দখলদারদের বিরুদ্ধে ঐক্য চাই, ফাঁদে পা দেবেন না


ফরহাদ মজহারের এই নিবন্ধগুলো এক-এগারোর সময়কালে বিভিন্ন সময়ে লেখা। এক-এগারোর সময়কাল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে পরের বছর ২০০৮ সাল জুড়ে। নিবন্ধগুলো ২০০৮ সালের রাজনৈতিক ঘটনা-ঘটনের পটভূমিতে বসে সমসাময়িক সময় ও প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা। ফলে ইতিহাসের বাস্তব ও সুনির্দিষ্ট উপাদানে ভরপুর। তবে এটা কেচ্ছাকাহিনীর মতো বলে যাওয়া কোনো বিবরণ নয়। বরং তার মধ্য দিয়ে মূলত বাস্তবতা ও বাস্তব ঘটনাঘটনের প্রতি তাৎক্ষণিক পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করা হয়েছে। এই লেখালিখিগুলো বাংলাদেশের রাজনীতির ময়দানে নতুন বয়ান ও মতামত হাজির করেছে, রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে। ফলে আমরা লেখাগুলিকে খোদ এই ইতিহাসের প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবেই পড়তে পারি। এই লেখাগুলি আমরা চিন্তার পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করছি যাতে পাঠক আজকের পরিস্থিতে বসে সেসময় কে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কিভাবে নিচ্ছিলো তার প্রতি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার করে নিতে পারেন।


 

বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার রিট আবেদন খারিজ করে দেয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতি ও আইনের পার্থক্য, সীমা ও এখতিয়ার সংক্রান্ত বেশ কিছু তর্ক বেশ জবরদস্ত কায়দায় তুলবার সুযোগ আদালত আমাদের করে দিয়েছেন। যেমন, প্রশ্ন উঠেছে, কোনো দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয় আদালত মীমাংসা করে দিতে পারে কিনা। মূর্খও বুঝবে, না, এটা আদালতের এখতিয়ার নয়। বিএনপি'র সংস্কারপন্থীরা যদি তাদের দল ও দলের চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে সেই বিশ্বাসঘাতকতার মীমাংসা আদালত কী করে করবে? সংস্কারওয়ালারা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যোগসাজশে খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে উৎখাত করার ফন্দি এঁটে থাকলে আদালতের সেখানে কী করার থাকতে পারে? যদি তারা পরাশক্তির সমর্থনে টিকে থাকা ক্ষমতাসীনদের সহযোগী হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ গণতান্ত্রিক জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শত্রুশিবিরে অবস্থান নেয় বাংলাদেশের আদালতের এই ক্ষেত্রে কি কিছু করার আছে? কিছুই করার নাই। পত্রপত্রিকায় বেগম খালেদা জিয়ার রিট মামলা খারিজের খবর যেভাবে ছাপা হয়েছে তার মর্মকথা এইভাবেই প্রচারিত হচ্ছে। বেশ।

কিন্তু ভুলে যাওয়া উচিত নয় বিচারকরা আমাদের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার রক্ষা করার জন্য শপথ নিয়েছেন, আবার আদালতই ক্রমাগত সেই অধিকারকে অবজ্ঞা করছে বলে দেশে-বিদেশে এখন অভিযোগ উঠেছে। খুবই লজ্জার কথা! বিচার বিভাগ 'পৃথক' হয়েছে বলে শুনেছি। তাই কি? বরং আমাদের মধ্যে এ সংশয় দানা বাঁধছে যে আদালত নানাভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। যদি এমন হয় তাহলে বিপদ অপরিসীম। তাঁরা ক্ষমতাসীনদের অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় আসা ও ক্ষমতায় থাকা উভয়কেই কিভাবে বিচার করবেন? ফলে আদালতে রিট মামলা করা আদৌ খালেদা জিয়ার উচিত ছিল কিনা সেই প্রশ্ন তোলা যায়। আমি মনে করি, কাজটা ভয়ানক বোকামি ও রাজনৈতিক দিক থেকে বিপজ্জনক হয়েছে। এই সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ এখন যে মাত্রায় পৌঁছেছে সেখানে যদি কমতি ঘটত এই রায় খালেদা জিয়ার মারাত্মক ক্ষতি করতে পারত। এখন অবশ্য এই রায়কে জনগণ সন্দেহের চোখে দেখবে। ভাগ্য বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি সুপ্রসন্নই বলতে হবে।

