময় অন্তর্মুখি ব্যাপার তাও নয়। আমাদের কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে গ্রহনক্ষত্রের যোগ নির্ণয় করে চাষাবাদের বিশাল ঐতিহ্য রয়েছে। তার মানে বিশ্ব নিখিলের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক বোঝাো গুরুত্বপূর্ণ আত্মিক বা আধ্যাত্মিক চর্চা। এই দেশে ধর্ম মানে বিশ্বনিখিলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে সরাসরি প্রকৃতির সঙ্গে ইহলৌকিক সম্বন্ধ চর্চার বিধানও বটে। যেন আমরা বুঝি জগত আমামদের ভোগের বিষয় নয়, এখানে আমরা বাসও করি। প্রকৃতি সকল প্রাণের আবাস। তার তাৎপর্য অনেক গভীর ও ব্যাপ্ত।
সার কথা হচ্ছে স্থানীয় সংস্কৃতির মহৎ দিকগুলো হারিয়ে ফেলা ঠিক না। ব্রাহ্মণ্যবাদ বা জাতপাত বাদ দিয়ে সনাতন ধর্ম কিম্বা বৌদ্ধ, জৈন বা প্রাচীনতর কোন চর্চাকে জ্ঞানগত দিক থেকে বোঝা জরুরি। তেমনি তাকে সাধারণ মানুষের ধর্ম, সংস্কৃতি বা রুহানিয়াতের চর্চা হিশাবে শনাক্ত করতে পারাও সমান জরুরি। এ লড়াই হাজার বছর ধরে চালু আছে। নতুন কিছু না। আধুনিক কালে প্রাণ ও পরিবেশ আন্দোলনের কারণে রুহানিয়াত চর্চার পরিসর বাড়ছে। সেই দিকে মানুষের আগ্রহও বাড়ছে। নয়াকৃষি আন্দোলন সেই জন্য স্থানীয় বা লোকায়ত জ্ঞান এবং জ্ঞানচর্চার ইতিহাসকে বিশেষ মূল্য দিয়ে থাকে।
কিন্তু ইসলামে রোজার একটি আলাদা তাৎপর্য আছে যা জ্ঞানী ব্যক্তিদের বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করে।
প্র: সেটা কেমন?
ইসলাম আসার আগেও রোজা রাখার বিধান আরবদের স্থানীয় সংস্কৃতি হিশাবে ছিল। রাসুলে করিম (সাঃ) তাকে গ্রহণ করেছেন। দুর্দান্ত কাজ করেছেন। কারন স্থানীয় সংস্কৃতির যা ভাল, উত্তম ও জ্ঞানময় তাকে সানন্দে গ্রহণ করবার নজির রেখেছেন তিনি। কিন্তু সেটা নির্বিচারে গ্রহণ করা না। আল্লার নিকটবর্তী হবার সচেতন প্রয়াস হিশাবেই রমজানে রোজার বিধান ইসলামে এসেছে। এই বোধটুকু না জন্মালে আমরা প্রাক-ইসলামি জাহেলিয়া আর ইসলামের যুগের ফারাক বুঝব না। এই বোঝাবুঝিটা হচ্ছে জাহেলিয়াতের সঙ্গে ছেদ ঘটানোর অবস্থাকে বিকাশ হিশাবে বোঝা। যাকে ইসলামে অজ্ঞানতার যুগ বা স্তর বলা হয় তাকে জ্ঞানের স্তরে রাসুলে করিম (সা.) উন্নীত করেছেন। এই দিকটা বুঝলে স্থানীয় সংস্কৃতিকে প্রজ্ঞা বা হেকমত – অর্থাৎ পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে গ্রহণ করবার শিক্ষাও আমরা পেতে পারি। এই শিক্ষা না নিয়ে জোর করে ইসলামি সংস্কৃতি বলে যদি কিছু আমরা স্থানীয় সংস্কৃতির ওপর চাপিয়ে দেই এবং স্থানীয় সংস্কৃতির উন্নত চর্চাগুলো আত্মস্থ করতে না শিখি সেটা তখন ভিন দেশের আধিপত্য বা আরব সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ হয়ে যায়। স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে অনর্থক একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।
প্র: যুগ আর স্তর কি একই কথা? নাকি তারা আলাদা? তাদের মধ্যে কি ফারাক?
