৫. বিএনপির 'রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা'


কিছুদিন আগেও আমরা প্রায়ই শুনতাম দল হিশাবে বিএনপি শেষ হয়ে গিয়েছে, একদিকে ভুল রাজনীতি এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা এবং অপরদিকে আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমখুন হাজার হাজার কর্মীকে কারাগারে নিক্ষেপ এবং লক্ষ লক্ষ কর্মীর মাথার ওপর মামলা ঝুলিয়ে রেখে তাদের ঘরছাড়া করা ইত্যাদি নানা কারনে বিএনপির পক্ষে আর জাতীয় দল হিশাবে দাঁড়ানো সম্ভব না, ইত্যাদি। এই সময় ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো গড়ে উঠেছিল এবং তাদের ছোট বড় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিস্ট শক্তি বিরোধী গণরাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু বিএনপির দিক থেকে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ যে উপাদান যুক্ত হয়েছে সেটা হচ্ছে বিএনপি তৃণমূল পর্যায়ে নিজেদের সংগঠিত করবার চেষ্টা করে গিয়েছে, তার ইতিবাচক ফল আমরা জেলা সমাবেশ এবং গোলাপবাগ সমাবেশে দেখেছি। গোলাপবাগ সমাবেশ গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক যা বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত রূপান্তরের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। বিএনপির এই সাফল্য এবং জাতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রত্যাবর্তনকে আমরা অভিনন্দন জানিয়েছি।

বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে যেসকল ইতিবাচক রূপান্তর ঘটেছে তাকে শুধু বিএনপির দিক থেকে বুঝলে চলবে না। ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিরোধী ছোট ছোট অনেক দলের অবদানও স্বীকার করতে হবে। যদিও এই দলগুলো এখনও পাশ্চাত্য লিবারেল রাজনীতির বাইরে বের হয়ে আসতে পারে নি। দ্বিতীয়ত ইসলাম প্রশ্ন মীমাংসা না করা এবং ইসলামি দলগুলোকে ফ্যাসিস্ট শক্তি বিরোধী আন্দোলনে শামিল না করারা বিপদ সম্পর্কে তারা একদমই সজ্ঞান নয়। এটা তাদের সেকুলার ইসলাম বিদ্বেষী রাজনীতির কারণে ঘটেছে। তাদের ধারণা ধর্মকে রাজনীতির বাইরে রাখলেই ল্যাঠা চুকে যায়।

সাধারণ ভাবে আমরা মনেকরি রাষ্ট্রসংক্রান্ত চিন্তাচেতনা বিকাশের প্রতি সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রহ বেড়েছে এবং রাষ্ট্রের ‘মেরামত’ বা ‘সংস্কার’ করবার দাবিও রাজনৈতিক পরিসরে উঠেছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র সংক্রান্ত চেতনা বুদ্ধিবৃত্তিক স্তর বা বিতর্ক থেকে ক্রমশ গণমানুষের রাজনৈতিক চেতনার স্তরে পৌঁছানোর চেষ্টা চলছে। আমরা রাষ্ট্র সংস্কারপন্থি না, আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে জনগণেই ইচ্ছা ও অভিপ্রায় অনুযায়ী নতুন ভাবে 'গঠন' করতে চাই। বাহাত্তরের সংবিধা প্রণয়নের সময় যে অধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা হয়েছে সেই অধিকারের বাস্তবায়ন চাই। কিন্তু তারপরও বিভিন্ন উদ্যোগের ইতিবাচক অবদান স্বীকার করতে আমামদের আদৌ কোন কুন্ঠা নাই।

