বিপ্লবী নবী 


মওলানা আবদুল কাদির আজাদ সুবহানি (১৮৯৬-১৯৬৩) ছিলেন বিখ্যাত রব্বানি দর্শনের প্রবক্তা। তিনি আল্লামা আজাদ সুবহানি নামে অধিক পরিচিত। ইসলামের নবি রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসালামকে রুহানি বয়ানের আলোকে পেশ করা এবং  'বিপ্লবী নবি হিশাবে হাজির করার প্রচেষ্টা সাহসী ও নতুন। ধর্ম নির্বিশেষে  মোহাম্মদ (সা) দলিত,  গরিব, হতদরিদ্র, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত জনগণের সিপাহসালার হিশাবে  হাজির করার মধ্য দিয়ে আজাদ সুবহানি  বিখ্যাত হয়েছেন। বলাবাহুল্য ইসলামকে ক্রমাগত পরকালবাদী জগৎবিমুখ ধর্ম হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করার  ধারা শক্তিশালী। বিপরীতে বিপ্লবী রাজনৈতিক চিন্তার জায়গা থেকে রাসুলকে বোঝার প্রচেষ্টা ইসলামকে ইহলৌকিকতার নিরিখে পেশ করা। ইসলামকে চরম পশ্চাতপদতার হাত থেকে রক্ষার জন্য জগত্মুখি করে তোলা।  আজাদ সুবহানি এই দিক থেকেই থেকেই ব্যতিক্রম। তাঁর চিন্তাী কারনে বিশেষ ভাবে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বিপুল ভাবে প্রভাবান্বিত করেছিল।  ভাসানীর 'হুকুমতে রাব্বানিয়া' খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রচেষ্টা।

বাংলায় বইটি অনুবাদ করেছিলেন মওলানা মুজিবুর রহমান। দীর্ঘকাল বইটি পাওয়া যাচ্ছিল না। সম্প্রতি  মওলবি আশরাফ বইটিকে আরও পাঠযোগ্য করে তোলার জন্য ভাষাগত দিকসহ সম্পাদনা করেছেন। এখানে মওলানা মুজিবুর রহমান অনুদিত এবং মৌলবি আশরাফ সম্পাদিত 'বিপ্লবী নবী'  আবার পাঠকদের হাতে  কয়েকটি পর্বে আমরা তুলে দিচ্ছি।

রব্বানি দর্শনের ভাবধারা এক সময় ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। বাঙালি মুসলিম রাজনীতিবিদদের মধ্যে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবুল হাশিম, শামসুল হক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের কর্মীরা আজাদ সুবহানির চিন্তাভাবনা দ্বারা উজ্জীবিত ছিলেন। 

আজাদ সুবহানির জন্ম ভারতের মধ্যপ্রদেশে। পড়াশোনা করেন জৌনপুর মাদরাসায়। ১৯১৩ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদান করে কারাবরণ, পরবর্তীকালে সারাজীবন রাজনীতি ও ইসলামের ইনকিলাবি দর্শনের প্রচার-প্রসারের খেদমত আঞ্জাম দেন। তিনি খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার বাইরে শরিয়া আদালত স্থাপনকল্পে মওলানা আবুল কালাম আজাদকে সহযোগিতা করেন। খেলাফত আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়লে আজাদ সুবহানি কানপুরে মজদুর আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। তাদের সাথে অল্প কিছুদিন থাকলেও এ সময় তার ভিতর কিছুটা সমাজতন্ত্রী ভাবধারার উন্মেষ ঘটে, যা পরবর্তী সময়ে রব্বানি দর্শনে রূপ পায়। তিনি রব্বানি ভাবধারায় লেখালেখি করা ছাড়াও ‘জমাআতে রব্বানি’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। এর সদর দপ্তর ছিল বিহারের গোরখপুরে। আজাদ সুবহানি তার জীবদ্দশায় রব্বানি ভাবধারাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ‘জামিয়া রব্বানিয়া’ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যার প্রথম রেক্টর ছিলেন তিনি নিজেই। তিনি তার আজীবনের অর্জিত ধনসম্পত্তি এই প্রতিষ্ঠানটির পেছনে ব্যয় করেন। ১৯৬৩ সালে বিহারের গোরখপুরে তিনি সংগ্রামী জীবনের ইতি টেনে মওলার সান্নিধ্যে সফর করেন।

ভূমিকা

বহুবার ইচ্ছে হয়েছে ‘বিপ্লবী নবী’ লিখে মহাসৌভাগ্যের অধিকারী হই এবং একটি গুরুদায়িত্ব পালন করি। কয়েকবার চেষ্টাও করেছি কিন্তু সফল হইনি। প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছি। এ কি আল্লাহরই ইচ্ছা ছিল না? হয়তো-বা তা-ই। কিন্তু পরে আবার কেন তিনি ইচ্ছা করলেন? আমার মতে এর উত্তর হলো—এই পবিত্র কাজের জন্য যে যোগ্যতার প্রয়োজন, ইতোপূর্বে তা আমার মধ্যে ছিল না। এখন আমি মোটামুটিভাবে এই যোগ্যতার অধিকারী হয়েছি বলে দাবি করতে পারি। প্রশ্ন উঠবে—সেই যোগ্যতা কি? একে বলা যায় নিসবতে মুহাম্মদি বা হজরত মুহাম্মদের (স) সাথে সম্পর্ক—কিন্তু সেই সম্পর্ক নয় যা প্রত্যেক মুহাম্মদ-অনুরাগীরই হয়ে থাকেন, ওই বিষয়টি তো বুঝমান হবার পর থেকেই আমার মধ্যে ছিল এবং এখনও আছে। বরং মুহাম্মদের (স) সাথে সম্পর্ক বলতে এমন সম্পর্ক বুঝানো হয়েছে যা কেবল হজরত মুহাম্মদকে (স) দিব্যদৃষ্টিতে দেখার ক্ষমতা অর্জনকারীদেরই আছে। এই বইটি রচনার কিছুদিন আগে সন্দেহাতীতভাবে, স্পষ্ট দিবালোকের মতো আমার কাছে প্রতিভাত হয় যে আমার সামনে হজরত মুহাম্মদের (স) রুহ মোবারক সর্বদা বিরাজ করছে এবং আমার সমগ্র অস্তিত্ব তা দ্বারা পরিবেষ্টিত। ফলে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সন্দেহ ও নিস্পৃহতার অবসান ঘটিয়ে এ অনুভূতি আমাকে এক প্রবল স্পৃহা দান করে। এখন আমার অবস্থা এই যে, আমি দিনরাত তার সৌন্দর্য উপভোগ করছি। সত্য বলতে কি, এই অনুভূতিই এই বই রচনার সম্পূর্ণতা সাধনে আমাকে নতুন করে স্পৃহ করেছে এবং এটি আল্লাহর ইচ্ছাকেও এই কাজের প্রতি অনুকূল করেছে। ফলে যে কাজ বারবার অসম্পূর্ণ থেকে গেছে তা এইবার মোটামুটিভাবে সম্পন্ন হলো।

‘বিপ্লবী নবী’ সিরাতবিষয়ক বইগুলির মধ্যে সামগ্রিকভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে দাবি না করা গেলেও অপরাপর গ্রন্থের তুলনায় এর বৈশিষ্ট্য অবশ্যই ব্যতিক্রম। কী সেই বৈশিষ্ট্য? বিভিন্ন সিরাতগ্রন্থে্র বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য—যা হজরত মুহাম্মদের (স) জীবনচরিতকে জীবন্ত ও গতিশীল করে তুলতে সক্ষম এবং ভাবাবেগমুক্ত, নিরপেক্ষ, তুলনাহীন ও জীবনের সামগ্রিকদিক তুলে ধরতে সমর্থ—বিপ্লবী নবীতে তার সব কয়টাই আছে। এসব ছাড়াও, হজরত মুহাম্মদের (স) জীবনীর যেসব গুরুত্বপূর্ণ রুকন আজ পর্যন্ত অস্পষ্ট ও অপ্রমাণিত রয়েছে—‘বিপ্লবী নবী’ সেইসব গুরুত্বপূর্ণ দিকও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছে।

দুটো কারণে ‘বিপ্লবী নবী’ আলাদা। প্রথমত, এই গ্রন্থে রব্বানি দর্শন—যা স্বভাবতই মহান ও স্বয়ংসম্পূর্ণ তাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়সমূহ—যা একমাত্র আধ্যাত্মিক উপলব্ধি ও কাশফের (স্বজ্ঞার) মাধ্যমে ব্যক্ত করা সম্ভব—তা ব্যক্ত করতে গিয়ে হজরত মুহাম্মদের (স) রুহের মাধ্যমে আমার যে রুহানি উপলব্ধি ও কাশফ হয়েছে, আমি হুবহু তা প্রয়োগ করেছি। এ ছাড়া আমি ‘বিপ্লবী নবীকে’ বিভিন্ন গ্রন্থের উদ্ধৃতি ও বরাত থেকে মুক্ত রেখেছি। উদ্ধৃতি ও বরাত গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধির সহায়ক হলেও এটি পাঠকের আকর্ষণ ও একাগ্রচিত্ততার পক্ষে বিঘ্নও বটে। এছাড়া, এটি পাঠককে আসল বিষয়বস্তু থেকে দূরে সরিয়ে পুস্তকের তালিকার প্রতি ঠেলে দেয়। পাঠক লেখকের প্রতি আস্থাশীল না হলে উদ্ধৃতি ও বরাত অবশ্যই ফলপ্রসূ হয়; কিন্তু (আমার কথা হলো) যে লেখকের প্রতি পাঠকের আস্থা নেই সে লেখকের বই পাঠক পড়তে যাবেই-বা কেন?

‘বিপ্লবী নবী’ বিন্যাসেরও বিশেষ ধরন রয়েছে এবং এর বিভিন্ন অধ্যায় ও শিরোনাম যেভাবে বিন্যস্ত করা করা হয়েছে তার বৈশিষ্ট্য পাঠক প্রথম পাঠেই উপলব্ধি করতে পারবেন।

‘বিপ্লবী নবী’ অলীক ও ভিত্তিহীন গল্পগুজবের বই নয় যে বিরাট কলেবরে কয়েক খণ্ডে রচিত হবে। তবু বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে সিরাতবিষয়ক বৃহদাকার গ্রন্থাদি থেকে এর মর্যাদা কম নয়। এর কারণ হচ্ছে ‘বিপ্লবী নবীর’ বিশিষ্ট প্রকাশভঙ্গি, যা কোনো সিরাতগ্রন্থেই পাওয়া যাবে না। এর অর্থ এই নয় কোনো সিরাত-লেখকেরই এই প্রকাশভঙ্গির ক্ষমতা ছিল না। হয়তো তারা রচনার এই ধরনকে পছন্দ করেন নাই আর এজন্যই তারা এই ধরনকে গ্রহণ করেন নাই। যাই হোক, ‘বিপ্লবী নবীর’ ক্ষুদ্র কলেবর দেখে কারও এ কথা মনে করা উচিত নয় যে প্রয়োজনে বিষয়বস্তুর পরিমাণের দিক থেকে এটি অসম্পূর্ণ, যেভাবে এটি উদ্ধৃতি বা বরাতের দিক দিয়ে অসম্পূর্ণ। বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে এটি সর্বোৎকৃষ্ট হলেও উপকারিতা অপেক্ষাকৃত কম—এমন ধারণা করাও উচিত নয়।

‘বিপ্লবী নবীর’ উল্লেখযোগ্য সাফল্য এই যে, এটি হজরত মুহাম্মদের (স) সিরাতকে স্থায়ীভাবে জ্ঞান ও ব্যবহারিক দর্শনে রূপ দিয়েছে। এছাড়া একে এমন একটি আন্দোলনেরও রূপ দিয়েছে—যা আজও সমাপ্ত হয়নি, যা কেবল অতীতের কাহিনি নয় বরং বর্তমানের কর্মসূচি ও ভবিষ্যতের ইশতেহার। এটি একটি ধারাবাহিক আন্দোলন—যার কোনো শেষ নাই, এমনকি আজ অবধি তাতে ঢিলও পড়েনি। বরং প্রথম যুগে যেমন সতেজ ও সক্রিয় ছিল, দিন দিন তার চেয়ে সতেজ, তাগড়া ও সক্রিয় হচ্ছে—এবং এর ভবিষ্যৎ থেকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর, তা বর্তমানের আয়নাতেও দেখা সম্ভব। এই আন্দোলনকে ‘রব্বানি আন্দোলন’ কিংবা বিশ্বজনীন, স্থায়ী, সামগ্রিক আন্দোলন বললে অত্যুক্তি হবে না। এবং এই নামেই পুস্তকটির নামকরণ হয়েছে। তারপর ‘বিপ্লবী নবীতে’ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত অথচ সামগ্রিক পদ্ধতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই আন্দোলনের স্বরূপ উদ্ঘাটিত করা হয়েছে। বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন পাঠকবৃন্দ অতি সহজেই এর থেকে একটি যুগোপযোগী আন্দোলনের কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করতে পারবেন। এটাই ‘বিপ্লবী নবীর’ উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য—যা সিরাতবিষয়ক অন্যান্য গ্রন্থে খুঁজে পাবেন না।

এমন ভাবা একদমই উচিত হবে না যে ‘বিপ্লবী নবীর’ যেসব গুণের কথা বলা হলো তার উদ্দেশ্য সিরাতবিষয়ক অন্যান্য গ্রন্থকে খাটো করা। ব্যাপারটা মোটেও এমন নয়; বরং যা বাস্তব তার বর্ণনা এবং অন্যের উপকার বাসনাই হচ্ছে এর উদ্দেশ্য—যা গ্রন্থের গুণাগুণ বিশ্লেষণ এবং খোদ-গ্রন্থকার কর্তৃক বিশ্লেষণ ছাড়া হাসিল হওয়া সম্ভব নয়। যদি অন্য কেউ এই দায়িত্ব পালন করত তবে কতই না ভালো হতো! কিন্তু সে আশা কোথায়? যে-দেশে যে-সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘বিপ্লবীর নবী’ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে সেখানে তো দলাদলি, সাম্প্রদায়িকতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, ব্যক্তিপূজা, পক্ষপাতিত্ব, ষড়যন্ত্র আধিপত্য করছে। সেখানে এসবের অবাধ রাজত্ব চলছে সেখানে বিদ্যার কদর ও সত্যের খেদমত কি করে আশা করা যায়? প্রাচ্য তো প্রাচ্যই—পাশ্চাত্য নয়! পাশ্চাত্যে জ্ঞানের ক্ষেত্রে অতি তুচ্ছ উদ্ভাবন-আবিষ্ক্রিয়া বা নতুন কথাকেও অনেক বড় করে দেখানো হয়; আর এখানে জ্ঞানের নতুন ভান্ডারকে দাবিয়ে রাখা হয় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এমতাবস্থায়, আমি জানি না, এই গুণ-বিশ্লেষণের এবং এই বইয়ের পরিণতি কী হবে? আমি আমার কাজ আল্লাহর নিকট সমর্পণ করছি। চূড়ান্ত মীমাংসা তারই কাছে। গ্রন্থকার তার নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন, এখন যার নামে দায়িত্ব পালন করা হয়েছে তিনিই জানেন এর পরিণতি কী হবে।

‘বিপ্লবী নবী’ বড়ো তাড়াহুড়ার মধ্যে রচিত হয়েছে; এটি সুপরিকল্পিত নয় এবং এর পুনরীক্ষণও সম্ভব হয়নি; এর কারণ এই নয় যে লেখক কামালিয়াত দাবি করেন কিংবা বইটির পুনরীক্ষণ নিষ্প্রয়োজন মনে করেন। বরং সময়ের অভাবই আসল কারণ। তা ছাড়া, এই নিশ্চয়তাই-বা কোথায় যে, ব্যস্ততার মধ্যে রচিত গ্রন্থের চেয়ে ধীর-মস্তিষ্কের রচনা বেহতর হবে?

যাকগে, ব্যাপারটা এমনই। এখন আর ওজর-আপত্তি করে কী ফায়দা? বইটি ত্রুটি-মুক্ত এ কথা দাবি করা চলে না; ভ্রান্তির অবকাশ রয়েছে এবং ভুল-প্রমাদ নজরে পড়লে অবশ্যই তা বাদ দেওয়া হবে। কিন্তু এমন যেন না হয়—একটি ভুলের জন্য গোটা বইটি নজির আহমদ রচিত ‘উম্মাহাতুল মুমিনিন’ কিংবা ইবন রুশদের ফালসাফার কিতাবের মতো জ্বালিয়ে দেওয়া বা বাজেয়াপ্ত করা হবে। এমন কাজ তো ছারপোকা নিবারণের জন্য কম্বল জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো। আপনি আল্লাহকে ভয় করুন বা না করুন, হজরত মুহাম্মদকে (স) অবশ্যই সমীহ করবেন।

পাঠকদের প্রতি অনুরোধ, তারা যেন নিরপেক্ষ দৃষ্টি, চিন্তা ও গবেষণা সহযোগে ‘বিপ্লবী নবী’ পাঠ করেন। সামর্থ্য থাকলে হজরত মুহাম্মদের (স) সাথে আত্মিক যোগসূত্র স্থাপন করে তবে যেন তারা এ গ্রন্থ অধ্যায়ন করেন; আর তা না থাকলে যেভাবে ইচ্ছা পাঠ করেন, তবে গ্রন্থটি আগাগোড়া যেন পাঠ করেন—এই আরজ রইল। হয়তো গভীর অধ্যয়নের ফলে পাঠক মুহাম্মদের (স) রুহের কৃপা দৃষ্টিতে অমূল্য রত্নে পরিণত হবেন—

❝যাদের নজরে মাটি হয়ে যায় সোনা;
আহা, তাদের কেউ যদি আমাদের প্রতি
একটিবারের জন্য তাকাতেন!❞

অবশেষে হজরত মুহাম্মদের (স) খেদমতে দাবি ও আল্লাহর দরবারে নিবেদন : আমার এই খেদমতে যদি অণুপরিমাণ এখলাসও থাকে, এতে যদি মানুষের বিন্দুপরিমাণ উপকারও পৌঁছায়, তবে একে কবুল করে নিয়ো—যদিও তাতে হাজারটা দোষ থাকে। আর যদি তা নাও হয়, তবে, এই না-চিজ লেখককে নবীজীবনী রচয়িতাদের দরবারে শামিল হওয়ার প্রতিদান অবশ্যই দিয়ো। তোমার খাস বান্দাদের কাতারে শামিল নাই-বা করলে, অনুগ্রহপ্রাপ্ত গুনাহগারদের মধ্যে আমাকে স্থান দিয়ো। আর পাপীরাই তো কৃপা ও অনুগ্রহের হকদার!

❝আমি গুনাহগার বটে তবে বিশ্বস্ত,
তোমার দিলের দরজা হতে আমাকে বিমুখ করিয়ো না,
আমি ভিখারী।❞

 

ফকির গুনাহগার অপরাধী
সুবহানি রব্বানি
ওরফে আজাদ সুবহানি

প্রথম অধ্যায়

হজরত মুহাম্মদ (স) কে ছিলেন? তাকে নিয়ে দুনিয়া জুড়ে এমন আলোড়ন সৃষ্টিরই-বা কারণ কী? চিন্তাশীল যেকোনো মানুষের মনেই প্রথমে এই দুইটি প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক—বিশেষত যখন তিনি দেখতে পান সবখানেই হজরত মুহাম্মদের (স) নাম ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হচ্ছে।

তো আমার মনে হয় প্রথম প্রশ্নের জওয়াবটিই প্রথমে জানা দরকার। কারণ এই জওয়াবটিকে সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে তবেই দ্বিতীয় প্রশ্নের জওয়াব উপলব্ধির জন্য প্রস্তুত হওয়া সম্ভব হবে।

সাকিন

হজরত মুহাম্মদ (স) ছিলেন একাধারে আরাবি, মক্কি ও মাদানি। তার জন্মস্থান ছিল আরব উপদ্বীপে, তাই তিনি আরাবি। মক্কা ও মদিনায় তিনি জীবন অতিবাহিত করেন। প্রথমে তিনি মক্কারই বাসিন্দা ছিলেন, পরে মদিনায় হিজরত করে বসতি স্থাপন করেন।

বংশসূত্রের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন একাধারে কুরায়শি হাশেমি ও মুত্তালিবি—কেননা তিনি কুরায়শ বংশের বনি হাশিম গোত্রে মুত্তালিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বংশপরম্পরায় নিকটতম সূত্র ছাড়া দূরসম্পর্কের আরও একটি সূত্র আছে। সেই সূত্র অনুসারে তিনি আদনানি, ইসমাইলি ও ইবরাহিমি। তার বংশপরম্পরায় ঊর্ধ্বতন পুরুষ হজরত ইবরাহিম (আ), তার পুত্র হজরত ইসমাইল (আ) এবং তারই বংশের এক বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন আদনান। এই আদনানের বংশধরগণ পরবর্তীকালে বিভিন্ন গোত্র ও শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। কুরায়শ তারই একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এই শাখারই বনি হাশিম গোত্রের মুত্তালিব পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এখান থেকে স্পষ্ট হলো তিনি হজরত ইবরাহিমের (আ) অধস্তন পুরুষ।

মধুময় নাম

তার নাম দুটো—মুহাম্মদ ও আহমদ। ইসলাম ধর্ম ও কোরআনের মনোনীত নাম মুহাম্মদ; এইজন্য এই নামটিই সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করেছে। ইসলামপূর্ব যুগে ও আহলে কিতাবিদের গ্রন্থে তাকে ‘আহমদ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। মুহাম্মদি যুগের ইতিহাসে বর্তমান যেন অতীত হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে সেজন্যে উম্মতে মুহাম্মদি দুই নামই একসাথে গ্রহণ করে। তাই, যখন কোনো মুসলমান তার নাম উচ্চারণ করেন, তিনি বলেন,—‘আহমদ মুজতবা মুহাম্মদ মুস্তফা’।

‘মুজতবা’ এবং ‘মুস্তফা’—এই দুইটি শব্দ নামের অংশ নয়, সম্মানসূচক পদবি। উভয় শব্দের অর্থ একই—মনোনীত। মূল নামের সাথে এই শব্দ জুড়ে দেওয়া এ কথাই ঘোষণা করে যে তিনি আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি; তাকে সেই দৃষ্টিতেই দেখতে হবে এবং তার সঙ্গে সেরকম সম্পর্কই রক্ষা করে চলতে হবে।

‘সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বাক্যটিও তার নাম থেকে আলাদা। এটি প্রার্থনামূলক বাক্য। এর অর্থ—‘মুহাম্মদের (স) ওপর আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ বর্ষিত হোক।’ ‘মুজতবা’ ও ‘মুস্তফা’ এই দুই সম্মানসূচক পদবি অপেক্ষা ‘সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বাক্যটিকেই তার নামের সাথে উচ্চারণ করা ওয়াজিব বা অধিকতর জরুরি গণ্য করা হয়। এমনকি এই বাক্যটি শেষে যুক্ত না করে আল্লাহর রসুলের নাম উচ্চারণকে বেয়াদবি এবং খানিকটা গুনাহর কাজ গণ্য করা হয়। এইজন্য তার নাম উল্লেখের সঙ্গে এই বাক্যটির উল্লেখও অপরিহার্য কর্তব্য হিশাবে পরিগণিত হয়ে আসছে সব সময়। নুন্যতম ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন কোনো মুসলমানের মুখ হতে তাই কখনও ‘সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ ছাড়া আল্লাহর রসুলের নাম উচ্চারিত হতে দেখা যায় না।

‘মুজতবা’ ও ‘মুস্তফা’ ছাড়াও তার আরও অনেক সম্মানসূচক পদবি আছে এবং এর সংখ্যা এত বেশি যে, সবগুলোকে একত্র করতে গিয়ে আলাদা গ্রন্থ প্রণয়ন করতে হয়েছে। এই সব সম্মানসূচক নাম ও পদবি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান হাসিলের জন্য গ্রন্থগুলো পাঠ জরুরি। উল্লিখিত বিষয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থের মধ্যে দুইটির নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য—দরুদে তাজ ও হিজবুল বাহার। অবশ্য এত অধিক সংখ্যক সম্মানসূচক নামের মধ্যে পাঁচটিই প্রধান। হজরত মুহাম্মদকে (স) জানতে হলে পাঁচটি সম্মানসূচক নামের সাথে পরিচিত হওয়া অবশ্য কর্তব্য এবং তার সামান্যতমও বরকত হাসিলের জন্য সেই পরিচয়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াও কর্তব্য।

এই প্রধান পাঁচটি সম্মানসূচক নাম হলো:

  • শাফিউল মুজনাবিন বা পাপীদের জান্নাত প্রবেশে সুপারিশকারী।
  • রহমাতুল্লিল আলামিন বা সমগ্র জগতের রহমত।
  • সাইয়িদুল মুরসালিন বা সকল নবী-রসুলের নেতা।
  • খাতামুন্নাবিইয়িন বা নবীগণের সিলমোহর।
  • ইমামুর রব্বানিইয়িন বা রব্বানিদের পথিকৃৎ।

এর মধ্যে ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ ও ‘খাতামুন্নাবিইয়িন’ এই দুইটি সম্মানসূচক নাম স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত এবং আল্লাহর কিতাবে এর উল্লেখ আছে। অবশিষ্ট তিনটি সম্মানসূচক নাম তার উম্মতগণ প্রদান করেছেন। এর মধ্যে দুইটি পুরাতন, একটি নতুন। এই নতুন সম্মানসূচক নামটি হলো ‘ইমামুর রব্বানিইয়িন’। রব্বানিগণ এই সম্মানসূচক নামটি উদ্ভাবন করে দো-জাহানের নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। শেষোক্ত সম্মানসূচক নামটি নতুন হলেও এর গুরুত্ব ও মূল্য অপরিসীম।

হজরত মুহাম্মদের (স) পিতার নাম আবদুল্লাহ আর মাতার নাম আমেনা; দাদার নাম আবদুল মুত্তালিব। তার চাচাদের মধ্যে হামজা, আব্বাস, আবু তালেব ও আবু লাহাবের নাম উল্লেখযোগ্য। অনেকেই আবু জাহলকেও তার চাচাদের মধ্যে শামিল করে থাকেন; কিন্তু তা সম্পূর্ণ ভুল। তার চাচাতো ভাইদের মধ্যে হজরত আলী, হজরত আবদুল্লাহ ও হজরত ফজল (রা) প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন।

তার আগমন কেন মক্কায় হলো

মক্কা নগরীর আবদুল মুত্তালিবের গৃহে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের পূর্বেও মক্কা নগরীর প্রসিদ্ধি ছিল সারা আরব জুড়ে, কেননা মক্কাই ছিল আরবের শ্রেষ্ঠতম উপাসনাকেন্দ্র। এখানেই অবস্থিত সেই কাবাঘর, যার খ্যাতি ও মর্যাদা কবে থেকে শুরু হয়েছে তা নির্ণয় করা মুশকিল। এ কথা সত্য যে কাবার খ্যাতি ও মর্যাদা আল্লাহর নবীর (স) হাতেই পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে। তারপরও স্বীকার করতে হয় যে, কাবার খ্যাতি ও মর্যাদা বহুকাল আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। সুতরাং যদি বলা হয় সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা অনুসারে শুদ্ধতম ও খ্যাতিমান হজরত মুহাম্মদ (স) পূতপবিত্র ও প্রশংসিত অঞ্চলে প্রেরিত হয়েছিলেন, কিংবা তার আলোকময় ও ঐতিহাসিক প্রকাশের জন্য পবিত্র ও প্রসিদ্ধ স্থানকেই নির্বাচিত করা হয়েছিল, তা ভুল হবে না।

মর্যাদার দিক থেকে অবশ্য কাবার সাথে মুত্তালিব পরিবারের তুলনা হতে পারে না। কেননা কাবার মর্যাদা কাবার জন্যই নির্দিষ্ট। তারপরেও মুত্তালিব পরিবারের একটি নিজস্ব মর্যাদা ছিল। সে মর্যাদা এই যে, এই পরিবার ছিল গোটা আরব অঞ্চলের শ্রেষ্ঠতম ধর্মীয় নেতার পরিবার। সুতরাং আল্লাহর নবীর (স) জন্মস্থান হিসেবে শহর নির্বাচনের ব্যাপারে যেমন একটি পরিকল্পনা পরিলক্ষিত হয় পরিবার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তেমনই একটি সূক্ষ্ম পরিকল্পনার আভাস পাওয়া যায়। এই পরিকল্পনা কী এখন তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। বিষয়টির গভীরে প্রবেশের আগে মক্কা এবং মুত্তালিবগৃহের গুরুত্ব সম্যক উপলব্ধি করা কর্তব্য; কেননা শুধু তখনই এই দুইটি স্থান নির্বাচনের ব্যাপারে যে মহান নীতিগত ও শিক্ষণীয় ইশারা বিদ্যমান রয়েছে, তা হৃদয়ঙ্গম করা সহজ হবে।

কাবার গুরুত্বের দিক দিয়ে বিচার করলে আপাতদৃষ্টিতে মক্কা কেবল আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রস্থল মনে হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা তেমন ছিল না। বরং তা বৈষয়িক দিক দিয়েও উন্নত একটি শহর ছিল। মূলত মক্কা ছিল তখনকার আরব অঞ্চলের লন্ডন বা নিউইয়র্ক—ব্যবসা-বাণিজ্য ও তহজিব-তমদ্দুন (সভ্যতা-সংস্কৃতি) দুটোরই প্রধান কেন্দ্র। আরবের শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী, আশরাফ ও কুলীন নাগরিকগণ এখানে বাস করতেন; ফলে তা ব্যবসায়ী, নেতা ও সমাজপতিদেরই বিশিষ্ট শহর হিসেবে গণ্য হতো। মোদ্দাকথা, মক্কা তখন সারা আরবের পুরোদস্তুর ‘দারুল হুকুমত’—রাজনীতি, শিল্পকলা ও তমদ্দুনিক (সাংস্কৃতিক) প্রাণকেন্দ্র।

আবার কাবার মতোই মুত্তালিব পরিবারটিও ছিল সকল দিক থেকে মক্কার প্রাণকেন্দ্র। তখনকার মক্কাকে যদি আরবের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র বলা হয় এবং সেজন্য যদি লন্ডন-নিউইয়র্কের সাথে তার তুলনা চলে, তাহলে সেই বিচারে মুত্তালিবগৃহকেও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল অথবা হেনরিফোর্ড ভবন, রকফেলার ভবন বলে অভিহিত করা যায়। তেমনই মক্কাকে সারা আরবের রাজনীতির কেন্দ্রস্থল বা দারুল হুকুমত রূপে গণ্য করা হলে মুত্তালিব পরিবারকে রাজনীতির কেন্দ্রস্থল রাজভবন বা আরবের হোয়াইট হাউস বা বাকিংহাম প্যালেস বলতে হয়। আর মক্কাকে আরবের তহজিব-তমদ্দুনের (সভ্যতা-সংস্কৃতির) প্রাণকেন্দ্র বলে স্বীকার করলে মুত্তালিব পরিবারকে তহজিব-তমদ্দুনের কেন্দ্রস্থল বলে অভিহিত করা যায়।

মক্কা নগরী ও মুত্তালিবগৃহকে আল্লাহর নবীর (স) জন্মস্থান নির্বাচন করার পেছনে যে পরিকল্পনাটি লুকায়িত ছিল, তা এই যে, তিনি কেবল আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন দরবেশ, যোগী, সন্ন্যাসী—অর্থাৎ সংসারবিরাগীদের নেতা হওয়ার জন্যই প্রেরিতপুরুষ হননি, বরং বণিক-ব্যবসায়ী, সমাজপতি, বিদগ্ধ, কুলীন ও অভিজাতদের নেতৃত্ব দানও তার প্রেরিত হওয়ার উদ্দেশ্য। মানে আল্লাহর নবী (স) তার অনুসারীদের জন্য কেবল আধ্যাত্মিক সাধনার চরম সিদ্ধি ও এবাদত-বন্দেগির ক্ষেত্রে নজির স্থাপনই নয়, বরং একই সাথে তাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও শাসনকার্যেও পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করতে ও তাতে চূড়ান্ত নজির স্থাপন করতে শিক্ষকরূপে প্রেরিত হন। আমাদের কর্তব্য হলো তার নির্দেশনা অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় ক্ষেত্রে পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে তার অনুসারীদেরকে আল্লাহর খেলাফতের চরম সৌভাগ্য ও গৌরবের মোকাম হাসিল করতে হবে।

এই ব্যাপারে আরও একটি সূক্ষ্ম বিষয় নিয়েও গভীর বিচার-বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে—শহর হিসেবে মক্কাকে যেমন জন্মস্থান নির্দিষ্ট করা হলো, গৃহ হিশাবে তেমনই কাবাকে নির্দিষ্ট করা হলো না কেন? অথচ তা-ই হওয়া তার সম্মান অনুপাতে যুক্তিযুক্ত হতো; হজরত আলীর জন্মস্থান যেভাবে কাবাঘর, তার জন্মস্থানও সেভাবে কাবাঘর হতে পারত না?

না, কারণ আল্লাহ তাআলার তার নবীকে (স) প্রেরণের উদ্দেশ্য হলো তাকে সামগ্রিক নেতৃত্বের উপযোগী করে তোলা ও তার দ্বারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পন্থা নির্দেশ করা। যদি তার জন্ম কাবাঘরে হতো, এই উদ্দেশ্যের ইশারা আধাআধি হতো, কেননা কাবাঘর তো কেবল আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রস্থল, পার্থিব রাজনীতি-অর্থনীতির কেন্দ্রস্থল না। অন্যদিকে মুত্তালিব পরিবার ছিল পার্থিব বিষয়ের কেন্দ্রস্থল। সুতরাং মক্কাকে জন্মস্থান নির্দিষ্ট করে তার মধ্যে আধ্যাত্মিকতার পূর্ণতা বিধান এবং মুত্তালিব পরিবারে প্রেরণ করে তার জাগতিক জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন করা হয়। এমনিভাবে হজরত মুহাম্মদের (স) ফিতরতে (স্বভাবে) আধ্যাত্মিক ও জাগতিক—উভয় দিককার গুণের সমন্বয় সাধন করে তাকে মানবজীবনের সামগ্রিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দানের যোগ্য করে তোলা হয়।

হজরত আলীকে (রা) যেহেতু আধ্যাত্মিক জগতের নেতা বানানোই উদ্দেশ্য ছিল, তাই তার জন্মের জন্য কাবাকে নির্দিষ্ট করা হয়। তাই দেখা যায় হজরত আলী (রা) আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে উচ্চতম অংশ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন সত্য, কিন্তু পার্থিব জগতের ক্ষেত্রে ন্যূনতম প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু অর্জন করতে পারেননি। তিনি যে অনুপযুক্ত ছিলেন তা নয় বরং তার মধ্যে পার্থিব জগতে উন্নয়নের আগ্রহই ছিল না। এই কারণেই আল্লাহর নবী (স) হজরত আলীকে (রা) হজরত হারুনের (আ) মতো বলে আখ্যায়িত করেছেন, হজরত ইউশার (আ) মতো বলে আখ্যায়িত করেননি। আবার ঘোষণা করেছেন, ‘আলী (রা) আমার অনুসারীদের মধ্যে ঈসা ইবনে মরিয়মের (আ) মতো।’

তার ইন্তেকাল কেন মদিনায় হয়েছিল

মক্কাকে যেমন জন্মস্থান হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল তেমনই অন্য একটি জায়গাকে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল চিরনিদ্রার স্থানরূপে। কবরস্থান নির্বাচনের ব্যাপারে পৃথক একটি পরিকল্পনা কার্যকর করা হয়। জন্মস্থানের জন্য তো এমন একটি জায়গা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল যা ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ শহর—ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র, রাজনীতির প্রাণভূমি, শাসন-পরিকল্পনাকেন্দ্র এবং সেইসঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রস্থল। কিন্তু চিরনিদ্রার জন্য এমন একটি জায়গাকে নির্বাচন করা হলো যার এইসকল মর্যাদা বা খ্যাতির কোনোটাই ছিল না। তবে মদিনা কী ছিল? ছিল কিষাণদের একটি বসতি মাত্র—পশুপালন ক্ষেত্র, চাষীদের একটি সাধারণ পল্লী, বড়জোর একটি বৃহৎ কৃষক এলাকা। এখানে আধ্যাত্মিকতার কোনো ছাপ ছিল না, ছিল না পার্থিব জগতের কোনো বিষয়ে সামান্যতম খ্যাতি।

এরপরেও মুসলমানদের মতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব আর অমুসলমানদের মতে শ্রেষ্ঠ মানবদের একজন, যার জন্মস্থান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছিল সভ্যতার লীলাকেন্দ্র, অথচ তারই চিরনিদ্রার স্থান হিসেবে এমন অখ্যাত, শ্রমজীবী-অধ্যুষিত ও সভ্যতা-সংস্কৃতির আলো থেকে বিচ্ছিন্ন একটি জায়গাকে কেন নির্বাচন করা হলো? এটি এইজন্য যে, পূর্ণতাপ্রাপ্তির পূর্বক্ষণ পর্যন্ত মানুষের জন্য জ্ঞান-আহরণ ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের প্রয়োজন হয়। তাই পূর্ণতাপ্রাপ্তির আগে এমন একটি বড় জায়গায় অবস্থান প্রয়োজন যে-স্থান থেকে জ্ঞান-আহরণ ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা সম্ভব। আরবে মক্কা নগরীরই সেই দিক দিয়ে উপযুক্ত স্থান ছিল। এ কথাও স্পষ্ট যে, জন্ম ও সত্যের প্রতি আহ্বান করার যোগ্যতা অর্জনের সময়টি অপরিপক্কতার অন্তর্ভুক্ত হওয়া সমীচীন। সুতরাং জন্ম থেকে সত্যের প্রতি দাওয়াতের জন্য যোগ্যতা অর্জন পর্যন্ত সময় অতিবাহিত করার জন্য পবিত্র মক্কা নগরীই সঠিক স্থান বলে মনোনীত করা হয়—কারণ মক্কা যেমন আধ্যাত্মিকতার শ্রেষ্ঠতম কেন্দ্র ছিল তেমনই জাগতিক উন্নতির সকল সুযোগ-সুবিধাও মক্কায় বিদ্যমান ছিল। সেখানে আল্লাহর নবী (স) আর্থিক ও জাগতিক বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান আহরণ করে উভয় ক্ষেত্রেই কামালিয়াত হাসিল করেন এবং নিজের চরম উৎকর্ষ সাধনে সক্ষম হন। সেখানেই তিনি প্রাপ্ত হন আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে নবীত্ব ও সত্যের পথে মানুষকে ডাকার পূর্ণ যোগ্যতা। এবং অর্জন করেন জাগতিক ব্যাপারস্যাপার—ব্যবসা-বানিজ্য, রাজনীতি ও রণকৌশলে অপূর্ব দক্ষতা।

কামালিয়াত হাসিলের পর কল্যাণ ও মঙ্গল সাধনের সময় আসে। এই সময় প্রয়োজন হয় এমন একটি ক্ষুদ্র জায়গা যেখানে উভয় ক্ষেত্রের সঞ্চয়ই ব্যবহার করা যায়, যেখানে মানুষের কল্যাণ সাধন সম্ভব হয়, যেখানে শক্তির পরিবর্তে নম্রতাতেই কাজ চলে, এবং যেখানকার অধিবাসীদের গ্রহণ ক্ষমতা থাকে অত্যাধিক। এমন জায়গার জন্য মদিনার মতো স্থানই ছিল সবদিক দিয়ে উপযুক্ত। অবশ্য এই প্রশ্ন উঠতে পারে হিজাজ বা আরব উপদ্বীপে এমন বহু অখ্যাত স্থান ছিল, তা সত্ত্বেও মদিনাকেই নির্দিষ্ট করা হলো কেন? এর জওয়াব কল্যাণ ও মঙ্গলে অখ্যাতের অগ্রাধিকার আছে, কিন্তু কৃত্রিমের নাই। মদিনা অখ্যাতদের জায়গা ছিল ঠিক, কৃত্রিমদের জায়গা ছিল না। অখ্যাত অথচ কৃত্রিম নয় এমন জায়গা আরবে কয়টিই-বা ছিল? অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে এই বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে মদিনা ছিল অদ্বিতীয়।

এ ছাড়াও কল্যাণমূলক কাজের জন্য ক্ষুদ্র জায়গা ও পতিত জনতার প্রয়োজন আছে বলে যে কথা রয়েছে, তার চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া যায় মক্কার আমজনতায় দাওয়াতের নিস্ফলতা ও মদিনায় আমজনতায় দাওয়াতের সাফল্যের মধ্যে। নিশ্চয় এ কথা সবারই জানা আছে যে, মক্কায় তেরো বছরের দাওয়াতে দাওয়াত-কবুলকারীর সংখ্যা বেশি বৃদ্ধি পায়নি। অথচ মদিনায় দশ বছরের দাওয়াতে রাজ্যের পর রাজ্য সাড়া দিয়েছে এবং কবুলকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে লাখের অংকে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এ কথা সত্য—মক্কায় যারা তার ডাকে সাড়া দিয়েছেন তারা প্রত্যেকেই ছিলেন এক একটি হীরার সমতুল্য। কিন্তু হীরা দিয়ে তো আর বাজার ধরা করা যায় না, বাজার ধরার জন্য প্রয়োজন প্রচুর টাকা-পয়সার।

এতে কোনো সন্দেহ নাই মদিনাকে নির্বাচন করার এছাড়াও আরও কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল—যেমন অবস্থানের গুরুত্ব, অধিবাসীদের যুদ্ধ করবার যোগ্যতা, এবং এর রাজনৈতিক ও গঠনমূলক ব্যবস্থাপনার অনুকূল পরিবেশ। মদিনার পরিবেশ এমন ছিল :

এক. মদিনা হেজাজ ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এখানে বসে আরব ও সিরিয়া উভয় এলাকাকেই দাওয়াতের লক্ষ্যস্থলে পরিণত করা সম্ভব ছিল।

দুই. মদিনা থেকে কিছু দূরে এমন একটি সংযোগস্থলে অবস্থিত ছিল, যে-স্থান দিয়ে একটি পথ সিরিয়ার দিকে চলে গেছে। সিরিয়া থেকে মক্কার সওদাগরদের এই পথ দিয়ে ফেরা ছাড়া উপায় ছিল না।

তিন. মদিনার অধিবাসীদের বেশির ভাগই ছিল কিষাণ-মজদুর। কিষাণ-মজদুররা স্বাভাবিকভাবেই সংযমী, পরিশ্রমী ও সাহসী হয়ে থাকে। এই কারণে মদিনা ছিল প্রকৃতিগতভাবে সৈনিকদের ভূমি, এখনকার অধিবাসীদের সহযোগিতায় একটি সুদক্ষ সেনাবাহিনী গঠন করা অতি সহজ ছিল।

মদিনার চারপাশে ইহুদিদের বসতি ছিল। কর্তৃত্বও ছিল তাদের হাতে। এই ইহুদিদের অধীনে ছিল গোটা কয়েকটি দুর্গ—এইগুলো জালের মতো বিস্তৃত ছিল সারা মদিনায়। দুর্গগুলো করতলগত করতে সক্ষম হলে সারা আরবের মোকাবেলায় একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল লাভ করার সম্ভাবনা ছিল। তা ছাড়া যেহেতু ইহুদিদের হাতেই ধর্ম, অর্থনৈতিক শক্তি ও কর্তৃত্ব ছিল, তাই পুরো আরব অঞ্চলই তাদের ভয়ে ভীত থাকত। তাদের পরাস্ত করতে পারলে সারা আরবে কর্তৃত্ব বিস্তার করা অতি সহজ ছিল। আর মদিনার একেবারে আশেপাশে ছিল খ্রিষ্টান গোত্রসমূহের শাসনকর্তৃত্ব। তারাও দুর্গাধিপতি ছিল। তাদের পরাজিত করতে পারলে শাসন ক্ষমতা লাভ করার পথে আর কোনো বাধা ছিল না এবং বৈপ্লবিক দাওয়াতের পেছনেও তা পূর্ণ শক্তি যোগাতে সক্ষম ছিল। এছাড়া, মদিনা সমুদ্রের কাছাকাছি অবস্থিত। সুতরাং মদিনায় প্রতিষ্ঠা লাভের পর সমুদ্রের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাও সহজ ছিল।

মদিনা আল্লাহর নবীর (স) চিরনিদ্রার স্থান হওয়ার জন্য আরও একটি কারণ বেশি উপযুক্ত, তা এই যে—মক্কায় নতুন ‘হারাম শরিফ’ স্থাপন করা সম্ভব হতো না, সেখানে হজরত মুহাম্মদের (স) হারাম শরিফ বা পূণ্যধাম প্রতিষ্ঠা করা হলেও আদিপিতা হজরত ইবরাহিমের (আ) সাথে তার মর্যাদা মিশে যেত। মদিনায় এতে কোনো বাধা ছিল না; এখানে তার নতুন ‘হারাম শরিফ’ হওয়া সম্ভব। আর এ কথা সত্য আল্লাহর নবী (স) যে ইনকিলাবি দাওয়াতের জন্য প্রেরিত হয়েছেন তার জন্য একটি খালেস ‘হারামে মুহাম্মদি’-এর প্রয়োজন ছিল। ‘তৌহিদ’ এমন একটি মিশ্র ও বিমূর্ত ধারণা যে এর সঠিক ব্যাখ্যা ও পূর্ণতা বিধানের জন্য হজরত মুহাম্মদের (স) প্রয়োজন ছিল। সুতরাং তৌহিদের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গই তার ব্যক্তিত্বের আভায় মণ্ডিত হওয়া উচিত। কিন্তু খালেস ‘হারামে মুহাম্মদি’ ছাড়া কীভাবে তা সম্ভব হতো? সিরাত ও চরিত্র-আদর্শের কেতাবি বর্ণনা ও ব্যাখ্যার অবশ্যই একটি মূল্য রয়েছে, কিন্তু তা যে শুষ্ক! জীবনক্ষমতা যে এতে বিদ্যমান থাকে না! হৃদয় ও মনকে উজ্জীবিত করার জন্য প্রয়োজন একটি চাক্ষুষ প্রেরণা-উৎসের। যতদিন মৃত্যুর কালো পর্দা তার জীবনে নেমে না আসে ততদিন জাতির প্রতিষ্ঠাতা এই উৎস হতে পারেন; আর হতে পারে তার পবিত্র মাজার ফরিয়াদির জন্য ‘হারাম শরিফে’। জিয়ারতকারীদের অন্তরে এই ‘হারাম শরিফ’ চিরবসন্তময় ও সুবাসিত কাননের মতো। এ-স্থান সব সময় মহব্বত ও ঈমান-একিনের সুগন্ধ বিতরণ করে এবং তাদের মন ও মস্তিষ্ককে আমৃত্যু তারই নেশায় মাতোয়ারা রাখে। যারা মসজিদুল হারামের (কাবা শরিফ) সাথে মদিনাও জিয়ারত করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, তাদের নিকট জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারা যাবে যে মদিনায় চিরবসন্তময় ‘বাগে জান্নাত’ প্রেম ও প্রত্যয়ের কী মধুর সুবাসই না তাদের মাঝে বিলিয়েছে।

এ কথা অবশ্য স্বীকার্য যে, নতুন হারাম শরিফ প্রতিষ্ঠা একদিক থেকে তৌহিদের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু শুধু এই ক্ষতিই তৌহিদের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটাতে পারে না, তৌহিদের অনুপস্থিতি তা পারে। তৌহিদকে আকৃতিমুক্ত রাখুন এবং কেবলমাত্র তা মনে ধারণের বিষয় বলে মনে করতে থাকুন—দেখবেন তৌহিদ গায়েব হয়ে গেছে। সুতরাং তৌহিদকে মনে ধারণের পরিবর্তে বাস্তবে আনার জন্যে ‘হারাম শরিফ’ প্রতিষ্ঠা জরুরি। অবশ্য এতে যতটুকু ক্ষতির আশঙ্কা বিদ্যমান তা প্রতিরোধের ব্যবস্থাও অবশ্যই থাকা দরকার। আর এটাই তৌহিদের খেদমতের বাস্তবপন্থা। সুখের বিষয়, হজরত মুহাম্মদ (স) সেই ক্ষতি প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেছেন, এবং চূড়ান্ত ব্যবস্থাই করে গেছেন।

জেসম মোবারকের বিবরণ

ক. হজরত মুহাম্মদ (স) ছিলেন খুবই স্বাস্থ্যবান, শক্তিশালী সুঠাম-দেহ ও সুন্দর। তিনি এত স্বাস্থ্যসচেতন ছিলেন যে কঠিন মেহনত ও পরিশ্রম করা সত্ত্বেও জীবনে দুইবারের বেশি তিনি অসুস্থ হননি। এই দুইবার অসুস্থ হওয়ার মূলে ছিল বিষের প্রতিক্রিয়া। একবার খাবারের মাংসে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল, মৃত্যুর সময়ও তিনি সেই বিষক্রিয়ার ফলে যন্ত্রণায় ভুগেছিলেন। তিনি এমন শক্তিশালী ছিলেন যে আরবের বিখ্যাত কুস্তিগির রুকানা তিনবার তার সাথে কুস্তি লড়ে তিনবারই হেরে গেছিলেন। তিনি মজবুতও ছিলেন, অনবরত অনাহার-অর্ধাহারে দিন গুজরান সত্ত্বেও তার বিরামহীন পরিশ্রমের মধ্যে একদিন বা এক ঘন্টার জন্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি। তিনি এমন সুন্দর ছিলেন যে তার সাথে কারুর তুলনা হয় না। কেউ তার সৌন্দর্যের সাথে চতুর্দশী চাঁদের তুলনা করেছেন, কেউ বলেছেন তিনি ছিলেন যেন একটি ঝলসানো তরবারি, কেউ তাকে তুলনা করেছেন গোলাপ ও মখমলের সাথে।

তিনি স্বয়ং তার সৌন্দর্যের সাথে হজরত ইউসুফের (আ) সৌন্দর্যের তুলনা করেছেন। বরং তার কথায় এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে হজরত মুহাম্মদের (স) সৌন্দর্য হজরত ইউসুফের (আ) সৌন্দর্যকেও ছাড়িয়ে গেছে। অথচ একটিমাত্র ঝলক এমন দৃশ্যের অবতারণা করেছিল যে মহিলাগণ ফলমূল কাটার পরিবর্তে নিজের হাত কেটে ফেলেছিল। তারপর তারা স্বীকার করেছিল জুলেখার তার প্রেমে পাগলপারা হওয়া অমূলক না।

আল্লাহর নবীর (স) সৌন্দর্যও হজরত ইউসুফের সৌন্দর্যের মতোই দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স ও একাধিক স্ত্রী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও তরুণী হজরত আয়েশা (রা) নবীজির (স) প্রেমে এতটাই দিওয়ানা ছিলেন যে বিয়ের পর একবার কোনো এক সফরে তার সাথী হতে না পেরে সাপের আবাসস্থলে একপ্রকার ঘাসের ওপর পা রেখে মনোবেদনায় চিৎকার করে তিনি মুনাজাত করছিলেন—‘হে খোদা, আমাকে দংশনের জন্য এই ঝোপ থেকে সাপ বের করে আমার পায়ে লাগিয়ে দাও!’

খ. হজরত মুহাম্মদ (স) অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও অত্যন্ত খোশবুদার ছিলেন। তিনি এত সংবেদনশীল ছিলেন যে অতি সূক্ষ্ম প্রতিক্রিয়াও তার শরীরে পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করত। আনন্দিত হলে তার চেহারায় রক্তিম আভা ফুটে উঠত, রাগান্বিত হলে গম্ভীর ভাব দেখা দিত। অর্থাৎ তার শরীর এত সুশ্রী ও স্বচ্ছ ছিল যে, যেকোনো আবেগই চেহারায় প্রতিফলিত হতো। ফলে কোনো আবেগই আর তার মনে লুকায়িত থেকে দুনিয়াকে প্রতারণা করতে পারত না।

তার ধৈর্য ও গাম্ভীর্য ছিল সীমাহীন; কিন্তু এই ধৈর্য গাম্ভীর্যের ক্রিয়াস্থল কেবল মস্তিষ্কে সীমিত থাকত—শরীরে নয়। আবেগ যদি দমনের প্রয়োজন হতো তবে তা সংকল্পেই দমন করতেন, শরীরে তার কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতো না।

তিনি এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিলেন যে কাপড়ে সামান্যতম দুর্গন্ধও তিনি সহ্য করতে পারতেন না। দিনে ও রাতে পাঁচবার মেসওয়াক করতেন, কোনো একবারও বাদ দিতেন না। এক নামাজ থেকে আরেক নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে মুখে যে সামান্য মলিনতা আসত তা-ই তার নিকট বরদাশত হতো না, তিনি তা-ও পরিষ্কার করে ফেলতেন। অথচ সাধারণত এ ধরনের মলিনতা বহু মানুষ অনুভব করতেও সমর্থ নয়। মানুষ সাধারণত দিনে একবার কিংবা বড়জোর দুইবার দাঁত ও মুখ পরিষ্কার করাকে যথেষ্ট মনে করে থাকে। কিন্তু আল্লাহর নবীর (স) মেসওয়াকের অভ্যাসটি এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে মুমূর্ষ অবস্থায়ও তিনি তা ভুলতে পারেননি ; অথচ এটি এমন একটি সময় যখন মানুষের সকল চেতনাশক্তি রহিত হয়ে যায়। আল্লাহর নবী (স) এই সময়েও মেসওয়াক ব্যবহার করেছেন। মেসওয়াক চিবিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তখন তার ছিল না, আম্মাজান হজরত আয়েশা (রা) চিবিয়ে নরম করে দেন, পরে তিনি ব্যবহার করেন।

সুযোগ পেলেই তিনি সুগন্ধি ব্যবহার করতেন, যাতে শরীর ও বস্ত্রের সামান্য দুর্গন্ধ মস্তিষ্ককে বিব্রত করতে না পারে। অথচ তার শরীরটাই ছিল প্রকৃতিগত খোশবুর ভান্ডার। এই ভান্ডার থেকে প্রতিনিয়ত খোশবু চতুর্দিকে ছড়িয়ে বাতাসকেও সুবাসিত করে তুলত। তার সাহচর্যে যারা থাকতেন তারা যেন সর্বদায় তার সেই খোশবুতে মাতোয়ারা থাকতেন। আল্লাহই জানেন তিনি পবিত্রতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে কত ভালোবাসতেন! কিন্তু এতকিছু থাকা সত্ত্বেও তার তৃপ্তি হতো না; প্রকৃতিগত খোশবুর সাথে আবার মানুষের তৈয়ারি খোশবু মিশাতেন। তিনি স্বয়ং এত সুগন্ধময় ছিলেন যে, যেদিকে গমন করতেন সেদিকে আকাশ বাতাস তার সুবাসে মোহিত হয়ে উঠত; আর তাকে খুঁজতে আসা মানুষ সেই সুবাস ধরে খুঁজে নিতে সক্ষম হতো।

এই সকল বর্ণনা অনেকের নিকট বিস্ময়কর মনে হতে পারে : উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদও উঠতে পারে যে হজরত মুহাম্মদের (স) জীবনচরিতকে কি অন্তত সন্দেহজনক এবং কাল্পনিক গালগল্প থেকে মুক্ত রাখা গেল না? কিন্তু মানবদেহ ও মানব সৃষ্টির স্বাভাবিক উপাদানসমূহ, যা নিয়ে এখনও বিতর্কের অবসান হয়নি, যদি কেউ সেগুলো একত্রে সন্নিবেশ করে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন এবং একবার এই নীতিকেই স্বীকার করতে সক্ষম হন যে, প্রকৃতি সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও বৈচিত্রহীন নয়, প্রকৃতির নিয়মের পূর্ণ অধীন হলেও তা ব্যতিক্রমের সম্ভাবনামুক্ত নয় এবং এই সঙ্গে যদি এ কথা উপলব্ধি করা সম্ভব হয় যে প্রকৃতির এই ব্যতিক্রম ও বিস্ময়কর প্রকাশ নিয়ম বহির্ভূত নয় বরং নিয়মসঙ্গত, এবং মানুষের নিয়ম-প্রকৃতি রহস্য উদঘাটনের অন্বেষা-স্পৃহা যাতে মানুষের চূড়ান্ত জ্ঞানাভিমানবশত কার্যকারণের মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ হয়ে না পড়ে, তার জন্য কতিপয় মৌলিক নীতি সক্রিয় রয়েছে, এই ব্যতিক্রম তারই অন্যতম—তা হলে এই ব্যাপারে বিস্ময়ের আর কোনো অবকাশ থাকে না। আর এটাও সত্য যে, তত্ত্বজ্ঞানের প্রকৃত অন্বেষীদল কখনও নিয়ম-কানুনের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকেন নাই। তাদের অন্বেষা সবসময় অব্যাহত রয়েছে এবং তারা প্রকৃতির বিস্ময়কর এমন অনেক রহস্য উদঘাটন করতে সমর্থ হয়েছেন সাধারণ মানুষ যা কল্পনাও করতে পারত না। আর, তাছাড়া প্রকৃতির নিয়ম ও পদ্ধতির ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো রায়দানও কারও পক্ষে সম্ভব নয় ; কেউ তা দিলেও তাকে সম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত বলে স্বীকার করা যায় না। এই জন্যই নিউটন অবশেষে মন্তব্য করেছিলেন : ‘জ্ঞানের রাজ্যে সারাজীবন বিচরণ করে এক্ষণে এ কথাই উপলব্ধি হচ্ছে যে, আমার অবস্থা ঠিক সেই বালকের মতো যে সমুদ্রের তীরে কুড়িয়ে পাওয়া চকমকে পাথর জমা করছে আর মনে মনে ভাবছে সে বুঝি গোটা সমুদ্র-সম্পদ আহরণ করে ফেলেছে!’

