অভ্যুত্থান পরবর্তী পদক্ষেপ: এখন কী করতে হবে 


এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে দুটো ব্যাপার লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। একদিকে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতৃত্বে এক অসাধারণ গণঅভ্যুত্থান, অথচ অপরদিকে সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গায়ে একটি আঁচড় না লাগা। জনগণকে দমন করবার সকল নাট-বল্টুসহ রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক ভিত্তি ও কাঠামো পুরোপুরি সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত থেকে গেছে। অবাক লাগে, এত বড় অভ্যুত্থান হবার পরেও রাষ্ট্রের গায়ে একটি আঙ্গুলের টোকাও টুক্ করল না। ওটা বহাল তবিয়তেই খোশহাল বজায় আছে। এটাও আশ্চর্যের যে এতো বড়ো বিজয়ের পরেও আমরা ব্যক্তির মৌলিক অধিকার বিরোধী গণধিকৃত স্পেশাল পাওয়ার এক্টিটি পর্যন্ত এখনো রদ করতে পারি নি। অন্যান্য কালো আইনের কথাটি অনেক দূরের ব্যাপার। ইতিমধ্যে চক্রান্ত শুরু হয়েছে, সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য যেন ভেঙ্গে দেয়া হয়। অথচ সর্বদলীয় ছাত্র‌ঐক্য‌ই এখন জনগণের একমাত্র ভরসা। পাশাপাশি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের অসাধারণ ভূমিকাও জনগণের দৃষ্টি এড়ায় নি। রাজপথের বিজয়কে একটা সংহত রূপ দেবার আগে কোনক্রমেই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সংস্থার একটিও যেন শিথিল না হয় সেদিকে আমাদের প্রত্যেককে যারপরনাই সতর্ক থাকতে হবে।

রাস্তায় শহীদের লাশের রক্ত শুকাবার আগেই নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। একদিকে গণঅভ্যুত্থানকে তার রাজনৈতিক পরিণতি লাভ করতে দেয়া হয় নি, তার আগেই তড়িঘড়ি রাষ্ট্র ক্ষমতার হাতবদল ঘটানো হয়েছে, ফলে ক্ষমতা জনগণের হাতে আসেনি। রাজপথের অসামান্য বিজয়ের সাফল্যে জনগণ সেটা এখনো উপলব্ধি করে উঠতে পারেনি। যদিও ইতিমধ্যেই নানান বুদ্ধিজীবীর রচনায় কিছুরই যে আসল বদল হয়নি তার ভয়ংকর বিপদ সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সংবাদের গাছ পাথর যথার্থই খুব আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘তাহলে পরিবর্তনটা কোথায় ঘটলো? কার পতন?কার উত্থান? সবতো ভায়রা-ভাই।’ তার এই তীব্র চাবুকের পর আর কিছুই আসলে বলার অবশিষ্ট থাকে না। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির সামনে এই পরিস্থিতিতে এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হাজির হয়েছে। আমরা অতীতে অনেক তীব্র ভাষায় তাদের অনেক সমালোচনা করেছি। তাদের সম্পর্কে আমাদের বিস্তর অভিযোগ আছে। কিন্তু আজ অভিযোগ পেশ বা সমালোচনার দিন নয়। ঘটনার দ্রুত বিবর্তনের এই মুহূর্তে এবং গণঅভ্যুত্থানের তেজ রাস্তায় স্থিমিত হবার আগে আমাদের উচিত যেসব গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল দল আন্দোলনের পুরোভাগে রয়েছে তাদেরকে যথাসাধ্য সহায়তা করা যাতে দ্রুত ঘটমান পরিস্থিতির মধ্যে তারা সঠিক কৌশল ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এদেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির কি করা দরকার সে সম্পর্কে আমাদের প্রত্যেকের ভাবনা পরিষ্কার করে জানানো উচিত। যাতে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজতর হয়। এ-নিবন্ধ প্রধানত সেই উদ্দেশ্যেই নিবেদিত।

আমাদের ভাবতে হবে বাস্তবকে সামনে নিয়ে। জনগণ এই অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে অক্ষত রেখে এক এরশাদকে সরিয়ে স্রেফ অন্য একজনের হাতে ক্ষমতার হাত বদল হোক সেজন্য আন্দোলন করেনি, রক্ত দেয়নি। কিন্তু বাস্তবে নির্বাচনী হাওয়া শুরু হয়ে যাওয়ার কারণে ঠিক সেই ব্যাপারটিই ঘটতে যাচ্ছে। এখন এই নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা কি পদক্ষেপ নিতে পারি?

