বিপ্লবী নবী

মওলানা আবদুল কাদির আজাদ সুবহানি (১৮৯৬-১৯৬৩) ছিলেন বিখ্যাত রব্বানি দর্শনের প্রবক্তা। তিনি আল্লামা আজাদ সুবহানি নামে অধিক পরিচিত। ইসলামের নবি রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসালামকে রুহানি বয়ানের আলোকে পেশ করা এবং 'বিপ্লবী নবি হিশাবে হাজির করার প্রচেষ্টা সাহসী ও নতুন। ধর্ম নির্বিশেষে মোহাম্মদ (সা) দলিত, গরিব, হতদরিদ্র, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত জনগণের সিপাহসালার হিশাবে হাজির করার মধ্য দিয়ে আজাদ সুবহানি বিখ্যাত হয়েছেন। বলাবাহুল্য ইসলামকে ক্রমাগত পরকালবাদী জগৎবিমুখ ধর্ম হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করার ধারা শক্তিশালী। বিপরীতে বিপ্লবী রাজনৈতিক চিন্তার জায়গা থেকে রাসুলকে বোঝার প্রচেষ্টা ইসলামকে ইহলৌকিকতার নিরিখে পেশ করা। ইসলামকে চরম পশ্চাতপদতার হাত থেকে রক্ষার জন্য জগত্মুখি করে তোলা। আজাদ সুবহানি এই দিক থেকেই থেকেই ব্যতিক্রম। তাঁর চিন্তাী কারনে বিশেষ ভাবে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বিপুল ভাবে প্রভাবান্বিত করেছিল। ভাসানীর 'হুকুমতে রাব্বানিয়া' খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রচেষ্টা।
বাংলায় বইটি অনুবাদ করেছিলেন মওলানা মুজিবুর রহমান। দীর্ঘকাল বইটি পাওয়া যাচ্ছিল না। সম্প্রতি মওলবি আশরাফ বইটিকে আরও পাঠযোগ্য করে তোলার জন্য ভাষাগত দিকসহ সম্পাদনা করেছেন। এখানে মওলানা মুজিবুর রহমান অনুদিত এবং মৌলবি আশরাফ সম্পাদিত 'বিপ্লবী নবী' আবার পাঠকদের হাতে কয়েকটি পর্বে আমরা তুলে দিচ্ছি।
রব্বানি দর্শনের ভাবধারা এক সময় ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। বাঙালি মুসলিম রাজনীতিবিদদের মধ্যে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবুল হাশিম, শামসুল হক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের কর্মীরা আজাদ সুবহানির চিন্তাভাবনা দ্বারা উজ্জীবিত ছিলেন।
আজাদ সুবহানির জন্ম ভারতের মধ্যপ্রদেশে। পড়াশোনা করেন জৌনপুর মাদরাসায়। ১৯১৩ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদান করে কারাবরণ, পরবর্তীকালে সারাজীবন রাজনীতি ও ইসলামের ইনকিলাবি দর্শনের প্রচার-প্রসারের খেদমত আঞ্জাম দেন। তিনি খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার বাইরে শরিয়া আদালত স্থাপনকল্পে মওলানা আবুল কালাম আজাদকে সহযোগিতা করেন। খেলাফত আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়লে আজাদ সুবহানি কানপুরে মজদুর আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। তাদের সাথে অল্প কিছুদিন থাকলেও এ সময় তার ভিতর কিছুটা সমাজতন্ত্রী ভাবধারার উন্মেষ ঘটে, যা পরবর্তী সময়ে রব্বানি দর্শনে রূপ পায়। তিনি রব্বানি ভাবধারায় লেখালেখি করা ছাড়াও ‘জমাআতে রব্বানি’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। এর সদর দপ্তর ছিল বিহারের গোরখপুরে। আজাদ সুবহানি তার জীবদ্দশায় রব্বানি ভাবধারাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ‘জামিয়া রব্বানিয়া’ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যার প্রথম রেক্টর ছিলেন তিনি নিজেই। তিনি তার আজীবনের অর্জিত ধনসম্পত্তি এই প্রতিষ্ঠানটির পেছনে ব্যয় করেন। ১৯৬৩ সালে বিহারের গোরখপুরে তিনি সংগ্রামী জীবনের ইতি টেনে মওলার সান্নিধ্যে সফর করেন।
ভূমিকা
বহুবার ইচ্ছে হয়েছে ‘বিপ্লবী নবী’ লিখে মহাসৌভাগ্যের অধিকারী হই এবং একটি গুরুদায়িত্ব পালন করি। কয়েকবার চেষ্টাও করেছি কিন্তু সফল হইনি। প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছি। এ কি আল্লাহরই ইচ্ছা ছিল না? হয়তো-বা তা-ই। কিন্তু পরে আবার কেন তিনি ইচ্ছা করলেন? আমার মতে এর উত্তর হলো—এই পবিত্র কাজের জন্য যে যোগ্যতার প্রয়োজন, ইতোপূর্বে তা আমার মধ্যে ছিল না। এখন আমি মোটামুটিভাবে এই যোগ্যতার অধিকারী হয়েছি বলে দাবি করতে পারি। প্রশ্ন উঠবে—সেই যোগ্যতা কি? একে বলা যায় নিসবতে মুহাম্মদি বা হজরত মুহাম্মদের (স) সাথে সম্পর্ক—কিন্তু সেই সম্পর্ক নয় যা প্রত্যেক মুহাম্মদ-অনুরাগীরই হয়ে থাকেন, ওই বিষয়টি তো বুঝমান হবার পর থেকেই আমার মধ্যে ছিল এবং এখনও আছে। বরং মুহাম্মদের (স) সাথে সম্পর্ক বলতে এমন সম্পর্ক বুঝানো হয়েছে যা কেবল হজরত মুহাম্মদকে (স) দিব্যদৃষ্টিতে দেখার ক্ষমতা অর্জনকারীদেরই আছে। এই বইটি রচনার কিছুদিন আগে সন্দেহাতীতভাবে, স্পষ্ট দিবালোকের মতো আমার কাছে প্রতিভাত হয় যে আমার সামনে হজরত মুহাম্মদের (স) রুহ মোবারক সর্বদা বিরাজ করছে এবং আমার সমগ্র অস্তিত্ব তা দ্বারা পরিবেষ্টিত। ফলে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সন্দেহ ও নিস্পৃহতার অবসান ঘটিয়ে এ অনুভূতি আমাকে এক প্রবল স্পৃহা দান করে। এখন আমার অবস্থা এই যে, আমি দিনরাত তার সৌন্দর্য উপভোগ করছি। সত্য বলতে কি, এই অনুভূতিই এই বই রচনার সম্পূর্ণতা সাধনে আমাকে নতুন করে স্পৃহ করেছে এবং এটি আল্লাহর ইচ্ছাকেও এই কাজের প্রতি অনুকূল করেছে। ফলে যে কাজ বারবার অসম্পূর্ণ থেকে গেছে তা এইবার মোটামুটিভাবে সম্পন্ন হলো।
‘বিপ্লবী নবী’ সিরাতবিষয়ক বইগুলির মধ্যে সামগ্রিকভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে দাবি না করা গেলেও অপরাপর গ্রন্থের তুলনায় এর বৈশিষ্ট্য অবশ্যই ব্যতিক্রম। কী সেই বৈশিষ্ট্য? বিভিন্ন সিরাতগ্রন্থে্র বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য—যা হজরত মুহাম্মদের (স) জীবনচরিতকে জীবন্ত ও গতিশীল করে তুলতে সক্ষম এবং ভাবাবেগমুক্ত, নিরপেক্ষ, তুলনাহীন ও জীবনের সামগ্রিকদিক তুলে ধরতে সমর্থ—বিপ্লবী নবীতে তার সব কয়টাই আছে। এসব ছাড়াও, হজরত মুহাম্মদের (স) জীবনীর যেসব গুরুত্বপূর্ণ রুকন আজ পর্যন্ত অস্পষ্ট ও অপ্রমাণিত রয়েছে—‘বিপ্লবী নবী’ সেইসব গুরুত্বপূর্ণ দিকও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছে।
দুটো কারণে ‘বিপ্লবী নবী’ আলাদা। প্রথমত, এই গ্রন্থে রব্বানি দর্শন—যা স্বভাবতই মহান ও স্বয়ংসম্পূর্ণ তাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়সমূহ—যা একমাত্র আধ্যাত্মিক উপলব্ধি ও কাশফের (স্বজ্ঞার) মাধ্যমে ব্যক্ত করা সম্ভব—তা ব্যক্ত করতে গিয়ে হজরত মুহাম্মদের (স) রুহের মাধ্যমে আমার যে রুহানি উপলব্ধি ও কাশফ হয়েছে, আমি হুবহু তা প্রয়োগ করেছি। এ ছাড়া আমি ‘বিপ্লবী নবীকে’ বিভিন্ন গ্রন্থের উদ্ধৃতি ও বরাত থেকে মুক্ত রেখেছি। উদ্ধৃতি ও বরাত গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধির সহায়ক হলেও এটি পাঠকের আকর্ষণ ও একাগ্রচিত্ততার পক্ষে বিঘ্নও বটে। এছাড়া, এটি পাঠককে আসল বিষয়বস্তু থেকে দূরে সরিয়ে পুস্তকের তালিকার প্রতি ঠেলে দেয়। পাঠক লেখকের প্রতি আস্থাশীল না হলে উদ্ধৃতি ও বরাত অবশ্যই ফলপ্রসূ হয়; কিন্তু (আমার কথা হলো) যে লেখকের প্রতি পাঠকের আস্থা নেই সে লেখকের বই পাঠক পড়তে যাবেই-বা কেন?
‘বিপ্লবী নবী’ বিন্যাসেরও বিশেষ ধরন রয়েছে এবং এর বিভিন্ন অধ্যায় ও শিরোনাম যেভাবে বিন্যস্ত করা করা হয়েছে তার বৈশিষ্ট্য পাঠক প্রথম পাঠেই উপলব্ধি করতে পারবেন।
‘বিপ্লবী নবী’ অলীক ও ভিত্তিহীন গল্পগুজবের বই নয় যে বিরাট কলেবরে কয়েক খণ্ডে রচিত হবে। তবু বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে সিরাতবিষয়ক বৃহদাকার গ্রন্থাদি থেকে এর মর্যাদা কম নয়। এর কারণ হচ্ছে ‘বিপ্লবী নবীর’ বিশিষ্ট প্রকাশভঙ্গি, যা কোনো সিরাতগ্রন্থেই পাওয়া যাবে না। এর অর্থ এই নয় কোনো সিরাত-লেখকেরই এই প্রকাশভঙ্গির ক্ষমতা ছিল না। হয়তো তারা রচনার এই ধরনকে পছন্দ করেন নাই আর এজন্যই তারা এই ধরনকে গ্রহণ করেন নাই। যাই হোক, ‘বিপ্লবী নবীর’ ক্ষুদ্র কলেবর দেখে কারও এ কথা মনে করা উচিত নয় যে প্রয়োজনে বিষয়বস্তুর পরিমাণের দিক থেকে এটি অসম্পূর্ণ, যেভাবে এটি উদ্ধৃতি বা বরাতের দিক দিয়ে অসম্পূর্ণ। বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে এটি সর্বোৎকৃষ্ট হলেও উপকারিতা অপেক্ষাকৃত কম—এমন ধারণা করাও উচিত নয়।
‘বিপ্লবী নবীর’ উল্লেখযোগ্য সাফল্য এই যে, এটি হজরত মুহাম্মদের (স) সিরাতকে স্থায়ীভাবে জ্ঞান ও ব্যবহারিক দর্শনে রূপ দিয়েছে। এছাড়া একে এমন একটি আন্দোলনেরও রূপ দিয়েছে—যা আজও সমাপ্ত হয়নি, যা কেবল অতীতের কাহিনি নয় বরং বর্তমানের কর্মসূচি ও ভবিষ্যতের ইশতেহার। এটি একটি ধারাবাহিক আন্দোলন—যার কোনো শেষ নাই, এমনকি আজ অবধি তাতে ঢিলও পড়েনি। বরং প্রথম যুগে যেমন সতেজ ও সক্রিয় ছিল, দিন দিন তার চেয়ে সতেজ, তাগড়া ও সক্রিয় হচ্ছে—এবং এর ভবিষ্যৎ থেকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর, তা বর্তমানের আয়নাতেও দেখা সম্ভব। এই আন্দোলনকে ‘রব্বানি আন্দোলন’ কিংবা বিশ্বজনীন, স্থায়ী, সামগ্রিক আন্দোলন বললে অত্যুক্তি হবে না। এবং এই নামেই পুস্তকটির নামকরণ হয়েছে। তারপর ‘বিপ্লবী নবীতে’ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত অথচ সামগ্রিক পদ্ধতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই আন্দোলনের স্বরূপ উদ্ঘাটিত করা হয়েছে। বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন পাঠকবৃন্দ অতি সহজেই এর থেকে একটি যুগোপযোগী আন্দোলনের কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করতে পারবেন। এটাই ‘বিপ্লবী নবীর’ উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য—যা সিরাতবিষয়ক অন্যান্য গ্রন্থে খুঁজে পাবেন না।
এমন ভাবা একদমই উচিত হবে না যে ‘বিপ্লবী নবীর’ যেসব গুণের কথা বলা হলো তার উদ্দেশ্য সিরাতবিষয়ক অন্যান্য গ্রন্থকে খাটো করা। ব্যাপারটা মোটেও এমন নয়; বরং যা বাস্তব তার বর্ণনা এবং অন্যের উপকার বাসনাই হচ্ছে এর উদ্দেশ্য—যা গ্রন্থের গুণাগুণ বিশ্লেষণ এবং খোদ-গ্রন্থকার কর্তৃক বিশ্লেষণ ছাড়া হাসিল হওয়া সম্ভব নয়। যদি অন্য কেউ এই দায়িত্ব পালন করত তবে কতই না ভালো হতো! কিন্তু সে আশা কোথায়? যে-দেশে যে-সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘বিপ্লবীর নবী’ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে সেখানে তো দলাদলি, সাম্প্রদায়িকতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, ব্যক্তিপূজা, পক্ষপাতিত্ব, ষড়যন্ত্র আধিপত্য করছে। সেখানে এসবের অবাধ রাজত্ব চলছে সেখানে বিদ্যার কদর ও সত্যের খেদমত কি করে আশা করা যায়? প্রাচ্য তো প্রাচ্যই—পাশ্চাত্য নয়! পাশ্চাত্যে জ্ঞানের ক্ষেত্রে অতি তুচ্ছ উদ্ভাবন-আবিষ্ক্রিয়া বা নতুন কথাকেও অনেক বড় করে দেখানো হয়; আর এখানে জ্ঞানের নতুন ভান্ডারকে দাবিয়ে রাখা হয় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এমতাবস্থায়, আমি জানি না, এই গুণ-বিশ্লেষণের এবং এই বইয়ের পরিণতি কী হবে? আমি আমার কাজ আল্লাহর নিকট সমর্পণ করছি। চূড়ান্ত মীমাংসা তারই কাছে। গ্রন্থকার তার নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন, এখন যার নামে দায়িত্ব পালন করা হয়েছে তিনিই জানেন এর পরিণতি কী হবে।
‘বিপ্লবী নবী’ বড়ো তাড়াহুড়ার মধ্যে রচিত হয়েছে; এটি সুপরিকল্পিত নয় এবং এর পুনরীক্ষণও সম্ভব হয়নি; এর কারণ এই নয় যে লেখক কামালিয়াত দাবি করেন কিংবা বইটির পুনরীক্ষণ নিষ্প্রয়োজন মনে করেন। বরং সময়ের অভাবই আসল কারণ। তা ছাড়া, এই নিশ্চয়তাই-বা কোথায় যে, ব্যস্ততার মধ্যে রচিত গ্রন্থের চেয়ে ধীর-মস্তিষ্কের রচনা বেহতর হবে?
যাকগে, ব্যাপারটা এমনই। এখন আর ওজর-আপত্তি করে কী ফায়দা? বইটি ত্রুটি-মুক্ত এ কথা দাবি করা চলে না; ভ্রান্তির অবকাশ রয়েছে এবং ভুল-প্রমাদ নজরে পড়লে অবশ্যই তা বাদ দেওয়া হবে। কিন্তু এমন যেন না হয়—একটি ভুলের জন্য গোটা বইটি নজির আহমদ রচিত ‘উম্মাহাতুল মুমিনিন’ কিংবা ইবন রুশদের ফালসাফার কিতাবের মতো জ্বালিয়ে দেওয়া বা বাজেয়াপ্ত করা হবে। এমন কাজ তো ছারপোকা নিবারণের জন্য কম্বল জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো। আপনি আল্লাহকে ভয় করুন বা না করুন, হজরত মুহাম্মদকে (স) অবশ্যই সমীহ করবেন।
পাঠকদের প্রতি অনুরোধ, তারা যেন নিরপেক্ষ দৃষ্টি, চিন্তা ও গবেষণা সহযোগে ‘বিপ্লবী নবী’ পাঠ করেন। সামর্থ্য থাকলে হজরত মুহাম্মদের (স) সাথে আত্মিক যোগসূত্র স্থাপন করে তবে যেন তারা এ গ্রন্থ অধ্যায়ন করেন; আর তা না থাকলে যেভাবে ইচ্ছা পাঠ করেন, তবে গ্রন্থটি আগাগোড়া যেন পাঠ করেন—এই আরজ রইল। হয়তো গভীর অধ্যয়নের ফলে পাঠক মুহাম্মদের (স) রুহের কৃপা দৃষ্টিতে অমূল্য রত্নে পরিণত হবেন—
❝যাদের নজরে মাটি হয়ে যায় সোনা;
আহা, তাদের কেউ যদি আমাদের প্রতি
একটিবারের জন্য তাকাতেন!❞
অবশেষে হজরত মুহাম্মদের (স) খেদমতে দাবি ও আল্লাহর দরবারে নিবেদন : আমার এই খেদমতে যদি অণুপরিমাণ এখলাসও থাকে, এতে যদি মানুষের বিন্দুপরিমাণ উপকারও পৌঁছায়, তবে একে কবুল করে নিয়ো—যদিও তাতে হাজারটা দোষ থাকে। আর যদি তা নাও হয়, তবে, এই না-চিজ লেখককে নবীজীবনী রচয়িতাদের দরবারে শামিল হওয়ার প্রতিদান অবশ্যই দিয়ো। তোমার খাস বান্দাদের কাতারে শামিল নাই-বা করলে, অনুগ্রহপ্রাপ্ত গুনাহগারদের মধ্যে আমাকে স্থান দিয়ো। আর পাপীরাই তো কৃপা ও অনুগ্রহের হকদার!
❝আমি গুনাহগার বটে তবে বিশ্বস্ত,
তোমার দিলের দরজা হতে আমাকে বিমুখ করিয়ো না,
আমি ভিখারী।❞
ফকির গুনাহগার অপরাধী
সুবহানি রব্বানি
ওরফে আজাদ সুবহানি
প্রথম অধ্যায়
হজরত মুহাম্মদ (স) কে ছিলেন? তাকে নিয়ে দুনিয়া জুড়ে এমন আলোড়ন সৃষ্টিরই-বা কারণ কী? চিন্তাশীল যেকোনো মানুষের মনেই প্রথমে এই দুইটি প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক—বিশেষত যখন তিনি দেখতে পান সবখানেই হজরত মুহাম্মদের (স) নাম ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হচ্ছে।
তো আমার মনে হয় প্রথম প্রশ্নের জওয়াবটিই প্রথমে জানা দরকার। কারণ এই জওয়াবটিকে সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে তবেই দ্বিতীয় প্রশ্নের জওয়াব উপলব্ধির জন্য প্রস্তুত হওয়া সম্ভব হবে।
সাকিন
হজরত মুহাম্মদ (স) ছিলেন একাধারে আরাবি, মক্কি ও মাদানি। তার জন্মস্থান ছিল আরব উপদ্বীপে, তাই তিনি আরাবি। মক্কা ও মদিনায় তিনি জীবন অতিবাহিত করেন। প্রথমে তিনি মক্কারই বাসিন্দা ছিলেন, পরে মদিনায় হিজরত করে বসতি স্থাপন করেন।
বংশসূত্রের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন একাধারে কুরায়শি হাশেমি ও মুত্তালিবি—কেননা তিনি কুরায়শ বংশের বনি হাশিম গোত্রে মুত্তালিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বংশপরম্পরায় নিকটতম সূত্র ছাড়া দূরসম্পর্কের আরও একটি সূত্র আছে। সেই সূত্র অনুসারে তিনি আদনানি, ইসমাইলি ও ইবরাহিমি। তার বংশপরম্পরায় ঊর্ধ্বতন পুরুষ হজরত ইবরাহিম (আ), তার পুত্র হজরত ইসমাইল (আ) এবং তারই বংশের এক বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন আদনান। এই আদনানের বংশধরগণ পরবর্তীকালে বিভিন্ন গোত্র ও শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। কুরায়শ তারই একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এই শাখারই বনি হাশিম গোত্রের মুত্তালিব পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এখান থেকে স্পষ্ট হলো তিনি হজরত ইবরাহিমের (আ) অধস্তন পুরুষ।
মধুময় নাম
তার নাম দুটো—মুহাম্মদ ও আহমদ। ইসলাম ধর্ম ও কোরআনের মনোনীত নাম মুহাম্মদ; এইজন্য এই নামটিই সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করেছে। ইসলামপূর্ব যুগে ও আহলে কিতাবিদের গ্রন্থে তাকে ‘আহমদ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। মুহাম্মদি যুগের ইতিহাসে বর্তমান যেন অতীত হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে সেজন্যে উম্মতে মুহাম্মদি দুই নামই একসাথে গ্রহণ করে। তাই, যখন কোনো মুসলমান তার নাম উচ্চারণ করেন, তিনি বলেন,—‘আহমদ মুজতবা মুহাম্মদ মুস্তফা’।
‘মুজতবা’ এবং ‘মুস্তফা’—এই দুইটি শব্দ নামের অংশ নয়, সম্মানসূচক পদবি। উভয় শব্দের অর্থ একই—মনোনীত। মূল নামের সাথে এই শব্দ জুড়ে দেওয়া এ কথাই ঘোষণা করে যে তিনি আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি; তাকে সেই দৃষ্টিতেই দেখতে হবে এবং তার সঙ্গে সেরকম সম্পর্কই রক্ষা করে চলতে হবে।
‘সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বাক্যটিও তার নাম থেকে আলাদা। এটি প্রার্থনামূলক বাক্য। এর অর্থ—‘মুহাম্মদের (স) ওপর আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ বর্ষিত হোক।’ ‘মুজতবা’ ও ‘মুস্তফা’ এই দুই সম্মানসূচক পদবি অপেক্ষা ‘সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বাক্যটিকেই তার নামের সাথে উচ্চারণ করা ওয়াজিব বা অধিকতর জরুরি গণ্য করা হয়। এমনকি এই বাক্যটি শেষে যুক্ত না করে আল্লাহর রসুলের নাম উচ্চারণকে বেয়াদবি এবং খানিকটা গুনাহর কাজ গণ্য করা হয়। এইজন্য তার নাম উল্লেখের সঙ্গে এই বাক্যটির উল্লেখও অপরিহার্য কর্তব্য হিশাবে পরিগণিত হয়ে আসছে সব সময়। নুন্যতম ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন কোনো মুসলমানের মুখ হতে তাই কখনও ‘সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ ছাড়া আল্লাহর রসুলের নাম উচ্চারিত হতে দেখা যায় না।
‘মুজতবা’ ও ‘মুস্তফা’ ছাড়াও তার আরও অনেক সম্মানসূচক পদবি আছে এবং এর সংখ্যা এত বেশি যে, সবগুলোকে একত্র করতে গিয়ে আলাদা গ্রন্থ প্রণয়ন করতে হয়েছে। এই সব সম্মানসূচক নাম ও পদবি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান হাসিলের জন্য গ্রন্থগুলো পাঠ জরুরি। উল্লিখিত বিষয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থের মধ্যে দুইটির নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য—দরুদে তাজ ও হিজবুল বাহার। অবশ্য এত অধিক সংখ্যক সম্মানসূচক নামের মধ্যে পাঁচটিই প্রধান। হজরত মুহাম্মদকে (স) জানতে হলে পাঁচটি সম্মানসূচক নামের সাথে পরিচিত হওয়া অবশ্য কর্তব্য এবং তার সামান্যতমও বরকত হাসিলের জন্য সেই পরিচয়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াও কর্তব্য।
এই প্রধান পাঁচটি সম্মানসূচক নাম হলো :
(১) শাফিউল মুজনাবিন বা পাপীদের জান্নাত প্রবেশে সুপারিশকারী।
(২) রহমাতুল্লিল আলামিন বা সমগ্র জগতের রহমত।
(৩) সাইয়িদুল মুরসালিন বা সকল নবী-রসুলের নেতা।
(৪) খাতামুন্নাবিইয়িন বা নবীগণের সিলমোহর।
(৫) ইমামুর রব্বানিইয়িন বা রব্বানিদের পথিকৃৎ।
এর মধ্যে ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ ও ‘খাতামুন্নাবিইয়িন’ এই দুইটি সম্মানসূচক নাম স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত এবং আল্লাহর কিতাবে এর উল্লেখ আছে। অবশিষ্ট তিনটি সম্মানসূচক নাম তার উম্মতগণ প্রদান করেছেন। এর মধ্যে দুইটি পুরাতন, একটি নতুন। এই নতুন সম্মানসূচক নামটি হলো ‘ইমামুর রব্বানিইয়িন’। রব্বানিগণ এই সম্মানসূচক নামটি উদ্ভাবন করে দো-জাহানের নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। শেষোক্ত সম্মানসূচক নামটি নতুন হলেও এর গুরুত্ব ও মূল্য অপরিসীম।
হজরত মুহাম্মদের (স) পিতার নাম আবদুল্লাহ আর মাতার নাম আমেনা; দাদার নাম আবদুল মুত্তালিব। তার চাচাদের মধ্যে হামজা, আব্বাস, আবু তালেব ও আবু লাহাবের নাম উল্লেখযোগ্য। অনেকেই আবু জাহলকেও তার চাচাদের মধ্যে শামিল করে থাকেন; কিন্তু তা সম্পূর্ণ ভুল। তার চাচাতো ভাইদের মধ্যে হজরত আলী, হজরত আবদুল্লাহ ও হজরত ফজল (রা) প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন।
তার আগমন কেন মক্কায় হলো
মক্কা নগরীর আবদুল মুত্তালিবের গৃহে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের পূর্বেও মক্কা নগরীর প্রসিদ্ধি ছিল সারা আরব জুড়ে, কেননা মক্কাই ছিল আরবের শ্রেষ্ঠতম উপাসনাকেন্দ্র। এখানেই অবস্থিত সেই কাবাঘর, যার খ্যাতি ও মর্যাদা কবে থেকে শুরু হয়েছে তা নির্ণয় করা মুশকিল। এ কথা সত্য যে কাবার খ্যাতি ও মর্যাদা আল্লাহর নবীর (স) হাতেই পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে। তারপরও স্বীকার করতে হয় যে, কাবার খ্যাতি ও মর্যাদা বহুকাল আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। সুতরাং যদি বলা হয় সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা অনুসারে শুদ্ধতম ও খ্যাতিমান হজরত মুহাম্মদ (স) পূতপবিত্র ও প্রশংসিত অঞ্চলে প্রেরিত হয়েছিলেন, কিংবা তার আলোকময় ও ঐতিহাসিক প্রকাশের জন্য পবিত্র ও প্রসিদ্ধ স্থানকেই নির্বাচিত করা হয়েছিল, তা ভুল হবে না।
মর্যাদার দিক থেকে অবশ্য কাবার সাথে মুত্তালিব পরিবারের তুলনা হতে পারে না। কেননা কাবার মর্যাদা কাবার জন্যই নির্দিষ্ট। তারপরেও মুত্তালিব পরিবারের একটি নিজস্ব মর্যাদা ছিল। সে মর্যাদা এই যে, এই পরিবার ছিল গোটা আরব অঞ্চলের শ্রেষ্ঠতম ধর্মীয় নেতার পরিবার। সুতরাং আল্লাহর নবীর (স) জন্মস্থান হিসেবে শহর নির্বাচনের ব্যাপারে যেমন একটি পরিকল্পনা পরিলক্ষিত হয় পরিবার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তেমনই একটি সূক্ষ্ম পরিকল্পনার আভাস পাওয়া যায়। এই পরিকল্পনা কী এখন তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। বিষয়টির গভীরে প্রবেশের আগে মক্কা এবং মুত্তালিবগৃহের গুরুত্ব সম্যক উপলব্ধি করা কর্তব্য; কেননা শুধু তখনই এই দুইটি স্থান নির্বাচনের ব্যাপারে যে মহান নীতিগত ও শিক্ষণীয় ইশারা বিদ্যমান রয়েছে, তা হৃদয়ঙ্গম করা সহজ হবে।
কাবার গুরুত্বের দিক দিয়ে বিচার করলে আপাতদৃষ্টিতে মক্কা কেবল আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রস্থল মনে হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা তেমন ছিল না। বরং তা বৈষয়িক দিক দিয়েও উন্নত একটি শহর ছিল। মূলত মক্কা ছিল তখনকার আরব অঞ্চলের লন্ডন বা নিউইয়র্ক—ব্যবসা-বাণিজ্য ও তহজিব-তমদ্দুন (সভ্যতা-সংস্কৃতি) দুটোরই প্রধান কেন্দ্র। আরবের শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী, আশরাফ ও কুলীন নাগরিকগণ এখানে বাস করতেন; ফলে তা ব্যবসায়ী, নেতা ও সমাজপতিদেরই বিশিষ্ট শহর হিসেবে গণ্য হতো। মোদ্দাকথা, মক্কা তখন সারা আরবের পুরোদস্তুর ‘দারুল হুকুমত’—রাজনীতি, শিল্পকলা ও তমদ্দুনিক (সাংস্কৃতিক) প্রাণকেন্দ্র।
আবার কাবার মতোই মুত্তালিব পরিবারটিও ছিল সকল দিক থেকে মক্কার প্রাণকেন্দ্র। তখনকার মক্কাকে যদি আরবের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র বলা হয় এবং সেজন্য যদি লন্ডন-নিউইয়র্কের সাথে তার তুলনা চলে, তাহলে সেই বিচারে মুত্তালিবগৃহকেও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল অথবা হেনরিফোর্ড ভবন, রকফেলার ভবন বলে অভিহিত করা যায়। তেমনই মক্কাকে সারা আরবের রাজনীতির কেন্দ্রস্থল বা দারুল হুকুমত রূপে গণ্য করা হলে মুত্তালিব পরিবারকে রাজনীতির কেন্দ্রস্থল রাজভবন বা আরবের হোয়াইট হাউস বা বাকিংহাম প্যালেস বলতে হয়। আর মক্কাকে আরবের তহজিব-তমদ্দুনের (সভ্যতা-সংস্কৃতির) প্রাণকেন্দ্র বলে স্বীকার করলে মুত্তালিব পরিবারকে তহজিব-তমদ্দুনের কেন্দ্রস্থল বলে অভিহিত করা যায়।
মক্কা নগরী ও মুত্তালিবগৃহকে আল্লাহর নবীর (স) জন্মস্থান নির্বাচন করার পেছনে যে পরিকল্পনাটি লুকায়িত ছিল, তা এই যে, তিনি কেবল আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন দরবেশ, যোগী, সন্ন্যাসী—অর্থাৎ সংসারবিরাগীদের নেতা হওয়ার জন্যই প্রেরিতপুরুষ হননি, বরং বণিক-ব্যবসায়ী, সমাজপতি, বিদগ্ধ, কুলীন ও অভিজাতদের নেতৃত্ব দানও তার প্রেরিত হওয়ার উদ্দেশ্য। মানে আল্লাহর নবী (স) তার অনুসারীদের জন্য কেবল আধ্যাত্মিক সাধনার চরম সিদ্ধি ও এবাদত-বন্দেগির ক্ষেত্রে নজির স্থাপনই নয়, বরং একই সাথে তাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও শাসনকার্যেও পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করতে ও তাতে চূড়ান্ত নজির স্থাপন করতে শিক্ষকরূপে প্রেরিত হন। আমাদের কর্তব্য হলো তার নির্দেশনা অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় ক্ষেত্রে পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে তার অনুসারীদেরকে আল্লাহর খেলাফতের চরম সৌভাগ্য ও গৌরবের মোকাম হাসিল করতে হবে।
এই ব্যাপারে আরও একটি সূক্ষ্ম বিষয় নিয়েও গভীর বিচার-বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে—শহর হিসেবে মক্কাকে যেমন জন্মস্থান নির্দিষ্ট করা হলো, গৃহ হিশাবে তেমনই কাবাকে নির্দিষ্ট করা হলো না কেন? অথচ তা-ই হওয়া তার সম্মান অনুপাতে যুক্তিযুক্ত হতো; হজরত আলীর জন্মস্থান যেভাবে কাবাঘর, তার জন্মস্থানও সেভাবে কাবাঘর হতে পারত না?