উপর্যুক্ত আলোচনার পর একটি বিষয় নিশ্চিত পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, হজরত মুহাম্মদের (স) দেহখানা প্রকৃতির চিররহস্যেরই একটি বিরল দিক। এমন বহু রহস্যই তো জগতে দেখা গেছে, এবং এখনও বিদ্যমান রয়েছে।

এখন হয়তো আবার দাবি উঠতে পারে যে তাহলে তো হজরত মুহাম্মদের (স) জীবনচরিত মোজেজা বা বিস্ময়কর ঘটনাসমূহের পরিপূর্ণ চিত্র থাকা দরকার। তা অবশ্যই কাম্য। তবে সহিহ বর্ণনা কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত ও মিথ্যা কল্পনামিশ্রিত বিষয়কে বাদ দিয়েই তা রচিত হওয়া উচিত। কারণ সহিহ বর্ণনায় পাওয়া বিস্ময়কর বিষয়কে হজরত মুহাম্মদের (স) জীবনচরিত থেকে বাদ দেওয়ার অর্থ যেমন জীবনী লেখার নীতিকেই হত্যা করা, তেমনই নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী কোনো অংশকে ত্যাগ করে যাওয়া আলোচ্য মানুষটির অসম্পূর্ণ চিত্র উপস্থাপন করারই নামান্তর। প্রকৃতপক্ষে একজন জীবনীকার ঘটনারই বর্ণনাদাতা। সুতরাং, জীবনী রচনায় জীবনীকারের কী অধিকার রয়েছে যে তিনি দর্শনের আলোকে ঘটনাকে বিকৃত করবেন? যদি এমনই হয় তাহলে ঘটনা বর্ণনাকারীদের প্রতি আস্থা বিনষ্ট হয়ে যাবে, জীবনী সন্দেহমূলক হয়ে উঠবে এবং সকল ইতিহাস পরিত্যাজ্য হয়ে পড়বে। এ কথা অতি সত্য যে ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই উত্তম কাজ, কিন্তু এক্ষেত্রে বুদ্ধির প্রয়োগ ঠিক নয়। কেননা প্রত্যেক ব্যক্তির স্বতন্ত্র বুদ্ধি রয়েছে। যদি এক ব্যক্তির এক হাজার জীবনীকার হয়, আর তারা সকলে নিজ নিজ বুদ্ধি প্রয়োগের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন, তাহলে একই ব্যক্তির হাজার রকম জীবনী রচিত হবে। ফলে আলোচ্য ব্যক্তির অসংখ্য জীবনী বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তার সত্যিকারের জীবনে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই প্রসঙ্গে আমি হজরত মুহাম্মদের (স) জীবনীকারদের মধ্যে আল ওয়াকিদিকে (৭৪৭-৮৩২ খ্রি.) স্বীকৃতি দান করি; অথচ হজরত মুহাম্মদের (স) জীবন-রচয়িতাগণ সকলে এক বাক্যে আল ওয়াকিদিকে ‘মরদুদ’ (পরিত্যাজ্য) আখ্যা দিয়েছে। আল ওয়াকিদির আসল দোষ হলো তিনি জীবনী রচনার ক্ষেত্রে বুদ্ধিকে কোনো স্থান দিতেন না, বরং হজরত মুহাম্মদের (স) জীবন-সংশ্লিষ্ট অলৌকিকত্ব বর্ণনায় লজ্জা বা ভয় করতেন না। অবশ্য কেউ কেউ বলেন তিনি মিথ্যা বর্ণনাও করেছেন। কিন্তু কারা এ অভিযোগ করছেন? রেওয়ায়েতশাস্ত্রকে যারা দার্শনিকতার পর্যায়ে উন্নীত করতে অক্ষম ছিলেন এবং সত্য সম্পর্কে একটি সাধারণ পর্যায়ের নিয়ম মেনে চলতেন ও এরই ভিত্তি মজবুত রাখার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকবেন, এই অভিযোগ তারাই এনেছেন।

তার চোখ দুটো ছিল টানা টানা। তাতে যেন প্রকৃতিগতভাবেই সুরমা লাগানো ছিল। তার যুগল ভুরু, প্রশস্ত ও উচ্চ ললাট এবং ঝকঝকে দাঁত সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করত। তার মাথায় চুল কোঁকড়ানো, হাতের তালু মাংসল, কাঁধ প্রসারিত এবং বাহু সবল ছিল। শরীরের রঙ ছিল উজ্জ্বল ও রক্তিমাভাযুক্ত গোলাবি। কখনও ঘাম দেখা দিলে তা মুক্তার মতো ঝলমল করত।

স্বভাব ও আখলাক

হজরত মুহাম্মদ (স) যেমন অত্যন্ত নীরবতাপ্রিয়, অত্যন্ত স্বল্প ও সারভাষী ছিলেন, তেমনই তিনি ছিলেন অত্যন্ত চিন্তাশীল ও ব্যথাদীর্ণ, ধ্যানমগ্ন, গম্ভীর ও সদা সচেতন। তিনি এত নীরব থাকতেন যে অপরিচিত ব্যক্তি তাকে আজন্ম বোবা বলে ভুল করে বসত; অতিরিক্ত একটি কথাও বলতেন না। যা বলতেন, তা-ও ঠিক প্রয়োজনমাফিক। গল্পচ্ছলেই গল্প ও অযাচিত কথা বলে জবানকে অপবিত্র করা ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ। যদি কখনও কোনো অতিভাষী তার নিকট আসত, তাহলে সে তার অতিভাষণের অভ্যাসই ভুলে যেত এবং আল্লাহর নবীর (স) নীরবতার প্রভাবে পড়ে প্রয়োজনীয় কথা বলাতেই সন্তষ্ট থাকত। দুর্ভাগ্যবশত যদি কেউ অতিরিক্ত কথা বলতেই থাকত তবে তিনি তা নীরবে শুনে যেতেন। কারণ, না শুনলে হয়তো-বা সে দুঃখিত হবে বা নিজেকে অপমানিত মনে করে বসবে। ‘সহ্য করিব, তবু অন্যের অন্তর দীর্ণ করিব না’—এই নীতি পুরাপুরি অনুসরণের জন্যই যে তিনি এই কাজ করতেন, এতে কোনো সন্দেহ নাই।

তিনি এত স্বল্পভাষী ছিলেন যে, দিন ও রাতের মধ্যে যা কিছু বলতেন তার হিসাব রাখা অসম্ভব ছিল না। অবশ্য, এজন্য এরূপ ভুল করবার কোনোই কারণ নাই যে এর ফলে কাজকর্ম কম হয়ে থাকবে এবং নির্জনতাপ্রিয়তা প্রাধান্য লাভ করার ফলেই হয়তো তার স্বল্পভাষণের অভ্যাস হয়ে থাকবে। এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্তিপূর্ণ।

প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহর নবীকে (স) এত কাজ করতে হতো যা কখনও কারও করতে হয় নাই। তার দৈনন্দিন কার্যতালিকা দেখলে যে-কেউ চমকে উঠবে এবং বলতে বাধ্য হবে যে, দুনিয়ায় আর কারও এত কাজ করতে হয়নি। এমন ব্যস্ততায় নির্জনতাপ্রিয়তার স্থানই-বা কোথায়? প্রকৃতপক্ষে, তিনি নির্জনতাপ্রিয় নয়, ছিলেন সত্যিকারের সংসর্গ-প্রিয়। কিছুদিনের জন্য তাকে অবশ্য নির্জনতা অবলম্বন করতে হয়েছিল, কিন্তু তাও ছিল সাময়িক এবং মহাজীবনের প্রস্তুতির জন্যই।

নির্জনতা ও মৌনব্রত অবলম্বনকারী সুফি ও খানকাহ-আখড়াপ্রিয় মোল্লা-মৌলবিদের কিংবা যোগী ও সন্ন্যাসীদের কার্যকলাপের প্রতি লক্ষ্য করে আল্লাহর নবী (স) সম্পর্কে কেউ কেউ উপর্যুক্ত ধারণা করছেন কি? কিন্তু তার কার্যাবলীর সাথে তাদের সম্পর্ক কিংবা মিল কোথায়? এ কথা সত্য যে আল্লাহর নবীর (স) সামগ্রিক জীবনবৃক্ষের একটি শাখা সুফিবাদের সাথে যুক্ত। কিন্তু বৃক্ষটিকে পর্যবেক্ষণ করলে প্রতীয়মান হবে যে ওটা সম্পূর্ণ আলাদা এক দুনিয়া। হজরতের সামগ্রিক জীবন নবুওয়তেরই পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি। কোনো একটি বিষয়ের বিশেষ দিক তার পূর্ণ চিত্র ফুটিয়ে তুলতে কিছুতেই সক্ষম হবে না। তা ছাড়া, আল্লাহর বিশেষ গুণেও তা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। সুতরাং, সারা সৃষ্টিজগৎ মিলেও তার পূর্ণচিত্র আঁকতে সক্ষম নয়। তা হলে আল্লাহর নবীর (স) জীবনের সাথে নির্জনতার আর কীই-বা সম্পর্ক? আর ইহলৌকিক ও পারলৌকিক—উভয় জগতের কর্মেরই যেখানে সমন্বয় ঘটেছিল সেখানে কাজ ‘কম ছিল’ এ প্রশ্ন উঠতেই পারে না। তবু প্রশ্ন থেকে যায় যে, তাহলে তার এই অস্বাভাবিক নীরবতা ও অতি স্বল্পভাষী স্বভাব কী করে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল? এই অবস্থায় তো বিশেষ করে শিক্ষাদান, উপদেশ-সংক্রান্ত কার্যাবলী অচল হওয়ারই কথা।

কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার যে, কাজ কেবল কথা ও দীর্ঘ বক্তৃতার মাধ্যমেই হয় না, ইশারা ও সংক্ষিপ্ত একটি বাক্য দিয়েও সাধিত হতে পারে। অনেক সময় তো ইশারারও প্রয়োজন পড়ে না। যেমন কোনো ব্যক্তি তার অনুসারী দলবলের সাহায্যে কোনো কাজ করতে চান, এক্ষেত্রে ইশারা ছাড়াই তিনি উপস্থিত সকলের দ্বারা তা করাতে পারবেন—যদি তিনি নিজেই সেই কাজটি করতে শুরু করেন। শর্ত একটাই—অনুসারীদের ঝুদ্ধিমান ও তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তা হলে তিনি কাজ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সকলেই তাতে অংশ নিতে শুরু করবে।

এ কথা অবশ্য সত্য যে, অল্প কথা, ইশারার মাধ্যমে ও ইশারা ছাড়া কাজ করাবার জন্য যেমন গভীর প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন, তেমনই কর্মটিও সকলের মনঃপূত হওয়া দরকার। আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে আল্লাহর নবী (স) এবং তার কার্যাবলীর মধ্যে এই দুইটি বিষয়ই পু্রোমাত্রায় বিদ্যমান ছিল।

তিনি যে কী পর্যায়ের স্বল্পভাষী ছিলেন এখানে তার দুই একটা নমুনা বিচার-বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। একবার মদিনার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্র আউস ও খাজরাজের মধ্যে সংঘর্ষের উপক্রম হলো। পূর্বে তাদের মধ্যে শত্রুতা বিদ্যমান থাকলেও ইসলাম পরস্পরকে প্রীতিবন্ধনে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু হঠাৎ সেই প্রদমিত শত্রুতা মাথা চাড়া দেওয়ায় জাহিলিয়াতের অভ্যাস অনুযায়ী খোলা তরবারি নিয়ে উভয় গোত্রের লোকে পরস্পর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। আল্লাহর নবী (স) এ কথা জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এই একটি বাক্য বললেন : ‘আমি তোমাদের মধ্যে থাকতেই তোমরা আবার জাহিলি যুগের আচরণ শুরু করে দিয়েছ?’ তার এই বাক্যটি দীর্ঘ ও জ্বালাময়ী বক্তৃতার চেয়ে বেশি কার্যকরী হলো। উপস্থিত সকলেই তরবারি খাপবদ্ধ করে অনুশোচিত ও অশ্রুসিক্ত নয়নে নিজ নিজ অবস্থানে প্রত্যাবর্তন করল। তার কথার এই যাদুকরী প্রভাব সাময়িক ছিল না—ছিল স্থায়ী। তিনি যতদিন এই দুনিয়ায় অবস্থান করে গেছেন ততদিন এই গোত্রগুলোর মধ্যে আর কোনো শত্রুতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাব পরিলক্ষিত হয় নাই।

তিনি যে কী রকম সংক্ষিপ্ত সারকথা বলতেন তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ তার হাদিসগুলো। যেকোনো একটি হাদিস নিয়েই বিচার করুন না কেন, দেখতে পাবেন যে, হাদিসটি যেমন সংক্ষিপ্ত, তেমনই সাহিত্যের এক নয়া অবদান। আল্লাহর কালামের পরেই হাদিসের স্থান, আর হাদিস মানবরচিত সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন—কোনো কিছুই তার সমকক্ষতা দাবি করতে পারবে না।

সংক্ষিপ্ত ও সারকথা বলার আরও একটি দিক রয়েছে। তা হলো, যা-ই বলা হোক না কেন, উত্তমভাবে বলতে হবে; অর্থাৎ স্পষ্ট, বীর্যপূর্ণ, প্রত্যেকটি শব্দ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও গুছানো হওয়া দরকার। আল্লাহর নবীর (স) মধ্যে এর প্রতিটি গুণ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। তিনি যা কিছুই আর যতটুকুই বলতেন, এমনভাবে তা বলতেন যেন অতটুকু কথা বলাই তার সারাজীবনের কাজ। তিনি প্রতিটি শব্দের ওপরই জোর দিয়ে এবং প্রত্যেক বাক্যই কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করে কথা বলতেন। তিনি যা বলছেন, তা যেন পষ্ট শোনা যায়, সকলেই যেন তা উপলব্ধি করতে ও মুখস্থ করে নিতে সক্ষম হয়, অতঃপর যেন তা হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে আবার অপরের নিকট পুনরাবৃত্তি করতে পারে এবং শ্রোতা বা অন্য কেউ যেন তার গুরুত্ব লাঘব করতে না পারে এই সকল বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখেই যেন তিনি কথা বলতেন।

হজরত মুহাম্মদ (স) খুবই চিন্তামগ্ন থাকতেন; বারবার আসমানের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন, যেন মাথায় তার কীসের এক চিন্তা, তারই চূড়ান্ত রূপদানের জন্য অন্তরকে তিনি প্রসারিত করেছেন সর্বশক্তিমানের দিকে সাহায্যের প্রত্যাশায়।

তার গভীর নীরবতা ও স্বল্পভাষীতার জন্য খানিকটা দায়ী ছিল তার এই চিন্তামগ্নতা। কারণ, চিন্তা যখন সর্বাঙ্গে প্রভাব বিস্তার করে এবং মনমস্তিষ্ক থাকে সমাধান-অন্বেষায় নিমগ্ন তখন স্বভাবতই গাম্ভীর্য প্রাধান্য লাভ করে এবং বাকশক্তি মৌন হয়ে যায়। এছাড়া, তার এমন ফুরসতই-বা কোথায় ছিল যে অত অধিক কথা বলবেন। অতিরিক্তকথা বলা তো শূন্যমস্তিষ্ক ও চিন্তাশক্তিহীনতারই পরিচায়ক। সুতরাং যখন মনমস্তিষ্ক চিন্তাভাবনায় পরিপূর্ণ, তখন অতিরিক্ত কথা বলার উৎসাহ আসবেই-বা কোথা থেকে?

তিনি এমন ব্যথিতচিত্ত থাকতেন যে, সারা জীবনে কখনও তাকে উচ্চস্বরে হাসতে দেখা যায় নাই। কখনও কখনও স্মিত হাসতেন বটে, কিন্তু সে হাসিতেও বিষাদেরই বিদ্যুৎ চমকে উঠত, যেন এ কথা বলত যে, এই বিদ্যুৎ আনন্দের উচ্ছ্বাস নয়, বিষাদের মেঘমালা হতেই এটি বের হয়েছে।

তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধ্যানমগ্ন প্রকৃতির। এমনকি, সর্বকনিষ্ঠা স্ত্রী ও সৌন্দর্যের রানি বিছানায় রয়েছেন, বাহ্যত তাকে ভালোবাসা ও প্রীতির পরশেও আপ্লুত করে দিচ্ছেন—কিন্তু প্রিয়তমা স্ত্রী নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ার পরই তিনি ক্ষিপ্রগতিতে উঠে পড়ছেন এবং পবিত্রতা হাসিলের পর নামাজে দাঁড়িয়ে গেছেন। নামাজে দাঁড়িয়েছেন তো ভুলে গেছেন যে, প্রকৃত মাশুক ও প্রকৃত আরাধ্য ছাড়া আর কোনো কাম্য ও প্রিয়জন আছেন যিনি বিশ্বের সৌন্দর্য-ভান্ডার নিয়ে তার পাশেই পড়ে রয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী হিশাবে হজরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন : আল্লাহর নবী (স) যখন তাহাজ্জুদ নামাজে গভীরভাবে নিমগ্ন হয়ে পড়তেন তখন তিনি এক এক রাকাত এত লম্বা করতেন যে, আমি বারবার জাগ্রত হতাম এবং তার নামাজ শেষ হবার জন্য প্রতীক্ষা করতাম, প্রতীক্ষা করতে করতেই আবার ঘুমিয়ে পড়তাম, কিন্তু তার প্রথম রাকাত শেষ হতো না। তিনি যখন রুকুতে যেতেন, তখন মনে হতো যে, তিনি বুঝি দাঁড়াবার কথা ভুলেই গেছেন; আবার যখন রুকু থেকে দাঁড়াতেন তখন মনে হতো সেজদার কথা ভুলে গেছেন।

তিনি এত সজাগ ও হুঁশিয়ার ছিলেন যে গাছের একটি পাতা ঝরে পড়লেও তিনি তা টের পেতেন। প্রতিবেশীর কোনো শিশু কেঁদে উঠল, তিনি হয়তো তার কারণ অনুসন্ধানের জন্য নিজেই বের হয়ে পড়লেন। যুদ্ধের সময়ে অন্ধকার রাত্রে হয়তো অকস্মাৎ বাহির হয়ে গেলেন আর ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তৎক্ষণাৎ সমস্ত ফৌজের খবর নিয়ে ফিরে আসলেন। কারও মলিন মুখ দেখলেই তিনি অনুসন্ধান করে তার কারণ জেনে নিতেন; যদি জানতেন যে অমুক ব্যক্তি ক্ষুধার্ত রয়েছে, তাহলে তার খাবারের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত তিনি স্বস্তি পেতেন না।

আল্লাহর নবী (স) কঠোর পরিশ্রমী, পরম ধৈর্যশীল, অত্যন্ত সন্তষ্টচিত্ত এবং অত্যন্ত দৃঢ়সংকল্প ছিলেন। তিনি এত পরিশ্রমী ছিলেন যে, সকলে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও তিনি ক্লান্ত হতেন না। প্রতিদিন এত বেশি কাজ করতেন যা অন্যকারও পক্ষে করা মোটেও সম্ভব ছিল না। এমনকি, হয়তো লাগাতার কয়েকদিন উপোস ছিলেন, তারপরেও তিনি গৃহে নিজ দায়িত্ব এবং বাহিরের সকল কাজই সম্পন্ন করেছেন। এই অবস্থাতেও তিনি শিক্ষাদান, সংগঠন, নেতৃত্ব, বিচার, দর্শনপ্রার্থীদের সাক্ষাৎদান এবং লেনদেন—সকল কাজই সুষ্ঠুভাবে করেছেন। এত কিছুর পরেও শেষরাত্রে আবার দীর্ঘ এবাদতে এমনভাবে মগ্ন হয়ে পড়েছেন যে ভাবতেও বিস্ময়বোধ হয়। এমন ধৈর্য ও গাম্ভীর্যের সাথে তিনি এইসব কাজ সমাধা করতেন যে মুখে তার সামান্য ‘উহ’ শব্দও উচ্চারিত হতো না, যেন বুকে তার ব্যথার লেশমাত্রও নাই।

এরূপ অবস্থার মধ্যেও তার কাজ এমন নিখুঁত, সুন্দর, সুষ্ঠু এবং সময়মতো সম্পন্ন হতো যে, অন্যকারও পক্ষেই সেইভাবে তা সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। তিনি এত ধৈর্যশীল ছিলেন যে ভাষায় তার বর্ণনা সাধ্যাতীত। ‘কৃতজ্ঞচিত্ত’ বললে বরং তার ধৈর্যশীলতা সম্পর্কে কিছুটা আভাসমাত্র দেওয়া যায়। দুনিয়ায় কেই-বা এমন আছেন সারাজীবন যিনি রিক্ততার মধ্যেই অতিবাহিত করেছেন, সারাজীবন পরিশ্রমে লিপ্ত ছিলেন আর গোটা জীবনটাই কেবল বিপদ-আপদের মধ্যে কাটিয়েও সর্বদা কৃতজ্ঞচিত্ত এবং সারাজীবন সমান কর্মতৎপর ছিলেন, কখনও কোনো অভিযোগ করেন নাই। আর যিনি এমন একটি জাতির স্রষ্টা, যে-জাতি কঠোর পরীক্ষা ও গুরুদায়িত্ব পালনের সময়েও বিস্ময়কর কর্মমুখরতা ও অসীম ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন। সারা দুনিয়া ও গোটা মানবজাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এমন ব্যক্তির সংখ্যা খুব অল্পই দেখা যাবে।

তার পরিশ্রম ও কঠোর জীবনযাপনের কাহিনী এত প্রসিদ্ধ যে, তা বিস্তারিত তো দূরের কথা, সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করারও প্রয়োজন পড়ে না, তবু আমরা এখানে তার ‘যৎকিঞ্চিৎ’ আলোচনা করব।

পরিশ্রম

আল্লাহর নবী (স) নিজ হাতে স্বীয় পরিধেয় ছিন্ন বস্ত্ৰ সেলাই করতেন এবং জুতার তালি লাগাতেন। তিনি গৃহকর্মে সাহায্য করতেন, প্রয়োজনবোধে আটাও পিষতেন। কোনো খাদেমের সাহায্য নিলে তার পরিবর্তে তিনি খাদেমের কাজ করে দিতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মসজিদে ইমামতি করতেন। অতিথি, দর্শনপ্রার্থী, স্থানীয় ও নবাগত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎদান করতেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি স্বয়ং অভাবগ্রস্তদের নিকট গিয়ে তাদের অভাব-অভিযোগের বিষয় জেনে নিয়ে তা পূরণ করার চেষ্টা করতেন। শিক্ষাদান-কার্যেও তাকে ব্যাপৃত থাকতে হতো। কোথাও বিবাদ বাঁধলে সেদিকেও মনোযোগ দিতে হতো; উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে তিনি তার মীমাংসা করে দিতেন। যুদ্ধের সময়ে স্বয়ং সৈন্য সংগ্রহ ও ভর্তি করতেন, ঝাণ্ডা প্রস্তুত করতেন, আবার তা নিজ হাতে বিতরণও করতেন। বহু যুদ্ধে তিনি স্বয়ং অংশগ্রহণ করে সকল দুঃখ-ক্লেশের ভাগী হয়েছেন; কখনও-বা সরাসরি যুদ্ধও করেছেন। গনিমত বা যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ তিনি একত্র করাতেন, তারপর নিজ হাতেই তা ভাগবাঁটোয়ারা করতেন।

শিক্ষক ও প্রচারক তৈরি করে তিনি তাদেরকে নির্দিষ্ট স্থানে পাঠিয়ে দিতেন। শিক্ষক ও প্রচারকগণ যে-সংবাদ পাঠাতেন তা পরীক্ষা করে সেই সম্পর্কে নিজস্ব অভিমত গড়ে তুলতেন। সংকট উপস্থিত হলে তা দূরীকরণের উপায় উদ্ভাবনের চিন্তাভাবনা করতেন এবং সেই জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করতেন। তিনি বিচারক, শাসনকর্তা ও জাকাত-উশর আদায়কারী নিয়োগে করতেন; তাদেরকে বিশেষ উপদেশও দান করতেন। তিনি মেহমানদারি করতেন, ধর্মপ্রচারও করতেন। মক্কা এবং মদিনা উভয় স্থানেই তার ওপর ঐশীবাণী বা ওহি নাজিল হতো। তিনি এই ওহি গ্রহণ করতেন এবং তা সংরক্ষণ করাতেন। তিনি যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের অনুশীলনী করাতেন এবং নিজেও তাতে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি ক্ষুধার্তের জন্য অন্ন, বস্ত্রহীনের জন্য বস্ত্র, এবং উপায়হীনের জন্য জীবিকার্জনের ব্যবস্থা করে দিতেন। তিনি রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে দেখতে যেতেন, জানাজার নামাজ পড়াতেন, মৃত ব্যক্তির আত্মার মাগফেরাত কামনা করতেন। এছাড়াও তাকে আরও অসংখ্য বাতেনি বা অপ্রকাশ্য কার্যে লিপ্ত থাকতে হতো। এই বাতেনি বা অপ্রকাশ্য কার্যের সংখ্যাও এত অধিক যে তা বর্ণনা করতে গেলে এই গ্রন্থে স্থান সংকুলান হবে না। মোটামুটি এতটুকু উল্লেখ করলেই যথেষ্ঠ যে, তিনি একদিকে যেমন অন্তরকে সকল প্রকার কলুষ থেকে মুক্ত, পবিত্র এবং তাকে আলোকিত করার কার্যে ব্যাপৃত থাকতেন, তেমনই এমন সব গঠনমূলক কার্যে তিনি লিপ্ত থাকতেন যার সম্পর্ক কেবল বাতেনের সাথে, বাহিরের জগৎ যা আঁচ করতেও পারত না।

উল্লিখিত বর্ণনায় আল্লাহর নবীর (স) পরিশ্রমের কর্মসূচি শেষ হয় নাই। কারণ, এতে কেবল দিন ও সন্ধ্যা রাতের বিষয় উল্লিখিত হয়েছে, শেষরাত্রের বিষয় এখনও অবশিষ্ট রয়েছে। তার শেষোক্ত সময়ের কার্যও কম পরিশ্রমের ছিল না। এই পরিশ্রম এমন ছিল যে, তার হাত-পা অবশ হয়ে যেত। এটি ছিল তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়ের পরিশ্রম। তাছাড়া, সাধারণ মানুষ যে তাহাজ্জুদ আদায় করে থাকে এটি তেমন নামাজ ছিল না। তিনি যেমন অনুপম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন তেমনই তার তাহাজ্জুদও ছিল বিশেষ ধরনের। এর এক এক রাকাতে পবিত্র কোরআনের দুই-তিন পারা খতম হয়ে যেত। প্রতিটি রুকু ও সেজদাতেও কেটে যেত এক ঘন্টার চারভাগের একভাগ।

কষ্ট-সহিষ্ণুতা

এই সকল পরিশ্রমের পরেও ছিল কঠোর জীবনযাপনের পালা। মাসের পর মাস পেট পুরে খাবার জুটত না। যা মিলত তাও এমন নীরস, স্বাদহীন ও খাদ্যপ্রাণশূন্য যে, জীবনীশক্তি সতেজ না হয়ে দুর্বল হয়ে যাওয়ারই কথা এবং রক্তবৃদ্ধির পরিবর্তে তাতে রক্তশূন্যতাই বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। তার ওপর ছিল সর্বদা বিপদ-আপদ ও মানসিক নির্যাতন। মক্কায় অবস্থানকালে, যখন শারীরিক নির্যাতন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, গালিগালাজ ও অন্যান্য উপায়ে মানসিক পীড়নে তাকে ক্লিষ্ট করে তোলা হতো, সামাজিক জীবন হতে বিচ্ছিন্ন করে গৃহহীন, আত্মীয়-স্বজনহারা ও অসহায় করে দেওয়া হতো, কারও সাথে মেলামেশার এবং শিক্ষাদান, প্রচার প্রভৃতি কোনো কার্যেরই যখন সুযোগ দেওয়া হতো না, তার ওপরে আবার তার নিজের ও সাথীদের জীবনকে পদে পদে করে তোলা হতো কণ্টকাকীর্ণ, তখন এরূপ পরিশ্রমের সঙ্গে কঠিন বিপদ-আপদ মিলিত হয়ে ইস্পাতের মতো কঠিন হৃদয়কেও গলিয়ে পানি করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু হজরত মুহাম্মদ (স) ছিলেন এমনই মহান যে তিনি সবকিছুকেই সানন্দে ও সাহসের সাথে গ্রহণ করেছিলেন। মদিনায় অবস্থানকালে অনবরত যুদ্ধ, অহরহ প্রাণহানির আশঙ্কা, দলীয় লোকদের জীবনধারণ উপযোগী সম্বলও না থাকার স্থায়ী সমস্যা, প্রচারকদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যার বিষাদজনক ঘটনা, সন্ধিচুক্তি ভঙ্গের ফলে সৃষ্ট অসুবিধা, বেদুইন গোত্ৰসমূহের অপ্রত্যাশিত হামলা, ইহুদিদের ষড়যন্ত্র, মুনাফেকদের বারবার চক্রান্ত, মক্কায় অবস্থানকারী মুসলমানদের নির্যাতনের সংবাদ ও তার প্রতিকারের চিন্তা—এসবের মোকাবেলায় যেকোনো মানুষের পক্ষেই নিস্তেজ হয়ে পড়ার কথা। কিন্তু তিনি ছিলেন এমনই সতেজ যে, সবকিছুকে তিনি হাসিমুখে ও বীরত্বের সাথে শুধু বরণই করেননি, সকল সংকট অতিক্রম করে নিজেকে এমন পর্যায়ে উপনীত করেছিলেন যেখানে সকল দুঃখ-কষ্টের অবসান হয়ে গেছে, সকল কাঁটা ফুল হয়ে ফুটে উঠেছে। তিনি স্বয়ং তাতে না থাকুন, কিন্তু তিনি যে-জাতির স্রষ্টা তাদের হস্তগত হয়েছে চিরন্তন আনন্দ ও স্থায়ী স্বাচ্ছন্দের এক মহান সামগ্রী, যার কোনো তুলনা এই ধরাধামে হতে পারে না। তিনি নিজে না থাকুন, কিন্তু তারই বদৌলতে অর্জিত হয় সেই ‘মাকামে মাহমুদ’ বা উচ্চপ্রশংসিত অবস্থান—যার কল্পনাও কোনো মানুষ কখনও করতে পারত না।

সন্তুষ্টচিত্ততা

আল্লাহর নবী (স) এমন সন্তুষ্টচিত্ত ছিলেন যে, এক মহারাজ্যের একচ্ছত্র ও প্রতাপশালী অধিপতি এবং শাসক হয়েও কম্বল-চাটাই ও মসজিদের ছোটো কামরা আর খাদ্যের মধ্যে ছাতু এবং খেজুর সম্বল করেই গোটা জীবন অতিবাহিত করে গেছেন। তার এই সন্তুষ্টচিত্ততা কোনো সাময়িক বিষয় ছিল না। অভাব-অনটন এবং বিত্তশালিতা উভয় অবস্থায়ই তার এই বৈশিষ্ট্য সমভাবে উজ্জ্বল ছিল। মক্কার অলিতে গলিতে যখন তিনি নিঃস্ব ও সম্বলহীন অবস্থায় ঘুরতেন এবং মদিনায় উপস্থিতির পর যখন তার ও তার সঙ্গীদের জীবনধারনের কিছুমাত্র সম্বল ছিল না, তখন যেমন তার মধ্যে সন্তুষ্টচিত্ততা বিরাজ করত, তেমনই তার সন্তুষ্টি জগৎবাসী তখনও প্রত্যক্ষ করেছে যখন সমগ্র আরবের ধনদৌলত চারদিক থেকে বন্যা-বেগে মদিনার সেই দীনহীন সুলতানের পদতলে এসে লুটিয়ে পড়ছিল। এতে এই সত্যটিও উপলব্ধি করা যায় যে, এই সন্তুষ্টচিত্ততা উপার্জনবিমুখ সুফির নির্লিপ্ততা বা নিঃস্ব অথচ ভোগাসক্ত ব্যক্তির গত্যন্তরহীনতা থেকে উদ্ভূত ছিল না। এটি ছিল বিত্তবান রাজ্যাধিপতির সন্তুষ্টচিত্ততা। এর মূল্য নির্ণয় সহজসাধ্য নয়। তার এই সন্তুষ্টচিত্ততা স্বভাবতই একক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ও পরম সৌকর্যমণ্ডিত; এটি সেই সন্তুষ্টচিত্ততারই অভিব্যক্তি ইসলাম সব সময় যার অনুপ্রেরণা যুগিয়ে থাকে। সম্বলহীনতা ও গত্যন্তরহীনতা-উদ্ভূত সন্তুষ্টচিত্ততা বরং এর বিপরীত জিনিশ; এইগুলো অভিপ্রেত ও প্রশংসিতও নয়। প্রকৃতপক্ষে এইগুলো সন্তুষ্টচিত্ততাই নয়—তার প্রহসনমাত্র।

তিনি অত্যন্ত উচ্চাভিলাসী ছিলেন, এমন পর্যায়ের উচ্চাভিলাসী যে, পার্থিব ক্ষেত্রে নিঃস্ব ও অসহায় অবস্থা থেকে একাধারে রাজ্যাধিপতি ও তর্কাতীত নেতৃত্বের উচ্চাসনে সমাসীন হয়েও তিনি তার অভিলাস তুরঙ্গের গতিকে শ্লথ হতে দেননি; বরং অভিলাস ও অভিযানের গতিবেগ তীব্র হতে তীব্রতর করেছেন এবং সমগ্র ধরণীর আধিপত্য ও নেতৃত্ব লাভের জন্য প্রকাশ্যে দাবি জানিয়ে নিকটতম সকল রাজ্যের অধিপতি ও শাসকদের নিকট এই বলে চিঠি প্রেরণ করেন যে—‘আসলিম তাসলাম’, অর্থাৎ ‘আনুগত্য বরণ করো, তবে মুক্তি পাবে।’

অপরদিকে, আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে মেরাজের সৌভাগ্য অর্জন করেও তার আধ্যাত্মিকতার অভিলাস-অভিযান নিবৃত্ত হয় নাই। অথচ, আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে মানবজাতির ইতিহাসে মেরাজের কোনো তুলনাই নাই। তবু তার এই পিপাসা যেন ক্রমশ বৃদ্ধিই পাচ্ছিল। কেবল আল্লাহ ও আল্লাহর রসুলই জানতেন, মেরাজের পরেও সান্নিধ্য ও সৌকর্যের কোনো মোকাম অবশিষ্ট ছিল যার কামনা তাকে অধীর করে রাখত। হতে পারে, এই জড়জগতে যা লভ্য নয় মিলন ও আসক্তির তেমনই এক ‘মোকাম’ লাভই তার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল; আর, সেই কামনাই তার মতো পরম উচ্চাভিলাসীকে হরহামেশা অধীর করে রেখেছিল।

ভদ্রতা

আল্লাহর নবী (স) অতি ভদ্র, অত্যন্ত নম্র, পরম মার্জিত ও দয়ার্দ্র স্বভাবের ছিলেন। তিনি এমন ভদ্র ছিলেন যে, কেউ গালি দিলে তা চুপ করে শুনতেন, প্রত্যুত্তরে মুখ খুলতেন না। কেউ আঘাত করলেও প্রতিবাদ করতেন না বা অভিশাপ ও গালি দিতেন না। কখনও যদিও-বা মুখ খুলতেন তা গালি বা অভিশাপ দেওয়ার জন্য নয়, গালিদাতার মঙ্গল ও কল্যাণ কামনার জন্যই। এমনকি, সঙ্গীরা অভিশাপ দেওয়ার জন্য তাকে পীড়াপীড়ি করলে তদুত্তরে তিনি বলেছেন : ‘অভিশাপ দেওয়ার জন্য নয়, মঙ্গল ও কল্যাণ কামনার জন্যই আমার আগমন হয়েছে।’

কোনো সময় তার জন্য জীবন উৎসর্গকারীদের কেউ অভিশাপ বা মন্দ বলার জন্য মুখ খুললে তৎক্ষণাৎ তিনি তাকে বারণ করতেন এবং বলতেন: ‘এটি মুমিনের মর্যাদার যোগ্য কাজ নয়।’

একবার তো তিনি ভদ্রতার এমন চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন যে, প্রত্যক্ষদর্শীরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধক্ষেত্র কারও অস্ত্রের আঘাতে তার দাঁত পড়ে গেছে। এর মধ্যে কপালেও আঘাত লেগেছে এবং ক্ষতস্থান হতে নির্গত রক্তধারা গণ্ডদেশ বেয়ে চলছে। তিনি এই অবস্থায় রক্ত মুছছেন আর বলছেন : ‘হে খোদা তুমি আমার জাতিকে সত্যপথ প্রদর্শন কর। তারা অবুঝ।’

তিনি এত দয়ার্দ্রচিত্ত ছিলেন যে মানুষ যেমন মৃত ব্যক্তির জন্য কেঁদে থাকে তিনিও জীবজন্তুর কাঁদনে তেমনই কেঁদে ফেলতেন। অসহায় বৃদ্ধলোক দেখলে তার হৃদয় দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠত। নিঃসহায় পিতা-মাতৃহীন বালক-বালিকার দুঃখবেদনায় তিনি কাতর হয়ে পড়তেন। অভাবগ্রস্তের দীর্ঘশ্বাস তার বুকে শেলের মতই বিঁধত।

শিষ্টতা

তিনি এত শিষ্ট ছিলেন যে, সারা জীবনেও কখনও একটি কটু বাক্য তার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়নি কিংবা একটি অভদ্র আচরণও তার কার্যকলাপে প্রকাশ পায়নি। অসামাজিক বা শিষ্টাচাবিরোধী একটি কার্যও তার সমগ্র জীবনে পাওয়া যাবে না। তিনি যে কেবল সভা-সমাবেশ ও মানুষের সামনেই শিষ্টাচার করতেন তা নয়, বরং গৃহাভ্যন্তরে এবং একা অবস্থানকালেও তার শিষ্টতা বজায় থাকত।

তবে এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তিনি কোন ধরনের শিষ্টাচার-অনুসারী ছিলেন এবং সেই শিষ্টতার মাপকাঠিই-বা কী ছিল? বিষয়টি স্বতন্ত্রভাবে আলোচিত হওয়া উচিত। এই গ্রন্থেরই অন্যত্র এর বিশদ আলোচনা করা হবে। এখানে শুধু এইটুকু জেনে রাখলেই চলবে যে, আল্লাহর নবী (স) শিষ্টতা ছিল রব্বানি শিষ্টতা। তিনি অত্যন্ত প্রসন্নচিত্তের অধিকারী ছিলেন। তার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে এমন কেউই বলতে পারবেন না তিনি হজরতের মৃদু-হাস্য উদ্ভাসিত মুখের অভ্যর্থনা লাভ করেন নাই।

তার এই প্রসন্নতা কেবল বন্ধুদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না, শত্রুদের সাথেও তিনি অনুরূপ প্রসন্নতাই প্রদর্শন করতেন। আত্মীয়-অনাত্মীয়, পরিচিত-অপরিচিত, ধনী-নির্ধন, বিত্তবান ও দুঃস্থ-কাঙাল—সর্বশ্রেণির লোকের জন্যই তার প্রসন্নচিত্তের দুয়ার সদাসর্বদা উন্মুক্ত থাকত এবং সকলকে এর মাঝে আশ্রয়দানের জন্য আগ্রহে প্রতীক্ষা করত। এইখানে এসে সকলেই সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করত যে এই একমাত্র আশ্রয়স্থল যেখানে কেবল মনুষত্বই মর্যাদা পেয়ে থাকে এবং যেকোনো সৃষ্টজীবই আশ্রয় পেতে পারে। এখানে সকল ভেদাভেদ বিলুপ্ত, সকল শ্রেণি-বৈশিষ্ট্যও অনুপস্থিত—এখানে হীন চাকরও মর্যাদাবান এবং নিঃস্ব দিনমজুরও সম্মানিত। এখানে রাজা হিশাবে কেউ অধিক সম্মান পাবে না, বা সুন্দর চেহারাবিশিষ্ট হওয়ার জন্য কেউ উত্তম ব্যবহার লাভ করবে না। এখানে ছোটোর প্রতি বড়োর তাচ্ছিল্যভাব প্রদর্শনের সুযোগ নাই—ছোটোও নিজেকে বড়োর চেয়ে হেয় জ্ঞান করবে না। মোদ্দাকথা, এইস্থানে সকলেই এক সমান—সকলেই এক ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ। সৃষ্টির দিক থেকে এই ভ্রাতৃত্ব মানবতার ভ্রাতৃত্ব।

কর্তব্যনিষ্ঠা

আল্লাহর নবী (স) পরম কর্তব্যনিষ্ঠ, পরম সুশৃংখল, খুব স্থির এবং অত্যন্ত বাহুল্যবর্জিত ছিলেন। তিনি এমন কর্তব্যনিষ্ঠ ছিলেন যে, কঠিন থেকে কঠিনতর বিপদ এবং খুব আনন্দের সময়েও স্বজ্ঞানে ‘অবশ্যকর্তব্য’ থেকে দূরের কথা ‘সাধারণ কর্তব্য’ থেকেও বিচ্যুত হন নাই। তিনি এমন সুশৃঙ্খল ছিলেন যে ছোটো-বড়ো, পার্থিব-অপার্থিব, স্থায়ী-অস্থায়ী, ব্যক্তিগত বা সামাজিক এবং অবশ্যকরণীয় বা ইচ্ছাসাপেক্ষ—যেকোনো কাজেই হাত দিয়েছেন, তা সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করেছেন এবং এমন সুশৃঙ্খলভাবে কাজে হাত দিয়েছেন যে ব্যর্থতার সম্ভাবনাও তার সীমারেখায় পৌঁছতে পারে নাই। তাই দেখা যায় তিনি যে-কাজেই হাত দিয়েছেন তা-ই সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে—মৃত্তিকায় স্পর্শ করলে তা স্বর্ণে পরিণত হয়েছে! এই প্রসঙ্গে তার জীবনের প্রথম যুদ্ধ, যা বদরের যুদ্ধ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, তার কথাই উল্লেখ করা যায়। তিনি প্রথম যুদ্ধটিই এমন সুশৃঙ্খলভাবে শুরু করলেন যে, শত্রুপক্ষের সংখ্যাধিক্য সংখ্যালঘুত্বে রূপান্তরিত হলো এবং অধিকতর শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও শত্রুপক্ষকে পরাজয় বরণ করতে হলো।

তিনি স্বয়ং যোদ্ধাদের এমনভাবে সারিবদ্ধ করান যেন ‘সীসা ঢালা প্রাচীর’ দাঁড় করানো হয়েছে। তিনি নিজেও অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত, এমনকি, তিনি সৈনিকবেশও পরিধান করেছেন। একজন নবীর জন্যে এটা সুশোভন হোক বা না হোক—একজন সেনাপতি এবং ফিল্ড মার্শালের জন্য সুশোভন তো বটেই, অপরিহার্যও।

এই যুদ্ধে তার নিখুঁত, নিপুণ ব্যবস্থাপনার প্রতি আরও দৃষ্টিনিবদ্ধ করলে দেখতে পাবেন যে, জাগতিক ও বাহ্যিক ব্যবস্থা অবলম্বন করার পরও তিনি মুনাজাতের সুযোগটি বৃথা যেতে দেন নাই। কিন্তু তার ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে জড়জগৎ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জাগতিক প্রচেষ্টার তুলনায় মুনাজাতের ওজন ছিল এক আনা। মানে পনের আনাই জাগতিক প্রচেষ্টা, বাকি এক আনা মুনাজাত। অথচ এই ঘটনার দিবস থেকে আজ পর্যন্ত অপূর্ণবুদ্ধির ব্যক্তিরা একটি মস্ত বড় ধোঁকায় নিপতিত রয়েছেন যে, তারা মনে করেন তার ব্যবস্থাপনায় মুনাজাতই ছিল মূল—বাকি এক আনা ছিল জাগতিক প্রচেষ্টা। তাদের মতে, জাগতিক প্রচেষ্টা সংশ্লিষ্ট বিষয় মাত্র, অথচ ব্যাপারটি ছিল সম্পূর্ণ তার বিপরীত। পূর্ণবুদ্ধি ব্যক্তির নিকট ব্যাপারটি দিবালোকের মতোই স্পষ্ট; কারণ, ঘটনাটি এই ছিল যে যুদ্ধের যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জামই জোগাড় করা হয়েছিল এবং তা সুবিন্যস্তভাবে সম্মুখে রাখা হয়েছিল। তারপর মুনাজাতের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সুতরাং, মুনাজাত মূল ছিল না—তার মর্যাদা ছিল পরিশিষ্টের। বড়জোর আমরা এইটুকু বলতে পারি যে মুনাজাতের মাধ্যমে উক্ত ব্যবস্থাপনার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছিল।

স্থৈর্য

লক্ষ্যের দিকে তিনি এত স্থির ছিলেন যে যতরকম হট্টগোল, গণ্ডগোল ও প্রতিকূল অবস্থায়ই নিপতিত হোন না কেন, যত আনন্দপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক পরিবেশেই তিনি থাকুন না কেন, তিনি তার লক্ষ্য থেকে সরে যাননি। বিবাহানুষ্ঠান, ভোজসভা, অভ্যর্থনানুষ্ঠান, গান-বাজনা কিংবা অন্য প্রকারের ধূমধামের মধ্যেও তার উদ্দেশ্য ঠিক রয়েছে এবং তিনি তার শিক্ষাদান কার্য অব্যাহত রেখেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে মারামারি কাটাকাটি চলছে, তিনি আহত হয়ে পড়েছেন, হয়তো-বা ক্ষুধায় কাতর বা নিঃসম্বল অবস্থায় পতিত হয়েছেন—কিন্তু লক্ষ্য তার স্থির আছে এবং শিক্ষাদান ও প্রচারকার্য সমান গতিতেই এগিয়ে চলছে। ওহুদের যুদ্ধে যখন পরাজয় স্পষ্ট, তিনি গর্তে আহত অবস্থায় পড়ে আছেন। কিন্তু যেইমাত্র শত্রুপক্ষের সৈন্যগণ লাত-হুবল মূর্তির নামে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠেছে, ঠিক তখনই তার পরম লক্ষ্যের কথা মনে পড়ে গেছে। তিনি ঝড়োগতিতে অস্ত্রসজ্জিত সকল সাহাবিকে একত্র করে আল্লাহর নামে তাকবির (জয়ধ্বনি) দিতে শুরু করেন। তায়েফে ধর্মপ্রচার-অভিযানে বের হয়ে ব্যর্থতার বোঝা নিয়ে আহত অবস্থায় ফেরার সময় ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত দেহ নিয়ে তিনি একটি বাগানে এসে উপস্থিত হন। এমন সময় বাগানরক্ষক এসে তার এই অবস্থা দেখে অনুগ্রহপূর্বক ফল খেতে বলেন। কিন্তু এমন অবস্থাতেও তিনি লক্ষ্য ভুললেন না। ফলের জন্য হাত বাড়াবার আগে তিনি বাগানরক্ষককে ধর্মের দাওয়াত দিলেন। অবশেষে তাকে জয় করে, অর্থাৎ ইসলাম কবুল করিয়ে ফল ভক্ষণ করেছেন।

বিজয়ীর বেশে তিনি মক্কা প্রবেশ করছেন। আনন্দ ও খুশির মৌজ উঠেছে। কিন্তু তিনি তার লক্ষ্যে স্থির ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন রয়েছেন। তাই আমরা দেখতে পাই তিনি উটের পিঠে অবনত মস্তকেই তসবিহ-তাহলিল পাঠ করতে করতে মক্কা প্রবেশ করছেন। এটা এইজন্য—উম্মতগণ ও জগৎবাসী প্রত্যক্ষ করুক এবং এই শিক্ষাই লাভ করুক যে বান্দা যত আনন্দেই থাকুক না কেন, তাকে কখনও তার স্রষ্টার কথা ভুললে চলবে না, এবং তার এবাদত-বন্দেগি থেকে বিরত থাকা চলবে না।

তিনি অনর্থক বাহুল্য কথা বলতেন না; ফলে জীবনভর যা কিছু তিনি বলেছেন তার প্রতিটি কথাই মূল্যবান, প্রতিটি বাক্যই সারসংক্ষেপ। রীতি, নীতি, বিধান ও জীবনপদ্ধতি ব্যাখ্যার মধ্যেই তার কথা সীমাবদ্ধ। সেই জন্যই তার প্রতিটি কথা, ‘প্রতিটি বাক্যকে এমন অমূল্য ধন হিশাবে হেফাজত করা হয়েছে। তার কোনো একটি বাক্যকেও অনাবশ্যক বলে গণ্য করার অবকাশ পর্যন্ত ছিল না। এ কারণে তার কোনো একটি কথা ও বাক্যকেও বিস্মৃতির অতলে ডুবিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি।

হজরত খুবই লজ্জাশীল, অতিশয় ধর্মনিষ্ঠ এবং পরম পূণ্যবান ছিলেন। একমাত্র সম্ভ্রান্ত বংশীয় যৌবনবতী কুমারীর লজ্জার সাথেই তার লজ্জার তুলনা করা যেতে পারে।

ধর্মনিষ্ঠা

তার ধর্মনিষ্ঠতার কয়েকটি উদাহরণ দিই। একদিন তিনি বায়তুল মালের (রাষ্ট্রীয় অর্থভান্ডার) কিছু স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা বণ্টন করছিলেন। সব বণ্টনের পর তার কাছে কোনো ক্রমে কয়েকটি মুদ্রা রয়ে গেছি, কিন্তু ভুলবশত তা বায়তুল মালে রাখার আগেই তিনি গৃহে প্রবেশ করেন। কিন্তু যেইমাত্র তা মনে পড়েছে, অমনি বিদ্যুৎ বেগে বের হয়ে সেই মুদ্রাগুলি বায়তুল মালে গচ্ছিত রেখে তারপর গৃহে প্রবেশ করেন। এর অর্থ এই ছিল যে অপরের হক এক ঘণ্টা বা দুই ঘণ্টার জন্যও নিজের কাছে রাখা তিনি সমীচীন মনে করেন নাই।

একবার তিনি সফর থেকে ফিরে ছোটো মেয়ে হজরত ফাতেমার (রা) ঘরে সর্বপ্রথম উপস্থিত হন। কিন্তু যখন তিনি দেখতে পেলেন তাদের ঘরের দরজায় নকশা-আঁকা পর্দা ঝুলছে এবং নাতিদের একজনের বাহুতে সোনার বাজুবন্দ শোভা পাচ্ছে, তখনই তিনি ফিরে গেলেন, যেন এই অবস্থায় কন্যার ঘর আর দর্শনের যোগ্যও নাই! অবশ্য, পরে যখন তিনি শুনতে পেলেন যে সেই নকশা-আঁকা পর্দাটি ছিঁড়ে খণ্ড খণ্ড করে ফেলা হয়েছে এবং নাতির বাহু থেকে সেই সোনার বাজুবন্দ খুলে ফেলা হয়েছে, তখন তিনি ঠিক আগের মতোই উদ্বেলিত চিত্তে ও স্নেহার্দ্র হৃদয়ে কন্যার ঘরে প্রবেশ করেন।

মহিলাদের নিকট হতে ‘বায়আত’ গ্রহণকালে তিনি কখনও তাদের হাত স্পর্শ করতেন না; বরং কাপড়ের সাহায্যে বায়আত গ্রহণ করতেন। অথচ এ জগতে তার মনের চেয়ে আর কার মনেরই-বা বেশি তুষ্ট, তৃপ্ত ও সংযত হওয়া সম্ভব?

