ফিলিস্তিন ও জায়নবাদবিরোধী লড়াই
আধিপত্যবাদ? বর্ণবাদ? সাম্রাজ্যবাদ?
ফিলিস্তিনের জনগণের লড়াইকে সাধারণত ‘পাশ্চাত্য আধিপত্যে’র বিরুদ্ধে সবচেয়ে দীর্ঘ, বেদনাজনক এবং কঠিন সংগ্রাম বলে গণ্য করা হয় যার কোনো শান্তিপূর্ণ আশু মীমাংসার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ফিলিস্তিনের প্রশ্ন কি নিছকই ‘আধিপত্য' সংক্রান্ত প্রশ্ন? এ লড়াই একই সঙ্গে ‘বর্ণবাদ’ এবং ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বিরোধী লড়াই। আল কুদস দিবস পালন উপলক্ষে অনেকে যথার্থই এই লড়াইকে ‘বর্ণবাদ’ ও ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বিরোধী লড়াই বলে গণ্য করেছেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কথাগুলোর মানে কী? ‘আধিপত্যবাদ’, ‘বর্ণবাদ’, ‘সাম্রাজ্যবাদ’ ইত্যাদির কী মানে? এই ভাষাগুলো আমরা ব্যবহার করছি নিছকই শুধু শত্রুকে নিন্দা করবার জন্য? গালিগালাজের ভাষা হিশাবে অবশ্যই নয়। বরং দুনিয়ার বর্তমান বাস্তবতা ব্যাখ্যা করবার ক্ষেত্রে এই ধারণাগুলো এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, এ সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা না থাকলে আধিপত্যবাদ, বর্ণবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম সংগঠিত করা ও বিজয়ী হওয়া অসম্ভব।
সাধারণত এই সকল পরিভাষার সঙ্গে বিপ্লবী রাজনীতির একটা সহজাত সম্পর্ক আছে। এবং সেটা সঙ্গত কারণেই। বিশেষত কার্ল মার্কস, লেনিন, মাও জে দং যাদের তত্ত্বগত এবং বিপ্লবী প্রেরণা উৎস। বিপ্লবী রাজনীতি চায় দুনিয়ার শাসক ও শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে গরিব, নির্যাতিত ও শোষিত মানুষের জয় হোক। সেই জয়ের মধ্য দিয়ে এমন এক সমাজ ও বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠুক যাতে শোষণ নির্যাতনের আদত কাঠামোটাই উপড়ে ফেলা যায়। দুনিয়ার শোষক ও শাসক পুঁজিপতি শ্রেণী কেবল তখনই জিততে পারবে যখন গোত্র গোষ্ঠি, রক্ত, দেশ, ভাষা, ভূখণ্ড, জাতীয়তা ইত্যাদির কথা বলে মানুষকে আর বিভক্ত করে রাখা যাবে না। এই সকল পরিচয় অতিক্রম করে খেটে খাওয়া মানুষ যদি সবার আগে নিজেদের খেটে খাওয়া নির্যাতিত শ্রেণী বা জনগণ হিশাবে বোঝে ও জানে কেবল তখনই মানুষের সঙ্গে মানুষের নতুন ধরণের ঐক্য গড়বার কাজ শুরু হতে পারে। সেই ঐক্যের ভিত্তি হচ্ছে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে দেশে দেশে শ্রমিকের সঙ্গে শ্রমিকের ঐক্য, পুঁজির যুগের চূড়ান্ত অবসানের জন্য খেটে খাওয়া জনগণের চেতনার বন্ধন। এই বিশ্ব-ঐতিহাসিক চৈতন্য বা পরিচয়ের ভিত্তিতে দুনিয়ার মজদুররা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যদি পুঁজিপতি শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামে কেবল তখনই পুঁজির দাসত্ব থেকে সকল মানুষের মুক্তি সম্ভব হবে। অতএব বিপ্লবী রাজনীতি মানেই হচ্ছে সকল প্রকার আধিপত্য থেকে মুক্তি, যে সমাজব্যবস্থা কিছু মানুষকে পুঁজিপতি আর দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষকে পুঁজির দাসে পরিণত করে সেই ব্যবস্থাকে চিরতরে ধ্বংস করা। এই কাজে সফলতার পথ হচ্ছে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থানকে শোষিতের রাজনৈতিক চেতনায় বা পরিচয়ে রপান্তরিত করতে শেখা। সেই চেতনা ও পরিচয় চর্চার মধ্য দিয়ে শুধু শ্রমিক বা মেহনতজীবী শ্রেণী নয়, সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রাজনৈতিক ভাবে সচেত হয়ে ওঠে। পুঁজি, পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক এবং পুঁজিপতি শ্রেণীর বিরুদ্ধে সমাজের সচেতনতাই রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
তাহলে তত্ত্ববাগীশতার বিপরীতে ব্যবহারিক দিক থেকে বিপ্লবী রাজনীতির মূল সুর হচ্ছে কী করে শোষণমূলক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে শোষিত ও নিপীড়িত জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা যায়। কোন্ তত্ত্ব কথায়, কোন্ বয়ানে বা বিদ্যমান ব্যবস্থার কী ব্যাখ্যা দিলে শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষের সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক বা আত্মিক শক্তির বিকাশ ঘটানো যায় -- এটাই হচ্ছে কার্যকর বিপ্লবী তত্ত্বের প্রধান প্রশ্ন। এই দিকটা ভেবেই কার্ল মার্কস বলেছেন, তত্ত্ব অনেক