উ: যুগ কথাটার নানান মানে আছে, কিন্তু যুগকে যদি সময় গণ্য করি তখন সেটা একটা সরল রেখার মতো একদিক থেকে আরেকদিকে ছুটে যাচ্ছে বলে আমরা ভাবি। তখন তা হয়ে ওঠে মানুষের ইতিহাসকে সরল রেখার মতো অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ হিশাবে দেখা। যেমন আমরা মনে করি অতীত কালের আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগ আমরা পার হয়ে এসেছি। এখন সবই অতীত হয়ে গিয়েছে। আসলে কি তাই? সেটা তো ঠিক না।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি ইসলাম বুঝি? আচার-অনুষ্ঠান শরিয়া বা বিধি বিধান বোঝা এক কথা, কিন্তু মানুষের জন্য তার তাৎপর্য কি সেই প্রশ্ন কি তুলি? নাকি তুলতে জানি? সে কারণে ইসলামের তাৎপর্য জ্ঞান ও প্রজ্ঞার চর্চা, রুহানি অধ্যবসায়, বা ভাব চর্চার বিষয় হিশাবে আমাদের কাছে হাজির হয় না। আরব দেশ থেকে আসা একটি আচার বা বিশ্বাস হিশাবে হাজির হয়। তাকে আকিদা বা বিশ্বাস হিশাবে মানি, অন্যদেরও মানতে বলি। সেটা হয়ে প্রাক-ইস্লামি যুগের আরবদের পাগান চর্চা। কেন মানুষের নিজের বিকাশের জন্যই জন্য রোজা ও এবাদত গুরুত্বপূর্ণ সেটা কাউকে য়ামরা আর বোঝাতে পারি না। নিজেও বুঝি না।
তাই ধর্ম আমাদের কাছে এখনও পাগান ও জাহেলি যুগের আরবদের মতো কে জান্নাত বা বেহেশতে যাবে আর কে দোজখে যাবে সেই হিশাবনিকাশের মধ্যে আটকে আছে। ধর্ম কি মানুষকে ভয় কিম্বা পুরষ্কৃত করবার ব্যাপার? আমরা তো এখনও ইসলামকে জ্ঞানের বিষয় হিশাবে কিম্বা রুহানিয়াতের চর্চা হিশাবে বুঝি নাই। কিম্বা বুঝতে শুরু করি নাই। সেই জন্যই স্তরের বিষয়টা আসে। অর্থাৎ চেতনা, সচেতনা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ইত্যাদি স্তর অতিক্রমের লক্ষ্য হিশাবে ধর্ম চর্চার বিষয়টা যেমন আমাদের সামনে হাজির নাই, তেমনি নিজের 'আমি' বা কর্তার যত্ন নেবার দায় -- যাকে রুহানিয়াতের চর্চা বলা হয় -- সেই দিক থেকেও আমরা ঈমান-আকিদাকে ভাবি না। প্রতিটি মানুষ বা ব্যক্তিকে মানবেতিহাসের যুগগুলো নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া এবং এবাদতের মধ্য দিয়েই পার হয়ে আসতে হয়। নইলে সে অজ্ঞানতার যুগে বা জাহেলি জগতে আটকা পড়ে থাকে।
রমজান সেই বোঝাপড়ার মাস। ইসলামে এর গুরুত্ব তাই অত্যধিক। কোরান এই মাসে নাজিল হওয়ার ঘটনাটিও বিশাল প্রতীকী ব্যঞ্জনা হয়ে ইতিহাসকে মহিমান্বিত করে।
প্র: তাহলে ‘যুগ’ ও ‘স্তর’-এর ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে এর সঙ্গে যুক্ত এবাদতের ধারণা।
উ: ঠিক বলেছেন।
প্র: তাহলে পাগান বা আরবদের সংস্কৃতি ইসলামে গ্রহণ করেছে কথাটা খুব অর্থপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারন বিকাশ মানে মানুষের অতীতের সব কিছুর সঙ্গে শুধু ছেদ ঘটানো নয়। একই সঙ্গে তীত নিয়ে বেড়ে ওঠা। এটাই কি বোঝানো হোল?
