নির্বাচন বনাম 'গঠন'


এক

জাতীয় ইনসাফ কমিটি গত ১৬ মার্চে তাদের প্রস্তাবনায় বাংলাদেশ নতুন ভাবে ‘গঠন’ করবার প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। বাংলাদেশে চিন্তার দুর্ভিক্ষ এতোই প্রবল যে দৈনিক পত্রিকাগুলো গণরাজনৈতিক সত্তা হিশাবে রাষ্ট্রের ‘গঠন’-কে স্রেফ আইনী ব্যাপার ধরে নিয়েছে। তাদের রিপোর্টে সকলেই লিখেছে আমরা নাকি নতুন সংবিধান চাইছি। অথচ আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলেছি। বলেছি, রাষ্ট্র স্রেফ ‘আইনী’ প্রতিষ্ঠান নয় যে উকিল-ব্যারিস্টারদের ধরে এনে একটি টুকলিফাই সংবিধান লিখে নিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। এই ধরনের ধ্যান ধারনা কলোনিয়াল হ্যাঙ্গওভার। ইংরেজের শাসন করবার দরকার হয়েছে, তাই তারা একটা 'শাসনতন্ত্র' বানিয়েছে। আগে আমরা 'শাসনতন্ত্র'-ই বলতাম। একাত্তরের পর আমাদের ইতিহাসবোধ ও রাজনৈতিক সচেতনতা আরও কয়েক ডিগ্রি ক্ষয় হয়েছে। 'শাসনতন্ত্র' না  বলে আমরা তাকে বানিয়েছি সংবিধান। উপনিবেশোত্তর দেশ হিশাবে আমরা এখনও কলোনিয়াল হ্যাঙ্গওভার কাটিয়ে উঠতে পারি নি। তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিভাবে ‘গঠিত’ হয়, জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ধারণ করবার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কী, এবং সেই ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে জনগণ কিভাবে পরস্পরের সঙ্গে আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আত্মিক ও আইনী সম্পর্ক গড়ে তুলবার জন্য গণ পরিষদ বা ‘রাষ্ট্র গঠন সভা’ (Constituent Assembly) আহ্বান করে এবং সকলে মিলে তর্কবিতর্ক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ন এবং রাষ্ট্র 'গঠন' করে  -- রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে নিজেদের পরিগঠন করবার এই সকল প্রক্রিয়া আমরা জানি না। রাজনীতি আমাদের এই সকল অতি জরুরি প্রাথমিক শিক্ষা দেয় নি। আমরা রাজনীতির সেই সকল সহজ বর্ণ শিক্ষার কথাই শুধু নতুন ভাবে বলেছি। মর্মের দিক থাকে নতুন কিছু বলি নি। আফসোস বাংলাদেশে রাজনীতি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে কোন পরিণত ধারণা গড়ে ওঠে নি।

নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে ‘গঠন’ করবার ধারণা অনেক বড়, ব্যাপক ও গভীর। তদুপরি স্বাধীনতা অর্জন যে যথেষ্ট না, রাষ্ট্র যে ‘গঠন’ করতে হয় এই ফারাক আধা শতক পার হয়ে যাবার পরেও আমরা জানি না। আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সব পড়ানো হয় না। সংবাদপত্রের লেখালিখি কিম্বা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্যে রাজনীতি ও রাষ্ট্র নিয়ে কোন দরকারি আলোচনা নাই বললেই চলে। যদি থাকত তাহলে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম রেখে ভোটের অধিকার চাওয়া যে নিস্ফল সেটা আমরা সহজে বুঝতাম।
( এখানে জাতীয় ইনসাফ কমিটির প্রস্তাবনা পড়ুন)

জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি এই গোড়ার কথাগুলোই সকলকে মনে করিয়ে দিতে চাইছে। বাংলাদেশ 'গঠন' করতে হবে, আমাদের সবার আগে রাজনোইতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে 'গঠিত' হতে হবে। তারপর নির্বাচন ও স্বশাসন, ইত্যাদি। গোড়ার কথা গুলোই আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই। ভোট অবশ্যই চাইব, কিন্তু তার আগে ফ্যসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত করে জনগণের গণতান্ত্রিক অভিপ্রায়কে মূর্ত বা বাস্তব রূপ দেওয়া  দরকার। গণতন্ত্র থাকলে নির্বাচন মানে গণতন্ত্রের চর্চা। কিন্তু যেখানে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা জারি রয়েছে সেখানে নির্বাচন মানে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা চর্চা। যার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ন্যায্যতা দেওয়া হয়। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত না করে ভোটের অধিকারের দাবি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই বৈধতা দেয়। আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত জনগণের সকল মানবিক অধিকারের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ‘গঠন’ সবার আগে জরুরি। সেই নবগঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত সকল মানবাধিকার বাস্তবায়নে সক্ষম, বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা নয়। জনগণকে পরিষ্কার একথাগুলো বলাই আমাদের কাজ।