হয়েছে বা তত্ত্ব আরো করা যায় কিন্তু মূল কথা হচ্ছে দুনিয়াকে বদলে দেয়া। কী করে সেই বদলের রাজনীতিকে কার্যকর করা যায় তার জন্যই অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক পরিচয় ছাড়া বিদ্যমান অন্য কোনো ইহলৌকিক বা পারলৌকিক বিষয়ের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ বিপ্লবী রাজনীতি গৌণ গণ্য করে। স্লোগান তোলে : ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। এটা নাস্তিকতা আস্তিকতার তর্ক নয়। কিম্বা ধর্মবাদী বা ধর্মনিরপেক্ষ হবার মামলাও নয়। এই ব্যবহারিক রাজনৈতিক প্রশ্নটির মীমাংসার বাইরে বিপ্লবী তত্ত্ব বলে কোনো স্বাধীন ও বিমূর্ত তত্ত্ব থাকতে পারে না। এই জায়গায় দাঁড়ালেই ধর্মের প্রশ্নে অবস্থান যাই থাকুক আধিপত্যবাদ, বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াই-সংগ্রামের সাধারণ অভিমুখ আমরা ধরতে পারি।
বিপ্লবী রাজনীতি মোকাবেলা করবার জন্য শোষিত জনগণের মধ্যে বিভাজন ও বিভক্তি বহাল ও বজায় রাখবার জন্য দুনিয়ার পুঁজিপতি শ্রেণী সব সময়ই তৎপর থেকেছে, এখনো রয়েছে। যেমন ইসলাম প্রধান দেশগুলোতে তারা ইসলামে বিশ্বাসীদের কাছে ক্রমাগত প্রচার চালিয়েছে এবং এখনো চালায় যে বিপ্লবী রাজনীতি ধর্মবিরোধী নাস্তিকদের রাজনীতি। বিপ্লবী রাজনীতির মধ্যেও এমন সব ব্যক্তি ঢুকে থাকে যারা শোষক ও সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবার কাজে ব্যাঘাত তৈরি করে। জঙ্গণকে বৈপ্লবিক তৎপরতায় আগ্রহী করবার পরিবর্তে অনৈক্য, বিভেদ, অবিশ্বাস ও সংশয় তৈরি করে। এই কাজ করবার ক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বড় সহায় হয় নাস্তিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি। অন্যদিকে ধর্ম বিশ্বাসীরাও বিপ্লবী রাজনীতির মর্ম কথার দিকে নজর না দিয়ে তার রাজনীতিকে আস্তিকতা ও নাস্তিকতার মানদণ্ড দ্বারাই বিচার করতে শুরু করে। এর ফলে শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের রাজনীতি থেকে জনগণের বিচ্ছিন্নতা ও বিরোধ ঘটে। এই বিপজ্জনক প্রবণতা এখনো হাজির থাকবার কারণে ধর্মের সঙ্গে বিপ্লবী রাজনীতির তত্ত্ব ও তৎপরতার সম্পর্ক বিচার এই কালের প্রধানীকটি কাজ হয়ে উঠেছে। এই কাজে যথেষ্ট সফলতা অর্জন করা যায় নি। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি অর্জনের জন্য ধর্ম ও বিপ্লবী রাজনীতির সম্পর্ক বিচার আজ তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় দিকে থেকে আশু কর্তব্য হয়ে উঠেছে।
এই কাজে আমাদের ব্যর্থতার জন্য আধিপত্যবাদ, বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনগণের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের সম্পর্ক আছে। ফিলিস্তনের জুগণের সঙ্গে একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করবার জন্য আমরা জনগণকে যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ করতে পারিনি। এটা ভাবা দরকার যে কেন আধিপত্যবাদ, বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই বলে দাবি করা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনি জনগণের লড়াই ইসলামপন্থী বা মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীলদের বিষয় হয়ে রয়েছে। যে আধিপত্যবাদ বর্ণবাদ বা সাম্রাজ্যবাদকে আমরা গালি দিচ্ছি তারা কি শুধু মুসলমানদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করছে নাকি সারা দুনিয়ার জনগণ আজ পুঁজির দাসে পরিণত হয়েছে? এই বর্ণবাদ কি শুধুই ‘মুসলমান’ জাতির বিরুদ্ধে ‘ইহুদি-খ্রিস্টান’ জাতির বর্ণবাদ? নাকি বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার গোড়াতেই বর্ণবাদ রয়েছে। সত্য যে, মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলীতে আমরা দেখছি ইসলাম প্রধান দেশ বা মুসলমানরাই এখন এই বর্ণবাদের প্রত্যক্ষ শিকার। কিন্তু ইউরোপে ইহুদিরাও কি একই বর্ণবাদের শিকার হয়ে হিটলারের কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে মরে নি? অতএব একে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘ইহুদি-নাসারার’ ষড়যন্ত্র হিশাবে হাজির না করে আমাদের বুঝতে হবে আসলেই আধিপত্যবাদ, বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ ব্যাপারগুলো কী এবং কী করে সকল ধর্ম, সকল জাতি, সকল দেশ ও সকল সংস্কৃতির মানুষই এর দ্বারা শোষিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত। এই আলোকেই প্রমাণ করে দেখাতে হবে ইসলামের ধর্মতত্ত্ব হিশাবে নয় বা ধর্মীয় আত্মপরিচয়ের জায়গা থেকেও নয় বরং মানবেতিহাসের বিশেষ একটি ভাব, বিশেষ একটি দর্শন ও জীবনব্যবস্থা হিশাবে ‘ইসলাম’ এমন কিছু বলেছে কি না যার খবর আমরা রাখি না। যদি আমরা সকলের কাছে পৌঁছাতে না পারি তাহলে মানবেতিহাসের আধিপত্যবাদী, বর্ণবাদ বা সাম্রাজ্যবাদী যুগের অবসান ঘটবে না। প্রতিটি ধর্মের মধ্যেই সকল মানুষের জন্য সার্বজনীন বীজ বা আদর্শ রয়েছে। ধর্মতত্ত্বের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে তার উপযোগিতা ধরা পড়ে।
বর্ণবাদী বিশ্বব্যবস্থা মানুষের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার যেসকল দিককে আমাদের নজর থেকে আড়াল করে ফেলেছে, প্রায় ধ্বংস করেছে, আজ কাজ হচ্ছে প্রতিটি ধ্বংসাবশেষ খুঁড়ে দেখা। মহা ভূমিকম্পের পর একটি বিধ্বস্ত শহরের ধ্বংসস্তুপ যেমন, তার মধ্যে কোনো জীবিত মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যায় কি না তার জন্য যে আকুতি সেই আকুতি থেকে আমাদের সর্বত্র অন্বেষণ জারি রাখা জরুরি। জরুরি অবস্থার তাগিদ থেকেই আমাদের সেই কাজ করা দরকার। আজ আল কুদস দিবসে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সংহতি জানাতে এসে এই দিকটির প্রতি সকলের মনোযোগ আকাঙ্খা করছি।
জায়নবাদ
ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রাম বহু লড়াই বহু রক্তে রঞ্জিত, বহু শহীদের বীরত্বে ও স্মৃতিতে অম্লান। কিন্তু শুধু ‘আধিপত্য’ এবং প্রাচ্য বনাম পাশ্চাত্যের বিরোধের জায়গা থেকে দেখলে ফিলিস্তিনের লড়াই-সংগ্রামের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে খাটো করা হয়। ফিলিস্তিনি সংগ্রাম মানবেতিহাসের ভুলে যাওয়া, প্রাচীন কিন্তু অমীমাংসিত এমন কিছু প্রশ্ন আমাদের সামনে জারি রাখে যার মীমাংসা ছাড়া নতুন দুনিয়ার স্বপ্ন দেখা অসম্ভবই বলতে হবে। সত্যি যে বাইরে থেকে দেখলে এই লড়াই একান্তই ফিলিস্তিনিদের নিজেদের দেশে প্রত্যাবর্তনের, নিজেদের ভূখণ্ড নিজেদের অধিকারে নেবার এবং একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিশাবে বিশ্বের রাষ্ট্রসভায় শরিক হবার লড়াই। বিদ্যমান সভ্যতার নীতিনৈতিকতা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বিধিবিধান এবং একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পর্কে যে সকল ‘আধুনিক’ চুক্তি, সনদ বা ঘোষণা আছে তার মধ্যে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হয়ে যাবার কথা বহু আগেই। কিন্তু হয় নি। হয়নি এ কারণে যে, ঔপনিবেশিকতার যে হানাদারি ও দখলদারি প্রকল্প এখন বিশ্বব্যাপী জায়নবাদী সাম্রাজ্যবাদী রূপ ধারণ করেছে তার আদি ও অকৃত্রিম প্রকৃতি আমরা ইজরায়েল রাষ্ট্রের মধ্যে দেখি। ঔপনিবেশিক হানাদারি ও দখলদারি আর পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা এখানে একাকার হয়ে আছে। কিন্তু ফিলিস্তিনি লড়াই-সংগ্রামের পরম সাফল্য এখানে যে ঔপনিবেশিকতা এবং সাম্রাজ্যবাদ বহু জাতি ও জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব দুনিয়া থেকে মুছে দিয়েছে বটে, কিন্তু লড়াকু ফিলিস্তিনির ইচ্ছা ও সংকল্পের মশাল নিভিয়ে ফেলতে পারে নি। ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা এই কালে জায়নবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, যুদ্ধ সহিংসতা এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনগণের অকুতোভয় লড়াইয়ের নাম। ইন্তিফাদা গণসংগ্রামের নতুন নাম। নিরস্ত্র মানুষ কীভাবে ভয়াবহ ট্যাংক ও মারণাস্ত্রের সামনে দাঁড়ায় তার নজির সৃষ্টি করে ফিলিস্তিনি জনগণ আজ দেশে দেশে জনগণের মুক্তি সংগ্রামের প্রেরণা জুগিয়ে চলেছে। ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের নীতি, কৌশল ও ব্যবহারিক দিক থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শেখেনি সম্ভবত গণমুক্তির জন্য লড়াই-সংগ্রামের তেমন কোনো নজির এই কালে আর নাই বললেই চলে।