তিনি এত পূণ্যবান ছিলেন যে, তার নিকৃষ্টতম শত্রুকে সাহায্য করে সওয়াব হাসিল করতে হলেও তিনি আগ্রহ ও উৎসাহের সাথেই তা করেছেন। মুনাফেকপ্রধান আবদুল্লাহ বিন উবাই ছিল তার নিকৃষ্টতম শত্রু। সে মারা গেলে তিনি নিজের পোশাক পাঠিয়ে দিলেন, সাথে বলে দিলেন এই পোশাকটিকে যেন তার কাফনের অংশ বানানো হয়, যাতে তার কবরের শাস্তি লঘু হয়।

একবার কোনো যুদ্ধে মুসলিম সৈন্যগণ শত্রুদের খাদ্যদ্রব্য অবরোধ করে ফেলেছিল। কাফেররা নিরুপায় হয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল : ‘আমাদেরকে কি না খেতে দিয়ে মেরে ফেলতে চাও?’ এই কথা শোনার সাথেসাথে তিনি অবরোধ তুলে নেন। এর তাৎপর্য তো এই যে, ‘ভাইসব, তোমাদেরকে অনাহারে মরতে দিতে পারব না। যদিও তোমরা আমাদের মারার ফিকিরে রয়েছো।’

ক্রোধ

ক্রোধ তার মধ্যেও ছিল, কিন্তু কখনও তার অহেতুক ক্রোধের উদ্রেক হয় নাই। কখনও ক্রোধের উদ্রেক হলে তা সঙ্গত কারণেই হয়েছে। ঘটনাক্রমে কখনও তার ক্রোধের উদ্রেক হলেও তা মানসিক ভারসাম্যের বিপর্যয় ঘটিয়ে তাকে অপ্রকৃতিস্থ করে তুলতে সক্ষম হয় নাই। রাগের বশীভূত হয়ে তিনি কখনও উত্তেজিত হয়ে উঠেন নাই বা কখনও মাথা ঝাঁকিয়ে কথা বলেন নাই; কিংবা রাগের কারণে শরীরের রগ ফুলে ওঠা বা হাত-পা কাঁপা—এই ধরনের কিছুই তার হয়নি। যত ক্রোধই তার মনে জমা থাকুক না কেন, মুখে কখনও তা অসংযতভাবে প্রকাশ পায়নি। রাগের সময় কেবল তার চেহারা রক্তিম হয়ে উঠত এবং গলার স্বরটি একটু ভারী বোধ হতো। যদি কখনও-বা তার মুখ থেকে কঠিন-কর্কশ বাক্য উচ্চারিত হয়েছে তা কেবল ধর্মের বিরোধিতায় যারা সীমাতিক্রমী ছিল তাদের উদ্দেশ্যে হয়েছে।

আত্মমর্যাদা

তার আত্মমর্যাদাবোধ ছিল অতিশয় তীক্ষ্ণ; কিন্তু উপযুক্ত ক্ষেত্রেই তা প্রকাশ পেত, অনুপযুক্ত ক্ষেত্রে নয়। আনন্দ অনুভবের ক্ষমতাও তার যথোপযুক্ত পরিমাপেই ছিল। মধুর আওয়াজ ও আনন্দদায়ক কাজের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হতেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু তার এই আকর্ষণ এমন কোনো স্থানে কেন্দ্রীভূত হতো না যা অশোভনীয়। তা ছাড়া, এই আনন্দ অনুভূতি তার গাম্ভীর্যকে কখনও সামান্যতমও হালকা করে দিতে পারত না। অনিচ্ছাক্রমে অপর কোনো রমণীর ওপর দৃষ্টি পড়ে গেলে তাতে তার নফস যে প্রভাবিত হতো না তা নয়; কিন্তু কখনও দ্বিতীয়বার তিনি সেই দিকে চোখ তুলে তাকাতেন না। এটা তো ছিল তার পবিত্রতা রক্ষার বাহ্যিক বিধি; কিন্তু অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা রক্ষাবিধি অনুযায়ী কখনও কখনও তৎক্ষণাৎ তিনি স্ত্রীদের নিকট চলে যেতেন এবং তাদের মধ্যে কোনো একজনের সাথে অন্তঃপুরে সময় কাটিয়ে মনকে পবিত্র করে নিতেন। সুমধুর কোনো ধ্বনি কানে আসলে তাতে তিনি বাধা দিতেন না, কিন্তু সেই ধ্বনি দ্বিতীয়বার শুনতে চাইতেন না। এই জন্য দেখা যায়, সারা জীবনে কেবলমাত্র তিনি একবার সংগীত শ্রবণ করেছেন: তাও তারই সংবর্ধনা উপলক্ষে। তবে হ্যাঁ, একটি সংগীত ছিল যা তিনি রোজানা পাঁচবার শুনতেন, উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে মুগ্ধ হয়েই তা শুনতেন। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কে আছে যে এই সংগীত শোনার জন্য তার চারিত্রিক দুর্বলতা আবিষ্কার করতে সক্ষম হবে? এই সংগীত ছিল মুয়াজ্জিন হজরত বেলালের (রা), যা আজানের মধ্য দিয়ে কানে মধু ঢালত। এই ধ্বনি এমনই ছিল যে তা বড় বড় সুর-সম্রাট ও স্বরধ্বনির সমঝদারকেও অন্য সংগীত হতে উদাসীন করে তার প্রতি আকৃষ্ট করে তুলত। এরপর এই ধ্বনির আমেজ বহন করেই তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন, সেখানে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে লাভ করতেন চিত্তের পরিপূর্ণ প্রসন্নতা।

নৃত্যও একদিন তিনি দেখেছিলেন, কিন্তু সে নৃত্য মেয়েদের নয়, পুরুষদের। যদিও তিনি তা আর দ্বিতীয়বার করতে দেন নাই। তা ছাড়া, এই সবের সময় কিংবা তার জীবনের লক্ষ্যের সাথে এইগুলোর সামঞ্জস্যই-বা ছিল কোথায়?

জীবনোপভোগ

আল্লাহর নবীর (স) মধ্যে উপভোগস্পৃহাও ছিল—যেমন উত্তম খাদ্য, উত্তম বস্ত্র, উত্তম সুগন্ধি ও উত্তম যানবাহন তার পছন্দনীয় ছিল। কিন্তু তাই বলে এইসব ‘উত্তম কিছুতে’ তার চিন্তা কেন্দ্রীভূত হতো না। কখনও কখনও তিনি বলে ফেলতেন : ‘মাংস খাবারের মধ্যে প্রধান খাবার’, ‘সিরকা খুব ভালো জিনিশ’, ‘খেজুর উৎকৃষ্ট’, ‘মধুও উত্তম’ এবং ‘দুধের মধ্যে আরোগ্যের উপাদান বিদ্যমান’। ইয়েমানি চাদর তিনি পছন্দ করতেন। খোশবুও খুব ভালবাসতেন। এসব জিনিশ কখনও পেলে তা তিনি আনন্দের সাথেই গ্রহণ করতেন এবং স্বচ্ছন্দেই উপভোগ করতেন। কিন্তু এসব জিনিশ পাওয়ার অন্বেষণে তিনি কখনও মন-মগজ নিয়োজিত করতেন না। কিংবা এসব পাওয়ার জন্য এরূপ লালায়িতও থাকতেন না যে তা অপরের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, সময়ের অপচয় হবে, সামান্যতমও লক্ষ্যচ্যুতি ঘটবে কিংবা প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধনের পথে তা এতটুকুও বাধা সৃষ্টি করবে। অথবা এসব জিনিশের প্রতি এমন আকর্ষণও তার ছিল না—না-পাওয়ার বেদনায় তা তার মানসিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে ফেলতে পারে, গাম্ভীর্যে সামান্যতমও চাঞ্চল্য আনয়ন করতে পারে কিংবা এসব পাওয়ার চেষ্টা তার ব্যক্তিত্বকে কিঞ্চিৎ খাটো করে ফেলতে পারে।

বহুবিবাহ

এ কথা অবশ্যই সত্য যে বহুবিবাহের আকাঙ্ক্ষাও তার মধ্যে ছিল। কিন্তু এও তো ঠিক যে, এই আকাঙ্ক্ষাকে তিনি পঁয়তাল্লিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত দাবিয়ে রেখেছিলেন। অথচ, এটাই ছিল এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রকৃষ্ট সময়। এসময়ে তার আকাঙ্ক্ষা কমজোর ছিল এবং সেইজন্য তিনি তা দাবিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন—তাও ঠিক নয়; বরং, প্রকৃত উদ্দেশ্যের ধ্যান তথা সত্যের চরম মার্গে উপনীত হওয়ার কামনাই এই সময় অপেক্ষাকৃত প্রবল ছিল। এই জন্যই তার প্রথম বিবাহটি সম্পন্ন হয়েছিল অনাসক্তির মধ্য দিয়ে। না ছিল কোনো চাহিদা, না ছিল কোনো আকাঙ্ক্ষা। এটি ছিল কেবলমাত্র ‘প্রস্তাব’ ও ‘গ্রহণের’ একটি আনুষ্ঠানিক কার্য। অবশ্য এও সত্য যে প্রথম স্ত্রী জীবিত থাকাকালীন তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন নাই। এর কারণ এই নয় যে, আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা আপনাআপনিই স্তিমিত হয়ে পড়েছিল, প্রকৃত ব্যাপার হলো প্রথম স্ত্রী তার মনে উচ্চস্থান লাভ করেছিল। তার ওপরে ছিল চিরসত্য ও সুন্দরের জন্য তার প্রবল প্রেমাসক্তি। এও সত্য যে প্রথম স্ত্রীর ইন্তেকালের পরেও কিছুদিন সেই আকাঙ্ক্ষাকে তিনি দমন করে রেখেছিলেন; কিন্তু তার কারণও এ নয় যে এ সময় তার আকাঙ্ক্ষা নির্জীব হয়ে পড়েছিল। বরং এটি ছিল তিনি যে ইনকিলাব ঘোষণা করেছিলেন তার প্রথম পর্যায়ের এমন একটি চূড়ান্ত স্তর অতিক্রমণের সময়—যখন যেকোনো মুহূর্তে সমগ্র ব্যাপারটিই যেকোনো দিকে গতি পরিবর্তন করতে পারত। সুতরাং, এমনই সংকট-সন্ধিক্ষণে কোনো কামেল মানুষের পক্ষে কী করে এ সম্ভব যে তিনি কোনো ক্ষণভঙ্গুর আকাঙ্ক্ষাকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে দিবেন, সেই আকাঙ্ক্ষাটি যত বৈধ এবং যত প্রয়োজনেরই হোক না কেন! এমন কাজ অপরিপূর্ণ বা ‘নাকেস’ মানুষের পক্ষে সম্ভব হতে পারে; কিন্তু হজরত তো কেবল কামেলই ছিলেন না, তিনি ছিলেন কামেলের ওপরেও কামেল—সর্বাপেক্ষা পূর্ণ মানব।

অতঃপর এই সকল বাধাবিঘ্ন অপসারিত হলো এবং পদার্পণ করল এক নতুন যুগ। এটি প্রথম যুগের তুলনায় যুদ্ধ-বিগ্রহ-ক্লিষ্ট ও সংশয়-সংকটপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এর ভিত্তি ছিল স্বস্তি ও শান্তির প্রলেপে আচ্ছাদিত; কারণ, ইতোমধ্যেই হুকুমতের বাহ্য ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। এখন বাকি ছিল কেবলমাত্র তাকে দৃঢ়-ভিত্তির ওপর শক্তিশালী করে তোলা ও তাতে স্থিতিশীলতা আনা। অপরদিকে, সাহায্য ও বিজয়ের সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতিসহ আল্লাহর নির্দেশও ইতিমধ্যেই অবতীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এই প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাসবাণীর চেয়ে তার কাছে অধিকতর স্বস্তি ও শান্তিপ্রদ আর কিছুই হতে পারত না। এই সময়েই তার পূর্বোক্ত আকাঙ্ক্ষা প্রবলভাবে আত্মপ্রকাশ করে। এ ব্যাপারে তাকে পূর্ণস্বাধীনতাও প্রদান করা হয়েছিল এবং এতে বাধা-নিষেধ আরোপেরও কোনো কারণ বিদ্যমান ছিল না। কেননা এই আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ সত্ত্বেও এর সাধ্য ছিল না আল্লাহর নবীকে (স) তার বিপুল কর্তব্য এবং মহান ও কঠোর জীবনের অজস্র কর্মসম্পাদনে মুহূর্তকালের জন্য বিরত রাখা। এই আকাঙ্ক্ষা যে সামান্যতম সময়ের জন্যও তাকে কর্তব্যচ্যুত করতে সমর্থ হয় নাই ইতিহাসই তার জ্বলন্ত সাক্ষ্য। বরং কখনও যদি তা স্বীয় গণ্ডি অতিক্রম করে তার উচ্চতম আদর্শপূর্ণ মহান জীবনযাত্রার সাথে সংঘাত বাঁধাত তবু তা তার জীবনযাত্রায় কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারত না; এছাড়াও আকাঙ্ক্ষাই পরাজয় স্বীকার করে নতজানু হয়ে পড়ত আর পরাজিত হয়ে নতজানু হলে পর তিনি তাকে তুলে নিয়ে গলায় জড়িয়ে ধরতেন! কারণ, তা যে প্রিয় ছিল না এমন তো নয়। তবে তা অপেক্ষাও অপর একটি জিনিশ তার অধিক প্রিয় ছিল; সেটি তার জীবনের লক্ষ্য—অর্থাৎ পূর্ণমর্যাদার সাথে সত্যের প্রতিষ্ঠা ও সৃষ্টির লালন। তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায়—বহুবিবাহের আকাঙ্ক্ষা শেষ পর্যন্ত তার মধ্যে বিদ্যমানই-বা ছিল কেন? কেন তা হতে তিনি নিজেকে মুক্ত করতে পারলেন না? অথবা, সংযম-সাধনার মাধ্যমে তা চিরকাল দাবিয়ে রাখলেন না কেন, যেমন অনেকেই করেছেন? এও তো সম্ভব ছিল যে, তিনি সংযম-সাধনা বা বিবাহ-পরিত্যাগের পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে তাকে উপেক্ষাও করতে পারতেন, যেমন হজরত ঈসা-মসিহ (আ) করেছিলেন। কিংবা এক স্ত্রী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাও তো তার পক্ষে সম্ভব ছিল, যেমন করেছিলেন হজরত মুসা (আ)!

বিষয়টি বিবেচনাসাপেক্ষ, সন্দেহ নাই। কিন্তু এখানে এর দীর্ঘ আলোচনা সম্ভব নয়। তবে কয়েকটি অবশ্যক বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে :

প্রকৃতি-প্রদত্ত ক্ষমতা কখনও মানবিক বিধানের আওতাধীন নয়। তবে হ্যাঁ, ইচ্ছাশক্তি তার আওতাধীন বটে। সুতরাং, অমুক পবিত্র ব্যক্তি দুর্বল রতিশক্তিসম্পন্ন কেন এ বিতর্ক যেমন নিষ্প্রয়োজন; তেমনই অমুক পবিত্র ব্যক্তি প্রবল রতিশক্তিসম্পন্ন এবং সুন্দরও বটে, আবার অমুক পবিত্র ব্যক্তি রতিশক্তিহীন এবং অসুন্দরও বটে—এ ধরনের বিতর্কও ভ্রান্তিপূর্ণ। সুতরাং রসুলুল্লাহ (স) কেন অসাধারণ রতিশক্তিসম্পন্ন ছিলেন, এটাও অবান্তর প্রশ্ন। মানবিক আইন কি কখনও প্রকৃতির ওপর স্বীয় প্রভাবের বেড়াজাল বিস্তার করতে সক্ষম? কখনও কি তা এমন বিধি প্রস্তুত করতে পারে যে কোনো পবিত্র ব্যক্তিরই অধিক রতিশক্তিসম্পন্ন হওয়া চলবে? এটা কখনোই সম্ভব নয়। কারণ, প্রকৃতি মানবিক বিধানের অধীন তো নয়ই, বরং এর অনেক উর্ধ্বে।

শুধু তা-ই নয়, প্রকৃতিগত বিষয়ের প্রভাবও আইনের মধ্যে সীমিত নয়, যদি তা সত্যিই প্রকৃতিগত হয়। এ কি সম্ভব যে, ফুলের সুন্দর রঙ এবং মধুর ঘ্রাণ আপত্তিকর হবে না, অথচ তার চিত্তাকর্ষক ও মনোহারী আপত্তির বিষয় হবে? তেমনই কোনো পবিত্র ব্যক্তির অস্বাভাবিক রতিশক্তিসম্পন্ন হওয়া অথচ তার বহুবিবাহ-আসক্তি না থাকা কি করে সম্ভবপর? সুতরাং, আল্লাহর রসুলের (স) বেলায়, তিনি এই আসক্তি হতে মুক্ত হবেন, এ কামনা আমরা কেমন করে করতে পারি? আর যদি তা সম্ভবই না হয় তবে এ নিয়ে বিতর্কই-বা কিসের?

তা ছাড়া, প্রকৃতিগত ক্ষমতা ও তার চাহিদাসমূহকে যেকোনো প্রকারে বা যেকোনো পরিমাণেই হোক, চিরতরে দাবিয়ে দেওয়ার নামই তো বৈরাগ্য বা সন্ন্যাসপন্থা অবলম্বন! এ কথা সত্য হলে, বৈরাগ্য বা সন্ন্যাসবাদের সমাধি রচনার জন্য যার আগমন, প্রকৃতিগত ক্ষমতার চাহিদাকে চিরতরে প্রদমিত করে নিজ হাতে সেই সন্ন্যাসবাদেরই নয়া ভিত্তি স্থাপন কি তার উচিত হতো? কখনও না। তিনি হজরত ঈসার (আ) মতো ‘রহবানিয়াত’ বা সন্ন্যাসবাদ প্রসারিত করতে, কিংবা হজরত মুসার (আ) মতো কট্টর বিধিবিধান প্রবর্তন করতে আসেন নাই; কেননা, এসবের ভিত্তি স্থাপিত সাধারণের ভাবাবেগের ওপর, দর্শনের ওপর নয়। দার্শনিকতাধর্মী চরিত্রের সাথে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। আল্লাহর নবী (স) এসেছিলেন ‘রহবানিয়াত’ বা বৈরাগ্যের স্থলে ‘রব্বানিয়াত’-এর সৌধ নির্মাণের জন্য এবং কট্টর বিধিবিধান, যা সাধারণের ভাবাবেগ-সংশ্লিষ্ট, তার পরিবর্তে মধ্যমপন্থী দার্শনিকতামূলক চরিত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। সুতরাং, বহুবিবাহের আসক্তিকে তিনি কেন চিরতরে বিলুপ্ত করে দিবেন আর কেনই-বা তা কঠোর হস্তে দমন করবেন? এ কথা সত্য যে দমন করবার ক্ষমতাও তার মধ্যে যথেষ্টই ছিল এবং সে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশও তিনি ঘটিয়েছেন বারবার। তার এই ক্ষমতার প্রমাণ তিনি শুধু এই জন্যই দিয়েছিলেন যে কম বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যেন প্রত্যক্ষ করতে পারে : রতিশক্তির উত্তাল তরঙ্গকে সংযম-সাধনার শিকলে বেঁধে রাখার যে অদ্ভুত ক্ষমতা তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল তার তুলনা এই ধরাধামে নাই। প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অবদমন ছিল তার কাছে অপছন্দনীয়। কেননা তা প্রকৃতিগত স্বভাব হত্যারই নামান্তর এবং সন্ন্যাসবাদের পোষণমাত্র। অথচ আল্লাহর নবী (স) ছিলেন প্রকৃতির অনুসারী এবং সন্ন্যাসবাদের প্রকৃত হন্তা।

তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, প্রখর স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন, গভীর চিন্তাশীল এবং অতিশয় পরিণামদর্শী। অপর কথায়, তিনি ছিলেন মহাদার্শনিক। তিনি এত বড় দার্শনিক ছিলেন—আল্লাহ না করুন—সারা বিশ্ব কোনো সময় তার নবুওয়তকে অথবা সাধারণভাবে নবুওয়তকে অবিশ্বাস করতে চাইলেও তার নবুওয়তকে অস্বীকার করা কখনও সম্ভব হবে না, কিংবা তাতে তার পয়গম্বরির কোনো ক্ষতি সাধিত হবে না। কেননা নবী ছাড়া আর কেই-বা অতি মহান দার্শনিক হতে পারেন?

নির্জন সাধনা

নির্জনতাপ্রিয়তা তার স্বভাব ছিল না; বরং স্বভাবগত দিক থেকে তিনি ছিলেন সংসর্গপ্রিয়। তার জীবনের মোট সময় থেকে তিনটি বছর বাদ দিলে দেখা যাবে বাকি সমগ্র জীবনটাই তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন মজলিশ ও মহফিলের মধ্যে। দিবসের মধ্য ভাগের দুই ঘণ্টা ছাড়া অর্ধ-রাত্রির সামান্য পূর্ব পর্যন্ত তিনি তো বাইরেই থাকতেন। তারপর গৃহাভ্যন্তরে গমন করতেন বটে, কিন্তু ফজরের আগেই আবার বের হয়ে পড়তেন। বড়জোর তিনি ছয় ঘন্টা ঘরে অবস্থান করতেন। বাকি আঠারো ঘন্টা তিনি বাহিরেই কাটিয়ে দিতেন—তবে এমন নয় যে পুরুষদের বৈঠক আখেরে মহিলা-বৈঠকে পরিণত হতো; কারণ বৈঠকের স্থান ছিল মসজিদ। যার ইচ্ছা সেখানে আসতেন এবং সোজাসুজি তার কাছে গিয়ে নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে নিতেন।

তবে, প্রয়োজনবশত তিন বৎসরের জন্য তিনি নির্জনতাকে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু তার এই নির্জনবাসও একটানা ছিল না, বিরতি সহকারেই ছিল। তার নির্জনবাসের স্থানটি ছিল একটি গুহা মাত্র। হেরা নামক পাহাড়ে যার অবস্থিতি। আজও মানুষ সেই গুহা পরিদর্শনে গিয়ে থাকে।

এই ভয়াবহ ও বিপদসংকুল নির্জন স্থানে দিনের পর দিন ও রাতের পর রাত অবস্থান করে তিনি কী কী করতেন এবং তার ফলে কোন দুষ্প্রাপ্য ফলই-বা তিনি সেখানে লাভ করেছিলেন—তা সত্যিই ভাববার বিষয়। তা ছাড়া, হিংস্র শ্বাপদ ও বন্য জন্তুর কবল থেকেই-বা তিনি সেখানে কী করে রক্ষা পেতেন, আর কী করেই-বা তিনি এমন নির্ভয়ে সেখানে অবস্থান করতেন—এ সকল প্রশ্ন স্বভাবতই সকলের মনে উদিত হয়। কিন্তু সেখানে তিনি কী করতেন তা তিনি নিজে কোনোদিন বলেননি, অপর কেউ তা বলতে পারেনি। সত্যি বলতে কী, এই রহস্যটির ওপর আজ পর্যন্ত লৌহজাল বিস্তার করেই রয়েছে—এমন কেউই নাই যে তা উন্মোচন করতে পেরেছে! ব্যাপারটি হজরতের জীবনচরিতের সামগ্রিক চিত্র লেখকের পক্ষেও একটি মস্ত বড় রহস্য হয়ে রয়েছে। পরিতাপের বিষয়, চৌদ্দশ বছর পার হতে চলল, অথচ কোনো জীবনী-রচয়িতাই তার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন নাই। আমি নিজেও এই রহস্য-পর্দা উন্মোচনের জন্য নিজেকে সর্বাংশে উপযুক্ত বলে দাবি করতে পারি না। তবে আমার পক্ষে এই-ই সৌভাগ্য যে আমি নিজের এই অযোগ্যতা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন। মুসলিম জাহান তথা সারা বিশ্বের তথ্য অনুসন্ধানকারীদের প্রতি আমি আহ্বান জানাচ্ছি যে হজরত মুহাম্মদের (স) জীবনের এই রহস্যপূর্ণ দিকটির প্রতি সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিত।

হেরা গুহার তিনি কী কী ফল লাভ করেছিলেন তার জীবনীকারগণ এর সঠিক বিবরণ দিতে অপারগ। প্রত্যেক জীবনীকারই এতটুক উল্লেখ করেই এগিয়ে যান যে হেরা গুহায় ফেরেশতার আগমন ঘটেছিল এবং ‘ইকরা বি-ইসমি’ পড়ে পবিত্র কোরআন অবতরণের উদ্বোধন করা হয়েছিল। হেরা গুহায় তিনি যে এই ফল লাভ করেছিলেন তা তো সর্বস্বীকৃত কথা। কিন্তু এটা ছাড়া অন্য ফলও যে সম্ভব, ঘটনাটিকে যুগপৎ ঐশী দৃষ্টিকোণ ও পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে তা উপলব্ধি করা যেতে পারে।

আমার দৃষ্টিতে, তার এই নির্জনবাসের পার্থিব একটি ফল হচ্ছে ভীতি-শূন্যতা ও প্রকৃতির নিবিড় পরিচয় লাভ—যে-কারণে তিনি নিসর্গপ্রেমিক হয়ে পড়েছিলেন। এছাড়া, তিনি নিসর্গের অব্যক্ত বাণী শ্রবণ করবার এবং নিজের বক্তব্য নিসর্গের গোচরীভূত করার ক্ষমতাও লাভ করেছিলেন। তার এই ক্ষমতা দুইটি ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। দুঃখের বিষয়, এখানে তার বিস্তারিত আলোচনা করার অবকাশ নাই। তবে মোটামুটি একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা অবশ্যই করা হবে।

নিসর্গের সাথে নিগূঢ় সম্পর্কের ফলে তার প্রথম লাভ এই হয়েছিল—দুই, চার কিংবা দশ-বিশটি ব্যক্তিকে বাদ দিলে সমগ্র মানবজাতির অসহযোগিতা ও অবন্ধুত্ব যখন তাকে বেষ্টন করেছিল, তখনো তিনি ভীতির শিকারে পরিণত হন নাই। এই সময় বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো তিনি নিসর্গের নিত্য সাহায্য লাভ করেছিলেন এবং নিসর্গ তার নীরব বন্ধুত্ব ও অব্যক্ত সমবেদনার দ্বারা তাকে পূর্ণ স্বস্তি ও পূর্ণ শান্তি দান করেছে; শুধু সেই কয়টি দিন তিনি এই প্রশান্তি থেকে বঞ্চিত ছিলেন যখন ওহি প্রাপ্তি বন্ধ থাকার ফলে তিনি বিষাদ-সমুদ্রে নিপতিত হয়েছিলেন। এ কথা নিশ্চিত যে তার ওপর রব্বানি প্রশান্তি অবশ্যই বর্ষিত হতো। কিন্তু নিশ্চিত করে এ কথা কে বলতে পারবে যে রব্বানি শান্তিধারা কেবল ‘ওহি’ এবং ফেরেশতার মাধ্যমেই অবতীর্ণ হতো? সম্ভবত, আর সম্ভবতই-বা বলি কেন, খুব সম্ভব বাহ্য-প্রকৃতিও শান্তিধারা অবতরণের উৎসভূমি হিশাবেই ব্যবহৃত হতো। বাহ্য-প্রকৃতির কথা বলার ক্ষমতা নাই ঠিক, কিন্তু কথার পটভূমি সৃষ্টির ক্ষমতা তার নিশ্চয় রয়েছে।

বাহ্য-প্রকৃতির সাথে সম্পর্কের ফলে দ্বিতীয় যে লাভটি হয়েছিল তা এই যে, তিনি মানুষের অভ্যন্তরীণ প্রকৃতির সুদক্ষ চিকিৎসক হয়ে গিয়েছিলেন। মুখে কিছু না বলেও তিনি মানুষের অভ্যন্তরীণ প্রকৃতির গভীরে প্রবেশ করতে পারতেন এবং তা পাঠ করে সেই মানুষের সম্পূর্ণ স্বরূপ জেনে নিতে সক্ষম হতেন।

মোদ্দাকথা, হেরা গুহার কঠোর নির্জনবাসে তিনি কেবল শ্রেষ্ঠতম ফেরেশতারই সাক্ষাৎ লাভ করেন নাই, বরং সেখানেই তিনি লাভ করেছিলেন মহান প্রকৃতির সন্ধান যা সেই দিগন্তবিস্তারী সীমাহীন বিজন প্রান্তরের চতুর্দিকেই বিস্তৃত ছিল এবং একজন পর্বতে অবস্থানকারী প্রান্তরবাসীই কেবল যা লাভ করতে সক্ষম। অন্য কথায় বলা যায়, হজরত হেরা গুহায় সাধনার পুরস্কার হিশাবে শুধু নবুওয়তই পান নাই, সঙ্গে সঙ্গে দার্শনিকতাও অর্জন করেছিলেন, যা মর্যাদার দিক দিয়ে নবুওয়তেরই কাতারভুক্ত। পার্থক্য শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় আসনের। উপর্যুক্ত আলোচনার অর্থ তো এই দাঁড়ায় না যে, তার উম্মতদেরও তার মতোই প্রান্তরবাসী এবং পর্বতগুহায় অবস্থানের সুন্নত পালন করতে হবে? তা হয়ে থাকলে অতিশয়োক্তি হয় নাই। কারণ, সমাজের মধ্যে কিছু বাঁধাধরা নিয়ম পালন, খাদ্যের মধ্যে লাউ ও সিরকা-প্রীতি, দিবসে খাওয়ার পর খানিকক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণ (কাইলুলা) এবং নিদ্রা গিয়ে জেগে থাকা অবস্থায় রাত্রিযাপন (নাউম বায়নাল ইয়াকজাতাইন) —এই সব সহজ পদ্ধতি প্রতিপালনের মধ্যেই তার সুন্নত (সংস্কৃতি) সীমিত নয়। এই সব সহজ তীর দিয়ে ফিনিক্স পাখি তুল্য মুহাম্মদিয়াতকে শিকার করা সম্ভব হলেও পরে দেখা যাবে সেই মুহাম্মদিয়াতরূপী ফিনিক্স পাখিটি ছিল চিল বা কাক! নামকাওয়াস্তে না করে যদি সত্যিকারঅর্থে তার সুন্নত অনুসরণের কারও ইচ্ছা থাকে, তা থেকে প্রকৃতই কোনো মূল্যবান ফল লাভের আকাঙ্ক্ষা কেউ যদি পোষণ করে, তাহলে সেই সুন্নতের শুরু হতে পারে প্রান্তরবাস ও পর্বতগুহায় সাধনার মাধ্যমে। এছাড়া শুরু করার অন্য কোনো কেন্দ্রবিন্দুই নাই।

কেউ হয়তো মনে করতে পারে, আর কেউ-বা বলি কেন, সারা বিশ্ববাসীরই একটি ধারণা রয়েছে যে উপর্যুক্ত অস্বাভাবিক, নিরলস ও ক্লেশপূর্ণ সাধনাটি কেবল তার জন্যই নির্দিষ্ট ছিল, তার উম্মতের জন্য এর প্রয়োজন নাই। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। প্রকৃতপক্ষে তার সকল ক্লেশপূর্ণ কার্যই তার উম্মতদের জন্যও অপরিহার্য। অবশ্য কেবলমাত্র ‘মাগফেরাত’ ও ‘নাজাত’ লাভের জন্য নয়; কেননা এর জন্য তো শরিয়তের সংক্ষিপ্ত বিধিবিধান, যা ‘রাহে নাজাত’ ও ‘মা লা বুদ্দা মিনহু’ পুস্তিকায় সন্নিবেশিত রয়েছে, তা পালন করাই যথেষ্ট! তরল খাদ্যের একটি লোকমা যেমন গালে পুরলেই পেটে গিয়ে পড়ে, এটি তেমনই সহজ কাজ! কিন্তু যদি জিজ্ঞাসা করি, তার আগমন কি শুধু ‘মাগফেরাত’ ও ‘নাজাত’-এর পদ্ধতি বাতলানোর জন্যই হয়েছিল? উত্তর হবে—‘অবশ্যই না’। তার আগমন, যে-আগমনের কোনো তুলনা বিশ্বে হতে পারে না, সেটা কেবল ‘মাগফেরাত’ ও ‘নাজাত’-এর জন্য হয়নি, বরং মানবতার পর্যায়ক্রমিক উন্নতি ও চরম পূর্ণতা বিধানের জন্যই তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন। আর এই পরম উন্নতি ও চরম পূর্ণতা বিধানের পদ্ধতিটি ‘রাহে নাজাত’ ও ‘মা লা বুদ্দা মিনহু’-তে সন্নিবেশিত মাসআলা-মাসায়েলের জালে আয়ত্ত করা যাবে, এটা কখনোই সম্ভব নয়।

আমি যে রহস্যটি এখানে উদ্ঘাটন করছি তা যে অস্পষ্টই রয়ে গেছে এমন ধারণা করারও কোনো কারণ নাই। মুহাম্মদিয়াতের এই উচ্চ পর্যায়ের বিধিবিধানের অনুশীলন বরং সর্বদাই সন্ন্যাসবাদে পর্যবসিত হয়ে রয়ে গেছে। মুসলমানদের প্রকৃত সুফিদল ও প্রথাগত সুফিদলের মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান। অপর পক্ষে, অমুসলমানদের মধ্যে ইউরোপের প্রকৃতিবাদীগণ মুহাম্মদিয়াতের এই উচ্চ পর্যায়ের বিধিবিধানকে নিশ্চিতই উপলব্ধি করেছেন। তারা এর যথাযথ মূল্য দিয়েছেন এবং এর ভিত্তিসূত্রের প্রথম পর্যায়ে সাহসের সাথে অবতরণ করে অপরের কাছে যা সম্পূর্ণ অস্পৃশ্য বলে প্রতীয়মান তারই মাণিক্য আহরণ করেছেন। তাই আমরা দেখতে পাই, এই দুই দল দুনিয়াকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেছেন। ইউরোপের প্রকৃতিপন্থীগণ পার্থিব জগৎকে চোখ ঝলসানো আলোকে উদ্ভাসিত করে দিয়েছেন, আর মুসলমানদের সুফিগণ আধ্যাত্মিক জগৎকে করে তুলেছেন এমনই ক্ষমতাবান যে, পার্থিব জগৎ একে উপেক্ষা করতে সাহসী হয় নাই।

এক দিকে নিউটন ও ডারউইনের মতো ব্যক্তিগণ পার্থিব জগৎকে আসমানের ওপর উঠানোর সুস্পষ্ট ভিত্তি স্থাপন করেছেন। এমন কে আছেন যিনি তাদের এই ভিত্তি প্রতিষ্ঠার কীর্তিকে তাচ্ছিল্যভরে অস্বীকার করার কথা মুখেও আনতে সাহসী হবেন—তা তিনি সংসারবিরাগী মৌলবি অথবা রেশম পরিধানকারী সুফি যে-ই হোন না কেন? অপরপক্ষে, জুনায়দ বাগদাদি ও হুসাইন বিন মনসুর হাল্লাজের মতো ব্যক্তিগণও তাদের কেরামতি বা অলৌকিকত্বের সামনে পার্থিব জগতের শক্তিশালী গর্দানকে অবনত করে দিয়েছেন!

আমার একান্ত ইচ্ছা, আল্লাহর নবীর (স) প্রত্যেক খাঁটি উম্মতেরই প্রথমে প্রান্তরবাসী ও পর্বতগুহায় সাধনানিরত হয়ে পরে তার খানকায় প্রবেশ করা উচিত। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সমগ্র উম্মতে মুহাম্মদিই হিম্মতহারা হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্য থেকে মুহাম্মদিয়াতের প্রাণপাখিই উড়ে গেছে। এখন রয়েছে কেবল মুহাম্মদিয়াতের লাশখানি, আর সেই লাশের আড়ম্বরপূর্ণ পূজা! এ কথা অবশ্য সত্য যে, ইউরোপবাসীদের কাছেও মুহাম্মদিয়াতের কেবল পার্থিব দিকটাই উদ্ভাসিত হয়েছে এবং তারাও কেবল এর সীমানার মধ্যেই ঘুরপাক খেয়ে ফিরছে। কিন্তু মুহাম্মদিয়াতের আধ্যাত্মিক দিগন্তটিও যে তাদের নিকট অনাবিষ্কৃত থাকবে না—তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তবে, তাদের নিকট উন্মোচিত হলেও তার বর্তমান মুসলিম উম্মতদের কাছে তা অজ্ঞাতই থেকে যাবে! খুব সম্ভবত এদের কেউই এই দিগন্ত উন্মোচনের জন্য চেষ্টা করবে না—যতক্ষণ না কোনো পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব এদের সম্পূর্ণ নতুন জিনিশে রূপান্তরিত করে দিতে সক্ষম হয়।

নবুওয়ত ও দার্শনিকতা

নির্জন সাধনার মাধ্যমে হজরত দুইটি অমূল্য জিনিশ অর্জন করেছিলেন : একটি নবুওয়ত, অপরটি দার্শনিকতা। এই দুইটি অর্জন এমন গৌরবময় যে বিশ্ববিজয়ও এর সামনে তুচ্ছ বলে বিবেচিত; আর একই ব্যক্তি যখন এই উভয় অমূল্য জিনিশের অধিকারী হন তখন তার মর্যাদা সম্বন্ধে তর্কের কোনো অবকাশই আর থাকে না। তিনি এমন ছিলেন যে দুনো জাহানকেই জয় করার সমস্ত সাজ-সরঞ্জাম তার হাতে এসে গেছিল। সত্য বলতে গেলে, এর ফলে দুনো জাহান জয়ের ভিত্তি স্থাপনের কাজই তার দ্বারা প্রথম সমাধা হয়।

সাধারণত প্রত্যেক নবীই দার্শনিক হয়ে থাকেন। এটা অপরিহার্যও বটে। কিন্তু নবুওয়তের জন্য যে-দার্শনিকতা অপরিহার্য তা আল্লাহ প্রেরিত ও অভিজ্ঞতালব্ধ। চিন্তাপ্রসূত দর্শন-জ্ঞান এর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। শেষোক্ত পর্যায়ের দার্শনিকতা নবুওয়তের জন্য অপরিহার্য নয়। হজরত মুসা (আ) যখন সিনাই উপত্যকায় নিজ বংশীয়দের জন্য বিস্তারিত আইন ও ব্যবস্থা-বিধি প্রণয়ন করছিলেন, তখন দার্শনিক নবী হজরত শোয়াইব (আ) তাতে হস্তক্ষেপ করেন এবং তিনি নিজে বহু আইন ও বিধিবিধান প্রস্তত করেন বা প্রস্তুত করিয়ে পেশ করেন। তাহলে এ কথা স্পষ্ট যে হজরত মুসা (আ) নবী ছিলেন সত্য, চিন্তাশীল দার্শনিক ছিলেন না। হজরত ঈসা-মসিহরও (আ) সেই একই অবস্থা—নবী ঠিক, কিন্তু চিন্তাপ্রসূত দর্শনের অধিকারী নন।

সুতরাং, যদি বলা হয় হজরত মুহাম্মদ (স) নবুওয়তের সাথে দর্শনও অর্জন করেছিলেন, তাহলে এর সাথে তার নবী না হওয়ার যে-ধারণাটি জড়িত হয়ে পড়ে তাতে বিস্ময়বোধের কিছু নাই। প্রকৃত ব্যাপার এই—চিন্তাশীলতা ছাড়া নবুওয়ত লাভই সম্ভবপর নয়। কিন্তু এই চিন্তা একটি নির্দিষ্ট বৃত্তে সীমিত হতে পারে। এই জন্য চিন্তাপ্রসূত দার্শনিক-জ্ঞান যদি নবুওয়তের জন্য অপরিহার্য বলে ধরা যায়, তা হলেও তা সীমিত চিন্তাপ্রসূত দার্শনিকতায়ই পর্যবসিত হয়। কিন্তু এখানে দাশনিতার অর্থ স্বাধীন দার্শনিক-জ্ঞান; এই স্বাধীন চিন্তাপ্রসূত দার্শনিক-জ্ঞান নবুওয়তের জন্য অপরিহার্য নয়। সুতরাং দার্শনিকতাকে নবুওয়ত থেকে পৃথক বিষয় হিশাবে বর্ণনা করা ভুল হতে পারে না।

এ ব্যাপারেও সাধারণভাবে একটা ভুল ধারণা রয়েছে। অনেকেই মনে করেন যে, নবী কখনও দার্শনিক হতে পারেন না এবং নবীর পক্ষে দার্শনিক হওয়া উচিতও নয়। তাদের মতে, দার্শনিকতা নবীর জন্য কামালিয়াত ও রওনকের কথা নয়, বরং ত্রুটি ও অশোভনতারই কথা। কিন্তু এ ধরনের অভিমতের মূলে কোনো সত্যতা নাই।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে নবুওয়ত কি অর্জন করার বিষয়? যদি তা না হয়, তবে কেন বলা হলো হজরত নবুওয়ত অর্জন করেছিলেন? আর, যদি তা-ই হয়ে থাকে তা হলে নবুওয়ত আল্লাহর দান—এই সর্বস্বীকৃতি বিশ্বাস আর থাকল কোথায়? তা ছাড়া, এই বিশ্বাসটিও তো কেবল কোনো ব্যক্তিগত বা জাতিগত বিশ্বাস নয়, এর পিছনে রয়েছে ধর্মীয় প্রমাণ। পবিত্র কোরআন ও হাদিস—ধর্মীয় বিধানের এই উভয় উৎসেই বলা হয়েছে নবুওয়ত প্রকৃতিগত এবং আল্লাহর দান, এটা অর্জিত বা লব্ধ নয়।

প্রকৃতপক্ষে, নবুওয়ত একাধারে ‘কসবি’ (অর্জনীয়) এবং ‘ওয়াহবি’ (খোদাপ্রদত্ত)। কিন্তু যদি মনে করা হয় নবুওয়ত সকল দিক দিয়েই কেবলমাত্র আল্লাহপ্রদত্ত—তাহলে ভুল করা হবে। পবিত্র কোরআন ও হাদিস-নির্গত এ সম্পর্কিত প্রমাণাদিও ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে। স্মরণযোগ্য যে এই দুই ক্ষেত্রেই বিষয়টির যে-দিকটার যখন প্রয়োজন বোধ হয়েছে তখন সেই দিকটা সম্পর্কেই আলোকপাত করা হয়েছে।

নবুওয়ত আল্লাহর দান এই অর্থে যে এটা কেবলমাত্র উপার্জিত ফল নয়। এই জন্যই, এটাও সম্ভব নয় যে, যে চেষ্টা করবে সে-ই নবী হতে পারবে। বরং এ ব্যাপারে ফিতরতের (প্রকৃতি বা স্বভাব) নির্বাচনের হাত রয়েছে। যিনি ফিতরতের দিক থেকে নির্বাচিত নন তিনি নবী হতে পারবেন না, তিনি পাহাড়ের সমান চেষ্টাও করুন না কেন। কিন্তু নবুওয়ত আল্লাহর দান—এর অর্থ আদৌ ‘অর্জনের মুখাপেক্ষী নয়’ এমন কিছুতেই হতে পারে না। যদি এমনই হতো, তাহলে হজরত মুসাকে (আ) সাত বৎসর হজরত শোয়াইবের (আ) খিদমতে কাটাতে হতো না, হজরত ইয়াকুবকে (আ) হজরত শিয়ার (আ) আস্তানায় সাত বৎসর অতিবাহিত করতে হতো না, কিংবা হজরত ঈসা-মসিহ (আ), যিনি ‘রুহুল্লাহ’ বা আল্লাহর আদেশ, কালিমাতুল্লাহ বা আল্লাহর নিদর্শন এবং আজন্ম অলৌকিকত্ব বহনকারী, তারও হজরত ইয়াহইয়ার (আ) কাছে প্রথম সবক গ্রহণ করতে হতো না। এবং নবী-রসুলদের নেতা হজরত মুহাম্মদের (স) তিন বৎসরের জন্য বিপদসংকুল গুহায় নির্জন জীবন অবলম্বনেরও প্রয়োজন হতো না।

এ কথা যেমন সত্য—

❝এই সৌভাগ্য যায় না পাওয়া বাহুবলে
যদি না রাজি থাকেন স্বয়ং খোদা।❞

তেমনই এ কথাও সত্য—

❝সম্পদ হস্তগত হয় না আপনাআপনি
না করলে চেষ্টায় আত্মনিয়োগ।❞

আর তা ছাড়া, যে অর্থে নবুওয়ত ‘খোদাপ্রদত্ত জিনিশ’ সেই অর্থে দার্শনিক জ্ঞানও ‘খোদাপ্রদত্ত জিনিশ’। কেননা, যে-কেউ চেষ্টা করলেই দার্শনিক বনে যেতে পারে না। চেষ্টার পরেই অবশ্য দার্শনিকতা লাভ হয়, কিন্তু লাভ করেন তারাই যারা আজন্ম দার্শনিক, অর্থাৎ যাদের মধ্যে দার্শনিকতার স্বভাবগত যোগ্যতা বিদ্যমান থাকে।

এ প্রসঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন উঠতে পারে। যদি কেউ বলেন আল্লাহর নবী (স) যে নবুওয়ত অর্জন করেছিলেন তা-ই বা কি করে জানা সম্ভব? এমনও তো হতে পারে যে, তা বাস্তবে অর্জন হয় নাই, কেবল প্রচার হয়েছে নবীত্বের। এই প্রশ্নটিই কঠিন সংশয়ের জন্ম দেয় এবং শেষ পর্যন্তও তা জটিল থেকে জটিলতর হয়। তার জন্মস্থানের কথা বলতে গেলে তো স্বীকার করতে হয় যে, সেখানে নবুওয়ত কখনও স্বীকৃতিই পায় নাই। তার নবুওয়ত কেবল বিদেশেই স্বীকৃত হয়েছিল; তাও একটি ক্ষুদ্র পল্লীবাসীর মাঝে, যে পল্লীর বাসিন্দারা দরিদ্র কিষাণ-মজদুর ও অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত। তারাই কেবল এই স্বীকৃতি জানিয়েছিল; সেখানকার নেতা ও সমাজপতিগণ আবার স্বীকৃতি দান করে নাই। তখনকার আরবে শিক্ষিত বলতে ছিল ইহুদি ও খ্রিষ্টানেরা। এই দুই জাতি কখনও তার নবুওয়তকে স্বীকৃতি দেয় নাই। এমনকি, তারা নির্বাসন ও ধ্বংসকে বরণ করে নিয়েছে তবু তার নবুওয়তকে মেনে নিতে সম্মত হয় নাই। তাহলে বোঝা যায়, কত জটিল এই ধারণাটি।

এ কথা সত্য যে শেষ পর্যন্ত সমগ্র আরব উপদ্বীপবাসীই ইহুদি এবং খ্রিষ্টানদের পরিত্যাগ করে হজরতের কাতারে শামিল হয়েছিল। কিন্তু তার দলে এই শামিল হওয়ার কারণ প্রমাণ ও বিশ্বাস নয়; বরং ভয় ও অনুসরণের মনোবৃত্তি হতেই তারা শেষ পর্যস্ত তার দলভুক্ত হয়। এটাও ঠিক যে, তার বিরুদ্ধে যে শক্তিই মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তা পানির মতোই দুই দিকে কেটে পড়েছে এবং সমগ্র আরব একত্র হয়েও তার ক্রমবর্ধমান শক্তিকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয় নাই। কিন্তু তার এই কীর্তি মূলে তার নবুওয়তের কিছু ছিল না। এটা ছিল তার দার্শনিকতার বিস্ময়কর সাফল্য। বস্তুত, নবী নন এমন বহু দার্শনিক এই বিশ্বে আগমন করেছেন যারা নিঃসম্বল অবস্থায় এসেও নিজেকে এমন এক পর্যায়ে উন্নীত করিতে সক্ষম হয়েছেন, যেখানে প্রতিটি বিরোধী শক্তিই খান খান হয়ে ভেঙে পড়েছে।

এই কিছুদিন আগেই ভ.ই. লেনিন নামক এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল। তিনি ছিলেন মামলা-না-পাওয়া উকিল মাত্র। কিন্তু পরবর্তী কালে তিনিই হয়ে গেলেন রুশ দেশের ভাগ্যবিধাতা। তার বিরুদ্ধে যত শক্তিই মাথা তুলেছিল সবই পরাজিত হয়েছে। এমনকি, যে ইংরেজ জাতি পরাজয় কাকে বলে তা জানেই না, তারাও তার কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। তারই স্থলাধিকারী হয়েছেন ইয়োসিফ স্তালিন, এবং তিনিও সেই পর্যায়েই উপনীত হন। তাহলে এই দুইজন কি নবী? নিশ্চয় না। তারা দার্শনিক মাত্র।

অন্যদিকে, এটাও ঠিক যে, বহু লোক তার নবুওয়তকে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং তারা হজরত এবং তার মিশনকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নেবার জন্য অকাতরে বিরাট ত্যাগও স্বীকার করেছেন। কিন্তু মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের নবুওয়তকে কি কেউই স্বীকার করে নাই, এবং তার জন্য ত্যাগ স্বীকারকারী কেউ কি ছিল না? আজও কি বাহাই নবুওয়তকে বহু লোক মানে না এবং বাহাউল্লাহর শিষ্যরা কি ত্যাগ স্বীকার করে নাই? অত দূরে যাওয়ারই-বা কি প্রয়োজন! পাক-ভারত উপমহাদেশে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও গান্ধীর অনুসারীও তো বহু এবং তারা কোনদিক দিয়েই-বা কম কষ্ট স্বীকার করেছেন? অথচ, তারা দুইজনই রাজনৈতিক নেতা ছাড়া অন্য কিছু না।

মেনে নিলাম, হজরত নিজে নবুওয়তের দাবি করেছেন এবং তিনি লোক হিশাবেও সত্যবাদী ছিলেন। কিন্তু নবুওয়তও এ ধরনের সূক্ষ্ম এবং বিতর্কমূলক কিছুর দাবি সত্যবাদীর কাছ থেকে উত্থিত হওয়া সত্ত্বেও তা মিথ্যা হতে পারে, অর্থাৎ তা ভুল হওয়ার সম্ভাবনামুক্ত নয়। কেননা, বহু দাবির ক্ষেত্রেই সঠিক ও ভ্রান্তির মানদণ্ড কেবল সত্যবাদিতা ও মিথ্যা নয়, বরং দাবিদারের সঠিক ধারণা ও ভুল ধারণার ওপরও তা অনেকখানি নির্ভরশীল। হতে পারে, একজন দাবিদার সত্যবাদীই বটে এবং তিনি তার দাবির ব্যাপারে নিয়তের দিক থেকে সত্যবাদী; কিন্তু ভুল ধারণার শিকারে পতিত হয়ে তিনি হয়তো ভুল দাবিই করে বসলেন, এ সম্ভাবনা তো অস্বীকার করা যায় না।

তা ছাড়া, অনেক সময় দেখা যায় অনেক সত্যপন্থী রাজনৈতিক নেতা নিজের মহৎ ও পবিত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সাফল্যের জন্য অসংখ্য জনপ্রিয় বিশ্বাস ও ঐতিহ্যকে মেনে নেওয়ার ভান করে থাকেন। তারপর তিনি ধীরে ধীরে নিজ উদ্দেশ্যের পথে অগ্রসর হন। এই ভাবে তিনি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সামগ্রিক সত্যের খাতিরে ক্ষুদ্র মিথ্যাসমূহকে অসংকোচে বরদাশত করে থাকেন। হজরতের নবুওয়তের ব্যাপারেও এই সত্যটিকে সম্ভব বলে না মানার কি কারণ রয়েছে?

অবশ্য এও সত্য—হজরত মুহাম্মদের (স) নবুওয়ত সম্পর্কে পবিত্র কোরআন প্রকাশ্য ঘোষণা করেছে আর পবিত্র কোরআনের সত্যতাও সর্বস্বীকৃত। কিন্তু পবিত্র কোরআনের সত্যতা ও হজরতের নবুওয়তের বিশুদ্ধতা, এই দুইটি তো পরস্পর নির্ভরশীল। সুতরাং কোরআন সত্য, এবং মুহাম্মদ (স) একজন নবী, কোরআনের এই দাবি সত্য হলেও তাতে আসল কথার সত্য হওয়া তো অপরিহার্য নয়, অর্থাৎ এর মাধ্যমে এ কথা অবধারিত বা অপরিহার্য বলে তো প্রমাণিত হয় না যে তার নবুওয়তের কথাটি প্রকৃতই সত্য হতে পারে। কেননা, কোরআনও হয়তো আসল সত্যকে জানতে পারে নাই। আর তা ছাড়া, কোরআনকে আল্লাহ্‌র বাণী বলে স্বীকার করলে তবেই তার জানা না-জানার একটা মূল্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। কিন্তু কোরআন যে আল্লাহর বাণী এটা প্রমাণ করা হজরতের নবুওয়তকে প্রমাণ করার চেয়ে কম কঠিন কাজ নয়। সুতরাং ‘তার নবুওয়তের দাবি সত্য’ এই দাবিকে ‘কোরআন আল্লার বাণী’ এই দাবির সাথে জড়িয়ে ফেললেই বিষয়টির ফয়সালা হবে না; বরং এর ফলে বিষয়টির জটিলতা আরও বৃদ্ধিই পায়।

এ কথা অবশ্য সত্য—হজরতের নবুওয়ত সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করার পরিণামে জাহান্নাম, হত্যা, অভিশাপ ও ধ্বংসের ভয় বিদ্যমান। এ ছাড়া, সর্বাপেক্ষা বড় ভয়ের কারণ হলো তথাকথিত মুফতি মাওলানা ও পীর গোষ্ঠী। কারণ, এ দুটি শ্রেণি কারও প্রতি বিগড়ে গেলে তার আর কোথাও স্থান হবে না! তা ছাড়া, মুফতি মাওলানা ও পীরদের জন্য তো অন্য কোনো প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না; কারণ তারা নিজেরাই তো সর্বাপেক্ষা খাঁটি প্রমাণ! সুতরাং তারা সশরীরে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আবার অন্য প্রমাণ খোঁজার কোনো কারণ আছে কি?

কিন্তু আফসোসের বিষয়, দর্শন উপর্যুক্ত ভয়ের একটির কাছেও নতিস্বীকার করে না। দর্শনের কথা হলো—‘জাহান্নাম মঞ্জুর করিব, তবু মূর্খতা মঞ্জুর করিব না।’ তা ছাড়া, দর্শন তথাকথিত পীর ও মুফতি মাওলানাদের থোড়াই কেয়ার করে। দর্শন তো তাদের সম্পর্কে ‘উল্টো’ ধারণা পোষণ করে। দর্শনের মতে, শক্তিশালী কোনো কথাকেও যদি এই দুই শ্রেণি স্পর্শ করে, তবে তা নিশ্চয়ই দুর্বল হয়ে পড়বে! এই দুই শ্রেণি তো জীবনভর মূর্খতা ও কুসংস্কারপূর্ণ কথাই বলে থাকে। আর, এ সবই তাদের প্রকৃত অস্ত্রও বটে। এ সবের মাধ্যমেই তারা নিজ অনুসারীদের সবসময় আঁকড়ে রাখতে সমর্থ হয় এবং বিরোধীদের স্থায়ীভাবে করে কুপোকাৎ। সুতরাং, তারা যদি মাঝে-মধ্যে এমন মহাপাণ্ডিত্যপূর্ণ (?) কথা না বলেন, তবে আর কারা বলবে?

হজরত মুহাম্মদ (স) দার্শনিকতার সাথে নবুওয়তও নিশ্চিতভাবেই অর্জন করেছিলেন—এ কথাটি কেবলমাত্র একটি উপায়ে জানা সম্ভব। কেননা, একমাত্র এই উপায়টিই দার্শনিকতাপূর্ণ, বাকি সমস্ত উপায়ই ভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ ও তাতে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা বিপুল। আর এই একটি উপায়ের মাধ্যমেই এই গ্রন্থাকারের দার্শনিকতা প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। সেই উপায়টা কি? এই উপায়টি হলো—‘মোশাহেদায়ে মুহাম্মদ (স)’ বা স্বয়ং হজরতকেই সাক্ষী মানা। তাকে দেখলে যে-কেউই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে যে তিনি নবী ছিলেন, আর যদি তিনি নবী না হয়ে থাকেন তিনি ফেরেশতা ছিলেন, আর যদি তিনি ফেরেশতা না হয়ে থাকেন তাহলে তিনি ছিলেন স্বয়ং অবতার!

