যুদ্ধ আরো কঠিন আরো গভীর


ফরহাদ মজহারের এই নিবন্ধগুলো এক-এগারোর সময়কালে বিভিন্ন সময়ে লেখা। এক-এগারোর সময়কাল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে পরের বছর ২০০৮ সাল জুড়ে। নিবন্ধগুলো ২০০৮ সালের রাজনৈতিক ঘটনা-ঘটনের পটভূমিতে বসে সমসাময়িক সময় ও প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা। ফলে ইতিহাসের বাস্তব ও সুনির্দিষ্ট উপাদানে ভরপুর। তবে এটা কেচ্ছাকাহিনীর মতো বলে যাওয়া কোনো বিবরণ নয়। বরং তার মধ্য দিয়ে মূলত বাস্তবতা ও বাস্তব ঘটনাঘটনের প্রতি তাৎক্ষণিক পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করা হয়েছে। এই লেখালিখিগুলো বাংলাদেশের রাজনীতির ময়দানে নতুন বয়ান ও মতামত হাজির করেছে, রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে। ফলে আমরা লেখাগুলিকে খোদ এই ইতিহাসের প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবেই পড়তে পারি। এই লেখাগুলি আমরা চিন্তার পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করছি যাতে পাঠক আজকের পরিস্থিতে বসে সেসময় কে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কিভাবে নিচ্ছিলো তার প্রতি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার করে নিতে পারেন।


In short, fundamentalism equals Islam equals everything-we-must- fight-against, as we did with communism during the Cold War, in fact, Pipes says, the battle is graver, more profound and dangerous with Islam. Neither Pipes nor Rodman writes as an outsider, nor as a member of a lunatic fringe. Their work is thoroughly mainstream and is intended with some realistic expectation, for the serious attention of policy makers.

—Edward Said in Covering Islam. How the Media and the Experts Determine How We See the Rest of the World. p-XIX

মওলানা-মৌলবাদীদের নাকি ‘মন’ বলে কিছু নাই। ওখানে পাথর। তাদের বড়োজোর জন্তুজানোয়ারের সঙ্গে তুলনা করা চলে, অতএব আমরা যখন ‘জনগণ’ কথাটা বলি তখন সেই ধারণা থেকে টুপিওয়ালা-দাড়িওয়ালা লোকদের এবং শুক্রবার বায়তুল মোকাররমে অবধারিতভাবে জুমার নামাজ পড়তে যারা যায় তাদের নাকি বাদ দিয়ে ভাবতে হবে— এই ধরনের তর্ক এই কিছু দিন আগেও ‘প্রগতিশীল’-দের আড্ডায় অনেককে করতে শুনেছি। অর্থাৎ মওলানা-মৌলবি-মুসল্লিদের ‘জনগণ’ গণ্য করা যাবে না। তাদের মতামতের কোনো দাম নাই, তাদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ করবারও কোনো অধিকার নাই। তাদের ধরো আর মারো আর ইসলামী মৌলবাদী বা জঙ্গী বলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দাও। এই বদ্ধমূল ফ্যাসিস্ট চিন্তা যে সমাজে বিচ্ছিন্ন দুই-একজন উন্মাদের ভাবনা, তা নয়। বাংলাদেশে নানা কারণে এই ধরনের চিন্তার আধিপত্য বাড়ছে, বাড়ার পেছনে আর্থিক ও নৈতিক প্রশ্রয় দিচ্ছে পরাশক্তি ও সাম্রাজ্যবাদ। যারা জানে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে’ টিকে থাকতে হলে এই ধরনের ফ্যাসিস্টদেরও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে টিকিয়ে রাখতে হবে। মাদ্রাসায় যেসব গরিব এতিম দারিদ্র্যক্লিষ্ট শিশুরা পড়তে যায় তারা নাকি সকলে একেক জন ‘সন্ত্রাসী’ দানব হয়ে বেরিয়ে আসে। যাদের কাজ হচ্ছে মানুষের রগ কাটা। সভ্যতাকে প্রাগৈতিহাসিক পর্যায়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। অতএব মাদ্রাসাগুলো হয় বন্ধ করে দাও অথবা ‘যুযোপযোগী’ বা ‘আধুনিক’ করে তোলো। অর্থাৎ মাদ্রাসাকে পরাশক্তির চাকরবাকর বা ও সাম্রাজ্যবাদের গোলাম তৈরির কারখানা বানাও। এই সকল ফ্যাসিস্টরা নিজেদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে পরিচয় দাখিল করে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা আর ফ্যাসিজম সমার্থক নয়। ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশধারী ফ্যাসিস্ট শক্তির মুখোশ উন্মোচন করে দেবার সময় এসেছে। যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি ও অনেক সতর্কতার সঙ্গে ফ্যাসিজম, নাস্তিকতা, ধর্মের খেয়ে না খেয়ে বিরোধিতা এবং সর্বোপরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি বাস্তবায়নের মতাদর্শ থেকে আলাদা করে পাশ্চাত্যের সুনির্দিষ্ট ইতিহাসের আলোকে এর ইতিবাচক তাৎপর্য রক্ষা করতে চান তাঁদের জন্য এটা খারাপ সময়।