না, কারণ আল্লাহ তাআলার তার নবীকে (স) প্রেরণের উদ্দেশ্য হলো তাকে সামগ্রিক নেতৃত্বের উপযোগী করে তোলা ও তার দ্বারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পন্থা নির্দেশ করা। যদি তার জন্ম কাবাঘরে হতো, এই উদ্দেশ্যের ইশারা আধাআধি হতো, কেননা কাবাঘর তো কেবল আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রস্থল, পার্থিব রাজনীতি-অর্থনীতির কেন্দ্রস্থল না। অন্যদিকে মুত্তালিব পরিবার ছিল পার্থিব বিষয়ের কেন্দ্রস্থল। সুতরাং মক্কাকে জন্মস্থান নির্দিষ্ট করে তার মধ্যে আধ্যাত্মিকতার পূর্ণতা বিধান এবং মুত্তালিব পরিবারে প্রেরণ করে তার জাগতিক জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন করা হয়। এমনিভাবে হজরত মুহাম্মদের (স) ফিতরতে (স্বভাবে) আধ্যাত্মিক ও জাগতিক—উভয় দিককার গুণের সমন্বয় সাধন করে তাকে মানবজীবনের সামগ্রিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দানের যোগ্য করে তোলা হয়।
হজরত আলীকে (রা) যেহেতু আধ্যাত্মিক জগতের নেতা বানানোই উদ্দেশ্য ছিল, তাই তার জন্মের জন্য কাবাকে নির্দিষ্ট করা হয়। তাই দেখা যায় হজরত আলী (রা) আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে উচ্চতম অংশ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন সত্য, কিন্তু পার্থিব জগতের ক্ষেত্রে ন্যূনতম প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু অর্জন করতে পারেননি। তিনি যে অনুপযুক্ত ছিলেন তা নয় বরং তার মধ্যে পার্থিব জগতে উন্নয়নের আগ্রহই ছিল না। এই কারণেই আল্লাহর নবী (স) হজরত আলীকে (রা) হজরত হারুনের (আ) মতো বলে আখ্যায়িত করেছেন, হজরত ইউশার (আ) মতো বলে আখ্যায়িত করেননি। আবার ঘোষণা করেছেন, ‘আলী (রা) আমার অনুসারীদের মধ্যে ঈসা ইবনে মরিয়মের (আ) মতো।’
তার ইন্তেকাল কেন মদিনায় হয়েছিল
মক্কাকে যেমন জন্মস্থান হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল তেমনই অন্য একটি জায়গাকে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল চিরনিদ্রার স্থানরূপে। কবরস্থান নির্বাচনের ব্যাপারে পৃথক একটি পরিকল্পনা কার্যকর করা হয়। জন্মস্থানের জন্য তো এমন একটি জায়গা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল যা ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ শহর—ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র, রাজনীতির প্রাণভূমি, শাসন-পরিকল্পনাকেন্দ্র এবং সেইসঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রস্থল। কিন্তু চিরনিদ্রার জন্য এমন একটি জায়গাকে নির্বাচন করা হলো যার এইসকল মর্যাদা বা খ্যাতির কোনোটাই ছিল না। তবে মদিনা কী ছিল? ছিল কিষাণদের একটি বসতি মাত্র—পশুপালন ক্ষেত্র, চাষীদের একটি সাধারণ পল্লী, বড়জোর একটি বৃহৎ কৃষক এলাকা। এখানে আধ্যাত্মিকতার কোনো ছাপ ছিল না, ছিল না পার্থিব জগতের কোনো বিষয়ে সামান্যতম খ্যাতি।
এরপরেও মুসলমানদের মতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব আর অমুসলমানদের মতে শ্রেষ্ঠ মানবদের একজন, যার জন্মস্থান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছিল সভ্যতার লীলাকেন্দ্র, অথচ তারই চিরনিদ্রার স্থান হিসেবে এমন অখ্যাত, শ্রমজীবী-অধ্যুষিত ও সভ্যতা-সংস্কৃতির আলো থেকে বিচ্ছিন্ন একটি জায়গাকে কেন নির্বাচন করা হলো? এটি এইজন্য যে, পূর্ণতাপ্রাপ্তির পূর্বক্ষণ পর্যন্ত মানুষের জন্য জ্ঞান-আহরণ ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের প্রয়োজন হয়। তাই পূর্ণতাপ্রাপ্তির আগে এমন একটি বড় জায়গায় অবস্থান প্রয়োজন যে-স্থান থেকে জ্ঞান-আহরণ ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা সম্ভব। আরবে মক্কা নগরীরই সেই দিক দিয়ে উপযুক্ত স্থান ছিল। এ কথাও স্পষ্ট যে, জন্ম ও সত্যের প্রতি আহ্বান করার যোগ্যতা অর্জনের সময়টি অপরিপক্কতার অন্তর্ভুক্ত হওয়া সমীচীন। সুতরাং জন্ম থেকে সত্যের প্রতি দাওয়াতের জন্য যোগ্যতা অর্জন পর্যন্ত সময় অতিবাহিত করার জন্য পবিত্র মক্কা নগরীই সঠিক স্থান বলে মনোনীত করা হয়—কারণ মক্কা যেমন আধ্যাত্মিকতার শ্রেষ্ঠতম কেন্দ্র ছিল তেমনই জাগতিক উন্নতির সকল সুযোগ-সুবিধাও মক্কায় বিদ্যমান ছিল। সেখানে আল্লাহর নবী (স) আর্থিক ও জাগতিক বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান আহরণ করে উভয় ক্ষেত্রেই কামালিয়াত হাসিল করেন এবং নিজের চরম উৎকর্ষ সাধনে সক্ষম হন। সেখানেই তিনি প্রাপ্ত হন আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে নবীত্ব ও সত্যের পথে মানুষকে ডাকার পূর্ণ যোগ্যতা। এবং অর্জন করেন জাগতিক ব্যাপারস্যাপার—ব্যবসা-বানিজ্য, রাজনীতি ও রণকৌশলে অপূর্ব দক্ষতা।
কামালিয়াত হাসিলের পর কল্যাণ ও মঙ্গল সাধনের সময় আসে। এই সময় প্রয়োজন হয় এমন একটি ক্ষুদ্র জায়গা যেখানে উভয় ক্ষেত্রের সঞ্চয়ই ব্যবহার করা যায়, যেখানে মানুষের কল্যাণ সাধন সম্ভব হয়, যেখানে শক্তির পরিবর্তে নম্রতাতেই কাজ চলে, এবং যেখানকার অধিবাসীদের গ্রহণ ক্ষমতা থাকে অত্যাধিক। এমন জায়গার জন্য মদিনার মতো স্থানই ছিল সবদিক দিয়ে উপযুক্ত। অবশ্য এই প্রশ্ন উঠতে পারে হিজাজ বা আরব উপদ্বীপে এমন বহু অখ্যাত স্থান ছিল, তা সত্ত্বেও মদিনাকেই নির্দিষ্ট করা হলো কেন? এর জওয়াব কল্যাণ ও মঙ্গলে অখ্যাতের অগ্রাধিকার আছে, কিন্তু কৃত্রিমের নাই। মদিনা অখ্যাতদের জায়গা ছিল ঠিক, কৃত্রিমদের জায়গা ছিল না। অখ্যাত অথচ কৃত্রিম নয় এমন জায়গা আরবে কয়টিই-বা ছিল? অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে এই বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে মদিনা ছিল অদ্বিতীয়।
এ ছাড়াও কল্যাণমূলক কাজের জন্য ক্ষুদ্র জায়গা ও পতিত জনতার প্রয়োজন আছে বলে যে কথা রয়েছে, তার চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া যায় মক্কার আমজনতায় দাওয়াতের নিস্ফলতা ও মদিনায় আমজনতায় দাওয়াতের সাফল্যের মধ্যে। নিশ্চয় এ কথা সবারই জানা আছে যে, মক্কায় তেরো বছরের দাওয়াতে দাওয়াত-কবুলকারীর সংখ্যা বেশি বৃদ্ধি পায়নি। অথচ মদিনায় দশ বছরের দাওয়াতে রাজ্যের পর রাজ্য সাড়া দিয়েছে এবং কবুলকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে লাখের অংকে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এ কথা সত্য—মক্কায় যারা তার ডাকে সাড়া দিয়েছেন তারা প্রত্যেকেই ছিলেন এক একটি হীরার সমতুল্য। কিন্তু হীরা দিয়ে তো আর বাজার ধরা করা যায় না, বাজার ধরার জন্য প্রয়োজন প্রচুর টাকা-পয়সার।
এতে কোনো সন্দেহ নাই মদিনাকে নির্বাচন করার এছাড়াও আরও কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল—যেমন অবস্থানের গুরুত্ব, অধিবাসীদের যুদ্ধ করবার যোগ্যতা, এবং এর রাজনৈতিক ও গঠনমূলক ব্যবস্থাপনার অনুকূল পরিবেশ। মদিনার পরিবেশ এমন ছিল :
এক. মদিনা হেজাজ ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এখানে বসে আরব ও সিরিয়া উভয় এলাকাকেই দাওয়াতের লক্ষ্যস্থলে পরিণত করা সম্ভব ছিল।
দুই. মদিনা থেকে কিছু দূরে এমন একটি সংযোগস্থলে অবস্থিত ছিল, যে-স্থান দিয়ে একটি পথ সিরিয়ার দিকে চলে গেছে। সিরিয়া থেকে মক্কার সওদাগরদের এই পথ দিয়ে ফেরা ছাড়া উপায় ছিল না।
তিন. মদিনার অধিবাসীদের বেশির ভাগই ছিল কিষাণ-মজদুর। কিষাণ-মজদুররা স্বাভাবিকভাবেই সংযমী, পরিশ্রমী ও সাহসী হয়ে থাকে। এই কারণে মদিনা ছিল প্রকৃতিগতভাবে সৈনিকদের ভূমি, এখনকার অধিবাসীদের সহযোগিতায় একটি সুদক্ষ সেনাবাহিনী গঠন করা অতি সহজ ছিল।
মদিনার চারপাশে ইহুদিদের বসতি ছিল। কর্তৃত্বও ছিল তাদের হাতে। এই ইহুদিদের অধীনে ছিল গোটা কয়েকটি দুর্গ—এইগুলো জালের মতো বিস্তৃত ছিল সারা মদিনায়। দুর্গগুলো করতলগত করতে সক্ষম হলে সারা আরবের মোকাবেলায় একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল লাভ করার সম্ভাবনা ছিল। তা ছাড়া যেহেতু ইহুদিদের হাতেই ধর্ম, অর্থনৈতিক শক্তি ও কর্তৃত্ব ছিল, তাই পুরো আরব অঞ্চলই তাদের ভয়ে ভীত থাকত। তাদের পরাস্ত করতে পারলে সারা আরবে কর্তৃত্ব বিস্তার করা অতি সহজ ছিল। আর মদিনার একেবারে আশেপাশে ছিল খ্রিষ্টান গোত্রসমূহের শাসনকর্তৃত্ব। তারাও দুর্গাধিপতি ছিল। তাদের পরাজিত করতে পারলে শাসন ক্ষমতা লাভ করার পথে আর কোনো বাধা ছিল না এবং বৈপ্লবিক দাওয়াতের পেছনেও তা পূর্ণ শক্তি যোগাতে সক্ষম ছিল। এছাড়া, মদিনা সমুদ্রের কাছাকাছি অবস্থিত। সুতরাং মদিনায় প্রতিষ্ঠা লাভের পর সমুদ্রের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাও সহজ ছিল।
মদিনা আল্লাহর নবীর (স) চিরনিদ্রার স্থান হওয়ার জন্য আরও একটি কারণ বেশি উপযুক্ত, তা এই যে—মক্কায় নতুন ‘হারাম শরিফ’ স্থাপন করা সম্ভব হতো না, সেখানে হজরত মুহাম্মদের (স) হারাম শরিফ বা পূণ্যধাম প্রতিষ্ঠা করা হলেও আদিপিতা হজরত ইবরাহিমের (আ) সাথে তার মর্যাদা মিশে যেত। মদিনায় এতে কোনো বাধা ছিল না; এখানে তার নতুন ‘হারাম শরিফ’ হওয়া সম্ভব। আর এ কথা সত্য আল্লাহর নবী (স) যে ইনকিলাবি দাওয়াতের জন্য প্রেরিত হয়েছেন তার জন্য একটি খালেস ‘হারামে মুহাম্মদি’-এর প্রয়োজন ছিল। ‘তৌহিদ’ এমন একটি মিশ্র ও বিমূর্ত ধারণা যে এর সঠিক ব্যাখ্যা ও পূর্ণতা বিধানের জন্য হজরত মুহাম্মদের (স) প্রয়োজন ছিল। সুতরাং তৌহিদের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গই তার ব্যক্তিত্বের আভায় মণ্ডিত হওয়া উচিত। কিন্তু খালেস ‘হারামে মুহাম্মদি’ ছাড়া কীভাবে তা সম্ভব হতো? সিরাত ও চরিত্র-আদর্শের কেতাবি বর্ণনা ও ব্যাখ্যার অবশ্যই একটি মূল্য রয়েছে, কিন্তু তা যে শুষ্ক! জীবনক্ষমতা যে এতে বিদ্যমান থাকে না! হৃদয় ও মনকে উজ্জীবিত করার জন্য প্রয়োজন একটি চাক্ষুষ প্রেরণা-উৎসের। যতদিন মৃত্যুর কালো পর্দা তার জীবনে নেমে না আসে ততদিন জাতির প্রতিষ্ঠাতা এই উৎস হতে পারেন; আর হতে পারে তার পবিত্র মাজার ফরিয়াদির জন্য ‘হারাম শরিফে’। জিয়ারতকারীদের অন্তরে এই ‘হারাম শরিফ’ চিরবসন্তময় ও সুবাসিত কাননের মতো। এ-স্থান সব সময় মহব্বত ও ঈমান-একিনের সুগন্ধ বিতরণ করে এবং তাদের মন ও মস্তিষ্ককে আমৃত্যু তারই নেশায় মাতোয়ারা রাখে। যারা মসজিদুল হারামের (কাবা শরিফ) সাথে মদিনাও জিয়ারত করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, তাদের নিকট জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারা যাবে যে মদিনায় চিরবসন্তময় ‘বাগে জান্নাত’ প্রেম ও প্রত্যয়ের কী মধুর সুবাসই না তাদের মাঝে বিলিয়েছে।
এ কথা অবশ্য স্বীকার্য যে, নতুন হারাম শরিফ প্রতিষ্ঠা একদিক থেকে তৌহিদের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু শুধু এই ক্ষতিই তৌহিদের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটাতে পারে না, তৌহিদের অনুপস্থিতি তা পারে। তৌহিদকে আকৃতিমুক্ত রাখুন এবং কেবলমাত্র তা মনে ধারণের বিষয় বলে মনে করতে থাকুন—দেখবেন তৌহিদ গায়েব হয়ে গেছে। সুতরাং তৌহিদকে মনে ধারণের পরিবর্তে বাস্তবে আনার জন্যে ‘হারাম শরিফ’ প্রতিষ্ঠা জরুরি। অবশ্য এতে যতটুকু ক্ষতির আশঙ্কা বিদ্যমান তা প্রতিরোধের ব্যবস্থাও অবশ্যই থাকা দরকার। আর এটাই তৌহিদের খেদমতের বাস্তবপন্থা। সুখের বিষয়, হজরত মুহাম্মদ (স) সেই ক্ষতি প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেছেন, এবং চূড়ান্ত ব্যবস্থাই করে গেছেন।
জেসম মোবারকের বিবরণ
ক.
হজরত মুহাম্মদ (স) ছিলেন খুবই স্বাস্থ্যবান, শক্তিশালী সুঠাম-দেহ ও সুন্দর। তিনি এত স্বাস্থ্যসচেতন ছিলেন যে কঠিন মেহনত ও পরিশ্রম করা সত্ত্বেও জীবনে দুইবারের বেশি তিনি অসুস্থ হননি। এই দুইবার অসুস্থ হওয়ার মূলে ছিল বিষের প্রতিক্রিয়া। একবার খাবারের মাংসে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল, মৃত্যুর সময়ও তিনি সেই বিষক্রিয়ার ফলে যন্ত্রণায় ভুগেছিলেন। তিনি এমন শক্তিশালী ছিলেন যে আরবের বিখ্যাত কুস্তিগির রুকানা তিনবার তার সাথে কুস্তি লড়ে তিনবারই হেরে গেছিলেন। তিনি মজবুতও ছিলেন, অনবরত অনাহার-অর্ধাহারে দিন গুজরান সত্ত্বেও তার বিরামহীন পরিশ্রমের মধ্যে একদিন বা এক ঘন্টার জন্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি। তিনি এমন সুন্দর ছিলেন যে তার সাথে কারুর তুলনা হয় না। কেউ তার সৌন্দর্যের সাথে চতুর্দশী চাঁদের তুলনা করেছেন, কেউ বলেছেন তিনি ছিলেন যেন একটি ঝলসানো তরবারি, কেউ তাকে তুলনা করেছেন গোলাপ ও মখমলের সাথে।
তিনি স্বয়ং তার সৌন্দর্যের সাথে হজরত ইউসুফের (আ) সৌন্দর্যের তুলনা করেছেন। বরং তার কথায় এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে হজরত মুহাম্মদের (স) সৌন্দর্য হজরত ইউসুফের (আ) সৌন্দর্যকেও ছাড়িয়ে গেছে। অথচ একটিমাত্র ঝলক এমন দৃশ্যের অবতারণা করেছিল যে মহিলাগণ ফলমূল কাটার পরিবর্তে নিজের হাত কেটে ফেলেছিল। তারপর তারা স্বীকার করেছিল জুলেখার তার প্রেমে পাগলপারা হওয়া অমূলক না।
আল্লাহর নবীর (স) সৌন্দর্যও হজরত ইউসুফের সৌন্দর্যের মতোই দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স ও একাধিক স্ত্রী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও তরুণী হজরত আয়েশা (রা) নবীজির (স) প্রেমে এতটাই দিওয়ানা ছিলেন যে বিয়ের পর একবার কোনো এক সফরে তার সাথী হতে না পেরে সাপের আবাসস্থলে একপ্রকার ঘাসের ওপর পা রেখে মনোবেদনায় চিৎকার করে তিনি মুনাজাত করছিলেন—‘হে খোদা, আমাকে দংশনের জন্য এই ঝোপ থেকে সাপ বের করে আমার পায়ে লাগিয়ে দাও!’
খ.