এই রিট রাজনৈতিক দিক থেকে ভুল পদক্ষেপ। তবে এর যদি কোনো ভাল দিক থাকে সেটা হচ্ছে এই সত্য প্রমাণ করা যে ক্ষমতাসীনদের অধীনতায় যে আইন ও জরুরি অবস্থার অধীনে যে খোঁড়া ও পঙ্গু সংবিধান তার পরিমণ্ডলের মধ্যে কোনো ইতিবাচক রাজনৈতিক মীমাংসা অসম্ভব। এই বাস্তবতায় মীমাংসা একমাত্র জনগণের আদালতেই হওয়া সম্ভব। অর্থাৎ রাজপথে। অন্য কোথাও নয়।

এখানেও আবার রাজনীতি ও আইনের সম্পর্কের প্রশ্নটা চলে আসে। সম্পর্কটা আসলে কী? রাজনীতি যদি জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্প মূর্ত করে তোলার প্রক্রিয়া হয় এবং এই অর্থে রাজনীতি যদি গণতান্ত্রিক ক্ষমতা নির্মাণের উপায় ব্য ক্ষেত্র হয়ে থাকে তাহলে বিদ্যমান আইন, সংবিধান বা আদালত গণতান্ত্রিক ক্ষমতার ঊর্ধ্বে ঐশ্বরিক কোনো ব্যাপার নয়, হতে পারে না, হয় না। জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা ও সংকল্পের সঙ্গে আদালতের যখন দূরত্ব তৈরি হয় তখন সেটা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। একই সঙ্গে তা জনকল্যাণও আনবে না। সাধারণ মানুষ এই সত্য জানে যে ক্ষমতাসীনরা বিএনপিকে বিভক্ত করেছে। বিএনপির বিরুদ্ধে জনগণের হাজারো অভিযোগ আছে, হয়তো নির্বাচনে বিএনপিই হারত। কিন্তু পরাশক্তি ও তাদের এই দেশীয় সহযোগীদের ‘মাইনাস টু’ নামক নকশা অনুযায়ী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে বলপ্রয়োগ করে চিরতরে উৎখাত করবার খায়েশ জনগণ মেনে নেয় নি। আদালতের রায়কে জনগণ বিচারক বা আইনজীবীদের চোখ দিয়ে নয়, পড়বে রাজনীতির হিশাবনিকাশ দিয়ে। গণরাজনৈতিকতার বিপরীতে আইন ও আদালতের অবস্থান সবসময়ই বিপজ্জনক। এগারোই জানুয়ারি ২০০৭ সালে বাংলাদেশ দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। একদিকে পরাশক্তি, বহুজাতিক কম্পানি এবং দেশে তাদের সহযোগী গোষ্ঠী— যেমন, তথাকথিত সংস্কারপন্থী রাজনৈতিক নেতা, সুশীল সমাজ, অতি চেনা হাতে গোনা দুই একটি সংবাদপত্র ও টেলিভিশন ইত্যাদি। এরা বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বানাতে চায়, আংশিক সফলও হয়েছে বলতে হবে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও ইসলামি জঙ্গিবাদের ছুতা দেখিয়ে সরাসরি ভারত-মার্কিন-ইসরায়েলী নিয়ন্ত্রণের অধীন করতে চায়। আর অন্যদিকে এদের বিপরীতে আছে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গণতান্ত্রিক জনগণ।