উ: এতে বোঝানো হয়েছে মানুষের বিকাশ স্রেফ ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে লাফ দিয়ে উঠে যাওয়া বা কোলা ব্যাঙের মতো উল্লম্ফনের ব্যাপার না। ইসলাম কবুল করলেই আপনি জাহেলিয়ার স্তর থকে ইসলামের স্তরে উঠে গিয়েছেন, ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। আপনার মধ্যে লোভ এবং ভয় পুরা মাত্রায় থেকে যেতে পারে। আপনি হয়তো নামে ‘মুসলমান’, কিন্তু রয়ে গিয়েছেন বা হয়ে আছেন প্রাক-ইসলাম যুগের আরব বেদুঈন: ট্রাইবাল, রক্তবাদী, গোত্রবাদী, গোষ্ঠবাদী, ইত্যাদি। হয়তো আপনি নিজের গোত্র ছাড়া আর সকলকে বিধর্মী বা দুষমণ মনে করেন। অথচ হতে পারে অন্য ধর্মের মানুষ রুহানি চর্চার দিক থেকে আমাদের চেয়ে অনেক অগ্রসর।
ইসলাম এখনও লোভ ও ভয়ের স্তর অতিক্রম করতে পারে নি, এটা ইসলাম অনুসারীদের বিপর্যয়ের বড় একটি কারন। লোভী কেন? কারণ জান্নাতের লোভে হয়তো আপনি ইসলাম করেন। ভীতু কেন? কারন দোজখের ভয়ে আল্লাহ আল্লাহ করেন।
তাহলে বুঝতে হবে ইতিহাসের যেমন অগ্রপশ্চাৎ ভেদ আছে। মানুষের চেতনাস্তরেরও ফারাক আছে। নিজের সঙ্গে নিজের ভেদরেখা বা ফারাকটা আপনি কিভাবে ঘটাবেন এবং নিজের কাছে স্পষ্ট করবেন সেটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। রমজান মাস তাই নিজেকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেওয়াও বটে। অলি-আউলিয়া দরবেশ সুফি, ফকিরগণ এই কথাটাই আমাদের নানা ভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেন। তাঁরা বলে্ন লোভ ছাড়, ভয় ত্যাগ কর। আল্লাহকে ভালবাসতে শেখ। নিজেকে জান, তাহলে তাঁকেও জানবে।
এটা আমাদের মনে রাখতে হবে মানবেতিহাসের বিকাশে ছেদ যেমন আছে তেমনি ধারাবাহিকতাও আছে। একই ভাবে ব্যক্তি মানুষের বিকাশেও ছেদ যেমন আছে, তেমনি ধারাবাহিকতাও রয়েছে। ধর্ম বা দ্বীন অর্জনের বিষয় , স্রেফ বিশ্বাস, কবুল বা ধর্মান্তকরণের ব্যাপার না। তাই ইসলামে ‘এবাদত’, ‘এহতেকাফ ইত্যাদি ধারণা বা বর্গ দার্শনিকদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ।
প্র: তাহলে ইসলামের আগে হাজির স্থানীয় সংস্কৃতিকে রাসুলে করিম (সাঃ) ইসলামে গ্রহণ বা তার প্রয়োপজনীয় সংস্কার করে আত্মস্থ করে নেবার দার্শনিক তাৎপর্য বিশাল ব্যাপার।