সাধারণত গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম এবং সর্বপ্রধান কর্তব্য হচ্ছে অবিলম্বে একটি সংবিধান সভা ডাকা এবং রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক ভিত্তি ও কাঠামোর খোল-নলচে বদলে দিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন করা। কিন্তু কার্যত সেদিকে আমরা যেতে পারছি না বরং আমাদের সামনে মোকাবিলা করতে হচ্ছে একটি গণপরিষদ বা সংসদ এবং এই সংসদ ডাকা হচ্ছে একটি সম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক সংবিধানের ভিত্তিতে। প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে এই সংসদে নাকি মৌলিক অধিকার বিরোধী কালো আইনগুলো রদ করা হবে এই প্রতিশ্রুতি আগাগোড়া একটা ভাঁওতাবাজি। কারণ যারা অতীতে এই আইনগুলো পাস করেছে তারাই গণপরিষদে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারে। ব্যক্তির মৌলিক অধিকার বিরোধী এই সকল আইন রোধ করার পরিবর্তে আরো কিছু কালো আইন প্রবর্তন করা‌ই বরং এদের পক্ষে বেশি স্বাভাবিক। অতীতে এইসব আইন প্রধানত প্রয়োগ করা হয়েছিল এদেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর। মূলত সমাজের প্রগতিশীল রূপান্তরের পক্ষে যারা কাজ করেছিলেন তাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে দমনের জন্যই ব্যক্তির মৌলিক অধিকার বিরোধী আইনগুলো পাশ হয়েছিল। আগামী দিনে সমাজের প্রগতিশীল রূপান্তরের জন্যে সক্রিয় কর্মীর সংখ্যা বাড়বে এবং তাদের সংগ্রামও তীব্রতর হবে। এটা অবিশ্বাস্য যে, এই পরিস্থিতি আগামী সংসদে ব্যক্তি অধিকারের পরিপন্থী কালো আইনগুলো বাতিল হবে।

অথচ দেশের সকল নাগরিকদের জন্য ব্যক্তি স্বাধীনতা অবশ্যই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। এই স্বাধীনতার উৎস হচ্ছে ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব। গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে ব্যক্তি সার্বভৌম। এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা। ব্যক্তির সার্বভৌমত্বই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি। এটা 'বামপন্থী' বা কমিউনিস্টদের আবিষ্কার নয়। এটা বুর্জোয়া শ্রেণীর স্লোগান এবং ১৬ ও ১৭ দশকে ইউরোপের বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্য দিয়েই সার্বভৌম ব্যক্তির এই ধারণা পরিপুষ্টি লাভ করে। এটা যে কোনো সচেতন, আত্মবোধ সম্পন্ন বুর্জোয়ার‌ও দাবি। রাষ্ট্র বা সরকার কখনোই ব্যক্তির এই সার্বভৌমত্বকে ক্ষুন্ন করার অধিকার রাখে না। সংসদ তো নয়ই। অথচ আমরা আমাদের সংবিধানে সংসদকে সংবিধান বদলের ক্ষমতা দিয়ে তথাকথিত 'সার্বভৌম সংসদ' নামক এক অদ্ভুত অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম রেখেছি যাকে এক কথায় সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র বলা যায়। এই স্বৈরতন্ত্র এরশাদশাহীর স্বৈরতন্ত্রের মতো যদি না হয় তবে তার চেয়েও বেশি। এই সংসদীয় স্বৈরতন্ত্রের বলেই অতীতে ব্যক্তির মৌলিক অধিকার বিরোধী আইন প্রণীত হয়েছে। সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বা নিরঙ্কুশ ভোটে জনগণের নাগরিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। রাষ্ট্র ও সরকার একটি ফ্যাসিস্ট চরিত্র অর্জন করে জনগণের টুঁটি চেপে ধরেছে।