হজরত মুহাম্মদ (স) অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও অত্যন্ত খোশবুদার ছিলেন। তিনি এত সংবেদনশীল ছিলেন যে অতি সূক্ষ্ম প্রতিক্রিয়াও তার শরীরে পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করত। আনন্দিত হলে তার চেহারায় রক্তিম আভা ফুটে উঠত, রাগান্বিত হলে গম্ভীর ভাব দেখা দিত। অর্থাৎ তার শরীর এত সুশ্রী ও স্বচ্ছ ছিল যে, যেকোনো আবেগই চেহারায় প্রতিফলিত হতো। ফলে কোনো আবেগই আর তার মনে লুকায়িত থেকে দুনিয়াকে প্রতারণা করতে পারত না।
তার ধৈর্য ও গাম্ভীর্য ছিল সীমাহীন; কিন্তু এই ধৈর্য গাম্ভীর্যের ক্রিয়াস্থল কেবল মস্তিষ্কে সীমিত থাকত—শরীরে নয়। আবেগ যদি দমনের প্রয়োজন হতো তবে তা সংকল্পেই দমন করতেন, শরীরে তার কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতো না।
তিনি এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিলেন যে কাপড়ে সামান্যতম দুর্গন্ধও তিনি সহ্য করতে পারতেন না। দিনে ও রাতে পাঁচবার মেসওয়াক করতেন, কোনো একবারও বাদ দিতেন না। এক নামাজ থেকে আরেক নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে মুখে যে সামান্য মলিনতা আসত তা-ই তার নিকট বরদাশত হতো না, তিনি তা-ও পরিষ্কার করে ফেলতেন। অথচ সাধারণত এ ধরনের মলিনতা বহু মানুষ অনুভব করতেও সমর্থ নয়। মানুষ সাধারণত দিনে একবার কিংবা বড়জোর দুইবার দাঁত ও মুখ পরিষ্কার করাকে যথেষ্ট মনে করে থাকে। কিন্তু আল্লাহর নবীর (স) মেসওয়াকের অভ্যাসটি এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে মুমূর্ষ অবস্থায়ও তিনি তা ভুলতে পারেননি ; অথচ এটি এমন একটি সময় যখন মানুষের সকল চেতনাশক্তি রহিত হয়ে যায়। আল্লাহর নবী (স) এই সময়েও মেসওয়াক ব্যবহার করেছেন। মেসওয়াক চিবিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তখন তার ছিল না, আম্মাজান হজরত আয়েশা (রা) চিবিয়ে নরম করে দেন, পরে তিনি ব্যবহার করেন।
সুযোগ পেলেই তিনি সুগন্ধি ব্যবহার করতেন, যাতে শরীর ও বস্ত্রের সামান্য দুর্গন্ধ মস্তিষ্ককে বিব্রত করতে না পারে। অথচ তার শরীরটাই ছিল প্রকৃতিগত খোশবুর ভান্ডার। এই ভান্ডার থেকে প্রতিনিয়ত খোশবু চতুর্দিকে ছড়িয়ে বাতাসকেও সুবাসিত করে তুলত। তার সাহচর্যে যারা থাকতেন তারা যেন সর্বদায় তার সেই খোশবুতে মাতোয়ারা থাকতেন। আল্লাহই জানেন তিনি পবিত্রতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে কত ভালোবাসতেন! কিন্তু এতকিছু থাকা সত্ত্বেও তার তৃপ্তি হতো না; প্রকৃতিগত খোশবুর সাথে আবার মানুষের তৈয়ারি খোশবু মিশাতেন। তিনি স্বয়ং এত সুগন্ধময় ছিলেন যে, যেদিকে গমন করতেন সেদিকে আকাশ বাতাস তার সুবাসে মোহিত হয়ে উঠত; আর তাকে খুঁজতে আসা মানুষ সেই সুবাস ধরে খুঁজে নিতে সক্ষম হতো।
এই সকল বর্ণনা অনেকের নিকট বিস্ময়কর মনে হতে পারে : উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদও উঠতে পারে যে হজরত মুহাম্মদের (স) জীবনচরিতকে কি অন্তত সন্দেহজনক এবং কাল্পনিক গালগল্প থেকে মুক্ত রাখা গেল না? কিন্তু মানবদেহ ও মানব সৃষ্টির স্বাভাবিক উপাদানসমূহ, যা নিয়ে এখনও বিতর্কের অবসান হয়নি, যদি কেউ সেগুলো একত্রে সন্নিবেশ করে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন এবং একবার এই নীতিকেই স্বীকার করতে সক্ষম হন যে, প্রকৃতি সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও বৈচিত্রহীন নয়, প্রকৃতির নিয়মের পূর্ণ অধীন হলেও তা ব্যতিক্রমের সম্ভাবনামুক্ত নয় এবং এই সঙ্গে যদি এ কথা উপলব্ধি করা সম্ভব হয় যে প্রকৃতির এই ব্যতিক্রম ও বিস্ময়কর প্রকাশ নিয়ম বহির্ভূত নয় বরং নিয়মসঙ্গত, এবং মানুষের নিয়ম-প্রকৃতি রহস্য উদঘাটনের অন্বেষা-স্পৃহা যাতে মানুষের চূড়ান্ত জ্ঞানাভিমানবশত কার্যকারণের মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ হয়ে না পড়ে, তার জন্য কতিপয় মৌলিক নীতি সক্রিয় রয়েছে, এই ব্যতিক্রম তারই অন্যতম—তা হলে এই ব্যাপারে বিস্ময়ের আর কোনো অবকাশ থাকে না। আর এটাও সত্য যে, তত্ত্বজ্ঞানের প্রকৃত অন্বেষীদল কখনও নিয়ম-কানুনের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকেন নাই। তাদের অন্বেষা সবসময় অব্যাহত রয়েছে এবং তারা প্রকৃতির বিস্ময়কর এমন অনেক রহস্য উদঘাটন করতে সমর্থ হয়েছেন সাধারণ মানুষ যা কল্পনাও করতে পারত না। আর, তাছাড়া প্রকৃতির নিয়ম ও পদ্ধতির ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো রায়দানও কারও পক্ষে সম্ভব নয় ; কেউ তা দিলেও তাকে সম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত বলে স্বীকার করা যায় না। এই জন্যই নিউটন অবশেষে মন্তব্য করেছিলেন : ‘জ্ঞানের রাজ্যে সারাজীবন বিচরণ করে এক্ষণে এ কথাই উপলব্ধি হচ্ছে যে, আমার অবস্থা ঠিক সেই বালকের মতো যে সমুদ্রের তীরে কুড়িয়ে পাওয়া চকমকে পাথর জমা করছে আর মনে মনে ভাবছে সে বুঝি গোটা সমুদ্র-সম্পদ আহরণ করে ফেলেছে!’
উপর্যুক্ত আলোচনার পর একটি বিষয় নিশ্চিত পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, হজরত মুহাম্মদের (স) দেহখানা প্রকৃতির চিররহস্যেরই একটি বিরল দিক। এমন বহু রহস্যই তো জগতে দেখা গেছে, এবং এখনও বিদ্যমান রয়েছে।
এখন হয়তো আবার দাবি উঠতে পারে যে তাহলে তো হজরত মুহাম্মদের (স) জীবনচরিত মোজেজা বা বিস্ময়কর ঘটনাসমূহের পরিপূর্ণ চিত্র থাকা দরকার। তা অবশ্যই কাম্য। তবে সহিহ বর্ণনা কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত ও মিথ্যা কল্পনামিশ্রিত বিষয়কে বাদ দিয়েই তা রচিত হওয়া উচিত। কারণ সহিহ বর্ণনায় পাওয়া বিস্ময়কর বিষয়কে হজরত মুহাম্মদের (স) জীবনচরিত থেকে বাদ দেওয়ার অর্থ যেমন জীবনী লেখার নীতিকেই হত্যা করা, তেমনই নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী কোনো অংশকে ত্যাগ করে যাওয়া আলোচ্য মানুষটির অসম্পূর্ণ চিত্র উপস্থাপন করারই নামান্তর। প্রকৃতপক্ষে একজন জীবনীকার ঘটনারই বর্ণনাদাতা। সুতরাং, জীবনী রচনায় জীবনীকারের কী অধিকার রয়েছে যে তিনি দর্শনের আলোকে ঘটনাকে বিকৃত করবেন? যদি এমনই হয় তাহলে ঘটনা বর্ণনাকারীদের প্রতি আস্থা বিনষ্ট হয়ে যাবে, জীবনী সন্দেহমূলক হয়ে উঠবে এবং সকল ইতিহাস পরিত্যাজ্য হয়ে পড়বে। এ কথা অতি সত্য যে ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই উত্তম কাজ, কিন্তু এক্ষেত্রে বুদ্ধির প্রয়োগ ঠিক নয়। কেননা প্রত্যেক ব্যক্তির স্বতন্ত্র বুদ্ধি রয়েছে। যদি এক ব্যক্তির এক হাজার জীবনীকার হয়, আর তারা সকলে নিজ নিজ বুদ্ধি প্রয়োগের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন, তাহলে একই ব্যক্তির হাজার রকম জীবনী রচিত হবে। ফলে আলোচ্য ব্যক্তির অসংখ্য জীবনী বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তার সত্যিকারের জীবনে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই প্রসঙ্গে আমি হজরত মুহাম্মদের (স) জীবনীকারদের মধ্যে আল ওয়াকিদিকে (৭৪৭-৮৩২ খ্রি.) স্বীকৃতি দান করি; অথচ হজরত মুহাম্মদের (স) জীবন-রচয়িতাগণ সকলে এক বাক্যে আল ওয়াকিদিকে ‘মরদুদ’ (পরিত্যাজ্য) আখ্যা দিয়েছে। আল ওয়াকিদির আসল দোষ হলো তিনি জীবনী রচনার ক্ষেত্রে বুদ্ধিকে কোনো স্থান দিতেন না, বরং হজরত মুহাম্মদের (স) জীবন-সংশ্লিষ্ট অলৌকিকত্ব বর্ণনায় লজ্জা বা ভয় করতেন না। অবশ্য কেউ কেউ বলেন তিনি মিথ্যা বর্ণনাও করেছেন। কিন্তু কারা এ অভিযোগ করছেন? রেওয়ায়েতশাস্ত্রকে যারা দার্শনিকতার পর্যায়ে উন্নীত করতে অক্ষম ছিলেন এবং সত্য সম্পর্কে একটি সাধারণ পর্যায়ের নিয়ম মেনে চলতেন ও এরই ভিত্তি মজবুত রাখার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকবেন, এই অভিযোগ তারাই এনেছেন।
তার চোখ দুটো ছিল টানা টানা। তাতে যেন প্রকৃতিগতভাবেই সুরমা লাগানো ছিল। তার যুগল ভুরু, প্রশস্ত ও উচ্চ ললাট এবং ঝকঝকে দাঁত সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করত। তার মাথায় চুল কোঁকড়ানো, হাতের তালু মাংসল, কাঁধ প্রসারিত এবং বাহু সবল ছিল। শরীরের রঙ ছিল উজ্জ্বল ও রক্তিমাভাযুক্ত গোলাবি। কখনও ঘাম দেখা দিলে তা মুক্তার মতো ঝলমল করত।
স্বভাব ও আখলাক
হজরত মুহাম্মদ (স) যেমন অত্যন্ত নীরবতাপ্রিয়, অত্যন্ত স্বল্প ও সারভাষী ছিলেন, তেমনই তিনি ছিলেন অত্যন্ত চিন্তাশীল ও ব্যথাদীর্ণ, ধ্যানমগ্ন, গম্ভীর ও সদা সচেতন। তিনি এত নীরব থাকতেন যে অপরিচিত ব্যক্তি তাকে আজন্ম বোবা বলে ভুল করে বসত; অতিরিক্ত একটি কথাও বলতেন না। যা বলতেন, তা-ও ঠিক প্রয়োজনমাফিক। গল্পচ্ছলেই গল্প ও অযাচিত কথা বলে জবানকে অপবিত্র করা ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ। যদি কখনও কোনো অতিভাষী তার নিকট আসত, তাহলে সে তার অতিভাষণের অভ্যাসই ভুলে যেত এবং আল্লাহর নবীর (স) নীরবতার প্রভাবে পড়ে প্রয়োজনীয় কথা বলাতেই সন্তষ্ট থাকত। দুর্ভাগ্যবশত যদি কেউ অতিরিক্ত কথা বলতেই থাকত তবে তিনি তা নীরবে শুনে যেতেন। কারণ, না শুনলে হয়তো-বা সে দুঃখিত হবে বা নিজেকে অপমানিত মনে করে বসবে। ‘সহ্য করিব, তবু অন্যের অন্তর দীর্ণ করিব না’—এই নীতি পুরাপুরি অনুসরণের জন্যই যে তিনি এই কাজ করতেন, এতে কোনো সন্দেহ নাই।
তিনি এত স্বল্পভাষী ছিলেন যে, দিন ও রাতের মধ্যে যা কিছু বলতেন তার হিসাব রাখা অসম্ভব ছিল না। অবশ্য, এজন্য এরূপ ভুল করবার কোনোই কারণ নাই যে এর ফলে কাজকর্ম কম হয়ে থাকবে এবং নির্জনতাপ্রিয়তা প্রাধান্য লাভ করার ফলেই হয়তো তার স্বল্পভাষণের অভ্যাস হয়ে থাকবে। এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্তিপূর্ণ।
প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহর নবীকে (স) এত কাজ করতে হতো যা কখনও কারও করতে হয় নাই। তার দৈনন্দিন কার্যতালিকা দেখলে যে-কেউ চমকে উঠবে এবং বলতে বাধ্য হবে যে, দুনিয়ায় আর কারও এত কাজ করতে হয়নি। এমন ব্যস্ততায় নির্জনতাপ্রিয়তার স্থানই-বা কোথায়? প্রকৃতপক্ষে, তিনি নির্জনতাপ্রিয় নয়, ছিলেন সত্যিকারের সংসর্গ-প্রিয়। কিছুদিনের জন্য তাকে অবশ্য নির্জনতা অবলম্বন করতে হয়েছিল, কিন্তু তাও ছিল সাময়িক এবং মহাজীবনের প্রস্তুতির জন্যই।
নির্জনতা ও মৌনব্রত অবলম্বনকারী সুফি ও খানকাহ-আখড়াপ্রিয় মোল্লা-মৌলবিদের কিংবা যোগী ও সন্ন্যাসীদের কার্যকলাপের প্রতি লক্ষ্য করে আল্লাহর নবী (স) সম্পর্কে কেউ কেউ উপর্যুক্ত ধারণা করছেন কি? কিন্তু তার কার্যাবলীর সাথে তাদের সম্পর্ক কিংবা মিল কোথায়? এ কথা সত্য যে আল্লাহর নবীর (স) সামগ্রিক জীবনবৃক্ষের একটি শাখা সুফিবাদের সাথে যুক্ত। কিন্তু বৃক্ষটিকে পর্যবেক্ষণ করলে প্রতীয়মান হবে যে ওটা সম্পূর্ণ আলাদা এক দুনিয়া। হজরতের সামগ্রিক জীবন নবুওয়তেরই পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি। কোনো একটি বিষয়ের বিশেষ দিক তার পূর্ণ চিত্র ফুটিয়ে তুলতে কিছুতেই সক্ষম হবে না। তা ছাড়া, আল্লাহর বিশেষ গুণেও তা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। সুতরাং, সারা সৃষ্টিজগৎ মিলেও তার পূর্ণচিত্র আঁকতে সক্ষম নয়। তা হলে আল্লাহর নবীর (স) জীবনের সাথে নির্জনতার আর কীই-বা সম্পর্ক? আর ইহলৌকিক ও পারলৌকিক—উভয় জগতের কর্মেরই যেখানে সমন্বয় ঘটেছিল সেখানে কাজ ‘কম ছিল’ এ প্রশ্ন উঠতেই পারে না। তবু প্রশ্ন থেকে যায় যে, তাহলে তার এই অস্বাভাবিক নীরবতা ও অতি স্বল্পভাষী স্বভাব কী করে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল? এই অবস্থায় তো বিশেষ করে শিক্ষাদান, উপদেশ-সংক্রান্ত কার্যাবলী অচল হওয়ারই কথা।
কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার যে, কাজ কেবল কথা ও দীর্ঘ বক্তৃতার মাধ্যমেই হয় না, ইশারা ও সংক্ষিপ্ত একটি বাক্য দিয়েও সাধিত হতে পারে। অনেক সময় তো ইশারারও প্রয়োজন পড়ে না। যেমন কোনো ব্যক্তি তার অনুসারী দলবলের সাহায্যে কোনো কাজ করতে চান, এক্ষেত্রে ইশারা ছাড়াই তিনি উপস্থিত সকলের দ্বারা তা করাতে পারবেন—যদি তিনি নিজেই সেই কাজটি করতে শুরু করেন। শর্ত একটাই—অনুসারীদের ঝুদ্ধিমান ও তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তা হলে তিনি কাজ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সকলেই তাতে অংশ নিতে শুরু করবে।
এ কথা অবশ্য সত্য যে, অল্প কথা, ইশারার মাধ্যমে ও ইশারা ছাড়া কাজ করাবার জন্য যেমন গভীর প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন, তেমনই কর্মটিও সকলের মনঃপূত হওয়া দরকার। আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে আল্লাহর নবী (স) এবং তার কার্যাবলীর মধ্যে এই দুইটি বিষয়ই পু্রোমাত্রায় বিদ্যমান ছিল।
তিনি যে কী পর্যায়ের স্বল্পভাষী ছিলেন এখানে তার দুই একটা নমুনা বিচার-বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। একবার মদিনার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্র আউস ও খাজরাজের মধ্যে সংঘর্ষের উপক্রম হলো। পূর্বে তাদের মধ্যে শত্রুতা বিদ্যমান থাকলেও ইসলাম পরস্পরকে প্রীতিবন্ধনে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু হঠাৎ সেই প্রদমিত শত্রুতা মাথা চাড়া দেওয়ায় জাহিলিয়াতের অভ্যাস অনুযায়ী খোলা তরবারি নিয়ে উভয় গোত্রের লোকে পরস্পর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। আল্লাহর নবী (স) এ কথা জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এই একটি বাক্য বললেন : ‘আমি তোমাদের মধ্যে থাকতেই তোমরা আবার জাহিলি যুগের আচরণ শুরু করে দিয়েছ?’ তার এই বাক্যটি দীর্ঘ ও জ্বালাময়ী বক্তৃতার চেয়ে বেশি কার্যকরী হলো। উপস্থিত সকলেই তরবারি খাপবদ্ধ করে অনুশোচিত ও অশ্রুসিক্ত নয়নে নিজ নিজ অবস্থানে প্রত্যাবর্তন করল। তার কথার এই যাদুকরী প্রভাব সাময়িক ছিল না—ছিল স্থায়ী। তিনি যতদিন এই দুনিয়ায় অবস্থান করে গেছেন ততদিন এই গোত্রগুলোর মধ্যে আর কোনো শত্রুতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাব পরিলক্ষিত হয় নাই।
তিনি যে কী রকম সংক্ষিপ্ত সারকথা বলতেন তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ তার হাদিসগুলো। যেকোনো একটি হাদিস নিয়েই বিচার করুন না কেন, দেখতে পাবেন যে, হাদিসটি যেমন সংক্ষিপ্ত, তেমনই সাহিত্যের এক নয়া অবদান। আল্লাহর কালামের পরেই হাদিসের স্থান, আর হাদিস মানবরচিত সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন—কোনো কিছুই তার সমকক্ষতা দাবি করতে পারবে না।
সংক্ষিপ্ত ও সারকথা বলার আরও একটি দিক রয়েছে। তা হলো, যা-ই বলা হোক না কেন, উত্তমভাবে বলতে হবে; অর্থাৎ স্পষ্ট, বীর্যপূর্ণ, প্রত্যেকটি শব্দ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও গুছানো হওয়া দরকার। আল্লাহর নবীর (স) মধ্যে এর প্রতিটি গুণ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। তিনি যা কিছুই আর যতটুকুই বলতেন, এমনভাবে তা বলতেন যেন অতটুকু কথা বলাই তার সারাজীবনের কাজ। তিনি প্রতিটি শব্দের ওপরই জোর দিয়ে এবং প্রত্যেক বাক্যই কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করে কথা বলতেন। তিনি যা বলছেন, তা যেন পষ্ট শোনা যায়, সকলেই যেন তা উপলব্ধি করতে ও মুখস্থ করে নিতে সক্ষম হয়, অতঃপর যেন তা হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে আবার অপরের নিকট পুনরাবৃত্তি করতে পারে এবং শ্রোতা বা অন্য কেউ যেন তার গুরুত্ব লাঘব করতে না পারে এই সকল বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখেই যেন তিনি কথা বলতেন।
হজরত মুহাম্মদ (স) খুবই চিন্তামগ্ন থাকতেন; বারবার আসমানের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন, যেন মাথায় তার কীসের এক চিন্তা, তারই চূড়ান্ত রূপদানের জন্য অন্তরকে তিনি প্রসারিত করেছেন সর্বশক্তিমানের দিকে সাহায্যের প্রত্যাশায়।
তার গভীর নীরবতা ও স্বল্পভাষীতার জন্য খানিকটা দায়ী ছিল তার এই চিন্তামগ্নতা। কারণ, চিন্তা যখন সর্বাঙ্গে প্রভাব বিস্তার করে এবং মনমস্তিষ্ক থাকে সমাধান-অন্বেষায় নিমগ্ন তখন স্বভাবতই গাম্ভীর্য প্রাধান্য লাভ করে এবং বাকশক্তি মৌন হয়ে যায়। এছাড়া, তার এমন ফুরসতই-বা কোথায় ছিল যে অত অধিক কথা বলবেন। অতিরিক্তকথা বলা তো শূন্যমস্তিষ্ক ও চিন্তাশক্তিহীনতারই পরিচায়ক। সুতরাং যখন মনমস্তিষ্ক চিন্তাভাবনায় পরিপূর্ণ, তখন অতিরিক্ত কথা বলার উৎসাহ আসবেই-বা কোথা থেকে?