এটাকে আমি অভ্যন্তরীন বা ভিত্তিগতপ্রমাণ বলে অভিহিত করতে চাই। বাকি প্রমাণগুলো বাহ্য প্রমাণ হিশাবেই পরিগণিত। আর এটাতে স্বীকৃত যে কোনো ব্যক্তির সত্য স্বরূপ জানার জন্য আসল প্রমাণ হচ্ছে অভ্যন্তরীন প্রমাণ। এই ক্ষেত্রে বাহ্যিক প্রমাণাদি ততখানি কার্যকরী নয়। হজরত মুহাম্মদকে (স) সত্যিকারভাবে প্রত্যক্ষ করলে সহজেই দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাবে যে তিনি সত্যই নবী ছিলেন। যদি সারা বিশ্বের কোনো কিছুই তার নবুওয়ত সম্পর্কে একটি সাক্ষ্যও উপস্থিত করতে সক্ষম না হয়, কিংবা ধরে নিলাম তিনি নিজেও নবুওয়তের দাবি উত্থাপন করেন নাই, পবিত্র কোরআনেও তার নবুওয়তের কোনো দাবি করা হয় নাই, অথবা কখনও তার কোনো অনুসারী ছিল না এবং আজও নাই, তবু হজরত মুহাম্মদকে (স) দেখলে আপনার দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাবে যে তিনি একজন খাঁটি নবী ছিলেন। মোশাহেদার ফলে আপনি জানতে পারবেন, তার মধ্যে একটি পূর্ণ মানব বা ‘কামেল ইনসান’ বিদ্যমান।

সেই পূর্ণ মানবটি এমন একটি মহাবৃক্ষ সদৃশ যা অপরূপ সজ্জায় সুসজ্জিত এবং দুনিয়ার সব রকমের ফলই যাতে নিজ নিজ স্থানে শোভিত; আর সেই ফলগুলোর মধ্যেই রয়েছেন সকল নবী সকল আউলিয়া, সকল দার্শনিক, সকল চিকিৎসক, সকল চিন্তাবিদ, সকল পরিচালক, সকল সেনাপতি, সমস্ত সভ্যতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠাতা এবং সকল আলিম ও ধর্ম প্রচারক; ওর মধ্যেই রয়েছেন সকল নেককার, সকল আল্লাহপ্রেমিক, সকল বিত্তশালী, ও সকল আমির; ওর এক পার্শ্বের ফলগুলোতে রয়েছেন বনি ইসরাইলের সকল নবী, অপর পার্শ্বে রয়েছেন বুদ্ধের মতো তপস্বীগণ আর তৃতীয় পার্শ্বে রয়েছেন পারস্য ও চীনের সকল ধর্মবেত্তা এবং চতুর্থ পার্শ্বে রয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন জাতির নেতৃবৃন্দ; আর এরই একদিকে জিব্রিল, মিকাইল, ইসরাফিল ও আজরাইলসহ ফেরেশতাদের সকল নেতা রয়েছেন, অপর একদিকে রয়েছে সকল প্রকারের জ্ঞানের আলোকপিণ্ড, গোপন রহস্যভান্ডার এবং সকল তথ্যের মূলসূত্র। এরপরেও ওখানে বহু জায়গা এখনও শূন্য পড়ে রয়েছে এবং ওর অনেক অংশ এখনও অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে। মোট কথা, ওটা যেন আলাদা একটি গোটা বিশ্ব। এই বিশ্বের খানিক অংশ মূর্তিমান যা আবিষ্কৃত হয়েছে, আর খানিক অংশ বাদ রয়েছে যার পরিচয় লাভ আজও সম্ভব হয় নাই। কেউ হজরত মুহাম্মদকে (স) প্রত্যক্ষ করার পর যখন উপর্যুক্ত তত্ত্বের সাথে পরিচয় লাভ করবে তখন সেই ব্যক্তি কেবল এ সিদ্ধান্তই করবে না যে, তিনি সত্যিই নবী ছিলেন, বরং সে এরূপও মনে করবে যে, নবুওয়তের চেয়েও উচ্চ কোনো মর্যাদা তার ছিল—সে মর্যাদার নাম যদিও বা জানা সম্ভব হচ্ছে না। এমতাবস্থায় তার সামনে হজরতের যে মূর্তি ভেসে উঠবে তাতে মনে হবে যে, নবুওয়ত তো তার আলোক-সূর্যের একটু কিরণ মাত্র—এই কিরণটুকুই এখানে এসে এমন তেজস্বিতা লাভ করেছে যে, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-তারকার সকল আলোকমালা মিশ্রিত হয়ে বুঝি এক অপুর্ব আলোর মেলা সাজিয়েছে!

হজরতকে পর্যবেক্ষণ করার দুটি দিক রয়েছে। একটি জাহেরি (প্রকাশ্য), অপরটি বাতেনি (গোপন)। যে-ব্যক্তি উভয় দিক দিয়েই তাকে প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হবে তার তো আর কোনো কিছুরই প্রয়োজন বাকি থাকবে না; কারণ তার কাছে দুইজন মুহাম্মদ (স) উদ্ভাসিত হবেন—একজন জাহেরি মুহাম্মদ (স), অপরজন বাতেনি মুহাম্মদ (স)। তিনি লাভ করবেন মুহাম্মদের (স) প্রতি দুইটি ঈমান, দুইটি দৃঢ় প্রত্যয়। তবে কেউ যদি কেবল জাহেরি দিক দিয়েও তাকে প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হন তাহলেও দুইটি না হোক একটি ঈমান ও একট দৃঢ় প্রত্যয় লাভ হতে তো তিনি কিছুতেই বঞ্চিত হবেন না।

এমনই অবস্থায় পৌঁছলে তার হৃদয়ে হজরতের প্রতি যে ঈমান থাকবে তাতে কোনো দিক দিয়েই দুর্বলতা বা সন্দেহ স্পর্শও করতে পারবে না। তাকে প্রত্যক্ষ করার প্রকাশ্য ফল-লাভ এই হবে যে তিনি দেখতে পাবেন : হজরত কামেল চিন্তাশীল ব্যক্তি ছিলেন। তিনি যখন চিন্তা করেছেন সঠিকভাবেই চিন্তা করেছেন; আর তিনি যে চিন্তা করেছেন বিশুদ্ধ চিন্তাই করেছেন। এজন্যই বিরোধী সকল চিন্তা সব সময়ই তার চিন্তার কাছে হার মেনেছে। তৎকালীন জ্ঞাত-বিশ্বের এমন কোনো চিন্তাবিদই ছিল না যে তার চিন্তার বিপক্ষে না গিয়েছে এবং পরাজিত না হয়েছে! তারপর, যদি কেউ বলতে চান হজরত মুহাম্মদ (স) প্রত্যাদেশ লাভে বঞ্চিত ছিলেন, আপাতত তা মেনে নিলেও ক্ষতি নাই। কারণ, যদি প্রত্যাদেশ লাভে বঞ্চিত কোনো ব্যক্তি নিজের সঠিক চিন্তার মাধ্যমে প্রত্যাদেশ-প্রাপ্ত সকলের অপেক্ষা সত্য-অনুধাবনের ক্ষেত্রে অধিক অগ্রসর হতে পারেন, তাহলে তার পক্ষে প্রত্যাদেশ লাভ না করা কি তার অযোগ্যতা প্রমাণ করবে, না তার কামলিয়াত প্রমাণ করবে? এমন ক্ষেত্রে তো তার চিন্তাই প্রত্যাদেশের চেয়ে অধিক মূল্যবান প্রমাণিত হবে। এমতাবস্থায়, প্রত্যাদেশ লাভ করাকেই যদি নবুওয়ত নামে আখ্যায়িত করা হয় তাহলে অবশ্য হজরত মুহাম্মদের (স) নবুওয়ত প্রমাণিত হয় না, কিন্তু এরচেয়ে বড় একটি জিনিশ প্রমাণিত হয়; তা এমন দার্শনিকতা যা নবুওয়তের চেয়ে উন্নত জিনিশ। সুতরাং ফল এই দাঁড়ায়—হজরত (স) নবুওয়ত অপেক্ষা আরও অধিক মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।

এখানে, আরও একটি প্রশ্নের উদয় হতে পারে যার আলোচনা মূল বিতর্কের ওপর নতুনভাবে আলোকপাত করব; প্রশ্নটি এই যে, কেন অপরিণত চিন্তাবিদদের ওপর ওহি বা প্রত্যাদেশ নাজিল হয়েছে? প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হওয়ার বিধি কি এই যে, অপরিণত চিন্তাবিদদের ওপর তা অবতীর্ণ হবে অথচ কামেল চিন্তাবিদদের ওপর অবতীর্ণ হবে না? যদি এটাই সত্যিকারের বিধান হয়ে থাকে তাহলে সমগ্র ঐশী বিষয়টিই ভিত্তিহীন হয়ে পড়বে। এটা কখনও হতে পারে না—বরং প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হবার বিধানটি এর সম্পূর্ণ বিপরীত; নিশ্চয় নিয়মটি এমন যে অপরিণত চিন্তাবিদ অপেক্ষা কামেল চিন্তাবিদদের ওপর অধিক উচ্চ পর্যায়ের প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়ে থাকে। সুতরাং, হজরত মুহাম্মদের (স) প্রত্যাদেশ লাভের বিষয়টিও এর ফলে নিশ্চিত হয়ে যায়—এ কথা প্রমাণিত হয় যে তার চিন্তা সর্বাপেক্ষা কামেল ছিল এবং এর বিপরীতে কোনো চিন্তাই এতটুকুও আলোক-বিকিরণ করতে সক্ষম হয় নাই। হজরত ঈসা (আ), হজরত মুসা (আ) ও অন্যান্য সম্মানিত নবীদের বেলায় প্রত্যাদেশ ছাড়া তাদের নিজস্ব চিন্তার স্বাতন্ত্র্য কোথায়? হজরত ঈসা (আ) কিছু উপদেশমূলক বক্তৃতাদান ও কয়েকজন শিষ্য একত্র করা ছাড়া অন্য কোনো চেষ্টায় সাফল্য লাভ করেছেন কি? অথচ, তাকে তো পরিবার-পরিজনের ঝামেলায় পড়তে হয় নাই, রাজ্য পরিচালনা ও দেশ শাসন করতে হয় নাই, কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোনো ব্যাপারের সাথেও কোনো সংশ্রব রাখতে হয় নাই; তিনি রাজনীতিতেও প্রবেশ করেন নাই, কিংবা সমাজনীতিও স্পর্শ করতে সক্ষম হন নাই। কেবল ধর্মপ্রচার ও ধর্মশিক্ষা দানই ছিল তার ব্রত। তারপরও, সেখানেও তার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। পরে কী কী হয়েছে তা পৃথক ব্যাপার এবং তা পরবর্তীদেরই বিষয়, তার কিছুই নয়।

হজরত মুসাও (আ) অলৌকিকত্ব ও প্রত্যাদেশের মাধ্যমে যত দূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিল তত দূরই অগ্রসর হয়েছেন; কিন্তু যখনই কোথাও চিন্তার প্রয়োজন হয়েছে তখনই সেখানে দেখা যায় তার ব্যর্থতা। হজরত মুসার (আ) ওপর যে-দায়িত্ব ছিল তা সুকঠিন ছিল, সন্দেহ নাই; কিন্তু নিজ কওমকে স্বীয় বিশ্বাসে দৃঢ় রাখাই তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এ কথা সত্য যে, হজরত ইউশা (আ) তার অসম্পূর্ণ কার্যকে সম্পূর্ণ করেছেন, কিন্তু সে কৃতিত্ব তো হজরত ইউশারই (আ), হজরত মুসার (আ) নয়। অপর পক্ষে, তাদের তুলনায় হজরত মুহাম্মদকে (স) পর্যবেক্ষণ করুন, দেখতে পাবেন, তিনি যা চিন্তা করেছেন অন্তত ভিত্তি-রচনা বা নমুনা পর্যায়ে তিনি তা নিজে করে গেছেন। শাখা-পর্যায়ে অবশ্য তিনি সমস্ত কিছু সম্পন্ন করে যেতে পারেন নাই। কিন্তু শেষোক্ত পর্যায়ে, খুঁটিনাটি সমস্ত কিছু করার সম্ভাবনা কোনো এক যুগে এবং একই ব্যক্তির জীবনে তো কল্পনাও করা যায় না।

প্রশ্ন হলো, অন্যান্যদের তুলনায় তার এই পার্থক্য কি জন্য? এ পার্থক্য এজন্য যে হজরত মুহাম্মদের (স) চিন্তা ছিল অপেক্ষাকৃত কামেল চিন্তা।

এইবার সমকালীন অবস্থা পর্যালোচনা করা যাক। একদিকে, ইহুদি ও খ্রিষ্টানসহ সমগ্র আরবের সকল চিন্তাবিদই তার বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়েছেন এবং নিজ নিজ চিন্তার চাকচিক্য প্রদর্শন করেও ব্যর্থ হয়েছেন। তারপর বিরোধিতায় নেমেছেন পারস্যের চিন্তাবিদগণ। তাদেরও একই পরিণতি ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এসেছেন রোমক চিন্তাবিদগণ। কিন্তু তারাও পরাজিত হয়ে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। সুতরাং হজরত যে কামেল চিন্তার অধিকারী ছিলেন তা স্বীকার করে নিতে আর আপত্তির কি থাকতে পারে?

এ প্রসঙ্গে, কেউ হয়তো বলতে পারেন যে, তার চিন্তার এই যে বিজয় এতে আল্লাহর সাহায্যেরও তো ভূমিকা ছিল। মেনে নিলাম, তা ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সাহায্যটি কীভাবে তিনি লাভ করতেন? যদি এর উত্তরে বলা হয় যে, ওহি বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে, তাহলে তার নবুওয়তের প্রমাণ করতে আর কোনো প্রকারের বেগই পেতে হয় না। যদি বলা হয় যে ওহি বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে নয়, বরং অদৃশ্য কোনো শক্তির মাধ্যমে তিনি আল্লাহর সাহায্য লাভ করতেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে যে, এই অদৃশ্য শক্তিটি কী? ফেরেশতার আগমন? তাহলেও তো তার নবুওয়ত স্বতঃসিদ্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া, এই অদৃশ্য শক্তির নিত্যপ্রকাশ অন্যান্য মাননীয় নবীদের বেলায় হয় নাই কেন? উত্তরে হয়তো কেউ বলবেন তা অবিনশ্বরের ইচ্ছা। তাহলে তো বুদ্ধির বিতর্ক এখানেই শেষ হয়ে যায়। সুতরাং অন্য কোনো প্রশ্নের আর অবকাশ থাকে না।

এরপর তার পর্যবেক্ষণ এ সত্যই প্রকাশ করবে যে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ছিলেন; কঠিন সংকট-সন্ধিক্ষণেও তিনি কখনও হতাশায় চিৎকার করে বলেন নাই যে, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমাকে কেন পরিত্যাগ করলে?’, কিংবা এ কথাও বলেন নাই যে, ‘হে আল্লাহ, এখন আমি কি করব?’ যদি বা কখনও উদ্বেগ বোধ করেছেন তবু তিনি বলেছেন : ‘হে আল্লাহ, আমার সাথে যদি তোমার নাম উচ্চারণকারীরাও আজ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তাহলে এই ধরাধামে তোমার নাম নেওয়ার আর কেউই অবশিষ্ট থাকবে না।’ এরপরই, তিনি যে-কার্যে রত ছিলেন তাতেই আবার আত্মনিয়োগ করেছেন। পরে আর তার মধ্যে সামান্যতম উদ্বেগও পরিলক্ষিত হয় নাই কিংবা তিনি একটুও বিচলিত ভাব প্রদর্শন করেন নাই; বরং তখন তিনি পরিপূর্ণ প্রশান্তির ভাব ধারণ করেছেন। এমনও অনেক সময় হয়েছে যে, সকলে ‘অপারগ’ হয়ে পড়েছেন কিন্তু তিনি একনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলছেন। এইরূপ অবিচলিততাবে কার্যে মগ্ন থেকে তিনি সঙ্গীদের মনে নতুন প্রেরণার সঞ্চার করেছেন—এতে, যারা ক্লান্ত, ভগ্নহৃদয় হয়ে পড়েছিলেন তারা লাভ করেছেন নতুন জীবন। ফলে, গোটা দলই নববলে বলীয়ান হয়ে পুনরায় পূর্ণোদ্যমে কর্মক্ষেত্রে ঝাপিয়ে পড়েছেন।

জিজ্ঞাসা করি, তার এই দৃঢ়চিত্ততা কি নবীদের দৃঢ়চিত্ততা অপেক্ষা কোনো অংশে দুর্বল ছিল? নিশ্চয়ই নয়। বরং তারচেয়েও দৃঢ়ই ছিল। এমনকি, এমন একজন নবীরও নাম করা সম্ভব হবে না যিনি হজরতের কীর্তির সমান কীর্তি প্রদর্শন করেছেন এবং তার চিত্তের দৃঢ়তার মতো নিজেকে দৃঢ়চিত্ত করতে পেরেছেন।

তাকে সাক্ষ্য মানার মাধ্যমে এই উপলব্ধিও সম্ভব হবে যে, হজরত পরিপূর্ণ বিনয়ী ছিলেন। অন্যের ক্ষুধা মিটাতে গিয়ে নিজের ও নিজ পরিবারের জন্য নিত্য-উপবাসকে তিনি স্থায়ী কার্যসূচীতে পরিণত করেছিলেন। আজীবন ধৈর্য ও তিতিক্ষা, আজীবন সৃষ্টির পালন ও সেবার মাধ্যমে উক্ত কার্যসূচীকে তিনি এমনই ক্রটিহীন ও নিখুঁত করে তুলেছিলেন যে, সমগ্ৰ মানবজাতির ইতিহাসে এমন কোনো মহৎ ব্যক্তিরই সাক্ষাৎ মিলবে না যিনি এই ক্ষেত্রে তার সমতুল্য হতে পারেন। এমনকি, অন্য কোনো নবীও নন।

তার দিকে তাকালে আরও জানা যাবে যে তিনি ছিলেন চরম নির্ভীক ও পরম সাহসী, তিনি ছিলেন মুক্তহস্ত দানশীল ও অত্যন্ত উদার।

সকলেই যখন ভীত হয়ে পড়ত এবং রণে ভঙ্গ প্রদর্শন করত তখনও তিনি থাকতেন ভয়হীন ও রণক্ষেত্রে অবিচল। শুধু তা-ই নয়, এমনই সংকটকালে তিনি যেন আরও সাহসী হয়ে উঠতেন এবং শক্রর মধ্যেও ধ্বনি উচ্চারণ করত বিপুল বিক্রমে অগ্রসর হতে থাকতেন। এমনকি, এসব দেখে শেষে পৃষ্ঠপ্রদর্শনকারীরাও ফিরে আসত এবং হতোদ্যমরাও পূর্ণোদ্যম হয়ে উঠত।

পরিপূর্ণতার পথে: গুরুত্বপুর্ণ ঘটনাবলির আলোকে

পবিত্র কোরআন লিখন ও ক্রমিক বিন্যাস: পবিত্র কোরআন ধীরে ধীরে অবতীর্ণ হচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই সেটা লেখা হতো এবং ক্রমিক বিন্যাসে সাজানো হতো। লেখার জন্য লেখকগণ নির্দিষ্ট ছিলেন। তখনো আরবে লেখার জন্য কাগজের প্রচলন ছিল না সুতরাং, খেজুরের পাতা, চামড়া ও মোটা হাড়ের ওপর আল কোরআন সংকলন হতো।

হজরত আবু বকরের (রা) খেলাফতের সময় এই সকল লেখাকে একত্র করে গ্রন্থাকারে প্রস্তুত করা হয়। অবশ্য এই গ্রন্থও কাগজের না, চামড়ার ছিল। হজরত ওসমানের (রা) খেলাফতকালে এই গ্রন্থটিরই ছয়টি কপি তৈরি করে খেলাফতের অধীন ছয়টি দেশে প্রেরণ করা হয়। তখনো মুদ্রাযন্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি। সুতরাং, ওই ছয় কপি থেকে অনুলিপি করে কোরআনের শিক্ষার প্রচার করা হতে থাকে। আগে থেকেই কোরআন মুখস্থ করার রীতি প্রচলিত ছিল। তারপর যখন মুদ্রণপ্রথা প্রচলিত হয় তখন কোরআনও মুদ্রিত হতে থাকে। এই জন্য পবিত্র কোরআন যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছে আদ্যোপান্ত অবিকৃত তেমনই সংরক্ষিত রয়েছে। পবিত্র কোরআন সবসময় আরবি অক্ষরে লিখিত হয়েছে। আজও এই নিয়মই অনুসৃত হচ্ছে।

সাহাবিদের যুগেই কোরআনের তফসিরের কাজটি হয়ে যায়। এ কাজ সম্পন্ন করেন সেই সব জ্ঞানী ব্যক্তি যারা স্বয়ং রসুল্লাহর (স) সান্নিধ্যে কোরআনের সবক লাভ করেন। কোরআনের কতকাংশের তফসির স্বয়ং হজরত করে গিয়েছিলেন; হাদিস গ্রন্থসমূহে আজও তা বিদ্যমান রয়েছে।

মসজিদ: নবী-যুগেই মসজিদ নির্মাণ শুরু হয়। সর্বপ্রথম এক গ্রামে কোবা নামক মসজিদটি নির্মিত হয়। তারপর মদিনায় নির্মিত হয় দ্বিতীয় মসজিদ তারই তত্ত্বাবধানে। প্রথম প্রথম মসজিদ সম্পূর্ণ সাদাসিধা ধরনের তৈরি করা হতো। পরে কারুকার্য-শোভিত মসজিদ নির্মিত হতে থাকে। প্রথম দিকে মসজিদে একটি মিনার থাকত, পরে দুই মিনার নির্মাণ শুরু হয়। প্রথম দিকে কারুকার্যময় এবং নামডাকের মসজিদ তৈরি হতো না। একবার নামডাকের জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল, কিন্তু স্বয়ং হজরতের নির্দেশে তা ভেঙে ফেলা হয়। অথচ, পরে সেই পদ্ধতিতেই বহু মসজিদ নির্মিত হয়েছে। কিন্তু এমন কে আছেন, যিনি ওইসব রঙঢঙের মসজিদসমূহকে ভেঙে দিতে সক্ষম?

প্রথম দিকে মসজিদসমূহ দুনিয়ার কর্মকেন্দ্র হিশাবেও বিবেচিত হতো। কিন্তু পরে তাকে নিছক গির্জায় পরিণত করা হয়েছ। অর্থাৎ মসজিদে এখন কেবল স্রষ্টা এবাদত করা যায়, সৃষ্টির সেবা করা যায় না। কিন্তু এমন কে আছেন যিনি মসজিদকে তার ছিনতাই করা মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম?

নামাজ: হজরত স্বয়ং নামাজ প্রবর্তন করেন। মসজিদেই এই নামাজ সম্পন্ন করা হতো। দৈনিক পাঁচবার জামাত বা দলবদ্ধ হয়েই তা সম্পন্ন করা হতো। পরে, অর্থাৎ বেশ কিছুদিন পরে, নামাজ আর নামাজ না থেকে ওঠাবসায় পরিণত হলো। এই নামাজের জন্য মসজিদ ও জামাত এই দুইটির প্রয়োজন থাকল না। তারপর এর আর পার্থিব ফলদানের ক্ষমতা রইল না, এই নামাজ বন্ধ্যা হয়ে গেল। ফলে, মসজিদ বিরান হলো, জামাত ভেঙে পড়ল এবং মুসল্লিদের সংখ্যাও হ্রাস পেতে লাগল। ভবিষ্যৎ বংশধরদের কালে সম্ভবত নামাজ বিলুপ্তই হয়ে যাবে। কিন্তু কে এমন আছেন, যিনি নামাজকে পুনরুজ্জীবিত করবেন, মসজিদসমূহকে লোকপ্রিয় করে তুলবেন, জামাতকে শক্তিশালী করবেন এবং নামাজকে খাঁটি করে তোলার পুণ্যার্জনে সক্ষম হবেন?

রোজা: নবী-যুগেই রোজার প্রচলন হয়। তবে তা ‘রোজা’ হিশাবেই প্রতিপালিত হতো। অবশ্য পরে রোজা আর রোজা রইল না, উপবাসে রূপান্তরিত হলো আর, এই জন্য রোজা আজ মৃতপ্রায়। কিন্তু কোথায় কে আছেন, যিনি রোজাকে রোজার মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন এবং তার মৃতপ্রায় প্রাণে নবজীবনের আবে হায়াত ঢেলে দিবেন?

জাকাত: জাকাতের প্রথাটিও নবী-যুগ হতেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরে জকাতকে ‘খয়রাত’-এ রূপান্তরিত করা হয় এবং খয়রাতের মতোই তা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু এমন কেউ কি আছেন যিনি জাকাতকে পুনরায় জাকাতের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবেন এবং তাকে পুনরুজ্জীবিত করবেন?

হজ: হজ কিছুদিন বন্ধ ছিল, পরে তা পুনরায় চালু হয়। তারপর হজ এমনই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। কিন্তু পরে এই হজকেই জিয়ারত প্রথায় পরিণত করা হয়েছে। এটি এখন ইসলামি-প্রাণশূন্য প্রথাসর্বস্ব অনুষ্ঠান মাত্র। ভবিষ্যতে এটি কেমন রূপ ধারণ করবে তা এখনে বলা কঠিন। কিন্তু লক্ষণ মোটেও ভালো মনে হয় না। কিন্তু কে আছেন এমন, যিনি হজকে পুনরায় সত্যিকার হজে পরিণত করবেন এবং এর বিলুপ্তপ্রায় মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবেন?

জেহাদ: জেহাদও হজরতের যুগে এবং তারই কল্যাণে মহত্তম মর্যাদা পায়—এমন মর্যাদা পায় যার কাছে আর সকল মর্যাদাই ম্লান হয়ে যায়। পরে এই জিহাদের গতি তীব্রতর হতে থাকে। সেই ক্ষিপ্রগতি এমনই ছিল যে অপর প্রতিটি চলমান বস্তুই এর কাছে থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু এই জেহাদই পরে সংঘাতে পরিণত হয়। সেই এর মর্যাদাহানি হয়েছে, আজ অবধি সে হৃতমর্যাদা পুনরুদ্ধার হয়নি। ভবিষ্যতে এর নামটিও অবশিষ্ট থাকবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু কে আছেন এমন যিনি জেহাদকে সংঘাতের আবর্ত হতে উদ্ধার করে একে যথাযথ লক্ষ্যপুষ্ট করে তুলতে সক্ষম হবেন?

চুক্তি: চুক্তির প্রথাটিও সর্বদাই বিদ্যমান ছিল। কখনও চুক্তি খানিকটা প্রাতিপালিত হয়েছে, কখনও-বা খানিকটা ভঙ্গ করা হয়েছে! তবে হজরত স্বয়ং কখনও সামান্যতম চুক্তিও ভঙ্গ করেন নাই। অপরপক্ষই বরং তা ভঙ্গ করেছে। চুক্তি ভঙ্গকারীদের সধ্যে ইহুদিরা ছিল অগ্রগামী। তারপর চুক্তি ভঙ্গ করে মক্কার প্রতিমাপূজকদল। এর পর যারা চুক্তি ভঙ্গ করে তারা আর কেউ নয়, এরা হলো বর্বরদেরই বন্ধু। এরা চুক্তি ভঙ্গ করেছে ঠিক, কিন্তু তার ফলও ভোগ করেছে যথেষ্ট। এমনকি, সেই চুক্তি ভঙ্গকারীদের কেউ কেউ আজও তা ভোগ করেই চলছে। কিন্তু বর্তমানে তো খোদ মুসলিমরাও চুক্তিভঙ্গে যথেষ্ট অগ্রগামী; ফলে কর্মফল ভোগ করছেও যথেষ্ট। কিন্তু কে এমন আছেন, যিনি তাদেরকে সঠিকভাবে বিষয়টি বুঝাতে সমর্থ?

সন্ধি ও বিজয়: যুদ্ধ উপর্যুপরিই করতে হয়েছে এবং এই অবস্থা শেষ অবধিই বিদ্যমান ছিল। যুদ্ধ না করেও উপায় ছিল না, কারণ সমগ্র আরব তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। প্রায় সবকয়টি যুদ্ধেই তার বিজয় হয়েছে। কিন্তু সে বিজয়কেই প্রকৃত বিজয় মনে করা উচিত যে-বিজয় যুদ্ধেরই সমাধি রচনা করেছিল এবং যা আরব উপদ্বীপে ইসলামের পতাকাকে চিরদিনের জন্য উঁচু করে তুলে ধরেছিল; সেই বিজয় হচ্ছে মক্কা বিজয়। তেমনই কাফের আরবদের সাথে মুসলিমদের বেশ কয়টি সন্ধিই হয়েছিল, কিন্তু যে-সন্ধিটি ইসলামকে পূর্ণ বিজয়ের শীর্ষে আরোহন করাতে সক্ষম হয়েছিল সেটি হচ্ছে হুদাইবিয়ার সন্ধি।

ব্যাপকভাবে ইসলাম গ্রহণ: মক্কা বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপকভাবে ইসলাম গ্রহণ শুরু হয়ে যায়। গোত্রের পর গোত্র তথা সমগ্র আরবই এই সময় ইসলাম গ্রহণ করে। আরবরা চিরকাল যুদ্ধপ্রিয় জাতি। প্রমাণ নয়, যুদ্ধে বিজয়ই তাদের ওপর অধিক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। এইজন্য, প্রমাণাদির দ্বারা বেশি দূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয় নাই, কিন্তু যুদ্ধ-বিজয় সামগ্রিক বিজয়ই ডেকে আনে। কী সাধারণ গ্রাম—স্বয়ং মক্কা নগরীরও মস্তক অবনত হয়ে গেছে। সুতরাং এর পর যেরূপ ব্যাপকভাবে ইসলাম গ্রহণের ধুম পড়ে গিয়েছিল এবং তখন যে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল তা সম্ভবত এ বিশ্ব আর কখনও দেখতে পাবে না। তিনি এক পর্বতশীর্ষে বসেছিলেন, সেখানে দলে দলে মানুষ আসছিল আর কলেমা উচ্চারণ করে প্রস্থান করছিল। অনাড়ম্বরতা ও সাধনা-সিদ্ধির এমন চূড়ান্ত ও অপূর্ব রূপ আর কখনও এমন মহিমাময় হয়ে ফোটে ওঠে নাই।

বিশ্বের প্রতি আহ্বান: আরবের এই হুলস্থুল তখনো থামে নাই, সেই সময়ই ইসলামের আহ্বান সেই সকল দেশে পৌঁছিয়ে দেওয়া হলো যেসব দেশে আরবদেশ থেকে বাণী প্রেরণ তখনকার দিনে সম্ভব ছিল। এই আহ্বান সর্বাবস্থায় যে সাড়া পেয়েছে এমন নয়। তবে ইসলামের এই আহ্বান নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। কোথাও কোথাও-বা কিছুটা সাড়াও পাওয়া গেল। অপরপক্ষে কোথাও-বা শাসক ও সরদারদের কাছে আহ্বান লিপি প্রেরিত হয়, তাতে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, ‘আনুগত্যে নিরাপত্তা, প্রত্যাখ্যানে ধ্বংস অনিবার্য’। এই সাবধানবাণী বাস্তবেও সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ওই আহ্বানে যারা সাড়া দিয়েছিলেন তারা লাভ করেছিলেন নিরাপত্তা ও শান্তি, আর যারা প্রত্যাখ্যান করেছিল তার ধ্বংস হয়ে গেছে।

নির্বাসন: ইহুদিদের প্রতারণা যখন সকল সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল তখন তাদেরকে আরবদেশ থেকে নির্বাসিত করে অন্য কোনো উপযুক্ত স্থানে তাদের বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়। এই ব্যবস্থাটির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয় হজরত ওমরের (রা) খেলাফতকালে যখন তাদের একটি নতুন ষড়যন্ত্রের বিষয় উদ্ঘাটিত হয় এবং তাতে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে যতই সুযোগ দান ও উদারতা প্রদর্শন করা হোক না কেন, কোনো কিছুই তাদেরকে ঠিক করতে সক্ষম হবে না।

ভরণপোষণের ব্যবস্থা: হজরত খেলাফতের প্রধান হিশাবে তার পরিবারবর্গের ভরণপোষণের ব্যয় নির্বাহের জন্য যে-ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই ব্যবস্থায় তার শ্রমের এক অংশের মূল্য অপরের সমপরিমাণ শ্রমের মূল্য অনুযায়ীই নির্ধারিত করেন এবং সেই মোতাবেক তিনি নিজের জন্য দুইটি খেজুরের বাগান নির্দিষ্ট করে নিয়েছিলেন। তার এই ব্যবস্থাটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছিল। কিন্তু হলে কী হবে, তারপরেও উপবাসের পর উপবাস এবং কঠোর জীবনের কোনো পরিবর্তনই হয়নি। এর কারণ কী? কারণ এই যে, আয়ের ব্যবস্থা করলেও সঙ্গে সঙ্গেই আরও একটি বিধি বলবৎ ছিল—তা এই যে আল্লাহর নবীর (স) দরোজায় এসে কেউ শূন্যহাতে ফেরত যেতে পারবে না।

জীবিকা উপার্জনে ভ্রাতৃত্ব: সামাজিক ভ্রাতৃত্ব তো এই বিশ্বে অসংখ্যবার স্থাপিত হয়েছে, কিন্তু জীবিকা উপার্জনে বিশ্বে সর্বপ্রথম ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিস্থাপন করেন হজরত মুহাম্মদ (স)। মক্কার মুহাজেরিন ও মদিনার আনসারদের মধ্যে তিনি ভাই-ভাইয়ের সম্পর্ক স্থাপন করে দেন, বলেন ‘তোমরা তোমাদের অর্ধাংশ মুহাজির ভাইদের প্রদান করবে’। এরপর আনসাররা তাদের যাবতীর সম্পত্তি ও আসবাবপত্রের অর্ধাংশ, এমনকি একাধিক স্ত্রী থাকলে একজনকে তালাক দিয়ে তার মুহাজির ভাইয়ে বিবাহের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এমনই সহজ ও সুস্পষ্টভাবে এই বিধানটি কার্যকরী করা হয়েছিল যে, ‘খিদে লাগলে খেয়ে নাও’ এই ধ্রুব নিয়মও অত সহজে ও অত সুষ্ঠুভাবে কার্যকরী করা হয় কিনা সন্দেহ। এমনকি, ‘অর্ধাংশ’ শব্দটির প্রতি গুরুত্ব দিতে গিয়ে তারা এমনই উৎসাহের পরিচয় দিয়েছিলেন যে, যার একজোড়া মাত্র জোতা ছিল তিনি তাও ভাগ করে তার মুহাজির ভাইকে প্রদান করেছিলেন।

হজরত মুহাম্মদের (স) কর্ম ও কর্মপদ্ধতি

নবুওয়তের তেইশ বছরে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মহান আল্লাহ হজরত মুহাম্মদকে (স) আদেশ-নিষেধ ও কর্মপন্থা বাতলেছেন। কোরআনে সুরা আলে ইমরানের ১৬৪ নং আয়াতে যেমন আছে—‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ মুমিনদের প্রতি বড়ো অনুগ্রহ করেছেন, তিনি তাদের কাছে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রসুল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের সামনে আল্লার আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তাদের পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে আল্লাহর কিতাব ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেন। আর নিশ্চয়ই এর আগে তারা সুস্পষ্ট গোমরাহির মধ্যে ছিল।’

এই আয়াতে আল্লাহ তার নবীর জন্য তিনটি কাজ স্পষ্ট করেন—  

  • উম্মতকে কোরআন শোনানো (তেলাওয়াত)। 
  • তাদের পরিশুদ্ধ করা (তাজকিয়া)।
  • আল্লাহর কিতাব তথা বিধিবিধান ব্যবহারিকভাবে শিক্ষা দেওয়া এবং প্রজ্ঞার বিকাশে সহায়তা করা (হেকমতের তালিম)।

তো এইসব বিষয় আল্লাহর নবীর (স) কোন কোন কর্মের মধ্য দিয়ে কীভাবে বাস্তবায়ন করেছেন তার একটি তালিকা নিম্নে প্রদান করা হলো :

ব্যক্তিগত পর্যায়ে

১. আত্মোপলব্ধি:

  • এই উপলব্ধি—আমি আছি।
  • এই উপলব্ধি—আমি যা-ই হই না কেন, আমার মর্যাদা ও মূল্য আছে।
  • এই উপলব্ধি—আমি যা, আমাকে তার যোগ্য হয়ে থাকতে হবে।
  • এই উপলব্ধি—আমিই আমার জিম্মাদার।
  • এই উপলব্ধি—আমি যদি নিজেকে প্রতিপালন না করি তাহলে টিকতে পারব না।
  • এই উপলব্ধি—নিজের প্রতিপালন আরম্ভ করতে হবে।

২. আপন লালন-পালন:

  • লালন-পালনের জন্য অপরের নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি।
  • নিজেকে পালনের পদ্ধতি নির্বাচন।
  • আত্মপালন-পদ্ধতির উন্নয়ন।
  • আপন লালন-পালনের আদর্শ নির্ধারণ ও সেই অনুযায়ী জীবিকা অর্জনের পন্থা নিরূপণ।

৩. নিজের তরবিয়ত বা নিজকে গড়ে তোলা:

  • নিজকে গড়ে তোলার আদর্শ ও পদ্ধতি নির্ধারণ।
  • নিজকে গড়ে তোলার ব্যবস্থাকরণ ও তা সমাপ্তিকরণ।

৪. নিজ শিক্ষা:

  • শিক্ষার আদর্শ ও পদ্ধতি নির্ধারণ।
  • নিজের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থাকরণ এবং তা সমাপ্তিকরণ।

৫. আত্মস্বাচ্ছন্দ্য:

  • স্বাচ্ছন্দ্য লাভের উদ্দীপনা।
  • স্বাচ্ছন্দ্য লাভের চেষ্টা করা।
  • স্বাচ্ছন্দ্য হাসিল করার নিয়ম।

৬. আপন যৌনপ্রয়োজন:

  • যৌনসম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত।
  • যৌনসম্পর্কের আদর্শ ও পদ্ধতি নির্ণয় ও তা কার্যকরীকরণের সিদ্ধান্ত।
  • স্ত্রীদের মান নির্ধারণ এবং সেরকম স্ত্রী পাওয়ার জন্য প্রতীক্ষা।
  • উদ্দিষ্টমানের স্ত্রী লাভের উপায়।

৭. আপন পরিবার প্রতিপালন:

  • পারিবারিক জীবন প্রয়োজন—এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
  • পারিবারিক জীবনের বিধিবিধান।
  • পারিবারিক জীবনের আপদবিপদের মোকাবিলা।
  • পারিবারিক জীবনের আদর্শ প্রতিষ্ঠায় সাফল্য।

৮. আত্মপরিচিতি:

  • এই পরিচয় লাভ যে, আমি আমিই—আমি ভিন্ন অন্য কেউ নয়।
  • আমি সুউচ্চ ও গভীরতাময় মর্যাদার অধিকারী মানুষ।
  • আমি মানুষের জন্য জন্মলাভ করেছি, নিজের জন্য নয়।
  • আমি যা আমাকে তা-ই হতে হবে।
  • আমার যা হওয়া উচিত আমি তা না হলে আমি ধ্বংস হয়ে যাব।
  • আমার যা হওয়া উচিত আমি তা হতে পারব।
  • আমার চেষ্টার সাথে অদৃশ্য সাহায্যলাভও হবে।
  • আমি যেই হই না কেন, আমার জীবন সাধারণের জীবনের মতো নয়।

৯. আত্মোন্নতি:

  • জ্ঞানের ব্যাপারে আত্মতুষ্টি বর্জন।
  • উন্নতির স্পৃহাকে সব সময় জাগ্রত রাখা।
  • উন্নতির আদর্শ ও পন্থা নির্ধারণ।
  • উন্নতির কর্মসূচি প্রণয়ন।
  • উন্নতির পথের বাধার মোকাবেলা করা।
  • উন্নতির চেষ্টায় সাফল্যলাভ।

১০. আপন পূর্ণতা বিধান:

  • পূর্ণতার আদর্শ ও পদ্ধতি নির্ধারণ।
  • পূর্ণতা আনয়নের জন্য চেষ্টা ও সাধনা।
  • পূর্ণতা বিধানে সাফল্যলাভ।

১১. স্বীয় খেলাফত প্রতিষ্ঠা:

  • খেলাফতের আদর্শ ও বিধিবিধান।
  • খেলাফতের জন্য চেষ্টা ও সাধনা।
  • খেলাফত লাভ।

১২. অহমবোধ বা আমিত্ব উপলদ্ধি:

  • অহমবোধ বা আমিত্বের আদর্শ ও তার ব্যবহারবিধি নির্ধারণ।
  • আমিত্ব অর্জনের চেষ্টা ও সাধনা।
  • আমিত্বে স্থিতিলাভ।

১৩. আপন রব্বানিয়াত:

  • রব্বানিয়াতের আদর্শ ও তার প্রয়োগবিধি নির্ধারণ।
  • রব্বানিয়াত বরণ।
  • রব্বানিয়াতে স্থিতিলাভ।

বিশ্বপর্যায়ে

১৪. বিশ্ব পরিচয় লাভ:

  • বিশ্ব সম্পর্কে এই জ্ঞানলাভ—বিশ্ব স্বয়ং অস্তিত্বশীল নয়।
  • বিশ্ব সম্পর্কে এই জ্ঞান লাভ—সৃষ্টিজগৎ বিক্ষিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও একত্রীভূত এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ হওয়া সত্ত্বে তা এক।
  • বিশ্ব সম্পর্কে এই জ্ঞান লাভ—মানুষ বিশ্বেরই অংশবিশেষ, তবে সে ‘আশরাফুল আলম’ (বিশ্বজগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম); এবং বিশ্বের লালনপালনে মানুষও অংশ গ্রহণ করতে সমর্থ।

১৫. বিশ্বের লালনপালন:

  • বিশ্ব-প্রতিপালনের জন্য একটি বিশেষ প্রতিপালন-ব্যবস্থা অপরিহার্য, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
  • সেই পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রয়াস।

১৬. বিশ্ব পালনে প্রতিনিধিত্ব:

  • বিশ্বের লালনপালনের বিধিবিধান প্রণয়ন।
  • বিশ্ব লালনপালনে মানুষের অংশ নির্ধারণ।
  • বিশ্ব প্রতিপালনে নিজ অংশ নির্ধারণ।
  • নিজের অংশের দায়িত্ব অনুযায়ী বিশ্ব প্রতিপালনের জন্য চেষ্ঠা ও সাধনা।
  • বিশ্ব-প্রতিপালনে সাফল্য লাভ।

১৭. বিশ্বের শিক্ষা:

  • বিশ্ব শিক্ষা এবং তার লক্ষ্য ও আদর্শ নির্ধারণ।
  • বিশ্বকে শিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারে মানুষের ভূমিকা।
  • বিশ্বকে শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজ ভূমিকা।
  • বিশ্বে শিক্ষার যথাসাধ্য ভূমিকা গ্রহণ।
  • বিশ্বের শিক্ষায় সাফল্য।

১৮. বিশ্বের স্বাচ্ছন্দ্য বিধান:

  • এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ যে, বিশ্বে সমৃদ্ধি বা স্বাচ্ছন্দ্যের সীমা থাকা উচিত।
  • বিশ্বকে সেই সীমা পর্যন্ত উপনীত করার চেষ্টা।

১৯. বিশ্বের তরবিয়ত বা বিশ্বকে গড়ে তোলা:

  • এই সিদ্ধান্ত যে, বিশ্বকে গড়ে তুলতে হবে।
  • বিশ্বকে গড়ে তোলার আদর্শ ও কর্মপন্থা গ্রহণ।
  • সেটা বাস্তবায়নের জন্য কর্মক্ষেত্রে অবতরণ।

২০. বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা:

  • এই সিদ্ধান্ত যে, বিশ্ব সামঞ্জস্যকামী।
  • বিশ্বকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার চেষ্টা।

২১. বিশ্বকে সংস্কৃতিবান করা:

  • এই সিদ্ধান্ত যে, বিশ্ব সুসভ্য হওয়া উচিত।
  • বিশ্বকে সুসভ্য হওয়ার ব্যাপারে সাহায্যের চেষ্টা।

২২. বিশ্বের প্রগতি বিধান:

  • এই সিদ্ধান্ত—বিশ্ব প্রগতিকামী।
  • বিশ্বের প্রগতির ব্যাপারে যথাসম্ভব সাহায্যের চেষ্টা।

২৩. বিশ্বের পূর্ণতা সাধন:

  • এই সিদ্ধান্ত যে, বিশ্বের পূর্ণতা বিধানের আবশ্যকতা রয়েছে।
  • বিশ্বকে পূর্ণতাবিধানের ব্যাপারে সাহায্য দানের চেষ্টা।

২৪. বিশ্বের অহম বা আমিত্ব বোধ সৃষ্টি:

  • এই সিদ্ধান্ত যে, সকল অহমবোধ বা আমিত্বকে আল্লার অভিমুখী করে তোলা দরকার।
  • বিশ্বে অহমবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা।

২৫. বিশ্বে আনুগত্য সৃষ্টি:

  • এই সিদ্ধান্ত যে, অহমবোধের মতোই আনুগত্যেরও প্রয়োজন রয়েছে।
  • আনুগত্য সৃষ্টি।

২৬. বিশ্বের কল্যাণ-বর্ধন:

  • এই সিদ্ধান্ত—বিশ্ব কল্যাণময় হতে পারে, অকল্যাণময়ও হতে পারে।
  • বিশ্বকে কল্যাণময় করার চেষ্টা।

সারসত্তা পর্যায়ে

২৭. আল্লাহর উপলব্ধি:

  • এই উপলব্ধি—আল্লাহই বাস্তব; যা দৃশ্যমান তা-ই সব নয়।
  • এই উপলব্ধি—আল্লাহই সবকিছুর মূল এবং আল্লাহর সাথে স্থায়ী সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব।

২৮. আল্লাহর সন্ধান:

  • এই সিদ্ধান্ত—আল্লাহকে পাওয়া সম্ভব।
  • এই সিদ্ধান্ত—আল্লাহর অনুসন্ধান করা উচিত।
  • এই সিদ্ধান্ত—আল্লাহর অনুসন্ধান ছাড়া পূর্ণতাপ্রাপ্তি হতে পারে না।
  • আল্লাহর অনুসন্ধানের বিধি নির্ধারণ।
  • আল্লাহর অনুসন্ধানে আত্মমগ্নতা।

২৯. আল্লাহর পরিচয় লাভ:

  • আল্লাহর পরিচয় লাভ।
  • আল্লাহর ব্যাখ্যা হাজির করা।

৩০. আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন:

  • আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন।
  • আল্লাহতে নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া।

৩১. আল্লাহর পক্ষ থেকে ফললাভ:

  • আল্লাহ থেকে যা কিছু গ্রহণীয় তা গ্রহণ।
  • আল্লাহ থেকে গ্রহণের পদ্ধতি নির্ণয়।

৩২. আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব লাভ:

  • আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কে জ্ঞানলাভ।
  • আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব লাভ।

৩৩. আল্লাহর খেদমত:

  • এই জ্ঞান লাভ—আল্লাহর খেদমত করাও সম্ভবপর।
  • এই সিদ্ধান্ত—আল্লাহর খেদমতও করতে হবে।
  • আল্লাহর খেদমতের পন্থা নিরূপণ।
  • আল্লাহর খেদমত আরম্ভ।

৩৪. আল্লাহর দিকে আহ্বান:

  • এই জ্ঞান লাভ—আল্লাতে বিলীন হয়ে যাওয়াও একটি চূড়ান্ত মর্যাদা।
  • এই সিদ্ধান্ত—আল্লাহতে বিলীন হয়ে যাব।
  • আল্লাহতে বিলীন হয়ে যাওয়া।

 

দ্বিতীয় অধ্যায়


নবী মুহাম্মদের (স) কার্যের উপকরণ

নবী মুহাম্মদের (স) এত বিপুল কর্মের এত বিপুল উপকরণ কোথা থেকে এসেছিল? নিশ্চয় তা বাহির থেকে আসেনি, ভিতর থেকেই এসেছিল। প্রকৃতপক্ষে তিনি কেবল একজন ব্যক্তি ছিলেন না, ছিলেন গোটা একটি জগৎ। সেই জগৎও অসম্পূর্ণ লোক ছিল না, ছিল একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জগৎ। আমার এ কথাটি ভাবাবেগপ্রসূত নয়, সম্পূর্ণ বাস্তব সত্য। এই সত্যটিও এমন নয় যে, এতে সামান্যতম ভেজাল মিশ্রিত হয়েছে; বরং এটি একেবারেই নির্ভেজাল সত্য। আমি এই পূর্ণ জগতের বাতেনি দিকটিকে বহুদিন ধরে দেখছি। এবং তা থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করছি; কিন্তু সত্য বলতে কি, এই সমুদ্রের কোনো কিনারা আমি কখনও পাইনি। অবশেষে আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি যে, হজরত মুহাম্মদ (স) জগৎ, আর জগৎই হজরত মুহাম্মদ (স), শুধু তা-ই নয়, তিনি হচ্ছেন স্বয়ং মহাজগৎ। এই জগতে কী কী রয়েছে তা জানবার চেষ্টা না করাই ভালো।

সুতরাং, এমন মহান ব্যক্তির পক্ষে কর্ম-সম্পাদনের জন্য বাহিরেরর উপকরণের প্রয়োজনই-বা কোথায়?

তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, ভেতর থেকে উপকরণের এই জগৎ কী করে উন্মোচিত হলো? আল্লাহ থেকে যেমন সমগ্র জগৎ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনই হজরত মুহাম্মদের (স) ভিতর থেকেও কার্যোপকরণের জগৎভান্ডার বিকশিত হয়েছে। সকলেরই হয়তো জানা আছে—জাহেরে যা কিছু আছে বাতেনেও তা আছে, আর বাতেনে যা আছে সেটাই মূল—জাহের হলো বাতেনের ছায়ামাত্র। সুতরাং মূল থেকে তার ছায়াকে বের করে আনা কঠিন কোনো কাজ নয়।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, হজরতের এত বিরাট ও মহান কার্যের উপকরণ কোথা থেকে এসেছিল, এবং কীভাবে তা বিকশিত হয়েছিল এই প্রশ্ন অবান্তর। প্রকৃত প্রশ্ন হলো, কী করে এই গুরুত্বপূর্ণ উপকরণগুলোর সন্ধানলাভ সম্ভব হয়েছিল? এছাড়া, এ প্রশ্নও উঠতে পারে—তার এই বিরাট ও মহান কার্য সাধনের জন্য কী কী উপকরণের প্রয়োজন হয়েছিল, এবং সেই উপকরণগুলোর তালিকা কী? এটা নিশ্চিত যে অতি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণেরই প্রয়োজন হয়েছিল। আমি শুধু এ কথাই বলবার চেষ্টা করেছি—উপকরণসমূহের প্রয়োগকর্তা উপকরণ অপেক্ষা অনেক বেশি বড়ো ও মহৎ; আর এই সকল উপকরণ যেহেতু তার নিজের মধ্যেই ছিল, সেহেতু এসবের সন্ধান লাভ কী করে কঠিন হতে পারে? এজন্য প্রয়োজন ছিল কেবল চিন্তায় নিমগ্নতার এবং বক্ষপ্রসারণের; আর এ দুটি অমূল্য অস্ত্রও এই ‘লাহুতি’ ব্যক্তির কাছে বিদ্যমান ছিল। এই অস্ত্র দুইটির মাধ্যমেই তিনি তার বাতেনি আলমকে (গূঢ়জগৎ) প্রত্যক্ষ করেছেন, এবং তাতে বিদ্যমান উপকরণরাজ্যের সন্ধান লাভ করেছেন। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনি কী কী উপকরণ লাভ করেছিলেন, আর এই সব উপকরণ তার মধ্যে কীভাবেই-বা বিন্যস্ত ছিল? এইবার তা-ই বর্ণনা করছি :

উপাদান-উপকরণের তালিকা:

১. রব্বানি চিন্তাভাবনার অভ্যাস।
২. আপন তবিয়ত ও ফিতরতের অর্থাৎ আপন সত্তার স্বভাবে রব্বানি উপলদ্ধি।
৩. স্বভাব-নিহিত যোগ্যতার রব্বানি ধারণা।
৪. বৃদ্ধিবৃত্তির রব্বানি ক্ষমতা।
৫. অন্তঃকরণের রব্বানি প্রশস্ততা।
৬. প্রভাব বিস্তারের রব্বানি শক্তি।
৭. অন্যকে বশ করার রব্বানি বাসনা।
৮. মর্মোপলব্ধির রব্বানি অবস্থা।
৯. জাগতিক বিশৃংখলার রব্বানি তদারক।
১০. সৃষ্টির খিদমতের রব্বানি উদ্দীপনা।
১১. প্রগতির রব্বানি ধারণা।
১২. পূর্ণতার রব্বানি নকশা।
১৩. সৃষ্টির অপূর্ণতার রব্বানি জ্ঞান।
১৪. সৃষ্টির বিবর্তন সম্পর্কে রব্বানি সিদ্ধান্ত।
১৫. স্থূল-বস্তুর রব্বানি সূক্ষ্মতা।
১৬. সূক্ষ্ম-বস্তুর রব্বানি স্থূলতা।
১৭. অণুপরমাণুর সংযোগ সাধনে রব্বানি নির্বাচন।
১৮. অণুপরমাণুর রব্বানি সংযোগ সাধন।
১৯. জনমতের রব্বানি পর্যবেক্ষণ।
২০. জনমত হতে রব্বানি সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
২১. জনমতের প্রতি রব্বানি নিষ্ঠা।
২২. সততার প্রতি রব্বানি নিষ্ঠা।
২৩. সমালোচনার প্রতি রব্বানি অভিনন্দন।
২৪. সংস্কার-সংশোধন মেনে নেবার রব্বানি চরিত্র।
২৫. তত্ত্ব-তালাশের রব্বানি উৎসাহ উদ্দীপনা।
২৬. সংকল্পে রব্বানি চরিত্র।
২৭. স্থৈর্যে রব্বানি অটলতা।
২৮. চরম ও মধ্যপন্থার রব্বানি সমন্বয়।
২৯. ভাবোন্মত্ততা ও সজ্ঞানচিন্তার মধ্যে রব্বানি সামঞ্জস্য।
৩০. আদি ও অন্তের রব্বানি সঙ্গতি।
৩১. সারল্য ও বৈচিত্র্যের রব্বানি সমাবেশ।
৩২. পঞ্চেন্দ্রিয়ের রব্বানি বিকাশ।
৩৩. নয়টি মহাতত্ত্বের রব্বানি উদঘাটন।
৩৪. নয়টি বস্তুজগতের পূর্ণ রব্বানি জ্ঞান।
৩৫. পরম উন্নতির রব্বানি সামর্থ।
৩৬. অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের রব্বানি ক্ষমতা।
৩৭. প্রগতিপ্রিয়তা ও দুর্লভ বস্ত-অনুসন্ধানের রব্বানি ফিতরত।
৩৮. সত্য ও তত্ত্ব-অনুসন্ধানের রব্বানি প্রেরণা।
৩৯. পরীক্ষণ ও নির্বাচনের রব্বানি যোগ্যতা।
৪০. সত্যপ্রিয়তা ও সত্যকথনের রব্বানি হিম্মত।
৪১. পরম রব্বানি শৌর্য।
৪২. পরম রব্বানি বদান্যতা।
৪৩. পরম রব্বানি গাম্ভীর্য।
৪৪. পরম রব্বানি মধুরতা।
৪৫. পরম রব্বানি কমনীয়তা।
৪৬. পরম রব্বানি বুদ্ধিমত্তা।
8৭. পরম রব্বানি শ্রম ও অধ্যবসায়।
৪৮. পরম রব্বানি স্নেহ ও দয়া।
৪৯. পরম রব্বানি ভালোবাসা ও সমবেদনা।
৫০. পূর্ণ শারীরিক সুস্থতা।
৫১. পূর্ণ দৈহিক বল।
৫২. পরম সাংগঠনিক শক্তি।
৫৩. পরম রব্বানি সৃজনী শক্তি।
৫৪. উপলব্ধির পরম রব্বানি ক্ষমতা।
৫৫. পরম রব্বানি প্রচারক্ষমতা।
৫৬. পূর্ণতা দানের পরম রব্বানি সামর্থ।
৫৭. কোনো কিছু করা-না-করার পরম রব্বানি শক্তি।
৫৮. ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্য রক্ষার পরম রব্বানি ক্ষমতা।
৫৯. সামাজিকতার পরম রব্বানি ক্ষমতা।
৬০. ব্যক্তিগত চূড়ান্ত রব্বানি ক্ষমতা।
৬১. চূড়ান্ত যৌথ রব্বানি ক্ষমতা।
৬২. পরম রব্বানি চিন্তাশক্তি।
৬৩. পরম রব্বানি কর্মশক্তি।
৬৪. পরম রব্বানি শৃঙ্খলা শক্তি।
৬৫. পরম রব্বানি আত্মীকরণ শক্তি।
৬৬. বিশদ বিবৃতির পরম রব্বানি ক্ষমতা।
৬৭. পরম রব্বানি শিক্ষাদান শক্তি।

উল্লিখিত উপাদান-উপকরণগুলো খুব বেশি কিছু নয়, বরং প্রয়োজন অনুপাতে অল্প মনে হয়। তবু এই উপাদান-উপকরণই সারাবিশ্বকে জয় করার জন্য যথেষ্ট। আমার এই দাবির সত্যতার বাস্তব প্রমাণও রয়েছে। বাস্তবে প্রয়োগ করলে যে-কেউই এর সত্যতার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে সক্ষম হবেন। হজরত যখন সমগ্র বিশ্বকে জয় করার জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন তখন এই সব ছাড়া আর কী উপাদান-উপকরণই-বা তার নিকট ছিল? এই সূক্ষ্ম বিষয়টি অবগত হওয়ার জন্য অন্য একটি বিষয় জানা দরকার। বিষয়টি হলো : জগৎ বাহিরেও বিদ্যমান—অভ্যন্তরেও বিদ্যমান। বাহিরে কেবল ফলিত রূপ বিকশিত—অভ্যন্তরেই এর আসল সত্য বিদ্যমান। বাহিরে শাখা, অভ্যন্তরেই এর মূল। মনুষ্য সৃষ্টির কৌশলটিই এমন সুন্দরভাবে করা হয়েছে যে মানুষের অভ্যন্তরে সমগ্র সৃষ্টিজগৎই যেন সুবিন্যস্ত রয়েছে, ঠিক যেমনভাবে বিস্তৃত প্রান্তরে প্রতিফলিত হয় সমগ্র সৃষ্টিজগতের রূপরেখা। মানুষের এই অভ্যন্তরীণ জগৎ কখনও প্রকাশিত হয়, আবার কখনও তা প্রকাশিত হয় না; অনেক ক্ষেত্রে অর্ধেকও বিকশিত হয়। যখন কারও এই অভ্যন্তরীণ জগৎ পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়, তখন সেই মানুষ আর মানুষ থাকেন না; তিনি নিজেই সৃষ্টিজগৎ হয়ে দাঁড়ান। এই সৃষ্টিজগৎও কোনো কল্পনা বা অনুমানের ব্যাপার নয়, প্রকৃতই তিনি নিজে একটি পূর্ণাঙ্গ জগতে রূপান্তরিত হয়ে থাকেন। এমতাবস্থায় একজন মানুষ একাই সেই সমস্ত কাজ করতে সক্ষম যা সমগ্র মানবজাতি একত্র মিলেও করতে পারে না। যেহেতু সাধারণ মানুষের কাছে কখনও এই মহাজগতের রূপ পরিস্ফুট ও বিকশিত হয় না, সেজন্য কোথাও কারও মধ্যে তা পরিস্ফুট বা বিকশিত হতে দেখলে মানুষ তাকে মোজেজা বা অস্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করে থাকে, এবং তার সংশ্রব বর্জন ও তার সাহচর্য হতে দূরে থাকাকেই শ্রেয় মনে করে। শুধু তা-ই নয়, তারপর সেই সান্ত্বনার মধ্যে যে নির্লিপ্ততা বিদ্যমান থাকে তাতেই সে গা ভাসিয়ে দেয়। এর পরিণামে সেই উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত ব্যক্তির পূজা শুরু হয়ে যায়; আবার কিছু সংখ্যক লোক এই উচ্চ মর্যাদাকেই অস্বীকার করে বসে। তবে সৌভাগ্যের কথা হলো এ ধরনের লোকের সংখ্যা খুব বেশি থাকে না, থাকলে অজ্ঞতাই প্রাধান্য লাভ করত।

ওপরে উক্ত মর্যাদাটি যে ব্যক্তির মধ্যে পূর্ণতম রূপ নিয়ে বিকশিত হয়েছিল, অথবা বলা যায়, যে ব্যক্তির মধ্যে তার অন্তর্জগৎ সম্পূর্ণ প্রস্ফুটিত হয়েছিল, যার অন্তর্জগতের প্রত্যেকটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুও পরিস্ফুটিত হয়েছিল, এবং একটি কোণও অবিকশিত থাকে নাই, কেবলমাত্র হজরত মুহাম্মদই (স) তেমন ব্যক্তি হিশাবে প্রমাণিত হতে পারেন। কারণ, তার মধ্যে যেভাবে সকল বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ও সবকিছুরই পূর্ণতা বিদ্যমান তা একজন তো দূরের কথা, সমগ্র মানব জাতির মধ্যেও পরিলক্ষিত হয় না। ওপরে বর্ণিত বিষয়গুলোই হচ্ছে সেই সব উপকরণ-উপাদান—যা তার অন্তর্জগৎকে সম্পূর্ণ বিকশিত করেছিল, এবং তাকে বানিয়েছিল একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জগৎ।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, উল্লিখিত উপকরণ-উপাদানগুলো কত মহামূল্য। সমগ্র বিশ্বের মধ্যে যা কিছু বিদ্যমান তা জয় করবার জন্য এগুলোই কি যথেষ্ট নয়? তবে প্রশ্ন হলো—এই উপাদানগুলোই কর্মসংগ্রামে পূর্ণ সাফল্যদান করতে সক্ষম কিনা, অথবা এইগুলো কর্মসংস্থানের কোনো পন্থা উন্মুক্ত করে দেয় কিনা? এ কথা প্রমাণ করা অতি সহজ। ওপরে যেসব বিষয় তালিকাভুক্ত করা হয়েছে হজরত নিশ্চয়ই সেসব সম্পাদন করেছিলেন। যদি বলি তার জীবনে উল্লিখিত কাজগুলো সম্পন্ন হয় নাই, তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়—তবে আর কী হয়েছে? তার সামগ্রিক কীর্তির মূল কথাই তো এই ছিল যে, তিনি যেমন একদিকে সমগ্র জগৎকে অতুলনীয়তাবে জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন অপরদিকে তেমনই রব্বুল আলামিনের ইচ্ছার ছায়ায় মানবতাকে পরম পূর্ণতার দিকে উন্নীত করারও চেষ্টা করেছেন। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা জরুরি—প্রত্যেক কর্মের জন্যই উপাদান ও উপকরণের প্রয়োজন হয়। সুতরাং আল্লাহর নবীর (স) এই মহান কীর্তির জন্যও নিশ্চয়ই কিছু উপাদান-উপকরণের প্রয়োজন হয়েছিল। আর এই উপাদান-উপকরণ যে উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়া আর কিছু ছিল না, তাতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নাই। তা ছাড়া, জগৎজয় তো তিনিই করতে পারেন—যিনি জগৎকে অতিক্রম করেছেন। বিজয়ী ব্যক্তি স্বয়ং এবং তার শক্তি ছাড়া আর কীই-বা জগৎ অতিক্রম করতে পারে! সুতরাং, ওপরে বর্ণিত উপাদান-উপকরণগুলো—যা আল্লাহর নবীর (স) মূর্ত পরিচয় বহন করছে—এগুলোই তার কর্মসংগ্রামের সমান হিশাবে পরিগণিত হতে পারে। মানবতাকে পূর্ণতর সৌভাগ্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করার অনুরূপ পন্থার কথাও জগতের মুখ থেকে শোনা যাবে বলে আশা করা যায় না। কেননা, জগৎ বেচারা তো একেবারেই নিশ্চুপ; আর মানবতার কর্তা ব্যক্তিদের যা দৌড়, তারাও কখনও তা করতে পারবে না! তাহলে আর বলবে কে? অনুসন্ধানকারীদের আপন দৃষ্টির ওপর নির্ভর করা ছাড়া এ ক্ষেত্রে গত্যান্তর নাই।

যাই হোক, কিছুটা ঘটনা-বিশ্লেষণসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে সক্ষম হলে প্রকৃত ব্যাপারটিও সহজেই উপলব্ধি করা সম্ভব! তবে, এই পর্যায়ের বর্ণনার জন্য শুধু আভাস দিয়েই ক্ষান্ত থাকব।

রব্বানি চিন্তাভাবনার অভ্যাস

আল্লাহর নবীর (স) কার্য উপাদান-উপকরণে প্রথমত রব্বানি চিন্তাভাবনার অভ্যাস ছিল, তার সংগ্রাম-সমাধার ব্যাপারে তার এই অভ্যাসটির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

এক্ষেত্রে প্রথমেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, হজরত মুহাম্মদের (স) মধ্যে যে এই অভ্যাসটি সত্যই ছিল তার প্রমাণ কী? প্রমাণিত তথ্য এই যে, তিনি একেবারে চুপচাপ থাকতেন এবং খুব কম কথা বলতেন, আর তিনি যখন মুখ খুলতেন তখন কেবল জ্ঞান-রূপ রত্নই মুখনিঃসৃত হতো। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তিনি যখন চুপচাপ থাকতেন তখন তিনি কী করতেন? অজ্ঞ, নিস্পৃহ ও হতোদ্যম মানুষের মতো তিনি কি ভাবনামুক্ত থাকতেন এবং এমনই করে বৃথা সময়ের অপচয় করতেন? এটা কিছুতেই হতে পারে না। মহামানবদের এক মুহূর্ত সময়ও, তা তিনি নিশ্চুপই থাকুন অথবা কথাবার্তায়ই থাকুন, এমনিতে উদ্দেশ্যহীনভাবে অযথা নষ্ট হতে পারে না। কেউ হয়তো বলতে পারেন, নিশ্চুপ অবস্থায় তিনি আল্লাহতে নিমগ্ন থাকতেন। এ কথা সত্য বটে। কিন্তু আল্লাহতে নিমগ্নতা ও চিন্তাভাবনা পরস্পরবিরোধী, এমন মনে করার কোনে কারণ নাই, অর্থাৎ একটি যখন যেখানে থাকবে অপরটি তখন সে স্থানে থাকতে পারে না এ ধারণা ঠিক নয়। বস্তুত এটি ভ্রান্ত চিন্তাপ্রসূত একটি ধারণা। প্রকৃতপক্ষে, এই দুইটি জিনিশ পরস্পরবিরোধী নয়। শুধু তা-ই নয়, বরং এই দুইটি জিনিশের মধ্যে এমন একটি মিল রয়েছে—যেখানে উভয়টিই এক সঙ্গে ক্রিয়াশীল সেখানে একটা ছাড়া অপরটির অস্তিত্বও থাকে না। আল্লাহর নবীর (স) ব্যক্তিত্ব সেইসব ব্যক্তিত্বেরই অন্যতম যাদের মধ্যে আল্লাহর নিমগ্নতা এবং চিন্তাভাবনা—দুইটিই সমভাবে সক্রিয় ছিল; এমনকি, হয়তো-বা উভয়টিই একই সময়ে একই সঙ্গে সক্রিয় ছিল। এছাড়াও, আল্লাহর নিমগ্নতা যে চিন্তা নয়, তা-ই বা কি করে বলা যেতে পারে? চিন্তা বা ফিকির মানে স্মরণ বা জিকির তো নয়ই, তা নিশ্চিতই স্বতন্ত্র বিষয়। সুতরাং ফিকির আল্লাহয় নিমগ্নতা না হয়ে আর কী হবে? তবে এ কথা সত্য যে, এই নিমগ্নতা সুপ্তির নিমগ্নতা নয়—এটি সজ্ঞান নিমগ্নতা। অবশ্য এই নিমগ্নতার লক্ষ্যবস্তু ভিন্ন হতে পারে। চূড়ান্ত পর্যায়ে এর বিষয়বস্তু আল্লাহ তাআলা হতে পারেন অথবা হতে পারে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু। সুতরাং প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহর নিমগ্নতাও এক প্রকারের চিন্তাভাবনাই বটে। এতে এটাও প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহর নবীর (স) রব্বানি চিন্তাভাবনার অভ্যাস ছিল।

তবে হ্যাঁ, এ সম্পর্কে আরও একটি প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। প্রশ্নটি এই—চিন্তাভাবনায় নিমগ্নতার আরও একটি রূপ আছে, সেই রূপটি হলো ধ্যানস্থ হওয়া। এই পর্যায়ে মানুষ কেবল পরম প্রিয়র দয়ার প্রতীক্ষায় উন্মুখ থাকে—আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে কোনো প্রকার চিন্তাভাবনা করা হয় না। কিন্তু যেহেতু দয়ার প্রতীক্ষাটিও এক প্রকার চিন্তাই বটে, সেই কারণে অনুরূপ প্রশ্নের আর কোনো অবকাশ থাকে না।

মনে রাখতে হবে—কেবল অনুসন্ধান-ভাবনাই চিন্তা নয়, উপভোগ-ভাবনাও চিন্তা বলে অভিহিত হতে পারে! কারণ উপভোগ-ভাবনাতেও চিন্তার প্রয়োজন হয়। যেমন : কোন জিনিশটা গ্রহণ করা যেতে পারে? কোন জিনিশটা নেওয়া হয়েছে? কোথা থেকে নেওয়া হয়েছে? কীভাবে নেওয়া হয়েছে? যা লক্ষ্যবস্তু এটি কি তা-ই—না অন্য কিছু? এটি কোন শ্রেণির বস্তু? এর মূল্য কত? এই জিনিশটি গ্রহণ করতে এবং পেতে কোন কোন নীতি ও বিধি পালনের প্রয়োজন হয়েছে? এই জিনিশ কি সেই স্থান হতেই পাওয়া গেছে যেখানে তা পাওয়ার কথা, না অন্য কোথাও থেকে পাওয়া গেছে?

রব্বানি চিন্তাভাবনার অভ্যাস আল্লাহর নবীর (স) কর্ম ও সংগ্রামে কতখানি ভূমিকা গ্রহণ করেছে এক্ষণে আমরা তা-ই পর্যালোচনা করব। একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে স্পষ্ট হবে এই উপাদানটি তার কীর্তি ও সংগ্রামে যে ভূমিকা গ্রহণ করেছে তার কোনো তুলনা নাই। কারণ, প্রথমত তার আপন স্বরূপ—যার ওপর অসংখ্য পর্দা পড়েছিল, এটিই তা উদ্ঘাটিত করে দিয়েছে। তারপর এটি তার সামনে এই তথ্য তুলে ধরেছে যে সৃষ্টিজগতের যা কিছু দৃশ্যমান এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তা বাহ্যিক আবরণ (জাহের) ছাড়া আর কিছু নয়। প্রকৃত রত্ন এর অভ্যন্তরে লুক্কায়িত (অর্থাৎ বাতেনি)। শুধু তা-ই নয়, বাতেনি জগতের প্রথম পর্দাটিও জাহেরের অন্তর্ভুক্ত, খানিকটা সূক্ষ্ম মাত্র! প্রকৃত রত্ন (বাতেন) আরও অনেক ভিতরে। এমনকি বাতেনি জগতের দ্বিতীয় পর্দাটিও আবরণ—অবশ্য প্রথম সূক্ষ্ম পর্দার তুলনায় সূক্ষ্মতর। এইভাবে বহু পর্দা অতিক্রমনের পর তবেই সন্ধান পাওয়া যায় প্রকৃত রত্নের।

রব্বানি চিন্তাভাবনা তার সামনে এটাও পরিষ্কার করে—‘বাতেনি জগৎ’ স্বয়ংসম্পূর্ণ, এবং সে নিজেকে মানুষের দৃষ্টি থাকে আড়ালে রাখে। বাতেনি জগৎ নিজেকে অনেকগুলো পর্দার আড়ালে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম, এবং সে এই ক্ষমতার ব্যবহারও করে।

এইভাবে তা সেই চমকদার ও বর্ণাঢ্য পর্দা এবং পোশাকি আবরণের মাধ্যমে স্থূল-দৃষ্টিসম্পন্ন ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ লোকদের কাছে নিজেকে ব্যক্ত করে; এই অভিব্যক্তি সাধারণ শ্রেণির মানুষের বিবেককে এমনভাবে অভিভূত করে যে তাদের পক্ষে সত্তার তাজাল্লির অভ্যন্তরে দৃষ্টি নিক্ষেপের অবকাশই হয় না। এমনইভাবে তা তাদেরকে সেই সব কর্মে নিমগ্ন করে যার সম্পর্ক স্থূল, কুৎসিত, বাহুল্য ও কৃত্রিম জীবন এবং কৃত্রিম পৃথিবী প্রতিষ্ঠার সাথে যুক্ত। কিন্তু অপরপক্ষে, এটিই আবার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ শ্রেণির রব্বানি বিবেকের অধিকারীদেরকে এত উচ্চ মহিমা দান করে যে তারা কোনো অভিব্যক্তি বা তাজাল্লিতেই সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না। এ কারণে তারা অধীর আগ্রহভরে তীব্র অনুসন্ধিৎসাসহ তাজাল্লির অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন এবং যতদূর সম্ভব সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকেন। অবশেষে তারা সেই স্থানে গিয়ে উপনীত হন যেখানে সত্তার তাজাল্লি স্বীয় মহিমায় দেদীপ্যমান রয়েছে।

মোটকথা, রব্বানি চিন্তাভাবনা রসুলুল্লাহর (স) বাতেনি দৃষ্টিকে সেইখানে পৌঁছিয়ে দিয়েছিল—জাহেরি দৃষ্টি যেখানে পৌঁছতে অক্ষম। আর যেহেতু, তার বাতেনি দৃষ্টি ছিল অতুলনীয়, সেজন্য তার দৃষ্টি সেখানে পৌঁছেই প্রথম বিরাম নিয়েছিল যেখানে পৌঁছার কল্পনা কখনও কোনো বাতেনি দৃষ্টিও করতে পারেনি।

সুতরাং, এটি রব্বানি চিন্তাভাবনার সাধারণ কৃতিত্বের কথা নয়। খুদির রহস্য উন্মোচন, স্বয়ং খোদা ও খোদায়ির রহস্য উদঘাটন—রব্বানি চিন্তাভাবনার এই যে ফল, একে যদি সাধারণ ফল বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে অসাধারণ ফল আর কী হতে পারে?

খুদির অধ্যয়ন

রব্বানি চিন্তাভাবনাই যে রব্বানি অস্ত্র—এতে কোনো সন্দেহ নাই। কারণ, এটি সকল আবরণ উন্মোচন ও সকল রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম। এটি খুদি এবং খোদায়ির রহস্য-আবরণ ভেদ করতে এবং সকল প্রকারের পর্দা ছিন্ন করতে সক্ষম। এইজন্য একে একটি উপকরণ হিশাবে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু এই অস্ত্রটি যে ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় তাও তো তার এই সামগ্রিক উপকরণের একটি অংশ, সন্দেহ নাই। শুধু তা-ই নয়, এই প্রয়োগক্ষেত্র ছাড়া এই অস্ত্রটিও অকেজো থেকে যায়। এই অস্ত্র যে যে ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় তার মধ্যে স্বয়ং চিন্তাভাবনাকারীর আপন খুদির অধ্যয়ন উল্লেখযোগ্য। যদি রব্বানি চিন্তাভাবনার বিষয়বস্তু আপন খুদির অধ্যয়ন না হয়ে কেবলমাত্র খুদির বাহুল্য প্রয়োজনের অধ্যয়নেই সীমাবদ্ধ হয়, তাহলে এর মাধ্যমে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব নয়; কারণ এমতাবস্থায় খুদির বিকাশই অসম্ভব। আর খুদির বিকাশই যখন অসম্ভব তখন খোদায়ি ও খোদা—এই দুইটি রহস্যের উদ্ঘাটনই-বা কী করে সম্ভব?

হজরত মুহাম্মদ (স) তার রব্বানি চিন্তাভাবনাকে সর্বপ্রথম আপন খুদির ওপরই প্রয়োগ করেন, অর্থাৎ প্রথমেই তিনি স্বীয় খুদির অধ্যয়ন শুরু করেন। এই অধ্যয়নের ফলেই তার খুদির বিকাশ সম্ভব হয়। হকিকতের পথে সফরে এটিই তার প্রথম পদক্ষেপ। ফলে তিনি অবহিত হন যে তার তবিয়ত বা বিধিপ্রদত্ত স্বভাবগত ক্ষমতা একটি বিশেষ তবিয়ত এবং তার এই বিশেষ অনন্যসাধারণ স্বভাব ও প্রকৃতিতে সকল তবিয়ত ও ফিতরত এমন ভাবে আকর্ষিত ও বিলীন হয়েছে—যেভাবে সমুদ্রে মিলিত হয় সকল ক্ষুদ্রবৃহৎ নদনদী এবং অবশেষে তাতেই একাকার হয়ে যায়।

আপন সত্তার রব্বানি উপলব্ধি

এটা রব্বানি চিন্তাভাবনার দ্বিতীয় বিষয়বস্তু। এ উপলব্ধির ফলে খুদি আরও বিস্তারিতভাবে উন্মোচিত হয়। এই প্রশস্ততর পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে তিনি জানতে পারেন—তার প্রকৃতিতে কোন কোন বিষয়ে অধিকতর ক্ষমতা রয়েছে—যে-ক্ষমতা অল্প বা অধিক পরিশ্রমের ফলে অচিরেই অথবা বিলম্বে সেই জীবনকালের মধ্যেই প্রাণবেগে ব্যক্ত হওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে, এবং তা এমন ব্যাপকভাবে ব্যক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যে, সেই সব সামর্থ নিজ-নিজ প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বৃহৎ বৃহৎ সৃষ্টিধর্মী কার্য সম্পাদন করতে এবং সাড়া জাগাতেও সক্ষম। এই পর্যায়ে অধ্যয়নের ফলেই তিনি জানতে পারেন যে, তার প্রকৃতিগত যোগ্যতা কোনো ক্ষেত্র বিশেষে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ক্ষমতার সকল ক্ষেত্রই তার আয়ত্তাধীন; জীবন তার রূপায়ণের জন্য যত রকম কর্মক্ষেত্রের উদ্ভাবন করতে পারে তার মধ্যে এর সকল ক্ষেত্রেরই যোগ্যতা বিদ্যমান রয়েছে। এই অধ্যয়নই তার মধ্যে দৃঢ়তা ও ও উদ্যম সঞ্চার করে যার সম্মুখে স্বর্গ-মর্ত্যের সকল শক্তি দুর্বল প্রতিপন্ন হয়।

বুদ্ধিবৃত্তির রব্বানি অনুশীলন

বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলনের ফল এই হয়েছিল যে, তার এই ক্ষমতা পূর্ণতা প্রাপ্তি এবং চূড়ান্ত সত্যে পৌঁছার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত কোথাও স্থিতিলাভ করতে পারে নাই। ফলে আল্লাহর নবীর (স) রব্বানি চিন্তার সম্মুখে যত প্রকারের আপাত সত্য এসেছে এবং এমনকি, চরম পর্যায়ের সত্য রূপেও প্রতীয়মান হয়েছে, সেই সবকিছুকেই সত্যের ভান ত্যাগ করে পথ ছেড়ে দিতে হয়েছে, এবং অবশেষে চূড়ান্ত সত্যকে তার আবৃতস্বরূপ উন্মুক্ত করতে হয়েছে—পর্দার পর পর্দা দিয়ে যা ছিল আবৃত।

অন্তঃকরণের রব্বানি সম্প্রসারণ

হৃদয়ের এই বিস্তৃতি, যা সম্ভব হয়েছিল এবং যা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল—সব কিছুর জন্যই এটি তার হৃদয়কে প্রশস্ত করেছিল এবং সকলের জন্যই এটি মুহাম্মদি প্রেমের স্নেহপূর্ণ কোল উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। তারপর, তার স্নেহসিক্ত কোলকে এমনভাবে প্রসারিত করে দেওয়া হয়েছিল যে যার ইচ্ছা সে-ই সে কোলে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারত। এবং তাতে দেহ কিংবা আত্মা, মণিমুক্তা কিংবা কাঁচ, ইহলৌকিক বা পারলৌকিক, আপন কিংবা পর, বন্ধু অথবা দুশমন—যেকোনো জনকেই একমাত্র সন্তানের মতোই স্নেহে এবং দুগ্ধপোষ্য শিশুর মতোই প্রতিপালন করা যেত। শুধু তা-ই নয়, বরং যদি কেউ এই কোলে না আসত তার জন্যও এই মমতার কোল সবসময় উন্মুক্তই থাকত। এমনকি, হৃদয়ের এই উদারতা তার অপরকে বশ করার শক্তি এবং প্রকৃতি-অনুসন্ধিৎসাকেও সাহায্য করেছে। এমনইভাবেই, সমগ্র বিশ্বের জন্য পরম সত্তার সাথে মুহাম্মদি সত্তাও স্বীয় কল্যাণীশক্তি প্রয়োগ করতে থাকে।

প্রভাব বিস্তারের রব্বানি শক্তি

এই শক্তি তার কর্মস্পৃহাকে প্রখর এবং সাহসকে জয়যুক্ত করেছিল। আল্লাহর নবীর (স) প্রকৃতি যখন উপলব্ধি করতে পারল যে তার প্রত্যেক কর্মেরই এবং প্রতিটি পদক্ষেপেরই প্রভাব বিদ্যমান এবং প্রতি স্থানেই সেগুলোর প্রভাব রয়েছে, তখন স্বভাবতই তার প্রকৃতির সাহসটি আল্লাহর হিম্মতের প্রতিবিম্বে পরিণত হয় এবং তার কর্মস্পৃহাও রূপান্তরিত হয় গ্রহ-নক্ষত্রের গতিশীলতায়। কেবল তা-ই নয়, বরং গ্রহ-উপগ্রহ যেমন একস্থানে এক মুহূর্তও অবস্থান করতে পারে না, পৃথিবী যেমন এক সেকেন্ডও আবর্তন থেকে বিরত থাকতে পারে না—দিবারাত্রি কেবল আবর্তন আর বিবর্তনে ঘূর্ণায়মান ও গতিশীল রয়েছে, তেমনই আল্লাহর নবীর (স) প্রকৃতিও বিরামহীন কর্মে আত্মনিয়োগ করেছিল—যা মৃত্যুর পূর্বক্ষণ তথা শেষনিঃশ্বাস পর্যন্ত একটি মুহূর্তের জন্য কখনও বিশ্রাম গ্রহণ করে নাই। বলা-বাহুল্য, হজরত মুহাম্মদ (স) সমগ্র জীবনের মধ্যে আরাম কাকে বলে কখনও তা জানতে পারেন নাই। এমনইভাবে আরও বহু ব্যাপারে তার এই প্রভাব-শক্তি সাহায্য করেছে।

রব্বানি জিগীষা

প্রভাব-বিস্তারে রব্বানি শক্তি যে উৎসাহ-উদ্দীপনা জাগ্রত করে রব্বানি জিগীষা তাকে আরও বেগবান ও তীব্রতর করে তোলে। অনন্য প্রভাব-বিস্তারের রব্বানি শক্তি কর্মস্পৃহা ও কর্মোদ্দীপনাকে বিকশিত করে, তাতে প্রাথমিক পর্যায়ে গতিচাঞ্চল্য এনে দেয়; রব্বানি জিগীষা তাকে পরিণত করে সাহায্যকারী শক্তিতে।

রব্বানি প্রভাবজাত প্রতিক্রিয়া

প্রতিক্রিয়া এমন একটি অবস্থা, যা কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি বা কোনো প্রভাবশালী অবস্থার প্রভাবে সৃষ্টি হয়। এই অবস্থাটিও তার সংকল্প ও কর্মকে অনেকখানি বেগবান করেছে এবং তাতে যথেষ্ট শক্তি জুগিয়েছে। আর, যেহেতু বিশ্বের সমগ্র অবস্থায় সাড়া দেবার যোগ্যতা হজরত মুহাম্মদের (স) মধ্যে বিদ্যমান ছিল সেজন্য এই অবস্থাটি তাকে কর্মনিরত হওয়ার ব্যাপারে বিপুল সাহায্য করেছে।

জাগতিক দ্বন্দ্ব-ফাসাদ সম্পর্কে জ্ঞান

এই জ্ঞান তাকে একদিকে যেমন বিশ্বের সামগ্রিক অমঙ্গল সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল তেমনই তাকে সুযোগ দিয়েছিল বিশ্বের আংশিক অমঙ্গল সম্পর্কেও অবহিত হওয়ার। জ্ঞান সর্বদাই জাগতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের খুঁটিনাটি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ দিয়ে থাকে। তা ছাড়া, এই জ্ঞান বিশেষ এক প্রকারের প্রেরণা সৃষ্টির ব্যাপারেও সাহায্য করেছিল। সে প্রেরণা ছিল সংস্কারের। অন্যদিকে, যেহেতু এই প্রেরণাটি ছিল সামগ্রিক ও বিশ্বজনীন, অর্থাৎ গোটা জাগতিক দ্বন্দ্ব-ফাসাদের সাথে এটি যেহেতু সম্পর্কযুক্ত ছিল সেহেতু এতে যে-সংস্কারের প্রেরণা সৃষ্টি হয়েছিল তা-ও স্থান ও অঞ্চলে গণ্ডিবদ্ধ না হয়ে সামগ্রিক ও বিশ্বজনীন রূপেই প্রকাশ পেয়েছিল।

ওপরে যে বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তার দ্বারা অন্য ব্যাখ্যাও অনুমান করা যেতে পারে। সকল বিষয়ের ব্যাখ্যা এই সংক্ষিপ্ত পুস্তকে সম্ভব নয়। তাছাড়া গভীরভাবে চিন্তা করলে দ্বিতীয় ব্যাখ্যাও আপনাআপনিই বোধগম্য হবে। সুতরাং এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অপরিহার্য নয়। তবে এই উপলব্ধির পক্ষে সম্যক সহায়ক হতে পারে এমন একটি মোদ্দাকথা না বললেই নয়।

মানুষের মধ্যে এমন দুইটি অমূল্য ও বুনিয়াদি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার সমন্বয় অন্য কোনো কিছুতেই পাওয়া যায় নাই। এমনকি, জীবাজন্তুর মধ্যেও তা অনুপস্থিত। প্রথমত, মনুষ্য-সৃষ্টি-কৌশলে সৃষ্টিজগতের সকল মৌল উপাদানের নির্যাস বিদ্যমান রয়েছে। দ্বিতীয়ত, উলুহিয়াতের ক্ষমতা মনুষ্যসত্তায় যেমন মিশে আছে তেমন অন্য কিছুতেই নাই। এই বৈশিষ্ট্য মানবপ্রকৃতি ও স্বভাবকে এতখানি শক্তি জোগায় যে, জাহের বা বাহ্যিক ও বাতেন বা অভ্যন্তরীণ উভয় ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ উন্নতি লাভ ও পূর্ণ মনুষ্যত্ব অর্জন করতে সমর্থ হলে স্বভাবতই সে সমগ্র সৃষ্টির ওপর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। এমনকি তার প্রভাব সৃষ্টিকে অতিক্রম করতেও সক্ষম হয়। কেননা তার মধ্যে রয়েছে ঐশী ক্ষমতা; আর তার মধ্যে সবকিছুর সমন্বয়ের যে মহিমা বিদ্যমান তা আর কিছুতেই পাওয়া যায় না। সুতরাং সে যখন নিজের এতটা বিকাশ ও প্রসার সাধন করে যে, নিজ কেন্দ্রে স্থিত হয়ে সে নিজেই এর প্রতীক হয়ে পড়ে তখন তার আয়ত্তের বাইরে কী থাকতে পারে? সৃষ্টি তো সৃষ্টিই, সৃষ্টির খোদাও প্রভাব-বহির্ভূত থাকেন না। অবশ্য এ কথা সত্য যে, এই পূর্ণতা সকলেই অর্জন করতে পারেন না। কিন্তু কেন? এ কারণে যে এই অবস্থা সকলের অনুকূল হয় না। এই ধরনের পূর্ণতা অর্জনের জন্য মানুষের এই জীবন নয়, অনাগত কোনো জীবন নির্ধারিত রয়েছে। এ জীবনে সৃষ্টির ও মানবতার সামগ্রিক রব্বানি ব্যবস্থা এই পূর্ণতা অর্জনের প্রতিকূল। সুতরাং সকলের পক্ষে পূর্ণতা অর্জনের আনুকূল্য লাভ কী করে সম্ভব?

কিন্তু আল্লাহর নবী (স) এই আনুকূল্য লাভ করেছিলেন। এজন্য, তাতে যে পূর্ণতা বিকশিত হয়েছে তাতে আশ্চর্যের কিছু নাই। বরং এটি প্রকৃতির সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার নিয়মানুযায়ীই ঘটেছিল। এই অবস্থার জন্য যেসব বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় প্রয়োজন ওপরে সেই বৈশিষ্ট্যগুলোরই তালিকা দেওয়া হয়েছে। কোনো ব্যক্তির মধ্যে এই সকল বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় এরই উজ্জ্বল নিদর্শন যে সেই ব্যক্তি অবশ্যই পূর্ণতার চরম পর্যায়ে বা ‘মিরাজে তকমিলে’ উপনীত হতে সক্ষম।

এই পূর্ণতার দুইটি দিক রয়েছে। একটি হলো সৃষ্টিজগৎকে বশে আনা, আর দ্বিতীয়টি হলো চরম উন্নতির প্রয়াস।

আল্লাহর নবীর (স) মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যগুলোর এমন পরিপূর্ণ সমন্বয় ঘটেছিল যা কখনও আর কারও মধ্যে ঘটে নাই। এ কারণে চূড়ান্ত পূর্ণতার অধিকারী হওয়া তার জন্য অবধারিত এবং একান্ত স্বাভাবিক ছিল আর এটি এমন চূড়ান্ত পূর্ণতা যা মানবেতিহাসে অতুলনীয়।

এই সকল প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের একটি সার-সংক্ষেপও রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি সামগ্রিক রূপ যেন সব সময় সামনে থাকে, তজ্জন্য এই সারসংক্ষেপটিও সম্যক উপলব্ধি করে নিতে হবে। এইভাবেই বৈশিষ্ট্যগুলোকে অনায়াসে স্মরণ রাখা সম্ভব। উত্তম দেহ, উত্তম মস্তিষ্ক, উত্তম অন্তঃকরণ, উত্তম চিন্তা এবং উত্তম সংকল্প—এই পাঁচটিই বৈশিষ্ট্যগুলোর সারসংক্ষেপ।

ঘটনার আলোকে পর্যালোচনা

আল্লাহর রসুল (স) যেসব কাজ করেছেন, মানে হাদিসে যেসব কথা উল্লেখ আছে, তিনি কি আসলেই সেই কাজগুলো করেছিলেন? এক্ষণে আমরা ঘটনার আলোকে দার্শনিকভাবে এই ব্যাপারটা প্রমাণের চেষ্টা করব। যদি আমরা গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করি, এই বিবরণের উদ্দেশ্য আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে যাবে।

মারেফতে খুদি বা আত্মপরিজ্ঞান

হজরত মুহাম্মদ (স) আত্মোপলব্ধির কাজ অর্থাৎ আপন খুদির মারেফতের কাজ আরম্ভ করেন যখন তিনি দুগ্ধপোষ্য শিশু মাত্র ছিলেন তখনই। সেই সময়ই তার এই আত্মোপলব্ধি জন্মে যে সমগ্র বিশ্বে ইনসাফ, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দায়িত্বটি তারই। তিনি উপলব্ধি করেন এজন্য সর্প্রথম তাকেই ইনসাফ ও সাম্যের নমুনা স্থাপন করতে হবে। এবং যাতে প্রথম-জীবনের দুর্বলতার জের জীবনের শেষ পর্যন্ত টানতে না হয় ও কর্মপ্রচেষ্টায় তা কোনোরূপ বিঘ্ন উৎপাদন করতে না পারে সেজন্য জীবনের এই প্রারম্ভেই সে আদর্শ স্থাপন করা দরকার। সুতরাং তাকে ধাত্রী মাতার দুগ্ধ পানের ক্ষেত্রেই সর্বপ্রথম ন্যায়বিচার ও সৌভ্রাতৃত্ব স্বাপন করতে হবে। এই উপলব্ধির পরিপ্রেক্ষিতেই দুগ্ধপানের জন্য তিনি এই নীতি নির্ধারণ করে নেন যে, ‘শুধু একটি স্তনের দুগ্ধ আমি পান করব, আর অপর স্তনের দুগ্ধ আমার অন্য দুধভাইয়ের জন্য ছেড়ে দেব।’ ধাত্রী হালিমা বলেন, ‘তাকে অপর স্তনের দুগ্ধ দানের চেষ্টায় আমি কখনও সফলকাম হতে পারিনি।’

হজরত মুহাম্মদ (স) দুগ্ধপোষ্য অবস্থায় মারেফতে খুদির সূত্রপাত করে নিরবচ্ছিন্নভাবে আমৃত্যু তা অব্যাহত রেখেছিলেন।

প্রথমবার যখন ওহির ফেরেশতার দর্শন লাভে তিনি ভয় পেয়ে গেছিলেন, জিব্রিলকে চিনতে সক্ষম হন নাই, তখনও হজরত মুহাম্মদের (স) মনে এই প্রশ্নেরই উদয় হয়েছিল, ‘আমার কর্তব্য কী?’ তারপর ভেতরের সত্তা যখন তাকে জানিয়ে দিল যে, ‘তুমি নবী’, তখনই তার মারেফতে খুদির প্রথম মনজিল অতিক্রান্ত হয়েছিল, যা ইতিপূর্বে ছিল অনতিক্রম্য।

আল্লাহর মারেফত ও সৃষ্টিজগতের পরিজ্ঞান যেমন ক্রমবিকাশমান, তেমনই খুদির পরিজ্ঞানও ক্রমবিকাশমান। কিছুকালের জন্য যখন ওহির ফেরেশতার আগমন বন্ধ এবং ঐশীবাণী অবতরণের যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তখনও হজরত মুহাম্মদের (স) মনে প্রশ্ন জেগেছিল, ‘আমি কে?’ এবং তার ভেতরের সত্তা তাকে জানিয়ে দিয়াছিল—‘তোমার ভাবনার কিছু নাই, তুমি এমন নবী নও যে তোমার ওপর ওহি আগমন বন্ধ হবে; বরং তুমি স্থায়ী ওহি লাভের যোগ্য নবী।’ অর্থাৎ হজরতের ভেতরের সত্তা তাকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়—‘তুমি এমন কোনো নবী নও যে, ওহি ধূমকেতুর মতো তোমার ওপর কখনও কখনও অবতীর্ণ হয়ে আবার বন্ধ হয়ে যাবে, বরং তুমি এমন নবী যে তোমার ওপর ওহি বৃষ্টির মতো সারাজীবন অবতীর্ণ হতে থাকবে; অবশ্য মাঝে মাঝে বিরতি দিয়েই তা অবতীর্ণ হবে; কেননা প্রয়োজন ও সুযোগের প্রয়োজনে এমন বিরতি আবশ্যক।’

এই ঘটনাটি খুদির পরিজ্ঞানের অপর একটি দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিল যা ইতোপূর্বে বন্ধই ছিল।

একবার যখন নবী-বাহিনীকে সম্পূর্ণ পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল, তখনও আল্লাহর নবীর (স) হৃদয়ে এই কথা জাগরিত হয়েছিল—‘তুমি চির বিজয়ী নবী, তুমি বিজিত নবী নও’, তখন তিনি কী করেছিলেন? পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিজয়ীর মতোই ধ্বনি দিয়ে উঠেছিলেন। খুদির পরিজ্ঞানের আরেকটি নক্ষত্রই তখন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল—ইতোপূর্বে যে নক্ষত্রটি আর কখনও প্রজ্জ্বলিত হয় নাই।

ওহির ফেরেশতা এবং মেরাজের সঙ্গী যখন ‘আলমে আ’লার’ (সর্বোচ্চ জগৎ, যেখানে আল্লাহর আরশ) শীর্ষদেশে হজরত মুহাম্মদকে (স) পৌঁছিয়ে দিয়ে তার সঙ্গ ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল, তখনও তিনি তার ভেতরের সত্তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আমি কে?’ তার অন্তর বলেছিল—‘তুমি সেই ব্যক্তি যাকে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা পর্যন্ত পৌঁছানো ছাড়া ফেরানো হবে না’। খুদির পরিজ্ঞানের গ্রন্থে তখন সেই দুষ্প্রাপ্য অধ্যায় সংযোজিত হলো যা ওই গ্রন্থকে পরিপূর্ণতার শেষ সীমায় উপনীত করে।

তারপর সমগ্র আরব যখন বিজিত হয়ে গেল, তখনও হজরত মুহাম্মদ (স) তার ভেতরের সত্তার কাছে ‘আমি কে?’ এই প্রশ্নেরই ব্যাখা চেয়েছিলেন। তখন ভেতরের সত্তা তাকে বলে, ‘তুমি যেমন আরব বিজয়ী তেমনই তুমি বিশ্ববিজয়ীও। শুধু কি তা-ই? তুমি বিশ্বের শান্তিদূতও’। এই সময় খুদির পরিজ্ঞানের সেই নতুন দিকটি উদ্ঘাটিত হয় যা সমগ্র খুদিটিকেই উন্মুক্ত করে মেলে ধরেছিল।

তারপর যখন মওতের ফেরেশতার আগমনে হজরত মুহাম্মদ (স) তার অন্তরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি কে?’, এবং তার অন্তর উত্তর দিয়েছিল—‘তুমি পরম প্রিয়তমের প্রিয়’। তখন তার খুদির পরিজ্ঞান পরিপূর্ণতা লাভ করে। এর ফলে তার হস্তগত হয় সেই প্রশান্তি যার জন্য আল্লাহর নবীর (স) আত্মা আজীবন ছিল ব্যাকুল; তবু ইতোপূর্বে তা লাভ করা সম্ভব হয় নাই। অথচ, স্থূল দৃষ্টিতে প্রতীয়মান হয় যে এমন কোনো বিষয়ই ছিল না যে-বিষয়ে নবীজি (স) সাফল্য লাভ করেন নাই। কিন্তু এখন যে-মুহূর্তে এই প্রশান্তিলাভ ঘটে, আল্লাহর নবীর (স) আত্মা চীৎকার দিয়ে উঠে—‘হে আল্লাহ! হে পরম প্রিয়তম! আমাকে তোমার শরণে টেনে নাও।’ তারপর পরম প্রিয়তমের সান্নিধ্য লাভের জন্য তার আত্মা বিদায় গ্রহণ করে।

আত্মপরিজ্ঞানের ফল

এখন প্রশ্ন হলো, খুদির পরিজ্ঞানের সারকথাটি কি? নিচে এর একটা পরিচয় দান করা হচ্ছে। হজরত মুহাম্মদ (স) তার নিজের যে-সকল বৈশিষ্ট্যের সন্ধান লাভ করেছিলেন এবং যেগুলোকে ভিত্তি করে তিনি আপন খুদির কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিলেন তা মোটামুটি এই :

● আমি একজন নবী।
● আমি আল্লাহর একজন মনোনীত বান্দা।
● আমি নবী ও রসুলদের নেতা।
● আমি আল্লাহর একজন প্রতিনিধি।
● আমি আল্লাহর প্রতিনিধিদের ইমাম।
● আমি বিশ্বজয়ী।
● আমি বিশ্বের জন্য রহমত।
● আমি শেষ নবী।
● আমি রব্বানিদের ইমাম।
● আমি বিপ্লবীদের নেতা।
● আমি সংস্কারকদের ইমাম।
● আমি অনন্যসাধারণ।
● আমি অস্তিত্ববান।
● আমি সে-ই মানুষ, সৃষ্টির পর থেকে যার আগমন অব্যাহত রয়েছে এবং যতক্ষণ মানুষের নামনিশানা মুছে না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত আসতেই থাকবে।
● আমি সে-ই, যার মূল হতে উৎপত্তি এই জগতের, আর যার নুরে প্রোজ্জ্বল এই সৃষ্টিজগৎ।
● আমি সে-ই, যে খোদা বা খোদার পুত্র তো নই-ই, তবে যাকে খোদা অথবা খোদার পুত্র বলে অভিহিত করে কতক লোক, তিনি স্বয়ং আমার
অনুসারী হওয়ার যোগ্য ছাড়া অন্য কিছু নন।
● আমিই সে-ই, যার বদৌলতে পূর্ববর্তীগণ মুক্তি লাভ করেছে এবং পরবর্তীগণও নাজাত প্রাপ্ত হবে।
● আমি সে-ই, যাকে নবুওয়ত-সৌধের সর্বশেষ ইট বলে অভিহিত করা হয়েছে।
● আমি সে-ই, কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যার কবর থেকে পুনরুত্থান হবে সকলের আগে ও যিনি সর্বাপেক্ষা অধিক সংখ্যক লোকের জন্য সুপারিশকারী হবেন এবং কেবলমাত্র তার হাতেই শোভা পাবে ‘হামদ’-এর নিশানা।
● আমি সে-ই, যাকে আগের ও পরের এলেম দান করা হয়েছে।

বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য যে হজরত মুহাম্মদ (স) তার সমগ্র জীবনে যেসব কাজ সম্পন্ন করেছেন আর তার যত কীর্তি আমরা দেখতে পাই, তার সবকিছু উল্লিখিত মারেফতে খুদির আলোকেই সম্পন্ন হয়।

মারেফত বা পরিজ্ঞান:

হজরত মুহাম্মদের (স) চিন্তার প্রথম কাজ ছিল আপন খুদীর অধ্যয়ন—যার ফলে আত্মপরিজ্ঞানের উল্লিখিত তালিকাটি লাভ হয়। সমগ্র তালিকাটি অবশ্য একদিনে হস্তগত হয়নি। ক্রমে ক্রমে হস্তগত হতে থাকে এবং জীবনের শেষে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। অপরদিকে তার চিন্তার দ্বিতীয় কাজ ছিল বিশ্ব-চরাচর সম্পর্কে গভীর অধ্যয়ন।

হজরত মুহাম্মদ (স) নিজেকে একটা বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত চিনে নেওয়ার পর চিন্তা শুরু করেন বিশ্ব-চরাচর সম্পর্কে। এই সময় তিনি ভাবতে থাকেন, ‘জগৎটা কী? এই পর্যায়ে তার চিন্তাভাবনার প্রত্যক্ষ ফল হলো বিশ্ব-জগতের পরিজ্ঞান অর্জন, যা পরে আলোচনা করা হবে। বিশ্ব-চরাচরের পরিজ্ঞানের তালিকাটিকে সামনে রেখেই তিনি জগৎ-প্রতিপালনকারী সেবামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন এবং এরই বদৌলতে সৃষ্টির সেবাধর্মী তার সকল কর্মপ্রচেষ্টাই কার্যকরী ও গ্রহণীয় প্রমাণিত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তার এই কর্মপ্রচেষ্টাই কিয়ামত পর্যন্ত আদর্শ ও পরীক্ষিত সেবাধর্ম বলে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকবে; কেননা, জগতের চাহিদানুযায়ী তার কর্মসূচি নির্ধারিত হয়েছিল।

বিশ্বপরিচয়ের ফল

হজরত মুহাম্মদ (স) সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তাভাবনার পর এর পরিজ্ঞানের যে-তালিকাটি লাভ করেন, তা মোটামুটি এই:

● সৃষ্টি নিজ থেকে সৃষ্ট নয়, কেননা এর কোনো একটি বস্তুও পূর্ণ নয়—অপূর্ণ বস্তু স্বয়ংসম্ভূত হতে পারে না।
● জগৎ একটি বিশ্ববিধির বন্ধনে আবদ্ধ।
● জগতের প্রত্যেকটি অণু পরস্পর পরস্পরকে আকর্ষণ করছে।
● জগৎ গতিশীল।
● একটি জাহেরি (বাহ্যিক) জগৎ ও আরেকটি বাতেনি (অভ্যন্তরীণ) জগৎ রয়েছে।
● সৃষ্টি অগণিত।
● সৃষ্টি পরিবর্তনশীল ও ধ্বংসশীল।
● সৃষ্টির বিকাশ ও প্রকাশ যেমন একটি সৃষ্টি-শক্তি ব্যতীত অসম্ভব তেমনই অসম্ভব একটি সংরক্ষক শক্তি ছাড়া এর দৈনন্দিন ক্রিয়া-নির্বাহ।
● সৃষ্টির মানবীয় অংশটি অর্থাৎ মানব জাতি এর শ্রেষ্ঠ অংশ, সৃষ্টির সেরা, সৃষ্টির মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুষমামণ্ডিত এবং সর্বাপেক্ষা সুসামঞ্জস্যপূর্ণ।
কিন্তু সৃষ্টির এই মানবীয় অংশটি কিছুকাল যাবৎ সৃষ্টির অধমে পরিণত হয়েছে।
● এক্ষণে সর্বাপেক্ষা অধিক প্রয়োজন মানব জাতিকে পুনরায় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করা।
● সৃষ্টির ফিতরতে যে বিধান কার্যকরী সেই জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে এবং সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে এবং সেই সঙ্গে কর্মফল ও সুন্দর আদর্শ সম্পর্কে মানব জাতিকে অবহিত করতে হবে।
● সৃষ্টিরই রায় এই যে মানুষ শুধু সৃষ্টির জন্যই নয়, স্রষ্টার জন্যও বটে।
● মানুষের পরম গৌরব এই—সে সৃষ্টি ও স্রষ্টা উভয়েরই খেদমত করবে, অর্থাৎ হক্কুল্লাহ ও হক্কুল এবাদ দুটোই করবে, শুধু একটি নয়।
● সৃষ্টির প্রতিটি বস্তই গতিমান—যে গতির লক্ষ্য হলো কেন্দ্রে উপনীত হওয়া। যখনই এটি কেন্দ্রে উপনীত হবে তখনই এটি সম্পূর্ণ শান্ত হয়ে পড়বে।

অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে যে, হজরত মুহাম্মদের (স) চিন্তাশক্তি যে সৃষ্টিরহস্য উদ্ঘাটনেও কার্যকরী ছিল তার প্রমাণ কী? এর উত্তরে এতটুকু মনে রাখাই যথেষ্ট যে হজরত মুহাম্মদ (স) আজন্ম প্রকৃতিগতভাবেই ভাবুক ছিলেন; সেই ভাবুকতাও সাধারণ পর্যায়ের নয়—বরং চূড়ান্ত পর্যায়ের। এর কারণ—তার ফিতরতই ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ের। তা ছাড়া মরুভূমির বিস্তৃতি, শ্রেণিবদ্ধ পাহাড়-পর্বত, মানুষের ক্রিয়া-কলাপ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও চলাফেরা প্রভৃতির মাধ্যমেও স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার অসংখ্য সুযোগ তার হয়েছিল। যেমন :

এক. আল্লাহর নবীর (স) চিন্তার উল্লেখযোগ্য প্রথম ঘটনাটি হচ্ছে এই : তিনি যখন তার দুই দুধভাইকে একই মহিলার দুধ পান করতে দেখলেন, তখন তিনি ভাবলেন, ‘ওরা দুইজন আমার অংশীদার; সুতরাং আমার মতো ওদেরও অংশ নির্ধারিত হওয়া উচিত।’ এইখানেই একটি বিষয় তার অন্তরে বদ্ধমূল হয় যে সৃষ্টিতে ভোগের বস্তু রয়েছে বটে, তবে এই ভোগের বস্তুতে হিস্যার প্রশ্নও রয়েছে, অংশীদারদেরও আরও অংশীদার আছে। আবার এই অংশীদারত্বে ইনসাফের প্রশ্নও রয়েছে। অপরপক্ষে ইনসাফের বিপরীত জুলুমও রয়েছে; ইনসাফই গ্রহণের যোগ্য আর জুলুম পরিত্যাজ্য। এই চিন্তার স্বাভাবিক ফল হিশাবেই তিনি দুগ্ধপানের উদ্দেশ্যে ধাত্রী মাতার একটি স্তনকে নিজের জন্য নির্দিষ্ট করে নেন। বহু চেষ্টা করা সত্ত্বেও দ্বিতীয় স্তনটিতে তার মুখ লাগানো সম্ভব হয়নি।

দুই. তার চিন্তার উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে তার স্তন্যপানের বয়স অতিক্রমের পর। তিনি যখন লক্ষ্য করলেন তার দুই দুধভাই বকরি চরাবার উদ্দেশ্যে গৃহ ত্যাগ করে চলে যায়, তখন তিনি চিন্তা করলেন—খাওয়া তো অপরিহার্য, তবে খাওয়ার জন্য কাজ করাও অপরিহার্য। কাজ করবে না তো খাওয়াও চলবে না—এটাই যখন জগতের বিধান। সুতরাং আমাকেও কাজ করতে হবে। যদি আমি কাজ না করি, তাহলে খাদ্যের ওপর আমার অধিকার আসবে কোথা থেকে? এই চিন্তার ফলেই ধাত্রীমাতা ও পিতা কর্তৃক যথেষ্ট বুঝানো এবং প্রচুর বাধাদান সত্ত্বেও তিনি বকরি চরাবার জন্য ভাইদের সঙ্গ গ্রহণ করলেন, এবং এই কাজে তাদের সহযোগিতা শুরু করে দিলেন। তার এই প্রয়াস উন্নত চরিত্র গঠনের পক্ষে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল, যেমন তিনি স্তন্যপান কালে পাঠ নিয়েছিলেন সুবিচারের।

তিন. চিন্তার তৃতীয় উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি তার বক্ষবিদারণের সময় ঘটে। এই সময় তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন—সৃষ্টিজগতে মানুষের (আংশিক) বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আরও একটি মাখলুক রয়েছে, যারা ক্ষমতার দিক দিয়ে অনেক উর্ধ্বে, এবং মানুষের কল্যাণ সাধন করে থাকে। কিন্তু তারা কোথায় অবস্থান করে, তাদের কাজ কী, তাদের নামই-বা কী, আর তাদের ব্যবস্থাপনাই-বা কেমন—এই সব বিষয় তার চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে।

চার. হজরত মুহাম্মদ (স) যখন তার মায়ের সাথে মাতুলালয় মদিনা গমন করেন, তখন তার চিন্তার উল্লেখযোগ্য চতুর্থ ঘটনাটি ঘটে। এই সফরে একদিন তাকে একটি মূর্তির সামনে সেজদাবনত হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি তা পালন না করে বরং নিখোঁজ হয়ে গেছিলেন। তারপর তার সন্ধান নিয়ে দেখা গেল তিনি একটি গাছের নীচে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন—যেন কিছু চিন্তা করছেন। এই সময় তার অন্তরে চিন্তার এই স্রোত প্রবাহিত হচ্ছিল—মূর্তি কি জিনিস? প্রতিমাকে কেন পূজা করা হবে? মানুষ কি মূর্তি অপেক্ষা পূজনীয় নয়? প্রতিমা অনুভূতিহীন গতিহীন পাথর ছাড়া তো কিছুই নয়। প্রতিমা চলৎশক্তিহীন, অক্ষম এবং বাকশক্তিহীনও তো বটে। অথচ মানুষ চলতে ফিরতে পারে—কথা বলবার শক্তিও তার রয়েছে। তা ছাড়া, প্রতিমা তো সেই সব পাথর দিয়েই তৈরি করা হয়—যা পর্বত বা প্রান্তরে স্তুপীকৃত হয়ে পড়ে থাকে। এই পাথরের কী মূল্য রয়েছে? মানুষের পায়ের তলে এইগুলি দলিত হয়; কী মর্যাদা রয়েছে এসবের? মানুষ যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো পাথর কেটে খণ্ড খণ্ডও তো করে ফেলতে পারে! তা ছাড়া প্রতিমাগুলির নির্মাতাই বা কারা? মানুষই তো এইগুলি নির্মাণ করে! সুতরাং, মানুষই ইচ্ছা করলে এগুলো ভেঙেও ফেলতে পারে। তাহলে মানুষ কেন প্রতিমাকে পূজা করবে? কেন মানুষ প্রতিমাকে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করবে?

তারপর তিনি ভাবতে লাগলেন—মানুষকেও নিশ্চয়ই কেউ সৃষ্টি করেছেন। তাকে সেজদা করাই মানুষের কর্তব্য। কিন্তু তিনি কোথায়, তার অনুসন্ধান করা উচিত। কী তার পরিচয়, তা-ও জানার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু কীভাবে তার অনুসন্ধান কার্য সম্ভব? কীভাবে তার পরিচয় লাভ হতে পারে?

