খরতাপ: বেশি উন্নয়ন ও কম পরিবেশ ধারণার পরিণাম


যে উন্নয়নের জন্যে পরিবেশ বিসর্জন দেয়া হয়েছে সেই উন্নয়ন ধরে রাখাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। প্রায় শতভাগ ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু এখন গ্রামেগঞ্জে বিদ্যুতের লাইন আছে বটে কিন্তু তাতে সরবরাহ নিয়মিত নাই। এরই আরেক নাম লোডশেডিং। সারাদেশে এই খরতাপের মধ্যে ঘরে লাগানো ফ্যানটিকে ঘুরতে দেখার প্রত্যাশায় কেটে যাচ্ছে দিনরাত। বিদ্যুৎ যাচ্ছে যতবার, আসছে তার চেয়ে অনেক কম।

চৈত্র-বৈশাখ থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত চলে গ্রীষ্মকাল। কাজেই গরম পড়বে, তাপমাত্রা বেশি থাকবে এই বিষয় নিয়ে অবাক হবার কিছু নেই। এই সময় খরার মৌসুম, তাই প্রকৃতিতে ফসলের মৌসুমও সেভাবে ভাগ করা আছে। আউশ ধান খরাতেই হয়, সে কারণে খরাপ্রবণ এলাকায় আউশ ধানের চাষও খুব ভাল হয়। অন্যদিকে খরা এবং গরমের মৌসুমেই হয় আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুর মত মিষ্টি এবং রসালো ফল। ঠিক মতো গরম আবহাওয়া না হলে এই ফলগুলো যথেষ্ট মিষ্টি হয় না, কেমন জানি পানসে স্বাদ হয়। তাই এই খরতাপের প্রয়োজনীয়তাও কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না।

প্রকৃতির নিয়মের সাথে গরম বা শীত এবং বৃষ্টি আমাদের সকলেরই কাম্য। কিন্তু আমরা কি লক্ষ্য করছি না যে বিগত দুই-তিন দশকে প্রাকৃতিক মৌসুম আমরা পাচ্ছি না? ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ; ছয় ঋতু না হোক তিনটি মৌসুম যথাসময়ে এবং যথানিয়মে হচ্ছে না । বিশেষ করে বৃষ্টির বিষয়ে কোন প্রকার আগাম পরিকল্পনা করা যাচ্ছে না। বৃষ্টি আমাদের সব ধরণের ফসলের জন্য দরকার। এবছরের চৈত্র-বৈশাখের গরম এ পর্যন্ত স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল। এ পর্যন্ত ঢাকা সহ বিভিন্ন জেলায় ৪১ থেকে ৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। এবং এই পর্যায়ের তাপমাত্রা এক-দুইদিন নয়, টানা দুই সপ্তাহ চলেছে। তার চেয়ে দুই এক ডিগ্রী অনুভূতও হয়েছে বেশি । আগামি সপ্তাহের মধ্যে তাপমাত্রা কমবে কি-না তার কোন আভাস এখনো নেই। যতোদূর দেখা যাচ্ছে বড়জোর ৩৪ ডিগ্রী পর্যন্ত নামতে পারে।

খরতাপ, দাবদাহ বা তাপদাহ যাই বলি না কেন, এই প্রবণতা আগামী দিনে আরো বাড়বে বই কমবে না। বৈশ্বিক উষ্ণতা যতো বাড়ছে আমাদের দেশে তার প্রভাব পড়ছে ক্রমাগতভাবে। বিগত বছরগুলো থেকে দেখে আসছি, এই বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার জন্যে সামান্য অবদান রাখছে বলে উষ্ণতার প্রভাব বাংলাদেশের ওপর আনুপাতিক হারে কম হচ্ছে না, বরং বেশি হচ্ছে। মাত্র ০.৪৭% বৈশ্বিক উষ্ণতায় অবদান রেখেও আমরা এই জলবায়ু পরিবর্তনের একটি ভুক্তভোগী দেশ।

প্রতি বছর আন্তর্জাতিভাবে বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানরা একত্রিত হন জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে, কিন্তু ধনী দেশগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস, বিশেষ করে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমাতে রাজি হচ্ছে না। ফলে বায়ুমণ্ডল উষ্ণতর হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে বসে গ্রীষ্ম উত্তপ্ত হতে দেখছি বছরের পর বছর।