ছোট ছোট রাজনৈতিক উদ্যোগগুলোর সাফল্য হচ্ছে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ মূহূর্তে তারা নিজেদের জাতীয় ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলতে পেরেছে। আমরা গণতন্ত্র মঞ্চ গঠনের পরপরই এর ইতিবাচক সম্ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছি। বাংলাদেশে গণরাজনৈতিক ধারা বিকাশের দিক থেকে বৃহৎ জাতীয় দলগুলোর বাইরে ছোট ছোট রাজনৈতিক দল বা জোটের ভূমিকা আগামি দিনগুলোতে আরও নির্ধারক হয়ে উঠবে বলে আমরা মনে করি।

কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রামের বাইরে বিএনপি ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া বৃহৎ জাতীয় দল হিশাবে কোন নতুন রাজনৈতিক চিন্তা সমাজকে দিতে পারে নি। এমনকি তাদের সাম্প্রতিক ‘রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা’তে তারা শিশুকিশোরদের কাছ থেকে আলংকারিক ভাষা (rhetoric) হিশাবে রাষ্ট্র ‘মেরামত’ করবার কথা বলেছে বটে, কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের পুরনা রেকর্ডই নতুন সুরে বাজাবার চেষ্টা করছে।

কিন্তু আমরা তত্ত্বের চেয়েও সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। তাই আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপিকে সমর্থন করা জরুরি মনে করি। কিন্তু জনগণের আত্মত্যাগ যেন এক লুটেরা ও মাফিয়া গোষ্ঠির হাত থেকে আরেক লুটেরা ও মাফিয়া গোষ্ঠির হাতে হস্তান্তরিত না হয় তার জন্য আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ের কঠোর পর্যালোচনা জরুরি।

বিএনপির মধ্যেও হয়তো ইতিবাচক রূপান্তর ঘটছে এবং ঘটতে বাধ্য। বিএনপি কোন বিপ্লবী দলে পরিণত হবে না। সেটা সম্ভবও না, আর আমরা তা প্রাণপণ চাইলেও তা হবে না। অতএব আমাদের বাস্তবোচিত হতে হবে। কিন্তু বিএনপিকেও নিজের শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিদেন পক্ষে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দল হিশাবে রূপান্তরিত হবার চেষ্টা করতে হবে। বাংলাদেশ আর পুরানা জায়গায় নাই। তারপরও বলব বিএনপির যতোটুকু রূপান্তর ঘটানো যায়, ততোটুকুই আমাদের লাভ। বাংলাদেশের বাস্তবতায় সেটাও বর্তমানের তুলনায় বিশাল বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটাতে সম্ভব ।

গণতন্ত্র মানে স্রেফ ‘নির্বাচন’ না, নির্বাচন গণতন্ত্র চর্চার গুরুত্বপূর্ণ দিক মাত্র। বাহ্যিক। নির্বাচনই গণতন্ত্র এই বুঝ শুধু বিএনপির না, বাংলাদেশের রাজনৈতিক চেতনার স্তর এখনও এই জায়গায় আটকে আছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় জীবন্ত গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ রূপ হচ্ছে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণ অভ্যূত্থান। গণতন্ত্র যদি জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় হয় তাহলে রাজনীতিতে সেটাই জনগণের অভিপ্রায় ও ইচ্ছার সর্বোচ্চ রূপ যখন ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাতের জন্য জনগণ অকাতরে রক্ত দিতে এবং শহিদ হতে তৈরি হয়ে যায়। নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র এই ভূয়া বকোয়াজগিরি আর তামাশা দিয়ে বাংলাদেশকে এখন ভোলানো কঠিন কাজ। এই জন্যই আমি আগে লিখেছিলাম বিএনপি আন্দোলন সংগ্রাম চায় না, এটা বিএনপির দুর্বলতা নয়, বরং বিচক্ষণতা। কারণ আন্দোলন-সংগ্রাম মানে বিএনপির নিজের রূপান্তর, জনগণের ইচ্ছার কাছে জবাবদিহি করা। সেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করে আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্বে বিএনপি থাকতে পারবে না। সেটা তাদের হাতেই চলে যাবে যারা জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় বাস্তবায়নে বদ্ধ পরিকর।