যখন স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অ্যাক্ট প্রভৃতি সংসদে পাশ হয়েছিল তখন সেটা মোটেও অসাংবিধানিক ছিল না। হ্যাঁ, এগুলো সংবিধান সম্মতভাবেই জারি করা হয়েছিল, অর্থাৎ সংবিধান দ্বারাই গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। আজকাল সংবিধানবাদী এক প্রকার উকিল ব্যারিস্টারদের আধিপত্য আমাদের রাজনীতিতে লক্ষ্য করছি। এদের অনেকের কাছ থেকেই শেখ মুজিবর রহমান সাংবিধানিক পদ্ধতিতে ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হরণ করার কায়দা শিখেছিলেন। তিনি উকিলদের উপর ভরসা না করে জনগণের প্রাণের দিকে যদি তাকাতেন তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস সম্ভবত ভিন্ন রকম হতো।

আমাদের অতএব এই বাস্তবতাকে আগে পরিষ্কার বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশের সংবিধানের মধ্যেই সংসদকে ব্যক্তির অধিকার হরণ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সংবিধানের ভিতরেই বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকারের ফ্যাসিস্ট, সমরতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠবার বীজ নিহিত রয়েছে। যারা মনে করেন শুধু ৭২ সালের সংবিধান পরবর্তী সংশোধনীগুলি রদ করলেই মূল সংবিধান গণতান্ত্রিক হয়ে যাবে তারা এখানেই একটা মারাত্মক ভুল করেন। গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির প্রথম কাজ হবে এই বিভ্রান্তি থেকে নিজেদের মুক্ত করা এবং জনগণকে এই বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে সহায়তা করা। মূল সংবিধানের আরো বহু দিক আছে যা আগাগোড়াই অগণতান্ত্রিক। এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হলেও ধর্মনিরপেক্ষতা মূল সংবিধানে বজায় রাখা হয়নি। সংবিধানের এই সকল অগণতান্ত্রিক চরিত্র যদি আমরা বদলাতে চাই তাহলে আমাদের অবশ্যই এই মুহূর্ত থেকেই একটি জাতীয় মতৈক্য গড়ে তোলার জন্য সমাজের সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক উদ্যোগ ও প্রচারণার প্রয়োজন। কী বিষয়ে মতৈক্য আসলে সাংবিধানিক দিক থেকে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে একটি বিষয়েই কেবল মতৈক্য দরকার। তা হোল সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে জনগণ একটিমাত্র নীতি এবং আদর্শকে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছে। তা হচ্ছে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এদেশের প্রতিটি নাগরিক ব্যক্তি হিসেবে সার্বভৌম এবং স্বাধীন। অতএব এমন কোনো সংবিধান এবং এমন কোনো আইন কক্ষনো কো্নো অবস্থাতেই প্রমাণ করা যাবে না যা ব্যক্তির সার্বভৌমত্বকে ক্ষুন্ন করে।

আসলে এটাকেই আমাদের সংবিধানের প্রাণে পরিণত করতে হবে, কারণ এটাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রা্‌ এটাই আমাদের হৃদপিণ্ড। আমরা অলিখিতভাবে যা আছি এবং নিজের মধ্যে নিজের সার্বভৌম ক্ষমতাকে যেমন করে বোধ করি তা যদি আমাদের লিখিত সংবিধানে প্রাণ না পায় তাহলে আমাদের ভেতরের সত্তার বাইরের রূপের সংঘাত থেকেই যাবে। কিভাবে আগামী ঘটাবো? এটাই হলো এখনকার ব্যবহারিক প্রশ্ন।

ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব সংবিধানে কিভাবে সহজে সন্নিবেশিত করা যায়? লক্ষ্য করা দরকার যে, ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব সহজে ও সরলভাবে একমাত্র না বাচক বাক্যের দ্বারাই সংবিধানে সংরক্ষণ করা সম্ভব। ব্যক্তি সার্বভৈম, কিন্তু রাষ্ট্র, সরকার, সংসদ সার্বভৌম নয়, হতে পারে না। এসবই ব্যক্তির সার্বভৌম ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ মাত্র সে কারণে এসবের সীমা নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ। অথচ ব্যক্তির সার্বভৌমত্বের কোন সীমানা নির্দেশ করে দেয়া যায় না। অতএব, আমাদের সংবিধানকে যে প্রধান মূলনীতির উপর দাঁড়াতে হবে তা হচ্ছে সংবিধানে এমন কোন ধারা, উপধার, অধ্যায, পরিচ্ছেদ, ইঙ্গিত বা ইশারা থাকতে পারবে না, যা নাগরিকদের সার্বভৌমত্ব বা সার্বভৌম ইচ্ছাকে কণা পরিমাণ ক্ষুন্ন করে। ব্যক্তিও এমন কোন আচার-আচরণ ক্রিয়া-কলাপ বা কর্মকাণ্ডে জড়িত হবে না যা অন্য নাগরিকের সর্বভৌম ইচ্ছাকে ক্ষুন্ন করে। রাষ্ট্র বা সরকার ব্যক্তির এই সার্বভৌম অধিকার ক্ষুন্ন করলে নাগরিকদের অধিকার থাকবে তাকে যে কোন প্রকারে প্রতিহত করার।