উ: অবশ্যই। রোজা বা উপবাস থাকা এবং পরিবার পরিজন নিয়ে নির্জনে এহতেকাফে মগ্ন হওয়া স্থানীয় সংস্কৃতি হিশাবে হাজির ছিল। কিন্তু রাসুলে করিম (সাঃ) তাকে জ্ঞানের স্তরে তুলে এনে তার সংস্কার করে একদিকে স্থানীয় সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন, তেমনি জ্ঞানীদেরও বোঝাতে চেয়েছেন ইসলাম স্রেফ বিশ্বাস কিম্বা শুধু আচারনুষ্ঠানের ব্যাপার না, জ্ঞানচর্চারও বিষয়। রাসুলে করিম (সাঃ) জ্ঞানীদের পরামর্শ দিয়েছেন বারো মাসের মধ্যে একটা মাস তোমরা নিজের জন্য বরাদ্দ রাখ। তার মধ্যে আবার রমজানের শেষ দশদিন সারা মাস থেকে আলাদা করে বরাদ্দ রাখ। যেন তুমি নিজের শরীর ও আত্মার দিকে তাকাতে পার। সারা বছর তুমি বাইরে তাকাও, বাহিরকে দেখ, এবার নিজের দিকে তাকাও নিজেকে দেখ। উদ্দেশ্য হচ্ছে সারাবছর মনে ও দেহে যে সকল আবর্জনা জমেছে তা যেন সাফ হয়ে যায়। নিজেকে নিজে যেন আরও উন্নত চেতনার অধিকারী করতে পার, বিশেষত সত্য যেন সহজে তোমার কাছে ধরা দিতে পারে।
রমজান মাসে লাইলাতুল কদর আছে। যে রাতে জ্ঞানীগণ তাদের শরীর ও মনের আবর্জনা ধূয়ে মুছে পরিষ্কার হবার পর নিজের স্বরূপ নিজে দর্শন করতে পারে। লাইলাতুল কদর তাই দারুন বরকতময় রাত। যারা শুধু আল্লাকে চায়, যারা কামনা বাসনা লোভ বর্জিত – যারা বেহেশতের লোভে আল্লাহকে ডাকে না, কিম্বা দোজখের ভয়ে ‘ইয়া নফসি ইয়া নফসি করে না’ -- তারা নানান রূপে নানান ইশারায় নানান ইঙ্গিতে বিভিন্ন স্বপ্নে -- হঠাৎ মনে জেগে ওঠা কল্পনা কাব্য উপমা উৎপ্রেক্ষার মধ্য দিয়ে -- যা পাবার পেয়ে যায়। নইলে কাব্য শিল্পকলা জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটল কিভাবে? শিল্পকলা বা কাব্যের রুহানি ব্যাপারটা হয়তো আমরা কিছুটা বুঝি। কিন্তু রুহানিয়াত দর্শন এবং বিজ্ঞানের পেছনেও কাজ করে। কিন্তু দার্শনিক বা বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই বলছেন যুক্তি, বুদ্ধি বা পরীক্ষাগারের বিধিবিধান মেনে বিজ্ঞানিরা নতুন ‘আবিষ্কার’ করেন তার পক্ষে বিশেষ প্রমাণ নাই। বরং মহৎ আবিষ্কারগুলো পুরানা চিন্তার ধারাবাহিকতার মধ্যে হঠাৎ ছেদ ঘটিয়ে হাজির হয়েছে। এ ব্যাপারে বিখ্যাত একটি বইও আছে (Structure of Scientific Revolution) । একে কেউ কেউ অভিজ্ঞতার স্থানবদল, বা জ্ঞানবর্গের অবস্থান্তর (Paradigm Shift) বলেন। কেউ কেউ বলেন জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারাবাহিকতায় ছেদ (Epistemological Break), ইত্যাদি।
প্র: আপনি তাহলে ধর্মকে স্রেফ জ্ঞানচর্চার দিক থেকে বিচার করছেন, তাই কি?