আমি ‘পাক্ষিক চিন্তা’ নামে একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। পাক্ষিক চিন্তার ‘সন্ত্রাস’ সংখ্যায় কোরআন পাঠরত কিশোরদের ছবি ছাপিয়ে এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হয়েছে। প্রমাণ করতে হয়েছে আমাদেরই যেসব সন্তান সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়ে মাদ্রাসায় পড়ে, তারা আসলেই ‘মানুষের বাচ্চা’, কোনো দানবের ঔরসজাত জন্তু নয়। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী ধ্যানধারণায় গড়ে ওঠা শহুরে শিক্ষিত গোলামদের আপত্তিটা আসলে কী? কারণ তাদের মা দেশি-বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপনে মাথা ধোলাই করে ‘ম্যাগি পাকা রাঁধুনী’-র মতো চটপট তাদের নুডলস করে খাওয়াতে পারে না। পাঠক, বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপনগুলো লক্ষ করবেন। যেখানে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণই দুঃসাধ্য, সেখানে ম্যাগি নুডলস খাওয়া কিভাবে সম্ভব। প্রধান সেনাপতি এখন আমাদের আলু খাওয়া শেখাচ্ছেন। সেটাও আবার যেখানে-সেখানে নয়। রীতিমতো একটি পাঁচতারা হোটেলে। ক্ষুধার্ত মানুষের পেটের জ্বালা নিয়ে তামাশা করার কতোটা নিষ্ঠুর জায়গায় পৌছাতে পারে ক্ষমতাবান ও অভিজাতদের এইসব প্রচারণা তার প্রমাণ। ইউনিলিভার কোম্পানিসহ নানান কোম্পানি যাদের স্টার বানাচ্ছে— যেমন, বৃষ্টিতে বা বাথরুমে কিশোরী মেয়েদের ভেজা শরীর দেখিয়ে লাক্সের বিজ্ঞাপনের ‘মডেল’ বা ‘স্টার’ হবার সুযোগও গরিব মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীদের নাই। গরিব মেয়েগুলো ক্যাটওয়াক শিখে মডেল হতে পারবে না। মেসওয়াকের বদলে তারা ‘পেপসোডেন্ট’ ব্যবহার করে দাঁত ঝকঝক করে তুলতে পারবে না। টেলিভিশানের কাঁচের বাক্সে রাক্ষসদের দাঁত মুক্তার মতোই ঝলসায়। তাদের পিপাসার পানি কখনই পেপসি, কোকাকোলা বা আইয়ুব বাচ্চুর ‘টাইগার’ হওয়ার সম্ভাবনা নাই। তাদের সুপেয় পানি নাই। যে পানি আছে তা ইতোমধ্যেই আর্সেনিক ও অন্যান্য বিষে বিষাক্ত। মোবাইল কোম্পানিগুলো ডিজুস বিজ্ঞাপনে জিনস আর টাইট পায়জামা পরিয়ে তাদের দিয়ে ডিসকো নাচ নাচিয়ে নিতে পারবে না। অতএব এই সব পোলাপান অবশ্যই বহুজাতিক কোম্পানি ও পরাশক্তির কাছে ‘বর্জ্য’ মাত্র। ডিসপোজেবল।