তিনি এমন ব্যথিতচিত্ত থাকতেন যে, সারা জীবনে কখনও তাকে উচ্চস্বরে হাসতে দেখা যায় নাই। কখনও কখনও স্মিত হাসতেন বটে, কিন্তু সে হাসিতেও বিষাদেরই বিদ্যুৎ চমকে উঠত, যেন এ কথা বলত যে, এই বিদ্যুৎ আনন্দের উচ্ছ্বাস নয়, বিষাদের মেঘমালা হতেই এটি বের হয়েছে।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধ্যানমগ্ন প্রকৃতির। এমনকি, সর্বকনিষ্ঠা স্ত্রী ও সৌন্দর্যের রানি বিছানায় রয়েছেন, বাহ্যত তাকে ভালোবাসা ও প্রীতির পরশেও আপ্লুত করে দিচ্ছেন—কিন্তু প্রিয়তমা স্ত্রী নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ার পরই তিনি ক্ষিপ্রগতিতে উঠে পড়ছেন এবং পবিত্রতা হাসিলের পর নামাজে দাঁড়িয়ে গেছেন। নামাজে দাঁড়িয়েছেন তো ভুলে গেছেন যে, প্রকৃত মাশুক ও প্রকৃত আরাধ্য ছাড়া আর কোনো কাম্য ও প্রিয়জন আছেন যিনি বিশ্বের সৌন্দর্য-ভান্ডার নিয়ে তার পাশেই পড়ে রয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী হিশাবে হজরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন : আল্লাহর নবী (স) যখন তাহাজ্জুদ নামাজে গভীরভাবে নিমগ্ন হয়ে পড়তেন তখন তিনি এক এক রাকাত এত লম্বা করতেন যে, আমি বারবার জাগ্রত হতাম এবং তার নামাজ শেষ হবার জন্য প্রতীক্ষা করতাম, প্রতীক্ষা করতে করতেই আবার ঘুমিয়ে পড়তাম, কিন্তু তার প্রথম রাকাত শেষ হতো না। তিনি যখন রুকুতে যেতেন, তখন মনে হতো যে, তিনি বুঝি দাঁড়াবার কথা ভুলেই গেছেন; আবার যখন রুকু থেকে দাঁড়াতেন তখন মনে হতো সেজদার কথা ভুলে গেছেন।
তিনি এত সজাগ ও হুঁশিয়ার ছিলেন যে গাছের একটি পাতা ঝরে পড়লেও তিনি তা টের পেতেন। প্রতিবেশীর কোনো শিশু কেঁদে উঠল, তিনি হয়তো তার কারণ অনুসন্ধানের জন্য নিজেই বের হয়ে পড়লেন। যুদ্ধের সময়ে অন্ধকার রাত্রে হয়তো অকস্মাৎ বাহির হয়ে গেলেন আর ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তৎক্ষণাৎ সমস্ত ফৌজের খবর নিয়ে ফিরে আসলেন। কারও মলিন মুখ দেখলেই তিনি অনুসন্ধান করে তার কারণ জেনে নিতেন; যদি জানতেন যে অমুক ব্যক্তি ক্ষুধার্ত রয়েছে, তাহলে তার খাবারের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত তিনি স্বস্তি পেতেন না।
আল্লাহর নবী (স) কঠোর পরিশ্রমী, পরম ধৈর্যশীল, অত্যন্ত সন্তষ্টচিত্ত এবং অত্যন্ত দৃঢ়সংকল্প ছিলেন। তিনি এত পরিশ্রমী ছিলেন যে, সকলে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও তিনি ক্লান্ত হতেন না। প্রতিদিন এত বেশি কাজ করতেন যা অন্যকারও পক্ষে করা মোটেও সম্ভব ছিল না। এমনকি, হয়তো লাগাতার কয়েকদিন উপোস ছিলেন, তারপরেও তিনি গৃহে নিজ দায়িত্ব এবং বাহিরের সকল কাজই সম্পন্ন করেছেন। এই অবস্থাতেও তিনি শিক্ষাদান, সংগঠন, নেতৃত্ব, বিচার, দর্শনপ্রার্থীদের সাক্ষাৎদান এবং লেনদেন—সকল কাজই সুষ্ঠুভাবে করেছেন। এত কিছুর পরেও শেষরাত্রে আবার দীর্ঘ এবাদতে এমনভাবে মগ্ন হয়ে পড়েছেন যে ভাবতেও বিস্ময়বোধ হয়। এমন ধৈর্য ও গাম্ভীর্যের সাথে তিনি এইসব কাজ সমাধা করতেন যে মুখে তার সামান্য ‘উহ’ শব্দও উচ্চারিত হতো না, যেন বুকে তার ব্যথার লেশমাত্রও নাই।
এরূপ অবস্থার মধ্যেও তার কাজ এমন নিখুঁত, সুন্দর, সুষ্ঠু এবং সময়মতো সম্পন্ন হতো যে, অন্যকারও পক্ষেই সেইভাবে তা সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। তিনি এত ধৈর্যশীল ছিলেন যে ভাষায় তার বর্ণনা সাধ্যাতীত। ‘কৃতজ্ঞচিত্ত’ বললে বরং তার ধৈর্যশীলতা সম্পর্কে কিছুটা আভাসমাত্র দেওয়া যায়। দুনিয়ায় কেই-বা এমন আছেন সারাজীবন যিনি রিক্ততার মধ্যেই অতিবাহিত করেছেন, সারাজীবন পরিশ্রমে লিপ্ত ছিলেন আর গোটা জীবনটাই কেবল বিপদ-আপদের মধ্যে কাটিয়েও সর্বদা কৃতজ্ঞচিত্ত এবং সারাজীবন সমান কর্মতৎপর ছিলেন, কখনও কোনো অভিযোগ করেন নাই। আর যিনি এমন একটি জাতির স্রষ্টা, যে-জাতি কঠোর পরীক্ষা ও গুরুদায়িত্ব পালনের সময়েও বিস্ময়কর কর্মমুখরতা ও অসীম ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন। সারা দুনিয়া ও গোটা মানবজাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এমন ব্যক্তির সংখ্যা খুব অল্পই দেখা যাবে।
তার পরিশ্রম ও কঠোর জীবনযাপনের কাহিনী এত প্রসিদ্ধ যে, তা বিস্তারিত তো দূরের কথা, সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করারও প্রয়োজন পড়ে না, তবু আমরা এখানে তার ‘যৎকিঞ্চিৎ’ আলোচনা করব।
পরিশ্রম
আল্লাহর নবী (স) নিজ হাতে স্বীয় পরিধেয় ছিন্ন বস্ত্ৰ সেলাই করতেন এবং জুতার তালি লাগাতেন। তিনি গৃহকর্মে সাহায্য করতেন, প্রয়োজনবোধে আটাও পিষতেন। কোনো খাদেমের সাহায্য নিলে তার পরিবর্তে তিনি খাদেমের কাজ করে দিতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মসজিদে ইমামতি করতেন। অতিথি, দর্শনপ্রার্থী, স্থানীয় ও নবাগত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎদান করতেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি স্বয়ং অভাবগ্রস্তদের নিকট গিয়ে তাদের অভাব-অভিযোগের বিষয় জেনে নিয়ে তা পূরণ করার চেষ্টা করতেন। শিক্ষাদান-কার্যেও তাকে ব্যাপৃত থাকতে হতো। কোথাও বিবাদ বাঁধলে সেদিকেও মনোযোগ দিতে হতো; উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে তিনি তার মীমাংসা করে দিতেন। যুদ্ধের সময়ে স্বয়ং সৈন্য সংগ্রহ ও ভর্তি করতেন, ঝাণ্ডা প্রস্তুত করতেন, আবার তা নিজ হাতে বিতরণও করতেন। বহু যুদ্ধে তিনি স্বয়ং অংশগ্রহণ করে সকল দুঃখ-ক্লেশের ভাগী হয়েছেন; কখনও-বা সরাসরি যুদ্ধও করেছেন। গনিমত বা যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ তিনি একত্র করাতেন, তারপর নিজ হাতেই তা ভাগবাঁটোয়ারা করতেন।
শিক্ষক ও প্রচারক তৈরি করে তিনি তাদেরকে নির্দিষ্ট স্থানে পাঠিয়ে দিতেন। শিক্ষক ও প্রচারকগণ যে-সংবাদ পাঠাতেন তা পরীক্ষা করে সেই সম্পর্কে নিজস্ব অভিমত গড়ে তুলতেন। সংকট উপস্থিত হলে তা দূরীকরণের উপায় উদ্ভাবনের চিন্তাভাবনা করতেন এবং সেই জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করতেন। তিনি বিচারক, শাসনকর্তা ও জাকাত-উশর আদায়কারী নিয়োগে করতেন; তাদেরকে বিশেষ উপদেশও দান করতেন। তিনি মেহমানদারি করতেন, ধর্মপ্রচারও করতেন। মক্কা এবং মদিনা উভয় স্থানেই তার ওপর ঐশীবাণী বা ওহি নাজিল হতো। তিনি এই ওহি গ্রহণ করতেন এবং তা সংরক্ষণ করাতেন। তিনি যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের অনুশীলনী করাতেন এবং নিজেও তাতে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি ক্ষুধার্তের জন্য অন্ন, বস্ত্রহীনের জন্য বস্ত্র, এবং উপায়হীনের জন্য জীবিকার্জনের ব্যবস্থা করে দিতেন। তিনি রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে দেখতে যেতেন, জানাজার নামাজ পড়াতেন, মৃত ব্যক্তির আত্মার মাগফেরাত কামনা করতেন। এছাড়াও তাকে আরও অসংখ্য বাতেনি বা অপ্রকাশ্য কার্যে লিপ্ত থাকতে হতো। এই বাতেনি বা অপ্রকাশ্য কার্যের সংখ্যাও এত অধিক যে তা বর্ণনা করতে গেলে এই গ্রন্থে স্থান সংকুলান হবে না। মোটামুটি এতটুকু উল্লেখ করলেই যথেষ্ঠ যে, তিনি একদিকে যেমন অন্তরকে সকল প্রকার কলুষ থেকে মুক্ত, পবিত্র এবং তাকে আলোকিত করার কার্যে ব্যাপৃত থাকতেন, তেমনই এমন সব গঠনমূলক কার্যে তিনি লিপ্ত থাকতেন যার সম্পর্ক কেবল বাতেনের সাথে, বাহিরের জগৎ যা আঁচ করতেও পারত না।
উল্লিখিত বর্ণনায় আল্লাহর নবীর (স) পরিশ্রমের কর্মসূচি শেষ হয় নাই। কারণ, এতে কেবল দিন ও সন্ধ্যা রাতের বিষয় উল্লিখিত হয়েছে, শেষরাত্রের বিষয় এখনও অবশিষ্ট রয়েছে। তার শেষোক্ত সময়ের কার্যও কম পরিশ্রমের ছিল না। এই পরিশ্রম এমন ছিল যে, তার হাত-পা অবশ হয়ে যেত। এটি ছিল তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়ের পরিশ্রম। তাছাড়া, সাধারণ মানুষ যে তাহাজ্জুদ আদায় করে থাকে এটি তেমন নামাজ ছিল না। তিনি যেমন অনুপম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন তেমনই তার তাহাজ্জুদও ছিল বিশেষ ধরনের। এর এক এক রাকাতে পবিত্র কোরআনের দুই-তিন পারা খতম হয়ে যেত। প্রতিটি রুকু ও সেজদাতেও কেটে যেত এক ঘন্টার চারভাগের একভাগ।
কষ্ট-সহিষ্ণুতা
এই সকল পরিশ্রমের পরেও ছিল কঠোর জীবনযাপনের পালা। মাসের পর মাস পেট পুরে খাবার জুটত না। যা মিলত তাও এমন নীরস, স্বাদহীন ও খাদ্যপ্রাণশূন্য যে, জীবনীশক্তি সতেজ না হয়ে দুর্বল হয়ে যাওয়ারই কথা এবং রক্তবৃদ্ধির পরিবর্তে তাতে রক্তশূন্যতাই বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। তার ওপর ছিল সর্বদা বিপদ-আপদ ও মানসিক নির্যাতন। মক্কায় অবস্থানকালে, যখন শারীরিক নির্যাতন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, গালিগালাজ ও অন্যান্য উপায়ে মানসিক পীড়নে তাকে ক্লিষ্ট করে তোলা হতো, সামাজিক জীবন হতে বিচ্ছিন্ন করে গৃহহীন, আত্মীয়-স্বজনহারা ও অসহায় করে দেওয়া হতো, কারও সাথে মেলামেশার এবং শিক্ষাদান, প্রচার প্রভৃতি কোনো কার্যেরই যখন সুযোগ দেওয়া হতো না, তার ওপরে আবার তার নিজের ও সাথীদের জীবনকে পদে পদে করে তোলা হতো কণ্টকাকীর্ণ, তখন এরূপ পরিশ্রমের সঙ্গে কঠিন বিপদ-আপদ মিলিত হয়ে ইস্পাতের মতো কঠিন হৃদয়কেও গলিয়ে পানি করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু হজরত মুহাম্মদ (স) ছিলেন এমনই মহান যে তিনি সবকিছুকেই সানন্দে ও সাহসের সাথে গ্রহণ করেছিলেন। মদিনায় অবস্থানকালে অনবরত যুদ্ধ, অহরহ প্রাণহানির আশঙ্কা, দলীয় লোকদের জীবনধারণ উপযোগী সম্বলও না থাকার স্থায়ী সমস্যা, প্রচারকদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যার বিষাদজনক ঘটনা, সন্ধিচুক্তি ভঙ্গের ফলে সৃষ্ট অসুবিধা, বেদুইন গোত্ৰসমূহের অপ্রত্যাশিত হামলা, ইহুদিদের ষড়যন্ত্র, মুনাফেকদের বারবার চক্রান্ত, মক্কায় অবস্থানকারী মুসলমানদের নির্যাতনের সংবাদ ও তার প্রতিকারের চিন্তা—এসবের মোকাবেলায় যেকোনো মানুষের পক্ষেই নিস্তেজ হয়ে পড়ার কথা। কিন্তু তিনি ছিলেন এমনই সতেজ যে, সবকিছুকে তিনি হাসিমুখে ও বীরত্বের সাথে শুধু বরণই করেননি, সকল সংকট অতিক্রম করে নিজেকে এমন পর্যায়ে উপনীত করেছিলেন যেখানে সকল দুঃখ-কষ্টের অবসান হয়ে গেছে, সকল কাঁটা ফুল হয়ে ফুটে উঠেছে। তিনি স্বয়ং তাতে না থাকুন, কিন্তু তিনি যে-জাতির স্রষ্টা তাদের হস্তগত হয়েছে চিরন্তন আনন্দ ও স্থায়ী স্বাচ্ছন্দের এক মহান সামগ্রী, যার কোনো তুলনা এই ধরাধামে হতে পারে না। তিনি নিজে না থাকুন, কিন্তু তারই বদৌলতে অর্জিত হয় সেই ‘মাকামে মাহমুদ’ বা উচ্চপ্রশংসিত অবস্থান—যার কল্পনাও কোনো মানুষ কখনও করতে পারত না।
সন্তুষ্টচিত্ততা
আল্লাহর নবী (স) এমন সন্তুষ্টচিত্ত ছিলেন যে, এক মহারাজ্যের একচ্ছত্র ও প্রতাপশালী অধিপতি এবং শাসক হয়েও কম্বল-চাটাই ও মসজিদের ছোটো কামরা আর খাদ্যের মধ্যে ছাতু এবং খেজুর সম্বল করেই গোটা জীবন অতিবাহিত করে গেছেন। তার এই সন্তুষ্টচিত্ততা কোনো সাময়িক বিষয় ছিল না। অভাব-অনটন এবং বিত্তশালিতা উভয় অবস্থায়ই তার এই বৈশিষ্ট্য সমভাবে উজ্জ্বল ছিল। মক্কার অলিতে গলিতে যখন তিনি নিঃস্ব ও সম্বলহীন অবস্থায় ঘুরতেন এবং মদিনায় উপস্থিতির পর যখন তার ও তার সঙ্গীদের জীবনধারনের কিছুমাত্র সম্বল ছিল না, তখন যেমন তার মধ্যে সন্তুষ্টচিত্ততা বিরাজ করত, তেমনই তার সন্তুষ্টি জগৎবাসী তখনও প্রত্যক্ষ করেছে যখন সমগ্র আরবের ধনদৌলত চারদিক থেকে বন্যা-বেগে মদিনার সেই দীনহীন সুলতানের পদতলে এসে লুটিয়ে পড়ছিল। এতে এই সত্যটিও উপলব্ধি করা যায় যে, এই সন্তুষ্টচিত্ততা উপার্জনবিমুখ সুফির নির্লিপ্ততা বা নিঃস্ব অথচ ভোগাসক্ত ব্যক্তির গত্যন্তরহীনতা থেকে উদ্ভূত ছিল না। এটি ছিল বিত্তবান রাজ্যাধিপতির সন্তুষ্টচিত্ততা। এর মূল্য নির্ণয় সহজসাধ্য নয়। তার এই সন্তুষ্টচিত্ততা স্বভাবতই একক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ও পরম সৌকর্যমণ্ডিত; এটি সেই সন্তুষ্টচিত্ততারই অভিব্যক্তি ইসলাম সব সময় যার অনুপ্রেরণা যুগিয়ে থাকে। সম্বলহীনতা ও গত্যন্তরহীনতা-উদ্ভূত সন্তুষ্টচিত্ততা বরং এর বিপরীত জিনিশ; এইগুলো অভিপ্রেত ও প্রশংসিতও নয়। প্রকৃতপক্ষে এইগুলো সন্তুষ্টচিত্ততাই নয়—তার প্রহসনমাত্র।
তিনি অত্যন্ত উচ্চাভিলাসী ছিলেন, এমন পর্যায়ের উচ্চাভিলাসী যে, পার্থিব ক্ষেত্রে নিঃস্ব ও অসহায় অবস্থা থেকে একাধারে রাজ্যাধিপতি ও তর্কাতীত নেতৃত্বের উচ্চাসনে সমাসীন হয়েও তিনি তার অভিলাস তুরঙ্গের গতিকে শ্লথ হতে দেননি; বরং অভিলাস ও অভিযানের গতিবেগ তীব্র হতে তীব্রতর করেছেন এবং সমগ্র ধরণীর আধিপত্য ও নেতৃত্ব লাভের জন্য প্রকাশ্যে দাবি জানিয়ে নিকটতম সকল রাজ্যের অধিপতি ও শাসকদের নিকট এই বলে চিঠি প্রেরণ করেন যে—‘আসলিম তাসলাম’, অর্থাৎ ‘আনুগত্য বরণ করো, তবে মুক্তি পাবে।’
অপরদিকে, আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে মেরাজের সৌভাগ্য অর্জন করেও তার আধ্যাত্মিকতার অভিলাস-অভিযান নিবৃত্ত হয় নাই। অথচ, আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে মানবজাতির ইতিহাসে মেরাজের কোনো তুলনাই নাই। তবু তার এই পিপাসা যেন ক্রমশ বৃদ্ধিই পাচ্ছিল। কেবল আল্লাহ ও আল্লাহর রসুলই জানতেন, মেরাজের পরেও সান্নিধ্য ও সৌকর্যের কোনো মোকাম অবশিষ্ট ছিল যার কামনা তাকে অধীর করে রাখত। হতে পারে, এই জড়জগতে যা লভ্য নয় মিলন ও আসক্তির তেমনই এক ‘মোকাম’ লাভই তার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল; আর, সেই কামনাই তার মতো পরম উচ্চাভিলাসীকে হরহামেশা অধীর করে রেখেছিল।
ভদ্রতা
আল্লাহর নবী (স) অতি ভদ্র, অত্যন্ত নম্র, পরম মার্জিত ও দয়ার্দ্র স্বভাবের ছিলেন। তিনি এমন ভদ্র ছিলেন যে, কেউ গালি দিলে তা চুপ করে শুনতেন, প্রত্যুত্তরে মুখ খুলতেন না। কেউ আঘাত করলেও প্রতিবাদ করতেন না বা অভিশাপ ও গালি দিতেন না। কখনও যদিও-বা মুখ খুলতেন তা গালি বা অভিশাপ দেওয়ার জন্য নয়, গালিদাতার মঙ্গল ও কল্যাণ কামনার জন্যই। এমনকি, সঙ্গীরা অভিশাপ দেওয়ার জন্য তাকে পীড়াপীড়ি করলে তদুত্তরে তিনি বলেছেন : ‘অভিশাপ দেওয়ার জন্য নয়, মঙ্গল ও কল্যাণ কামনার জন্যই আমার আগমন হয়েছে।’
কোনো সময় তার জন্য জীবন উৎসর্গকারীদের কেউ অভিশাপ বা মন্দ বলার জন্য মুখ খুললে তৎক্ষণাৎ তিনি তাকে বারণ করতেন এবং বলতেন : ‘এটি মুমিনের মর্যাদার যোগ্য কাজ নয়।’
একবার তো তিনি ভদ্রতার এমন চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন যে, প্রত্যক্ষদর্শীরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধক্ষেত্র কারও অস্ত্রের আঘাতে তার দাঁত পড়ে গেছে। এর মধ্যে কপালেও আঘাত লেগেছে এবং ক্ষতস্থান হতে নির্গত রক্তধারা গণ্ডদেশ বেয়ে চলছে। তিনি এই অবস্থায় রক্ত মুছছেন আর বলছেন : ‘হে খোদা তুমি আমার জাতিকে সত্যপথ প্রদর্শন কর। তারা অবুঝ।’
তিনি এত দয়ার্দ্রচিত্ত ছিলেন যে মানুষ যেমন মৃত ব্যক্তির জন্য কেঁদে থাকে তিনিও জীবজন্তুর কাঁদনে তেমনই কেঁদে ফেলতেন। অসহায় বৃদ্ধলোক দেখলে তার হৃদয় দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠত। নিঃসহায় পিতা-মাতৃহীন বালক-বালিকার দুঃখবেদনায় তিনি কাতর হয়ে পড়তেন। অভাবগ্রস্তের দীর্ঘশ্বাস তার বুকে শেলের মতই বিঁধত।
শিষ্টতা
তিনি এত শিষ্ট ছিলেন যে, সারা জীবনেও কখনও একটি কটু বাক্য তার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়নি কিংবা একটি অভদ্র আচরণও তার কার্যকলাপে প্রকাশ পায়নি। অসামাজিক বা শিষ্টাচাবিরোধী একটি কার্যও তার সমগ্র জীবনে পাওয়া যাবে না। তিনি যে কেবল সভা-সমাবেশ ও মানুষের সামনেই শিষ্টাচার করতেন তা নয়, বরং গৃহাভ্যন্তরে এবং একা অবস্থানকালেও তার শিষ্টতা বজায় থাকত।
তবে এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তিনি কোন ধরনের শিষ্টাচার-অনুসারী ছিলেন এবং সেই শিষ্টতার মাপকাঠিই-বা কী ছিল? বিষয়টি স্বতন্ত্রভাবে আলোচিত হওয়া উচিত। এই গ্রন্থেরই অন্যত্র এর বিশদ আলোচনা করা হবে। এখানে শুধু এইটুকু জেনে রাখলেই চলবে যে, আল্লাহর নবী (স) শিষ্টতা ছিল রব্বানি শিষ্টতা। তিনি অত্যন্ত প্রসন্নচিত্তের অধিকারী ছিলেন। তার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে এমন কেউই বলতে পারবেন না তিনি হজরতের মৃদু-হাস্য উদ্ভাসিত মুখের অভ্যর্থনা লাভ করেন নাই।
তার এই প্রসন্নতা কেবল বন্ধুদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না, শত্রুদের সাথেও তিনি অনুরূপ প্রসন্নতাই প্রদর্শন করতেন। আত্মীয়-অনাত্মীয়, পরিচিত-অপরিচিত, ধনী-নির্ধন, বিত্তবান ও দুঃস্থ-কাঙাল—সর্বশ্রেণির লোকের জন্যই তার প্রসন্নচিত্তের দুয়ার সদাসর্বদা উন্মুক্ত থাকত এবং সকলকে এর মাঝে আশ্রয়দানের জন্য আগ্রহে প্রতীক্ষা করত। এইখানে এসে সকলেই সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করত যে এই একমাত্র আশ্রয়স্থল যেখানে কেবল মনুষত্বই মর্যাদা পেয়ে থাকে এবং যেকোনো সৃষ্টজীবই আশ্রয় পেতে পারে। এখানে সকল ভেদাভেদ বিলুপ্ত, সকল শ্রেণি-বৈশিষ্ট্যও অনুপস্থিত—এখানে হীন চাকরও মর্যাদাবান এবং নিঃস্ব দিনমজুরও সম্মানিত। এখানে রাজা হিশাবে কেউ অধিক সম্মান পাবে না, বা সুন্দর চেহারাবিশিষ্ট হওয়ার জন্য কেউ উত্তম ব্যবহার লাভ করবে না। এখানে ছোটোর প্রতি বড়োর তাচ্ছিল্যভাব প্রদর্শনের সুযোগ নাই—ছোটোও নিজেকে বড়োর চেয়ে হেয় জ্ঞান করবে না। মোদ্দাকথা, এইস্থানে সকলেই এক সমান—সকলেই এক ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ। সৃষ্টির দিক থেকে এই ভ্রাতৃত্ব মানবতার ভ্রাতৃত্ব।
কর্তব্যনিষ্ঠা
আল্লাহর নবী (স) পরম কর্তব্যনিষ্ঠ, পরম সুশৃংখল, খুব স্থির এবং অত্যন্ত বাহুল্যবর্জিত ছিলেন। তিনি এমন কর্তব্যনিষ্ঠ ছিলেন যে, কঠিন থেকে কঠিনতর বিপদ এবং খুব আনন্দের সময়েও স্বজ্ঞানে ‘অবশ্যকর্তব্য’ থেকে দূরের কথা ‘সাধারণ কর্তব্য’ থেকেও বিচ্যুত হন নাই। তিনি এমন সুশৃঙ্খল ছিলেন যে ছোটো-বড়ো, পার্থিব-অপার্থিব, স্থায়ী-অস্থায়ী, ব্যক্তিগত বা সামাজিক এবং অবশ্যকরণীয় বা ইচ্ছাসাপেক্ষ—যেকোনো কাজেই হাত দিয়েছেন, তা সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করেছেন এবং এমন সুশৃঙ্খলভাবে কাজে হাত দিয়েছেন যে ব্যর্থতার সম্ভাবনাও তার সীমারেখায় পৌঁছতে পারে নাই। তাই দেখা যায় তিনি যে-কাজেই হাত দিয়েছেন তা-ই সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে—মৃত্তিকায় স্পর্শ করলে তা স্বর্ণে পরিণত হয়েছে! এই প্রসঙ্গে তার জীবনের প্রথম যুদ্ধ, যা বদরের যুদ্ধ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, তার কথাই উল্লেখ করা যায়। তিনি প্রথম যুদ্ধটিই এমন সুশৃঙ্খলভাবে শুরু করলেন যে, শত্রুপক্ষের সংখ্যাধিক্য সংখ্যালঘুত্বে রূপান্তরিত হলো এবং অধিকতর শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও শত্রুপক্ষকে পরাজয় বরণ করতে হলো।
তিনি স্বয়ং যোদ্ধাদের এমনভাবে সারিবদ্ধ করান যেন ‘সীসা ঢালা প্রাচীর’ দাঁড় করানো হয়েছে। তিনি নিজেও অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত, এমনকি, তিনি সৈনিকবেশও পরিধান করেছেন। একজন নবীর জন্যে এটা সুশোভন হোক বা না হোক—একজন সেনাপতি এবং ফিল্ড মার্শালের জন্য সুশোভন তো বটেই, অপরিহার্যও।
এই যুদ্ধে তার নিখুঁত, নিপুণ ব্যবস্থাপনার প্রতি আরও দৃষ্টিনিবদ্ধ করলে দেখতে পাবেন যে, জাগতিক ও বাহ্যিক ব্যবস্থা অবলম্বন করার পরও তিনি মুনাজাতের সুযোগটি বৃথা যেতে দেন নাই। কিন্তু তার ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে জড়জগৎ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জাগতিক প্রচেষ্টার তুলনায় মুনাজাতের ওজন ছিল এক আনা। মানে পনের আনাই জাগতিক প্রচেষ্টা, বাকি এক আনা মুনাজাত। অথচ এই ঘটনার দিবস থেকে আজ পর্যন্ত অপূর্ণবুদ্ধির ব্যক্তিরা একটি মস্ত বড় ধোঁকায় নিপতিত রয়েছেন যে, তারা মনে করেন তার ব্যবস্থাপনায় মুনাজাতই ছিল মূল—বাকি এক আনা ছিল জাগতিক প্রচেষ্টা। তাদের মতে, জাগতিক প্রচেষ্টা সংশ্লিষ্ট বিষয় মাত্র, অথচ ব্যাপারটি ছিল সম্পূর্ণ তার বিপরীত। পূর্ণবুদ্ধি ব্যক্তির নিকট ব্যাপারটি দিবালোকের মতোই স্পষ্ট; কারণ, ঘটনাটি এই ছিল যে যুদ্ধের যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জামই জোগাড় করা হয়েছিল এবং তা সুবিন্যস্তভাবে সম্মুখে রাখা হয়েছিল। তারপর মুনাজাতের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সুতরাং, মুনাজাত মূল ছিল না—তার মর্যাদা ছিল পরিশিষ্টের। বড়জোর আমরা এইটুকু বলতে পারি যে মুনাজাতের মাধ্যমে উক্ত ব্যবস্থাপনার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছিল।
স্থৈর্য
লক্ষ্যের দিকে তিনি এত স্থির ছিলেন যে যতরকম হট্টগোল, গণ্ডগোল ও প্রতিকূল অবস্থায়ই নিপতিত হোন না কেন, যত আনন্দপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক পরিবেশেই তিনি থাকুন না কেন, তিনি তার লক্ষ্য থেকে সরে যাননি। বিবাহানুষ্ঠান, ভোজসভা, অভ্যর্থনানুষ্ঠান, গান-বাজনা কিংবা অন্য প্রকারের ধূমধামের মধ্যেও তার উদ্দেশ্য ঠিক রয়েছে এবং তিনি তার শিক্ষাদান কার্য অব্যাহত রেখেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে মারামারি কাটাকাটি চলছে, তিনি আহত হয়ে পড়েছেন, হয়তো-বা ক্ষুধায় কাতর বা নিঃসম্বল অবস্থায় পতিত হয়েছেন—কিন্তু লক্ষ্য তার স্থির আছে এবং শিক্ষাদান ও প্রচারকার্য সমান গতিতেই এগিয়ে চলছে। ওহুদের যুদ্ধে যখন পরাজয় স্পষ্ট, তিনি গর্তে আহত অবস্থায় পড়ে আছেন। কিন্তু যেইমাত্র শত্রুপক্ষের সৈন্যগণ লাত-হুবল মূর্তির নামে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠেছে, ঠিক তখনই তার পরম লক্ষ্যের কথা মনে পড়ে গেছে। তিনি ঝড়োগতিতে অস্ত্রসজ্জিত সকল সাহাবিকে একত্র করে আল্লাহর নামে তাকবির (জয়ধ্বনি) দিতে শুরু করেন। তায়েফে ধর্মপ্রচার-অভিযানে বের হয়ে ব্যর্থতার বোঝা নিয়ে আহত অবস্থায় ফেরার সময় ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত দেহ নিয়ে তিনি একটি বাগানে এসে উপস্থিত হন। এমন সময় বাগানরক্ষক এসে তার এই অবস্থা দেখে অনুগ্রহপূর্বক ফল খেতে বলেন। কিন্তু এমন অবস্থাতেও তিনি লক্ষ্য ভুললেন না। ফলের জন্য হাত বাড়াবার আগে তিনি বাগানরক্ষককে ধর্মের দাওয়াত দিলেন। অবশেষে তাকে জয় করে, অর্থাৎ ইসলাম কবুল করিয়ে ফল ভক্ষণ করেছেন।
বিজয়ীর বেশে তিনি মক্কা প্রবেশ করছেন। আনন্দ ও খুশির মৌজ উঠেছে। কিন্তু তিনি তার লক্ষ্যে স্থির ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন রয়েছেন। তাই আমরা দেখতে পাই তিনি উটের পিঠে অবনত মস্তকেই তসবিহ-তাহলিল পাঠ করতে করতে মক্কা প্রবেশ করছেন। এটা এইজন্য—উম্মতগণ ও জগৎবাসী প্রত্যক্ষ করুক এবং এই শিক্ষাই লাভ করুক যে বান্দা যত আনন্দেই থাকুক না কেন, তাকে কখনও তার স্রষ্টার কথা ভুললে চলবে না, এবং তার এবাদত-বন্দেগি থেকে বিরত থাকা চলবে না।
তিনি অনর্থক বাহুল্য কথা বলতেন না; ফলে জীবনভর যা কিছু তিনি বলেছেন তার প্রতিটি কথাই মূল্যবান, প্রতিটি বাক্যই সারসংক্ষেপ। রীতি, নীতি, বিধান ও জীবনপদ্ধতি ব্যাখ্যার মধ্যেই তার কথা সীমাবদ্ধ। সেই জন্যই তার প্রতিটি কথা, ‘প্রতিটি বাক্যকে এমন অমূল্য ধন হিশাবে হেফাজত করা হয়েছে। তার কোনো একটি বাক্যকেও অনাবশ্যক বলে গণ্য করার অবকাশ পর্যন্ত ছিল না। এ কারণে তার কোনো একটি কথা ও বাক্যকেও বিস্মৃতির অতলে ডুবিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি।
হজরত খুবই লজ্জাশীল, অতিশয় ধর্মনিষ্ঠ এবং পরম পূণ্যবান ছিলেন। একমাত্র সম্ভ্রান্ত বংশীয় যৌবনবতী কুমারীর লজ্জার সাথেই তার লজ্জার তুলনা করা যেতে পারে।
ধর্মনিষ্ঠা
তার ধর্মনিষ্ঠতার কয়েকটি উদাহরণ দিই। একদিন তিনি বায়তুল মালের (রাষ্ট্রীয় অর্থভান্ডার) কিছু স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা বণ্টন করছিলেন। সব বণ্টনের পর তার কাছে কোনো ক্রমে কয়েকটি মুদ্রা রয়ে গেছি, কিন্তু ভুলবশত তা বায়তুল মালে রাখার আগেই তিনি গৃহে প্রবেশ করেন। কিন্তু যেইমাত্র তা মনে পড়েছে, অমনি বিদ্যুৎ বেগে বের হয়ে সেই মুদ্রাগুলি বায়তুল মালে গচ্ছিত রেখে তারপর গৃহে প্রবেশ করেন। এর অর্থ এই ছিল যে অপরের হক এক ঘণ্টা বা দুই ঘণ্টার জন্যও নিজের কাছে রাখা তিনি সমীচীন মনে করেন নাই।
একবার তিনি সফর থেকে ফিরে ছোটো মেয়ে হজরত ফাতেমার (রা) ঘরে সর্বপ্রথম উপস্থিত হন। কিন্তু যখন তিনি দেখতে পেলেন তাদের ঘরের দরজায় নকশা-আঁকা পর্দা ঝুলছে এবং নাতিদের একজনের বাহুতে সোনার বাজুবন্দ শোভা পাচ্ছে, তখনই তিনি ফিরে গেলেন, যেন এই অবস্থায় কন্যার ঘর আর দর্শনের যোগ্যও নাই! অবশ্য, পরে যখন তিনি শুনতে পেলেন যে সেই নকশা-আঁকা পর্দাটি ছিঁড়ে খণ্ড খণ্ড করে ফেলা হয়েছে এবং নাতির বাহু থেকে সেই সোনার বাজুবন্দ খুলে ফেলা হয়েছে, তখন তিনি ঠিক আগের মতোই উদ্বেলিত চিত্তে ও স্নেহার্দ্র হৃদয়ে কন্যার ঘরে প্রবেশ করেন।
মহিলাদের নিকট হতে ‘বায়আত’ গ্রহণকালে তিনি কখনও তাদের হাত স্পর্শ করতেন না; বরং কাপড়ের সাহায্যে বায়আত গ্রহণ করতেন। অথচ এ জগতে তার মনের চেয়ে আর কার মনেরই-বা বেশি তুষ্ট, তৃপ্ত ও সংযত হওয়া সম্ভব?