এই চিন্তাভাবনাই তাকে এমন ব্যাকুল করে তুলেছিল যে সাত বৎসরের বালক মুহাম্মদকে (স) আপন সঙ্গীদের কাছ থেকে দূরে নিয়ে গিয়েছিল, এবং তিনি নির্ভীকচিত্তে নিঃসঙ্গ অবস্থায় চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন।

পাঁচ. হজরত মুহাম্মদের (স) চিন্তাভাবনার পঞ্চম উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে তার পঁচিশ বৎসর বয়স অতিক্রমের পর। সাত বৎসর বয়স হতে আরম্ভ করে পঁচিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত মানুষের সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব অনুসন্ধান করতে করতে তিনি পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লেন—তবুও তাকে মিলল না। তিনি হতাশ হয়ে ভাবতে লাগলেন, এই সামাজিক জীবনের আওতায় থেকে চিন্তাভাবনার দ্বারা তাকে পাওয়া অসম্ভব; কেননা জীবন ও জগতের কোনোটাই তো সেই সন্ধান দান করতে সক্ষম হয়নি! এই সময় তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন—যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, আর কেবল মানুষকে কেন, সমগ্র জগৎকে সৃষ্টি করেছেন (কেননা, সৃষ্টিতে এমন কিছুই দেখা যায় না যাকে মানুষের সৃষ্টিকর্তা বলে প্রমাণ করা যায়।) তারই যদি সন্ধান না মিলে, তাহলে এই জীবন বৃথা, জগতের ব্যাপারে আগ্রহ প্রদর্শন বৃথা, সম্পদ বৃথা, নারী বৃথা, সংসার বৃথা, আত্মীয়স্বজন বৃথা, বন্ধুবান্ধব বৃথা,—এই পৃথিবী ও পৃথিবী যা বক্ষে ধারণ করে রয়েছে সব বৃথা। আসমান ও নক্ষত্ররাজিও বৃথা। এইরকম চিন্তা করে তিনি পর্বতের এক গুহায় সাধনায় নিমগ্ন হলেন। এই সাধনায়, তার হৃদয়ে জগৎ সম্পর্কে অনেক রহস্য উদ্ঘাটিত হয়ে গেল। যেমন :

জগতে এমন কিছুই নাই যা মানুষ ও জগতের সৃষ্টিকর্তা হওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে। জগৎকে দেখা বা জগতের পর্যবেক্ষণ সৃষ্টিশক্তিকে অনুসন্ধান করে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। মানুষের বাহ্যিক দিকটির প্রত্যক্ষণও এই ব্যাপারে যথেষ্ট নয়। মানুষের বাতেন বা অপ্রকাশ্য দিকটির পর্যবেক্ষণ বা মোশাহেদা হয়তো সেই অভীষ্ট রত্নের সন্ধান দান করতে পারবে। হ্যাঁ, মানুষের অপ্রকাশ্যদিকের পর্যবেক্ষণই প্রকৃত লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার পন্থা বাৎলাতে সক্ষম। এ ছাড়া, অন্য কোনো মানুষের হেদায়েত ও মানুষকে প্রকৃত লক্ষ্যে উপনীত করতে সক্ষম নয়। ধর্মও এ ব্যাপারে যথেষ্ট নয়—না তার কর্মপদ্ধতি, না তার গ্রন্থসমূহ, না তার পণ্ডিত ও দরবেশগণ!

এই সব পথ-নির্দেশক কথা কী করে তার অন্তরে বদ্ধমূল হয়েছিল? পরবর্তী অংশে আমরা তা নিয়ে আলোচনা করব।

সৃষ্টিকর্তার তালাশ

মাত্র সাত বৎসর বয়ঃক্রমকালেই তার মনে মূর্তি ও মূর্তিপূজার প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি হয়। বিশাল মরুভূমি, সীমাহীন প্রান্তর, সুউচ্চ পর্বতমালা, বাতাস, বৃষ্টি, পানি, অগ্নি, বিদ্যুৎ, নক্ষত্ররাজি—এ সবই তার দৃষ্টির সামনে ছিল, কিন্তু এসবের মধ্যে এমন কোনো আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল না যা সেই মহান চিন্তাবিদের মনে সামান্যতম সময়ের জন্যও এ ধারণা জাগাতে পারে যে মানুষ ও জগতের সৃষ্টিকর্তা হওয়ার নামমাত্র যোগ্যতাও এগুলোর কোনোটার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে।

জীবজন্তুর প্রতি লক্ষ্য করে তিনি দেখতে পেলেন এরা শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও মানবশিশু প্রজননে অক্ষম; এমনকি এরা একটি মাছির প্রজনন ও ঘাসের একটি দানা উৎপাদনেও সক্ষম নয়। তা ছাড়া বহু শক্তিশালী জীব-জানোয়ারও মানুষের বাহন হিশাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে—মানুষের হাতে যন্ত্রণা ভোগ করে এবং মানুষের হাতেই প্রতিপালিত হয়। অবশ্য এমন হিংস্র জানোয়ারও রয়েছে মানুষকে যারা আহত করতে বা মেরে ফেলতে সক্ষম। কিন্তু সেগুলিও মানুষের হাতে মারা পড়ে। সুতরাং এরাও যে মানুষের চেয়ে বড়ো নয় তা-ই প্রমাণিত হয়। আর, তা ছাড়া হত্যা করা আর সৃষ্টি করা এক কথা নয়। হত্যা ও সৃষ্টি এই দুইটির মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। অনেক সময় মানুষ আত্মহত্যাও তো করে থাকে।

পালিত পশু অনেক উপকারে আসে, সন্দেহ নাই। কিন্তু উপকার করা স্বতন্ত্র কথা, আর সৃষ্টি করা পৃথক ব্যাপার। তা ছাড়া, পালিত জানোয়ার মানুষের যতখানি উপকারে আসে মানুষও ওর ততখানি উপকার করে থাকে। পালিত পশু মানুষকে দুগ্ধ, মাংস দান করে, বহন করে অন্যত্র নিয়ে যায়, এবং গোবর দিয়ে ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে; অর্থাৎ মানুষকে খাদ্য-বস্তু দান করে এবং খাদ্যবস্তু সংগ্রহে সাহায্য করে। তেমনই মানুষও ওদের খাদ্য দিয়ে থাকে এবং খাদ্য সংগ্রহে সাহায্য করে। মানে হিশাবে সমান সমান।

জীব-জানোয়ারের চেয়ে গাছপালায় অধিক মূল্যবান কিছু নাই। তা ছাড়া এগুলিও মানুষেরই কাজে ব্যবহৃত হয়। মরুভূমি এবং পর্বতমালার ব্যাপারেও তা-ই! এ ছাড়া, এর অধিক আর কীই-বা এসবের কাছে প্রত্যাশা করা যায়? এগুলোর মাধ্যমে মানুষের কোনো কোনো কাজে সাহায্য হয় অথবা মানুষের সামনে এরা নিজেদের বিচিত্র রূপ তুলে ধরে। কিন্তু সৃষ্টির সাথে এ ধরনের সাহায্যের সম্পর্ক কোথায়?

অন্তরীক্ষের ব্যাপ্তি অপরিসীম এতে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু এটি সবসময় একইভাবে নিস্তব্ধ ও নিস্পন্দ। তা ছাড়া, বাক্স যেমন সাজ-সরঞ্জামকে নিজের অভ্যন্তরে স্থান দেয়, প্রান্তরও তেমনই জগতের বিভিন্ন অংশকে তার মাঝে স্থান দান করে। এছাড়া আর কী কাজেই-বা তা আসতে পারে!

মেঘমালা, পানি, অগ্নি প্রভৃতি মানুষের জন্য নিশ্চয়ই উপকারী, কিন্তু এগুলি মানুষের সৃষ্টিকর্তা কখনও নয়; আর, এগুলিও অনেক ক্ষেত্রে মানুষেরই তাবেদার।

বজ্র ভয়াবহ জিনিস; কখনও কখনও তা মানুষকে মেরেও ফেলে। কিন্তু কোনো কিছু সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়। সুতরাং তুলনা করলে ওটা সাধারণ হিংস্র জানোয়ারের মতোই। হ্যাঁ, কখনও কখনও বজ্র আবার মানুষের উপকারও করে থাকে; যেমন বিদ্যুৎ চমকে অন্ধকার বিদূরিত করে, ফলে, পথিকের জন্য পথ চিনে নেওয়া সহজ হয়। কিন্তু মানুষকে প্রতিপালনের ক্ষমতা ওর নাই।

নক্ষত্র যে উজ্জ্বল, সুন্দর ও মনোহারী, তা ঠিক, কিন্তু তা আদৌ সৃষ্টি-ক্ষমতা রাখে না। কোনো মৃতকেই তা জীবিত করতে পারবে না, সৃষ্টি করা তো দূরের কথা! নক্ষত্র আলোক প্রদর্শন করে ঠিক, কিন্তু তাও এক নির্দিষ্ট প্রকৃতিগত স্বভাবেরই পরিস্ফুটন ছাড়া আর কিছুই নয়। এছাড়া নক্ষত্র থেকে আর কিছু আশা করা যার না। সেই আলোক বিতরণেও মাঝে যাঝে মেঘমালা বাধার সৃষ্টি করে; কেননা অনেক সময়ে বিরাট আকার মেঘখণ্ড তাকে ঢেকে ফেলে আলোক প্রদর্শনীর সমাপ্তি ঘটিয়ে দেয়। এ ছাড়া সৃষ্টির সাথে আলোক বিকিরণের সম্পর্কই বা কোথায়? প্রতিপালনের সাথেও তো আলোক বিকিরণের কোনো মিল নাই। নক্ষত্রকে রোজই আকাশমণ্ডলে প্রোজ্জ্বল হয়ে ফুটতে দেখা যায়, কিন্তু তাতে তো কোনো মানুষ সৃষ্টি হয় না; মানুষ তো দূরের কথা, তার আলোকচ্ছটায় একটি ঘাসের বীজও তে অংকুরিত হয় না! অংকুরিত হওয়ার জন্য মাটি, পানি ও বাতাস এই তিনের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়।

সৃষ্টিকে দেখে সৃষ্টিশক্তির স্বরূপ উদঘাটন সম্ভব নয়। এ কারণে, তিনি এক যুগ ধরে সৃষ্টিকে পর্যবেক্ষণ করলেও এই সময়ের মধ্যে কখনও সৃষ্টিশক্তির আভাস পর্যন্ত পান নাই। যে তথ্যই তার সম্মুখে এসে স্থিতিলাভ করেছে এবং কিছুটা লীলা বহন করে এনেছে, তা ছিল একটি গুণ বা স্বভাবের বহিঃপ্রকাশ এবং প্রদর্শনলীলা মাত্র, এ ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, কোনো একটি গুণ বা স্বভাবে সৃষ্টি-শক্তির সেই সামগ্রিক তাজাল্লি কোথায় যা একাই মানব-সৃষ্টি এবং জগৎ-সৃষ্টির উপকরণ হতে পারে? মানুষ ও জগৎ-সৃষ্টির কাজটি কোনো একটি গুণ ও অবস্থার আয়ত্তাধীন নয় মোটেই। অগ্নিতে উত্তাপ রয়েছে এবং তাপদানের ক্ষমতাও তাতে বিদ্যমান। কিন্তু কেবলমাত্র উত্তাপের দ্বারাই তো জীবনের উৎপত্তি হওয়া সম্ভব নয়। জীবন শৈত্য এবং স্নিগ্ধতারও মুখাপেক্ষী। পানিতে শৈত্য এবং স্নিগ্ধতার স্বভাব বিদ্যমান—কিন্তু তাতে উত্তাপ কোথায়? অথচ জীবন উত্তাপও চায়।

এমনইভাবে, সৃষ্টিজগতের অংশসমূহে যে সমস্ত স্বতন্ত্র স্বভাব বিতরিত রয়েছে তা স্বতন্ত্রভাবে প্রাণ-সৃষ্টির ক্ষমতা হতে বঞ্চিত। সুতরাং সকল স্বতন্ত্র ও পৃথক জাগতিক সত্তার স্বভাবগুলো যে-সত্তার মাঝে সামগ্রিকভাবে একীভূত ও বিমূর্ত, উপর্যুক্ত প্রকার পর্যবেক্ষণ দ্বারা সেই সৃষ্টিশক্তির স্বরূপ কী করে উদ্ঘাটিত হতে পারে? কিছুতেই তা সম্ভব নয়। এজন্য, যে-সকল লোকের দৃষ্টি কেবল জাগতিক বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ বস্তুপূজা ছাড়া তাদের পক্ষে আর কিছুরই সন্ধান লাভ সম্ভব হয় নাই—সে বস্তুপূজা সামগ্রিকভাবে হোক আর পৃথক পৃথকভাবেই হোক। এই ভাবেই সৃষ্টি হয়েছে প্রস্তরপূজক, বৃক্ষপূজক, প্রাণীপূজক, মানুষপূজক, মেঘপূজক, অগ্নিপূজক, নক্ষত্র ও অন্যান্য জীবজন্তু ও বস্তুপূজক দলের।

এইভাবে, কেবলমাত্র মানুষের বাহ্য পর্যবেক্ষণ দ্বারাও সৃষ্টিশক্তির পরিচয় লাভ অসম্ভব; কারণ, মানুষের বাহ্য দিকটিতেও এমন কোনো কিছু নাই যার মধ্যে সৃষ্টিশক্তির পরিপূর্ণ অভিব্যক্তি ঘটেছে। এজন্য কেবলমাত্র মানুষের বাতেন বা অভ্যন্তরীণ দিকটির ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে। এখানেও যদি এর সন্ধান পাওয়া না যায়, তাহলে এটি আর কোথাও নাই, এবং এটি এমন একটি রহস্য যা কোনোক্রমেই বোধগম্য হবার নয়। এ ব্যাপারে ধর্ম পথপ্রদর্শক হতে পারবে না কেন?—এই জন্য পারবে না যে ধর্ম কেবল বার্তাই দিতে পারে—দেখাতে পারে না। কিন্তু সৃষ্টিশক্তির পরিচয় লাভের জন্য দরকার পর্যবেক্ষণের উদ্যম, পর্যবেক্ষণের নেশা। ধর্মের কর্মসূচি একটি বার্তা, একটি নির্দেশ ছাড়া আর কিছুই নয়। ধর্মীয় গ্রন্থও একটি বার্তা এবং একটি নির্দেশই বটে। ধর্মের পণ্ডিতও একটি নিদর্শন মাত্র—সুতরাং সারসত্তার নিদর্শন তিনি কী করে দেখাবেন? সারসত্তা বা হকিকতের অনুসন্ধানে নির্গত ব্যক্তিকেই তো ধর্মের দরবেশ বলে মেনে নেওয়া হয়। কিন্তু এ তো অপরিহার্য নয় যে, তিনি সারসত্তার সাথে পরিচিত হয়েছেন! শুধু তা-ই নয়, কেউ দরবেশি-কোর্তা পরিধান করলেও তো তাকে দরবেশ বলেই গণ্য করা হয়ে থাকে—তিনি হকিকত বা তত্ত্ব-অনুসিন্ধুৎসু মনের অধিকারী হোন বা না হোন। সুতরাং ফেরেশতার মুখাপেক্ষী হওয়ার আগেই যার অনুসন্ধিৎসা বহুদূর অগ্রসর হয়ে গেছে, এমন কোন দরবেশ আছেন যিনি তাকে পথ দেখাবেন? তাই মানুষের ও তার নিজের অভ্যন্তরীণ দিকই অবশেষে তার অধ্যয়ন-পর্যবেক্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়। সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তাভাবনার সাক্ষ্য হিশাবে এ-ই কি যথেষ্ট নয় যা প্রত্যক্ষভাবে হজরত মুহাম্মদকে (স) সৃষ্টির তথা জগতের ভাবুক হিশাবেও প্রমাণ করছে?

এ কথা ঠিক যে, এ সকল সাক্ষ্য নিছক জগৎ-সম্পর্কে চিন্তাভাবনার আনুষঙ্গিক সাক্ষ্য হিশাবেই পরিগণিত। এগুলো জগৎ সম্পর্কে চিন্তাভাবনার মূল সাক্ষ্য নয়। কিন্তু এ কথাও ভুললে চলবে না যে এসব সাক্ষ্য সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তাভাবনার প্রাথমিক পর্যায়ের। তা ছাড়া আরও প্রমাণ রয়েছে—তবে সেগুলো সৃষ্টিশক্তির সন্ধানলাভের পরবর্তীকালের ব্যাপার। সামনে নির্দিষ্ট স্থানে সেগুলোর উল্লেখও করা হবে। এক্ষণে, আমাদের সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে চিন্তাভাবনার প্রমাণাদি বিষয়ে আলোচনা করার দরকার এবং তা হতে নির্গত রত্ন সম্পর্কে অবহিত হওয়া উচিত।

তবে, হ্যাঁ, সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা শুরুর পূর্বে আরও একটি বিষয় জেনে রাখা দরকার। জগৎ-সম্পর্কে চিন্তাভাবনার দ্বারা কি কেবল নেতিবাচক ফলই উৎপন্ন হয়েছে, না এর দ্বারা ইতিবাচক ফলও কিছু লাভ হয়েছে সেই বিষয় জানা কর্তব্য। অর্থাৎ সৃষ্টিজগতের কোনো কিছুতেই স্রষ্টা হওয়ার ক্ষমতা নাই এবং কেবলমাত্র সৃষ্টিজগতের এই গোলকধাঁধার মাধ্যমে স্রষ্টার সান্নিধ্যে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়—এই নেতিবাচক সূক্ষ্ম প্রশ্নে পৌঁছেই কি তার চিন্তাশক্তির গতি থেমে গেছিল? নিশ্চয় না, বরং তার হৃদয়ের অস্থির জিজ্ঞসা জগৎ সম্পর্কে তার চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফসলও ফলিয়েছিল। সেই ফসলও এমন পরিপূর্ণতা নিয়ে উৎপন্ন হয়েছিল যা জগৎ সম্পর্কে সমস্ত আস্তিক চিন্তাবিদের চিন্তার উৎসধারা বলে প্রমাণিত হয়েছে। উক্ত চিন্তার ফল হিশাবে যা তিনি পেয়েছিলেন নীচে তার একটি নমুনা তালিকা দেওয়া হলো। এই তালিকাটি প্রকৃতপক্ষে পূর্বে প্রদত্ত অনুরূপ একটি তালিকারই সংযোজন হিশাবে পরিগণিত হতে পারে :

১. সৃষ্টির সকল বস্তুতেই প্রাণ রয়েছে—তবে অধিকাংশের প্রাণই অস্পষ্ট।
২. সৃষ্টির প্রত্যেক বস্তুই মহিমা কীর্তন করে থাকে, তবে তা এমন আওয়াজে যা মানুষের সাধারণ বোধশক্তির আওতার বাইরে।
৩. সৃষ্টির প্রত্যেক বস্তুই পরিবর্তনশীল এবং চূড়ান্ত স্তরে না পৌঁছানো পর্যন্ত পরিবর্তনশীল।
৪. সৃষ্টির প্রত্যেক বস্তুই একটি নির্দিষ্ট ফিতরত ও স্বভাবসম্পন্ন এবং সেই ফিতরত ও স্বভাবের চাহিদানুযায়ী কর্ম করতে বাধ্য।
৫. সৃষ্টি সুশৃঙ্খল ও সুবিন্যস্ত, বিক্ষিপ্ত এবং অবিন্যস্ত নয়; সৃষ্টি একটি শৃঙ্খলস্বরূপ—যার প্রতিটি কড়া পরস্পর সংযুক্ত, বিচ্ছিন্ন নয়।
৬. সৃষ্টির কোনো অংশই অকারণ নয় এবং কোনো ঘটনাই আকস্মিক নয়; বরং প্রতিটি অংশ এবং প্রতিটি ঘটনাই কারণসিদ্ধ এবং কারণ
পরম্পরায় উদ্ভূত।
৭. সৃষ্টির প্রতিটি অংশেরই একটি ‘নিকট-হেতু’ ছাড়াও অপর একটি ‘পরম-হেতুও’ রয়েছে।
৮. সামগ্রিকভাবে সৃষ্টি পরম-হেতুর সাথেই সম্পৃক্ত।
৯. সৃষ্টি একটি ‘রবুবিয়াত’ ব্যবস্থাপনার আওতাধীন, যার পৃষ্ঠপোষকতাতেই সামগ্রিকভাবে যেমন তেমনই আংশিকভাবেও সৃষ্টি প্রতিপালিত হচ্ছ
—অর্থাৎ, রবুবিয়াতের পৃষ্ঠপোষকতার দ্বারাই সৃষ্টি এবং সৃষ্টির প্রতিটি অংশ স্বতন্ত্রভাবেও প্রতিপালিত হচ্ছে।
১০. যাকে কেন্দ্র করে সমগ্রভাবে সৃষ্টি আবর্তন করছে তা-ই সেই পরম-হেতু। পৃথিবী যেমন সূর্যের চারপাশে চক্রাকারে ঘুরছে—অথবা বাহ্যদৃষ্টিতে
সূর্য যেমন পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে তেমনই সমগ্র সৃষ্টি আবর্তন করছে এই পরম-হেতুকে।
১১. পরম-হেতু সৃষ্টির কেন্দ্রে এমন প্রতাপ ও পরাক্রমের সঙ্গে অধিষ্ঠিত আছেন যেমন অধিষ্ঠিত থাকেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিপতি কোনো নৃপতি; পার্থক্য শুধু এই যে, পরম-হেতু রবুবিয়াতের জন্য অধিষ্ঠিত।
১২. সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুই অপর বস্তুকে আকর্ষণ করছে।
১৩. সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুই যুগপৎ পরিবর্তনশীল ও উন্নতিকামী।
১৪. সৃষ্টির উন্নতিকামিতা মিলনমুখী, মিলনবিমুখ নয়; অর্থাৎ সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুর উন্নতিরই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে, সেই লক্ষ্য হচ্ছে পরম-হেতুর সাথে মিলন।

সৃষ্টিকর্তার মারেফত

সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে হজরত মুহাম্মদের (স) চিন্তা নিস্ফল হয় নাই, বরং ফলপ্রসূই হয়েছিল। এমনকি এ ব্যাপারে তার চিন্তাভাবনা এতটা ফলপ্রসূ ও সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল যে অতীত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান—কোনো কালেই এর কোনো নজির খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে না। সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে হজরত মুহাম্মদের (স) চিন্তা মারেফতের শেষ স্তর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, এবং শুধু সেখানে উপনীত হয়ে প্রথম স্থিতিলাভ করেছিল আর পেয়েছিল সৃষ্টি-শক্তির সন্ধান। তিনি যেমনটি সৃষ্টিশক্তির সন্ধান লাভ করেছিলেন সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে তা কখনও কারও তেমনভাবে লাভ করা সম্ভব হয় নাই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই প্রাপ্তি তার ভাগ্যে কোথায় ঘটেছিল? প্রসিদ্ধি আছে হেরা গুহায়। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা এই যে—উম্মে হানি নামী এক মহিলার গৃহেই তিনি এই ভাগ্য লাভ করেছিলেন। হেরা গুহার চেয়ে এই গৃহটিরই অধিক ঐতিহাসিক গুরুত্ব লাভ করা উচিত ছিল—কিন্তু অদৃষ্টে তা ঘটেনি। সৃষ্টিশক্তির সন্ধান লাভের ফলে সৃষ্টিকর্তার যে পরিজ্ঞান হাসিলের সৌভাগ্য তার হয়েছিল তার সংক্ষিপ্ত তালিকা এমন :

ক. সৃষ্টিকর্তা কেবল একটি শক্তি, কিন্তু বাকি সকলের মধ্যে যে শক্তি বিদ্যমান তা তেমন শক্তি নয়, বরং ওটা স্বয়ংসম্ভূত। সৃষ্টিকর্তা শরীরী নন, রুহও নন—তিনি নরও নন, নারীও নন। তিনি কারও তুল্য নন, তার তুল্যও কেউ নাই। তিনি বর্ণনাতীত ও কল্পনাতীত। চক্ষু তাকে দেখতে পায় না, বুদ্ধি তাকে ধারণ করতে পারে না। কেবলমাত্র সাযুজ্য দ্বারা তাকে পাওয়া সম্ভব—যদি কারও ভাগ্যে সেই সাযুজ্য ঘটে।

খ. সৃষ্টিকর্তার চেয়ে কেউ বড় নয়, কেউ তার সমকক্ষও নয়। তবে দুইটি বিষয় তার নিকটতর: জীবাত্মা আর অপরটি হলো মানবাত্মা।

গ. এ পর্যন্ত যতদূর ধারণা করা সম্ভব হয়েছে এবং ভবিষ্যতে যতদূর ধারণা করা সম্ভব হবে তার সমস্ত পূর্ণতা ও সৌন্দর্যের ভান্ডার স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা। তা ছাড়া সম্ভাব্য সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি হতেও তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত।

ঘ. সৃষ্টিকর্তা এমন একটি প্রস্রবণ, যে-প্রস্রবণ হতে সারা সৃষ্টিজগৎ ধারা ও লহরীর মতো উৎসারিত এবং প্রবাহিত এবং এই প্রবাহ অবিরাম। এ ব্যাপারে কারও অংশীদারিত্ব নাই, কিংবা কারও সামর্থও এর সাথে যুক্ত হয় নাই। সৃষ্টিকর্তার এই প্রস্রবণ আপন মহিমায় প্রবহমান। সৃষ্টিতরঙ্গ এটি থেকেই লাভ করছে সঞ্জীবনী ধারা।

ঙ. সৃষ্টিকর্তা সকল প্রভার অধিকারী। তিনি প্রভা বিস্তার করেন—কখনও ব্যাপক আকারে, কখনও সংকীর্ণ আকারে; কখনও তা হয় প্রখর আবার কখনও তা হয় মৃদু। সর্বাপেক্ষা ব্যাপক ও মৃদু প্রভা অবতীর্ণ হয় কেবল দুটি জিনিশের ওপর—একটি হলো জীবাত্মা, অপরটি হলো মানবাত্মা। কিন্তু প্রত্যেক মানবাত্মার ওপর নয়, শুধু সান্নিধ্যপ্রাপ্ত মানবাত্মার ওপর।

চ. সৃষ্টিকর্তা রব-ও বটে। যেভাবে তিনি সৃষ্টি করেন ঠিক তেমনইভাবে তিনি পালনও করেন।

ছ. সৃষ্টিকর্তা তার এক খলিফা মনোনীত করেছেন এবং তাকে স্বীয় প্রতিনিধি করে শর্ত সাপেক্ষে সমগ্র সৃষ্টির ওপর নিয়ন্তা করেছেন। তাকে এই এখতিয়ার দিয়েছেন যে সে ইচ্ছা করলে সমগ্র সৃষ্টিকে নিজের বশে আনতে পারে—সৃষ্টিকে পরিচালনা করতে পারে। এই খলিফা কে? মানুষ। কিন্তু সান্নিধ্যপ্রাপ্ত মানুষ—সান্নিধ্যবঞ্চিত মানুষ নয়।

প্রশ্ন উঠবে—হজরত মুহাম্মদ (স) যে সৃষ্টিকর্তার অনুসন্ধান ও সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করেছেন তারই-বা প্রমাণ কী?

এই প্রশ্নের জওয়াব—

এক. আল্লাহর স্মরণে আরবদেশ একেবারে বিমুখ ছিল না, এমনকি রসুলের পরিবারও ছিল। আল্লাহর নাম গ্রহণকারী বেশ কয়েকটি ধর্ম বিদ্যমান ছিল, যেমন : ইবরাহিমি ধর্ম, ইহুদি ধর্ম ও খ্রিষ্ট ধর্ম।

সৃষ্টিকর্তার অনুসন্ধান এবং সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা যদি তার মধ্যে না থাকত তাহলে তিনি এই সকল ধর্মকর্তৃক উপস্থাপিত সৃষ্টিকর্তার ধারণাসমূহ কেন গ্রহণ করেন নাই এবং তা নিয়েই কেন কর্মে অবতীর্ণ হন নাই? প্রকৃতপক্ষে, সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে পুরাতন ধারণাসমূহে তিনি তুষ্ট ছিলেন না—তিনি ছিলেন সৃষ্টিকর্তার নতুন ধারণার অন্বেষণে। অথবা এ কথাও বলা যায়—তাকলিদ বা অন্ধ অনুকরণের ওপর তিনি নির্ভর করেন নাই। তিনি ছিলেন যাচাই করে নেওয়ার পক্ষপাতী। সেইজন্য তার তিনটি বৎসর অতিক্রান্ত হয় হেরা গুহায়, নির্জন সাধনায়।

দুই. যদি অনুসন্ধান ও চিন্তা না থাকত তাহলে সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে নতুন ধারণা তিনি কী করে লাভ করেছিলেন? আর, সেই ধারণাকেই-বা এমন নিশ্চিত বিশ্বাস হিশাবে কীভাবে উপস্থাপিত করেছিলেন যে তার ফলে, কেবল সমগ্র আরবেরই নয়, তিনি সমগ্র জগতেরই বিরাগভাজন হয়েছিলেন—নিদারুণ ক্লেশের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল তার সমগ্র জীবনটাকেই।

তিন. তারপর ওহির ফেরেশতার প্রথম আগমন ও বার্তাদানের সময়েও কেন তিনি এই বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেন নাই যে ইনিই আল্লাহর ফেরেশতা এবং ওই রকম বাণী তিনি বহন করে এনেছেন? এবং যতক্ষণ পর্যন্ত দ্বিতীয় দফা ওহি নিয়ে তিনি আসেননি ততক্ষণ পর্যন্ত কেন তিনি নিশ্চিত হতে পারেননি? এমনকি তার নিজস্ব ব্যক্তিগত প্রাথমিক রহস্য উন্মোচনকেও তো তিনি অভিজ্ঞতার সঞ্চয় ভান্ডারে গ্রহণ করতে চান নাই। অনুসন্ধান ও চিন্তার ফল না হলে এইগুলোকে আর কীসের ফল বলে অভিহিত করা যায়?


তৃতীয় অধ্যায়


মানব-জগৎকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যবেক্ষণ:

হজরত মুহাম্মদ (স) সবার আগে আরবের ওপর দৃষ্টিপাত করেন, আর এই দৃষ্টিও ছিল সেই অনুসন্ধিৎসু ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টি, যা মুহাম্মদি চিন্তাধারারই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, যা অন্ধ-অনুকরণের সামান্যতম আঁচও সহ্য করতে পারত না। কোন পদ্ধতি ও কৌশলে তিনি দৃষ্টিপাত করেছিলেন?

তিনি দৃষ্টিনিপাত করেছিলেন—

● আপন পরিবারের ওপর
● আপন নগরীর ওপর
● কাবার ওপর
● বেদুইন গোত্রসমূহের ওপর
● আরবের দরিদ্রদের ওপর
● আরবের আমিরদের ওপর
● এবং আরব সভ্যতার ওপর

কিন্তু তার এই দৃষ্টিপাত এতই সূক্ষ্ম ছিল—কেউ যে পর্যবেক্ষণ করছে এটা কারও পক্ষে টের পাওয়া সম্ভব হয় নাই। শুধু তাই নয়, এমন গভীরভাবেই তিনি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিলেন যে আরব দেশে যা-কিছু কার্যকরী ও যা-কিছু প্রচলিত ছিল সেই দৃষ্টিতে তার সবকিছুই ধরা পড়েছিল। কিন্তু তিনি কাউকে বলেন নাই তার দৃষ্টিতে কী কী ধরা পড়েছিল এবং কোন বিষয়টি তার মনে কীভাবে রেখাপাত করেছিল। এর কারণ এই— প্রথমত, সমগ্র আরবে তার এমন কেউই ছিল না যার কাছে তিনি রহস্য বা ভেদ ব্যক্ত করতে পারতেন। দ্বিতীয়ত, প্রকৃতগতভাবেই তার স্বভাব ছিল পরম সংযত ও একান্ত ধৃতিশীল। তা ছাড়া, অধিক কর্ম, স্বল্প কথা এবং কর্মের পূর্বে কথায় কী লাভ— এই নীতিরই পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটেছিল তার চরিত্রে।

আরবের ওপর দৃষ্টিপাতের ফলে তার যা কিছু আহরিত হয়েছিল তার ব্যাখ্যা কেউ তার মুখে শুনে নাই, আর একত্রে তো আদৌ শুনে নাই। এই প্রয়াস তো মুহাম্মদের (স) স্বভাবকে স্পর্শও করতে পারে নাই। কিন্তু হজরতের কর্ম তা ব্যক্ত করেছে, তবে খণ্ড খণ্ড ভাবে। তার কারণ এই যে হজরতের কর্মেও তার জবানের মতোই এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল যে সে কোনো সংগ্রাম এবং কীর্তিকেই ক্রমাগত উপস্থাপিত করত না। সমুদ্রের ঊর্মির মতো তার গতি ছিল না, তার গতি ছিল গ্রীষ্মের ঝঞ্ঝার ন্যায়; প্রভাতী সমীরণে ঝটিকা প্রবাহের মতো ছিল তার গতিবেগ। এরপরেও একজন গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তাবিদের পক্ষে মুহাম্মদ (স) কর্তৃক ইতস্তত ছড়ানো রত্নসমূহকে একত্র করে সাজিয়ে নেওয়া সম্ভব।

উপর্যুক্ত চেষ্টার মাধ্যমে আরবের অবস্থা সম্পর্কে হজরতের গোচরীভূত তথ্যসমূহের যে তালিকা প্রস্তুত করা যায় তাকে একটি ক্ষুদ্র পরিচিতি হিশাবে এখানে উপস্থিত করা হচ্ছে। তিনি আরবদের মাঝে দুই ধরনের বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আরব একদিকে—

১. ক্ষুধার্ত
২. লুণ্ঠনকারী
৩. যুদ্ধ বা কলহপ্রিয়
৪. যাযাবর
৫. বাহুল্য-প্রিয়
৬. অহংকারী বা উদ্ধত
৭. দুষ্কৃতিপরায়ণ
৮. অশিক্ষিত
৯. কুসংস্কার পূজারী
১০. জড়পূজারী
১১. জাতীয়তাপূজারী
১২. কামপূজারী
১৩. লোভী
১৪. অসংস্কৃত
১৫. অসভ্য
১৬. দুর্বল
১৭. গোলাম

অন্যদিকে—

১. মেধাশক্তি সম্পন্ন
২. স্বভাব-কবি
৩. নির্ভয়
৪. সৈনিক
৫. সুক্ষ্ম মর্যাদাবোধ সম্পন্ন
৬. দাতা
৭. কষ্ট-সহিষ্ণু
৮. স্বাধীনতা-প্রিয়

নিরীক্ষণের ফল

এইরূপ দৃষ্টিপাতের ফল আল্লাহর নবীর (স) স্বভাবে কি আছর করেছিল? এই আছর বা প্রভাবের বিষয়টিও বহুদিন পর্যন্ত রহস্যাবৃত ছিল। আর ব্যাখ্যার দিক থেকে তো চিরকালের জন্যই এটা রহস্য হিশাবেই বিরাজমান। আল্লাহর নবীর (স) জবানে যেমন তার দৃষ্টিপাত সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারিত হয় নাই, তেমনই সেই দৃষ্টিপাতের প্রভাব সম্পর্কেও তা কখনও কোনো কিছু প্রকাশ করে নাই। তবে তার কার্যক্রমে সেই প্রভাবের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। অনুসন্ধানের পর যতটুকু সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে সংক্ষিপ্তভাবে তা এই :

এক. আরব সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্য।
দুই. আরব সংস্কারের অযোগ্য নয়।
তিন. সংস্কারের পর আরবরা এমন জিনিশে পরিণত হবে যার সামনে সমগ্র বিশ্বই মূল্যহীন হয়ে পড়বে।
চার. আরবের সংস্কার সমগ্র বিশ্বের সংস্কারে রূপান্তরিত হবে।
পাঁচ. আরবের সংস্কার কে করতে সক্ষম?
ছয়. আরবের সংস্কার আমাকেই করতে হবে এবং আমি অবশ্যই তা করব।
সাত. আরবের সংস্কার একটি বিপ্লবের প্রতীক্ষা করছে; সেই বিপ্লবও কেমন? তা অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব—যে-বিপ্লব অনুষ্ঠিত হবে প্রতিটি প্রান্তে,প্রতিটি অণুপরমাণুতেও।
আট. এই বিপ্লবের ভিত্তি রচনা করতে হবে ধর্মের ওপর, সেই একই ধর্মের পতাকাতলে সমগ্র আরবকে সম্মিলিত করতে।
নয়. এই ধর্মটি কী হবে? দীনে রব্বানি, দীনে রব্বানিয়াত।

আরব বাদে বাকি মানবজগতের ওপর দৃষ্টিপাত

আরবের সঙ্গে সঙ্গেই বাকি গোটা মানব জগতের ওপরও তিনি দৃষ্টিপাত করেছিলেন। কারণ, জন্মগতভাবেই তার দৃষ্টিতে বিশ্বজনীনতা ছিল। সুতরাং স্বদেশ ও স্বজাতির মধ্যেই সেই দৃষ্টি আবদ্ধ থাকবে কেন? তার এই দৃষ্টি তো গোটা জগৎকেই এক রহস্য বিবেচনা করত এবং একে রূপান্তরিত করবার জন্য তা প্রস্তুতও ছিল। মানবজগৎকে একই রাজ্যাধীন মনে করতে এবং একই রাজ্য বলে ধরে নিতে তার কোনো অসুবিধাই ছিল না। অন্যদিকে দেশীয়, জাতীয় ও দলগত কোনোদিক প্রাধান্য লাভের প্রশ্নই ছিল না। বস্তুত তিনি গোটা মানবজগতের ওপর তার দৃষ্টিনিক্ষেপ করেন এবং গভীরভাবে এর সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেন। তবে প্রশ্ন হলো, কীভাবে? আরব তার সামনে ছিল এ কথা ঠিক, কিন্তু আরব বাদে বাকি জগৎ তো তার সামনে ছিল না। সর্বোচ্চ তিনি সিরিয়া দেখেছিলেন আর সিরিয়ার সাথে পরিচয়ের মাধ্যমেই পারস্য ও রোমকদের সম্পর্কে খানিকটা অনুমান করতে পেরেছিলেন। কিন্তু অবশিষ্ট মানবজগৎ, যা তার দৃষ্টির সম্পূর্ণ আড়ালে এবং অজ্ঞাতই ছিল। কী করে তা পর্যবেক্ষণ করা তার পক্ষে সম্ভব? তা হলে শুনুন! অবশিষ্ট মানব জগতের অবস্থা উপলব্ধি করার জন্য সিরিয়ার সাথে পরিচিত হওয়ারও প্রয়োজন ছিল না, আরবই ছিল এ ব্যাপারে যথেষ্ট। মূলত, আরব কেবল আরবই ছিল না, তা ছিল গোটা বিশ্ব—মৌলিক মর্যাদার দিক দিয়ে যেমন, তেমনই সমসাময়িক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেও। আপনাদের কি জানা আছে আরবের মৌলিক মর্যাদা কী ছিল যা পরে বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল? আরবের মৌলিক মর্যাদার বিষয় অনুমান করার জন্য তার অতীতের কয়েকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরা হচ্ছে। এতেই বিষয়টি সম্যক উপলব্ধি করা সম্ভব হবে বলে আশা করি।

ক. অতীত-আরবে হজরত ইবরাহিম (আ) ও হজরত ইসমাইলের (আ) মতো অতুল মর্যাদা-সম্পন্ন নবীদের তামিরগাহ ছিল। আর ইবরাহিম (আ) কে? তিনি ছিলেন আল্লাহর খলিল অর্থাৎ বন্ধু, তিনি ছিলেন প্রেমিকরাজ; তিনি আল্লাহর মহব্বতে আপন পুত্রকে নিজ হাতে জবাই করার জন্য উদ্যত হয়েছিলেন। তার প্রেমের শিক্ষা প্রলয়কাল পর্যন্ত শিক্ষণীয় উদাহরণ হিশাবে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। আর ইসমাইল (আ), তিনি কে ছিলেন? তিনিই তো পিতা ইবরাহিমকে (আ) নিজের কোরবানির সময় বলেছিলেন : ‘আব্বাজান, আমাকে জবাই করার সময় পট্টি বেঁধে নিবেন—যাতে এমন না হয় যে জবাই হওয়ার সময় আমার যন্ত্রণা দর্শন করে আপনি সংকল্পচ্যুত হয়ে যান এবং আমি কোরবান হওয়ার সৌভাগ্য হতে বঞ্চিত হয়ে পড়ি।’ সুতরাং, একজনকে যদি বলি প্রেমিকরাজ, তাহলে অপরজন ছিলেন ত্যাগের মুকুটমণি। এমন দুই মহান প্রেরিতপুরুষের কর্মস্থান ছিল যে আরব, তা যে কত মর্যাদাপূর্ণ ছিল তা অনুমান করা কঠিন নয়। এই মহামানবদের বদৌলতেই আরবের ধর্ম মিল্লাতে ইবরাহিমিতে পরিণত হয়। ‘মিল্লাতে ইবরাহিম’ তা-ই যাকে পরবর্তীকালে ‘ইসলাম’ নামে আখ্যায়িত করা হয়; আর ইসলাম নামে অভিহিত হওয়ার আগে এটাই ‘মসলুক-ই-মুহাম্মদিয়াত’ বা ‘মুহাম্মদি পন্থা’ হিশাবে প্রতিপন্ন হয়। ‘ইলহাম-ই-মুহাম্মদি’ আল্লাহর নবীকে (স) এই পন্থায় অগ্রসর হওয়ার জন্যই সুস্পষ্ট আদেশ দিয়েছিল। আরবের অতীত ধর্ম খালিস এটাই। মিল্লাতে ইবরাহিমির পর আগমন হয় ইহুদী ধর্মের। তারপর আসে খ্রিষ্ট ধর্ম। কিন্তু এই দুই ধর্ম অল্পই গৃহীত হয়েছিল। এরপর সৃষ্টি হয় এক ধর্ম থেকে অপর ধর্ম গ্রহণের প্রবণতা। কিন্তু এই অবস্থাও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এর পর ‘মিল্লাতে ইবরাহিমি’, যা ছিল তৌহিদ, এবং তৌহিদেরই ধর্ম, শিরকের লেশমাত্রও যাতে ছিল না, তাও বিকৃত হয়ে পরিণত হলো প্রতিমাপূজায়। এইজন্য সেখানে ‘বুজুর্গ’ বা অতিমানব পূজা দেখা যায়। প্রথমে স্বয়ং হজরত ইবরাহিম (আ) ও ইসমাইলের (আ) মূর্তি তৈরি করে পূজা করা হতো। এরপর অপরাপর বুজুর্গের পূজাও শুরু হয়ে যায়। এমনকি শেষপর্যন্ত প্রত্যেক গোত্রেরই নিজস্ব প্রতিমা তৈরি হলো। তাহলে ভেবে দেখুন, সমকালীন আরব যত অধঃপতিতই হয়ে থাকুক না কেন, অতীত-আরব ধর্মের দিক দিয়ে কতখানি ঐশ্বর্যের অধিকারী ছিল। অতীত-আরবের কৃষ্টি-কালচারও ছিল ইবরাহিমি কৃষ্টি। এই জন্য কৃষ্টিগত দিক দিয়েও আরব ছিল পূর্ণ ঐশ্বর্যশালী; কারণ, ইবরাহিমি কৃষ্টির ভিত্তি ছিল তৌহিদ, আর যার ভিত্তি তৌহিদ তার ঐশ্বর্য তো কল্পনাতীত। তৌহিদি কৃষ্টি হলো সার্বজনীন কৃষ্টি। এর সীমা আল্লাহর সাথে জড়িত থেকে সমগ্র জগৎকে পরিবেষ্টন করে থাকে। সুতরাং, যেখানে এমন উদার-দৃষ্টি বিদ্যমান সেখানে চারিত্রিক ও ব্যবহারগত উদারতা ও মাধুর্য যে কতখানি হবে তা বলাই বাহুল্য। এ কারণেই, আরবের বিকৃত কৃষ্টিতেও কিছু দিক দিয়ে এমন যোগ্যতা বজায় ছিল—যা গোটা বিশ্বকে কৃষ্টির ক্ষেত্রে পথ প্রদর্শন করতে সক্ষম, যদিও তা বহু রকমের বিকৃতিতে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল।

খ. অতীত আরবের এই গৌরব লাভের সৌভাগ্যও হয়েছিল যে আরবই ছিল আল্লাহর প্রথম গৃহের অধিকারী যেখানে বিশ্ব-সমাবেশে এক আল্লাহর এবাদত করা হতো। জ্ঞান ও সভ্যতার প্রথম কেন্দ্রভূমি সিরিয়ার মতো কৃষ্টি-সম্পন্ন দেশেরও এক-আল্লাহর আরাধনাস্থল হিশাবে অভিহিত হওয়ার মর্যাদা লাভ হয় আরবের পরে। এ পরিপ্রেক্ষিতে অতীত-আরব গোটা মানবজগতের পুরোধা ছিল; কারণ, সেই অতীতে, যখন আরবের এমর্যাদা লাভ হয়েছিল তখন সমগ্র ধরাধামে এমন একটি দেশ এবং এমন একটি জাতিও বিদ্যমান ছিল না যাদের ভাগ্যে অনুরূপ মর্যাদা লাভ হয়েছিল। যে-দেশ এবং জাতিরই এই মর্যাদা লাভের সৌভাগ্য হয়েছে তা আরবের পরেই হয়েছে। এজন্য, এই মর্যাদার দিক দিয়ে অপরাপর দেশ ও জাতি আরবের অনুসারী বৈ আর কিছুই নয়। তা ছাড়া, এ ব্যাপারে লজ্জারও কোনো প্রয়োজনীতা নাই। কারণ ভূখণ্ড আল্লাহর; তিনি ভূখণ্ডের যে-অংশকে ইচ্ছা যেকোনো মর্যাদা দান করতে পারেন, আর তিনি যেখানে যে মর্যাদা দান করেন তা সঙ্গতভাবেই দান করেন।

গ. অতীত-আরবের এ গৌরবও ছিল যে, আরবকে যে-ভাষা দেওয়া হয়েছিল তা বিশ্বের অপর কাউকেও দেওয়া হয়নি। এ কারণেই, আরব নিজেদের ছাড়া অন্য সকলকে ‘আজম’ অর্থাৎ ‘বোবা’ বলে অভিহিত করত। এ কারণেই দর্শন ও কবিত্ব পূর্ণ ব্যাপ্তি ও সূক্ষ্মতা ব্যক্ত করার জন্য এই ভাষাই মনোনীত হয় এবং আজও এমন কোনো ভাষা নাই যা দর্শন ও কবিত্ব-প্রকাশের ক্ষেত্রে আরবি ভাষার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম।

ঘ. অতীত-আরবের এই গৌরবও ছিল যে মেধার দিক দিয়ে আরবীয়দের সমকক্ষ কেউ ছিল না। আরব ছাড়া পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত এমন কোনো অশিক্ষিত জাতির আর্বিভাব হয় নাই যারা অশিক্ষার মতো অজ্ঞতায় নিমজ্জিত থেকেও উচ্চ পর্যায়ের কবিত্ব করেছে, বিনা চিন্তাভাবনায় কবিত্ব করেছে এবং গোটা জাতিই কবিত্ব করেছে। শুধু কবিত্বই নয়, ইতিহাশাস্ত্রকেও তারা মুখস্ত রাখার মাধ্যমেই এমনভাবে সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধিশালী করেছিল যে জানোয়ারের বংশ-সূত্র পর্যন্ত তাদের মুখস্ত থাকত।

ঙ. অতীত-আরবের এ গৌরবও ছিল যে তারা বীরত্ব, সততা, মর্যাদাবোধ ও স্বাধীনতা-প্রিয়তায় ছিল অদ্বিতীয়। অতীতের সেই বৈশিষ্ট্যেরই আধ্যাত্মিক সন্তান ছিলেন সমসাময়িক কালের হাতিম তাই ও খালিদ ইবনে ওয়ালিদ। তাদের বদান্যতা ও বীরত্ব বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। তা ছাড়া, ওই বৈশিষ্ট্যেরই আধ্যাত্মিক সন্তান ছিল সেই বেদুঈন, যে হজরত ওমরের মতো প্রতাপশালী বিশ্বত্রাস খলিফাকেও বিপুল জনসমাবেশে এ-কথা শুনিয়ে দিয়েছিল যে ‘যদি তুমি ঠিক পথে না চলো তাহলে এই তলোয়ার দিয়ে তোমাকে সোজা করে দেব’।

চ. অতীত-আরবের এ গৌরবও ছিল যে ভালোবাসার চর্চায় তারা নিজেদেরকে অদ্বিতীয় প্রতিপন্ন করেছিল। এরই আধ্যাত্মিক সন্তান ছিলেন কায়েস ইবনে আমের, যিনি এশকের পাগলপনার ক্ষেত্রে পুরোধার মর্যাদা অর্জন করেছিলেন।

ছ. অতীত-আরবের আরও একটি গৌরব ছিল সেটি এই যে, যাযাবর আরব এমন সভ্যতা সৃষ্টি করেছিল অন্যান্য সভ্যতা যাকে সর্বদাই হিংসার চোখে দেখেছে।

অতীত-আরবের এ সকল বৈশিষ্ট্য এমনই সার্বজনীন ছিল যে গোটা মানবজগতের সমস্ত মৌলিক গুণই এখানে একত্রিত হয়েছিল। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যদিও-বা মলিন হয়ে পড়েছিল কিন্তু তখনও বিলুপ্ত হয় নাই। এ কারণে একজন রব্বানি চিন্তাবিদের পক্ষে আরবে বসে সহজেই গোটা মানবজগতের সমস্ত মৌলিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া সম্ভব ছিল। এ যেন নিজ ঘরে বসে বিশ্বের গোটা সৌন্দর্য-নকশা প্রত্যক্ষ করা।

অন্যদিকে, আরব যখন বিগড়ে গেল তখন সে এমনভাবেই বিগড়ে গেল যে—দুষ্কৃতি যত রকমের হতে পারে আরবে সবই মজবুত বাসা বেঁধেছিল। সুতরাং একজন রব্বানি চিন্তাবিদ এসব প্রত্যক্ষ করেই গোটা মানবজগতের দোষত্রুটির সম্পূর্ণ নকশাও পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম ছিলেন।

তাহলে, পূর্বে যেমন বলা হয়েছে যে, হজরত মুহাম্মদের (স) জন্য সমগ্র বিশ্বের অবস্থা উপলব্ধির জন্য আরবের বাইরে, এমনকি তার প্রতিবেশী সিরিয়ার সাথে পরিচিত হওয়ারও আদৌ প্রয়োজন ছিল না, তা অতি সত্য। তারপরেও সিরিয়া প্রত্যক্ষ করার সুযোগ তাকে কিছু না কিছু সাহায্য করেছিল বৈ কি। কিন্তু সিরিয়া ছাড়া অপর কোনো দেশ দেখা তো ছিল সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়; কারণ সিরিয়াই ছিল তখনকার মতো, গোটা বিশ্বের সভ্যতার কেন্দ্রস্থল ও সৌকর্যের ভান্ডার; সিরিয়াই ছিল সেই স্থান যেখানে রোমক, মিসরীয় ও পারসিক—এই জাতিত্রয়ই নিজ নিজ সভ্যতা ও অবদানসহ সমবেত ছিল। রোমক রাজ্য ছিল তখন পাশ্চাত্য অর্থাৎ ইউরোপের কেন্দ্রস্থল। সুতরাং তখন যে-ব্যক্তি রোমকদের পরিচয় লাভ করেছেন তিনি সমগ্র পাশ্চাত্যকেই জেনে ফেলেছেন। মিসর ছিল আফ্রিকার কেন্দ্রভুমি; সুতরাং, তখন যিনি মিসরের সাথে পরিচিত হয়েছেন তিনি গোটা আফ্রিকাকেই বুঝতে পেরেছেন। পারস্য ছিল তখন এশিয়ার কেন্দ্রস্থল, সুতরাং, যিনি পারস্যের সহিত পরিচয় লাভ করেছেন তিনি গোটা এশিয়ার অবস্থাই বুঝতে পেরেছেন। এতে সন্দেহ নাই যে, সে-কালে হিন্দুস্তান এবং চীনও সভ্যতার দুইটি কেন্দ্র হিশাবে বিদ্যমান ছিল। অবশ্য হিন্দু্স্তানি সভ্যতা হিন্দুস্তানের নিজস্ব বস্তু ছিল না, ওটা ছিল মূলত পারস্য-সভ্যতা। পারস্যের বিজেতাদের ঘাড়ে ভর করে এ সভ্যতা এই দেশে পদার্পণ করেছিল এবং হিন্দুস্তানিদের মধ্যে আসন গেড়ে বসে খ্যাতি অর্জন করেছিল। চীনের সভ্যতাও চীনের নিজস্ব সম্পদ ছিল না ; ওটাও ছিল পারস্য-সভ্যতা। চীনে সভ্যতা কোথা থেকে গিয়েছিল? মধ্য এশিয়া হতে। অন্যদিকে, পারস্য ও মধ্য এশিয়া বলতে কী বুঝায়? পারস্য কেবল পারস্যেরই নাম নয়, বরং মধ্য এশিয়া যার অন্তর্ভুক্ত সেই গোটা অঞ্চলকেই পারস্য বলা হয়। সুতরাং, যে ব্যক্তি পারস্যকে প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি হিন্দুস্তান ও চীন— উভয়কেই প্রত্যক্ষ করেছেন।

দ্বিতীয় দৃষ্টি নিক্ষেপের ফলাফল

আরবের ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপের যে আছর হয়েছিল আরব ছাড়া অবশিষ্ট বিশ্বের প্রতি দৃষ্টি-নিক্ষেপও সেই ফলই বহন করে আনে; এটা কী? একটি বিশ্ব বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা। এই দুইটি প্রভাব একত্র মিলে বিশ্ববিপ্লবের পরিকল্পনার রূপ পরিগ্রহ করেছিল। কিন্তু বিশ্ব-বিপ্লবের মধ্যে একটি বিশেষ শ্রেণিবিভাগ ও ক্রমবিন্যাসের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। সেটি কী? সেইটি এই যে আরবের বিপ্লব প্রথমে, আরব ছাড়া অবশিষ্ট বিশ্বের বিপ্লব পরে। কিন্তু এই পার্থক্য কেন? কেন আরব প্রথমে আর অবশিষ্ট বিশ্ব পরে? এটা এই জন্য নয় যে আরব তার মাতৃভূমি হওয়ার কারণে অধিক প্রিয় ছিল আর অবশিষ্ট বিশ্ব ছিল অল্প প্রিয়। ধিক, বিশ্ব-রব্বানির পক্ষে এমন সংকীর্ণ হৃদয়বৃত্তির সাথে কী সম্পর্ক থাকতে পারে? এর কারণ কেবল এই যে, এই ভাবেই কাজ করা সম্ভব ছিল। আরব ছিল গোটা বিশ্বের কেন্দ্রভূমি; কারণ, তার কাবা গোটা বিশ্বেরই কেন্দ্রস্থল ছিল—বাস্তবে তা প্রতিপালিত না হোক কিন্তু নীতিগত দিক দিয়ে এটা তা-ই ছিল। সুতরাং আরবের বিপ্লবই গোটা বিশ্বের বিপ্লবে পরিণত হতে পারত। আরব ভূমিতেই বিশ্ববিপ্লবের পূর্ণ সম্ভাবনা বিদ্যমান ছিল; এ কারণে বিশ্ববিপ্লবের বীজ আরব ভূমিতেই উত্তম ভাবে অংকুরিত হতে পারত; তারপর সেখান থেকে অপর ভূখণ্ডে তা স্থানান্তরিত করা সম্ভব ছিল। বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতার পক্ষেও আরবে প্রচুর সুযোগ সুবিধা ছিল; কারণ, বিপ্লবের কাজ সেখানেই সম্ভব ছিল, অপর কোনো স্থানে নয়। সুতরাং,আরবকে অগ্রাধিকার দানের যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তা ছিল সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত। এরপর, এই প্রভেদ ভুল শব্দের মতোই মিটিয়ে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু তা কখন? যখন আরবে বিপ্লব শিকড় গেড়ে বসল এবং বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতার দৃঢ়বিশ্বাস জন্মে গেল যে এখন এই বন্যার গতিপথ অপরদিকে সহজেই ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব। বস্তুত সেই বন্যার গতিপথ পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছিল। যে-সাফল্যের সাথে সে পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল আর তাতে যে সুফল লাভ ঘটেছিল তা বিশ্বের সামনে ভাস্বর হয়েই আজও বিরাজ করছে। এই বিপ্লবের সামগ্রিক বিশেষত্ব এই ছিল যে তা নফসানি ছিল না, ছিল রব্বানি বিপ্লব।

 

চতুর্থ অধ্যায়

আরবের রব্বানি বিপ্লব

এক. আরবের বিপ্লব বিশ্বের প্রথম সুশৃঙ্খল ও পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব। আধুনিক জগত এই ভেবে আত্মপ্রতারণা করছে যে ফরাসি বিপ্লব বিশ্বের প্রথম সুশৃঙ্খল ও পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব। সত্যি বলতে কী, ফরাসি বিপ্লব যেমন সুশৃঙ্খল বিপ্লব ছিল না, তেমনই তা পূর্ণাঙ্গ বিপ্লবও ছিল না৷ সুশৃঙ্খল ছিল না এই কারণে—বিপ্লবটা হয়েছিল আকস্মিক এবং অতর্কিত। এ জন্য এই বিপ্লব শুরুর আগে যেমন কোনো সুষ্ঠু কর্মসূচি তৈরি হয়নি, তেমনই কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করার কোনো নকশা বা কোনো রাহনুমাও (পথপ্রদর্শক) নির্ধারণ করা হয়নি। ঘটনার সূত্রপাত এভাবে হয়—জনতার একটি দলকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য জুলুমশাহির ফৌজ এগিয়ে যায়, জনতা ছত্রভঙ্গ হওয়ার উপক্রম করেছে এমন সময় হঠাৎ করে মরাবোঁ নামক এক ব্যক্তি ঘোষণা করল কেউ পিছু হটবেন না। এই ঘোষণায় জনতা উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে এবং উদ্দীপনার ফলে আপনা আপনিই ছত্রভঙ্গ হয়ে হত্যা ও লুণ্ঠন শুরু করে দেয়। এ কারণে ভয়াবহ রকমের রক্তারক্তি হলেও ফায়দা হয়েছিল খুবই কম। এ বিপ্লব পূর্ণাঙ্গ ছিল না, কারণ এ বিপ্লব রাজতন্ত্র ধ্বংস করা ছাড়া ফরাসি দেশের আর কোনো অনাচার-দুর্নীতি উচ্ছেদ করতে সক্ষম হয় নাই। সেই রাজতন্ত্র উচ্ছেদও একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, মানে অস্থায়ী ফল বলে প্রমাণিত হয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যেই এক রাজতন্ত্রের স্থলে অপর রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সুতরাং, প্রকৃতপক্ষে এ বিপ্লব একটি পারিবারিক বিপ্লব, বেশি থেকে বেশি একে একটি ব্যবস্থাপক বা এন্তেজামি বিপ্লব বলে প্রতিপন্ন করা যেতে পারে। অন্যদিকে আরবের বিপ্লবের একটি সুষ্ঠু কর্মসূচি ছিল। এটি একটি পূর্ণ পরিবর্তন সাধন করেছিল, একটি সামগ্রিক সংস্কার শুরু করে তা সম্পন্ন করেছিল। এবং এতে রক্তারক্তি হয়েছিল খুবই সামান্য, ফলাফল ছিল অতি গৌরবজনক।

দুই. (ক) আরবের বিপ্লব শুরু হয়েছিল একজন নির্দিষ্ট পথপ্রদর্শকের দিকনির্দেশনায়, আর তা সম্পন্নও হয়েছিল সুচারুভাবে। এই পথপ্রদর্শক ছিলেন খোদ হজরত মুহাম্মদ (স)। আরবের বিপ্লব ছিল ক্রমবিকাশমান ‘খালিস’ শিক্ষাভিত্তিক। শুধু তা-ই নয়, এ বিপ্লব ছিল গঠনমূলকও। এই বিপ্লব এগিয়ে এসেছিল ভোরের মন-মাতানো বাতাসের মতো ধীর লয়ে। নতুন মাসের মতো আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং পূর্ণিমার চাঁদের মতো ক্রমে ক্রমে পূর্ণ রূপ লাভ করেছিল। আরবের বিপ্লবের কর্মসূচি নিছক চিন্তাপ্রসূত ছিল না, বরঞ্চ তাতে ইলহামি বিষয়ও ছিল। স্পষ্ট করে বললে—বিপ্লবের নকশা ছিল চিন্তাপ্রসূত, কিন্তু সিদ্ধান্ত ছিল ইলহামি। এই চিন্তাটা ছিল ইলহামের একটি শাখার অন্তর্ভুক্ত, ইলহামের সাথেই তার চলাচল।

(খ) আরবের বিপ্লবের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল তালিম বা শিক্ষার ওপর। এ বিপ্লব শিক্ষার ওপরই শুরু হয়ে শিক্ষার মাধ্যমেই অগ্রসর হতে থাকে এবং শিক্ষার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। মাঝে-মধ্যে যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়েছে ঠিক, কিন্তু তা কেবল ‘নফসানিয়াতের’ মোকাবেলার প্রয়োজনেই। এজন্য যুদ্ধগুলি ‘নফসানি’ হওয়ার পরিবর্তে পরিণত হয়েছে রব্বানি যুদ্ধে। কিন্তু এর পরেও যুদ্ধ কর্মসূচি বা বিপ্লব-বাস্তবায়নের নকশার অন্তর্ভুক্তও হয় নাই। যুদ্ধের ব্যাপারটি ছিল কর্মসূচির বাইরে, হঠাৎ সামনে চলে এসেছিল। যুদ্ধ যেন বিলুপ্ত হয় এটাই ছিল মূল লক্ষ্য। কিন্তু তখনও পৃথিবী ‘যুদ্ধমুক্ত’ পরিবেশের জন্য প্রস্তুত হয়নি, মানুষের স্বভাবে পরিপক্বতা আসেনি, তাই এই ‘লক্ষ্যে’ পৌঁছা সম্ভবও হয়নি। ‘যুদ্ধমুক্ত’ পৃথিবীর জন্য মানবজাতির যে বৌদ্ধিক বিকাশ প্রয়োজন, আমরা এখনও সেই পর্যায়ে যাইনি। তবে মানুষ কোনো একদিন সেদিকে যাবেই।

(গ) আরবের বিপ্লবের ভিত্তি ছিল গঠনমূলক; এর কর্মসূচিও ছিল গঠনমূলক, আর সমাপ্তিও ছিল গঠনমূলক। ভাঙ্গার দিকটি ছিল সব সময়েই গৌণ। যেমন কোনো দুষ্ট ছেলেকে শিক্ষাদান করা হয়; প্রথমত, শিক্ষাদানের মাধ্যমেই তা শুরু করা হয় এবং শিক্ষার ওপরই অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং মাঝে মাঝে তার মন্দ স্বভাবের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তা উচ্ছেদ করার চেষ্টা করা হয়।

(ঘ) এই বিশেষত্বেরই ফলস্বরূপ বিপ্লব পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সমগ্র আরব দেশ জাতি-গোত্র নির্বিশেষে এক পূর্ণাঙ্গ জাতি বলে প্রতীয়মান হতে থাকে। এবং এ কারণেই যখন তারা বিশ্ববিপ্লবের পথে অগ্রসর হয়, তখন তাদের সামনে যে জাতি পড়েছে তারাই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে উড়ে গেছে। এর কারণ আরবরা কামালিয়াত বা চরমোৎকর্ষ লাভ করেছিল, অন্যদিকে প্রতিপক্ষ জাতি ছিল দোষ-ত্রুটি সম্পন্ন। দোষ-ত্রুটি সম্পন্ন কোনো কিছু কি পূর্ণতাপ্রাপ্ত জিনিসের মোকাবেলা করতে সক্ষম?