ইজরায়েল সাম্রাজ্যবাদের অবিচ্ছেদ্য সামরিক ফ্রন্টলাইন। শুধু মধ্যপ্রাচ্যের তেলের খনি এবং গণবিরোধী ও একনায়কতান্ত্রিক মুসলমান রাজা-রাজড়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদার শাসকদের টিকিয়ে রাখাই তার কাজ নয়, একই সঙ্গে দুনিয়াব্যাপী প্রচার-প্রপাগান্ডা বিশেষত ইসলাম সম্পর্কে বিকৃত কুৎসা রটনার মধ্য দিয়ে জায়নবাদী রাষ্ট্র ইজরায়েলের নৈতিক বৈধতা অর্জন ও টিকিয়ে রাখাও জায়নবাদের প্রধান কাজ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে যার প্রকট রূপ আমরা প্রতিদিনই প্রত্যক্ষ করছি।
জায়নিজমের (Zionism) সঙ্গে ইহুদি ধর্মের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে বাংলা অনুবাদে বোঝার সুবিধার জন্য সাধারণত ‘ইহুদিবাদ’ করা হয়। কিন্তু এটা বিশেষ একটি চিন্তা পদ্ধতি, মতাদর্শ ও রাজনীতির নাম। জায়নবাদ ইহুদি ধর্মের এবং পুরানা বাইবেলের একটি বিশেষ ব্যাখ্যার ওপর যে বয়ান তৈরি করে তার সার কথা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ ইহুদিদের সঙ্গে চুক্তি করেছেন যে, একটি বিশেষ ভূখণ্ড, এই ক্ষেত্রে জেরুজালেম এবং কার্যত ফিলিস্তিন ভূখণ্ড একমাত্র ইহুদিদের। এই দৈব বৈধতা ইহলৌকিক বা অন্য যে কোনো ঐতিহাসিক নীতি নৈতিকতার ঊর্ধ্বে। তাছাড়া জমির সঙ্গে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর এই সম্পর্ক চিরন্তন, অলংঘনীয় ও পরম অধিকারের মধ্যে পড়ে। এই সম্বন্ধ এতোই প্রাগৈতিহাসিক যে এর অন্যথা অসম্ভব।
জায়নবাদ একটি মতাদর্শ। জায়নবাদের সঙ্গে হজরত মুসা (আ:) এর অনুসারী ইহুদি কিম্বা জন্মসূত্রে ইহুদি পরিবারের কোনো মানুষের কোনোই সহজাত সম্পর্ক নেই। তেমনি জায়নবাদ মানেই যে শুধু ইহুদিদের ব্যাপার তার পক্ষেও কোনো সত্যতা নেই। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির পেছনে প্রত্যক্ষ, প্রকাশ্য ও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে খ্রিস্টিয় জায়নবাদ (Christian Zionism)। এই অতি প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মগোষ্ঠী জর্জ বুশের পররাষ্ট্রনীতির, বিশেষত যুদ্ধ ও দখলদারি্ ঘোর সমর্থক। তাদের কথা হচ্ছে দুনিয়া অচিরেই শেষ হয়ে যাচ্ছে, রোজ কেয়ামত আসন্ন, অতএব প্রাণ, পরিবেশ বনজঙ্গল প্রকৃতি ইত্যাদি রক্ষা করার কথা বলা নিছকই আহাম্মকি ছাড়া কিছুই নয় বরং বাইবেল যেভাবে বলেছে সেই ভাবে ইজরায়েলকে দ্রুত আল্লাহর নির্বাচিত গোষ্ঠী ইহুদিদের হাতে নিশ্চিতভাবে সঁপে দিলেই মহান যিশু পাপীকে মুক্ত করবেন। কাজে কাজেই সত্যিকারের খ্রিস্টানদের কাজ হওয়া উচিত ইজরায়েলকে ইহুদিদের হাতে সঁপে দেবার ধর্মীয় কর্তব্যে সোচ্চার হওয়া। বলা বাহুল্য, হজরত ঈসা (আ:) এর সজ্ঞান ও সচেতন অনুসারীরা এই চিন্তার ভয়াবহতা ও বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ার। একই সঙ্গে খ্রিস্টীয় জায়নবাদ আজ পরিবেশবাদী আন্দোলন সংগ্রামের প্রধান দুশমনে পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রাম, জায়নবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে আলোচনায় এই তথ্য আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, মার্কিন শাসক শ্রেণ, বিশেষত জর্জ বুশের সমর্থনের ভিত্তি এই খ্রিস্টীয় জায়নবাদী এবং তাদের সক্রিয় তৎপরতা। মূলত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি এই খ্রিস্টীয় জায়নবাদীদের দ্বারাই পরিচালিত। তবে মনে রাখা দরকার, হজরত ঈসা (আ:)-এর প্রবর্তিত ধর্ম বা একজন জন্মসূত্রে খ্রিস্টানের সঙ্গে জায়নবাদী খ্রিস্টতত্ত্বের কোনো সম্পর্ক নেই।
অতএব এটা ভাববারও কোনো কারণ নেই যে, জায়নবাদ আর হজরত মুসা (আ:) এর ধর্ম বা তার অনুসারীরা সমার্থক। বরং ইহুদি ধর্মের গোঁড়া অনুসারীরা যেমন নেতুরাই কারটা (Neturei Karta) জায়নবাদের ঘোর বিরোধী। লন্ডনে ট্রাফালগার স্কয়ারে রাব্বি আহরণ কোহেন গত ২০০৫ সালের ৩০ অক্টোবর ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি আল কুদস দিবসে সংহতি জানাতে এসে বলেছেন, ‘গোঁড়া ইহুদিরা ফিলিস্তিনিদের প্রতি পুরোপুরি একাত্ম। ধর্ম বিশ্বাস, ইহুদি ধর্ম এবং মানবিক নীতিনৈতিকতার দিক থেকে ইহুদি ধর্মের মৌলিক শিক্ষা জায়নবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। আমাদের ধর্ম বিশ্বাস এই রকম যে, হাজার বছর বা তারো বেশি সময় ধরে ইহুদি জনগণ মহান আল্লাহ তাআলার ডিক্রি অনুযায়ী নির্বাসিত জীবন পালন করছে, কারণ তাদের কাছ থেকে যে উন্নত মানের প্রত্যাশা করা হয়েছিল তা তারা রক্ষা করতে পারে নি। আমরা দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছি এবং আমাদের ধর্মীয় কর্তব্য হচ্ছে যে দেশে আমরা বাস করি সেই দেশের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য বজায় রাখা। তাছাড়া ফিলিস্তিনে আমাদের নিজেদের কোনো রাষ্ট্র কায়েম করা নিষিদ্ধ, যদি এমন কিছু করবার চেষ্টা করা হয় তাহলে তার কঠিন পরিণতি সম্পর্কে আমাদের হুঁশিয়ার করা হয়েছে। এমন কিছু করা মানে পরম শক্তিমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। অতএব ধর্ম বিশ্বাসের জায়গা থেকে ফিলিস্তিনে আমাদের কোনো রাষ্ট্র গঠনের অধিকার নেই।