তিনি এত পূণ্যবান ছিলেন যে, তার নিকৃষ্টতম শত্রুকে সাহায্য করে সওয়াব হাসিল করতে হলেও তিনি আগ্রহ ও উৎসাহের সাথেই তা করেছেন। মুনাফেকপ্রধান আবদুল্লাহ বিন উবাই ছিল তার নিকৃষ্টতম শত্রু। সে মারা গেলে তিনি নিজের পোশাক পাঠিয়ে দিলেন, সাথে বলে দিলেন এই পোশাকটিকে যেন তার কাফনের অংশ বানানো হয়, যাতে তার কবরের শাস্তি লঘু হয়।
একবার কোনো যুদ্ধে মুসলিম সৈন্যগণ শত্রুদের খাদ্যদ্রব্য অবরোধ করে ফেলেছিল। কাফেররা নিরুপায় হয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল : ‘আমাদেরকে কি না খেতে দিয়ে মেরে ফেলতে চাও?’ এই কথা শোনার সাথেসাথে তিনি অবরোধ তুলে নেন। এর তাৎপর্য তো এই যে, ‘ভাইসব, তোমাদেরকে অনাহারে মরতে দিতে পারব না। যদিও তোমরা আমাদের মারার ফিকিরে রয়েছো।’
ক্রোধ
ক্রোধ তার মধ্যেও ছিল, কিন্তু কখনও তার অহেতুক ক্রোধের উদ্রেক হয় নাই। কখনও ক্রোধের উদ্রেক হলে তা সঙ্গত কারণেই হয়েছে। ঘটনাক্রমে কখনও তার ক্রোধের উদ্রেক হলেও তা মানসিক ভারসাম্যের বিপর্যয় ঘটিয়ে তাকে অপ্রকৃতিস্থ করে তুলতে সক্ষম হয় নাই। রাগের বশীভূত হয়ে তিনি কখনও উত্তেজিত হয়ে উঠেন নাই বা কখনও মাথা ঝাঁকিয়ে কথা বলেন নাই; কিংবা রাগের কারণে শরীরের রগ ফুলে ওঠা বা হাত-পা কাঁপা—এই ধরনের কিছুই তার হয়নি। যত ক্রোধই তার মনে জমা থাকুক না কেন, মুখে কখনও তা অসংযতভাবে প্রকাশ পায়নি। রাগের সময় কেবল তার চেহারা রক্তিম হয়ে উঠত এবং গলার স্বরটি একটু ভারী বোধ হতো। যদি কখনও-বা তার মুখ থেকে কঠিন-কর্কশ বাক্য উচ্চারিত হয়েছে তা কেবল ধর্মের বিরোধিতায় যারা সীমাতিক্রমী ছিল তাদের উদ্দেশ্যে হয়েছে।
আত্মমর্যাদা
তার আত্মমর্যাদাবোধ ছিল অতিশয় তীক্ষ্ণ; কিন্তু উপযুক্ত ক্ষেত্রেই তা প্রকাশ পেত, অনুপযুক্ত ক্ষেত্রে নয়। আনন্দ অনুভবের ক্ষমতাও তার যথোপযুক্ত পরিমাপেই ছিল। মধুর আওয়াজ ও আনন্দদায়ক কাজের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হতেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু তার এই আকর্ষণ এমন কোনো স্থানে কেন্দ্রীভূত হতো না যা অশোভনীয়। তা ছাড়া, এই আনন্দ অনুভূতি তার গাম্ভীর্যকে কখনও সামান্যতমও হালকা করে দিতে পারত না। অনিচ্ছাক্রমে অপর কোনো রমণীর ওপর দৃষ্টি পড়ে গেলে তাতে তার নফস যে প্রভাবিত হতো না তা নয়; কিন্তু কখনও দ্বিতীয়বার তিনি সেই দিকে চোখ তুলে তাকাতেন না। এটা তো ছিল তার পবিত্রতা রক্ষার বাহ্যিক বিধি; কিন্তু অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা রক্ষাবিধি অনুযায়ী কখনও কখনও তৎক্ষণাৎ তিনি স্ত্রীদের নিকট চলে যেতেন এবং তাদের মধ্যে কোনো একজনের সাথে অন্তঃপুরে সময় কাটিয়ে মনকে পবিত্র করে নিতেন। সুমধুর কোনো ধ্বনি কানে আসলে তাতে তিনি বাধা দিতেন না, কিন্তু সেই ধ্বনি দ্বিতীয়বার শুনতে চাইতেন না। এই জন্য দেখা যায়, সারা জীবনে কেবলমাত্র তিনি একবার সংগীত শ্রবণ করেছেন: তাও তারই সংবর্ধনা উপলক্ষে। তবে হ্যাঁ, একটি সংগীত ছিল যা তিনি রোজানা পাঁচবার শুনতেন, উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে মুগ্ধ হয়েই তা শুনতেন। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কে আছে যে এই সংগীত শোনার জন্য তার চারিত্রিক দুর্বলতা আবিষ্কার করতে সক্ষম হবে? এই সংগীত ছিল মুয়াজ্জিন হজরত বেলালের (রা), যা আজানের মধ্য দিয়ে কানে মধু ঢালত। এই ধ্বনি এমনই ছিল যে তা বড় বড় সুর-সম্রাট ও স্বরধ্বনির সমঝদারকেও অন্য সংগীত হতে উদাসীন করে তার প্রতি আকৃষ্ট করে তুলত। এরপর এই ধ্বনির আমেজ বহন করেই তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন, সেখানে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে লাভ করতেন চিত্তের পরিপূর্ণ প্রসন্নতা।
নৃত্যও একদিন তিনি দেখেছিলেন, কিন্তু সে নৃত্য মেয়েদের নয়, পুরুষদের। যদিও তিনি তা আর দ্বিতীয়বার করতে দেন নাই। তা ছাড়া, এই সবের সময় কিংবা তার জীবনের লক্ষ্যের সাথে এইগুলোর সামঞ্জস্যই-বা ছিল কোথায়?
জীবনোপভোগ
আল্লাহর নবীর (স) মধ্যে উপভোগস্পৃহাও ছিল—যেমন উত্তম খাদ্য, উত্তম বস্ত্র, উত্তম সুগন্ধি ও উত্তম যানবাহন তার পছন্দনীয় ছিল। কিন্তু তাই বলে এইসব ‘উত্তম কিছুতে’ তার চিন্তা কেন্দ্রীভূত হতো না। কখনও কখনও তিনি বলে ফেলতেন : ‘মাংস খাবারের মধ্যে প্রধান খাবার’, ‘সিরকা খুব ভালো জিনিশ’, ‘খেজুর উৎকৃষ্ট’, ‘মধুও উত্তম’ এবং ‘দুধের মধ্যে আরোগ্যের উপাদান বিদ্যমান’। ইয়েমানি চাদর তিনি পছন্দ করতেন। খোশবুও খুব ভালবাসতেন। এসব জিনিশ কখনও পেলে তা তিনি আনন্দের সাথেই গ্রহণ করতেন এবং স্বচ্ছন্দেই উপভোগ করতেন। কিন্তু এসব জিনিশ পাওয়ার অন্বেষণে তিনি কখনও মন-মগজ নিয়োজিত করতেন না। কিংবা এসব পাওয়ার জন্য এরূপ লালায়িতও থাকতেন না যে তা অপরের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, সময়ের অপচয় হবে, সামান্যতমও লক্ষ্যচ্যুতি ঘটবে কিংবা প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধনের পথে তা এতটুকুও বাধা সৃষ্টি করবে। অথবা এসব জিনিশের প্রতি এমন আকর্ষণও তার ছিল না—না-পাওয়ার বেদনায় তা তার মানসিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে ফেলতে পারে, গাম্ভীর্যে সামান্যতমও চাঞ্চল্য আনয়ন করতে পারে কিংবা এসব পাওয়ার চেষ্টা তার ব্যক্তিত্বকে কিঞ্চিৎ খাটো করে ফেলতে পারে।
বহুবিবাহ
এ কথা অবশ্যই সত্য যে বহুবিবাহের আকাঙ্ক্ষাও তার মধ্যে ছিল। কিন্তু এও তো ঠিক যে, এই আকাঙ্ক্ষাকে তিনি পঁয়তাল্লিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত দাবিয়ে রেখেছিলেন। অথচ, এটাই ছিল এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রকৃষ্ট সময়। এসময়ে তার আকাঙ্ক্ষা কমজোর ছিল এবং সেইজন্য তিনি তা দাবিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন—তাও ঠিক নয়; বরং, প্রকৃত উদ্দেশ্যের ধ্যান তথা সত্যের চরম মার্গে উপনীত হওয়ার কামনাই এই সময় অপেক্ষাকৃত প্রবল ছিল। এই জন্যই তার প্রথম বিবাহটি সম্পন্ন হয়েছিল অনাসক্তির মধ্য দিয়ে। না ছিল কোনো চাহিদা, না ছিল কোনো আকাঙ্ক্ষা। এটি ছিল কেবলমাত্র ‘প্রস্তাব’ ও ‘গ্রহণের’ একটি আনুষ্ঠানিক কার্য। অবশ্য এও সত্য যে প্রথম স্ত্রী জীবিত থাকাকালীন তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন নাই। এর কারণ এই নয় যে, আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা আপনাআপনিই স্তিমিত হয়ে পড়েছিল, প্রকৃত ব্যাপার হলো প্রথম স্ত্রী তার মনে উচ্চস্থান লাভ করেছিল। তার ওপরে ছিল চিরসত্য ও সুন্দরের জন্য তার প্রবল প্রেমাসক্তি। এও সত্য যে প্রথম স্ত্রীর ইন্তেকালের পরেও কিছুদিন সেই আকাঙ্ক্ষাকে তিনি দমন করে রেখেছিলেন; কিন্তু তার কারণও এ নয় যে এ সময় তার আকাঙ্ক্ষা নির্জীব হয়ে পড়েছিল। বরং এটি ছিল তিনি যে ইনকিলাব ঘোষণা করেছিলেন তার প্রথম পর্যায়ের এমন একটি চূড়ান্ত স্তর অতিক্রমণের সময়—যখন যেকোনো মুহূর্তে সমগ্র ব্যাপারটিই যেকোনো দিকে গতি পরিবর্তন করতে পারত। সুতরাং, এমনই সংকট-সন্ধিক্ষণে কোনো কামেল মানুষের পক্ষে কী করে এ সম্ভব যে তিনি কোনো ক্ষণভঙ্গুর আকাঙ্ক্ষাকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে দিবেন, সেই আকাঙ্ক্ষাটি যত বৈধ এবং যত প্রয়োজনেরই হোক না কেন! এমন কাজ অপরিপূর্ণ বা ‘নাকেস’ মানুষের পক্ষে সম্ভব হতে পারে; কিন্তু হজরত তো কেবল কামেলই ছিলেন না, তিনি ছিলেন কামেলের ওপরেও কামেল—সর্বাপেক্ষা পূর্ণ মানব।
অতঃপর এই সকল বাধাবিঘ্ন অপসারিত হলো এবং পদার্পণ করল এক নতুন যুগ। এটি প্রথম যুগের তুলনায় যুদ্ধ-বিগ্রহ-ক্লিষ্ট ও সংশয়-সংকটপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এর ভিত্তি ছিল স্বস্তি ও শান্তির প্রলেপে আচ্ছাদিত; কারণ, ইতোমধ্যেই হুকুমতের বাহ্য ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। এখন বাকি ছিল কেবলমাত্র তাকে দৃঢ়-ভিত্তির ওপর শক্তিশালী করে তোলা ও তাতে স্থিতিশীলতা আনা। অপরদিকে, সাহায্য ও বিজয়ের সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতিসহ আল্লাহর নির্দেশও ইতিমধ্যেই অবতীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এই প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাসবাণীর চেয়ে তার কাছে অধিকতর স্বস্তি ও শান্তিপ্রদ আর কিছুই হতে পারত না। এই সময়েই তার পূর্বোক্ত আকাঙ্ক্ষা প্রবলভাবে আত্মপ্রকাশ করে। এ ব্যাপারে তাকে পূর্ণস্বাধীনতাও প্রদান করা হয়েছিল এবং এতে বাধা-নিষেধ আরোপেরও কোনো কারণ বিদ্যমান ছিল না। কেননা এই আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ সত্ত্বেও এর সাধ্য ছিল না আল্লাহর নবীকে (স) তার বিপুল কর্তব্য এবং মহান ও কঠোর জীবনের অজস্র কর্মসম্পাদনে মুহূর্তকালের জন্য বিরত রাখা। এই আকাঙ্ক্ষা যে সামান্যতম সময়ের জন্যও তাকে কর্তব্যচ্যুত করতে সমর্থ হয় নাই ইতিহাসই তার জ্বলন্ত সাক্ষ্য। বরং কখনও যদি তা স্বীয় গণ্ডি অতিক্রম করে তার উচ্চতম আদর্শপূর্ণ মহান জীবনযাত্রার সাথে সংঘাত বাঁধাত তবু তা তার জীবনযাত্রায় কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারত না; এছাড়াও আকাঙ্ক্ষাই পরাজয় স্বীকার করে নতজানু হয়ে পড়ত আর পরাজিত হয়ে নতজানু হলে পর তিনি তাকে তুলে নিয়ে গলায় জড়িয়ে ধরতেন! কারণ, তা যে প্রিয় ছিল না এমন তো নয়। তবে তা অপেক্ষাও অপর একটি জিনিশ তার অধিক প্রিয় ছিল; সেটি তার জীবনের লক্ষ্য—অর্থাৎ পূর্ণমর্যাদার সাথে সত্যের প্রতিষ্ঠা ও সৃষ্টির লালন। তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায়—বহুবিবাহের আকাঙ্ক্ষা শেষ পর্যন্ত তার মধ্যে বিদ্যমানই-বা ছিল কেন? কেন তা হতে তিনি নিজেকে মুক্ত করতে পারলেন না? অথবা, সংযম-সাধনার মাধ্যমে তা চিরকাল দাবিয়ে রাখলেন না কেন, যেমন অনেকেই করেছেন? এও তো সম্ভব ছিল যে, তিনি সংযম-সাধনা বা বিবাহ-পরিত্যাগের পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে তাকে উপেক্ষাও করতে পারতেন, যেমন হজরত ঈসা-মসিহ (আ) করেছিলেন। কিংবা এক স্ত্রী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাও তো তার পক্ষে সম্ভব ছিল, যেমন করেছিলেন হজরত মুসা (আ)!
বিষয়টি বিবেচনাসাপেক্ষ, সন্দেহ নাই। কিন্তু এখানে এর দীর্ঘ আলোচনা সম্ভব নয়। তবে কয়েকটি অবশ্যক বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে :
প্রকৃতি-প্রদত্ত ক্ষমতা কখনও মানবিক বিধানের আওতাধীন নয়। তবে হ্যাঁ, ইচ্ছাশক্তি তার আওতাধীন বটে। সুতরাং, অমুক পবিত্র ব্যক্তি দুর্বল রতিশক্তিসম্পন্ন কেন এ বিতর্ক যেমন নিষ্প্রয়োজন; তেমনই অমুক পবিত্র ব্যক্তি প্রবল রতিশক্তিসম্পন্ন এবং সুন্দরও বটে, আবার অমুক পবিত্র ব্যক্তি রতিশক্তিহীন এবং অসুন্দরও বটে—এ ধরনের বিতর্কও ভ্রান্তিপূর্ণ। সুতরাং রসুলুল্লাহ (স) কেন অসাধারণ রতিশক্তিসম্পন্ন ছিলেন, এটাও অবান্তর প্রশ্ন। মানবিক আইন কি কখনও প্রকৃতির ওপর স্বীয় প্রভাবের বেড়াজাল বিস্তার করতে সক্ষম? কখনও কি তা এমন বিধি প্রস্তুত করতে পারে যে কোনো পবিত্র ব্যক্তিরই অধিক রতিশক্তিসম্পন্ন হওয়া চলবে? এটা কখনোই সম্ভব নয়। কারণ, প্রকৃতি মানবিক বিধানের অধীন তো নয়ই, বরং এর অনেক উর্ধ্বে।
শুধু তা-ই নয়, প্রকৃতিগত বিষয়ের প্রভাবও আইনের মধ্যে সীমিত নয়, যদি তা সত্যিই প্রকৃতিগত হয়। এ কি সম্ভব যে, ফুলের সুন্দর রঙ এবং মধুর ঘ্রাণ আপত্তিকর হবে না, অথচ তার চিত্তাকর্ষক ও মনোহারী আপত্তির বিষয় হবে? তেমনই কোনো পবিত্র ব্যক্তির অস্বাভাবিক রতিশক্তিসম্পন্ন হওয়া অথচ তার বহুবিবাহ-আসক্তি না থাকা কি করে সম্ভবপর? সুতরাং, আল্লাহর রসুলের (স) বেলায়, তিনি এই আসক্তি হতে মুক্ত হবেন, এ কামনা আমরা কেমন করে করতে পারি? আর যদি তা সম্ভবই না হয় তবে এ নিয়ে বিতর্কই-বা কিসের?
তা ছাড়া, প্রকৃতিগত ক্ষমতা ও তার চাহিদাসমূহকে যেকোনো প্রকারে বা যেকোনো পরিমাণেই হোক, চিরতরে দাবিয়ে দেওয়ার নামই তো বৈরাগ্য বা সন্ন্যাসপন্থা অবলম্বন! এ কথা সত্য হলে, বৈরাগ্য বা সন্ন্যাসবাদের সমাধি রচনার জন্য যার আগমন, প্রকৃতিগত ক্ষমতার চাহিদাকে চিরতরে প্রদমিত করে নিজ হাতে সেই সন্ন্যাসবাদেরই নয়া ভিত্তি স্থাপন কি তার উচিত হতো? কখনও না। তিনি হজরত ঈসার (আ) মতো ‘রহবানিয়াত’ বা সন্ন্যাসবাদ প্রসারিত করতে, কিংবা হজরত মুসার (আ) মতো কট্টর বিধিবিধান প্রবর্তন করতে আসেন নাই; কেননা, এসবের ভিত্তি স্থাপিত সাধারণের ভাবাবেগের ওপর, দর্শনের ওপর নয়। দার্শনিকতাধর্মী চরিত্রের সাথে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। আল্লাহর নবী (স) এসেছিলেন ‘রহবানিয়াত’ বা বৈরাগ্যের স্থলে ‘রব্বানিয়াত’-এর সৌধ নির্মাণের জন্য এবং কট্টর বিধিবিধান, যা সাধারণের ভাবাবেগ-সংশ্লিষ্ট, তার পরিবর্তে মধ্যমপন্থী দার্শনিকতামূলক চরিত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। সুতরাং, বহুবিবাহের আসক্তিকে তিনি কেন চিরতরে বিলুপ্ত করে দিবেন আর কেনই-বা তা কঠোর হস্তে দমন করবেন? এ কথা সত্য যে দমন করবার ক্ষমতাও তার মধ্যে যথেষ্টই ছিল এবং সে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশও তিনি ঘটিয়েছেন বারবার। তার এই ক্ষমতার প্রমাণ তিনি শুধু এই জন্যই দিয়েছিলেন যে কম বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যেন প্রত্যক্ষ করতে পারে : রতিশক্তির উত্তাল তরঙ্গকে সংযম-সাধনার শিকলে বেঁধে রাখার যে অদ্ভুত ক্ষমতা তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল তার তুলনা এই ধরাধামে নাই। প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অবদমন ছিল তার কাছে অপছন্দনীয়। কেননা তা প্রকৃতিগত স্বভাব হত্যারই নামান্তর এবং সন্ন্যাসবাদের পোষণমাত্র। অথচ আল্লাহর নবী (স) ছিলেন প্রকৃতির অনুসারী এবং সন্ন্যাসবাদের প্রকৃত হন্তা।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, প্রখর স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন, গভীর চিন্তাশীল এবং অতিশয় পরিণামদর্শী। অপর কথায়, তিনি ছিলেন মহাদার্শনিক। তিনি এত বড় দার্শনিক ছিলেন—আল্লাহ না করুন—সারা বিশ্ব কোনো সময় তার নবুওয়তকে অথবা সাধারণভাবে নবুওয়তকে অবিশ্বাস করতে চাইলেও তার নবুওয়তকে অস্বীকার করা কখনও সম্ভব হবে না, কিংবা তাতে তার পয়গম্বরির কোনো ক্ষতি সাধিত হবে না। কেননা নবী ছাড়া আর কেই-বা অতি মহান দার্শনিক হতে পারেন?