গণতন্ত্র রাষ্ট্রের একটি বিশেষ রূপ। সেই রূপ কায়েম করা গেলে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক গঠনের অধীনে নির্বাচন গণতন্ত্র চর্চার রীতি মাত্র। একই সাথে তখন নির্বাচন গণতন্ত্র সুরক্ষার পথও বটে। যেখানে গণতন্ত্র নাই, সেখানে নির্বাচন ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বৈধ করবার কৌশল। যেখানে বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রশক্তি এবং খোদ রাষ্ট্র ব্যবস্থাই ফ্যাসিস্ট সেই ক্ষেত্রে এই ফ্যাসিস্ট শক্তিকে গণশক্তির দ্বারা ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে বাংলাদেশকে নতুন ভাবে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে ‘গঠন’ (Constitute) করাই সবার আগে কর্তব্য।

বিএনপিকে তাহলে বুঝতে হবে ‘নির্বাচন’ নয়। সবার আগে গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে। বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিশাবে আগে ‘গঠন’ (Constitute) করতে হবে। এটাই এখনকার একমাত্র এবং প্রধান কাজ। বাকি নানাবিধ সংস্কার, কমিশন ইত্যাদি সবই গাধার সামনে মুলা ঝুলিয়ে রাখার ব্যাপার।

যদি নির্বাচনের কথাই শুধু বলি তাহলে শুধু জাতীয় নির্বাচন নয়, প্রশাসন ও শাসন ব্যবস্থার সকল স্তরে জনগণের ক্ষমতা চর্চার পদ্ধতি হিশাবে ‘নির্বাচন’ চালু করতে হবে।

প্রশাসন ও শাসন ব্যবস্থার সকল স্তরে নির্বাচিত গণপ্রনিধিদের দ্বরা রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পুরানা অঙ্গীকার। বর্তমান আন্দোলন-সংরামের মধ্য দিয়ে আমাদের অবশ্যই সেই অনুচ্ছেদকেও হালনাগাদ করতে হবে। ক্ষমতা ও প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এটাও মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ধ্বংসের ক্ষেত্রে বিএনপি অতীতে প্রকট গণবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। সামরিক শাসক হয়েও এরশাদ বিচার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ চেয়েছে, কিন্তু সেটাও সামরিক শাসন বিরোধিতার নামে নস্যাৎ করা হয়েছে। এরশাদ আমলে সকল রাজনৈতিক দল জাতীয় ওষুধ নীতির বিরোধিতা করে। দলীয় গুণ্ডারা ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল হামলা করে। সেই সকল ইতিহাস আমরা ভুলে যাই নি।

এটা এখন সকলেই স্বীকার করে ক্ষমতা ঢাকা শহর কেন্দ্রিক এক ব্যক্তির একনায়কী ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা হিশাবে রূপ লাভ করেছে। সামরিক একনায়কতন্ত্রের চেয়েও ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্র ভয়ংকর। কারণ সামরিক শাসনের গণভিত্তি থাকে না, কিন্তু ফ্যাসিস্ট শক্তি গণভিত্তি ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। ক্ষমতার এই বেসামরিক রূপ – অর্থাৎ রাজধানীকেন্দ্রিক ফ্যাসিস্ট বেসামরিক এবং সাংবিধানিক একনায়কতান্ত্রিক রূপকে অবশ্যই চুরমার করে দিতে হবে। বিপরীতে বিভিন্ন বিভাগে, জেলায়, উপজিলায় এবং গ্রামীন সমিতিগুলোর মধ্যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ গণতন্ত্র কায়েমের দিক থেকা এখনকার প্রধান কাজের একটি। অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট শক্তি ও কাঠামো উৎখাত করে রাষ্ট্রকে গণশক্তি চর্চার উপযুক্ত গণকাঠামোতে রূপান্তর করাই সবার আগে দরকার। এটাই গণতন্ত্র। গণতন্ত্র আগে, নির্বাচন পরে।