বৈশ্বিক উষ্ণতায় অবদান কম বলেই কি এই খরতাপ বৃদ্ধিতে আমাদের দেশের নিজস্ব কোন অবদান নেই? শুধু বাইরের দেশের দোহাই দিলে মূল সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়া হবে। আমরা উন্নয়ন চাই, কিন্তু এর সাথে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি গৌণ করে দেয়া হচ্ছে। উন্নয়নের জন্যে গাড়ির সংখ্যা বাড়াচ্ছি, দালানকোঠা যত উঁচু করা যায় করছি, রাস্তা-হাইওয়ে চার লেন ছয় লেন করতে গিয়ে দুপাশের গাছগুলো নির্দয়ভাবে কাটছি, পাহাড় কেটে সমান করে দিচ্ছি। আমরা পাহাড়ের আদি স্থানীয় জাতের গাছ কেটে তামাক চাষ করছি, বেশি আয়ের লোভে। এক একটা দ্রুত বর্ধনশীল গাছ লাগাচ্ছি বনায়নের নামে। আধুনিক কৃষির মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে মাটির তলার পানি তুলতে তুলতে এখন তার স্তর ক্রমশঃ নেমেই যাচ্ছে। টিউবওয়েলগুলোতে পানি উঠছে না। সার-কীটনাশক দেদার ব্যবহার করে পরিবেশ বিষাক্ত হচ্ছে। থাকছে না কোন প্রাণবৈচিত্র্য। দেশের উন্নয়নের সাথে দেশের পরিবেশ পেছনের সীটে স্থান পাচ্ছে। তার দিকে নজর দেয়া হচ্ছে না। তাই সে গরম হয়ে উঠছে।

তাপমাত্রার বৃদ্ধি চল্লিশ ডিগ্রীর ওপর উঠেছে এ বছরই শুধু নয়, ২০২১ সালের এপ্রিল মাসেও ৪১.২ ডিগ্রী (১০৬.২ ডিগ্রী ফারেনহাইট) রেকর্ড হয়েছিল, যা সেই সময়ের ৭ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু এ বছর কিছু কিছু জেলা যেমন চুয়াডাঙ্গা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪২.২ ডিগ্রী, যশোরে ছিল ৪১.৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস।

গত ৭ দিন একনাগাড়ে তাপমাত্রা অনেক বেশি ছিল। পয়লা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল) থেকে শুরু করে ৩ দিন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল, তারপর কমে ৩৬ ডিগ্রি পর্যন্ত এসেছে। কিন্তু মানুষের কোন স্বস্তি আসেনি। গতকাল (২০ এপ্রিল) ঢাকার তাপমাত্রা একটু কমলেও বিভিন্ন জেলাতে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত রয়ে যায়, ঈশ্বরদী ও চুয়াডাঙ্গায় ৪২ ডিগ্রী মার্কারি উঠে। যদিও কোথাও কোথাও বৃষ্টি, দমকা হাওয়া, ঝড়ো বৃষ্টিরও পূর্বাভাস দিচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। পত্রিকাগুলো এটাকে সুখবর হিসেবে শিরোনাম করছে।

এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির যে প্রভাব মানুষের এবং পশুপাখির জীবনে পড়ছে তা নিয়ে সার্বিকভাবে কোন সরকারি নির্দেশনা দেখা যাচ্ছে না। পত্রিকার যে উৎকণ্ঠা তা বিশেষভাবে মানুষ কেন্দ্রিক। অসুস্থতা, জীবন-জীবিকার অসুবিধা ইত্যাদির ওপর প্রতিবেদন করা হয়। হিট স্ট্রোক, ডায়রিয়া, জ্বর ইত্যাদি নিয়ে রোগীরা ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে। শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে নানা রোগে। ফসলের কথাও আসছে। রিপোর্ট আসছে লিচু, কাঁচা আম ঝরে পড়ছে। এসবই মানুষের জন্য।