নির্জন সাধনা
নির্জনতাপ্রিয়তা তার স্বভাব ছিল না; বরং স্বভাবগত দিক থেকে তিনি ছিলেন সংসর্গপ্রিয়। তার জীবনের মোট সময় থেকে তিনটি বছর বাদ দিলে দেখা যাবে বাকি সমগ্র জীবনটাই তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন মজলিশ ও মহফিলের মধ্যে। দিবসের মধ্য ভাগের দুই ঘণ্টা ছাড়া অর্ধ-রাত্রির সামান্য পূর্ব পর্যন্ত তিনি তো বাইরেই থাকতেন। তারপর গৃহাভ্যন্তরে গমন করতেন বটে, কিন্তু ফজরের আগেই আবার বের হয়ে পড়তেন। বড়জোর তিনি ছয় ঘন্টা ঘরে অবস্থান করতেন। বাকি আঠারো ঘন্টা তিনি বাহিরেই কাটিয়ে দিতেন—তবে এমন নয় যে পুরুষদের বৈঠক আখেরে মহিলা-বৈঠকে পরিণত হতো; কারণ বৈঠকের স্থান ছিল মসজিদ। যার ইচ্ছা সেখানে আসতেন এবং সোজাসুজি তার কাছে গিয়ে নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে নিতেন।
তবে, প্রয়োজনবশত তিন বৎসরের জন্য তিনি নির্জনতাকে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু তার এই নির্জনবাসও একটানা ছিল না, বিরতি সহকারেই ছিল। তার নির্জনবাসের স্থানটি ছিল একটি গুহা মাত্র। হেরা নামক পাহাড়ে যার অবস্থিতি। আজও মানুষ সেই গুহা পরিদর্শনে গিয়ে থাকে।
এই ভয়াবহ ও বিপদসংকুল নির্জন স্থানে দিনের পর দিন ও রাতের পর রাত অবস্থান করে তিনি কী কী করতেন এবং তার ফলে কোন দুষ্প্রাপ্য ফলই-বা তিনি সেখানে লাভ করেছিলেন—তা সত্যিই ভাববার বিষয়। তা ছাড়া, হিংস্র শ্বাপদ ও বন্য জন্তুর কবল থেকেই-বা তিনি সেখানে কী করে রক্ষা পেতেন, আর কী করেই-বা তিনি এমন নির্ভয়ে সেখানে অবস্থান করতেন—এ সকল প্রশ্ন স্বভাবতই সকলের মনে উদিত হয়। কিন্তু সেখানে তিনি কী করতেন তা তিনি নিজে কোনোদিন বলেননি, অপর কেউ তা বলতে পারেনি। সত্যি বলতে কী, এই রহস্যটির ওপর আজ পর্যন্ত লৌহজাল বিস্তার করেই রয়েছে—এমন কেউই নাই যে তা উন্মোচন করতে পেরেছে! ব্যাপারটি হজরতের জীবনচরিতের সামগ্রিক চিত্র লেখকের পক্ষেও একটি মস্ত বড় রহস্য হয়ে রয়েছে। পরিতাপের বিষয়, চৌদ্দশ বছর পার হতে চলল, অথচ কোনো জীবনী-রচয়িতাই তার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন নাই। আমি নিজেও এই রহস্য-পর্দা উন্মোচনের জন্য নিজেকে সর্বাংশে উপযুক্ত বলে দাবি করতে পারি না। তবে আমার পক্ষে এই-ই সৌভাগ্য যে আমি নিজের এই অযোগ্যতা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন। মুসলিম জাহান তথা সারা বিশ্বের তথ্য অনুসন্ধানকারীদের প্রতি আমি আহ্বান জানাচ্ছি যে হজরত মুহাম্মদের (স) জীবনের এই রহস্যপূর্ণ দিকটির প্রতি সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিত।
হেরা গুহার তিনি কী কী ফল লাভ করেছিলেন তার জীবনীকারগণ এর সঠিক বিবরণ দিতে অপারগ। প্রত্যেক জীবনীকারই এতটুক উল্লেখ করেই এগিয়ে যান যে হেরা গুহায় ফেরেশতার আগমন ঘটেছিল এবং ‘ইকরা বি-ইসমি’ পড়ে পবিত্র কোরআন অবতরণের উদ্বোধন করা হয়েছিল। হেরা গুহায় তিনি যে এই ফল লাভ করেছিলেন তা তো সর্বস্বীকৃত কথা। কিন্তু এটা ছাড়া অন্য ফলও যে সম্ভব, ঘটনাটিকে যুগপৎ ঐশী দৃষ্টিকোণ ও পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে তা উপলব্ধি করা যেতে পারে।
আমার দৃষ্টিতে, তার এই নির্জনবাসের পার্থিব একটি ফল হচ্ছে ভীতি-শূন্যতা ও প্রকৃতির নিবিড় পরিচয় লাভ—যে-কারণে তিনি নিসর্গপ্রেমিক হয়ে পড়েছিলেন। এছাড়া, তিনি নিসর্গের অব্যক্ত বাণী শ্রবণ করবার এবং নিজের বক্তব্য নিসর্গের গোচরীভূত করার ক্ষমতাও লাভ করেছিলেন। তার এই ক্ষমতা দুইটি ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। দুঃখের বিষয়, এখানে তার বিস্তারিত আলোচনা করার অবকাশ নাই। তবে মোটামুটি একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা অবশ্যই করা হবে।
নিসর্গের সাথে নিগূঢ় সম্পর্কের ফলে তার প্রথম লাভ এই হয়েছিল—দুই, চার কিংবা দশ-বিশটি ব্যক্তিকে বাদ দিলে সমগ্র মানবজাতির অসহযোগিতা ও অবন্ধুত্ব যখন তাকে বেষ্টন করেছিল, তখনো তিনি ভীতির শিকারে পরিণত হন নাই। এই সময় বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো তিনি নিসর্গের নিত্য সাহায্য লাভ করেছিলেন এবং নিসর্গ তার নীরব বন্ধুত্ব ও অব্যক্ত সমবেদনার দ্বারা তাকে পূর্ণ স্বস্তি ও পূর্ণ শান্তি দান করেছে; শুধু সেই কয়টি দিন তিনি এই প্রশান্তি থেকে বঞ্চিত ছিলেন যখন ওহি প্রাপ্তি বন্ধ থাকার ফলে তিনি বিষাদ-সমুদ্রে নিপতিত হয়েছিলেন। এ কথা নিশ্চিত যে তার ওপর রব্বানি প্রশান্তি অবশ্যই বর্ষিত হতো। কিন্তু নিশ্চিত করে এ কথা কে বলতে পারবে যে রব্বানি শান্তিধারা কেবল ‘ওহি’ এবং ফেরেশতার মাধ্যমেই অবতীর্ণ হতো? সম্ভবত, আর সম্ভবতই-বা বলি কেন, খুব সম্ভব বাহ্য-প্রকৃতিও শান্তিধারা অবতরণের উৎসভূমি হিশাবেই ব্যবহৃত হতো। বাহ্য-প্রকৃতির কথা বলার ক্ষমতা নাই ঠিক, কিন্তু কথার পটভূমি সৃষ্টির ক্ষমতা তার নিশ্চয় রয়েছে।
বাহ্য-প্রকৃতির সাথে সম্পর্কের ফলে দ্বিতীয় যে লাভটি হয়েছিল তা এই যে, তিনি মানুষের অভ্যন্তরীণ প্রকৃতির সুদক্ষ চিকিৎসক হয়ে গিয়েছিলেন। মুখে কিছু না বলেও তিনি মানুষের অভ্যন্তরীণ প্রকৃতির গভীরে প্রবেশ করতে পারতেন এবং তা পাঠ করে সেই মানুষের সম্পূর্ণ স্বরূপ জেনে নিতে সক্ষম হতেন।
মোদ্দাকথা, হেরা গুহার কঠোর নির্জনবাসে তিনি কেবল শ্রেষ্ঠতম ফেরেশতারই সাক্ষাৎ লাভ করেন নাই, বরং সেখানেই তিনি লাভ করেছিলেন মহান প্রকৃতির সন্ধান যা সেই দিগন্তবিস্তারী সীমাহীন বিজন প্রান্তরের চতুর্দিকেই বিস্তৃত ছিল এবং একজন পর্বতে অবস্থানকারী প্রান্তরবাসীই কেবল যা লাভ করতে সক্ষম। অন্য কথায় বলা যায়, হজরত হেরা গুহায় সাধনার পুরস্কার হিশাবে শুধু নবুওয়তই পান নাই, সঙ্গে সঙ্গে দার্শনিকতাও অর্জন করেছিলেন, যা মর্যাদার দিক দিয়ে নবুওয়তেরই কাতারভুক্ত। পার্থক্য শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় আসনের। উপর্যুক্ত আলোচনার অর্থ তো এই দাঁড়ায় না যে, তার উম্মতদেরও তার মতোই প্রান্তরবাসী এবং পর্বতগুহায় অবস্থানের সুন্নত পালন করতে হবে? তা হয়ে থাকলে অতিশয়োক্তি হয় নাই। কারণ, সমাজের মধ্যে কিছু বাঁধাধরা নিয়ম পালন, খাদ্যের মধ্যে লাউ ও সিরকা-প্রীতি, দিবসে খাওয়ার পর খানিকক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণ (কাইলুলা) এবং নিদ্রা গিয়ে জেগে থাকা অবস্থায় রাত্রিযাপন (নাউম বায়নাল ইয়াকজাতাইন) —এই সব সহজ পদ্ধতি প্রতিপালনের মধ্যেই তার সুন্নত (সংস্কৃতি) সীমিত নয়। এই সব সহজ তীর দিয়ে ফিনিক্স পাখি তুল্য মুহাম্মদিয়াতকে শিকার করা সম্ভব হলেও পরে দেখা যাবে সেই মুহাম্মদিয়াতরূপী ফিনিক্স পাখিটি ছিল চিল বা কাক! নামকাওয়াস্তে না করে যদি সত্যিকারঅর্থে তার সুন্নত অনুসরণের কারও ইচ্ছা থাকে, তা থেকে প্রকৃতই কোনো মূল্যবান ফল লাভের আকাঙ্ক্ষা কেউ যদি পোষণ করে, তাহলে সেই সুন্নতের শুরু হতে পারে প্রান্তরবাস ও পর্বতগুহায় সাধনার মাধ্যমে। এছাড়া শুরু করার অন্য কোনো কেন্দ্রবিন্দুই নাই।
কেউ হয়তো মনে করতে পারে, আর কেউ-বা বলি কেন, সারা বিশ্ববাসীরই একটি ধারণা রয়েছে যে উপর্যুক্ত অস্বাভাবিক, নিরলস ও ক্লেশপূর্ণ সাধনাটি কেবল তার জন্যই নির্দিষ্ট ছিল, তার উম্মতের জন্য এর প্রয়োজন নাই। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। প্রকৃতপক্ষে তার সকল ক্লেশপূর্ণ কার্যই তার উম্মতদের জন্যও অপরিহার্য। অবশ্য কেবলমাত্র ‘মাগফেরাত’ ও ‘নাজাত’ লাভের জন্য নয়; কেননা এর জন্য তো শরিয়তের সংক্ষিপ্ত বিধিবিধান, যা ‘রাহে নাজাত’ ও ‘মা লা বুদ্দা মিনহু’ পুস্তিকায় সন্নিবেশিত রয়েছে, তা পালন করাই যথেষ্ট! তরল খাদ্যের একটি লোকমা যেমন গালে পুরলেই পেটে গিয়ে পড়ে, এটি তেমনই সহজ কাজ! কিন্তু যদি জিজ্ঞাসা করি, তার আগমন কি শুধু ‘মাগফেরাত’ ও ‘নাজাত’-এর পদ্ধতি বাতলানোর জন্যই হয়েছিল? উত্তর হবে—‘অবশ্যই না’। তার আগমন, যে-আগমনের কোনো তুলনা বিশ্বে হতে পারে না, সেটা কেবল ‘মাগফেরাত’ ও ‘নাজাত’-এর জন্য হয়নি, বরং মানবতার পর্যায়ক্রমিক উন্নতি ও চরম পূর্ণতা বিধানের জন্যই তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন। আর এই পরম উন্নতি ও চরম পূর্ণতা বিধানের পদ্ধতিটি ‘রাহে নাজাত’ ও ‘মা লা বুদ্দা মিনহু’-তে সন্নিবেশিত মাসআলা-মাসায়েলের জালে আয়ত্ত করা যাবে, এটা কখনোই সম্ভব নয়।
আমি যে রহস্যটি এখানে উদ্ঘাটন করছি তা যে অস্পষ্টই রয়ে গেছে এমন ধারণা করারও কোনো কারণ নাই। মুহাম্মদিয়াতের এই উচ্চ পর্যায়ের বিধিবিধানের অনুশীলন বরং সর্বদাই সন্ন্যাসবাদে পর্যবসিত হয়ে রয়ে গেছে। মুসলমানদের প্রকৃত সুফিদল ও প্রথাগত সুফিদলের মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান। অপর পক্ষে, অমুসলমানদের মধ্যে ইউরোপের প্রকৃতিবাদীগণ মুহাম্মদিয়াতের এই উচ্চ পর্যায়ের বিধিবিধানকে নিশ্চিতই উপলব্ধি করেছেন। তারা এর যথাযথ মূল্য দিয়েছেন এবং এর ভিত্তিসূত্রের প্রথম পর্যায়ে সাহসের সাথে অবতরণ করে অপরের কাছে যা সম্পূর্ণ অস্পৃশ্য বলে প্রতীয়মান তারই মাণিক্য আহরণ করেছেন। তাই আমরা দেখতে পাই, এই দুই দল দুনিয়াকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেছেন। ইউরোপের প্রকৃতিপন্থীগণ পার্থিব জগৎকে চোখ ঝলসানো আলোকে উদ্ভাসিত করে দিয়েছেন, আর মুসলমানদের সুফিগণ আধ্যাত্মিক জগৎকে করে তুলেছেন এমনই ক্ষমতাবান যে, পার্থিব জগৎ একে উপেক্ষা করতে সাহসী হয় নাই।
এক দিকে নিউটন ও ডারউইনের মতো ব্যক্তিগণ পার্থিব জগৎকে আসমানের ওপর উঠানোর সুস্পষ্ট ভিত্তি স্থাপন করেছেন। এমন কে আছেন যিনি তাদের এই ভিত্তি প্রতিষ্ঠার কীর্তিকে তাচ্ছিল্যভরে অস্বীকার করার কথা মুখেও আনতে সাহসী হবেন—তা তিনি সংসারবিরাগী মৌলবি অথবা রেশম পরিধানকারী সুফি যে-ই হোন না কেন? অপরপক্ষে, জুনায়দ বাগদাদি ও হুসাইন বিন মনসুর হাল্লাজের মতো ব্যক্তিগণও তাদের কেরামতি বা অলৌকিকত্বের সামনে পার্থিব জগতের শক্তিশালী গর্দানকে অবনত করে দিয়েছেন!
আমার একান্ত ইচ্ছা, আল্লাহর নবীর (স) প্রত্যেক খাঁটি উম্মতেরই প্রথমে প্রান্তরবাসী ও পর্বতগুহায় সাধনানিরত হয়ে পরে তার খানকায় প্রবেশ করা উচিত। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সমগ্র উম্মতে মুহাম্মদিই হিম্মতহারা হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্য থেকে মুহাম্মদিয়াতের প্রাণপাখিই উড়ে গেছে। এখন রয়েছে কেবল মুহাম্মদিয়াতের লাশখানি, আর সেই লাশের আড়ম্বরপূর্ণ পূজা! এ কথা অবশ্য সত্য যে, ইউরোপবাসীদের কাছেও মুহাম্মদিয়াতের কেবল পার্থিব দিকটাই উদ্ভাসিত হয়েছে এবং তারাও কেবল এর সীমানার মধ্যেই ঘুরপাক খেয়ে ফিরছে। কিন্তু মুহাম্মদিয়াতের আধ্যাত্মিক দিগন্তটিও যে তাদের নিকট অনাবিষ্কৃত থাকবে না—তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তবে, তাদের নিকট উন্মোচিত হলেও তার বর্তমান মুসলিম উম্মতদের কাছে তা অজ্ঞাতই থেকে যাবে! খুব সম্ভবত এদের কেউই এই দিগন্ত উন্মোচনের জন্য চেষ্টা করবে না—যতক্ষণ না কোনো পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব এদের সম্পূর্ণ নতুন জিনিশে রূপান্তরিত করে দিতে সক্ষম হয়।
নবুওয়ত ও দার্শনিকতা
নির্জন সাধনার মাধ্যমে হজরত দুইটি অমূল্য জিনিশ অর্জন করেছিলেন : একটি নবুওয়ত, অপরটি দার্শনিকতা। এই দুইটি অর্জন এমন গৌরবময় যে বিশ্ববিজয়ও এর সামনে তুচ্ছ বলে বিবেচিত; আর একই ব্যক্তি যখন এই উভয় অমূল্য জিনিশের অধিকারী হন তখন তার মর্যাদা সম্বন্ধে তর্কের কোনো অবকাশই আর থাকে না। তিনি এমন ছিলেন যে দুনো জাহানকেই জয় করার সমস্ত সাজ-সরঞ্জাম তার হাতে এসে গেছিল। সত্য বলতে গেলে, এর ফলে দুনো জাহান জয়ের ভিত্তি স্থাপনের কাজই তার দ্বারা প্রথম সমাধা হয়।
সাধারণত প্রত্যেক নবীই দার্শনিক হয়ে থাকেন। এটা অপরিহার্যও বটে। কিন্তু নবুওয়তের জন্য যে-দার্শনিকতা অপরিহার্য তা আল্লাহ প্রেরিত ও অভিজ্ঞতালব্ধ। চিন্তাপ্রসূত দর্শন-জ্ঞান এর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। শেষোক্ত পর্যায়ের দার্শনিকতা নবুওয়তের জন্য অপরিহার্য নয়। হজরত মুসা (আ) যখন সিনাই উপত্যকায় নিজ বংশীয়দের জন্য বিস্তারিত আইন ও ব্যবস্থা-বিধি প্রণয়ন করছিলেন, তখন দার্শনিক নবী হজরত শোয়াইব (আ) তাতে হস্তক্ষেপ করেন এবং তিনি নিজে বহু আইন ও বিধিবিধান প্রস্তত করেন বা প্রস্তুত করিয়ে পেশ করেন। তাহলে এ কথা স্পষ্ট যে হজরত মুসা (আ) নবী ছিলেন সত্য, চিন্তাশীল দার্শনিক ছিলেন না। হজরত ঈসা-মসিহরও (আ) সেই একই অবস্থা—নবী ঠিক, কিন্তু চিন্তাপ্রসূত দর্শনের অধিকারী নন।
সুতরাং, যদি বলা হয় হজরত মুহাম্মদ (স) নবুওয়তের সাথে দর্শনও অর্জন করেছিলেন, তাহলে এর সাথে তার নবী না হওয়ার যে-ধারণাটি জড়িত হয়ে পড়ে তাতে বিস্ময়বোধের কিছু নাই। প্রকৃত ব্যাপার এই—চিন্তাশীলতা ছাড়া নবুওয়ত লাভই সম্ভবপর নয়। কিন্তু এই চিন্তা একটি নির্দিষ্ট বৃত্তে সীমিত হতে পারে। এই জন্য চিন্তাপ্রসূত দার্শনিক-জ্ঞান যদি নবুওয়তের জন্য অপরিহার্য বলে ধরা যায়, তা হলেও তা সীমিত চিন্তাপ্রসূত দার্শনিকতায়ই পর্যবসিত হয়। কিন্তু এখানে দাশনিতার অর্থ স্বাধীন দার্শনিক-জ্ঞান; এই স্বাধীন চিন্তাপ্রসূত দার্শনিক-জ্ঞান নবুওয়তের জন্য অপরিহার্য নয়। সুতরাং দার্শনিকতাকে নবুওয়ত থেকে পৃথক বিষয় হিশাবে বর্ণনা করা ভুল হতে পারে না।
এ ব্যাপারেও সাধারণভাবে একটা ভুল ধারণা রয়েছে। অনেকেই মনে করেন যে, নবী কখনও দার্শনিক হতে পারেন না এবং নবীর পক্ষে দার্শনিক হওয়া উচিতও নয়। তাদের মতে, দার্শনিকতা নবীর জন্য কামালিয়াত ও রওনকের কথা নয়, বরং ত্রুটি ও অশোভনতারই কথা। কিন্তু এ ধরনের অভিমতের মূলে কোনো সত্যতা নাই।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে নবুওয়ত কি অর্জন করার বিষয়? যদি তা না হয়, তবে কেন বলা হলো হজরত নবুওয়ত অর্জন করেছিলেন? আর, যদি তা-ই হয়ে থাকে তা হলে নবুওয়ত আল্লাহর দান—এই সর্বস্বীকৃতি বিশ্বাস আর থাকল কোথায়? তা ছাড়া, এই বিশ্বাসটিও তো কেবল কোনো ব্যক্তিগত বা জাতিগত বিশ্বাস নয়, এর পিছনে রয়েছে ধর্মীয় প্রমাণ। পবিত্র কোরআন ও হাদিস—ধর্মীয় বিধানের এই উভয় উৎসেই বলা হয়েছে নবুওয়ত প্রকৃতিগত এবং আল্লাহর দান, এটা অর্জিত বা লব্ধ নয়।
প্রকৃতপক্ষে, নবুওয়ত একাধারে ‘কসবি’ (অর্জনীয়) এবং ‘ওয়াহবি’ (খোদাপ্রদত্ত)। কিন্তু যদি মনে করা হয় নবুওয়ত সকল দিক দিয়েই কেবলমাত্র আল্লাহপ্রদত্ত—তাহলে ভুল করা হবে। পবিত্র কোরআন ও হাদিস-নির্গত এ সম্পর্কিত প্রমাণাদিও ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে। স্মরণযোগ্য যে এই দুই ক্ষেত্রেই বিষয়টির যে-দিকটার যখন প্রয়োজন বোধ হয়েছে তখন সেই দিকটা সম্পর্কেই আলোকপাত করা হয়েছে।
নবুওয়ত আল্লাহর দান এই অর্থে যে এটা কেবলমাত্র উপার্জিত ফল নয়। এই জন্যই, এটাও সম্ভব নয় যে, যে চেষ্টা করবে সে-ই নবী হতে পারবে। বরং এ ব্যাপারে ফিতরতের (প্রকৃতি বা স্বভাব) নির্বাচনের হাত রয়েছে। যিনি ফিতরতের দিক থেকে নির্বাচিত নন তিনি নবী হতে পারবেন না, তিনি পাহাড়ের সমান চেষ্টাও করুন না কেন। কিন্তু নবুওয়ত আল্লাহর দান—এর অর্থ আদৌ ‘অর্জনের মুখাপেক্ষী নয়’ এমন কিছুতেই হতে পারে না। যদি এমনই হতো, তাহলে হজরত মুসাকে (আ) সাত বৎসর হজরত শোয়াইবের (আ) খিদমতে কাটাতে হতো না, হজরত ইয়াকুবকে (আ) হজরত শিয়ার (আ) আস্তানায় সাত বৎসর অতিবাহিত করতে হতো না, কিংবা হজরত ঈসা-মসিহ (আ), যিনি ‘রুহুল্লাহ’ বা আল্লাহর আদেশ, কালিমাতুল্লাহ বা আল্লাহর নিদর্শন এবং আজন্ম অলৌকিকত্ব বহনকারী, তারও হজরত ইয়াহইয়ার (আ) কাছে প্রথম সবক গ্রহণ করতে হতো না। এবং নবী-রসুলদের নেতা হজরত মুহাম্মদের (স) তিন বৎসরের জন্য বিপদসংকুল গুহায় নির্জন জীবন অবলম্বনেরও প্রয়োজন হতো না।
এ কথা যেমন সত্য—
❝এই সৌভাগ্য যায় না পাওয়া বাহুবলে
যদি না রাজি থাকেন স্বয়ং খোদা।❞
তেমনই এ কথাও সত্য—
❝সম্পদ হস্তগত হয় না আপনাআপনি
না করলে চেষ্টায় আত্মনিয়োগ।❞
আর তা ছাড়া, যে অর্থে নবুওয়ত ‘খোদাপ্রদত্ত জিনিশ’ সেই অর্থে দার্শনিক জ্ঞানও ‘খোদাপ্রদত্ত জিনিশ’। কেননা, যে-কেউ চেষ্টা করলেই দার্শনিক বনে যেতে পারে না। চেষ্টার পরেই অবশ্য দার্শনিকতা লাভ হয়, কিন্তু লাভ করেন তারাই যারা আজন্ম দার্শনিক, অর্থাৎ যাদের মধ্যে দার্শনিকতার স্বভাবগত যোগ্যতা বিদ্যমান থাকে।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন উঠতে পারে। যদি কেউ বলেন আল্লাহর নবী (স) যে নবুওয়ত অর্জন করেছিলেন তা-ই বা কি করে জানা সম্ভব? এমনও তো হতে পারে যে, তা বাস্তবে অর্জন হয় নাই, কেবল প্রচার হয়েছে নবীত্বের। এই প্রশ্নটিই কঠিন সংশয়ের জন্ম দেয় এবং শেষ পর্যন্তও তা জটিল থেকে জটিলতর হয়। তার জন্মস্থানের কথা বলতে গেলে তো স্বীকার করতে হয় যে, সেখানে নবুওয়ত কখনও স্বীকৃতিই পায় নাই। তার নবুওয়ত কেবল বিদেশেই স্বীকৃত হয়েছিল; তাও একটি ক্ষুদ্র পল্লীবাসীর মাঝে, যে পল্লীর বাসিন্দারা দরিদ্র কিষাণ-মজদুর ও অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত। তারাই কেবল এই স্বীকৃতি জানিয়েছিল; সেখানকার নেতা ও সমাজপতিগণ আবার স্বীকৃতি দান করে নাই। তখনকার আরবে শিক্ষিত বলতে ছিল ইহুদি ও খ্রিষ্টানেরা। এই দুই জাতি কখনও তার নবুওয়তকে স্বীকৃতি দেয় নাই। এমনকি, তারা নির্বাসন ও ধ্বংসকে বরণ করে নিয়েছে তবু তার নবুওয়তকে মেনে নিতে সম্মত হয় নাই। তাহলে বোঝা যায়, কত জটিল এই ধারণাটি।
এ কথা সত্য যে শেষ পর্যন্ত সমগ্র আরব উপদ্বীপবাসীই ইহুদি এবং খ্রিষ্টানদের পরিত্যাগ করে হজরতের কাতারে শামিল হয়েছিল। কিন্তু তার দলে এই শামিল হওয়ার কারণ প্রমাণ ও বিশ্বাস নয়; বরং ভয় ও অনুসরণের মনোবৃত্তি হতেই তারা শেষ পর্যস্ত তার দলভুক্ত হয়। এটাও ঠিক যে, তার বিরুদ্ধে যে শক্তিই মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তা পানির মতোই দুই দিকে কেটে পড়েছে এবং সমগ্র আরব একত্র হয়েও তার ক্রমবর্ধমান শক্তিকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয় নাই। কিন্তু তার এই কীর্তি মূলে তার নবুওয়তের কিছু ছিল না। এটা ছিল তার দার্শনিকতার বিস্ময়কর সাফল্য। বস্তুত, নবী নন এমন বহু দার্শনিক এই বিশ্বে আগমন করেছেন যারা নিঃসম্বল অবস্থায় এসেও নিজেকে এমন এক পর্যায়ে উন্নীত করিতে সক্ষম হয়েছেন, যেখানে প্রতিটি বিরোধী শক্তিই খান খান হয়ে ভেঙে পড়েছে।
এই কিছুদিন আগেই ভ.ই. লেনিন নামক এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল। তিনি ছিলেন মামলা-না-পাওয়া উকিল মাত্র। কিন্তু পরবর্তী কালে তিনিই হয়ে গেলেন রুশ দেশের ভাগ্যবিধাতা। তার বিরুদ্ধে যত শক্তিই মাথা তুলেছিল সবই পরাজিত হয়েছে। এমনকি, যে ইংরেজ জাতি পরাজয় কাকে বলে তা জানেই না, তারাও তার কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। তারই স্থলাধিকারী হয়েছেন ইয়োসিফ স্তালিন, এবং তিনিও সেই পর্যায়েই উপনীত হন। তাহলে এই দুইজন কি নবী? নিশ্চয় না। তারা দার্শনিক মাত্র।
অন্যদিকে, এটাও ঠিক যে, বহু লোক তার নবুওয়তকে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং তারা হজরত এবং তার মিশনকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নেবার জন্য অকাতরে বিরাট ত্যাগও স্বীকার করেছেন। কিন্তু মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের নবুওয়তকে কি কেউই স্বীকার করে নাই, এবং তার জন্য ত্যাগ স্বীকারকারী কেউ কি ছিল না? আজও কি বাহাই নবুওয়তকে বহু লোক মানে না এবং বাহাউল্লাহর শিষ্যরা কি ত্যাগ স্বীকার করে নাই? অত দূরে যাওয়ারই-বা কি প্রয়োজন! পাক-ভারত উপমহাদেশে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও গান্ধীর অনুসারীও তো বহু এবং তারা কোনদিক দিয়েই-বা কম কষ্ট স্বীকার করেছেন? অথচ, তারা দুইজনই রাজনৈতিক নেতা ছাড়া অন্য কিছু না।
মেনে নিলাম, হজরত নিজে নবুওয়তের দাবি করেছেন এবং তিনি লোক হিশাবেও সত্যবাদী ছিলেন। কিন্তু নবুওয়তও এ ধরনের সূক্ষ্ম এবং বিতর্কমূলক কিছুর দাবি সত্যবাদীর কাছ থেকে উত্থিত হওয়া সত্ত্বেও তা মিথ্যা হতে পারে, অর্থাৎ তা ভুল হওয়ার সম্ভাবনামুক্ত নয়। কেননা, বহু দাবির ক্ষেত্রেই সঠিক ও ভ্রান্তির মানদণ্ড কেবল সত্যবাদিতা ও মিথ্যা নয়, বরং দাবিদারের সঠিক ধারণা ও ভুল ধারণার ওপরও তা অনেকখানি নির্ভরশীল। হতে পারে, একজন দাবিদার সত্যবাদীই বটে এবং তিনি তার দাবির ব্যাপারে নিয়তের দিক থেকে সত্যবাদী; কিন্তু ভুল ধারণার শিকারে পতিত হয়ে তিনি হয়তো ভুল দাবিই করে বসলেন, এ সম্ভাবনা তো অস্বীকার করা যায় না।
তা ছাড়া, অনেক সময় দেখা যায় অনেক সত্যপন্থী রাজনৈতিক নেতা নিজের মহৎ ও পবিত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সাফল্যের জন্য অসংখ্য জনপ্রিয় বিশ্বাস ও ঐতিহ্যকে মেনে নেওয়ার ভান করে থাকেন। তারপর তিনি ধীরে ধীরে নিজ উদ্দেশ্যের পথে অগ্রসর হন। এই ভাবে তিনি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সামগ্রিক সত্যের খাতিরে ক্ষুদ্র মিথ্যাসমূহকে অসংকোচে বরদাশত করে থাকেন। হজরতের নবুওয়তের ব্যাপারেও এই সত্যটিকে সম্ভব বলে না মানার কি কারণ রয়েছে?