তিন. যেহেতু আরবের বিপ্লবের সামগ্রিক বিশেষত্ব ছিল রব্বানিয়াত, যা কেবল রবুবিইয়াত প্রতিষ্ঠা করে, রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে না, এ কারণে আরবের বিপ্লব রাজতন্ত্রকে কবর দিতে থাকে, আর বিপরীতে প্রতিষ্ঠা করতে থাকে রবুবিইয়াত। এই বিপ্লব যখন সম্পূর্ণ হয়, বিশ্ববাসী দেখল এক আশ্চর্য ঘটনা—আরবে রাজতন্ত্র নাই। নাই তো নাই-ই, যেন কোনোকালেই ছিল না। আর তার স্থলে ছেয়ে আছে রবুবিইয়াত—মেঘমুক্ত আকাশে জ্বলজ্বল করা সূর্যের মতোই।

চার. আরবের রব্বানি বিপ্লব রব্বানিয়াতের বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে কেবল বিশ্বের প্রথম বিপ্লবই নয়, আজ পর্যন্ত এটাই শেষ বিপ্লব। কারণ, আরবের রব্বানি বিপ্লবের পর দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত আর কোনো রব্বানি বিপ্লব দেখা যায় নাই। এর পর যত বিপ্লব এসেছে সবই এসেছে নফসানিইয়াতের পূজা করতে এবং সেই পূজাতেই তারা নিমজ্জিত হয়ে রয়ে গেছে। তবে রুশ বিপ্লব ও তুর্কি বিপ্লবকে নফসানিইয়াত থেকে আলাদা করা যায়, কারণ এই দুই বিপ্লবের উদ্দেশ্য ‘খালিস নফসানি’ বলতে যা বোঝায় তা না, বরং স্বাধীনতা। আর স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা শর্তসাপেক্ষে হালাল, হারাম নয়। এই দুই বিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিল রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ এবং রবুবিইয়াতের পত্তন। কিন্তু তাদের বিপ্লবে রুহানিয়াত ছিল না। উল্টো রুহানিয়াত থেকে এতটাই দূরে ছিল যে জড়বাদ ও নৈরাজ্যবাদ অতিক্রম করে শয়তানিয়াতের দিকে চলে গেছিল। এ কারণে এই দুই বিপ্লবকে বলতে হয় অর্ধ-রব্বানিয়াত। অর্থাৎ এর মধ্যে রব্বানি বিপ্লবের জাগতিক উপাদান ছিল। বটে, কিন্তু পরিপূর্ণ রব্বানিয়াতের ছায়া ছিল না। কারণ এই দুই বিপ্লব রুহানি রব্বানিয়াতের ভিত্তিতে দাঁড়ায়নি। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য, কেবল ফিদায়ত বা ত্যাগই রুহানিয়াতের সিরাপ তৈরি করে দেয় না; ত্যাগ যেমন রুহানিয়াতের একটি ক্রিয়া, তেমনই তা জড়বাদেরও একটি ক্রিয়া। ত্যাগ রুহানিয়াতের সিরাপ প্রস্তুত করে আরেকটি সিরাপ প্রস্তুতকারক শক্তির সাথে মিলে। সেই সিরাপ প্রস্তুতকারক শক্তি হলো লিল্লাহিইয়াত অর্থাৎ আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজেকে নিবেদিত করার মনোভাব। সুতরাং যেখানে ‘লিল্লাহিইয়াত’ নাই সেখানে ত্যাগ থাকলেও তাতে রব্বানিয়াতের ছায়া পর্যন্ত নাই।

পাঁচ. আগেই বলা হয়েছে আরবের রব্বানি বিপ্লব কোনো বিচ্ছিন্ন বিপ্লব নয়, বরং তা ছিল বিশ্ব-রব্বানি বিপ্লবের প্রথম ধাপ। এ কারণে আরবের রব্বানি বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গেই বিপ্লবের উদ্দেশ্য-পরম্পরা ছিন্ন হয় নাই; বরং তা যুক্ত হয়েছে ও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পরেই ‘আজমি বিপ্লবের’ সিলসিলা কায়েম হয়, অর্থাৎ আরব বাদে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে একের এক বিপ্লব হতে থাকে। এর মধ্যে তিনটি বিপ্লব খুব কাছাকাছি সময়ে ঘটে—সিরীয় বিপ্লব, মিশরীয় বিপ্লব এবং পারসিক বিপ্লব। ভারতেও কাছাকাছি সময়ে বিপ্লব শুরু হয়, কিন্তু বিপ্লবের পূর্ণতা পেতে অনেক সময় লেগে যায়। ততদিনে বিপ্লবীদের রব্বানিয়াতে ‘খাদ’ ঢুকে পড়েছিল, তা আর খালিস বা খাঁটি থাকতে পারে নাই। তাতে প্রবেশ করেছিল নফসানিয়াতের পংকিলতা। কারণ, এ বিপ্লব এমনসব লোকের হাতে রূপ পেয়েছিল যারা বিশ্ব-বিপ্লবের মর্ম যথাযথভাবে বুঝেনি, তাদের মনোযোগ সেদিকে ছিলও না। এর কারণ বলা যায় বিপ্লবীদের ‘আরব’ না হওয়া, এমনকি তারা আল্লাহর রসুলের ‘হাতে গড়া’ সাহাবা ছিল না, বরং ছিল সাহাবাদের সাহাবা। এই জন্য তাদের উদ্দেশ্য নেক হওয়া সত্ত্বেও ‘রব্বানিয়াত’ থেকে খালি ছিল।

ছয়. আরবের বিপ্লব এবং তারপর একের পর এক যে বিপ্লব হয়, সেই সিলসিলা আজ অবধি জারি আছে। যতদিন না পুরো পৃথিবী এই বিপ্লবের স্বাদ গ্রহণ করবে, ততদিন পর্যন্ত বিপ্লব জারি থাকবে। তাই আজতক যত বিপ্লব এ বিশ্ব-মায়ের রেহেম হতে ভূমিষ্ঠ হয়েছে সবই আরবি বিপ্লবের সন্তান, চাই এই সন্তান দেখতে যেমনই হোক। এসব বিপ্লবে হয়তো আরবি বিপ্লবের রুহ ছিল না, কিন্তু রক্ত-মাংস অবশ্যই ছিল। আর রুহ ছিল না এ কথাই-বা কীভাবে বলা যায়, কিছু না কিছু ছিলই। তাই এসব বিপ্লব পুরোপুরি রব্বানি না হলেও তাতে বহু মূল্যবান উপাদান আছে, যা বিশ্ব-রব্বানি বিপ্লবের জন্য ক্ষেত্র তৈয়ার করেছে। আর বিশ্ব-রব্বানি বিপ্লব আরবের রব্বানি বিপ্লবেরই পরবর্তী ধাপ।

সাত. আরবের বিপ্লবেরই একমাত্র এই অধিকার রয়েছে, এবং এটা তার জন্য জরুরিও বটে—সে অঞ্চলগত সমস্ত বিপ্লবের পথপ্রদর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করবে, যেন প্রতিটি বিপ্লবে রব্বানি বিপ্লবে পরিণত হয়, এবং নফসানি বিপ্লব না হয়।

 

পঞ্চম অধ্যায়


আরবের রব্বানি বিপ্লবের গঠন-কৌশল

তৎকালীন আরব ও সমগ্র পৃথিবী যেসব বিষয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল এবং ভবিষ্যতের পৃথিবী যেসব বিষয়ের সম্মুখীন হতে পারে—আরবের রব্বানি বিপ্লবের ভিত্তি সেই সব জরুরি বিষয়ের ওপরই স্থাপিত হয়েছিল। সুতরাং, আরবি বিপ্লবের গঠন কৌশল বুঝবার জন্য সেই প্রয়োজনীয় বিষয়গুলিও উপলব্ধি করা দরকার। সেই জরুরি বিষয়গুলি কী? নিম্নে সেসব বিষয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচতি দেওয়া হচ্ছে :

ক. হীনতাবোধ ও সংকীর্ণ ধারণা বিলুপ্তির যেমন প্রয়োজন ছিল তেমনই প্রয়োজন ছিল উচ্চ মর্যাদাবোধ ও উচ্চ ধারণা সৃষ্টির। অন্য কথায় কুসংস্কার উচ্ছেদ করার যেমন প্রয়োজন ছিল, তেমনই প্রয়োজন ছিল যুক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার। তবে নফসানি যুক্তির নয়, কারণ তা অপূর্ণ এবং বিভ্রান্তিকরও হয়ে থাকে। নফসানি যুক্তি কুসংস্কারেরই উপরিভাগ (surface); তা পরমার্থ হতে মানুষকে দূরে তো রাখেই, এমনকি অনেক সময় পরমার্থের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যায়। তাই, রব্বানি যুক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠারই প্রয়োজন ছিল—যা অন্ধ কুসংস্কার থেকে অনেক দূরের জিনিস, এবং যা মানুষকে পরমার্থের দিকে নিয়ে যায়, এমনকি অনেক সময় পরমার্থের কোলেও পৌঁছিয়ে দেয়।

এই প্রয়োজনের প্রথম প্রয়োগস্থল ও এর অগ্রাধিকার দানের মৌলিক স্থল ছিল ধর্ম। ধর্মই মানুষের ওপর মৌলিক প্রভাব বিস্তারকারী ধারণা ও ব্যবস্থা। ধর্মের প্রভাব থেকে এখনও মানুষের মস্তিষ্ক স্বাধীন নয়, ভবিষ্যতেও স্বাধীন হওয়ার কারণ নেই। এ দিক দিয়ে বিচার করলে, অন্ধ-ধারণার নাম শিরক এবং যুক্তিমূলক ধারণার নামই হলো তওহিদ। আরবি রব্বানি বিপ্লবের সময় গোটা বিশ্ব শিরকে নিমজ্জিত ছিল। আজও শিরক যথেষ্ট পরিমাণেই বিদ্যমান রয়েছে। তার কারণ আজ পর্যন্ত আরবি বিপ্লব বিশ্ববিপ্লবে পরিণত হতে পারে নাই। মানুষ যখন এমন কোনো শক্তির পূজা শুরু করে দেয় যা অংশত তার চাইতে বড়, কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় তার সমান অথবা তার চাইতে ছোট, তখন তকে ‘শিরক’ বলে। আর তওহিদের অর্থ মানুষ কেবল সেই শক্তিরই আরাধনা করবে এবং তারই কাছে প্রার্থনা করবে যে-শক্তি অংশত এবং সামগ্রিক—সবদিক দিয়েই মানুষের চাইতে এবং গোটা জগতের চাইতে বড়। শিরকের ক্ষতির কোনো সীমা নাই, তওহিদের উপকারের কোনো সীমা নাই। শিরকের মূল ক্ষতি হলো বাসনার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকা। এটা মানুষের গোটা জীবনকেই খেয়ালখুশি-সর্বস্ব করে ফেলে, ফলে মানুষ পরিণত হয় পশুতে। তওহিদের মৌলিক ফায়দা হলো ধারণার অন্ধকূপ হতে মুক্তি এবং যুক্তিবৃত্তির স্বাধীনতায় ঐশ্বর্য-মণ্ডিত হওয়া। এটাই মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হিসাবে রক্ষা করে এবং মানুষকে এতখানি মহিমান্বিত করে তোলে যে গোটা জগৎও তার নিকট তুচ্ছ হয়ে যায়।

সুতরাং, ধর্মীয় ধ্যান-ধারণায় বিপ্লব-সৃষ্টিই ছিল প্রথম আবশ্যকীয় কর্তব্য, ধর্মকে এমন পবিত্র করা প্রয়োজন ছিল যে তাতে যেন ‘শিরকের’ গন্ধও না থাকে—এমন তওহিদময় করে তোলা যে তার সুগন্ধিতে যেন সর্বদিক বিমোহিত হয়, সর্বদা ‘শিরক’ হতে মানুষকে যেন তা দূরে রাখে এবং তওহিদের প্রতি সর্বদাই যেন আকর্ষণ করে।

উপর্যুক্ত প্রয়োজনের দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল দর্শনের প্রতি মনোযোগ দান করা। ধর্মের পরেই দর্শন মানুষের জীবনে অধিক প্রভাবশালী ধারণা ও ব্যবস্থা। দর্শনও অবাস্তব কল্পনার শিকারে পরিণত এবং বুদ্ধিবৃত্তির সাথে সম্পর্ক-রহিত হয়ে পড়তে পারে। এমন কতক দার্শনিকও আছেন যারা কল্পনাকেই শক্তিশালী করে বুদ্ধিবৃত্তিকে প্রাণহীন করে ফেলেছেন। মুদ্রিক জাতিসমূহের গ্রন্থাদি পাঠ করলেই এর সত্যতা উপলব্ধি করা যায়—সেখানেও দর্শন আছে, কিন্তু এমন দর্শন, যা ‘শিরক’-এর যুক্তিসিদ্ধতা প্রমাণের ওপরই গুরুত্ব দান করে। এটা যেন রাত্রিকে দিবসে পরিণত করার চেষ্টা আর কি! তাদের দর্শন দেখলে শুধু এটাই প্রতীয়মান হয়—হয় তাদের দার্শনিকগণ মুশরিক, নয়তো তারা স্বজাতির কুসংস্কারের শিকারে পরিণত হয়েছেন। নিজেদের মুশরিক জাতিসমূহকে তওহিদপন্থী জাতিসমূহের মোকাবেলায় হেয় হতে না দেওয়াই তাদের একমাত্র অভিসন্ধি। এইভাবে তাদের দর্শন আর দর্শন থাকে না।

সুতরাং, দর্শনকেও অবাস্তব কল্পনার নিশ্ছিদ্র অন্ধকার হতে যুক্তিবৃত্তির উজ্জ্বল আলোকে আনা ছিল দ্বিতীয় প্রয়োজনীয় কর্তব্য।

উপর্যুক্ত কর্তব্যের তৃতীয় পর্যায় ছিল তহজিব ও তমদ্দুনের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করা। ধর্ম ও দর্শনের পর মানুষের ওপর গভীর ও ব্যাপক প্রভাবশালী অবস্থা ও ব্যবস্থা হলো তহজিব ও তমদ্দুন এবং তার রীতি-নীতি। আর এটা এমনই ভয়াবহ জিনিস যে অনেক সময় ধর্ম ও দর্শনকেও কার্যক্ষেত্র থেকে দূরে ঠেলে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ ধর্ম ও দর্শনকে শিকড়ে তুলে তহজিব-তমদ্দুনের ব্যাপারে এমনভাবে জড়িত হয়ে পড়ে যে, যেন এটাই সব কিছু, আর, ধর্ম ও দর্শন যেন নীরব দর্শক ছাড়া কিছুই নয়।

তমদ্দুন-তহজিব এবং তার নীতি ও বিধিব্যবস্থাকে যে-বিষয়টি ভ্রষ্ট করে দেয়, তা হলো কাহিনি ও রীতি। সুতরাং, তৃতীয় প্রয়োজনীয় কর্তব্য হলো তমদ্দুন ও তহজিবকে কল্পনার গোলকধাঁধা থেকে বের করে যুক্তিবৃত্তির প্রশস্ত অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করা। এই কর্তব্য পালনের জন্য কবিত্বে, কাহিনি-রচনায় ও সাহিত্যশৈলীতে যুক্তির প্রয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু এটা ভুললে চলবে না যে কল্পনার উৎস ও যুক্তির হন্তা এ সব কারণকে অধিকতর দুষ্ট করে ফেলার ব্যাপারে আরও একটি জিনিসের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। বলতে গেলে, ওটাই বিকৃতির মূল হিসাবে পরিগণিত। সেই জিনিসটি কী? তা হলো নফসানিয়াত—যা ধনতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের মূল হতে অঙ্কুরিত হয়ে জীবিকার অসাম্য এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা রূপে প্রকাশিত হয়। এর বিষ ঝড়োগতিতে সমগ্র জাতিতে সংক্রমিত হওয়ার ক্ষমতা রাখে; ফলে সেই জাতি বুদ্ধিবৃত্তি খুইয়ে বসে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে এই বিষের একটি মাত্র প্রতিষেধকই রয়েছে—তা হলো রব্বানিয়াত, রবুবিয়াতের সুধায় যা প্রস্তুত হয়।

সুতরাং, কল্পনা-প্রবণতার উচ্ছেদ এবং বুদ্ধিবৃত্তিতে প্রাণসঞ্চারের জন্য ধর্ম, দর্শন, তমদ্দুন-তহজিব, রীতি-নীতি, কবিত্ব ও কাহিনিতে বুদ্ধি-সচেতনতা আনয়ন এবং কল্পনাশ্রিত অতিরঞ্জন দূরীকরণ যেমন কর্তব্য, তেমনই প্রয়োজন ধনতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ, রবুবিয়াতের পত্তন, নফসানিয়াতের বিলোপ এবং রব্বানিয়াতের প্রতিষ্ঠা—যাতে জীবিকার অসাম্য এবং সামাজিক অবনতি দূর হয়ে যায়।

খ. বুদ্ধিবৃত্তির নিষ্ক্রিয়তা ও বন্ধ্যাত্ব দূর করা এবং একই সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও তাতে চিন্তাশক্তি যোগ করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এই চর্চা ‘রব্বানি’ হতে হবে, ‘নফসানি’ হলে হবে না, এবং চিন্তাটাও ‘রব্বানি’ হতে হবে, ‘নফসানি’ না। ওপরের বর্ণিত ক্ষেত্রগুলিই অর্থাৎ ধর্ম, দর্শন, তমদ্দুন-তহজিবই হচ্ছে এই প্রয়োজনের প্রয়োগস্থল। এসব ক্ষেত্রে, ‘তকলিদ’ বা অন্ধ অনুসরণের ফল জড়ত্ব ও সংকীর্ণতা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। অন্যদিকে চিন্তার প্রবহমানতা এসবের সূক্ষ্মতা ও প্রগতি-মুখাপেক্ষী দিকগুলিকে স্পষ্ট করে তুলে ধরে অথবা এসবের মাঝে সঙ্গত সংস্কার শুরু করে। এই পদ্ধতিতেই এসবের মাঝে সব সময় প্রাণময়তা বিদ্যমান থাকে। ফলে এসবের অনুসরণ প্রগতি ও স্বাচ্ছন্দ্যের কারণ হয়। তবে রব্বানিয়াত ছাড়া রব্বানি চিন্তাই-বা আসবে কোথা হতে?

গ. মানসিক নৈরাজ্য দূরীকরণ এবং তার জায়গায় ভারসাম্য আনা প্রয়োজন ছিল। মন যখন কেন্দ্রীয়-সত্তা ও জীবনের সাথে সম্পর্কহীন হয়ে পড়ে তখন ওটাই নৈরাজ্য; আর কেন্দ্রীয় সত্তা ও জীবনের সাথে যখন মন সম্পর্কযুক্ত থাকে তাকেই বলে ভারসাম্য। সুতরাং যখন ভারসাম্য থাকবে না তখন ধর্ম ও দর্শনেও ঈমান থাকবে না, আর তমদ্দুন-তহজিবেও প্রাণ থাকবে না। এই ভারসাম্যও রব্বানিয়াত ছাড়া অসম্ভব।

ঘ. ‘নফসানি নফসিয়াত’ দূর করে তার জায়গায় ‘রব্বানি নফসিয়াত’ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন ছিল। রবুবিয়াতের কর্তব্যপালন ছাড়া নফসের আকাঙ্ক্ষা পূরণকেই বলা হয় নফসানি নফসিয়াত। আর রবুবিয়াতের কর্তব্যের সাথে নফসের আকাঙ্ক্ষা পূরণকে বলা হয় রব্বানি নফসিয়াত।

নফসানি নফসিয়াতের কারণেই ধর্মচর্চা ‘অকেজো’ হয়ে পড়ে, দর্শন তুচ্ছ হয়ে যায়, তমদ্দুন বিরান হয় এবং তহজিব শয়তানি আচরণে পরিণত হয়। অথচ রব্বানিয়াত ছাড়া রব্বানি নফসিয়াতের কথা চিন্তা করা কল্পনাবিলাস মাত্র।

ঙ. প্রয়োজন ছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের খর্বীকরণের এবং সমাজভিত্তিক পদ্ধতির সম্প্রসারণের; তবে নফসানি সামাজিক পদ্ধতির নয়, কারণ, এটা তো ব্যষ্টিকে পিষে মারে। অথচ ব্যাষ্টিরও জীবিত থাকার অধিকার রয়েছে। যদি ব্যষ্টিরই কোনো অধিকার না থাকে তা হলে কারও কোনো অধিকার নাই। কারণ, ব্যষ্টিই তো উৎস, প্রকৃত এবং চিরন্তন। সমাজগত ব্যাপারটি তো কেবল কৃত্রিম, আপেক্ষিক এবং অস্থায়ী। কিছু সংখ্যক ব্যষ্টির সম্পর্কযুক্ত হওয়ার ফলেই তো সমাজ দৃশ্যমান হয়। সুতরাং, যেখানে ব্যষ্টির অস্তিত্বই নাই সেখানে সমাজ আসবে কোথা থেকে? আর কেনই-বা আসবে? অবশ্য সমাজেরও গুরুত্ব রয়েছে। কারণ সমাজ না হলে সহযোগিতা কোথায়? সহযোগিতা নাই, তো উন্নতি কোথায় এবং জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আসবে কীভাবে? এ জন্যই রব্বানি সমাজব্যবস্থার প্রয়োজন, যা ব্যষ্টিকে পিষে মারে না, বরং পালন করে।

সমাজহীন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ধর্ম ও দর্শনকে বর্বরতার শিক্ষায় পরিণত করে, আর তমদ্দুন ও তহজিবকে পরিণত করে বর্বরতার প্রদর্শনীতে। অন্যদিকে ‘নফসানি ইতিমাইয়াত’ অর্থাৎ ব্যক্তিসত্তাহীন সমাজ মানুষকে প্রাণহীন মেশিনে রূপান্তরিত করে, জীবনকেই রূপান্তরিত করে মৃত্যুতে। সুতরাং এমন আপেক্ষিক অথবা কৃত্রিম জীবন ব্যবস্থা কি কোনো কাজের যা প্রকৃত জীবনকেই মৃত্যুতে পরিণত করে?

এটাও অতি স্পষ্ট কথা যে রব্বানিয়াত ছাড়া রব্বানি সমাজ গঠন কিছুতেই সম্ভব নয়।

চ. প্রয়োজন ছিল পরাধীনতার জিল্লতি দূরীকরণের এবং স্বাধীনতার মহান নেয়ামত অর্জনের; কিন্তু ‘রব্বানি স্বাধীনতা’ অর্জন করতে হবে, ‘নফসানি স্বাধীনতা’ নয়। অধীনতা মানুষকে জিল্লতিতে নিমজ্জিত রাখে, স্বাধীনতা মানুষকে সম্মানের শীর্ষদেশে উপনীত করে। তা ছাড়া, অধীনতা জীবিকা ও সমাজিক জীবনকে সংকীর্ণ করে তোলে। অধীনতা ধর্ম, দর্শন ও তমদ্দুন-তাহজিবকে বক্র ও বিকৃত করে দেয়, স্বাধীনতা এই গুলিকে সঠিক ও যথাযথ রাখে। কিন্তু ‘নফসানি স্বাধীনতা’ স্বাধীনতা-পরাধীনতা দুটোকেই ধ্বংসের দ্বারে পৌঁছে দেয়, তখন স্বাধীনতা উল্টো আজাদিপ্রাপ্ত জাতিকে গোলামি করা শেখায়, এবং সাম্রাজ্যবাদী জাতি তাদের যেভাবে গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে নফসানিয়াতের চর্চা করত—স্বাধীনরাও ঠিক তা-ই করে।

রব্বানি স্বাধীনতা রাষ্ট্র ও সমাজকে এই সকল দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত রাখে এবং শাসনবাদের স্থলে রবুবিয়াতের দিকে নিয়ে যায়। রবুবিয়াত ছাড়া রব্বানি স্বাধীনতাও ‘স্বপ্ন নাই, স্বপ্নের ব্যাখ্যা’-র মতোই অবাস্তব ব্যাপার।

ছ. তারপর প্রয়োজন ছিল জাতিকে তালিম (শিক্ষাদান) করা। কিন্তু কোন শিক্ষা? রব্বানি তালিম। জাতির দারিদ্র্য নির্মূল করতে হবে; তবে নফসানি পদ্ধতিতে নয়, রব্বানি পদ্ধতিতে। জাতির সামাজিক জীবনও সঠিক করে তোলা দরকার—অর্থাৎ নফসানি সমাজকে রব্বানি সমাজে রূপান্তরিত করা প্রয়োজন।

কর্মনীতি

এক. সর্বপ্রথম একটি ‘রব্বানি সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে : রব্বানি আন্দোলনের মাধ্যমে তার পৃষ্ঠপোষকতা দান করতে হবে, যাতে রব্বানি সংঘে পরম্পরা এবং নিয়মানুবর্তিতা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

দুই. তারপর বিশেষ-শ্রেণির মধ্যে রব্বানি আহ্বান জারি করতে হবে এবং আহ্বানের রব্বানি মাধ্যমে রব্বানিয়াতের প্রতি আহ্বান জানাতে হবে। এই আহ্বানের সর্ব প্রথম দফা হবে আল্লাহর প্রতি আহ্বান। সে আহ্বানও হবে তওহিদি জাঁকজমকের সাথে, শিরকি আলোকে নয়; কিংবা অপর কেউ আল্লাহকে জানেন, আল্লাহর কথা উল্লেখ করেছেন—এই বর্ণনা বা বিবৃতির যুক্তিতে নয়; বরং এই দাবির সাথে আহ্বান জানাতে হবে যে আহ্বানের নেতা স্বয়ং আল্লাহ কে জানেন, আল্লাহ সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারেন, আল্লাহর সাথে মিলিত হয়েছেন এবং আল্লাহর সাথে মিলাতেও পারেন। তারপর সাধারণকে আল্লাহর প্রতি আহ্বান জানতে হবে।

তিন. তারপর ধর্মকে নতুনত্বের দীপ্তিতে পেশ করতে হবে—শরিয়তি মর্যাদায় সম্ভব না হলেও অন্তত পুনরুজ্জীবনত্বের মর্যাদায়। এই দাবির সাথে তা পেশ করতে হবে যে, আহ্বানের নেতা স্বয়ং ধর্মের বাহক—তিনি কেবল ধর্মের অনুলিপিকারক নন। তারপর মানুষকে এই বলে ধর্মের আহ্বান জানাতে হবে যে ধর্মই সকল রোগের ঔষধ, ধর্মই সকল প্রয়োজন মিটাতে সক্ষম!

চার. তারপর ধর্মের জীবিকা ও এবাদত-সংশ্লিষ্ট অংশের প্রতি আহ্বান জানাতে হবে এই বলে যে এই অংশ অন্য অংশের ভিত্তি ও মূল। এরপর অপর অংশগুলিও আসবে। ব্যক্তিগতভাবে কার্যকরীকরণের মাধ্যমে এই আহ্বানকে শক্তিশালীও করতে হবে। জীবিকার সাহায্য দান করতে হবে। নিজেও এবাদত করতে হবে এবং এতখানি করতে হবে যেন সর্বসাধারণ তাতে প্রভাবিত হয় এবং তাদের মধ্যে এবাদতের প্রেরণা সৃষ্টি হয়।

পাঁচ. তারপর ধর্মের রব্বানি : চারিত্রিক অংশ সন্মুখে আনয়ন করতে হবে এবং তার মাধ্যমে কর্মসমূহের শুদ্ধি বিধান করতে হবে। এই চারিত্রিক অংশের জন্যও উৎকৃষ্টতর দৃষ্টান্ত স্থাপন প্রয়োজনীয়। নেতা স্বয়ং, তার সাহাবি (সঙ্গী) এবং নেতার পক্ষে আহ্বায়কগণ—সকলের ব্যক্তিগত আমলের মাধ্যমেই তা সৃষ্টি হওয়া সম্ভব।

ছয়. তারপর ধর্মের সমষ্টিমূলক রব্বানি দিকটিকে তুলে ধরতে হবে। এই ক্ষণে সমগ্র জাতিকেই সমষ্টিগত পদ্ধতির প্রতি আহ্বান জানানো উচিত হবে। তাদেরকে সংঘবদ্ধতায় দীক্ষিত হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে।

সাত. তারপর হাতে নিতে হবে রব্বানি ‘সিয়াসত’ বা রাজনীতির ‘বরবত’। এবং ধর্মের রাজনৈতিক বিভাগের অধীনে তাতে রাজনৈতিক তান তুলতে হবে। সর্বপ্রথম ঘোষণা করতে হবে : হে জাতি, তোমরা রব্বানি জাতি, নফসানি জাতি হতে তোমরা উচ্চ-মর্যাদাসম্পন্ন। উচ্চ বংশোদ্ভূত বলে তোমাদের এই মর্যাদা নয়, বরং এই জন্য যে তোমরা রব্বানি এবং রব্বানিয়াতের নিশানবরদার! ওঠো, সকল নফসানি জাতিকে রব্বানি আহ্বান পৌঁছিয়ে দাও। এমনকি সেইসব জাতির কাছেও যাও যারা নফসানিয়াতের মাধ্যমে তোমাদেরকে দাস বা অধীন করে রেখেছে। যাও, বলো যে তোমরা আমাদের রব্বানি আমন্ত্রণ কবুল করো। যদি তোমরা কবুল করো, তা হলে আমাদের সাথে তোমাদের সম্পর্ক হবে ভাই-ভাইয়ের সম্পর্ক। কিন্তু যদি প্রত্যাখ্যান করো, তা হলে তোমাদের ভবিষ্যৎ তোমাদেরই হাতে; তবে তোমাদের নফসানিয়াতের একচ্ছত্র শাসন বাতিল করে স্বাধীন হওয়ার অধিকারটুকু অবশ্যই আমাদের রয়েছে। তা ছাড়া আমাদের এ অধিকারও রয়েছে যে তোমরা প্রত্যাখ্যান করা সত্ত্বেও আমরা তোমাদের নিকট রব্বানি আমন্ত্রণ নিয়ে বারবার উপস্থিত হতে পারি—তার ফলাফল যা-ই হোক না কেন। উপর্যুক্ত মর্মবাণীকে বাস্তবায়িত করতে হবে—অর্থাৎ অপরাপর নফসানি জাতির নিকট আমন্ত্রণ পৌঁছাতে হবে এবং তার জন্য আহ্বানকারী পাঠাতে হবে।

আট. রব্বানি আমন্ত্রণের সাথে প্রারম্ভিক ব্যবস্থাপনাও জুড়ে দেওয়া দরকার। তা হলে এটা একদিকে যেমন রব্বানি আমন্ত্রণে শৃঙ্খলা বিধান করবে, তেমনই রব্বানি আমন্ত্রণের প্রভাবে সৃষ্ট রব্বানি জামাতগুলোকেও শাসনগত শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করতে থাকবে। এইভাবে ওতেই হুকুমতের মর্যাদা লাভ ঘটতে থাকবে। ফলে শুরুটাই হবে হুকুমতে রব্বানির ভিত্তিপ্রস্তর।

নয়. দেশে যখন আমন্ত্রণের কাজটি সাফল্যজনকভাবে সম্পন্ন হবে তখন রব্বানি ব্যবস্থাপনাতে হুকুমতের পূর্ণরূপ দান করতে হবে। তবে এই হুকুমত দেশকেন্দ্রিক হুকুমত হবে না, হবে বিশ্বকেন্দ্রিক; ওটা নফসানি হুকুমত হবে না, হবে রব্বানি হুকুমত।

 

ষষ্ঠ অধ্যায়

আরবের রব্বানি বিপ্লবে গৃহীত কর্মসূচি

কোনো সংগ্রামকে জয়যুক্ত করার জন্য ব্যাপকতর নীতির সমন্বয়ে যে খসড়া তৈরি করা হয়, তাকে বলা হয় ‘লায়েহা আমল’ বা কর্মনীতি। আর কর্মনীতিকে বাস্তবায়িত করার জন্য সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নীতির আলোকে যে খসড়া তৈরি করা হয়, তাকে বলা হয় ‘নকশায়ে তামিল’ বা প্রয়োগবিধি।

আরবি রব্বানি বিপ্লবেরও অপরাপর বিপ্লব বা সুশৃঙ্খল আদর্শিক আন্দোলনের মতোই কর্মনীতি ও প্রয়োগবিধি ছিল। দুটোই প্রস্তুত করা হয়েছে বিশ্ব-রব্বানি বিপ্লবকে সামনে রেখে। এ কারণে বিশ্বের সকল রব্বানি বিপ্লবের ক্ষেত্রেই এসবকে খুবই গুরুত্বের সামনে আনতে হবে, চিন্তা-ফিকিরের সাথে পাঠ করতে হবে। নয়তো এসব কর্মনীতি আর প্রয়োগবিধি এক সময় পুরানা দিনের কিসসা-কাহিনিতে পরিণত হবে। সেই কাহিনি রব্বানিই হোক কিংবা নফসানি—কাহিনি দিয়ে তো আর বিপ্লব হয় না।

বিপ্লবের প্রয়োগবিধি

এক. যিনি রব্বানি বিপ্লবের নেতা হতে চান তাকে সর্বপ্রথম উলুহিয়াত অনুসন্ধানে মনোনিবেশ করতে হবে। ঈপ্সিত রত্ন হাতে না আসা পর্যন্ত অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার সন্ধান লাভ না হওয়া পর্যন্ত তাকে সেই উলুহিয়াত-অনুসন্ধানে নিমগ্ন থাকতে হবে। তবে সে সন্ধান এমন নয় যা মৌলবি, ওয়ায়েজ, ধর্মীয় বক্তা ও পিরগণ লাভ করেন। এই ধরনের সন্ধান তো অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। বরং তার অনুসন্ধান হবে এমন : তিনি যেন পূর্ণ সততার সাথে আল্লাহর সত্তার ওপর দৃঢ় প্রত্যয় স্থাপন করতে পারেন, তারপর পূর্ণ সততার সাথে অপরকেও দৃঢ় প্রত্যয়ের রঙে রঙিন করতে পারেন—এজন্য পরম সত্যের সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ এবং রহস্য উন্মোচনে ক্ষমতাবান লোকেরা যেভাবে সন্ধান লাভ করেন তাকেও তেমনই সন্ধান লাভ করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই ‘হক্কুল একিন’ (পরম সত্য) সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয়ের মর্যাদা লাভে সামান্য ত্রুটিও থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার জন্যে কর্মক্ষেত্রে অবতরণ করা কিছুতেই উচিত হবে না। কারণ এই মর্যাদা হাসিলের আগ পর্যন্ত সে মিথ্যা প্রচার কিংবা প্রহসন ছাড়া কিছুই করতে পারবে না। এমন লোক দিয়ে কোনোভাবেই রব্বানি বিপ্লবের ভিত্তি স্থাপন সম্ভব না; বড়জোর তার দ্বারা নফসানি বিপ্লবের ভিত্তি স্থাপন সম্ভব —যা অদৌ উচিত নয়।

দুই. যার তুলনায় গোটা জগতের কর্তৃত্বেরও কোনো মূল্য নাই, যাকে ‘হক্কুল একিন’ পর্যায়ের ‘মারেফতে ইলাহি' বলে অভিহিত করা যায় সেই মহান রত্ন অর্জনের পর অপর যে বিষয়টি অর্জন করা দরকার, তা হলো ‘ইজনে ইলাহি’ বা আল্লাহর অনুমতি।

আল্লাহর এই অনুমতি ওহি, কাশফ, সত্য-স্বপ্ন কিংবা ইলহাম আকারেই হোক—আল্লাহর অনুমতি ছাড়া এই পথে অগ্রসর হওয়া সম্পূর্ণ অন্ধকারে পথ চলার মতোই হবে, এবং তাতে হোঁচট খাওয়ারই বব্যস্থা হবে। রবের ইচ্ছা ছাড়া যে প্রবৃত্তি-পরিচালিত ব্যক্তি এই পবিত্র সংগ্রামের দুঃসাহস করবে তার হাত ভেঙ্গে দেওয়ার এবং গর্দানের রগ কেটে দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, কারণ সে বিনা অনুমতিতে এমন বিষয়ে হাত দিয়েছে যেখানে হাত দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সুতরাং এতে কেবল তার ব্যর্থতাই আসবে না, সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর শাস্তির বোঝাও তাকে মাথায় নিতে হবে। সম্ভবত বহু ‘আরেফ’ নিজেদের দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার কারণে এই জ্বলন্ত আলোকপিণ্ডে হাত দেওয়ার ব্যাপারে সাহসী হন নাই।

তিন. সম্পূর্ণ মুক্ত এবং পূর্ণ একাগ্রতা অর্জন করে নিতে হব, অর্থাৎ উদ্দেশ্য ছাড়া সবকিছু থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে হবে এবং ঈপ্সিতে পরিপূর্ণভাবে নিমগ্ন হতে হবে। বিপ্লবের নেতার স্মরণ রাখা উচিত এবং সব সময়ের জন্যই এটা স্থির করে নেওয়া উচিত যে বিপ্লবের সম্পূর্ণ বোঝা একা তারই ওপর। এ ব্যাপারে সঙ্গী-সাথিরা যেমন গণনার মধ্যে পড়বে না, তেমনই সাধারণ শ্রেণির অনুগামীগণ থাকবে হিসাবের বাইরে। তার চেষ্টা আর আল্লাহর কবুল করা ছাড়া তৃতীয় কোনো বিষয় এখানে থাকবে না। তাই, উদ্দেশ্য ছাড়া দুনিয়ার সব জিনিশ থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র বিপ্লবেই যদি তিনি পূর্ণ মনোযোগ দিতে না পারেন, তাহলে তার জন্য বিপ্লব-সাধনের সৌভাগ্যের অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া, যখন এই বিপদে পড়ারও সম্ভাবনা আছে যে কেবল বন্ধুবান্ধবই না, নিজের ইচ্ছাও নিজেকে ছেড়ে যাবে, অন্যদিকে আল্লাহর তরফ থেকে কোনো ইশারাও আসছে না—এমন সংকট-সন্ধিক্ষণে নিজেকে দৃঢ় রাখবে কীভাবে? উপর্যুক্ত পূর্ণ মুক্তি এবং পূর্ণ একাগ্রতাই তা পারে। তাই যে ব্যক্তি সর্পিল ও সংকটপূর্ণ পথ পাড়ি দেওয়ার হিম্মত না রাখে, তার জন্য রব্বানি বিপ্লবের অজগর নিয়ে খেলা করা মোটেই উচিত নয়।

চার. বিপ্লবের নেতাকে বিপ্লবের সূচনার জন্য একটি সাজানো-গোছানো দিন নির্ধারিত করতে হবে; এমনভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে যেন যুদ্ধের ময়দানে যাচ্ছেন, এবং বিজয় মুকুট ছাড়া জীবিত ফিরে আসার কোনো সুযোগ নাই। তখন তার সামনে কেবল দু্টো পথ খোলা থাকবে—হয় জয় নাহয় মৃত্যু। তৃতীয় কোনো পথ নেই। এই দিনটি যেন বিপ্লবের নেতার জন্যও ‘বিপ্লব দিবস’-এ পরিগণিত হয়। কারণ এ দিনেই তিনি নিজের মধ্যে যেমন বিপ্লব আনছেন, তেমনই অপরের মধ্যেও বিপ্লব আনয়নের জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। তবে, সেই দিবসটির নাম ‘বিপ্লব সূচনা দিবস’ হওয়াই সঙ্গত ৷

পাঁচ. ‘বিপ্লব সূচনা দিবসের’ শুরুটা এমন পরিকল্পিত ও সাজানো-গোছানো হতে হবে—যেন এই একদিনেই সারাদেশ, অন্ততপক্ষে কেন্দ্রীয় অঞ্চল চমকে উঠে; এবং বিপ্লবের নেতাকে যেন ‘তুফান’ ভাবা হয়। তার খ্যাতি ও আকর্ষণ যেন এত ব্যাপক হয়—মানুষের মনে হবে ‘এই বুঝি নতুন এক নক্ষত্রের আবির্ভাব হলো’। কীভাবে এমন সাজানো-গোছানো ‘সূচনা’ করা যায়? সবদিক বিবেচনা করলে একটি পন্থাই কেবল সামনে আসে—তা হলো বিপ্লবের নেতৃত্ব দাবি এবং বিপ্লবের সংকল্প ঘোষণা। এই ঘোষণা সঙ্গীতের মতো মিষ্ট ভাষায় হবে না, ভূমিকম্পের মতো গর্জনের সাথে করতে হবে—চুল্লির মধ্যে লুকিয়ে নয়, পর্বতশীর্ষে আরোহণ করে।

ছয়. বিপ্লবের আমন্ত্রণ জারি করতে হবে পৃথক পৃথকভাবে আবার দলগতভাবেও—তবে বিপ্লবের নামে নয়, বরং বিপ্লবের কেন্দ্রীয় সমস্যার নামে। অর্থাৎ এই আমন্ত্রণ এবং প্রচার হওয়া উচিত নয় যে ‘আমি বিপ্লব করতে নেমেছি—আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দাও।’ এই ধরনের সংকীর্ণ ও ফাঁপা প্রচারণা প্রকৃতপক্ষে বিপ্লবী প্রচার এবং বিপ্লবের প্রচার হবে না। বরং একে বলা যায় আগুনে ঘি ঢালা বা আগুন ছড়ানো। এর পরিণাম সকলেরই জানা আছে। এই ধরনের কাজ করে কখনও ভালো ফল পাওয়া যায় না। আসল কথা হলো শ্লোগান বাগিয়ে বিপ্লব করা যায় না। বিপ্লবের প্রাণ হলো তার কাজ। কাজই এর মূল, সবকিছুই হবে কাজ কেন্দ্র করে। আর এটাও মনে রাখতে হবে—সরাসরি না করে ইশার-ইঙ্গিতে প্রচার করলে সেটা বেশি প্রভাব সৃষ্টি করে। যদিও ইশারা-ইঙ্গিত অস্পষ্টতা দোষে দূষণীয়। কিন্তু সুষ্ঠু কর্ম ও স্পষ্ট কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে সেই অস্পষ্টতা দূর করাও সম্ভব।

সাত. পৃথক পৃথকভাবে প্রচারের জন্য প্রথমত সেই সব রব্বানি ফিতরত-সম্পন্ন ব্যক্তিকে নির্বাচন করতে হবে—যাদের মধ্যে প্রকৃতিগত বিপ্লবী ক্ষমতা অথবা দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে। প্রচারকের মধ্যে ‘জিন্দা’ স্বভাব থাকতে হবে, ‘মুর্দা’ স্বভাব থাকলে হবে না।

আট. উপর্যুক্ত বিশেষ রব্বানি ব্যক্তিদেরকে একটি দলে সংঘবদ্ধ করা দরকার। নামমাত্র ও প্রথাসর্বস্ব এমন কোনো দলে নয়—যা গঠন করতেই বেশির ভাগ শক্তি ব্যয় হয়ে যায়, আর আসল কাজের জন্য শক্তি থাকে না। বরং প্রকৃত ও কার্যকরী দল গঠন করতে হবে—যা প্রথার প্রতি সামান্যই আনুগত্যশীল হবে, কিন্তু কাজ করবে বেশি। এই সকল ব্যক্তির মধ্যে এমন পরিপূর্ণ দায়িত্ববোধ জন্মাতে হবে যেন তারা নিজেদেরকেই নেতার সমান দায়িত্বশীল বলে বিবেচনা করে, এবং সেই অনুযায়ী কার্য পরিচালনা করে। বিপ্লবের আহ্বান-কার্যটি তাদেরই দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ে তার ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। অন্যদিকে তাদের তালিম (শিক্ষা-দীক্ষা) ও ট্রেনিং (তরবিয়ত বা সকল দিক হতে গড়ে তোলার কাজ) অব্যাহত রাখতে হবে—যেন ধীরে ধীরে তাদের যোগ্যতা বাড়তেই থাকে। এবং তাদের কাজ জাগতিক ও আধ্যাত্মিক—দুই দিক দিয়েই উন্নত হতে থাকে।

নয়. নেতার নিজস্ব বিপ্লবী আহ্বান-কার্য সঙ্গীদের আহ্বান-কার্য আলাদা পৃথকভাবে অব্যাহত থাকবে। তাহলে একদিকে যেমন মৌলিক শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই কার্যটি গুণগতভাবে অগ্রসর হবে, তেমনই ফলিত শক্তির সঙ্গে সঙ্গেই সংখ্যাগত দিক দিয়েও তা অগ্রসর হতে থাকবে।

দশ. কর্মের মৌলিক ক্ষেত্রে নেতার পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকা আবশ্যক—যদিও তা ‘শুরায়ি হাকিমান’ অর্থাৎ পরামর্শ-মূলক কর্তৃত্ব হবে, একচ্ছত্র কর্তৃত্ব নয়। তবে এই পরামর্শ-মূলক কর্তৃত্বও থাকবে শাখা-প্রশাখার ক্ষেত্রে—মূলনীতির ব্যাপারে একচ্ছত্র কর্তৃত্বই থাকবে। সুযোগ-সুবিধা মতো এই ক্ষমতার বলিষ্ঠ প্রকাশও ঘটতে থাকবে। মনে রাখতে হবে, এই ক্ষমতাই সংস্থার মূল শৃঙ্খলা বিধানকারী বস্তু। এটাই সংস্থাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখবে এবং এটাই জনতাকে সংস্থায় রূপান্তরিত করতে সক্ষম। সেই সঙ্গে সব সময় ব্যক্তির আস্থাশীলতা ও নেতার প্রতি তাদের আনুগত্য পর্যবেক্ষণাধীন রাখতে হবে। এই আস্থাশীলতাকে কখনও মন্দীভূত হতে দেওয়া চলবে না। এই জন্য কখনো কখনো নেতাকে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনও করতে হবে। এ প্রদর্শন হবে যা একই সাথে কল্যাণকর ও চমকপ্রদ। প্রদর্শনের অর্থ কেবল ‘কারামত’ টাইপের প্রদর্শনই নয়, বরং বুদ্ধিবৃত্তিক ও চরিত্রগত পূর্ণতাও এর অন্তর্ভুক্ত।

বিশেষভাবে স্মরণ রাখতে হবে, ওপরে বর্ণিত পদ্ধতিগুলো যদি যথাযথভাবে অনুসৃত না হয়, তাহলে বিধিব্যবস্থা যত শৃঙ্খলাবদ্ধই হোক না কেন, তা কয়েকটা নামসর্বস্ব নিয়মের বেশি কিছু গণ্য হবে না। প্রকৃত সংগঠনী শক্তি হচ্ছে এক মহান ব্যক্তিত্ব এবং তার মহত্তের ভিত্তি হলো উপর্যুক্ত উচ্চ পর্যায়ের প্রদর্শনক্রিয়া। এটা না থাকলে সংগঠন প্রহসন ছাড়া আর কিছুই হতে পারবে না।

এগারো. কর্মের মৌলিক ক্ষেত্র ছাড়া জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে নেতা হবেন সাধারণ মানুষের মতোই। এমনকি তার এই মনোভাব রাখতে হবে—আমি জনতার খাদেম মাত্র। যেন এক ক্ষেত্রের তিক্ততা অন্য ক্ষেত্রে ক্ষমতা ও সেবায় মধুময় হয়ে ওঠে। অন্যথায় স্থায়ী তিক্ততা ক্রমশ সংস্থাকে দুর্বল করে ফেলবে, আর এভাবে তা একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্থাকে ভেতর ও বাহির—দু দিক দিয়েই ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। শুধু সংস্থাকেই নয়, সবকিছুর মূলে যে জিনিশ—অর্থাৎ রব্বানিয়াতকেও তা গ্রাস করতে পারে।