উ: না সেটা ঠিক না। সেটা আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন করে। আমি আধুনিকতাকে পশ্চাতপদ চিন্তা মনে করি। বা মানবেতিহাসের একটা পর্ব বা স্তর মনে করি, এই পর্বটা অবশ্য মানুষ অতিক্রম করে যাচ্ছে বলে মনে হয়। কিন্তু আমরা পিছিয়ে আছি। জ্ঞানী বা প্রজ্ঞাবান হওয়ার অর্থ যুক্তিবাদী, বুদ্ধিমান বা বিজ্ঞানী হওয়া না। বরং ‘আধুনিক’ নামধারী যে কর্তা আমাদের আত্মাকে দখল করে রেখেছে তার চেহারা চিনে নেওয়া, তাকে পরিহার করা। আধুনিকতা আমাদের বৈষয়িক জীবন সমৃদ্ধ করতে গিয়ে আকাশ ফুটা করে দিয়েছে, গরমে প্লাবনে মরছি আমরা। বিকট জলবায়ু বিপর্যয় ঘটেছে। তাই প্রজাতি হিশাবে মানুষকে রক্ষা করতে হলে আমাদের নিজেদের কাছে নিজেদের দ্রুত ফিরে আসতে হবে – এটা অতিশয় জরুরি কাজ হয়ে পড়েছে। দ্রুত নিজের দি্কে তাকাতে হবে আমাদের যেন হাজার বছর ধরে জমে ওঠা আবর্জনা আমরা সাফ করে নিতে পারি।
রমজান নিজের দিকে তাকানো, নিজের কাছে নিজে ফেরে আসা, নিজের যত্ন করা এই সবের জন্য অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ ধর্মের দিকে ফিরে যাচ্ছে বা ধর্মে ফিরে যেতে চাইবার একটা বড় কারন এখানেই। কারণ প্রজাতি হিশাবে মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে চায় না।
ইসলামে এই ফিরে আসা ও নিজের আত্মার হেফাজত করা আরও বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে। কারন ইসলাম দাবি করে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লার খলিফা হিশাবে। তার মানে সৃষ্টির সুরক্ষা বা হেফাজত করা তার ধর্ম বা দ্বীন পালনের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের যারা হেফাজত করে না তারা ইসলামের মানে বোঝে দাবি করতে পারে না। তারা ইসলাম চর্চা করে বলা যায় না।
আধুনিকতা মানুষকে চরম ভোগী বানিয়েছে। মানুষ বুঝতে শিখেছে তার বুদ্ধি থাকলেই হোল, অন্য কোন বৃত্তি – কোন নীতি, নৈতিকতা আদর্শ দরকার নাই। ধর্মের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বোঝা সময়ের অপচয়, ইত্যাদি। মানুষ যেহেতু যুক্তিকে তার অন্য সকল বৃত্তি ও সম্ভাবনা থেকে আলাদা করে তাই ধর্ম বলতে সে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বোঝে। তার বাইরে ব্যাপকার্থে মানুষের সামগ্রিক বৃত্তির বিকাশ আকারে ধর্ম বা ধর্ম চর্চাকে বোঝে না।
একালে ‘ধর্ম’ নামে না যা হাজির তা আসলে ক্ষমতা চর্চার প্রতিষ্ঠান কিম্বা তার ঐতিহাসিক রূপান্তর। আধুনিক কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রই একালে গির্জা। আধুনিক রাষ্ট্র মূলত ধর্মতাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠানের অধিক কিছু না। এ কথা কার্ল মার্কস না বললেও আমরা এখন কাণ্ডজ্ঞান দ্বারা সেটা অনায়াসে বুঝি। রাষ্ট্র যখন দাবি করে আমি সার্বভৌম -- তখন আধুনিক রাষ্ট্র কার্যত আল্লাহ হয়ে আল্লার ভূমিকা নিয়ে শাস্তি, শৃংখলা ও পুরস্কারের দাঁড়িপাল্লা হাতে পুলিশ সেনাবাহিনী আইন আদালতসহ হাজির হয়। গির্জার সার্বভৌম ক্ষমতাই আধুনিক রাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়েছে। ইসলাম নামেও ক্ষমতা চর্চার ধারা প্রবল যেখানে ইসলামকেও অনেকে আধুনিক রাষ্ট্রের মতো গির্জার সেকুলার রূপ দিতে চায়। অনেকে তাই আধুনিক পাশ্চাত্য রাষত্রের আদলে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েমের খোয়াব দেখে, যা সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী।
অন্যদিকে ইহলৌকিক পরিসরে বিজ্ঞান ও যুক্তিবুদ্ধির হাতে পরাস্ত হয়ে এক দল সারাক্ষণই দাবি করছে তাদের হাতেই নাকি জান্নাতের চাবি আছে। দোজখে যেন যেতে না হয় তার ফর্মূলাও নাকি আছে। বুঝুন কাণ্ড!
প্র: জ্বি। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র – যতোই গণতন্ত্রী হোক – আসলে তা সেকুলার গির্জা। তাহলে পথ কি?