অবশ্য এও সত্য—হজরত মুহাম্মদের (স) নবুওয়ত সম্পর্কে পবিত্র কোরআন প্রকাশ্য ঘোষণা করেছে আর পবিত্র কোরআনের সত্যতাও সর্বস্বীকৃত। কিন্তু পবিত্র কোরআনের সত্যতা ও হজরতের নবুওয়তের বিশুদ্ধতা, এই দুইটি তো পরস্পর নির্ভরশীল। সুতরাং কোরআন সত্য, এবং মুহাম্মদ (স) একজন নবী, কোরআনের এই দাবি সত্য হলেও তাতে আসল কথার সত্য হওয়া তো অপরিহার্য নয়, অর্থাৎ এর মাধ্যমে এ কথা অবধারিত বা অপরিহার্য বলে তো প্রমাণিত হয় না যে তার নবুওয়তের কথাটি প্রকৃতই সত্য হতে পারে। কেননা, কোরআনও হয়তো আসল সত্যকে জানতে পারে নাই। আর তা ছাড়া, কোরআনকে আল্লাহ্র বাণী বলে স্বীকার করলে তবেই তার জানা না-জানার একটা মূল্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। কিন্তু কোরআন যে আল্লাহর বাণী এটা প্রমাণ করা হজরতের নবুওয়তকে প্রমাণ করার চেয়ে কম কঠিন কাজ নয়। সুতরাং ‘তার নবুওয়তের দাবি সত্য’ এই দাবিকে ‘কোরআন আল্লার বাণী’ এই দাবির সাথে জড়িয়ে ফেললেই বিষয়টির ফয়সালা হবে না; বরং এর ফলে বিষয়টির জটিলতা আরও বৃদ্ধিই পায়।
এ কথা অবশ্য সত্য—হজরতের নবুওয়ত সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করার পরিণামে জাহান্নাম, হত্যা, অভিশাপ ও ধ্বংসের ভয় বিদ্যমান। এ ছাড়া, সর্বাপেক্ষা বড় ভয়ের কারণ হলো তথাকথিত মুফতি মাওলানা ও পীর গোষ্ঠী। কারণ, এ দুটি শ্রেণি কারও প্রতি বিগড়ে গেলে তার আর কোথাও স্থান হবে না! তা ছাড়া, মুফতি মাওলানা ও পীরদের জন্য তো অন্য কোনো প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না; কারণ তারা নিজেরাই তো সর্বাপেক্ষা খাঁটি প্রমাণ! সুতরাং তারা সশরীরে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আবার অন্য প্রমাণ খোঁজার কোনো কারণ আছে কি?
কিন্তু আফসোসের বিষয়, দর্শন উপর্যুক্ত ভয়ের একটির কাছেও নতিস্বীকার করে না। দর্শনের কথা হলো—‘জাহান্নাম মঞ্জুর করিব, তবু মূর্খতা মঞ্জুর করিব না।’ তা ছাড়া, দর্শন তথাকথিত পীর ও মুফতি মাওলানাদের থোড়াই কেয়ার করে। দর্শন তো তাদের সম্পর্কে ‘উল্টো’ ধারণা পোষণ করে। দর্শনের মতে, শক্তিশালী কোনো কথাকেও যদি এই দুই শ্রেণি স্পর্শ করে, তবে তা নিশ্চয়ই দুর্বল হয়ে পড়বে! এই দুই শ্রেণি তো জীবনভর মূর্খতা ও কুসংস্কারপূর্ণ কথাই বলে থাকে। আর, এ সবই তাদের প্রকৃত অস্ত্রও বটে। এ সবের মাধ্যমেই তারা নিজ অনুসারীদের সবসময় আঁকড়ে রাখতে সমর্থ হয় এবং বিরোধীদের স্থায়ীভাবে করে কুপোকাৎ। সুতরাং, তারা যদি মাঝে-মধ্যে এমন মহাপাণ্ডিত্যপূর্ণ (?) কথা না বলেন, তবে আর কারা বলবে?
হজরত মুহাম্মদ (স) দার্শনিকতার সাথে নবুওয়তও নিশ্চিতভাবেই অর্জন করেছিলেন—এ কথাটি কেবলমাত্র একটি উপায়ে জানা সম্ভব। কেননা, একমাত্র এই উপায়টিই দার্শনিকতাপূর্ণ, বাকি সমস্ত উপায়ই ভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ ও তাতে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা বিপুল। আর এই একটি উপায়ের মাধ্যমেই এই গ্রন্থাকারের দার্শনিকতা প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। সেই উপায়টা কি? এই উপায়টি হলো—‘মোশাহেদায়ে মুহাম্মদ (স)’ বা স্বয়ং হজরতকেই সাক্ষী মানা। তাকে দেখলে যে-কেউই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে যে তিনি নবী ছিলেন, আর যদি তিনি নবী না হয়ে থাকেন তিনি ফেরেশতা ছিলেন, আর যদি তিনি ফেরেশতা না হয়ে থাকেন তাহলে তিনি ছিলেন স্বয়ং অবতার!
এটাকে আমি অভ্যন্তরীন বা ভিত্তিগতপ্রমাণ বলে অভিহিত করতে চাই। বাকি প্রমাণগুলো বাহ্য প্রমাণ হিশাবেই পরিগণিত। আর এটাতে স্বীকৃত যে কোনো ব্যক্তির সত্য স্বরূপ জানার জন্য আসল প্রমাণ হচ্ছে অভ্যন্তরীন প্রমাণ। এই ক্ষেত্রে বাহ্যিক প্রমাণাদি ততখানি কার্যকরী নয়। হজরত মুহাম্মদকে (স) সত্যিকারভাবে প্রত্যক্ষ করলে সহজেই দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাবে যে তিনি সত্যই নবী ছিলেন। যদি সারা বিশ্বের কোনো কিছুই তার নবুওয়ত সম্পর্কে একটি সাক্ষ্যও উপস্থিত করতে সক্ষম না হয়, কিংবা ধরে নিলাম তিনি নিজেও নবুওয়তের দাবি উত্থাপন করেন নাই, পবিত্র কোরআনেও তার নবুওয়তের কোনো দাবি করা হয় নাই, অথবা কখনও তার কোনো অনুসারী ছিল না এবং আজও নাই, তবু হজরত মুহাম্মদকে (স) দেখলে আপনার দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাবে যে তিনি একজন খাঁটি নবী ছিলেন। মোশাহেদার ফলে আপনি জানতে পারবেন, তার মধ্যে একটি পূর্ণ মানব বা ‘কামেল ইনসান’ বিদ্যমান।
সেই পূর্ণ মানবটি এমন একটি মহাবৃক্ষ সদৃশ যা অপরূপ সজ্জায় সুসজ্জিত এবং দুনিয়ার সব রকমের ফলই যাতে নিজ নিজ স্থানে শোভিত; আর সেই ফলগুলোর মধ্যেই রয়েছেন সকল নবী সকল আউলিয়া, সকল দার্শনিক, সকল চিকিৎসক, সকল চিন্তাবিদ, সকল পরিচালক, সকল সেনাপতি, সমস্ত সভ্যতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠাতা এবং সকল আলিম ও ধর্ম প্রচারক; ওর মধ্যেই রয়েছেন সকল নেককার, সকল আল্লাহপ্রেমিক, সকল বিত্তশালী, ও সকল আমির; ওর এক পার্শ্বের ফলগুলোতে রয়েছেন বনি ইসরাইলের সকল নবী, অপর পার্শ্বে রয়েছেন বুদ্ধের মতো তপস্বীগণ আর তৃতীয় পার্শ্বে রয়েছেন পারস্য ও চীনের সকল ধর্মবেত্তা এবং চতুর্থ পার্শ্বে রয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন জাতির নেতৃবৃন্দ; আর এরই একদিকে জিব্রিল, মিকাইল, ইসরাফিল ও আজরাইলসহ ফেরেশতাদের সকল নেতা রয়েছেন, অপর একদিকে রয়েছে সকল প্রকারের জ্ঞানের আলোকপিণ্ড, গোপন রহস্যভান্ডার এবং সকল তথ্যের মূলসূত্র। এরপরেও ওখানে বহু জায়গা এখনও শূন্য পড়ে রয়েছে এবং ওর অনেক অংশ এখনও অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে। মোট কথা, ওটা যেন আলাদা একটি গোটা বিশ্ব। এই বিশ্বের খানিক অংশ মূর্তিমান যা আবিষ্কৃত হয়েছে, আর খানিক অংশ বাদ রয়েছে যার পরিচয় লাভ আজও সম্ভব হয় নাই। কেউ হজরত মুহাম্মদকে (স) প্রত্যক্ষ করার পর যখন উপর্যুক্ত তত্ত্বের সাথে পরিচয় লাভ করবে তখন সেই ব্যক্তি কেবল এ সিদ্ধান্তই করবে না যে, তিনি সত্যিই নবী ছিলেন, বরং সে এরূপও মনে করবে যে, নবুওয়তের চেয়েও উচ্চ কোনো মর্যাদা তার ছিল—সে মর্যাদার নাম যদিও বা জানা সম্ভব হচ্ছে না। এমতাবস্থায় তার সামনে হজরতের যে মূর্তি ভেসে উঠবে তাতে মনে হবে যে, নবুওয়ত তো তার আলোক-সূর্যের একটু কিরণ মাত্র—এই কিরণটুকুই এখানে এসে এমন তেজস্বিতা লাভ করেছে যে, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-তারকার সকল আলোকমালা মিশ্রিত হয়ে বুঝি এক অপুর্ব আলোর মেলা সাজিয়েছে!
হজরতকে পর্যবেক্ষণ করার দুটি দিক রয়েছে। একটি জাহেরি (প্রকাশ্য), অপরটি বাতেনি (গোপন)। যে-ব্যক্তি উভয় দিক দিয়েই তাকে প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হবে তার তো আর কোনো কিছুরই প্রয়োজন বাকি থাকবে না; কারণ তার কাছে দুইজন মুহাম্মদ (স) উদ্ভাসিত হবেন—একজন জাহেরি মুহাম্মদ (স), অপরজন বাতেনি মুহাম্মদ (স)। তিনি লাভ করবেন মুহাম্মদের (স) প্রতি দুইটি ঈমান, দুইটি দৃঢ় প্রত্যয়। তবে কেউ যদি কেবল জাহেরি দিক দিয়েও তাকে প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হন তাহলেও দুইটি না হোক একটি ঈমান ও একট দৃঢ় প্রত্যয় লাভ হতে তো তিনি কিছুতেই বঞ্চিত হবেন না।
এমনই অবস্থায় পৌঁছলে তার হৃদয়ে হজরতের প্রতি যে ঈমান থাকবে তাতে কোনো দিক দিয়েই দুর্বলতা বা সন্দেহ স্পর্শও করতে পারবে না। তাকে প্রত্যক্ষ করার প্রকাশ্য ফল-লাভ এই হবে যে তিনি দেখতে পাবেন : হজরত কামেল চিন্তাশীল ব্যক্তি ছিলেন। তিনি যখন চিন্তা করেছেন সঠিকভাবেই চিন্তা করেছেন; আর তিনি যে চিন্তা করেছেন বিশুদ্ধ চিন্তাই করেছেন। এজন্যই বিরোধী সকল চিন্তা সব সময়ই তার চিন্তার কাছে হার মেনেছে। তৎকালীন জ্ঞাত-বিশ্বের এমন কোনো চিন্তাবিদই ছিল না যে তার চিন্তার বিপক্ষে না গিয়েছে এবং পরাজিত না হয়েছে! তারপর, যদি কেউ বলতে চান হজরত মুহাম্মদ (স) প্রত্যাদেশ লাভে বঞ্চিত ছিলেন, আপাতত তা মেনে নিলেও ক্ষতি নাই। কারণ, যদি প্রত্যাদেশ লাভে বঞ্চিত কোনো ব্যক্তি নিজের সঠিক চিন্তার মাধ্যমে প্রত্যাদেশ-প্রাপ্ত সকলের অপেক্ষা সত্য-অনুধাবনের ক্ষেত্রে অধিক অগ্রসর হতে পারেন, তাহলে তার পক্ষে প্রত্যাদেশ লাভ না করা কি তার অযোগ্যতা প্রমাণ করবে, না তার কামলিয়াত প্রমাণ করবে? এমন ক্ষেত্রে তো তার চিন্তাই প্রত্যাদেশের চেয়ে অধিক মূল্যবান প্রমাণিত হবে। এমতাবস্থায়, প্রত্যাদেশ লাভ করাকেই যদি নবুওয়ত নামে আখ্যায়িত করা হয় তাহলে অবশ্য হজরত মুহাম্মদের (স) নবুওয়ত প্রমাণিত হয় না, কিন্তু এরচেয়ে বড় একটি জিনিশ প্রমাণিত হয়; তা এমন দার্শনিকতা যা নবুওয়তের চেয়ে উন্নত জিনিশ। সুতরাং ফল এই দাঁড়ায়—হজরত (স) নবুওয়ত অপেক্ষা আরও অধিক মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।
এখানে, আরও একটি প্রশ্নের উদয় হতে পারে যার আলোচনা মূল বিতর্কের ওপর নতুনভাবে আলোকপাত করব; প্রশ্নটি এই যে, কেন অপরিণত চিন্তাবিদদের ওপর ওহি বা প্রত্যাদেশ নাজিল হয়েছে? প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হওয়ার বিধি কি এই যে, অপরিণত চিন্তাবিদদের ওপর তা অবতীর্ণ হবে অথচ কামেল চিন্তাবিদদের ওপর অবতীর্ণ হবে না? যদি এটাই সত্যিকারের বিধান হয়ে থাকে তাহলে সমগ্র ঐশী বিষয়টিই ভিত্তিহীন হয়ে পড়বে। এটা কখনও হতে পারে না—বরং প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হবার বিধানটি এর সম্পূর্ণ বিপরীত; নিশ্চয় নিয়মটি এমন যে অপরিণত চিন্তাবিদ অপেক্ষা কামেল চিন্তাবিদদের ওপর অধিক উচ্চ পর্যায়ের প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়ে থাকে। সুতরাং, হজরত মুহাম্মদের (স) প্রত্যাদেশ লাভের বিষয়টিও এর ফলে নিশ্চিত হয়ে যায়—এ কথা প্রমাণিত হয় যে তার চিন্তা সর্বাপেক্ষা কামেল ছিল এবং এর বিপরীতে কোনো চিন্তাই এতটুকুও আলোক-বিকিরণ করতে সক্ষম হয় নাই। হজরত ঈসা (আ), হজরত মুসা (আ) ও অন্যান্য সম্মানিত নবীদের বেলায় প্রত্যাদেশ ছাড়া তাদের নিজস্ব চিন্তার স্বাতন্ত্র্য কোথায়? হজরত ঈসা (আ) কিছু উপদেশমূলক বক্তৃতাদান ও কয়েকজন শিষ্য একত্র করা ছাড়া অন্য কোনো চেষ্টায় সাফল্য লাভ করেছেন কি? অথচ, তাকে তো পরিবার-পরিজনের ঝামেলায় পড়তে হয় নাই, রাজ্য পরিচালনা ও দেশ শাসন করতে হয় নাই, কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোনো ব্যাপারের সাথেও কোনো সংশ্রব রাখতে হয় নাই; তিনি রাজনীতিতেও প্রবেশ করেন নাই, কিংবা সমাজনীতিও স্পর্শ করতে সক্ষম হন নাই। কেবল ধর্মপ্রচার ও ধর্মশিক্ষা দানই ছিল তার ব্রত। তারপরও, সেখানেও তার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। পরে কী কী হয়েছে তা পৃথক ব্যাপার এবং তা পরবর্তীদেরই বিষয়, তার কিছুই নয়।
হজরত মুসাও (আ) অলৌকিকত্ব ও প্রত্যাদেশের মাধ্যমে যত দূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিল তত দূরই অগ্রসর হয়েছেন; কিন্তু যখনই কোথাও চিন্তার প্রয়োজন হয়েছে তখনই সেখানে দেখা যায় তার ব্যর্থতা। হজরত মুসার (আ) ওপর যে-দায়িত্ব ছিল তা সুকঠিন ছিল, সন্দেহ নাই; কিন্তু নিজ কওমকে স্বীয় বিশ্বাসে দৃঢ় রাখাই তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এ কথা সত্য যে, হজরত ইউশা (আ) তার অসম্পূর্ণ কার্যকে সম্পূর্ণ করেছেন, কিন্তু সে কৃতিত্ব তো হজরত ইউশারই (আ), হজরত মুসার (আ) নয়। অপর পক্ষে, তাদের তুলনায় হজরত মুহাম্মদকে (স) পর্যবেক্ষণ করুন, দেখতে পাবেন, তিনি যা চিন্তা করেছেন অন্তত ভিত্তি-রচনা বা নমুনা পর্যায়ে তিনি তা নিজে করে গেছেন। শাখা-পর্যায়ে অবশ্য তিনি সমস্ত কিছু সম্পন্ন করে যেতে পারেন নাই। কিন্তু শেষোক্ত পর্যায়ে, খুঁটিনাটি সমস্ত কিছু করার সম্ভাবনা কোনো এক যুগে এবং একই ব্যক্তির জীবনে তো কল্পনাও করা যায় না।
প্রশ্ন হলো, অন্যান্যদের তুলনায় তার এই পার্থক্য কি জন্য? এ পার্থক্য এজন্য যে হজরত মুহাম্মদের (স) চিন্তা ছিল অপেক্ষাকৃত কামেল চিন্তা।
এইবার সমকালীন অবস্থা পর্যালোচনা করা যাক। একদিকে, ইহুদি ও খ্রিষ্টানসহ সমগ্র আরবের সকল চিন্তাবিদই তার বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়েছেন এবং নিজ নিজ চিন্তার চাকচিক্য প্রদর্শন করেও ব্যর্থ হয়েছেন। তারপর বিরোধিতায় নেমেছেন পারস্যের চিন্তাবিদগণ। তাদেরও একই পরিণতি ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এসেছেন রোমক চিন্তাবিদগণ। কিন্তু তারাও পরাজিত হয়ে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। সুতরাং হজরত যে কামেল চিন্তার অধিকারী ছিলেন তা স্বীকার করে নিতে আর আপত্তির কি থাকতে পারে?
এ প্রসঙ্গে, কেউ হয়তো বলতে পারেন যে, তার চিন্তার এই যে বিজয় এতে আল্লাহর সাহায্যেরও তো ভূমিকা ছিল। মেনে নিলাম, তা ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সাহায্যটি কীভাবে তিনি লাভ করতেন? যদি এর উত্তরে বলা হয় যে, ওহি বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে, তাহলে তার নবুওয়তের প্রমাণ করতে আর কোনো প্রকারের বেগই পেতে হয় না। যদি বলা হয় যে ওহি বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে নয়, বরং অদৃশ্য কোনো শক্তির মাধ্যমে তিনি আল্লাহর সাহায্য লাভ করতেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে যে, এই অদৃশ্য শক্তিটি কী? ফেরেশতার আগমন? তাহলেও তো তার নবুওয়ত স্বতঃসিদ্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া, এই অদৃশ্য শক্তির নিত্যপ্রকাশ অন্যান্য মাননীয় নবীদের বেলায় হয় নাই কেন? উত্তরে হয়তো কেউ বলবেন তা অবিনশ্বরের ইচ্ছা। তাহলে তো বুদ্ধির বিতর্ক এখানেই শেষ হয়ে যায়। সুতরাং অন্য কোনো প্রশ্নের আর অবকাশ থাকে না।
এরপর তার পর্যবেক্ষণ এ সত্যই প্রকাশ করবে যে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ছিলেন; কঠিন সংকট-সন্ধিক্ষণেও তিনি কখনও হতাশায় চিৎকার করে বলেন নাই যে, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমাকে কেন পরিত্যাগ করলে?’, কিংবা এ কথাও বলেন নাই যে, ‘হে আল্লাহ, এখন আমি কি করব?’ যদি বা কখনও উদ্বেগ বোধ করেছেন তবু তিনি বলেছেন : ‘হে আল্লাহ, আমার সাথে যদি তোমার নাম উচ্চারণকারীরাও আজ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তাহলে এই ধরাধামে তোমার নাম নেওয়ার আর কেউই অবশিষ্ট থাকবে না।’ এরপরই, তিনি যে-কার্যে রত ছিলেন তাতেই আবার আত্মনিয়োগ করেছেন। পরে আর তার মধ্যে সামান্যতম উদ্বেগও পরিলক্ষিত হয় নাই কিংবা তিনি একটুও বিচলিত ভাব প্রদর্শন করেন নাই; বরং তখন তিনি পরিপূর্ণ প্রশান্তির ভাব ধারণ করেছেন। এমনও অনেক সময় হয়েছে যে, সকলে ‘অপারগ’ হয়ে পড়েছেন কিন্তু তিনি একনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলছেন। এইরূপ অবিচলিততাবে কার্যে মগ্ন থেকে তিনি সঙ্গীদের মনে নতুন প্রেরণার সঞ্চার করেছেন—এতে, যারা ক্লান্ত, ভগ্নহৃদয় হয়ে পড়েছিলেন তারা লাভ করেছেন নতুন জীবন। ফলে, গোটা দলই নববলে বলীয়ান হয়ে পুনরায় পূর্ণোদ্যমে কর্মক্ষেত্রে ঝাপিয়ে পড়েছেন।
জিজ্ঞাসা করি, তার এই দৃঢ়চিত্ততা কি নবীদের দৃঢ়চিত্ততা অপেক্ষা কোনো অংশে দুর্বল ছিল? নিশ্চয়ই নয়। বরং তারচেয়েও দৃঢ়ই ছিল। এমনকি, এমন একজন নবীরও নাম করা সম্ভব হবে না যিনি হজরতের কীর্তির সমান কীর্তি প্রদর্শন করেছেন এবং তার চিত্তের দৃঢ়তার মতো নিজেকে দৃঢ়চিত্ত করতে পেরেছেন।
তাকে সাক্ষ্য মানার মাধ্যমে এই উপলব্ধিও সম্ভব হবে যে, হজরত পরিপূর্ণ বিনয়ী ছিলেন। অন্যের ক্ষুধা মিটাতে গিয়ে নিজের ও নিজ পরিবারের জন্য নিত্য-উপবাসকে তিনি স্থায়ী কার্যসূচীতে পরিণত করেছিলেন। আজীবন ধৈর্য ও তিতিক্ষা, আজীবন সৃষ্টির পালন ও সেবার মাধ্যমে উক্ত কার্যসূচীকে তিনি এমনই ক্রটিহীন ও নিখুঁত করে তুলেছিলেন যে, সমগ্ৰ মানবজাতির ইতিহাসে এমন কোনো মহৎ ব্যক্তিরই সাক্ষাৎ মিলবে না যিনি এই ক্ষেত্রে তার সমতুল্য হতে পারেন। এমনকি, অন্য কোনো নবীও নন।
তার দিকে তাকালে আরও জানা যাবে যে তিনি ছিলেন চরম নির্ভীক ও পরম সাহসী, তিনি ছিলেন মুক্তহস্ত দানশীল ও অত্যন্ত উদার।
সকলেই যখন ভীত হয়ে পড়ত এবং রণে ভঙ্গ প্রদর্শন করত তখনও তিনি থাকতেন ভয়হীন ও রণক্ষেত্রে অবিচল। শুধু তা-ই নয়, এমনই সংকটকালে তিনি যেন আরও সাহসী হয়ে উঠতেন এবং শক্রর মধ্যেও ধ্বনি উচ্চারণ করত বিপুল বিক্রমে অগ্রসর হতে থাকতেন। এমনকি, এসব দেখে শেষে পৃষ্ঠপ্রদর্শনকারীরাও ফিরে আসত এবং হতোদ্যমরাও পূর্ণোদ্যম হয়ে উঠত।
পরিপূর্ণতার পথে : গুরুত্বপুর্ণ ঘটনাবলির আলোকে
পবিত্র কোরআন ধীরে ধীরে অবতীর্ণ হচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই সেটা লেখা হতো এবং ক্রমিক বিন্যাসে সাজানো হতো। লেখার জন্য লেখকগণ নির্দিষ্ট ছিলেন। তখনো আরবে লেখার জন্য কাগজের প্রচলন ছিল না সুতরাং, খেজুরের পাতা, চামড়া ও মোটা হাড়ের ওপর আল কোরআন সংকলন হতো।
পবিত্র কোরআন লিখন ও ক্রমিক বিন্যাস:
হজরত আবু বকরের (রা) খেলাফতের সময় এই সকল লেখাকে একত্র করে গ্রন্থাকারে প্রস্তুত করা হয়। অবশ্য এই গ্রন্থও কাগজের না, চামড়ার ছিল। হজরত ওসমানের (রা) খেলাফতকালে এই গ্রন্থটিরই ছয়টি কপি তৈরি করে খেলাফতের অধীন ছয়টি দেশে প্রেরণ করা হয়। তখনো মুদ্রাযন্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি। সুতরাং, ওই ছয় কপি থেকে অনুলিপি করে কোরআনের শিক্ষার প্রচার করা হতে থাকে। আগে থেকেই কোরআন মুখস্থ করার রীতি প্রচলিত ছিল। তারপর যখন মুদ্রণপ্রথা প্রচলিত হয় তখন কোরআনও মুদ্রিত হতে থাকে। এই জন্য পবিত্র কোরআন যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছে আদ্যোপান্ত অবিকৃত তেমনই সংরক্ষিত রয়েছে। পবিত্র কোরআন সবসময় আরবি অক্ষরে লিখিত হয়েছে। আজও এই নিয়মই অনুসৃত হচ্ছে।
সাহাবিদের যুগেই কোরআনের তফসিরের কাজটি হয়ে যায়। এ কাজ সম্পন্ন করেন সেই সব জ্ঞানী ব্যক্তি যারা স্বয়ং রসুল্লাহর (স) সান্নিধ্যে কোরআনের সবক লাভ করেন। কোরআনের কতকাংশের তফসির স্বয়ং হজরত করে গিয়েছিলেন; হাদিস গ্রন্থসমূহে আজও তা বিদ্যমান রয়েছে।
মসজিদ:
নবি-যুগেই মসজিদ নির্মাণ শুরু হয়। সর্বপ্রথম এক গ্রামে কোবা নামক মসজিদটি নির্মিত হয়। তারপর মদিনায় নির্মিত হয় দ্বিতীয় মসজিদ তারই তত্ত্বাবধানে। প্রথম প্রথম মসজিদ সম্পূর্ণ সাদাসিধা ধরনের তৈরি করা হতো। পরে কারুকার্য-শোভিত মসজিদ নির্মিত হতে থাকে। প্রথম দিকে মসজিদে একটি মিনার থাকত, পরে দুই মিনার নির্মাণ শুরু হয়। প্রথম দিকে কারুকার্যময় এবং নামডাকের মসজিদ তৈরি হতো না। একবার নামডাকের জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল, কিন্তু স্বয়ং হজরতের নির্দেশে তা ভেঙে ফেলা হয়। অথচ, পরে সেই পদ্ধতিতেই বহু মসজিদ নির্মিত হয়েছে। কিন্তু এমন কে আছেন, যিনি ওইসব রঙঢঙের মসজিদসমূহকে ভেঙে দিতে সক্ষম?