তিনি আরো বলেছেন যে, ‘প্রায় একশ বছর আগে জায়নবাদী মতাদর্শ গঠিত হয়েছে অধার্মিকদের ও অবিশ্বাসীদের দ্বারা যারা দাবি করেছে, যে নির্বাসিত ইহুদিদের নিজেদের নির্বাসন থেকে মুক্তি পাবার জন্য লড়তে হবে। তারা এই ক্ষেত্রে ধর্মীয় বাধানিষেধ মানে নি এবং তাদের নির্বাসনের প্রশ্নে সহনশীল (Passive) অবস্থানের তারা সম্পূর্ণ বিপরীতে। তবে যারা ইহুদি নন তারা যে দিকটা সহজে বুঝবেন তা হলো জায়নবাদী মতাদর্শ স্থানীয় অধিবাসী অধ্যুষিত একটি দেশ দখল করে নিয়েছে সেই অধিবাসীদের কী হলো তার পরিণতি বিচার না করে, তাদের নিজের দেশ ও বাসভূমি থেকে বঞ্চিত করে।
জায়নবাদ আধুনিক জাতীয়তাবাদেরই আরেকটি ধরণ মাত্র। ধর্ম এখানে জাতীয়তাবাদী বয়ানের কাঁচামাল। অন্যান্য জাতীয়তাবাদ যে কোনো সূত্র থেকেই কাঁচামাল সংগ্রহ করতে পারে। সেই সূত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ককে পবিত্র, অবিচ্ছেদ্য এবং তার সঙ্গে সম্বন্ধের চরিত্র চিরায়ত গণ্য করে। জায়নবাদ এই দিক থেকে ভূখণ্ড, রক্ত, গোত্র, গোষ্ঠী, জাতি, ভাষা সংস্কৃতি এমনকি বিদ্যমান ধর্ম বা যে কোনো ইহলৌকিক বা দৃশ্যমান বিষয়াদির সঙ্গে কোনো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক এবং চিরায়ত ও অনন্ত সম্বন্ধের ধারণা, তার বয়ান এবং তারই রাজনীতি। এই দিক থেকেই জায়নবাদ বিচার ও বোঝা জরুরি। সত্যি যে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সংগ্রামের জন্য জাতিবাদী বয়ান তৈরি করে, তার নজির আছে। কিন্তু নিপীড়িতের লড়াই সংগ্রামের সত্য এবং নিপীড়ন থেকে মুক্তির দাবি আর তার জাতিবাদী মতাদর্শিক বয়ানের সত্য সমর্থক নয়।
ইহুদি মাত্রই জায়নবাদী নয়, কিন্তু ইহুদি ধর্মের সঙ্গে জায়নবাদের সম্পর্ক আছে। সেই কারণে জায়নবাদের ধর্মীয় বয়ান বোঝা দরকার। অন্যান্য ধর্মীয় বয়ানের সঙ্গে তার বিরোধ ও মিলের জায়গা তখন পরিষ্কার হবে। যেমন, যদি কেউ দাবি করে যে, আল্লাহ একমাত্র মুসলমানদেরই বেহেশতে নেবেন, অন্য কাউকে নয়, আল্লাহর সঙ্গে এই ধরণের অবিচ্ছেদ্য ও চিরায়ত চুক্তিও জায়নবাদেরও আরেকটি ধরণ মাত্র। কিন্তু একই সঙ্গে জায়নবাদকে ‘আধুনিক’ চরিত্রের জায়গা থেকে বিচার না করলে আমরা সাম্রাজ্যবাদী যুগের জায়নবাদী পরিগঠনের মর্ম ধরতে পারব না। যদি জাতীয়তাবাদ এই ধারণার ওপর বদ্ধমূল হয় যে, একটি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একটি ভূখণ্ডের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য, চিরায়ত এবং চিরন্তন তাহলে সেই ক্ষেত্রে আল্লাহর দোহাই না থাকলেও এটা জায়নবাদেরই আরেকটি ধরণ বলে সহজেই চেনা যায়। আধুনিক ইউরোপের ধারণা হচ্ছে ইহুদিবিহীন ইউরোপের ধারণা। কিন্তু ইউরোপ বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের প্রতি যে নির্যাতন অত্যাচার করেছে তার মূল্য দেবার জন্য নির্বাসিত ইহুদিদের ইউরোপ থেকে সরাবার পথ হিশাবে জায়নবাদকে উৎসাহিত করেছে। জায়নবাদ অবশ্যই জাতীয়তাবাদও বটে। জায়নবাদকে ইউরোপ কাজে খাটিয়েছে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তেলের উৎস ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে। বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে জায়নবাদকে এখন আর আলাদা করে শনাক্ত করা যায় না। কিন্তু ধনী দেশগুলোর নিরাপত্তা যদি ইজরায়েলের টিকে থাকা না থাকার ওপর নির্ভরশীল হয় তাহলে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার গোড়ায় রয়েছে জায়নবাদ।