কেন গণরাজনৈতিকতার বিপরীতে আইন ও আদালতের অবস্থান বিপজ্জনক? যদি জনগণ আদালতের রায় না মানে তাহলে সামরিক বাহিনী ও পুলিশ দিয়ে কি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে রায় মানতে রাষ্ট্র বাধ্য করতে পারে? পারে না। আদালত আইনী বা সাংবিধানিক দিক থেকে এই রায়ে ঠিক করেছেন কি বেঠিক করেছেন সেটা জনগণের রাজনৈতিক বিচারে কূটতর্ক বলেই গণ্য হবে। বাংলাদেশের বর্তমান বিপর্যয়ের দিক থেকে সেই তর্ক অর্থহীন। কিন্তু কেউ করতে চাইলে অবশ্যই প্রমাণ করা সম্ভব যে সংবিধানের নির্বাচন কমিশন জনগণকে মানের তৃতীয় ভাগের দ্বারা অর্পিত অধিকার থেকে বঞ্চিত করবার জন্যই বিভক্ত বিএনপির সেই অংশকেই তথাকথিত সংলাপে ডেকেছে যে অংশ ক্ষমতাসীনদের বশংবদ। অন্যদিকে যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার কোনোই এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের নাই, সেই সব বিষয় সম্পর্কে জাতীয় সংসদের বাইরে সিদ্ধান্ত নেবার জন্যই এই তথাকথিত ‘সংলাপ’ নামক তামাশার বাহানা। এই সংলাপের উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধু তাদেরকেই নির্বাচন করবার সুযোগ করে দেওয়া বা পথ প্রশস্ত করা যারা নির্বাচিত হয়ে এসে ক্ষমতাসীনদের অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতারোহণ, ক্ষমতায় থাকা ও অসাংবিধানিক সকল কার্যকলাপের ‘বৈধতা’ দিতে পারে। এটা কি তাহলে আদৌ নির্বাচন হবে? নাকি হবে অবৈধ ক্ষমতারোহণ ও ক্ষমতায় থাকাকে বৈধতা দেবার প্রক্রিয়া। ঠিকই, নির্বাচন কমিশন নির্বাচন করতে চায় না, ক্ষমতাসীনদের জন্য। বৈধতা তৈরির প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে চায় মাত্র। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য যেসব নিয়মকানুনের প্রস্তাব করা হচ্ছে তার কতটা নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার আর কতটা রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নী সংস্থা বা জাতীয় সংসদের এলাকা? নির্বাচন কমিশনকে মনে রাখতে হবে জাতীয় সংসদে যে বিধিবিধান সাব্যস্ত করবার কথা, সেই বিধিবিধান জারি করবার ক্ষমতা মূলত সংবিধানে দেয়া হয় নি। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ১২৪ অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করে নির্বাচন কমিশনকে ‘বিধান’ প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়। কিন্তু সেই ‘বিধান’কেও হতে হবে, ‘সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে এবং সংসদের 'নির্বাচন সংক্রান্ত বা নির্বাচনের সহিত সম্পর্কিত’। রাজনৈতিক দলগুলোকে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে উৎখাত করা ও ক্ষমতাসীনদের বৈধতা দেবার প্রতিশ্রুতি আদায় করা ছাড়া নির্বাচন কমিশনের তথাকথিত সংলাপ নামক ব্যাপারের আর কীইবা উদ্দেশ্য থাকতে পারে? বন্দুক দিয়ে বাঘ যখন মরল না এখন খাঁচার মধ্যে তাকে আটক রাখার ফন্দি। এইসব খেলা বাংলাদেশের জনগণ ভালই বোঝে। খাঁচার দরজা ভাঙ্গার পর্যায়ে নিয়ে যাবেন না। তাতে ক্ষমতাসীনদের লোকসান হবে বেশি।