প্রথম দিকে মসজিদসমূহ দুনিয়ার কর্মকেন্দ্র হিশাবেও বিবেচিত হতো। কিন্তু পরে তাকে নিছক গির্জায় পরিণত করা হয়েছ। অর্থাৎ মসজিদে এখন কেবল স্রষ্টা এবাদত করা যায়, সৃষ্টির সেবা করা যায় না। কিন্তু এমন কে আছেন যিনি মসজিদকে তার ছিনতাই করা মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম?
নামাজ:
হজরত স্বয়ং নামাজ প্রবর্তন করেন। মসজিদেই এই নামাজ সম্পন্ন করা হতো। দৈনিক পাঁচবার জামাত বা দলবদ্ধ হয়েই তা সম্পন্ন করা হতো। পরে, অর্থাৎ বেশ কিছুদিন পরে, নামাজ আর নামাজ না থেকে ওঠাবসায় পরিণত হলো। এই নামাজের জন্য মসজিদ ও জামাত এই দুইটির প্রয়োজন থাকল না। তারপর এর আর পার্থিব ফলদানের ক্ষমতা রইল না, এই নামাজ বন্ধ্যা হয়ে গেল। ফলে, মসজিদ বিরান হলো, জামাত ভেঙে পড়ল এবং মুসল্লিদের সংখ্যাও হ্রাস পেতে লাগল। ভবিষ্যৎ বংশধরদের কালে সম্ভবত নামাজ বিলুপ্তই হয়ে যাবে। কিন্তু কে এমন আছেন, যিনি নামাজকে পুনরুজ্জীবিত করবেন, মসজিদসমূহকে লোকপ্রিয় করে তুলবেন, জামাতকে শক্তিশালী করবেন এবং নামাজকে খাঁটি করে তোলার পুণ্যার্জনে সক্ষম হবেন?
রোজা:
নবী-যুগেই রোজার প্রচলন হয়। তবে তা ‘রোজা’ হিশাবেই প্রতিপালিত হতো। অবশ্য পরে রোজা আর রোজা রইল না, উপবাসে রূপান্তরিত হলো আর, এই জন্য রোজা আজ মৃতপ্রায়। কিন্তু কোথায় কে আছেন, যিনি রোজাকে রোজার মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন এবং তার মৃতপ্রায় প্রাণে নবজীবনের আবে হায়াত ঢেলে দিবেন?
জাকাত:
জাকাতের প্রথাটিও নবী-যুগ হতেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরে জকাতকে ‘খয়রাত’-এ রূপান্তরিত করা হয় এবং খয়রাতের মতোই তা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু এমন কেউ কি আছেন যিনি জাকাতকে পুনরায় জাকাতের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবেন এবং তাকে পুনরুজ্জীবিত করবেন?
হজ:
হজ কিছুদিন বন্ধ ছিল, পরে তা পুনরায় চালু হয়। তারপর হজ এমনই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। কিন্তু পরে এই হজকেই জিয়ারত প্রথায় পরিণত করা হয়েছে। এটি এখন ইসলামি-প্রাণশূন্য প্রথাসর্বস্ব অনুষ্ঠান মাত্র। ভবিষ্যতে এটি কেমন রূপ ধারণ করবে তা এখনে বলা কঠিন। কিন্তু লক্ষণ মোটেও ভালো মনে হয় না। কিন্তু কে আছেন এমন, যিনি হজকে পুনরায় সত্যিকার হজে পরিণত করবেন এবং এর বিলুপ্তপ্রায় মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবেন?
জেহাদ:
জেহাদও হজরতের যুগে এবং তারই কল্যাণে মহত্তম মর্যাদা পায়—এমন মর্যাদা পায় যার কাছে আর সকল মর্যাদাই ম্লান হয়ে যায়। পরে এই জিহাদের গতি তীব্রতর হতে থাকে। সেই ক্ষিপ্রগতি এমনই ছিল যে অপর প্রতিটি চলমান বস্তুই এর কাছে থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু এই জেহাদই পরে সংঘাতে পরিণত হয়। সেই এর মর্যাদাহানি হয়েছে, আজ অবধি সে হৃতমর্যাদা পুনরুদ্ধার হয়নি। ভবিষ্যতে এর নামটিও অবশিষ্ট থাকবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু কে আছেন এমন যিনি জেহাদকে সংঘাতের আবর্ত হতে উদ্ধার করে একে যথাযথ লক্ষ্যপুষ্ট করে তুলতে সক্ষম হবেন?
চুক্তি:
চুক্তির প্রথাটিও সর্বদাই বিদ্যমান ছিল। কখনও চুক্তি খানিকটা প্রাতিপালিত হয়েছে, কখনও-বা খানিকটা ভঙ্গ করা হয়েছে! তবে হজরত স্বয়ং কখনও সামান্যতম চুক্তিও ভঙ্গ করেন নাই। অপরপক্ষই বরং তা ভঙ্গ করেছে। চুক্তি ভঙ্গকারীদের সধ্যে ইহুদিরা ছিল অগ্রগামী। তারপর চুক্তি ভঙ্গ করে মক্কার প্রতিমাপূজকদল। এর পর যারা চুক্তি ভঙ্গ করে তারা আর কেউ নয়, এরা হলো বর্বরদেরই বন্ধু। এরা চুক্তি ভঙ্গ করেছে ঠিক, কিন্তু তার ফলও ভোগ করেছে যথেষ্ট। এমনকি, সেই চুক্তি ভঙ্গকারীদের কেউ কেউ আজও তা ভোগ করেই চলছে। কিন্তু বর্তমানে তো খোদ মুসলিমরাও চুক্তিভঙ্গে যথেষ্ট অগ্রগামী; ফলে কর্মফল ভোগ করছেও যথেষ্ট। কিন্তু কে এমন আছেন, যিনি তাদেরকে সঠিকভাবে বিষয়টি বুঝাতে সমর্থ?
সন্ধি ও বিজয়:
যুদ্ধ উপর্যুপরিই করতে হয়েছে এবং এই অবস্থা শেষ অবধিই বিদ্যমান ছিল। যুদ্ধ না করেও উপায় ছিল না, কারণ সমগ্র আরব তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। প্রায় সবকয়টি যুদ্ধেই তার বিজয় হয়েছে। কিন্তু সে বিজয়কেই প্রকৃত বিজয় মনে করা উচিত যে-বিজয় যুদ্ধেরই সমাধি রচনা করেছিল এবং যা আরব উপদ্বীপে ইসলামের পতাকাকে চিরদিনের জন্য উঁচু করে তুলে ধরেছিল; সেই বিজয় হচ্ছে মক্কা বিজয়। তেমনই কাফের আরবদের সাথে মুসলিমদের বেশ কয়টি সন্ধিই হয়েছিল, কিন্তু যে-সন্ধিটি ইসলামকে পূর্ণ বিজয়ের শীর্ষে আরোহন করাতে সক্ষম হয়েছিল সেটি হচ্ছে হুদাইবিয়ার সন্ধি।
ব্যাপকভাবে ইসলাম গ্রহণ:
মক্কা বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপকভাবে ইসলাম গ্রহণ শুরু হয়ে যায়। গোত্রের পর গোত্র তথা সমগ্র আরবই এই সময় ইসলাম গ্রহণ করে। আরবরা চিরকাল যুদ্ধপ্রিয় জাতি। প্রমাণ নয়, যুদ্ধে বিজয়ই তাদের ওপর অধিক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। এইজন্য, প্রমাণাদির দ্বারা বেশি দূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয় নাই, কিন্তু যুদ্ধ-বিজয় সামগ্রিক বিজয়ই ডেকে আনে। কী সাধারণ গ্রাম—স্বয়ং মক্কা নগরীরও মস্তক অবনত হয়ে গেছে। সুতরাং এর পর যেরূপ ব্যাপকভাবে ইসলাম গ্রহণের ধুম পড়ে গিয়েছিল এবং তখন যে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল তা সম্ভবত এ বিশ্ব আর কখনও দেখতে পাবে না। তিনি এক পর্বতশীর্ষে বসেছিলেন, সেখানে দলে দলে মানুষ আসছিল আর কলেমা উচ্চারণ করে প্রস্থান করছিল। অনাড়ম্বরতা ও সাধনা-সিদ্ধির এমন চূড়ান্ত ও অপূর্ব রূপ আর কখনও এমন মহিমাময় হয়ে ফোটে ওঠে নাই।
বিশ্বের প্রতি আহ্বান:
আরবের এই হুলস্থুল তখনো থামে নাই, সেই সময়ই ইসলামের আহ্বান সেই সকল দেশে পৌঁছিয়ে দেওয়া হলো যেসব দেশে আরবদেশ থেকে বাণী প্রেরণ তখনকার দিনে সম্ভব ছিল। এই আহ্বান সর্বাবস্থায় যে সাড়া পেয়েছে এমন নয়। তবে ইসলামের এই আহ্বান নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। কোথাও কোথাও-বা কিছুটা সাড়াও পাওয়া গেল। অপরপক্ষে কোথাও-বা শাসক ও সরদারদের কাছে আহ্বান লিপি প্রেরিত হয়, তাতে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, ‘আনুগত্যে নিরাপত্তা, প্রত্যাখ্যানে ধ্বংস অনিবার্য’। এই সাবধানবাণী বাস্তবেও সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ওই আহ্বানে যারা সাড়া দিয়েছিলেন তারা লাভ করেছিলেন নিরাপত্তা ও শান্তি, আর যারা প্রত্যাখ্যান করেছিল তার ধ্বংস হয়ে গেছে।
নির্বাসন:
ইহুদিদের প্রতারণা যখন সকল সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল তখন তাদেরকে আরবদেশ থেকে নির্বাসিত করে অন্য কোনো উপযুক্ত স্থানে তাদের বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়। এই ব্যবস্থাটির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয় হজরত ওমরের (রা) খেলাফতকালে যখন তাদের একটি নতুন ষড়যন্ত্রের বিষয় উদ্ঘাটিত হয় এবং তাতে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে যতই সুযোগ দান ও উদারতা প্রদর্শন করা হোক না কেন, কোনো কিছুই তাদেরকে ঠিক করতে সক্ষম হবে না।
ভরণপোষণের ব্যবস্থা:
হজরত খেলাফতের প্রধান হিশাবে তার পরিবারবর্গের ভরণপোষণের ব্যয় নির্বাহের জন্য যে-ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই ব্যবস্থায় তার শ্রমের এক অংশের মূল্য অপরের সমপরিমাণ শ্রমের মূল্য অনুযায়ীই নির্ধারিত করেন এবং সেই মোতাবেক তিনি নিজের জন্য দুইটি খেজুরের বাগান নির্দিষ্ট করে নিয়েছিলেন। তার এই ব্যবস্থাটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছিল। কিন্তু হলে কী হবে, তারপরেও উপবাসের পর উপবাস এবং কঠোর জীবনের কোনো পরিবর্তনই হয়নি। এর কারণ কী? কারণ এই যে, আয়ের ব্যবস্থা করলেও সঙ্গে সঙ্গেই আরও একটি বিধি বলবৎ ছিল—তা এই যে আল্লাহর নবীর (স) দরোজায় এসে কেউ শূন্যহাতে ফেরত যেতে পারবে না।
জীবিকা উপার্জনে ভ্রাতৃত্ব:
সামাজিক ভ্রাতৃত্ব তো এই বিশ্বে অসংখ্যবার স্থাপিত হয়েছে, কিন্তু জীবিকা উপার্জনে বিশ্বে সর্বপ্রথম ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিস্থাপন করেন হজরত মুহাম্মদ (স)। মক্কার মুহাজেরিন ও মদিনার আনসারদের মধ্যে তিনি ভাই-ভাইয়ের সম্পর্ক স্থাপন করে দেন, বলেন ‘তোমরা তোমাদের অর্ধাংশ মুহাজির ভাইদের প্রদান করবে’। এরপর আনসাররা তাদের যাবতীর সম্পত্তি ও আসবাবপত্রের অর্ধাংশ, এমনকি একাধিক স্ত্রী থাকলে একজনকে তালাক দিয়ে তার মুহাজির ভাইয়ে বিবাহের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এমনই সহজ ও সুস্পষ্টভাবে এই বিধানটি কার্যকরী করা হয়েছিল যে, ‘খিদে লাগলে খেয়ে নাও’ এই ধ্রুব নিয়মও অত সহজে ও অত সুষ্ঠুভাবে কার্যকরী করা হয় কিনা সন্দেহ। এমনকি, ‘অর্ধাংশ’ শব্দটির প্রতি গুরুত্ব দিতে গিয়ে তারা এমনই উৎসাহের পরিচয় দিয়েছিলেন যে, যার একজোড়া মাত্র জোতা ছিল তিনি তাও ভাগ করে তার মুহাজির ভাইকে প্রদান করেছিলেন।
হজরত মুহাম্মদের (স) কর্ম ও কর্মপদ্ধতি
নবুওয়তের তেইশ বছরে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মহান আল্লাহ হজরত মুহাম্মদকে (স) আদেশ-নিষেধ ও কর্মপন্থা বাতলেছেন। কোরআনে সুরা আলে ইমরানের ১৬৪ নং আয়াতে যেমন আছে—‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ মুমিনদের প্রতি বড়ো অনুগ্রহ করেছেন, তিনি তাদের কাছে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রসুল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের সামনে আল্লার আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তাদের পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে আল্লাহর কিতাব ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেন। আর নিশ্চয়ই এর আগে তারা সুস্পষ্ট গোমরাহির মধ্যে ছিল।’
এই আয়াতে আল্লাহ তার নবীর জন্য তিনটি কাজ স্পষ্ট করেন—
এক. উম্মতকে কোরআন শোনানো (তেলাওয়াত)।
দুই. তাদের পরিশুদ্ধ করা (তাজকিয়া)।
তিন. আল্লাহর কিতাব তথা বিধিবিধান ব্যবহারিকভাবে শিক্ষা দেওয়া এবং প্রজ্ঞার বিকাশে সহায়তা করা (হেকমতের তালিম)।
তো এইসব বিষয় আল্লাহর নবীর (স) কোন কোন কর্মের মধ্য দিয়ে কীভাবে বাস্তবায়ন করেছেন তার একটি তালিকা নিম্নে প্রদান করা হলো :
ব্যক্তিগত পর্যায়ে
১। আত্মোপলব্ধি :
(ক) এই উপলব্ধি—আমি আছি।
(খ) এই উপলব্ধি—আমি যা-ই হই না কেন, আমার মর্যাদা ও মূল্য আছে।
(গ) এই উপলব্ধি—আমি যা, আমাকে তার যোগ্য হয়ে থাকতে হবে।
(ঘ) এই উপলব্ধি—আমিই আমার জিম্মাদার।
(ঙ) এই উপলব্ধি—আমি যদি নিজেকে প্রতিপালন না করি তাহলে টিকতে পারব না।
(চ) এই উপলব্ধি—নিজের প্রতিপালন আরম্ভ করতে হবে।
২। আপন লালন-পালন :
(ক) লালন-পালনের জন্য অপরের নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি।
(খ) নিজেকে পালনের পদ্ধতি নির্বাচন।
(গ) আত্মপালন-পদ্ধতির উন্নয়ন।
(ঘ) আপন লালন-পালনের আদর্শ নির্ধারণ ও সেই অনুযায়ী জীবিকা অর্জনের পন্থা নিরূপণ।
৩। নিজের তরবিয়ত বা নিজকে গড়ে তোলা :
(ক) নিজকে গড়ে তোলার আদর্শ ও পদ্ধতি নির্ধারণ।
(খ) নিজকে গড়ে তোলার ব্যবস্থাকরণ ও তা সমাপ্তিকরণ।
৪। নিজ শিক্ষা :
(ক) শিক্ষার আদর্শ ও পদ্ধতি নির্ধারণ।
(খ) নিজের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থাকরণ এবং তা সমাপ্তিকরণ।
৫। আত্মস্বাচ্ছন্দ্য :
(ক) স্বাচ্ছন্দ্য লাভের উদ্দীপনা।
(খ) স্বাচ্ছন্দ্য লাভের চেষ্টা করা।
(গ) স্বাচ্ছন্দ্য হাসিল করার নিয়ম।
৬। আপন যৌনপ্রয়োজন :
(ক) যৌনসম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত।
(খ) যৌনসম্পর্কের আদর্শ ও পদ্ধতি নির্ণয় ও তা কার্যকরীকরণের সিদ্ধান্ত।
(গ) স্ত্রীদের মান নির্ধারণ এবং সেরকম স্ত্রী পাওয়ার জন্য প্রতীক্ষা।
(ঘ) উদ্দিষ্টমানের স্ত্রী লাভের উপায়।
৭। আপন পরিবার প্রতিপালন :
(ক) পারিবারিক জীবন প্রয়োজন—এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
(খ) পারিবারিক জীবনের বিধিবিধান।
(গ) পারিবারিক জীবনের আপদবিপদের মোকাবিলা।
(ঘ) পারিবারিক জীবনের আদর্শ প্রতিষ্ঠায় সাফল্য।
৮। আত্মপরিচিতি :
(ক) এই পরিচয় লাভ যে, আমি আমিই—আমি ভিন্ন অন্য কেউ নয়।
(খ) আমি সুউচ্চ ও গভীরতাময় মর্যাদার অধিকারী মানুষ।
(গ) আমি মানুষের জন্য জন্মলাভ করেছি, নিজের জন্য নয়।
(ঘ) আমি যা আমাকে তা-ই হতে হবে।
(ঙ) আমার যা হওয়া উচিত আমি তা না হলে আমি ধ্বংস হয়ে যাব।
(চ) আমার যা হওয়া উচিত আমি তা হতে পারব।
(ছ) আমার চেষ্টার সাথে অদৃশ্য সাহায্যলাভও হবে।
(জ) আমি যেই হই না কেন, আমার জীবন সাধারণের জীবনের মতো নয়।
৯। আত্মোন্নতি :
(ক) জ্ঞানের ব্যাপারে আত্মতুষ্টি বর্জন।
(খ) উন্নতির স্পৃহাকে সব সময় জাগ্রত রাখা।
(গ) উন্নতির আদর্শ ও পন্থা নির্ধারণ।
(ঘ) উন্নতির কর্মসূচি প্রণয়ন।
(ঙ) উন্নতির পথের বাধার মোকাবেলা করা।
(চ) উন্নতির চেষ্টায় সাফল্যলাভ।
১০। আপন পূর্ণতা বিধান :
(ক) পূর্ণতার আদর্শ ও পদ্ধতি নির্ধারণ।
(খ) পূর্ণতা আনয়নের জন্য চেষ্টা ও সাধনা।
(গ) পূর্ণতা বিধানে সাফল্যলাভ।
১১। স্বীয় খেলাফত প্রতিষ্ঠা :
(ক) খেলাফতের আদর্শ ও বিধিবিধান।
(খ) খেলাফতের জন্য চেষ্টা ও সাধনা।
(গ) খেলাফত লাভ।
১২। অহমবোধ বা আমিত্ব উপলদ্ধি :
(ক) অহমবোধ বা আমিত্বের আদর্শ ও তার ব্যবহারবিধি নির্ধারণ।
(খ) আমিত্ব অর্জনের চেষ্টা ও সাধনা।
(গ) আমিত্বে স্থিতিলাভ।
১৩। আপন রব্বানিয়াত :
(ক) রব্বানিয়াতের আদর্শ ও তার প্রয়োগবিধি নির্ধারণ।
(খ) রব্বানিয়াত বরণ।
(গ) রব্বানিয়াতে স্থিতিলাভ।
বিশ্বপর্যায়ে
১৪। বিশ্ব পরিচয় লাভ :
(ক) বিশ্ব সম্পর্কে এই জ্ঞানলাভ—বিশ্ব স্বয়ং অস্তিত্বশীল নয়।
(খ) বিশ্ব সম্পর্কে এই জ্ঞান লাভ—সৃষ্টিজগৎ বিক্ষিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও একত্রীভূত এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ হওয়া সত্ত্বে তা এক।
(গ) বিশ্ব সম্পর্কে এই জ্ঞান লাভ—মানুষ বিশ্বেরই অংশবিশেষ, তবে সে ‘আশরাফুল আলম’ (বিশ্বজগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম); এবং বিশ্বের লালনপালনে মানুষও অংশ গ্রহণ করতে সমর্থ।
১৫। বিশ্বের লালনপালন :
(ক) বিশ্ব-প্রতিপালনের জন্য একটি বিশেষ প্রতিপালন-ব্যবস্থা অপরিহার্য, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
(খ) সেই পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রয়াস।
১৬। বিশ্ব পালনে প্রতিনিধিত্ব :
(ক) বিশ্বের লালনপালনের বিধিবিধান প্রণয়ন।
(খ) বিশ্ব লালনপালনে মানুষের অংশ নির্ধারণ।
(গ) বিশ্ব প্রতিপালনে নিজ অংশ নির্ধারণ।
(ঘ) নিজের অংশের দায়িত্ব অনুযায়ী বিশ্ব প্রতিপালনের জন্য চেষ্ঠা ও সাধনা।
(ঙ) বিশ্ব-প্রতিপালনে সাফল্য লাভ।
১৭। বিশ্বের শিক্ষা :
(ক) বিশ্ব শিক্ষা এবং তার লক্ষ্য ও আদর্শ নির্ধারণ।
(খ) বিশ্বকে শিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারে মানুষের ভূমিকা।
(গ) বিশ্বকে শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজ ভূমিকা।
(ঘ) বিশ্বে শিক্ষার যথাসাধ্য ভূমিকা গ্রহণ।
(ঙ) বিশ্বের শিক্ষায় সাফল্য।
১৮। বিশ্বের স্বাচ্ছন্দ্য বিধান :
(ক) এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ যে, বিশ্বে সমৃদ্ধি বা স্বাচ্ছন্দ্যের সীমা থাকা উচিত।
(খ) বিশ্বকে সেই সীমা পর্যন্ত উপনীত করার চেষ্টা।
১৯। বিশ্বের তরবিয়ত বা বিশ্বকে গড়ে তোলা :
(ক) এই সিদ্ধান্ত যে, বিশ্বকে গড়ে তুলতে হবে।
(খ) বিশ্বকে গড়ে তোলার আদর্শ ও কর্মপন্থা গ্রহণ।
(গ) সেটা বাস্তবায়নের জন্য কর্মক্ষেত্রে অবতরণ।
২০। বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা :
(ক) এই সিদ্ধান্ত যে, বিশ্ব সামঞ্জস্যকামী।
(খ) বিশ্বকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার চেষ্টা।
২১। বিশ্বকে সংস্কৃতিবান করা :
(ক) এই সিদ্ধান্ত যে, বিশ্ব সুসভ্য হওয়া উচিত।
(খ) বিশ্বকে সুসভ্য হওয়ার ব্যাপারে সাহায্যের চেষ্টা।
২২। বিশ্বের প্রগতি বিধান :
(ক) এই সিদ্ধান্ত—বিশ্ব প্রগতিকামী।
(খ) বিশ্বের প্রগতির ব্যাপারে যথাসম্ভব সাহায্যের চেষ্টা।
২৩। বিশ্বের পূর্ণতা সাধন :
(ক) এই সিদ্ধান্ত যে, বিশ্বের পূর্ণতা বিধানের আবশ্যকতা রয়েছে।
(খ) বিশ্বকে পূর্ণতাবিধানের ব্যাপারে সাহায্য দানের চেষ্টা।
২৪। বিশ্বের অহম বা আমিত্ব বোধ সৃষ্টি :
(ক) এই সিদ্ধান্ত যে, সকল অহমবোধ বা আমিত্বকে আল্লার অভিমুখী করে তোলা দরকার।
খ) বিশ্বে অহমবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা।
২৫। বিশ্বে আনুগত্য সৃষ্টি :
(ক) এই সিদ্ধান্ত যে, অহমবোধের মতোই আনুগত্যেরও প্রয়োজন রয়েছে।
(খ) আনুগত্য সৃষ্টি।
২৬। বিশ্বের কল্যাণ-বর্ধন :
(ক) এই সিদ্ধান্ত—বিশ্ব কল্যাণময় হতে পারে, অকল্যাণময়ও হতে পারে।
(খ) বিশ্বকে কল্যাণময় করার চেষ্টা।
সারসত্তা পর্যায়ে
২৭। আল্লাহর উপলব্ধি :
(ক) এই উপলব্ধি—আল্লাহই বাস্তব; যা দৃশ্যমান তা-ই সব নয়।
(খ) এই উপলব্ধি—আল্লাহই সবকিছুর মূল এবং আল্লাহর সাথে স্থায়ী সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব।
২৮। আল্লাহর সন্ধান :
(ক) এই সিদ্ধান্ত—আল্লাহকে পাওয়া সম্ভব।
(খ) এই সিদ্ধান্ত—আল্লাহর অনুসন্ধান করা উচিত।
(গ) এই সিদ্ধান্ত—আল্লাহর অনুসন্ধান ছাড়া পূর্ণতাপ্রাপ্তি হতে পারে না।
(ঘ) আল্লাহর অনুসন্ধানের বিধি নির্ধারণ।
(চ) আল্লাহর অনুসন্ধানে আত্মমগ্নতা।
২৯। আল্লাহর পরিচয় লাভ :
(ক) আল্লাহর পরিচয় লাভ।
(খ) আল্লাহর ব্যাখ্যা হাজির করা।
৩০। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন :
(ক) আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন।
(খ) আল্লাহতে নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া।
৩১। আল্লাহর পক্ষ থেকে ফললাভ :
(ক) আল্লাহ থেকে যা কিছু গ্রহণীয় তা গ্রহণ।
(খ) আল্লাহ থেকে গ্রহণের পদ্ধতি নির্ণয়।
৩২। আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব লাভ :
(ক) আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কে জ্ঞানলাভ।
(খ) আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব লাভ।
৩৩। আল্লাহর খেদমত :
(ক) এই জ্ঞান লাভ—আল্লাহর খেদমত করাও সম্ভবপর।
(খ) এই সিদ্ধান্ত—আল্লাহর খেদমতও করতে হবে।
(গ) আল্লাহর খেদমতের পন্থা নিরূপণ।
(ঘ) আল্লাহর খেদমত আরম্ভ।
৩৪। আল্লাহর দিকে আহ্বান :
(ক) এই জ্ঞান লাভ—আল্লাতে বিলীন হয়ে যাওয়াও একটি চূড়ান্ত মর্যাদা।
(খ) এই সিদ্ধান্ত—আল্লাহতে বিলীন হয়ে যাব।
(গ) আল্লাহতে বিলীন হয়ে যাওয়া।
(চলবে)
বিপ্লবী নবী: আল্লামা আবদুল কাদির আজাদ সুবহানি (১৮৯৬-১৯৬৩) ।। তর্জমা : মওলানা মুজিবুর রহমান।। সম্পাদনা : মওলবি আশরাফ