ব্যক্তির সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতেই রাষ্ট্র কাঠামোর রূপ ও সরকার পদ্ধতির রূপ নির্ণয় করতে হবে। নাগরিকদের সার্বভৌম স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হচ্ছে কিনা তার খবরদারি করবে যে সংস্থা তাকে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক, নির্বাহী ও আইন প্রণয়নী সংস্থাগুলো থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও বিযুক্ত থাকতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের হাতে অনেক সময় বলা হয় সুপ্রিম কোর্ট সার্বভৌম। আসলে সুপ্রিমকোর্ট সার্বভৌম নয়। নাগরিকদের সার্বভৌম ইচ্ছা কোথাও লংঘিত হচ্ছে কিনা তা সরাসরি খবরদারি করার দায়িত্বে থাকার কারণে রাষ্ট্র ও সরকারের অন্য যেকোনো সংস্থার তুলনায় সুপ্রিম কোর্ট অধিক ক্ষমতার অধিকারী। এমনকি সংসদে যদি ব্যক্তির সার্বভৌম ইচ্ছা বা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কোন আইন পাস করে ব্যক্তির সার্বভৌমত্বের সরাসরি খবরদারি করবার প্রতিনিধি ও রক্ষাকবচ হবার কারণে সুপ্রিম কোর্ট তা নাকচ করে দিতে পারে। এছাড়া বিচার বিভাগকেও রাষ্ট্রের অন্যান্য সকল সংস্থা থেকে আলাদা ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া নাগরিকদের সার্বভৌম স্বার্থ রক্ষা করার প্রাথমিক শর্ত।

এখন ব্যক্তির সার্বভৌমত্বকে সংবিধানের প্রাণে পরিণত করার লক্ষ্যে নির্বাচনকে সামনে রেখে কি কি পদক্ষেপ নেয়া দরকার সেটা দেখা যাক প্রথমেই একটা বিরাট সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে এ কারণে যে, আমরা সামনে একটি সংসদ পাচ্ছি, কোন সংবিধান সভা নয়। ওপরের সাংবিধানিক রূপান্তরের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা কার্যকর করতে হলে এই সংসদকে ঐতিহাসিক কারণে সংবিধান সভা হিসেবে ভূমিকা রাখতে হচ্ছে। বিরাজমান সংবিধান অনুযায়ী আগামী সংসদের এই ভূমিকা পালন করা সম্ভব। কিন্তু যেহেতু সংসদ কে আমরা আর কখনোই সংবিধান সভা হিসেবে ক্ষমতা দিতে চাই না, কারণ এই ক্ষমতাই সংসদীয় স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি। অতএব এক্ষেত্রে অবশ্যই জাতীয় মতৈক্য প্রয়োজন যে, একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করার প্রয়োজনে কিংবা বিরাজমান সংবিধানের গণতন্ত্রায়ণের দরকারে শেষবারের মতো সীমিত সময়ের জন্য এই সংসদই হচ্ছে শেষ সংসদ যা সংবিধান সভা হিশাবে ভূমিকা পালন করবে। সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনী, পরিমার্জনা, রূপান্তর বা পরিবর্ধনের পর এই সভা সংসদীয় সভার অধিক আর কোন ক্ষমতা ধারণ করবে না এবং নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধানের কোনো পরিবর্তন সাধনের ক্ষমতাও রাখবে না। যেহেতু আগামী সংসদের বৈধতা আদতে সাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের উপর নির্ভরশীল নয়। বরং এর বৈধতার ভিত্তি হচ্ছে গণতন্ত্র বা ব্যক্তির সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থান, অতএব আগামী সংসদ যেদিন প্রথম অধিবেশনে বসবে সেদিনই সঙ্গে সঙ্গে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সকল কলাকানুন অকার্যকর হয়ে যাবে। সংবিধান সংশোধনের সময় এমন কোন ধারা, উপধারা বা অধ্যায় আর কখনোই প্রণয়ন করা যাবে না যা ব্যক্তির সার্বভৌম অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে। সংবিধান প্রণয়নের প্রশ্নে বা তার পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের সময় গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে কোনো নাগরিকের অভিযোগ থাকলে তার অভিযোগ সুপ্রিম কোর্ট গ্রহণ করবে এবং বিচার করে দেখবে।

সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ সকল আন্দোলনের সংস্থার উপর আরো বড় দায়িত্ব এসে পড়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে এবং ব্যক্তির সার্বভৌমত্বকে সাংবিধানিক রূপ দেবার জ্ন্যে জাতীয় ঐক্যমত গড়ে তোলার কাজ একমাত্র আন্দোলনের সংস্থাগুলোর দ্বারাই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। নির্বাচনের আগে সকল গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে এই বিষয়ে লিখিত মতৈক্য যে করেই হোক প্রতিষ্ঠা করা উচিত এবং জনগণের মধ্যে এই মতৈক্যের প্রকাশ্য প্রচারের ব্যবস্থা করা দরকার। যদি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়বার প্রশ্নে জাতীয় মতৈক্য নির্বাচনের আগে প্রতিষ্ঠিত না হয় এবং এই জাতীয় সমঝোতা ছাড়া নির্বাচন হয়ে যায় তাহলে তা হবে সারা দেশ ও জতির জন্যে একটি চরম বিপর্যয়।

যদি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিগুলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এই সকল মৌলিক প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড়ো দলগুলোকে রাজি করিয়ে নেবার শর্ত সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে এই মুহূর্তে জাতীয় সরকার গঠনের আহ্বান বোধহয় খুব সমীচীন কোন আহ্বান নয়। এই দলগুলো নির্বাচনের জন্যে পুরো মাত্রায় প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং নির্বাচন যদি তারা দিতে পারে তাহলে সরকার গঠনের অধিকার তাদের রয়েছে। জাতীয় সরকারের আহ্বান তাদের বহুদিনের লালিত আকাঙ্ক্ষার সম্পূর্ণ বিরোধী এবং যারা এ ধরনের প্রস্তাব দেবে তাদেরকে বড় দলগুলো খুবই সন্দেহের চোখে দেখবে। তাছাড়া বাম দলগুলো থেকে যদি এই প্রস্তাব আসে তাহলে তা পরোক্ষভাবে এইসব দলের কাছে এটাই আসলে প্রমাণ করবে যে যাদের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যাবার মুরোদ নেই তারাই এখন জাতীয় সরকারের বেহুদা ধুয়ে তুলছে এর উদ্দেশ্য জাতির স্বার্থ রক্ষা নয় বরং দু-একজনের মন্ত্রী হবার খায়েশ মেটানো। আগামীতে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে সেই নির্বাচনের জন্যই কি বাম দলগুলো ইতাল আওয়ামীলীগ বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন করেনি? এই নির্বাচন-নির্বাচন খেলাটাই বামরা বুর্জোয়া দলগুলোর সঙ্গে এতোকাল খেলে এসেছে। এই খেলাটা তাদের উপর এখন প্রতিশোধ নেবে, তবুও এখন এই খেলা থেকে পিছুটান দেয়াটা হবে খুবই কাপুরুষতার লক্ষণ। আশা করি বাম দলগুলো এই লজ্জাকর প্রস্তাব ত্যাগ করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র করবার জন্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সর্বস্তরে সংবিধান ও অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের একটি জাতীয় সমঝোতা গড়ে তুলবার কাজকেই এখনকার একমাত্র কাজ বলে গণ্য করবে এবং সাথে সাথে জাতীয় সমঝোতা গড়ার দরকারে আন্দোলনের সংস্থাগুলোকে জীবিত রাখার প্রয়োজনীয়তা বারবার তুলে ধরবে।