বারো. সংস্থার সকলের অন্তরে এই কথাটি বদ্ধমূল করে দিতে হবে যে সংস্থার প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে দাওয়াত—কেবল মানুষকে আহ্বান করা। সুতরাং সংস্থার প্রতিটি ব্যক্তিকে দাওয়াতি কাজে নিয়োজিত হতে হবে। তা ছাড়া বিপ্লবের ডাক নিরবচ্ছিন্ন ও চিরন্তন; সে ডাক কখনও ব্যাহত হবে না—কখনও থামবে না। তবে এই কাজের জন্য উন্নত পর্যায়ের ব্যক্তিগত সাধনারও প্রয়োজন। এ কারণে সংস্থার প্রত্যেককেই ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও ক্ষমতার বিকাশ সাধনে মন দিতে হবে। কারণ এই বিকাশ নিজেই একটি ‘উদ্দেশ্য’। সত্য বলতে এটাই প্রধান উদ্দেশ্য, কারণ দাওয়াতি কাজের মূল প্রেরণাই ব্যক্তির বিকাশ। ব্যক্তির বিকাশ ছাড়া দাওয়াতি কার্যক্রমে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব না।

তেরো. আহ্বানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং খোদ সংস্থার জন্য যে ব্যবস্থাপ্রণালী প্রস্তুত করা হবে তাকে স্থায়ীভাবে দুইভাবে বিভক্ত করতে হবে। একটি বাতেনি ব্যবস্থা, আর অপরটি জাহেরি ব্যবস্থা। জাহেরি ব্যবস্থাটি সংস্থার প্রতিটি ব্যক্তির জন্য উন্মুক্ত থাকবে আর বাতেনি ব্যবস্থাটি কেবল সেই সকল বিশেষ ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে যারা নেতার ঘনিষ্ঠ সহচর। কিন্তু বাতেনি ব্যবস্থার সম্পূর্ণ জ্ঞান উপর্যুক্ত বিশেষ ব্যক্তিদেরও জানানো হবে না। এই জ্ঞান ধারণ করবেন কেবল নেতা নিজে। অবশ্য নেতার মৃত্যুর পর নেতার খলিফা বা প্রতিনিধি তা সম্পূর্ণ জ্ঞাত হতে পারেন।

চৌদ্দ. ব্যবস্থাপনাকে এইভাবে বিভক্তিকরণের ফলে দাওয়াতি কাজও দুইভাগে বিভক্ত হয়ে দুই রকমের ডাকে পরিণত হবে। একটি জাহেরি দাওয়াত, অপরটি বাতেনি দাওয়াত। ব্যবস্থাপনার বাতেনি অংশ বাতেনি দাওয়াতের পৃষ্ঠপোষকতা করবে, আর জাহেরি অংশ দিবে জাহেরি দাওয়াত।

পনের. এখন নেতাকে নিজের আন্দোলন, আহ্বান সংগঠন, পরিকল্পনা ও অভীষ্টের সমন্বয়ে একটি ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করে তা প্রচার করতে হবে। তিনি কী কী করতে চান এই ঘোষণাপত্রে তা বিবৃত হবে। ঘোষণাপত্রের সারকথা এই হবে যে তিনি দেশ ও জাতিকে এক নতুন জীবন দান করবেন; এই নতুন জীবন হবে রব্বানি জীবন, যা প্রচলিত নফসানি জীবনের ভালো দিকগুলি হেফাজত করবে এবং মন্দ দিকগুলি কবর দিবে।

‘ইলহাম’ ও ‘কাশফ’-এর অধিকার এই ঘোষণাপত্রকে শক্তি যোগাবে—প্রকৃত অধিকার, অলীক নয়। এটাই হবে ঘোষণাপত্রটির মূল শক্তি ৷

ষোলো. এই পর্যায়ে নেতা সাধারণ মানুষের মাঝে তার দাওয়াত পৌঁছিয়ে দেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করবেন। সমষ্টিকে যেমন এই আহ্বান পৌঁছাতে হবে, তেমনি ব্যক্তিকেও। মনে রাখতে হবে, দাওয়াতি কাজ শুরুর সময় থেকেই যে বিরোধিতা চলে আসছিল, সাধারণ মানুষের কাছে দাওয়াত নিয়ে হাজির হওয়ার সাথে সাথেই সেই বিরোধিতা তীব্রতর হয়ে উঠবে। বিপ্লবী আন্দোলন মাত্রই বিরোধিতার জন্ম দিয়ে থাকে। সুতরাং পাহাড়ের দৃঢ়তা ও সূর্যের স্থিরতা নিয়ে এই বিরোধিতার মোকাবেলা করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, প্রতিরোধ প্রচেষ্টায় যাতে সংগঠনী-শক্তি চাপা পড়ে না যায় এবং সহ্যের পরীক্ষা যাতে একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে না ওঠে তার জন্য বিরোধী শক্তিকে চূর্ণ-বিচূর্ণও করতে হবে। কারণ প্রথমটিতে ক্ষতি ও দ্বিতীয়টিতে বিপদ।

সতের. সহ্যের ব্যাপারে নেতাকে সকলের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। নেতাই সততা ও প্রেমের দীপ্তিমান আলোকপিণ্ড এবং উজ্জ্বল সূর্য। যদি সেখানেই উষ্ণতার অভাব ঘটে তাহলে উষ্ণতা যেখানে সঞ্চারিত হওয়া উচিৎ কতটুকু উষ্ণতাই বা সেখানে থাকবে? আর সেই অবস্থায় এই সহ্যের সংগ্রাম আর কী করে পরিচালিত হবে? প্রতিরক্ষা প্রচেষ্টায়ও নেতাকে সকলের আগে থাকতে হবে। তিনি পশ্চাদ্বর্তী হয়েছেন তো প্রতিরক্ষা প্রয়াস বানচাল হয়ে গেল। তবে সহ্য ও প্রতিরক্ষা—উভয় ক্ষেত্রে হেকমতের রজ্জুকে হাতছাড়া হতে দেওয়া চলবে না; অন্যথায়, উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আলোড়ন সৃষ্টিতে এবং খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হলেও বিপ্লব সাফল্যমণ্ডিত হবে না। এমনকি সাফল্যের নিকটবর্তীও হতে পারবে না। একটি বিষয় বিশেষভাবে মনে রাখবে, আলোড়ন সৃষ্টি বা খ্যাতি অর্জন উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য হচ্ছে সাফল্য—কেবলই সাফল্য। আর এ কথাও ভুললে চলবে না—বিপ্লব কোনো ভাবোন্মাদ বা জাদুকরের কাজ নয়, বরং একজন নিষ্ঠাবান ও সাহসী প্রজ্ঞাবানের কাজ।

আঠারো. সহ্যকে দুইটি শাখায় বিভক্ত করতে হবে। একটা ত্যাগ না করা, আরেকটা ত্যাগ করা। প্রথমটা হলো ধৈর্য ও স্থৈর্য। এটা কস্মিনকালেও ত্যাগ করা যাবে না, এমনকি মৃত্যুর আশঙ্কা থাকলেও। আর দ্বিতীয়টা হলো দেশ—শক্তি অর্জনের প্রয়োজনে দেশত্যাগ। নেতার পক্ষে প্রথম শাখা গ্রহণ করা উচিৎ নয়। তাহলে নেতার সাথে সাথে বিপ্লবেরও সমাধি রচিত হওয়ার সম্ভাবনা অধিক। তবে হাঁ, যদি বাধ্য হয়ে এটা গ্রহণ করতে হয় তাতে ক্ষতি নাই। এমন পরিস্থিতি পড়লে বুঝতে হবে ইচ্ছার মালিক এই নেতাকে পরিপূর্ণ নেতা বানাতে ইচ্ছুক নন। তা ছাড়া, ইচ্ছাময়ের অভিপ্রায়টা কী তাও এতে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। যদি এই অবস্থা অনিবার্য হয়ে ওঠে তা হলে নেতার পলায়ন করা চলবে না। নয়তো সূচনাকারী হিসাবে তার যে মর্যাদা ছিল তা ছিনিয়ে নেওয়া হবে। অন্যদিকে বিপ্লবের ওপর আসবে প্রচণ্ড ধাক্কা, যার পরিণাম নেতাকেই বহন করতে হবে।

উনিশ. দেশত্যাগকে ‘হিজরত’ নামেও আখ্যায়িত করা হয়। হিজরত পলায়নের মতো হওয়া যাবে না, বরং পূর্ণ সতর্কতা ও ব্যবস্থাপনার সাথেই হওয়া উচিত। এমন যেন না হয়, উঠে দাঁড়ালাম আর যাত্রা দিলাম, তারপর নতুন দেশে পৌঁছে সেখানেই পড়ে থাকলাম। বরঞ্চ যেখানে যাওয়া হবে যাত্রার আগে সেখানে শক্তিশালী একটি দল গঠিত হওয়া উচিত—যারা হিজরতকারী বা হিজরতকারীদের জন্য পথ পানে চেয়ে থাকবে এবং তাদেরকে গ্রহণের জন্য হৃদয় মেলে রাখবে। তারপর সেখানে পৌঁছে লক্ষ্যের ধ্যান থাকতে হবে এমন : নষ্ট করার মতো এক মুহূর্তও সময় নাই, প্রতিটি মুহূর্তকে মূল্যায়ন করতে হবে। এছাড়া মেজবানদের মনে যেন ঘুণাক্ষরেও এমন ধারণা তৈরি না হয়—এই লোক তো নেতা হতে আসেনি, বসে বসে খাওয়া আর আরাম-আয়েশ করাই তার উদ্দেশ্য।

বিশ. হিজরতে নেতাকে যে কাজটি সবার আগে করতে হয়, তা হলো তার উচ্চ চরিত্র-মাহাত্ম্যের অভিব্যক্তি—যাতে বিদেশি সংস্থাটিও নেতার মহত্ত্ব স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবার সুযোগ লাভ করে এবং এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে যে—হ্যাঁ, আসলেই ইনি একজন নেতা। দ্বিতীয় যে কাজটি তাকে সম্পন্ন করতে হবে তা হলো, এতদিন যে হুকুমত বা শাসন-সংস্থা আভাসরূপে বিদ্যমান ছিল তাকে এখন সুস্পষ্ট ও কার্যকরীভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তবে নামের মাধ্যমে এই স্পষ্টতা আনা জরুরি নয়, কর্মের মাধ্যমে আনা জরুরি। নামের মাধ্যমে প্রকাশ অপরিহার্যও নয়, এমনকি ঘোষণা করারও দরকার নেই, যদি না অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তা অনিবার্য হয়ে ওঠে।

একুশ. শাসন-সংস্থা প্রতিষ্ঠার প্রথম বাস্তব পদক্ষেপ হবে দুইটি। প্রথমত, সর্বাত্মক প্রাথমিক গঠনমূলক প্রচেষ্টা, যা ‘হিজরত’-অঞ্চলে ও তার অধিবাসীদের জীবনে চারদিক থেকে কল্যাণ পৌঁছাতে আরম্ভ করবে। দ্বিতীয়ত, বাইরের প্রতিরক্ষা কার্য, যা রাষ্ট্র-বিরোধীদের আক্রমণের যথাযোগ্য প্রত্যুত্তরদানে সক্ষম এবং সঙ্গে সঙ্গে, তাদেরকে জয় করতেও সমর্থ।

বাইশ. যদি বিরোধী শক্তি উপদ্রব না করে, তাহলে আহ্বান-কার্যকে শিক্ষা দান ও ট্রেনিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে তার বিস্তার সাধনকেই যথেষ্ট মনে করতে হবে—যেন আহ্বানের এই রূপটিই আহ্বানের লক্ষ্য বস্তু। রব্বানি বিপ্লবের জন্য এইটুকুই যথেষ্ট। এই বিপ্লবের কোনো দিকই প্রতিশোধ এবং রক্তপাতের জন্য উন্মুখ নয়। তবে যদি বিরোধী শক্তি উৎপাত-উপদ্রব করে, তাহলে অনন্যোপায় হয়ে বিরোধী শক্তির প্রত্যক্ষ চ্যালেঞ্জও গ্রহণ করতে হবে—কিন্তু তা করতে হবে এমন নিয়তের সাথে যে বিরোধী শক্তিকে পরাস্ত করার পর বিরোধীদের কোনো শাস্তি দেওয়া হবে না—যদিও তারা কঠিন শাস্তির যোগ্য হয়। সঙ্গে সঙ্গে এই সিদ্ধান্তও করে নিতে হবে যে যুদ্ধের জবাবে যুদ্ধ নিম্নস্তরের জবাব এবং তাও কেবল এইজন্য স্বীকার করে নিতে হচ্ছে যে মানবতার উৎকর্ষ এখনও প্রাথমিক স্তরে রয়েছে এবং কতক লোকের অনিবার্য ক্ষতির বিবেচনায়, যে-ক্ষতি সাময়িকও হতে পারে, বহু লোকের স্থায়ী কল্যাণকে কোরবান করা যায় না। উচ্চ-স্তরের জবাব হলো শান্তি ও পালনের ঘোষণা। কিন্তু এই স্তরের জবাবের সময় তখনই হবে যখন নিম্নস্তরে জবাবের সঙ্গে রব্বানি বিপ্লব সাফল্যমণ্ডিত হয়ে তার নিজস্ব সমুচ্চ আদর্শ সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রতিষ্ঠিত করেছে।

তেইশ. যদি একান্তই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় তা হলে যুদ্ধকে রব্বানি যুদ্ধে রূপান্তরিত করতে হবে। অবশ্য যুদ্ধ সকল দিক থেকেই রব্বানিয়াতের পরিপন্থী। তার পরেও তাতে রব্বানি রূপদানের অবকাশ অবশ্যই রয়েছে। যদি সেই রূপদান সম্ভব হয় তা হলে যুদ্ধের মধ্যেও রব্বানিয়াত স্বীয় রূপের আভাসদানে সক্ষম হবে? হয়তো রব্বানিয়াত স্বরূপ উন্মোচিত করে বলবে—‘যুদ্ধ তো একটি পর্দা মাত্র, যা জবরদস্তি করে আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে; আসল ব্যাপার আমি স্বয়ং; পর্দা ছিন্ন করে এবং আমার রূপ অবলোকন করে দিওয়ানা হয়ে যাও।’ এই পদ্ধতিতে যুদ্ধাবস্থায়ও রব্বানিয়াত কিছু-না-কিছু ত্বরান্বিত হবে। বিজয়ের পর তো কিছুকালের জন্য তা সম্পূর্ণই এসে যাবে।

চব্বিশ. যুদ্ধ হোক বা না হোক, যদি আহ্বান সফল হয় তা হলে বিপ্লবকে দুইটি শাখায় বিভক্ত করতে হবে। প্রথমত, অভ্যন্তর বিষয়ক; দ্বিতীয়ত বহির্দেশ সম্পর্কিত। অভ্যন্তর বিষয়ক শাখার কাজ হবে দেশে রব্বানি বিপ্লবী শাসন-সংস্থা প্রতিষ্ঠিত করা এবং এই উদ্দেশ্যে সমগ্র জাতিকে অন্তত বাহ্যিকভাবে রব্বানি জাতিতে পরিণত করতে পারে এমন সব রব্বানি আইনকানুন ও বিধিব্যবস্থা জারি করা। অবশ্য বাতেনি দিক দিয়েও জাতিকে রব্বানি করে তোলার জন্য আরও একটি হাতিয়ারের প্রয়োজন। সে হাতিয়ার হচ্ছে বাতেনি দাওয়াত। এই বাতেনি দাওয়াতের একটি শাখা জাগতিক হলেও অপর শাখাটি হবে রুহানি। বহির্দেশ-সম্পর্কিত শাখাটি অপর দেশসমূহে বিপ্লবের আহ্বান-কার্য পরিচালনায় আত্মনিয়োগ করবে।

আর যদি পরাজয় বরণ করতে হয়, তাহলেও হতাশ হওয়া চলবে না। পরিণাম বিশ্বনিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থার আওতাধীন—তা ইচ্ছাময় ছাড়া অন্য কারও হাতে নয়, যিনি এই নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার ওপরেও ক্ষমতাবান। তবে কর্তব্য সর্বদা কর্তব্যই থাকবে। সুতরাং তা প্রতিপালন করতে কুণ্ঠা কেন? তা ছাড়া, রব্বানিয়াত ও রব্বানি বিপ্লবের পক্ষে পরাজয় কেবল একটা আকস্মিক দুর্বিপাক মাত্র, পারিণাম নয়। তার স্বাভাবিক পরিণাম তো বিজয় ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে এই বিজয় বিলম্বে হতে পারে। সুতরাং বিজয় সম্পর্কে পূর্ণ আস্থা নিয়ে আবার কাজ শুরু করব না কেন?

পঁচিশ. বিপ্লব সফল হলে বিপ্লবের অভ্যন্তরীণ শাখার শেষ কাজ হবে বিপ্লবী কর্মব্যবস্থা যাতে স্থায়ী হতে পারে তার জন্য সকল কৌশল প্রয়োগ করা। কারণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ এই জগতের রীতিই এই যে প্রভাতের মনোহারিত্ব মাত্র চার প্রহর অতিক্রান্ত হবার পর সন্ধ্যার ম্লানিমায় রূপান্তরিত হয়; এক সময়ের উত্তাল তরঙ্গে স্ফীত বিক্ষুব্ধ সমুদ্র পরমুহূর্তেই মৃতবৎ নিথর হয়ে যায়। কী সেই সব কৌশল যা এই বিপ্লবকে স্থায়িত্ব দান করতে পারে? এই কৌশল হচ্ছে সংখ্যায় মোটামুটি পাঁচটি—যথা :

ক. এমন এক রব্বানি মাজহাব বা মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যা হবে রব্বানি বিপ্লবের স্রষ্টা।

খ. এমন এক রব্বানি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যা কখনও শাসনযন্ত্রের অংশে পরিণত হবে না এবং সব সময় শাসনতন্ত্র ও জনগণের সংশোধন-কার্যে নিয়োজিত থাকবে।

গ. এমন এক রব্বানি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যা আধ্যাত্মিক পদমর্যাদায় শাসনযন্ত্রের চেয়েও উচ্চতর বলে স্বীকৃত হবে এবং সেই নেতৃত্বের এখতিয়ার থাকবে শাসনযন্ত্র রদবদলের—এবং জনগণও থাকবে তারই পরিচালনাধীন।

ঘ. সংস্কারকের পদ সৃষ্টি করতে হবে যার অধিকার থাকবে মতবাদের পুনরুজ্জীবনের। শাসনতন্ত্র ও জনগণকে এই পদ মতবাদের দিকে আকর্ষণ করতে থাকবে এবং মতবাদের মাধ্যমে বিপ্লবকে রাখবে প্রাণবন্ত।

ঙ. ইজতিহাদ বিভাগের প্রতিষ্ঠা। তা মতবাদের কুল্লিয়াত বা নির্বিশেষ হতে সেই সব জুজইয়াত বা বিশেষকে উদ্ধার করতে থাকবে, যা বিপ্লবকে রাখবে বলিষ্ঠ।

 

সপ্তম অধ্যায়

 

সামঞ্জস্য বিধান

এখন ঘটনার আলোকে দেখাতে হবে হজরত মুহাম্মদ (স) সত্যই এই কর্মনীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছিলেন, নাকি মনগড়া কিছু বিষয় তার ওপর আরোপ করা হচ্ছে। আমরা তার কর্মপদ্ধতির দিকে তাকালে বুঝতে পারি তিনি আসলেই ‘বিপ্লবের’ ভাবনা সামনে রেখে কাজ করেছেন, আর এই কারণেই তার সাথে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি যুক্ত করা হচ্ছে।

এক. খেয়াল করলে দেখা যাবে প্রথমে হজরত মুহাম্মদ (স) তত্ত্ব-অনুসন্ধানের পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিন বৎসর ধরে তিনি পর্বতে রব্বানিয়াতের সাধনা করেছেন। তার মতো সুমহান প্রকৃতির অধিকারী মানুষের তিন বৎসর অন্য মানুষের ত্রিশ বৎসরের সমান; বরঞ্চ তার তিন বৎসরের মর্যাদা অন্য মানুষের ত্রিশটি জীবনকালেরই সমান; কারণ এই সুমহান প্রকৃতির অধিকারী ব্যক্তি তো সাধনা ছাড়াই, বুদ্ধিপ্রাপ্তির আগে থেকেই ফেরেশতা দেখতেন। সত্যি বলতে কী, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর চক্ষু মেলেই তিনি ফেরেশতা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তাদের হাতেই তিনি লালিত-পালিত হয়েছেন!

কেউ কেউ বলতে পারে তার এই অনুসন্ধিৎসাময় সাধনার উদ্দেশ্য তো ছিল নিজস্ব শান্তি ও তৃপ্তি; কোনো সামাজিক আন্দোলন ও সর্বজনীন কল্যাণের সাথে তার সম্পর্ক কোথায়? এর উত্তরে বলা যায়—ফলই বৃক্ষের পরিচয় দেয়। তিনি যা যা করেছেন এটাি প্রমাণ করে তার এই সাধনা নিজ সন্তুষ্টি ও তৃপ্তির জন্য ছিল না—বরং তার লক্ষ্য ছিল বিশ্বের ও মানবতার খেদমত৷

এই অনুসন্ধিৎসা এবং এমন ব্যাপক সাধনার ফল কী হয়েছিল? যিনি এই অনুসন্ধান-কার্যে রত থেকে ফল লাভ করেছিলেন, তার ওপর কি বৈরাগ্য প্রভাব বিস্তার করেছিল, এবং তিনি কি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছিলেন? মানে তিনি কি ফকির-সাধু হয়ে হুজরায় কিংবা জনহীন স্থানে ধ্যানে বসে গিয়েছিলেন? এমন তো হয় নাই—বরং তার বিপরীতই হয়েছিল। এবং যা হয়েছিল বিশ্ববাসী তা দিনে-দুপুরে স্পষ্টভাবেই দেখেছিলেন। মানুষ দেখেছে তিনি যে গুহায় প্রথম সত্যকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সেখান থেকে বের হয়েই তিনি সৃষ্টির সেবা-সম্পর্কিত সত্য-পরিচায়নের উদ্দেশ্যে অস্থির হয়ে পড়েছেন। আর এটা ছিল সৃষ্টির নিজের নির্ধারিত সেবাদর্শের পক্ষে অপরিহার্যও। আসমান-জমিন উভয়েই এই সাক্ষী দেবে—সত্য পরিচায়নের শর্তটি পূরণ হওয়ার পর তিনি কীভাবে সৃষ্টির সেবার জন্য এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

তারপর এই ব্যক্তি যখন প্রকৃতই সৃষ্টির ভীড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তখন তার বিরোধী কেউই অথবা বিরোধী কোনো শক্তিই তাকে সৃষ্টি হতে বিচ্ছিন্ন করতে সমর্থ হয় নাই—যতক্ষণ না মৃত্যুর অমোঘ হস্ত পরমসত্তার ইঙ্গিতে তাকে পৃথক করে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সৃষ্টির সেবায় নিমগ্নতা ও আত্মোৎসর্গের যে নজির তিনি স্থাপন করেছেন, তেমন নজির অনাদিকাল হতে আজ পর্যন্ত কেউই স্থাপন করে নাই। মহাসত্য প্রত্যক্ষণের আনন্দ, যা এবাদতের সময় অতুলনীয় উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করত তা তিনি সংযত রাখতেন এবং প্রত্যেকদিন সাতবার তার সাক্ষ্য দান করতেন। তারপর রাত্রিতেও তিনি নিদ্রা-সুখকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেন। তার পরেও, যতক্ষণ সৃষ্টিলোক জাগ্রত থাকে সেই সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট নামাজের জন্য ছাড়া মহাসত্য প্রত্যক্ষণের আনন্দে বিভোর হয়ে সামান্য সময়ের জন্যও সৃষ্টির সেবা থেকে বিরত থাকা ছিল তার প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। তারপর রাত্রির সালাত তো তিনি পালন করতেনই—এর পরেও রাত্রির শেষভাগে যখন সারাজাহান গভীর ঘুমে নিমগ্ন, তখন তিনি সারাদিনের কঠিন পরিশ্রম সত্ত্বেও আল্লাহর স্মরণে জাগ্রত হতেন। প্রত্যেক ওয়াক্ত নামাজই তিনি মানুষের মিলনকেন্দ্র, অর্থাৎ মসজিদে মানুষের সঙ্গেই আদায় করতেন, প্রত্যেক নামাজেই তিনি তাদের অবস্থা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করতেন এবং প্রয়োজনীয় জিনিশের ব্যবস্থা করে দিতেন। সত্যের অনুসন্ধান ও সত্যের উপলব্ধি-রূপ এ ফল কি এ-দাবির সুস্পষ্ট প্রমাণ নয় যে, তার সত্যানুসন্ধানেরও উদ্দেশ্য ছিল সৃষ্টিরই বৈপ্লবিক সেবা–কেবলমাত্র ব্যক্তিগত শান্তি ও তৃপ্তিই নয়?

তারপর এই মহান ব্যক্তির ইন্তেকালের পর তার সর্বোত্তম ও প্রত্যক্ষ সহচর চতুষ্টয়ের দিবারাত্রি সৃষ্টির বৈপ্লবিক সেবায় নিমগ্ন থাকা কি এটাই প্রমাণ করে না যে সেই সত্য ও হকিকত অনুসন্ধানীর সত্যানুসন্ধান ও সত্যোপলব্ধির একটি মাত্র স্থির লক্ষ্যই ছিল—আর সেই লক্ষ্যটি হচ্ছে সৃষ্টির বৈপ্লবিক সেবা?

দুই. হকিকত উপলব্ধি ও হকিকত পরিচায়নের প্রথম পদক্ষেপ অতিক্রমের পর হজরত মুহাম্মদ (স) কী করলেন? আপন পরিবার-পরিজনের কাছে এটা ঘোষণা করে দিলেন যে ‘আমি ইনকিলাবের নেতা—স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত ইনকিলাবের নেতা আমি। আল্লাহর অনু্মতিক্রমে ও আদেশে ইনকিলাবি আন্দোলন পরিচালনার জন্য আমি আবির্ভূত হয়েছি। আত্মপূজার স্থবির গতানুগতিক জীবন বর্জন করে। এবং সৃষ্টি-পালনের ইনকিলাবি জীবনে আমার সঙ্গী হও।’ এই মৌলিক ইনকিলাবি ঘোষণায় তিনি সামান্যতমও সংকোচ বা সংশয় প্রকাশ করলেন না। ভেবে দেখেছেন কি—এই ঘোষণাটিতে কী অটল লক্ষ্য ও কার্য-সম্পাদনের কী সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা লুকিয়ে ছিল? সেই লক্ষ্য ও সেই প্রতিজ্ঞা এই যে : ‘ওহে, আমার প্রিয় পরিবার-পরিজন, তোমরা যদি আমার সঙ্গী হতে রাজি থাকো—সঙ্গী হও, নয়তো আমিই তোমাদের সঙ্গ পরিত্যাগ করছি।

একটিমাত্র ঘটনা হতেই উপর্যুক্ত লক্ষ্য ও প্রতিজ্ঞার সুস্পষ্ট পরিচয় লাভ করা সম্ভব। ঘটনাটি এই:

হজরত মুহাম্মদের (স) যখন দৃঢ়বিশ্বাস জন্মাল তার দুই জামাতা ইনকিলাবি আন্দোলনে যোগদানকারীদের সঙ্গে শরিক হতে অসম্মত, তখন জামাতারা তারই চাচাতো ভাই এবং অতি প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিনা দ্বিধায় আপন কন্যা দুইজনের তালাক নিয়ে তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং ইনকিলাব যাদের প্রিয় ছিল তাদের সাথে সেই কন্যাদের বিবাহ দেন।

সৌভাগ্য যে তার এই চরম আহ্বানে তার পরিবার-পরিজন সাড়া দিয়াছিলেন; নয়তো বিশ্ব শ্রবণ করত এবং ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হতো যে প্রিয়তমা পত্নী খাদিজার সাথে তার বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটেছে, প্রিয় তনয়া ফাতেমা, রুকাইয়া ও উম্মে কুলসুমকে পৃথক করে দেওয়া হয়েছে, আর তিনি ঘর-সংসার পরিত্যাগ করে কোনো এক বন্ধুর আশ্রয় গ্রহণ করেছেন।

পরিবারের নিকট এই চরম ও ভয়ংকর ঘোষণা কি এই কথারই প্রমাণ নয় যে হজরত মুহাম্মদের (স) জীবনের একমাত্র ব্রতই ছিল ইনকিলাব এবং তার সম্মুখে অবশ্যই কোনো সুস্পষ্ট ইনকিলাবি কর্মনীতি ও ইনকিলাবি কার্যসূচি ছিল।

তারপর ইনকিলাবের এই উম্মি নেতা একবার নিজ কবিলার সর্দারদেরকে পর্বতের ওপর আহ্বান করে ইনকিলাবের সেই ঘোষণা করলেন, যা কেবল ইনকিলাবের নেতার পক্ষেই সম্ভব—ইনকিলাবের সেই নেতা যিনি আল্লাহর অনুমতি প্রাপ্ত। এই ঘোষণায় পরিষ্কার ভাষায় বলে দেওয়া হলো যে, ‘মানব-জগৎ পথভ্রষ্টতা, অজ্ঞতা, শয়তান-পূজা ও শয়তানি কার্যকলাপে নিমজ্জিত। ধ্বংস ও বরবাদি দ্বারা তারা সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত। শুধু আমিই—আমি এবং আমার আনুগত্যই মানব-জগৎকে বিশৃঙ্খলা ও দূরবস্থা হতে উদ্ধার করতে সক্ষম।

তার এই ইনকিলাবি ঘোষণা কি অপর কোনো সাধারণ অথবা চরম ইনকিলাবি ঘোষণা অপেক্ষা বিন্দুমাত্রও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল? ইহা কি স্পষ্ট প্রমাণ করছে না যে, এই ঘোষণাকারীর সম্মুখে একটি সুনির্দিষ্ট সুস্পষ্ট ইনকিলাবি কৰ্মনীতি ও ইনকিলাবি কর্মসূচি ছিল?

তারপর হজরত মুহাম্মদ (স) প্রত্যেকের কাছে আলাদা আলাদাভাবে ইনকিলাব প্রচারে মনোযোগী হন এবং তা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে থাকেন। এরই প্রভাবে অল্পদিনের মধ্যেই খাস একটি দল ইনকিলাবে শরিক হয় এবং সুনিয়ন্ত্রিত একটি জামাতে পরিণত হয়। নতুবা, পর্বতের শীর্ষদেশে প্রদত্ত ভাষণটি তো প্রচারের ডামাডোল সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই করে নাই। এর অর্থই এই যে প্রকৃত দাওয়াত অর্থাৎ রব্বানি ইনকিলাবের আহ্বান প্রতিষ্ঠিত হলো এবং এই আহ্বান একটি আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করল। এই আহ্বান হচ্ছে প্রচারের নিরবচ্ছিন্ন আহ্বান, নিরবচ্ছিন্নতায় নিয়ন্ত্রিত একটি আন্দোলন। তারপর সেই দলটি যা ‘রব্বানি ইনকিলাবি দল’ নামে আখ্যায়িত হওয়ার যোগ্য, সেই দলভুক্ত প্রত্যেকে দ্বিধা-সংকোচমুক্ত হয়ে আহ্বান-কার্য শুরু করে দিলেন। অর্থাৎ, এই দলের প্রত্যেক ব্যক্তিই স্বয়ং নেতা হতে পৃথকভাবে অথচ নেতারই নির্দেশিত পদ্ধতিতে ইনকিলাবের প্রচারকার্য চালাতে লাগলেন। প্রমাণ স্বরূপ, একটি ঘটনার উল্লেখই যথেষ্ট যে, হজরত আবু বকর (রা) প্রায় এক ডজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ইনকিলাবি প্রচার পদ্ধতির মাধ্যমে ইনকিলাবি দলের অন্তর্ভুক্ত করেন। এই কাজটি কি ইনকিলাবি কর্মনীতি ও কর্মসূচি মোতাবেক ছিল না?

তারপর হজরত মুহাম্মদ (স) কী করলেন? তিনি আরবের প্রসিদ্ধ বিভিন্ন মেলায় যেতে লাগলেন। এই সব মেলায় বড় বড় কবিও সমবেত হতেন। তৎকালে আরবে এই কবিদের মর্যাদা ছিল আলেমদেরই মতো, অবশ্য খাঁটি আলেমদের মতো নয়। এই সব মেলায় তিনি ইনকিলাবি প্রচার করতে লাগলেন। এই ভাবে তিনি হজের মওসুমে হজের জন্য আগত প্রত্যেক ব্যক্তির শিবিরে উপস্থিত হয়ে তার নিকট ইনকিলাব প্রচার করতেন। এটা এই কথারই বাস্তব প্রমাণ যে, প্রতিটি ব্যক্তির প্রতি স্বতন্ত্র আহ্বান এক্ষণে সমষ্টির প্রতি আহ্বানের রূপ লাভ করছে এবং এতোদিন আহ্বানের যে গতি ছিল মন্থর তা এখন দ্রুততর হয়ে উঠছে, আর সেই সঙ্গে ঘুমন্ত কলবে লাগাচ্ছে আগুনের ছোঁয়া।

তার এই প্রচেষ্টা কি ইনকিলাবি কর্মনীতি ও কর্মসূচি অনুযায়ী ছিল না?

তারপর হজরত মুহাম্মদ (স) ও তার সহচরদের জীবনে রুদ্র দিনা সমুপস্থিত হলো। বিপদ আসল কঠোর মূর্তি নিয়ে। তখন কী হলো? হজরত মুহাম্মদ (স) কি তখনও স্ফীতবক্ষে ও উন্নতমস্তকে বিপদকে সন্ধোধন করে বলেন নাই—‘হে ধৈর্য ও সহনশীলতার পরীক্ষক বিপদসমূহ! এগিয়ে আসো, আমার ও আমার খাঁটি সহচরদের ওপর যেমন ইচ্ছা ঝাঁপিয়ে পড়ো।’ এই চ্যালেঞ্জের পর সেই সব মহা মহা বিপদ রুদ্র মূর্তি ধারণ করে তাদেরকে দলিত-মথিত করে দিয়ে চলে গেছিল। ফলে, অনেকেই প্রাণত্যাগ করেছিলেন, আর অনেকেই হয়েছিলেন মৃত-প্রায়। কিন্তু সেই বিপদসমূহ এবং বিশ্ববাসীও প্রত্যক্ষ করেছে যে না ইনকিলাবের নেতা ক্লান্ত হয়েছেন, না তার অবশিষ্ট সঙ্গীদের কেউ ভীতি-বিহ্বল হয়েছেন!

এটা কি নির্দিষ্ট ইনকিলাবি কর্মনীতি ও কর্মসূচির সাথে ঠিক সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না? নিশ্চয় ছিল।

তারপর হজরত মুহাম্মদ (স) যখন উপলব্ধি করলেন যে তার ইনকিলাবি ডাক বসতি এলাকা হতে প্রান্তর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং জামাতও বড় হয়ে পড়েছে আর অত্যাচারও অব্যাহতভাবে চলছে, তখন, কেন্দ্রে যাতে প্রচারের নাম-নিশানা মুছে না যায়, তার জন্য এমন কিছু সংখ্যক লোককে কেন্দ্রেই রেখে দিলেন যাদের কেবল আত্মরক্ষার ক্ষমতাই ছিল এবং এমন কোনো বিশেষত্ব ছিল না যে, অন্যত্র ইনকিলাবে কোনো মহৎ সাহায্য করতে পারেন। অন্যদিকে, আনন্দে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারেন এবং অধিকতর কার্যক্ষম, এমন কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে তিনি হিজরতের সিদ্ধান্ত নিলেন। এই হিজরতও হবে এই নিয়মে যে সঙ্গীদেরকে প্রেরণ করা হবে প্রথমে, পরে তিনি নিজে যাত্রা করবেন তার সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীকে নিয়ে। শুধু তা-ই নয়, যে স্থানে হিজরত করার সিদ্ধান্ত হলো হিজরতের পূর্বেই সেখানে ইনকিলাবের ডাক পৌঁছিয়ে দেওয়ার এবং তাকে দৃঢ়-মূল করার কাজটিও ইতোমধ্যেই তিনি সম্পন্ন করেছিলেন। যেমন বারো জন মদিনাবাসীকে হজের দুইটি মওসুমে প্রচার মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করে ইনকিলাবি দলভুক্ত করলেন এবং তাদেরকে প্রচারক নিযুক্ত করে নির্দেশ দিলেন যে, তারা যেন নিরব প্রচারের মাধ্যমে তথায় ইনকিলাবি আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে থাকেন। আন্দোলনকে যখন তারা শক্তিশালী করতে সমর্থ হবেন তখন যেন তারা বার্তা পাঠান। তারপর তিনি জানিয়ে দিবেন তার নিজ হিজরতের কথা। অবশ্য সঙ্গী ও বন্ধুগণ পূর্বাহ্নেই যাত্রা শুধু করে দিবেন। বলা বাহুল্য, ঠিক এই নিয়মেই হিজরত অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এটা কি ইনকিলাবি কর্মনীতি ও কর্মসূচি অনুযায়ী ছিল না?

তারপর হজরত মুহাম্মদ (স) হিজরত উপলক্ষে মদিনায় পদার্পণ করেই সর্বপ্রথম দুইটি কাজ করলেন। প্রথমত মসজিদ নির্মাণ করে পাঁচবার দলবদ্ধভাবে সালাত আদায়ের ব্যবস্থা প্রবর্তন করলেন। এই সালাতের পূর্বে ও পরে তিনি সকলের অবস্থা অবহিত হতেন এবং যার যে অভাব থাকত তার সেই অভাব মোচনের ব্যবস্থাদি করা হতো। শুধু তা-ই নয়, সেই মসজিদেই তিনি একটি শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তুললেন যেখানে তিনি স্বয়ং ইনকিলাবের দরস বা পাঠ দিতেন। মসজিদেই যাদের অবস্থানস্থল নির্দিষ্ট হয়েছিল, এমন একদল প্রচারকের ওপর এই সব পাঠ-সংরক্ষণের দায়িত্ব অর্পিত হলো—যাতে এই সব পাঠ বিস্তার লাভ করে এবং সর্বকালে ব্যবহারে আসে।

দ্বিতীয়ত, প্রতিবেশী যেসব ইহুদি ছিল সুরক্ষিত দুর্গের অধিপতি, যারা বাস করত বাদশাহি শানশওকতে তাদের সাথে তিনি সম-মর্যাদার চুক্তি স্বাক্ষর করেন; এমন চুক্তি করলেন যা দুইটি রাষ্ট্রের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই কার্যের অবশ্যম্ভাবী ফল এই হয়েছিল যে, কেউ তাদেরকে বলে না দিলেও হিজরত অঞ্চলের অর্থাৎ মদিনাবাসীদের মনে এই বিশ্বাস জন্মে গেল যে ‘আমাদের জন্যও একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে, যে-রাষ্ট্র ইনকিলাবি তো বটেই, রব্বানিও।’ ইহুদিরা বিশ্বাসঘাতকতা না করলে এবং ইনকিলাববিরোধীদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত না হলে এই চুক্তির দ্বিতীয় আরও একটি ফল ফলত; সে ফলটি এই হতো যে বিনা রক্তপাতেই ইনকিলাব সম্পূর্ণ হয়ে যেত এবং ইহুদিদেরও এই লাভ হতো যে তারা স্বদেশেই সসম্মানে জীবন অতিবাহিত করতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই—তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ফলে তারা পর্যদুস্ত হয় এবং সে সময় না হলেও পরবর্তীকালে তাদেরকে বহিষ্কারও করা হয়। এছাড়া আরও একটি কথাও রয়েছে। যেহেতু ইহুদিদের সমাজ-জীবন ও সমাজ-ব্যবস্থাই ছিল পুঁজিবাদী যার ভিত্তি ছিল সুদখোরি ও কর আদায়ের ওপর, তাই ইহুদিরা কী করেই বা সেই ইনকিলাবে যোগ দিতে পারে যে-ইনকিলাব পুঁজিবাদী সমাজ-ব্যবস্থাকে নিশ্চিহ্ন করতে এসেছে?

যাই হোক, এই দুইটি কার্য প্রথমেই সম্পন্ন হয়েছিল। এই ব্যবস্থাগুলি কি ইনকিলাবি কর্মনীতি ও কর্মসূচি অনুযায়ী ছিল না?

তারপর হজরত মুহাম্মদ (স) কী করলেন? তিনি প্রতিদিন তার পাঠ দিতে লাগলেন, আবার সপ্তাহের একটি বিশেষ দিনেও। এইভাবে পাঠদান এবং সময়-সুযোগমতো বিভিন্ন উপলক্ষে ঘোষণার মাধ্যমে ইনকিলাবের রব্বানি প্রচার কার্য তিনি সমাধা করলেন। এই ধরনের প্রচার গোটা ইনকিলাবি জামাত এবং অসহযোগীদের মনেও এই বিশ্বাস জন্মিয়ে দিল যে ইনকিলাব কল্যাণময় এবং তার সাফল্যের মধ্যে লুক্কায়িত রয়েছে ঐশ্বর্য-সমৃদ্ধির সুবিশাল ভান্ডার।

এই ইনকিলাবি প্রচারের সারকথা ছিল:

ক. গোটা দেশে—এবং ইনকিলাব বিশ্বজনীন হয়ে উঠলে, গোটা বিশ্বে—একটি মানুষও উলঙ্গ, গৃহহীন, নিরাশ্রয় এবং অবনত থাকবে না। মোট কথা : দরিদ্র, পরমুখাপেক্ষী বলে কেউই থাকবে না।

খ. গোটা দেশ এবং গোটা বিশ্ব হতে অশান্তির মূল কারণগুলি লোপ পাবে।

গ. গোটা দেশ এবং গোটা বিশ্ব থেকে আশরাফ-আতরাফের ভেদ মুছে যাবে এবং মানব জাতি মধ্যম ধরনের একটি জাতিতে রূপান্তরিত হবে—যারা খেটে খাবে, সুখে থাকবে।

ঘ. গোটা দেশে এবং গোটা বিশ্বে ‘মুলুকিয়াত’ বা শাসনবাদের স্থান গ্রহণ করবে ‘রবুবিয়াত' বা পালনবাদ।

ঙ. গোটা দেশে এবং গোটা বিশ্বে ‘রুহানিয়াত’ বা আধ্যাত্মিকতা ও ‘মাদ্দিয়াত’ বা বস্তুবাদের সমন্বয় সাধিত হবে এবং এই নিয়মেই নফসানিয়াতের স্থলে প্রাধান্য লাভ করবে রব্বানিয়াত। অপরপক্ষে, শয়তানিয়াত যেমন দমিত হবে তেমনি নৈরাজ্যবাদের হবে অবসান।

চ. গোটা দেশে এবং গোটা বিশ্বে অজ্ঞতার স্থান গ্রহণ করবে জ্ঞান আর তকলিদ বা অন্ধ-অনুসরণের স্থান গ্রহণ করিবে তহকিক বা যুক্তি-বিচার

ছ. গোটা দেশে এবং গোটা বিশ্বে নফসানি জীবন-পদ্ধতি ও ব্যবস্থাসমূহ ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে গিয়ে তার জায়গায় রব্বানি ব্যবস্থা ক্রমবিকাশ লাভ করতে থাকবে।

জ. এই ইনকিলাব কখনও মুছে যাবে না, কখনও ব্যাহত হবে না—এগোতেই থাকবে, কেবল এগিয়েই যাবে। বাধা-বিঘ্ন সত্ত্বেও তা এগিয়ে চলবে। অবশেষে একদিন তা লাভ করবে পরিপূর্ণতা, আর, কেবল তখনই মানবজাতি সম্মুখীন হবে কিয়ামতের। বস্তুত, এটাই হচ্ছে জড়-জগৎ হতে আধ্যাত্মিক জগতে স্থানান্তরিত হওয়ার চূড়ান্ত মুহূর্ত।

উপর্যুক্ত বিষয়টি কি নির্দিষ্ট ইনকিলাবি কর্মনীতি ও কর্মসূচির ঠিক অনুযায়ী ছিল না? নিশ্চয় ছিল।

তারপর হজরত মুহাম্মদ (স) যখন দেখতে পেলেন, যুদ্ধকে কিছুতেই উপেক্ষা করা যাচ্ছে না, কারণ কেন্দ্র তথা মক্কার ইনকিলাববিরোধীরা হিজরত অঞ্চল তথা মদিনার ওপরও আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছে, তখন তিনি যুদ্ধের প্রতি তার ঘৃণা সত্ত্বেও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন এবং যুদ্ধে যোগদান করলেন এবং এমন শৌর্য ও আভিজাত্যের সঙ্গে তাতে যোগদান করলেন যা ইনকিলাবের নেতা, রব্বানি ইনকিলাবের নেতা, আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট ইনকিলাবের নেতার পক্ষে শোভনীয়। এই যুদ্ধ-প্রস্তুতিও এমন সুব্যবস্থা ও সুশৃঙ্খলার সাথে সম্পন্ন হলো যা ছিল পূর্ণ ইনকিলাবি এবং রব্বানি বিপ্লব-ভিত্তিক—যা পরাস্ত হওয়ার কথা জানেই না এবং বিজয়ের পরেও যা দুরভিসন্ধিকে প্রশ্রয় দেয় না। এই কারণেই এটা মোজেজা বা অলৌকিকত্ব বলেই প্রতীয়মান হতে থাকে। কারণ, মুষ্টিমেয় লোক নিয়ে তিনি গোটা আরবের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন এবং বিজয়ীও হয়েছিলেন।

তার এই কাজটি কি নির্দিষ্ট ইনকিলাবি কর্মনীতির ও কর্মসূচির সাথে ঠিক সামঞ্জস্য পূর্ণ ছিল না? ছিল।

তারপর হজরত মুহাম্মদ (স) কী করলেন? যুদ্ধাবস্থা তখনও শেষ হয় নাই; যদিও বিজয় সম্পর্কে তিনি নিঃসন্দেহ হয়ে গিয়েছিলেন ঠিক সেই সময়েই তিনি কতিপয় ভিনদেশে একটি ইনকিলাবি লিপি মারফত ইনকিলাবের ডাক পৌঁছিয়ে দিলেন। উদ্দেশ্য : দেশ ও জাতির গণ্ডিতে এই ইনকিলাব সীমাবদ্ধ, এরূপ ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন এবং তার বিশ্বজনীন দিকটি এমন করে উন্মোচিত করা যাতে তার বিশ্বজনীনতা সম্পর্কে সামন্যতম সন্দেহেরও অবকাশ না থাকে।

এই কাজটিও কি ইনকিলাবি কর্মনীতি ও কর্মসূচির সাথে ঠিক সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না? এর পর হজরত মুহাম্মদ (স) কী করলেন? কেন্দ্রে যুদ্ধ থেমে গেছে এবং সামান্য কিছু অঞ্চল ছাড়া অবশিষ্ট সকল স্থান বিজিত হয়েছে। হজরত তখন হুকুমতের প্রকাশ্য ঘোষণা করে দিলেন। কাবাগৃহ থেকে মূর্তি অপসারণের নির্দেশ দিলেন—সেই কাবাগৃহ, যা ছিল নফসানি ও অংশীবাদীদের হুকুমতের প্রধান কেন্দ্রস্থল। নতুন হুকুমত প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই উপর্যুক্ত নির্দেশটি ঘোষিত হলো, আর সঙ্গে সঙ্গেই এটাও শুনিয়ে দেওয়া হলো যে কাবাঘর কোনো অপরাধীকে বাঁচাতে সক্ষম নয়; অর্থাৎ এটা এই কথারই প্রকাশ্য ঘোষণা যে নতুন হুকুমতের সম্পর্ক সেই মকামের সাথে—যা কাবা হতেও উচ্চতর; অর্থাৎ তার সম্পর্ক আল্লাহর আরশের সঙ্গে, যার আইন অমোঘ, বিশ্বজনীন এবং সর্বব্যাপ্ত, যা কাবায় প্রস্তুত আইনকে স্বীকার করে না।

উপর্যুক্ত পদক্ষেপটি কি নির্দিষ্ট ইনকিলাবি কর্মনীতি ও কর্মসূচির ঠিক অনুযায়ী গ্রহণ করা হয় নাই?

এর পর হজরত মুহাম্মদ (স) সেই সুস্পষ্ট বিজয় দিবসে দুই-একজন অপরাধী ছাড়া সমগ্র বিরোধী দলটিকেই সম্পূর্ণ ক্ষমা করে দিলেন এবং প্রতিশোধের একটি শব্দ পর্যন্ত কোনো সঙ্গীর মুখ থেকে উচ্চারিত হতে দিলেন না। অথচ তার অনুসারী মুহাজিরদের মধ্যে এমন কে ছিলেন, যার অন্তর সেই বিরোধী দলের অত্যাচার ও নিপীড়নে ক্ষত-বিক্ষত হয় নাই? তারপর সেই সময়েই এই রব্বানি ঘোষণাও তিনি করে দিলেন যে, ‘আমি বাদশাহ নই, আমি সেই অসহায় নারীরই পুত্র মাত্র।’

এই কর্মটিও কী ইনকিলাবি কর্মনীতি ও কর্মসূচির সাথে সম্পূৰ্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না? ছিল।

তারপর হজরত মুহাম্মদ (স) কী করলেন? সমগ্র আরব যখন বিজিত হয়ে গেছে এবং বিশ্ব-রব্বানি হুকুমতের প্রথম অংশ, যার ক্ষেত্র ছিল দেশের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ তা সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, তখন কোনো একটি উপলক্ষে, যে-উপলক্ষে, সমগ্র দেশের প্রতিনিধিরা একত্র হয়েছিল, তিনি তার সমগ্র শিক্ষার শেষ সারগর্ভ ভাষণ দান করলেন—যাতে ইনকিলাবের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং বিধি-ব্যবস্থার সনদ একবার একত্রে নতুন করে শুনিয়ে দেওয়া হলো। সঙ্গে সঙ্গেই এই তাগিদও দেওয়া হলো যে, এই সনদ যারা শ্রবণ করলেন তাদের কর্তব্য হলো অপরের নিকট তা পৌঁছিয়ে দেওয়া—যাতে ইনকিলাবের এই সনদ বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত হয়ে যায়। উপর্যুক্ত কার্যটি কি নির্দিষ্ট ইনকিলাবি কর্মনীতি ও কর্মসূচির সাথে ঠিক সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না? এর পর হজরত মুহাম্মদের (স) দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল যে, নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রম, সংগ্রাম এবং অনশন—তদুপরি শ্রমিক, সৈনিক, ধ্যান-তপস্বীর মতো দিবারাত্রির কায়িক ও আত্মিক পরিশ্রমে জীর্ণ-দীর্ণ এই পার্থিব জীবন আর অধিক দিন টিকে থাকতে সক্ষম নয়। তা ছাড়া কাশফের মাধ্যমে পরম-প্রভুর কাছ থেকেও তাকে জানিয়ে দেওয়া হলো, ‘এখন যদি থাকতে চাও, থাকো, নয়তো চলো।’ তিনি উত্তরে বললেন : এখন বিদায় গ্রহণই তার অধিকতর কাম্য—তা ছাড়া, নমুনা হিসাবে কর্মও সুসম্পন্ন হয়ে গেছে, কারণ সমগ্র বিশ্বব্যাপী কাজ করার মতো এতো দীর্ঘ পরমায়ু পাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং তিনি কী করলেন? সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ইঙ্গিতে তিনি এমন একজনের ওপর ন্যস্ত করলেন যিনি ছিলেন ইনকিলাবের সূক্ষ্ম তত্ত্ব সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল; তিনিই ছিলেন বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ও সর্বাপেক্ষা পুরাতন বন্ধু; কোনো গুরুত্বপূর্ণ সময়েই তিনি রসুলের সঙ্গ পরিত্যাগ করেন নাই। বৈপ্লবিক চরিত্রের দিক দিয়ে সকল উৎসর্গীকৃত-প্রাণ বন্ধুর চাইতে তিনি ছিলেন সামগ্রিকভাবে উন্নত ও মহান। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকজন উৎসর্গীত-প্রাণ বন্ধুরও একক ও বিশিষ্ট গুণাবলির উল্লেখ করে বহু পূর্বেই তিনি ইঙ্গিত দান করেছিলেন যে ইনকিলাবের স্থলাধিকারী নেতার জন্য মানুষের একটি সংক্ষিপ্ত দল শুরা বা পরামর্শ সভারূপে থাকা উচিত। একজনের সম্পর্কে তিনি বলেন : ‘এ আমিনুল উম্মত বা জাতির বিশ্বাসভাজন। আর একজনের সম্পর্কে তিনি বলেন: ‘হক ছাড়া তার মুখ থেকে কিছুই উচ্চারিত হয় না এবং শয়তান তাকে দেখে পলায়ন করে।’ তৃতীয় জনের সম্পর্কে তিনি বলেন : ‘ইনি শালীনতার প্রতিমূর্তি।’ চতুর্থ জনের সম্পর্কে বলেন : ‘ইনি জ্ঞানের দ্বার; আমার রক্ত মাংস। আমি যার মাওলা, সেও তার মাওলা।’ পঞ্চম জনের সম্পর্কে তিনি বলেন : ‘এ আমার বিশ্বস্ত সঙ্গী।’ ষষ্ঠ জনের সম্পর্কে বলেন : ‘এ আমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।’ সপ্তম জনের সম্পর্কে বলেন : ‘এ আমার বন্ধুর বন্ধু।’ অষ্টম জনের সম্পর্কে বলেন; ‘এ পরম সত্যবাদী।’ এইভাবে স্থলাধিকারী ইনকিলাবের নেতাসহ নয় জন উৎসর্গিত-প্রাণ সঙ্গীর সমন্বয়ে নেতৃত্ব পরিষদ গঠন করে তাদের ওপরই তিনি ইনকিলাবের সর্বোচ্চ স্তরের নেতৃত্বভার অর্পণ করেছিলেন।

হজরত মুহাম্মদের (স) শেষোক্ত কাজটি কি নির্দিষ্ট ইনকিলাবি কৰ্মনীতি ও কর্মসূচির ঠিক অনুযায়ী ছিল না? নিশ্চয় ছিল।

উপসংহার

বই শেষ, অথচ এই বইয়ের সমাপ্ত হওয়া উচিত ছিল না। কিন্তু সমুদ্রকে কী আর ছোট পাত্রে ভরা যায়? বইয়ের কলেবর বৃদ্ধির ভয়ে বাধ্য হয়ে এখানেই সমাপ্তি টানা হচ্ছে। এটা সত্য যে এই বই ‘কুল্লিয়াত’ অর্থাৎ সমগ্রের বর্ণনার জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তু সমগ্রেরও তো বহুদিক রয়েছে। সত্য বলতে গেলে, তার দুই-চারটি দিক ছাড়া অবশিষ্ট সকল দিক বাদই পড়েছে। সুতরাং এই সমাপ্তি ইচ্ছাকৃত নয়—অনিচ্ছাকৃতই হচ্ছে। এ কারণে এই অবশ্যই অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। একে অসম্পূর্ণ ধরে নিতে হবে। কিন্তু এটা অতি গূঢ় সত্য যে বইটি অসম্পূর্ণ হয়েও সম্পূর্ণ; কারণ এতে এমন সব বিরল বিষয় রয়েছে যা অনেক মোটা মোটা বইয়েও মিলবে না। এই জন্যই এই বইয়ের উপকারিতার দিকটা অনেক উচ্চ পর্যায়ের।

এছাড়া যদি মিথ্যা বলে ধরে নেওয়া না হয়, তাহলে এই বইয়ের আর একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে; তা এই—যে দিন এই বই লেখা সমাপ্ত হয়েছে সেদিনই গ্রন্থকারের একদিক দিয়ে ‘সলুকে মুহাম্মদি’ পূর্ণ হচ্ছে। গ্রন্থকারের জন্য এটাই উত্তম পুরস্কার। এই দিক দিয়ে বইটিকে গ্রহণীয় এবং কল্যাণপ্রসূ বলেই মনে হয়। আহা, যদি বইটি গভীরভাবে পাঠ করা হয়! আমার বিশ্বাস, তা হবেই!

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।