এই সকল সহজ সাধারণ সত্য সম্পর্কে আমাদের সমাজে সচেতনতার মাত্রা খুবই কম। কা্রণ আমরা শুধু নির্বাচনকেই ‘গণতন্ত্র’ মনে করি। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় নির্বাচন আন্তর্জাতিক ভাবে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা ‘বৈধ’ করার প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার বিকৃতি প্রবল। রাষ্ট্রের বিশেষ রূপ হিশাবে গণতন্ত্র -- অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বাস্তবায়নে সক্ষম রাষ্ট্র ব্যবস্থা কিভাবে ‘গঠন’ করতে হয় সেটা জনগণকে বোঝানোটাই দুঃসাধ্য কাজ হয়ে পড়েছে। এটাই বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে গোড়ার এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এই অজ্ঞতা ও রাজনৈতিক অসচেতনতার কারণে গণতন্ত্রকে স্রেফ এক লুটেরা শ্রেণি বা গোষ্ঠির পরিবর্তে আরেক লুটেরা শ্রেণি বা গোষ্ঠিকে চার পাঁচ বছর পর পর নির্বাচিত করে আমাদের নতুন করে লুট ও শোষণ করবার ব্যবস্থা আমরা বানিয়ে রেখেছি। দারুন এক ব্যবস্থা! এই অবস্থার অবসান হওয়া দরকার।

গণতন্ত্রে নির্বাচন লাগবে, সেটা তর্কের বিষয় নয়। কিন্তু আগে গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে। জনগণের প্রতি ইনসাফ কায়েমের এটাই সরল পথ, এটাই প্রথম রাজনৈতিক সবক।

তাই আমরা বলেছি, “জনগণের বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তবর্তী সরকারের কাজ হবে বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় অনুযায়ী একটি নতুন ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ণের  কাজে হাত দেওয়া। ‘গঠন’ থেকে ‘গঠনতন্ত্র’। অর্থাৎ গণতন্ত্র কায়েম মানে বাংলাদেশকে নতুন ভাবে 'গঠন' করবার কাজ। গঠন করবার  কাজ সবার আগে, তারপর নির্বাচন। গণতন্ত্র কায়েম একটি গাঠনিক (Constitutive) প্রক্রিয়া। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় জনগণকেই প্রকাশ করবার সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ তৈরি করতে হবে সবার আগে। কি ধরণের রাষ্ট্র বর্তমান আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বাস্তবতায় জনগণ গড়তে চায় সেটা জনগণই পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা তর্ক বিতর্কের মধ্য দিয়ে নির্ণয় করবে। আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের বিজয়ী গণভ্যূত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হবে এই প্রক্রিয়াকে আরও জোরদার করা।

নিজেদের কোন মনগড়া সিদ্ধান্ত নয়, জনগণ তাদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কি ধরণের রাষ্ট্র ‘গঠন’ করতে চায় সেই ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে আন্তরিক ভাবে জাতীয় পর্যায়ে তুলে আনতে হবে। ‘গঠন’ করবার  কাজের পরিকল্পনা, কাজ এবং  কাজের প্রক্রিয়া থেকে তৈরি দলিলকেই ‘গঠনতন্ত্র’ (Constitution) বলা হয়। গঠনতন্ত্রে জাতীয় সংসদ কিভাবে আইন প্রণয়ন করতে পারে, কিভাবে বিচার ও প্রতিরক্ষা বিভাগ ‘গঠনতন্ত্র’ রক্ষা করে, কিভাবে নির্বাহী বিভাগ রাষ্ট্রের দৈনন্দিনের কাজ পরিচালনা করে ইত্যাদি বিষয়ে জনগণের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকে।