উ: পথ হচ্ছে আমরা আমাদের যে কর্তারূপ ‘আধুনিকতা’ নামে ফুটিয়ে তুলেছি তাকে বিচার ও পর্যালোচনা করতে শেখা। আধুনিক এই পাশ্চাত্য সভ্যতাই কি মানুষের রূপ? নাকি এটা জাহেলিয়াতের একটা পর্যায়? রমজান এই জিজ্ঞাসাকে সামনে আনে। সেই জিজ্ঞাসার সামনে নতজানু হতে আমাদের বাধ্য করে। আমাদের বুঝতে অনুপ্রাণিত করে এই পর্যায় আমরা কিভাবে অতিক্রম করব? এই ভোগী দুর্দশার হাত থেকে মানুষকে আমরা কিভাবে মুক্ত করব। কিভাবে আমরা নিজেদের কাছে নিজেরা ফিরে আসব। নিজের যত্ন নিতে শিখব, যেন আমাদের মধ্যে জমে থাকা আবর্জনা আমরা নিজেরাই সাফ করে নিতে পারি। মানুষকে খলিফা ঘোষণা দিয়ে ইসলাম সেই শক্তি মানুষকে দিয়েছে। রমজান তাই ভোগী জীবন প্রত্যাখান করে মানুষের রুহানি বা দিব্য স্বভাবকে জাগিয়ে তুলতে সহায়তা করে। মানুষ তার অধঃপতন থেকে কিভাবে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াবে সেই রুহানি শিক্ষা দেয়। সকলকে নিয়েই মানুষের এই অধঃপতনের পর্ব আমাদের পার হতে হবে।
পাশ্চাত্য আধুনিকতার দাবি হচ্ছে সব কিছু বুদ্ধি দিয়ে বিচার করা। সেটা করতে গিয়ে তারা মানুষের অপরাপর বৃত্তির ভূমিকা ও শক্তিকে অস্বীকার ও নাকচ করে দেয়। তারা বুদ্ধি নামক এক বিমূর্ত কর্তার কল্পনা ও চর্চা করে, যে বুদ্ধি মানুষের স্বভাব থেকে অন্য সকল বৃত্তি বিয়োগ করে দেয়। বিয়োগ করে দিয়ে ‘কর্তা’ হয়, এই 'আধুনিক কর্তা' মানুষের খণ্ডিত ও ক্ষুদ্র দিক মাত্র। তাহলে আমরা আমাদের কি বিয়োগ করেছি সেটা দ্রুত বোঝা দরকার। রুহানিয়াত যেমন। এই বোঝাবুঝিটা একালে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সেই বিয়োগই ধর্ম হয়ে আবার ফিরে আসছে। যে কারণে পাশ্চাত্যে ‘রিটার্ন অব রিলিজয়ন’ ঘটছে বলে কথা উঠেছে। আসলে 'রিলিজিয়ন' আর পুরানা কায়দায় কখনই ফিরবে না। যা ফিরবে তা মানুষের রুহানি শক্তি। রুহানিয়াত।
আধুনিকতার অনুমান হচ্ছে বুদ্ধি মানুষের অন্য কোন বৃত্তির সহযোগিতা ছাড়া নিজগুণেই সত্য নির্ণয় বা সত্য আবিষ্কার করে ফেলতে পারে। তথাকথিত বিজ্ঞানের কোন নীতি নৈতিকতা আদর্শ সত্য-মিথ্যা উপলব্ধি ইত্যাদির কোন দায় নাই। সত্য উপলব্ধি, আবিষ্কার বা জানার জন্য মানুষের নিজের কোন আত্মিক প্রস্তুতির প্রয়োজন নাই। রমজান আমাদের আহ্বান করে এবং বলে এটা ঠিক না। তুমি নিজেকে নিজে হারিয়ে ফেলেছ, নিজের কাছে আসো, নিজেকে জানো, নিজের যত্ন করো। তোমার স্বরূপ বোঝার চেষ্টা কর। রোজা রাখ, এবাদতে মন দাও। তুমি নিজে তোমার শরীর ও আত্মার প্রতি যত্নশীল হও।
অর্থাৎ যারা বিজ্ঞান চর্চা করেন এবং বিজ্ঞান ব্যবহার করে আবিষ্কার করেন তাকে শুধু বহির্মুখী হলে চলবে না। অন্তর্মুখী হতে হবে। তার নিজেকে নিজে ভিন্ন ভাবে তৈরির চর্চা দরকার। যেমন, আণবিক বোমা বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কিলিং-এর জন্য মারণাস্ত্র বানাব কি বানাব না সেটা বৈজ্ঞানিক বা বিজ্ঞানের ব্যাপার না। সেটা নীতি, নৈতিকতা আদর্শ বা ধর্মের ব্যাপার। এই জিজ্ঞাসা মানুষ যখনই তুলতে শেখে তখনই মানুষ রুহানিয়াতের পরিসরে প্রবেশ করতে শুরু করে। মানুষ নিজের কর্তাসত্তাকে নতুন করে সাজাবার বা তৈরির দায় গ্রহণ করে।