জাতীয় সমঝোতা যদি সত্যি সত্যি গড়ে ওঠে তাহলে মতের ঐক্য গড়ে তুলবার ফলাফল হিসাবে একটি জাতীয় সরকার হয়তোবা গড়ে উঠতেও পারে। গড়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মৌলিক প্রশ্নে সমঝোতার বিষয়টিকেই এখন মুখ্য করতে হবে, জাতীয় সরকারের বেহুদা স্লোগান তুলে মূল বিষয়কে আড়াল করা হবে এখন খুবই ক্ষতিকর একটা কাজ।

গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিগুলো দুটো বড় দলের মধ্যে কার কাছ থেকে জাতীয় সমঝোতা গড়ার প্রশ্নে সম্ভাব্য সাড়া পেতে পারে তার একটা হিসাব নেয়া দরকার। প্রথমেই আওয়ামী লীগের কথা বলি। আমি এর আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কথা বলেছি। কারণ আমার মনে হয়েছে আওয়ামী লীগ যে শ্রেণীর রাজনৈতিক প্রতিনিধি তাদের জন্য শেখ হাসিনা সবচেয়ে যোগ্য এবং কার্যকর নেত্রী। এই শ্রেণীর মধ্যে প্রধানত রয়েছে ব্যবসায়ী ও ইন্ডেন্টার, গ্রামের মাতব্বর ও মহাজন, আমলাদের একাংশ, গ্রামের মাঝারি থেকে ধনী কৃষক ইত্যাদি। রাজনৈতিক চেতনার দিক থেকে এই সকল শ্রেণীর বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বোধ এখনও অবিকশিত, পশ্চাদপদ ব্যক্তিনির্ভর সামন্তীয় মানসিকতা এদের মধ্যে প্রবল। সেটা বোঝা যায়, ব্যক্তি শেখ মুজিবকে কেন্দ্র করে অতিমাত্রার আবেগ ও উচ্ছ্বাস এবং সংগঠন করবার ক্ষেত্রে দল ও নেত্রীর প্রতি অন্ধ আমি আনুগত্য চর্চাকে প্রধান করে তোলার লক্ষণ দেখে। তদুপরি প্রতিহিংসা পরায়ণতার মধ্যেও এইসব শ্রেণীর পশ্চাৎপদ চেতনা ধরা পড়ে। হাসিনার গুণ হচ্ছে তিনি এদের বুঝতে পারেন এবং রাজনৈতিকভাবে এদের নিয়ে খেলতে জানেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের বর্তমান ক্রান্তিকালে একজন অগ্রসর গণতান্ত্রিক বুর্জোয়ার মতো জাতির নেত্রী হয়ে ওঠার চেয়ে এদেরই নেত্রী হয়ে থাকা ছাড়া শেখ হাসিনার পক্ষে তার দলকে ধরে রাখার বিশেষ কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশের নেতা হয়ে ওঠার চেয়ে তার সাধনা হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রাণের নেত্রী হয়ে ওঠা। এটাই অনেকের চোখে শেখ হাসিনার দলীয় সংকীর্ণতা আকারে প্রকাশ হয়ে পড়ে।

অতএব জাতীয় প্রশ্নে শেখ হাসিনা ও তার দলের সমঝোতা আদায় করা বেশ কঠিন হতে পারে। এক্ষেত্রে সম্ভবত ধৈর্য ও সহনশীলতার প্রয়োজন হবে। এবং শেখ হাসিনাকেও বুঝিয়ে বলার দরকার পড়বে যে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতে এসে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে কেউ তাকে বাগড়া দেবে না। কিন্তু তিনি যদি মৌলিক জাতীয় প্রশ্নে একটা সমঝোতায় না আসেন তাহলে এরশাদশাহীর মতো তিনি তার আওয়ামী লীগসহ তাসের ঘরের মতোই দুদিনে ভেঙ্গে যাবেন। জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধাচরণ বাংলাদেশে করা সত্যিই এখন কঠিন। আশা করি তার পিতার ত্রুটি থেকেও তিনি অনেক কিছুই এখন শিখেছেন।