কিন্তু ফ্যাসিস্ট শক্তির বানানো সংবিধানকে এখন যেভাবে ‘সর্বোচ্চ’ আইন বলে দাবি করা হয় জনগণের তৈরি 'গঠনতন্ত্র' মানে সেটা মোটেও না। হতে পারে না। যেমন, জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট’ পাশ করলেই সেটা ‘আইন’ হয়ে যায় না। অর্থাৎ জাতীয় সংসদ চাইলেই  তাদের সিদ্ধান্তকে ‘আইন’ দাবি করে ঔপনিবেশিক শাসকদের মতো জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না। ফ্যাসিস্ট শক্তির আইন জাতীয় সংসদে পাশ হয়েছে বলেই সেটা আইন নয়, সেটা আইন হয়ে যায় না। জনগণ ফ্যাসিস্ট আইন মানতে বাধ্য নয়। কারণ তা জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। গঠনতন্ত্র হোল জনগণ যে ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে নিজেদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে ‘গঠন’ করেছে কোন আইন দ্বারা সেই ‘গঠন’-কে নস্যাৎ করা যাবে না। রাষ্ট্র গঠনের নৈতিক ও আদর্শিকভিত্তিকে নস্যাৎ করা যাবে না। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে নস্যাৎ করবার যে কোন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে জনগণের বিদ্রোহ, প্রতিরোধ বা গণঅভ্যূত্থান সে কারণেই আইন ও রাষ্ট্রতত্ত্বে বৈধ বলে স্বীকৃত ও গৃহীত। তাই জনগণের বিজয়ী গণভ্যূত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হচ্ছে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে নিজেদের গঠনের প্রক্রিয়াকে সবল ও গতিশীল করে তোলা। ত্বরান্বিত করা। জনগণ যেন তাদের বাস্তব সমস্যার সমাধান বাস্তবোচিত ভাবে হাজির করতে পারে তার প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা নিশ্চিত করা। বিজয়ী গণঅভ্যূত্থান সফল হলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ তাই প্রতিটি ইউনিয়নে, প্রতিটি উপজেলায় প্রতিটি জেলায় জনগণ কিভাবে নতুন বাংলাদেশ গঠন করতে চায় তার পরামর্শ আন্তরিকতা ও মনোযোগের সঙ্গে শোনা। রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় সমাজের সকল স্তরের জনগণকে অবশ্যই সম্পৃক্ত করা।

জনগণই গণতন্ত্রের ভিত্তি। রাষ্ট্র নয়, জনগণই সার্বভৌম -- জনগণকে অবশ্যই তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা  ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের কবল থেকে উদ্ধার করতে হবে। গণআন্দোলন, গণসংগ্রাম ও গণঅভ্যুত্থান ছাড়া বাংলাদেশের জনগণের সামনে আর কোন বিকল্প নাই।

আমরা বলেছি নতুন ভাবে বাংলাদেশ ‘গঠন’ একটি সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া। স্রেফ আইনি বা সাংবিধানিক ব্যাপার না। অতীতে উকিল-ব্যারিস্টারদের মুসাবিদাকে বাংলাদেশের ‘সংবিধান’ হিশাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ধরণের কাজ কলোনিয়াল বা ঔপনিবেশিক শক্তি করে। কারণ তারা তাদের তৈরি আইন বা সংবিধান জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়। তাই ‘গঠন’ মানে যে একখানা সংবিধান লিখে দেওয়া নয়, এটা সংবাদ মাধ্যমগুলো বোঝে নি। অসুবিধা নাই। আমরা তাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। কারন এর জন্য তারা একা দায়ী নয়, বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতই প্রধানত দায়ী।

তাহলে একটা কথা পরিষ্কার থাকা ভাল। না, আমরা স্রেফ পুরানা সংবিধানের জায়গায় আরেকটি নতুন ‘সংবিধান’-এর কথা বলছি না, আমরা আরও গোড়ায় গিয়ে বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠন করবার (Constitute) কথা বলছি।

দুই

মনে রাখা দরকার জনগণ বলতে সুনির্দিষ্ট ভাবে আমরা বুঝিয়েছি যারা ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়ছে, রক্ত দিচ্ছে, শহিদ হয়েছে। বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে উৎখাত করাই যাদের ইচ্ছা। তাহলে জনগণ নামক কোন আলুর বস্তা আমরা অনুমান করি নি, কিম্বা প্রচলিত রাজনীতিতে জনগণকে যেভাবে স্রেফ ভোটের সংখ্যা বানানো হয় এবং কেনাবেচা চলে, জনগণকে আমরা এরকম হীন গণ্য করি না। গণতন্ত্র এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে ফারাক পরিষ্কার দেখিয়ে দেওয়ার ওপর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। জনগণের বিজয়ী অভ্যূত্থানকে অবশ্যই ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে গোড়াসুদ্ধ উপড়ে ফেলতে হবে, কোন প্রকার ছল চাতুরি, প্রতারণা বা অন্তঃসারশূন্য গণতন্ত্রের নামে আবার  যেন কোন্দিন ফিরে আসতে না পারে।