নির্বাচন সংক্রান্ত আইন বা বিধিবিধান প্রণয়নের এখতিয়ার একমাত্র জাতীয় সংসদের হতে হবে। অতএব দ্বাদশ সংশোধনীতে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও রাষ্ট্রনীতির বিরোধী। জাতীয় সংসদের বিষয় নির্বাচন কমিশনের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। নির্বাচন কমিশনের কাজ হচ্ছে সাংবিধানিক রীতিনীতি ও বিদ্যমান আইন মেনে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া। সংবিধানের সংস্কার বা সংবিধানের সংস্কার করবার কোনো প্রস্তাব দেওয়া তার এখতিয়ার বহির্ভূত কাজ। অথচ নির্বাচন কমিশন এইসব অপকর্ম করে যাচ্ছে। নির্বাচনে যে কোনো নাগরিকের নির্বাচিত হওয়ার জন্য দাঁড়াবার বা যে কাউকেই ভোট দেবার অধিকার রয়েছে। বিএনপি’র মূল অংশকে তথাকথিত ‘সংলাপ’ থেকে বাদ দেওয়ার অর্থ কি বিএনপিকে নির্বাচনে দাঁড়াবার, নিজের মত প্রচার করবার ও নির্বাচিত হবার মৌলিক অধিকার হরণ করবার প্রক্রিয়ার অংশ নয়? অবশ্যই নির্বাচনী রীতিনীতির নামে সেই মৌলিক অধিকার খর্ব করার কোনো ক্ষমতা সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে দেয় নি। যে কোনো নাগরিকের দল করা, চিন্তা ও মত প্রকাশ ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বা নির্বাচিত হবার অধিকার রয়েছে। এটা সংবিধানের তৃতীয় ভাগে দেওয়া মৌলিক অধিকার। নির্বাচন কমিশন যদি বিভক্ত বিএনপি'র দুই অংশকে চিঠি দিত তাহলে সংক্ষুব্ধ হবার হয়ত কারণ থাকত না। নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তে এই অধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা অবশ্য তৈরি হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বিএনপির সরকারপন্থী বা তথাকথিত সংস্কারবাদী অংশের সঙ্গে চিঠি দিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের বিষয়াদি নিয়ে কথা বলবে, আর তার প্রধান অংশকে এই প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেবে কেন— সেই প্রশ্ন তুলবার এখতিয়ার অবশ্যই আদালতের রয়েছে। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার প্রশ্নে আদালত নিজের দায়িত্ব এড়াতে পারে না। যাঁরা ‘সংক্ষুব্ধ’ হয়ে এই নালিশ করেছেন তাঁদের পক্ষে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের দিক থেকে বহু কিছু বলা যায়, বলার আছে। কিন্তু আদালত নিজের এখতিয়ারকে নিজেই যদি অস্বীকার করেন, আদালত আসলে জনগণকে রাজপথেই ঠেলে দিলেন। পত্রিকার খবর দেখে যতোটুকু বুঝেছি, তা হলো আইন ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকে দিকনির্দেশনা দেবার জন্য সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অবস্থান থেকে খালেদা জিয়া যে নালিশ জানিয়েছিলেন, আদালত তা অস্বীকার করেছে। রাজপথ ছাড়া রাজনৈতিক বিষয়ের মীমাংসা আর সম্ভব নয়। অতএব আদালত যে রায় দিয়েছেন, সেটা এখন আর আদালতের রায় বলে জনগণ বিবেচনা করবে না। একে তারা পরাশক্তি বা দখলদারদের রাজনীতি বাস্তবায়নেরই আরেকটি পদক্ষেপ বলে গণ্য করবে।

এই রায় গণতান্ত্রিক ক্ষমতা নির্মাণের যে আন্দোলন-সংগ্রাম– যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া– অর্থাৎ যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের ইচ্ছা ও সংকল্পের সার্বভৌম শক্তি প্রদর্শন করে তার সঙ্গে বিদ্যমান সংবিধান, আইন, আদালত ইত্যাদির সম্পর্ক বিষয়ে আমাদের নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করবে। খবর কাগজে দেখেছি, আদালত খালেদা জিয়ার রিটের সূত্র ধরে বলছেন, ‘বিএনপির অভ্যন্তরীণ’ রাজনীতি এই রিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কাজেই এই বিষয়ে আদালত কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। আমি রিট বা আদালতের কাছে চেয়ারপারসনের নালিশ কিংবা রায় কোনোটিই দেখি নি। পত্রিকাই আমার একমাত্র সূত্র। ফলে রিটের মর্ম কিংবা রায়ের তাৎপর্য নিয়ে পুরোপুরি আলোচনার সুযোগ এখানে নাই। ‘বিএনপির অভ্যন্তরীণ’ রাজনীতি নালিশে থাকলে অসুবিধা কোথায় একমাত্র আইন বিশেষজ্ঞরাই সেটা বুঝবেন। আমরা মৌলিক নাগরিক অধিকার নিয়ে শংকিত। এই রায় নির্বাচন কমিশন নাগরিকদের নির্বাচন করবার বা নির্বাচিত হবার অধিকার লঙ্ঘন করেছে কিনা এবং লঙ্ঘন হয়ে থাকলে আদালত তা আমলে আনলেন না কেন তার জন্যই আশংকা প্রকাশ করছি।

বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার কথা বলে। তৃতীয় ভাগের দ্বারা অর্পিত অধিকারসমূহের যে কোনো একটি বলবৎ করবার জন্য প্রজাতন্ত্রের বিষয়াবলির সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো দায়িত্বপালনকারী ব্যক্তিসহ যে কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে হাইকোর্ট বিভাগ উপযুক্ত নির্দেশাবলি বা আদেশাবলি দান করতে পারেন।

এই রায়ের পরে বিএনপির রাজনীতি কোন দিকে গড়াবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। আমি আমার আগের অনেক লেখায় বারবারই বলেছি যে দুই নেত্রীর সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের আলাপ আলোচনাই বর্তমান সঙ্কট থেকে প্রস্থানের সবচেয়ে ভাল পথ। এই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের অতীতে কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা এবং জনগণের কাছে ক্ষমতা চাইবার একটা সুযোগও আমরা করে দিতে পারতাম। ক্রমে ক্রমে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে সুবিবেচক কেউ নাই। আমরা এখন সংঘাতের মুখোমুখিই কমবেশি দাঁড়াচ্ছি।

এই রায়ে খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তি খানেক বিনষ্ট হবে। এই কারণে নয় যে আদালতে তিনি হেরেছেন। বরং এই কারণে যে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় আসা শক্তির কাছে তিনি তার দলের আবর্জনা সাফ করবার জন্য দরখাস্ত করেছেন। তাকে অবিলম্বে তিনটি কাজ করতে হবে। এক নিজের ভুল খোলা মনে জনগণের কাছে স্বীকার করা এবং আগামী দিনে তিনি কী কী বিষয়ে সতর্ক থাকবেন সেটা পরিষ্কারভাবে জনগণের কাছে বলা। বলবার এখনই সময় কারণ রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে এবং জনগণ তাঁর কাছে তাঁর নিজের আত্মসমালোচনার জন্য অপেক্ষা করে আছে। তারা অন্যের সমালোচনা শুনতে রাজি নয়। জনগণের দিক থেকে বুঝতে পারি ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের কোনো 'সংলাপ' জনগণ চায় না। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও সংলাপের আর কী দরকার? এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন জনগণ মানবে কি? 'সংলাপ' করবার মুহূর্তটুকু নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। 

দুই: আবারও দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের ডাক তাঁকে দিতে হবে। তাঁর অবশ্যই আওয়ামী লীগের প্রতি এই আহ্বান জানানো উচিত যে, ক্ষমতায় এলে এই সরকারকে বৈধতা দেব- আওয়ামী লীগ যেন এই ভুল ও বিপজ্জনক নীতি থেকে সরে আসে। আগামী সংসদে ক্ষমতাসীনদের বৈধতা দেবার প্রশ্ন নিয়ে কোনো সংলাপ হতে পারে না। আশা করি আওয়ামী লীগ উপলব্ধি করবে যে এই অবস্থান তার জন্য রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর। তিনি বারবারই শেখ হাসিনার মুক্তির দাবি তুলেছেন। তাঁকে অপমানিত করা হয়েছে বলে প্রতিবাদ করেছেন এবং তাঁর স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার দাবি তুলেছেন। শেখ হাসিনা এই রাজনৈতিক অবস্থান ও ঔদার্যের কোনো সাড়া না দিয়ে সম্ভবত নিজেকে ক্ষুদ্র করেছেন। কিন্তু আমার আশা আওয়ামী লীগের কর্মীরা অন্তত এটা অনুভব করবেন যে এখন বাংলাদেশকে পরাশক্তির হাত থেকে উদ্ধার করাই আমাদের একমাত্র কাজ। এই কাজে যারাই আগে অকুণ্ঠচিত্তে এগিয়ে আসবেন তাঁরাই আগামী দিনে জনগণের কাছে বরণীয় হবে। যে কারণে আমি বারবারই কর্মী পর্যায়ে ঐক্যের ওপর জোর দিয়ে আসছি।