জায়নবাদ যে একটি বিশেষ ধরণের ‘আধুনিক’ মতাদর্শ এই দিকটা বোঝাবার জন্যই ইহুদি ও খ্রিস্টধর্ম থেকে জায়নবাদকে আলাদা করে বিচার করা দরকার। এই আলাদা করে বিচারের কারণ হচ্ছে জায়নবাদ ইহুদি বা খ্রিস্টান ধর্মের ব্যাপারই নয়, এমনকি ধর্মের ব্যাপারই নয়। একজন মুসলমানও জায়নবাদী হতে পারে। অজ্ঞাতসারে (এমনকি জ্ঞাতসারেও) ‘পৌত্তলিক’ হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ একজন মুসলমানও ইহলৌকিক বিষয়াদির সঙ্গে তার সম্পর্ক চিরন্তন, অবিচ্ছেদ্য ও অনন্তকালীন ভাবতে পারে। জায়নবাদকে নিছকই ইহুদি বা খ্রিস্টান ব্যাপার ভাবা চরম বিভ্রান্তি। তার আধিপত্য সর্বব্যাপী, এই দিকটি যদি আমরা ধরতে পারি তাহলে জায়নবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ের মর্ম আমরা ধরতে পারব।
কোন ভূখণ্ড বা ইহলৌকিক বস্তুর সঙ্গে মানুষের চিরন্তন ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ধারণা ও বয়ান মানুষকে ঐকবদ্ধ করবার ক্ষেত্রে প্রধান মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক বাধা। এই দিকটা না বুঝতে পারলে কেন হজরত ইব্রাহিম (আ:) নিরাকারকেই একমাত্র উপাস্য গণ্য করেছেন তার দার্শনিক তাৎপর্য ও রাজনীতি আমরা ধরতে পারব না। ইহলৌকিক কোনো বিষয় বা ‘পুতুল’ যদি মানুষের সঙ্গে মানুষের বা মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক নির্ধারণ করে তাহলে মানুষে মানুষে ভেদ বাড়ে বই কমে না। যদি সাকার বা আকারবিশিষ্ট সত্তাই মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নির্ণয় করে তাহলে মানুষ গোত্র, বর্ণ, রক্ত, গোষ্ঠী, জাতি, ভূখণ্ড, ভাষা ও সংস্কৃতিতে চিরদিন রাজনৈতিকভাবে বিভক্তই থাকবে। এই অর্থে ‘পৌত্তলিকতা’র অবসান ছাড়া আমাদের মনের ভেতরে বাইরে যে ‘পুতুল’ আমরা লালন করি তার নিরাকরণ জরুরি। এই নিরাকরণ ছাড়া মানুষের ঐক্য অসম্ভব। নিরাকারের উপাসনা ছাড়া গোত্র, বর্ণ, রক্ত, গোষ্ঠি, জাতি, ভূখণ্ড, ভাষা ও সংস্কৃতিতে বিভক্ত মানুষকে একত্র করবার স্বপ্ন কোনোদিনই পূর্ণ হবার নয়। মানুষ বিচিত্র এবং বৈচিত্র্য এই সৃষ্টিজগতের মাধুর্য, কিন্তু একই সঙ্গে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ধারণা শুধু নয়, 'এক'-এর ভাব ও রাজনীতি চর্চাই মানুষকে তৌহিদের তাৎপর্য ধরিয়ে দিয়ে 'এক' বা ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। সাম্রাজ্যবাদী যুগে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের সাফল্যের জন্য 'এক'ই সত্য এই উপলব্ধির মর্মোদ্ধার জরুরি। পুঁজির যুগে মানুষ পূজা করছে পুঁজির। পুঁজিই মানুষের একমাত্র উপাস্য হয়ে উঠেছে। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা মানুষকে বিভক্ত করছে কিন্তু মানুষের ভাবুকতা ও রাজনীতির কাজ বিভক্তি ও অনৈক্য নয়, বরং মানুষকে 'একত্র' করা, এক করা। এই মূল ধারাটিকে অনুধাবন করতে না পারলে সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী রাজনীতি আত্মিক ও বৈষয়িক শক্তি লাভ করতে পারবে না বলে আমার ধারণা। যারা নাস্তিক নিজেদের ‘আধুনিক’ গণ্য করেন কিম্বা ধর্মনিরপেক্ষতায় যারা বিশ্বাসী তারাও জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে কোনো না কোনো ‘পুতুল’ বা ইহলৌকিক বিষয়ের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য, চিরায়ত বা অনন্তকালীন মনে করতে পারেন। মতাদর্শ হিশাবে জায়নবাদের এই আধিপত্য সর্বব্যাপী। এর বিরুদ্ধে মতাদর্শিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লড়াই পরিচালনাই একালে প্রগতিশীল রাজনীতির প্রধান চরিত্র লক্ষণ ।
জায়নবাদ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং জীবাশ্মভিত্তিক (fossil fuel) শিল্পসভ্যতার সঙ্গে জড়িত। -সভ্যতা এখন আমাদের প্রাণ ও প্রাণের শর্তকে বিপদাপন্ন করে তুলেছে সেই সকল প্রসঙ্গের সঙ্গে জায়নবাদ অঙ্গাঙ্গি যুক্ত। এই প্রসঙ্গগুলো আড়াল করে, উহ্য রেখে, পাশ কেটে আমরা ফিলিস্তিন নিয়ে আলোচনা করতে পারি না। খ্রিস্টীয় জায়নবাদ স্পষ্টতই প্রাণ, পরিবেশ ও প্রাণের শর্ত ধ্বংসের পক্ষে একটি শক্তিশালী মতাদর্শ। এই আলোচনাগুলো আমাদের আরও খোলামেলা করা দরকার। যে প্রশ্নগুলো আমাদের গোপনে বিব্রত করে তাদের খোলামেলা উপস্থাপন জরুরি। ‘আধিপত্যবাদ’ নিয়ে ফিলিস্তিন সম্পর্কে উদার আলোচনা রাজনৈতিক সুবিধাবাদকে আড়াল করে রাখতে পারে বলে আমার আশঙ্কা। ফিলিস্তিন এমন একটি চিহ্নের মতো যাকে কেন্দ্র করে প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাসের বিচার করলে মানবেতিহাসের বহুল জটিল গ্রন্থির রহস্য উন্মোচিত হবে।
জায়নবাদ, বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও জীবাশ্মভিত্তিক শিল্পসভ্যতা