তাহলে গণতন্ত্র কায়েমের কথা না বলে নির্বাচনের দাবি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নিজেদের ফ্যাসিস্ট শাসক হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করবারই দাবি। বিএনপি এতকাল তাই করেছে, জনগণও সাড়া দেয় নি। কিন্তু বিএনপি জেলা সমাবেশ ও গোলাপবাগের সাফল্য অর্জনের পর এখনও পুরানা কাঁদুনি গাইতে থাকবে সেটা খুবই আফসোসের কথা। রাষ্ট্র এমন ভাবে গঠন করতে হবে যেন ক্ষমতা পরজীবী শক্তি হিশাবে রাষ্ট্র ও প্রশাসনের কোন স্তরেই জনগণের টুঁটি টিপে ধরতে না পারে। সেটাই গণতন্ত্র। সেটা কতোটুকু আদায় করা সম্ভব সেটা সমাজের সামগ্রিক রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ এবং জনগণের সাংগঠনিক শক্তি নির্মাণের ওপর নির্ভর করে।

তারপরও আমরা বার বারই বলছি, বিএনপি যতোদূর অর্জন করেছে আমরা ততোটুকু স্বীকার করি। কিন্তু বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখার মধ্যে পুরানা মদ নতুন বোতলে ঢুকাবার চেষ্টার আমরা কঠোর পর্যালোচনা জরুরি মনে করি। কারন এর সাথে জনগণের বাঁচামরারা প্রশ্ন – বিশেষত বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা না রাখার প্রশ্ন জড়িত। আশা করি বিএনপির নেতৃবৃন্দ আন্তরিক হবেন এবং বুঝবেন।

বিএনপির বোঝা দরকার তাদের বর্তমান জনপ্রিয়তার ভিত্তি ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান এবং কঠোর আন্দোলন সংগ্রাম। কিন্তু বিএনপির লক্ষ্য বা চাওয়া পাওয়ার সঙ্গে জনগণের আশা আকাংখার বিরাট পার্থক্য আছে। সেই আশা আকাংখাকে একাট্টা একরকম ভাবাও বোকামি। আগেই বলেছি, বিভিন্ন শ্রেণীর স্বার্থ একরকম নয়। নারীপুরুষের চাওয়া পাওয়ার মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু এই পার্থক্য আছে বলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বর্তমান লড়াইয়ে সমর্থন না করার কোন কারন হতে পারে না। কারন ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের প্রশ্নে জনগণ বিএনপির ডাকে একাট্টা হচ্ছে। জাতীয় রাজনীতির এটাই বর্তমান বাস্তবতা। এখান থেকেই আমাদের পরবর্তী স্তরে পৌঁছাতে হবে। আন্দোলনের নীতি ও কৌশল পর্যালোচনা করেই সেই স্তরে আমাদের পৌঁছাতে হবে।