কিন্তু যে খবর পত্রিকায় স্থান পাচ্ছে না তা হচ্ছে পশুপাখিদের কি অবস্থা? গরু-ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি, কবুতর, চড়ুই পাখিসহ নানা রকম পাখি, কাক, কুকুর, বেড়াল- তাদের কি এই তাপমাত্রায় কষ্ট হচ্ছে না? নিশ্চয়ই হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো নিয়ে কোন প্রতিবেদন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। আমি ধন্যবাদ জানাই মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউটকে। তারা পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছেন তাপ প্রবাহে প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় করণীয় শিরোনামে। এই গরমে গরু-ছাগল এবং পোল্ট্রির জন্যে তারা বিশেষ কয়েকটি ব্যবস্থার নির্দেশনা দিয়েছেন। এই নির্দেশনা গরু-ছাগল এবং পোল্ট্রি খামারিদের কাজে লাগবে সন্দেহ নেই। কিন্তু এখানেও মানুষের খাদ্য হিসেবে মাংস সরবরাহে যেন কোন ঘাটতি না হয় সে বিবেচনাটি বেশি কাজ করেছে।

অথচ গ্রামের চিত্র কিন্তু ভিন্ন। গ্রামের কৃষকের বাড়িতে পশু-পাখির জন্য পানির ব্যবস্থা রাখা হয়। পাখির জন্যে মাটি বা অন্য যেকোন পাত্রে পানি রেখে এখানে সেখানে রেখে দেয়া হয় যেন পিপাসায় তারা কষ্ট না পায়। কৃষকের জন্য তার বাড়ির গরু-ছাগলক, হাঁস-মুরগি তার সন্তানের মতো। তারা সবাই কৃষকের পরিবারের সদস্য। কাজেই তারা পশুপাখির কষ্ট নিজেরা অনুভব করেন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এই কাজ সব এলাকায় করা যাচ্ছে না। জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে, নদী শীর্ণ আকার ধারণ করেছে, খালবিলগুলোতে পানির বড় অভাব। ঈশ্বরদী এবং অন্যান্য এলাকায় পানি নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে।

যে উন্নয়নের জন্যে পরিবেশ বিসর্জন দেয়া হয়েছে সেই উন্নয়ন ধরে রাখাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। প্রায় শতভাগ ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু এখন গ্রামেগঞ্জে বিদ্যুতের লাইন আছে বটে কিন্তু তাতে সরবরাহ নিয়মিত নাই। এরই আরেক নাম লোডশেডিং। সারাদেশে এই খরতাপের মধ্যে ঘরে লাগানো ফ্যানটিকে ঘুরতে দেখার প্রত্যাশায় কেটে যাচ্ছে দিনরাত। বিদ্যুৎ যাচ্ছে যতবার, আসছে তার চেয়ে অনেক কম। শহরে উন্নয়নের একটি লক্ষণ হচ্ছে ঘরে ঘরে এয়ার কন্ডিশনার (এসি) থাকা। এবারের এই দীর্ঘ তাপদাহের সময়ে এসি বিক্রেতারা ভাল ব্যবসা করতে পেরেছেন।

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে এপ্রিলে এসি বিক্রি গত বছরের তুলনায় ২ থেকে ৪ গুণ বেশি বেড়ে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে যেখানে দিনে ১০০০ এসি বিক্রি হোত সেখানে ৩৫০০ থেকে ৪০০০ এসি বিক্রি হচ্ছে। এই তথ্য একটি কোম্পানির। অন্যান্য কোম্পানিরও বিক্রি অনেক বেশি। একই সাথে এসির দাম এক বছরে বেড়েছে ১৫% থেকে ২০। মধ্যবিত্তরা ঘরে অন্তত একটি রুমে এসি লাগিয়ে গরমের কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করছেন।

কদর বেড়েছে হাতে তৈরি তালপাতা, বাঁশবেত, কাপড়ের বানানো হাতপাখারও। গরিব মানুষ এবং যারা বিদ্যুতের ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না, হাতপাখাই তাদের সহায়।

গরম বাড়ছে এবং আরও বাড়বে। আসুন একটু আমাদের চিন্তা পাল্টাই। শুধু উন্নয়ন নয়, পরিবেশ রক্ষায়ও সচেষ্ট হই।

 

বিশেষ দ্রষ্টব্য

এই লেখাটি ২১ এপ্রিল, ২০২৩ তারিখে 'খরতাপ: বেশি উন্নয়ন ও কম পরিবেশ ধারণার পরিণাম' এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে

 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।