এই আলোকেই বাংলাদেশকে নতুন ভাবে ‘গঠন’ কথাটা বুঝতে হবে। ধরুন আপনি একই ঘরে সকলে মিলে বাস করবেন, আমাদের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা, সাংস্কৃতিক বোধ, ধর্ম ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু একসঙ্গে বাস করতে হলে পারস্পরিক সম্বন্ধ নির্ণয়ের জন্য আমাদের অবশ্যই কিছু মৌলিক, আদর্শিক ও গাঠনিক বিষয়ে সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিতে  হবে। নিতে শিখতে হবে। এটাই রাজনৈতিক শিক্ষা। না পারলে একসঙ্গে থাকা যাবে না। একে ফরাসি দার্শনিক জাঁ জ্যাক রুশো গণ অভিপ্রায় (General Will) বলেছিলেন। আজকাল বাংলাদেশে অনেকে হয়তো ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ বলে এই সমঝোতাই বোঝাতে চান। বিভিন্ন বিষয়ে পার্থক্য বা মতভেদের সুযোগ থাকলেও অবশ্যই সমাজের বৈষয়িক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক, আত্মিক এবং আইনী বিষয়ে সকলকে যথাসম্ভব একমত হবে। ব্যর্থ হলে এখনকার বাংলাদেশের মতো একটা গৃহযুদ্ধ জারি থাকবে।

জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায় নির্ণয় করা একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এটা আমার মত বা আমার বুঝ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেবার ব্যাপার না। সেখানে আপোষের দরকার আছে এবং বিতর্কিত ইস্যুগুলো নিয়ে আমরা কিভাবে পরস্পরের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাব তার বিধি বিধান মেনে নেওয়ার বিধান নির্ণয়ও নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে গঠনের পূর্বশর্ত। যে কারণে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা সহ মত প্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের অ আ ক খ মনে করে স্বীকার করে নেওয়া হয়। কিন্তু যদি কেউ দাবি করে আমরা নতুন করে সংবিধান লিখে দিলাম এই সংবিধান কেউ সমালোচনা করলে সেটা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে – তাহলে সেটা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র। শুধু তা নয় বাংলাদেশে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিশাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট। এই রাষ্ট্র উৎখাত করে নতুন ভাবে বাংলাদেশ গঠন করা ছাড়া বাংলাদেশের জনগণের সামনে আর কি পথ খোলা আছে? নাই।

তাই নির্বাচন নির্বাচন করবেন না। আমাদের ভোটের অধিকার আদায়ের কেচ্ছা শোনাবেন না। বুঝলাম ভোটের অধিকার দরকার আছে। সেটা আপনার দরকার থাকতে পারে, কারণ আপনি ক্ষমতায় গিয়ে এই ব্যবস্থাই বহাল রাখতে চান। কিন্তু ‘অধিকার’-ই যদি চান তাহলে দেখুন জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারের লিস্টি অনেক বড়। সেই অধিকার আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত, আন্তর্জাতিক আইন। যে সকল সার্বজনীন আইন দুনিয়ার সকল মানুষের অধিকার হিশাবে জাতিসংঘ মেনে নিয়েছে - যে সকল অধিকার আমাদের এমনিতেই পাবার কথা -- আসুন তার জন্য লড়ি। সেই সকল অধিকার বাদ দিয়ে শুধু ভোট ভোট বলে হৈ হুল্লোড়ের কি আছে? প্রশ্ন তুলুন সেই সকল অধিকার এতোদিন পাই নি কেন? পাবো না কেন?

কারন আমরা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারগুলোর কথা তুলি নি, ভোট পাবার জন্য মিথ্যা প্রতিশ্রুতির লম্বা লম্বা ফর্দ হাজির করছি। আগে রাষ্ট্র ঠিক করেন, রাষ্ট্র বানান, বাংলাদেশকে নতুন ভাবে ‘গঠন’ করবার কথা বলুন। জনগণ আপনার পেছনেই জড়ো হবে।

যারা ভোটের অধিকারকে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত অন্যসকল মানবাধিকারের বাস্তবায়নের প্রশ্ন উহ্য রেখে বিচ্ছিন্ন ভাবে তোলে , সারাক্ষপণ 'ভোট, 'ভোট' করে -- তাদের সম্পর্কে াবধান থাকবেন। আশা করি সকলে ভেবে দেখবেন। ক্ষমতায় যাবার জন্য এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী করবার ছল চাতুরি বাংলাদেশের জনগণ মেনে নেবে না।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।