গ্রামের গরিব কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষ, শ্রমিক-মজুরের সন্তানেরা কৃষকের বুকের ধন শস্যবীজ লুট করে নিয়ে গিয়ে হাইব্রিড-জিএম বীজের ব্যবসা করে না। তাদের আত্মীয়-পরিজনদের কেউই নাইকো-শেল-ইউনোকলের কাজে মাটি-জংগল-জীবন বন্ধক দেয় না। তবু এরাই বিপজ্জনক। পাক্ষিক চিন্তার ‘সন্ত্রাস’ সংখ্যায় কেন মওলানা-মৌলবি-মাদ্রাসার ছাত্র এবং মসজিদ-মাদ্রাসা সাম্রাজ্যবাদীদের টার্গেট সেই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে পৃথিবীকে নতুন করে গড়বার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ‘সন্ত্রাস’ ব্যাপারটির বিচার স্বনামধন্য দার্শনিক ও চিন্তাশীল ব্যক্তিরা কিভাবে করছেন তাদের লেখা অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করে ‘প্রগতি’ কথাটার মানে আমরা এই সংখ্যায় পাঠকদের বোঝাবার চেষ্টা করেছি। আগ্রহী পাঠককে অবশ্যই এই সংখ্যাটি পড়বার অনুরোধ জানাব। কারণ, আমি এখানে এখন যা লিখছি তার কিছু জ্ঞানগত ভিত্তি বা বিশ্লেষণ সূত্র তাঁরা পাক্ষিক চিন্তার ‘সন্ত্রাস’ সংখ্যায় পাবেন।

প্রগতিশীলতার নামে ফ্যাসিবাদ বা প্রকট প্রতিক্রিয়াশীলতার ঘটনা নতুন কিছু নয়। আমরা যাদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বা ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী’ বলে জানি, তার মূল প্রবণতা ফ্যাসিবাদের দিকে। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা প্রধানত খেয়ে না খেয়ে ইসলামবিরোধী, অতএব আপাদমস্তক সাম্প্রদায়িক এবং একই সঙ্গে ফ্যাসিবাদী। অতএব এই ধারার সঙ্গে এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের লড়াই অনিবার্য। পরাশক্তি ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই মানে বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই, যারা ইসলাম ও ইসলামপ্রধান জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামাজ্যবাদের তরফে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ও সেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তাদের গণমাধ্যমগুলোই তার প্রমাণ। আজ হোক কাল হোক এই লড়াই হবেই এই কথা আজ নয়, আমি বহু বছর থেকে বলে আসছি। একে এড়িয়ে যাবার কোনো মতাদর্শিক, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ নাই। কিন্তু এই লড়াইয়ে এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ভয়াবহভাবে মার খেয়ে যাবে যদি ফ্যাসিবাদ হিশাবে চিহ্নিত না করে এদের 'ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী' বলে লড়াই করবার ভুল রণনীতি ও রণকৌশল গ্রহণ করা হয়। এরা ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকপ্রাপ্ত অর্থে মোটেও সেক্যুলার নয়, যার অনুবাদ (ভুলভাবে) আমরা সাধারণত 'ধর্মনিরপেক্ষ' বলে থাকি। মূলত এরা জর্জ বুশ ও ব্রাউনের আণ্ডা- বাচ্চার অধিক কিছুই নয়। এদের সঙ্গে ঠিক সেইভাবেই আচরণ করা বিধেয়। এদের কাজই হচ্ছে ইসলাম ও ইসলামপ্রধান জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো এবং এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে ইরাক ও আফগানিস্তানের মতো আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তি বাংলাদেশকে একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে পারে। কারণ ইসলাম যদি বর্বরদের ধর্ম আর মুসলমান মাত্রই বর্বরের বাচ্চা হয়, তাহলে সভ্যতা রক্ষার খাতিরে এইসব আবর্জনা সাফ করা পরাশক্তির একটা কর্তব্য হয়ে ওঠে, নয় কি? এই সাফসুতরোর কাজই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্তত যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদেরই সাঙ্গোপাঙ্গরা বাংলাদেশে 'ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী' বলে মুখোশ এঁটে থাকে। এদের মুখোশ খসিয়ে এদের ফ্যাসিবাদী চেহারাটা দেখিয়ে দেওয়াই এখন আমাদের কাজ। এদের বীভৎস চেহারা অবশ্য ক্রমেই চেনা যাচ্ছে। এদের 'ধর্মনিরপেক্ষ' বলা বা সাপকে ফুলের মালা বলা একই কথা।

বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বা ইরাকে যদি আমরা পরিণত করতে না চাই তাহলে পরাশক্তি ও সাম্রাজ্যবাদের দালাল ও গোলামদের ফ্যাসিবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন করে তোলা এবং লড়াইয়ের সঠিক নীতি ও কৌশল সম্পর্কে ভাবা এখন অতি আবশ্যিক ও আশু কর্তব্য। দেয়ালের লেখন ফুটে উঠছে দ্রুত। ইউরোপ চার্চকে রাষ্ট্র থেকে যে ঐতিহাসিক কারণে আলাদা করতে বাধ্য হয়েছে, সেটা শুধু 'ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নামক মতাদর্শিক কারণে ঘটে নি. বরং ঐতিহাসিক বাস্তবতার অভ্যান্তরীণ, টানাপড়েন বা মার্কসীয় ভাষায় যাকে শ্রেণী সংগ্রাম বলা হয়, জনগণের সেই লড়াই-সংগ্রামের ঐতিহাসিক ফল। এই দিকটা ভুলে গিয়ে ইতিহাসের অন্ধকার গর্ভের দিকে যেন আমরা আবার পা না বাড়াই। সেক্যুলারিজমের বয়ানটা কেন কিভাবে ঐতিহাসিক কারণে তৈরি হয়েছে? তার সঙ্গে ইসলাম ও ইসলামপ্রধান সমাজগুলোর ঐক্য ও বিরোধের জায়গাগুলো আসলে কী সেই বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনা বাংলাদেশে নাই বললেই চলে। অন্য দিকে ধর্মতত্ত্বের চোখ দিয়ে ইতিহাস বিচার চলে না, বিশ্ব ইতিহাসের বিচারের আলোকেই ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহাসিক ভূমিকা বুঝতে হবে।ধর্ম ও রাষ্ট্রের ফারাকের ওপর দাঁড়িয়ে যে আাধুনিক রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে, তার সীমা ও সম্ভাবনা এবং সেই ফারাকের ধারাবাহিকতা সম্পর্কে যে সকল জ্ঞানগর্ভ তর্ক-বিতর্ক আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে তার সঙ্গে আমাদের পরিচিত হয়ে ওঠা খুবই জরুরি। এই কালের দার্শনিকদের অনেকেই দাবি করছেন আদর্শ রাষ্ট্র মাত্রই 'ধর্মনিরপেক্ষ' হবে তার পক্ষে কোনো যুক্তি নাই। বড়জোর বলা যায় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের উদয় একটি ঐতিহাসিক ঘটনা মাত্র। আগামী দিনের রাষ্ট্র পাশ্চাত্যকেই অনুকরণ করবে তা অনিবার্য প্রমাণ করা অসম্ভব। ধর্মতত্ত্বের জায়গা থেকে ইসলামের এই প্রসঙ্গে অনেক কিছু বলার থাকতেই পারে। থাকতে পারে ইসলামের দর্শনের দিক থেকেও। ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শন, বলাবাহুল্য আলাদা ব্যাপার। মওলানা-মাশায়েখরা অবশ্যই ধর্মতত্ত্বে প্রাজ্ঞ হতে পারেন, কিন্তু ইসলামের ভাবকথা বা দর্শন তাঁরা মানুষসহ সকল সৃষ্টির জন্য ‘রহমত’ হিশাবে ব্যাখ্যা করতে নাও পারেন। যে কারণে এই ধরনের ব্যাখ্যা প্রায়ই মুসলমান সম্প্রদায়ের দাবি হয়ে ওঠে, জ্ঞানের সার্বজনীন রূপ হয়ে উঠতে পারে না। এই কাজ করতে হলে পাশ্চাত্য দর্শন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার এবং ইসলামের মৌলিক দার্শনিক প্রস্তাবনা তুলনামূলক বিচারে হাজির করবার চর্চাও দরকার। এই চর্চা আমরা বাংলাদেশে এখনও শুরু করি নি বলা যায়। সার্বজনীন জ্ঞানের সভায় ইসলামের নিজের কিছু প্রস্তাব নিশ্চয়ই আছে, সেই ইতিবাচক দিকনির্দেশনা যদি ইতিহাসের একটা প্রগতিশীল অভিমুখ স্থাপন করতে সক্ষম হয়, তার সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের মৌলিক কোনো সংঘাত নাই, থাকতে পারে না। সমস্যাটা ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে ইসলামের নয়- সংঘাতটা ফ্যাসিবাদ ও পরাশক্তির বরকন্দাজদের সঙ্গে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের। আর্থ-সামাজিক ইনসাফ ও শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে জনগণ নিজের ধর্ম ও বিশ্বাসের মধ্যে লড়াইয়ের নীতি ও কৌশলের প্রেরণা অন্বেষণ করে, ইতিহাসে এর ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের শোচনীয় পরাজয় এবং বাংলাদেশে কমিউনিস্ট বা বামপন্থীদের করুণ পচনের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলাম সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকায় প্রেরণা ও রসদ জোগাবে এতে বিস্মিত হওয়ার কিছুই নাই।