জায়নবাদ, বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং জীবাশ্মভিত্তিক (fossil fuel) শিল্পসভ্যতা তিনটি বিষয়। কিন্তু তারা কি একসূত্রে গাঁথা? ইহুদিবাদের প্রসঙ্গ তো শেষাবধি সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার প্রশ্ন। একটি গোত্র দাবি করছে পবিত্র ভূমির একমাত্র অধিকারী ও মালিক তারাই কারণ তাদেরকে স্বয়ং আল্লাহ এই ভূখণ্ড দিয়েছেন। ইজরায়েল ভূমির সঙ্গে ইহুদিদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য কারণ খোদ আল্লাহর সঙ্গেই প্যালেস্টাইনের মালিকানা নিয়ে তাদের এই চুক্তি হয়েছে। ধর্মসূত্রেই তারা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের উত্তরাধিকার। এর বিপরীতে অন্যদের দাবি হচ্ছে আল্লাহর কোনো সয়সম্পত্তি থাকতে পারে না এবং তিনি কারো সঙ্গে জমিজমা নিয়ে চুক্তি করেন না। অতএব পবিত্র ভূমি ওয়াকফ সম্পত্তি হোক, নিয়মের মধ্যে ভোগ দখলের অধিকার সকলেরই থাকুক।
কিন্তু পুঁজি, তো সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানারই বিকশিত রূপ। ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে ইসলামের লড়াই কি তাহলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির এবং কাজে কাজেই পুুঁজির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রাথমিক বীজ? এই লড়াই তাহলে হজরত মুসা (আ:)-এর অনুসারী ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে নয়, বরং জায়নবাদের বিরুদ্ধে। যে লড়াইয়ের বীজ আমরা প্রাচীন ইতিহাসে দেখছি তাকে নতুন করে বোঝা দরকার। একটি বিশেষ গোত্র বা গোষ্ঠীর দখলদারির বিরুদ্ধে দুনিয়ার সকল মানুষের পবিত্র ভূমিতে অধিকার কায়েমের লড়াইয়ের মধ্যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, ঐতিহাসিক বা দার্শনিক দিক আছে সেই দিকেই আমি নজর ফেরাতে চাইছি। কারণ ইজরায়েল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইকে আমি ইহুদিদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের লড়াই গণ্য করি না। এই লড়াই সর্বব্যাপী জায়নবাদের বিরুদ্ধে। এর সঙ্গে সুদ খাওয়া হারাম এই ধর্মনীতিরও সম্পর্ক রয়েছে। টাকা সম্পদ নয় এবং টাকা সম্পদ তৈরিও করে না। অতএব টাকা ভাড়া দিয়ে টাকা নেয়া মানে সম্পদ তৈরিতে অংশগ্রহণ না করে সম্পদের 'মালিক' হওয়া।
পুঁজিবাদের সঙ্গে জায়নবাদের সম্পর্ক কি তাহলে ঘনিষ্ঠ নয়? তাহলে ফিলিস্তিন প্রশ্ন কি নিছকই ইহুদিবাদীদের তাড়িয়ে মুসলমান বা আরবদের ভূমিমালিকানা ও অধিকার কায়েমের প্রশ্ন মাত্র? কিম্বা ফিলিস্তিনিদের? এটা কি জাতীয়তাবাদের প্রশ্ন? জমি, গোত্র, গোষ্ঠী, রক্ত, পরিবার, ভাষা, সংস্কৃতি বা যে কোনো প্রকার ইহলৌকিক বিষয়ের সঙ্গে মানুষের চিরন্তন ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের দাবি যদি জায়নবাদ হয় তাহলে তো জায়নবাদ শুধু ইহুদিদের ব্যাপার মাত্র নয়। আমাদের নিজেদের অন্তর্গত খাসিলতেরও মামলা। আমরা সকলেই কি কমবেশি জায়নবাদী নই? নামে মুসলমান বা অন্য যে কোনো ধর্মাবলম্বী হলেও আসলে তো আচারে বিশ্বাসে ধর্মে জায়নবাদী?
ইহলৌকিক বিষয়াদি থেকে মুক্তির পথ ইহলৌকিকতা থেকে মুক্তি নয়। যদি জায়নবাদের আমরা ঠিকভাবে বিচারকরি তাহলে নিরাকারের সালাত কায়েম করা কথাটির রাজনৈতিক অর্থও আমরা বুঝতে পারব। নিরাকারের উপাসনার অর্থ সকল ইহলৌকিক বিষয়ের উপাসনা বা পৌত্তলিকতা পরিহার করে সেই দিকেই রুকু ফেরানোর রাজনীতি কায়েম করা যাতে গোত্র, রক্ত, গোষ্ঠী, পরিবার, দেশ, ভূখণ্ড, ভাষা সংস্কৃতিসহ সকল ইহলৌকিক বাধা ছিন্ন করে মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মিক সম্পর্ক স্থাপনের শর্ত তৈরি হয়। যেন সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা যায়। পৌত্তলিকতা বা ইহলৌকিক বিষয়ের উপাসনা থেকে মুক্ত হলেই মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ বিভাজন বিরোধের চির অবসান ঘটবে কি? এটাই কি শান্তি? এটাই কি ইসলাম? তাহলে নিরাকারের উপাসনার লক্ষ্য ধর্ম মাত্র নয়। তার ইহলৌকিক উদ্দেশ্য আছে। সেটা হচ্ছে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করবার তাগিদ। এই সকল বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়া আজ আমার কাজ নয়। কিন্তু প্রশ্নের দিকে নজর ফেরানোই সপ্রাণ চিন্তার কর্তব্য।