এই আন্দোলনে একজন সত্যিকারের জাতীয় নেত্রী হিসেবে ক্রমান্বয়ে যার উদ্ভব ঘটেছে, তিনি হচ্ছেন খালেদা জিয়া। খালেদা এটা অন্তত প্রমাণ করেছেন তিনি এক কথার মানুষ এবং নীতির প্রশ্নে তার দৃঢ়তার কোন জুড়ি নেই। তার বিকাশ হয়েছে ধীরে ধীরে, ঠেকে ঠেকে তিনি শিখেছেন। এবং এতোদিনে তিনি অনেকের এই বিশ্বাস জাগ্রত করতে পেরেছেন যে, নিজের দলের চেয়ে দেশের স্বার্থ তার কাছে অনেক বড়ো। বিপুল তরুণ সমাজকে ঠিক এই কারণেই তিনি আকৃষ্ট করতে পেরেছেন। তদুপরি জনগণ যখন ঐক্যের জন্যে আকাঙ্খিত হয়ে উঠেছিল তখন ঐক্যের জন্যে তার ঔদা্ররযের কোনো ঘাটতি ঘটে নি। জনগণ তা দেখেছে।

অপরদিকে রাজনৈতিক দিক থেকে প্রথমদিককার বিশৃঙ্খলা কাটিয়ে ধীরে ধীরে তিনি অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন লক্ষ্য করা যায়। প্রথমে এটা বোঝা গিয়েছিল যখন জামায়েতে ইসলামীর কাছ থেকে তিনি দূরে সরে আসার চেষ্টা করেছিলেন। ফলে বাম দলগুলোর সঙ্গে সঙ্গত কারণে তার একটা সখ্য গড়ে উঠেছে। তার অপেক্ষাকৃত পরিণত রাজনৈতিক মনের পরিচয় পাওয়া যায় যখন তিনি আমানুল্লাহ আমানকে ডাকসুর ভিপির জন্য মনোনীত করেছিলেন। অস্ত্রবাজি নয়, সাংগঠনিক ও আদর্শিক শক্তিই যে রাজনীতির প্রাণ এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে এই প্রচ্ছন্ন উপলব্ধি সম্ভবত নিহিত। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রাজনীতিকে বদলে দিয়েছে। বিএনপির মধ্যেও রূপান্তর এনেছে দেশকে বিশেষত ছাত্রসমাজকে একজন তরুণ রাজনৈতিক নেতা উপহার দেবার জন্যে তিনি প্রশংসা পাবার যোগ্য নিঃসন্দেহে। নিরু-অভিকে তিনি যেদিন বহিষ্কার করলেন সেদিন তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতাও প্রমাণিত হয়েছে। অতএব আমার ধারণা গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তি আরো বহুদূর খালেদা জিয়া ও বিএনপির সঙ্গে যেতে পারবে এবং একটি আধুনিক অগ্রসর ও বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সম্মান করে এমন একটি দল হিসাবে গড়ে উঠবার জন্যে বিএনপির মধ্যে যে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলছে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির সংস্পর্শে এলে তা ত্বরান্বিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ধরনের একটি দল ইতিহাসের বর্তমান পর্যায়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার সম্ভাবনাই বেশি। এটা আরো বেশি মনে হবার কারণ হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবার মত কিম্বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে একাই বিকশিত করে তোলার মতো ক্ষমতা সম্পন্ন বিপ্লবী শক্তি বাংলাদেশে এখনো গড়ে ওঠেনি এবং গড়ে ওঠার আগে বিএনপির মতো দলের ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্ভবত বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু সে ভূমিকা পালন করতে হলে বিএনপিকেও এ দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির ভাষা বুঝতে হবে। খালেদা জিয়া যদি বুদ্ধিমান হন তাহলে এই শক্তিকে খুবই সফলভাবে তিনি তার মিত্র হিশাবে ব্যবহার করতে পারবেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ব্যাপক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীকেও তার পেছনে পাবেন।

এদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা খালেদা জিয়া বুঝতে পারছেন কিনা এবং গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির ভাষা তার কাছে কতটুকু পরিষ্কার সেটা বোঝা যাবে জাতীয় সমঝোতার ক্ষেত্রে তার আগ্রহ, ভূমিকা ও পদক্ষেপের ওপর। এটা নিঃসন্দেহে যে, তিনি দেশের গণতান্ত্রিক জনগণকে অনায়াসেই জয় করতে পারবেন যদি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা আন্দোলনের বিগত দিনগুলোর ভূমিকার মতোই দৃঢ়চিত্ত হয়।

একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলবার জন্যে একটি জাতীয় সমঝোতা গড়ে উঠুক এটাই এখন গণতান্ত্রিক জনগণের কাম্য।

৫ পৌষ, ১৩৯৭।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।