অন্য দিকে পাশ্চাত্য ইতিহাসে খ্রিস্টীয় চার্চের বিরুদ্ধে কৃষকদের বিদ্রোহ, সামন্তবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, প্রাকৃতিকভাবে নির্ধারিত সম্পর্কের বিলয় ঘটিয়ে ব্যক্তির বিকাশ এবং বিশ্বাস বা ঈমানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের যে কোনো এখতিয়ার নাই বা থাকতে পারে না এই ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রচিন্তা ইত্যাদির ইতিবাচক দিক সম্পর্কে আমরা জানি। প্রতিটি ইতিবাচক ক্ষেত্রে ইসলামের সঙ্গে ইতিবাচক মোকাবেলা হতে পারে। অর্থাৎ মানবেতিহাসের ইতিবাচক অর্জনের সঙ্গে মওলানা- মৌলবি-মাশায়েখদের কোনো বিরোধ থাকতে পারে না। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এই জন্যই বলতেন— যা কিছুই মানুষ ও সৃষ্টির জন্য কল্যাণকর ও রহমতস্বরূপ তারই ডাকনাম ‘ইসলাম’। ইসলামকে মানবেতিহাসের ইতিবাচক অর্জনের বিপরীতে নিয়ে যাবার কোনোই দরকার নাই, বরং ইতিহাস যেখানে এসে ঠেকেছে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আমাদের এখন আর ইসলামী ধর্মতত্ত্বে সংকীর্ণ থাকলে চলছে না। জ্ঞান-বিজ্ঞান দর্শনচিন্তার প্রতিটি শাখায় অগ্রসর চিন্তার ছাপ দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। আমাদের রোজা-নামাজ-ঈদ-জাকাতসহ সকল ধর্মীয় বিধান পালনের জন্য যেমন ধর্মতত্ত্বের প্রয়োজন রয়েছে, একই সঙ্গে বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য আমাদের ভাব বা দর্শনের চর্চার প্রয়োজন রয়েছে। সেই ক্ষেত্রে ইসলামের একটি নির্ধারক ভূমিকা আছে তা আজ দার্শনিকরাও মানেন ও স্বীকার করেন। ইসলামের কিছু ভাবগত বা দার্শনিক মৌলিক প্রস্তাবনা রয়েছে যা পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা ধ্বংস করে নতুন জগৎ তৈরির জন্য উপাদান হতে পারে। ইসলাম মানবেতিহাসের নতুন দিকনির্দেশনা দিতে পারে কি? এটা একটা চ্যালেঞ্জ আকারে নিতে হবে। যদি আমি ঠিক বলে থাকি তাহলে সম্প্রতি প্রস্তাবিত নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে যেসব ঘটনা ঘটেছে (এবং হয়তো ঘটবে) তাকে আমাদের চিন্তার স্বচ্ছ আয়নায় ফেলে বিচার করতে হবে। কিছু কিছু ভাল লেখা ইতোমধ্যেই পত্রিকায় এসেছে। আজ আমি এ প্রসঙ্গে যাব না। আজ শুধু এডওয়ার্ড সাঈদ থেকে ওপরে টোকা উদ্ধৃতি মনে করিয়ে দিয়ে হুঁশিয়ার করে দেব যে, নারী উন্নয়ন নীতির বিরুদ্ধে বায়তুল মোকাররমের প্রতিবাদ-বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু গণমাধ্যম যে ভূমিকা রেখেছে তা নিছকই তাদের অজ্ঞতা বা অসচেতনতা নয়। এটাই মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি। কিভাবে বাংলাদেশকে পরাশক্তির হামলার টার্গেটে পরিণত করা হচ্ছে— এই সকল গণমাধ্যমের ভূমিকার মধ্য দিয়ে আমরা তারই রিহার্সাল দেখলাম। অন্য দিকে জনগণের ক্ষোভ-বিক্ষোভ যে কোনো সূত্রেই আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে যেতে পারে। সেই ক্ষেত্রে নারী উন্নয়ন নীতি নিছকই একটি উপলক্ষ মাত্র। যারা সামগ্রিক দিক বিবেচনা না করে সব কিছুই মৌলবাদীদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন, তাদের রাজনীতিটাই এডওয়ার্ড সাঈদ পরিষ্কার করেছেন। যারাই কথায় কথায় ইসলাম দেখলেই ‘মৌলবাদ’ দেখে, সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে হবে এরা পরাশক্তির ভাড়াটে সৈনিক ছাড়া কিছুই নয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যদি আমরা রক্ষা করতে চাই তাহলে এদের বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক ঐক্য মজবুত করতে হবে।

৫ বৈশাখ ১৪১৫; ১৮ এপ্রিল ২০০৮, শ্যামলী।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।