বিএনপির কাছে এখন তাহলে কিছু বিষয় প্রশ্ন হিশাবে হাজির হয়েছে। সেটা হোল, বিএনপির নেতৃত্বের কাছে তাদের ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ কি নিছকই কৌশলগত অবস্থান? নীতিগত কিছুই না? গণতন্ত্র কায়েম কি তাদের উদ্দেশ্য না? তারা কি শুধু ক্ষমতায় যেতে চায় এবং বিদ্যমান সংবিধান খানিক সংস্কার করে কার্যত সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্রের আরাম এবং একচ্ছত্র ক্ষমতা নিজেরাও ভোগ করতে চায়? এরশাদ বিরোধী গণঅভ্যূত্থান নস্যাৎ করার পুরানা কৌশল ছিল সংবিধান খানিক সংস্কার করে এক ব্যাক্তির হাত থেকে ক্ষমতা আরেক ব্যক্তির হাতে হস্তান্তর করা। বিএনপিও কি তাই চাইছে? এটা কি পুরানা মদ নতুন বোতলে হাজির করা? এরশাদ বিরোধী ত্রিদলীয় জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে বিদ্যমান সংবিধান ও রাষ্ট্র কাঠামোর কোন পরিবর্তন না করে একজন ব্যাক্তিকে শুধু ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হয়েছিল। তার ফল আমরা এক এগারো এবং বর্তমান ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার অধীনে থেকে যারপরনাই ভোগ করছি। পার্থক্য হচ্ছে এখন একজন ব্যাক্তি নয়, একটি রাজনোইতিক দলকে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে অপ্সারণের কথা উঠেছে এবং জঙ্গণ সাড়া দিচ্ছে। বিএনপির অবস্থান বা ভূমিকার যে পর্যালোচনা আমরা করছি তা এখনই আমরা স্পষ্ট বুঝব না। কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর দ্বন্দ-সংঘাত এবং আন্দোলনের গুণগত রূপান্তর ক্রমেই সেটা স্পষ্ট করে তুলবে। বাস্তবতা অচিরেই বোঝা যাবে।

যারা বিএনপির খসড়া করেন তাদের বোঝা উচিত যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা আর ক্ষমতাসীনদের আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে ‘অপসারণ’ করে নতুন জাতীয় সরকার গঠন সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন ধারণা। কিন্তু বিএনপি যেভাবে কথাগুলো তোলে এবং তাদের বিভিন্ন লিখিত বক্তব্যে হাজির করে তাতে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এই ধারণাই তৈরি হয় যে তারা তাদের পুরনা অবস্থান থেকে সরে আসে নি। বিএনপি কি চায় সেই বিষয়েও সন্দেহ তৈরি হয়।

তবে আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শক্তি ‘অপসারণ’ এবং জাতীর সরকারের প্রস্তাব বড়সড় অগ্রগতি। জনগণ আর্থ-সামাজিক ও ফ্যসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল বদল চায়, নিদেন পক্ষে ‘মেরামত’ তো বটেই। কিন্তু বিএনপি এখনও একই ধারণাই দিচ্ছে যে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে আন্দোলনের মাধ্যমে ‘অপসারণ’ – অতোটুকুই। সেই অপসারণে সব দল যুগপৎ বা যৌথ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের সহায়তা করুক বিএনপি সেটা চায়। কিন্তু জাতীয় সরকার হবে কার্যত বিএনপির। নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনের ছাঁকনি দিয়ে গণভ্যূত্থানের সহযোগীদের বিএনপি কার্যত বাদ দেবে। বাদ দিয়ে বিএনপি একাই সরকার গঠন করতে চায়। অর্থাৎ বিএনপি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্ববধায়ক সরকার বানাবে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচিতদের নিয়ে গঠিত হবে ‘জাতীয় সরকার’।

একটি সম্ভাব্য বিজয়ী গণঅভ্যূত্থানের পরও বিএনপি নতুন ভাবে বাংলাদেশ গঠন করতে চায় না। বরং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা পুনর্বহাল ও অক্ষুন্ন রেখে, শুধু এখানে ওখানে টুটাফাটা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চায়। এর অতিরিক্ত বিএনপির নেতৃত্ব কোন গণমুখী চিন্তা করতে পারছে না।

এটা বাংলাদেশের জন্য শুধু না, বিএনপির জন্যও বিপজ্জনক। কিন্তু তারপরও বিএনপির যে কোন ইতিবাচক রূপান্তরকে আমরা প্রশংসা করতে চাই। যেমন বিভিন্ন ছোট ছোট দলের সঙ্গে কথাবার্তা-আলোচনা চালিয়ে যাওয়া এবং তাদের দাবিদাওয়া যুগপৎ বা যৌথ আন্দোলনের স্বার্থে যতোটুকু সম্ভব গ্রহণ করা। পরের কোন কিস্তিতে সেই সকল বিষয়ে আমরা আলোচনা করব।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।