তিন: যদি কোনো অর্থবহ জাতীয় সংলাপ বর্তমান বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনীয় হয় তাহলে সেটা সর্বপ্রথম হতে হবে রাজনৈতিক দলের মধ্যে। অতএব রাজনৈতিক দলের মধ্যে 'সংলাপ' ও বর্তমান পরিস্থিতি থেকে নিষ্ক্রমণের লক্ষ্যে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অবস্থান নির্ণয়ের জন্য সমাজের অন্যান্য নাগরিকসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপই এখন দরকার। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের খণ্ড খণ্ড সংলাপ নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ন্যূনতম অবস্থানের প্রতি ক্ষমতাসীনদের প্রতিক্রিয়া বিচার করেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।

এই লেখা যখন প্রায় শেষ করে এনেছি তখন খবর পেলাম যে বায়তুল মোকাররমে প্রচণ্ড বিক্ষোভ হয়েছে এবং পুলিশি দমন-পীড়ন চলেছে। আমি পুলিশি বর্বরতার নিন্দা করি। নারীনীতি ভাল কি মন্দ বা তার মধ্যে কী আছে নাই এই তর্ক একদমই কূটতর্ক। রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের বর্তমান সংকট হচ্ছে দেশ আমাদের হাতে নাই, পরাশক্তি ও তাদের অভ্যন্তরীণ দালালরা এই দেশ কুজা করে নিয়েছে। তাহলে প্রথম কাজ কী করে আমরা জনগণের শাসন ফিরিয়ে আনতে পারি। দেশ পুনরুদ্ধার করতে পারি। এই সরকারের কাজ ছিল একটি নির্বাচন দেওয়া এবং গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। কিন্তু তা না করে তারা উস্কানিমূলক নীতি প্রণয়ন করেছে। ‘সুশীল সমাজের’ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে— এর সঙ্গে বাংলাদেশের নারীর সম্পর্ক কোথায়? বাংলাদেশের নারীদের নিয়ে কি এই নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। সেই নারীরা কারা? অবশ্যই সম্পত্তি ও সম্পদ ও পারিবারিক সম্পর্ক বিষয়ে আমাদের অনেক কিছু সংস্কার করতে হবে। কিন্তু সেটা কি আমরা বিদেশিদের টাকায় তাদের উস্কানিতে পা দিয়ে করব, নাকি আলাপ আলোচনা, পরস্পরকে জানা বোঝার মধ্য দিয়ে আমরা অগ্রসর হবো, যাতে সমাজে এমন কোনো বিভক্তি তৈরি না হয় যার সুযোগ পরাশক্তি নিতে পারে। নারীকে ইসলামের প্রতিপক্ষ হিশাবে ধরে নিয়ে উস্কানিমূলক নীতি অসময়ে চাপিয়ে দিয়ে পরাশক্তি কি এটাই প্রমাণ করতে চায় যে, বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিরা কতো তৎপর? তারা আফগানিস্তানের মতো নারীদের পক্ষে কোনো নীতিই বাস্তবায়িত হতে দেবে না। পরাশক্তির ফাঁদে পা দিয়ে বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বা ইরাক বানানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরি করলো নাকি নারী নীতি!

আমাদের অজান্তে আমরা কোনো পাতানো ফাঁদে পা দিচ্ছি কি? হুঁশিয়ার!!

২৮ চৈত্র ১৪১৪ ১১ এপ্রিল ২০০৮। শ্যামলী।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।