বিজ্ঞানের যে বিশাল উল্লম্ফন ঘটেছে তাতে সারা দুনিয়া বা আমাদের এই প্লানেটারি ব্যবস্থার যত্ন করা, প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা খুবই সহজে সম্ভব। বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের যে বিপুল বিকাশ তাতে সারা দুনিয়ার মানুষকে একটি সুন্দর, সুস্থ আনন্দময় জীবন দেওয়া মোটেও কঠিন না। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কেন? কারণ আমরা ধর্ম হারিয়ে ফেলেছি। আমরা শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়েছি। মানুষ তার সমাজকে মুনাফাকারী ব্যবস্থার ওপর দাঁড় করিয়েছে, পুঁজিকে আল্লাহ এবং পুঁজির ধর্মকেই মানুষ তার নিজের ধর্ম হিশাবে গ্রহণ করেছে। যে ধর্ম জিজ্ঞাসা আমাদের সবাইকে সুন্দর জীবন দেয় সেই প্রাচীন অথচ গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা দিয়ে এখনকার ধর্মকে আর চেনা যায় না। ধর্মের এখনকার রূপ অধর্মের রূপ।
তাহলে ধর্মকে তার এখনকার রূপ দেখে আর ধর্ম বলা যাবে না। কিন্তু আমাদের ধর্মে ফিরতে হবে। মানুষের রুহানি শক্তি আবিষ্কার করতে হবে। অর্থাৎ নিজের যত্ন নিতে হবে। প্রাচীন কালে ধর্মের যে অন্তর্নিহিত তাগিদ জীবনের সকল স্তরকে মানুষের উপযোগী করে সাজানো বা বিন্যাসের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবার চেষ্টা করেছে সেই ঐতিহ্যকে আমাদের নতুন ভাবে নতুন বাস্তবতায় নতুন করে আবিষ্কার করা দরকার। আমরা তা হারিয়ে ফেলেছি। সেই ঐতিহ্যের গোড়ার কথা হোল নিজের যত্ন নেওয়া, নিজের কর্তারূপের সন্ধান নেওয়া। নিজের দিকে তাকিয়ে বুঝতে হবে নিজের চেহারায় শয়তানের চেহারা দেখা যায়, নাকি মানুষের কোন আদল আছে বোঝা যায়?
বিজ্ঞানী হতে হলে আমাদের বিজ্ঞান শিখতে হয়, বিজ্ঞান চর্চা করতে হয়। আপসে আপ বিজ্ঞান আসে না, আমরা আবিষ্কার করতে পারি না। ঠিক তেমনি আমরা যদি নীতি নৈতিকতা আদর্শে বড় ও মহৎ হতে চাই তাহলে আমাদের নিজের প্রতি -- অর্থাৎ আমাদের মধ্যে যে ‘কর্তা’ বাস করেন তার প্রতি মনোযোগী হতে হবে, কর্তার যত্ন করতে হবে। নিজেকে নিজে শিক্ষা দেবার চর্চা প্রবল করতে হবে।
প্র: আপনার কাছে রমজান তাহলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মাস।
উ: অবশ্যই। এটা স্রেফ রহমতের মাস বললে কম বলা হয়। তিনি তো সদাই দয়াল। রাহমানুর রাহিম। রমজানে তাঁকে নতুন করে রহমান হতে হয় না। এটা রুহানিয়তের মাস। রোজা রাখুন, নিজের শরীর বা দেহের সঙ্গে আপনার রুহানি বন্ধনের মূল্য বুঝুন এবং নিজের – আপনার ‘আমি’ বা আপনার কর্তারূপের যত্ন করুন, সেখানে শয়তানের চেহারা না, মানুষের রূপ ফুটিয়ে তুলুন।
সিরাজ সাঁই কয়, লালন কানা
স্বরূপে রূপ দেখ সংক্ষেপে।