‘উম্মাহ’ কথাটিকে তাহলে নিরাকারের উপাসনার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েই বুঝতে হবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের পরমার্থিক ঐক্য বা প্রতিটি মানুষের সঙ্গে প্রতিটি মানুষের আত্মার সঙ্গে আত্মার ঐক্য কায়েমের জন্য সকল ইহলৌকিক বাধা অপসারণের দরকার। সজ্ঞান মানুষের সেখানেই নিজেকে চূড়ান্তভাবে সমর্পণের চর্চা যার সঙ্গে বৈষয়িক বা ইহলৌকিক কোনো কিছুর সম্পর্ক নাই। তাই নয় কি? তাহলে নিরাকারের যে ধারণা বা একত্ববাদী যে ভাব আরবে তিনটি ধর্মের আবির্ভাব ও বিকাশের মধ্যে গড়ে উঠেছিল, হজরত ইব্রাহিম (আ:) তার আদি ভাবুকতাকে শুধু ধর্মবিশ্বাস বলে বিচার করা ঠিক না। একই সঙ্গে তা দর্শন এবং রাজনীতিও বটে। ফিলিস্তিন প্রশ্ন আমাদের মানবেতিহাসের এই সকল গোড়ার প্রশ্নে যেতে বাধ্য করে বলে ফিলিস্তিন নিছকই পাশ্চাত্যের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের অধিকার কায়েম মাত্র নয়। বলাবাহুল্য, ফিলিস্তিনীদের অধিকার কায়েম অবশ্যই আমাদের আশু দাবি, কিন্তু গোড়ার কথা নয়। একই সঙ্গে ওপরে যে সকল প্রশ্ন তুলেছি সেই সকল প্রশ্নের মীমাংসাও ফিলিস্তিন দাবি করে। কারণ একালের জিজ্ঞাসার মীমাংসার মধ্যে মানুষের ভবিষ্যৎ ইতিহাসের বীজও নিহিত রয়েছে।
অন্যদিকে আল্লাহর ওপর খোদকারি করে প্রকৃতির ওপর হানাদারি ও দখলদারিই হচ্ছে জীবাশ্মভিত্তিক আধুনিক শিল্পসভ্যতার ধর্ম। ফিলিস্তিনকে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের রাজনীতির দিক থেকে আমরা বিচার করতে পারি। আজ তেল নিয়ে যুদ্ধবিগ্রহ হিংসা রক্তপাত চরম আকার ধারণ করেছে। ‘খলিফা’ বা ইহলোকে আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়ার কারণে সৃষ্টিজগতের রক্ষা ও বিকাশের দায়িত্ব মানুষের। সেই রক্ষা ও বিকাশের দায় না নিয়ে একে ধ্বংস ও বিনাশ করার সঙ্গে যে বিরোধ ঘটছে ধর্ম তাকে কীভাবে দেখে? জীবাশ্মভিত্তিক এই হানাদারি সভ্যতা টিকিয়ে রেখে মানুষ ও প্রকৃতির মুক্তি কী করে সম্ভব? প্রাণ ও পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের দায় আছে। জীবাশ্মভিত্তিক শিল্প সভ্যতার বিপরীতে আরো উন্নত ও প্রাণবান সভ্যতা ও সংস্কৃতি চর্চার প্রয়োজন আছে। তেলের রাজনীতির আলোকে মধ্যপ্রাচ্যে ইজরায়েল রাষ্ট্র কায়েম এবং ফিলিস্তিনের অধিবাসীদের দেশত্যাগী করা ও ক্যাম্পে থাকতে বাধ্য করার ব্যাপারটা কমবেশি পরিষ্কার। এই বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি আছে কিন্তু তেলের রাজনীতির বিরোধিতা করা মানে একই সঙ্গে ভিন্ন ধরণের সভ্যতার চিন্তা করতে শেখা। এই দিকটায় চিন্তা এখনো দুর্বল।
বায়তুল মোকাদ্দেস বা জেরুজালেম তিনটি একত্ববাদী সেমিটিক ধর্মের অতি পবিত্র নগরী। কিন্তু এই অতি প্রাচীন পবিত্র নগরকে কেন্দ্র করে তিনটি ধর্মের মধ্যে যে বিরোধ, সংঘাত ও লড়াই তার জের সাম্রাজ্যবাদী লড়াই-সংগ্রামে রূপ নিয়েছে। এই লড়াই যে নিছকই ধর্মের লড়াই নয় বরং একই সঙ্গে মানবেতিহাসের অনেকগুলো অমীমাংসিত প্রশ্নের লড়াই -- এই কথাটি জানাবার জন্যই আমি এই নিবন্ধে হাজির হয়েছি। এই বিরোধ আরবদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ বটে, যা এখন আন্তর্জাতিক শক্তিবলয়ের সহায়তায় জায়নবাদী ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এখন পরাশক্তির বিরুদ্ধে অধিকারহারা জনগণের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। পরিণত হয়েছে পাশ্চাত্য আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আরব জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে। কিম্বা এখন যেমন হাজির হয়েছেচ জর্জ বুশের খ্রিস্টিয় ক্রুসেডের বিরুদ্ধে জঙ্গি ইসলামপন্থীদের লড়াই হিশাবে। নিপীড়িত জাতিসত্তার লড়াইয়ের প্রতি অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণের সমর্থন রয়েছে এবং থাকবে। কোনো রাজনীতিই এখন আর নিজেদের প্রগতিশীল বা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দাবি করতে পারে না যদি না সেই রাজনীতি ফিলিস্তিনের জনগণের লড়াই-সংগ্রামের সঙ্গে নিঃশর্ত একাত্মতা প্রকাশ করে, জায়নবাদের বিরুদ্ধে পরিষ্কার অবস্থান না নেয়। সময় হয়েছে আমাদের আরো গভীরভাবে ফিলিস্তিন প্রশ্নের দিকে তাকানোর। যে সকল প্রশ্ন আমরা সযত্নে এড়িয়ে যেতে চাই সেই চরম সুবিধাবাদ পরিহার করে সরল ও খোলামেলাভাবে সেই প্রশ্নগুলোই তোলা দরকার সাম্রাজ্যবাদ ও জায়নবাদের বিরুদ্ধে যা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। একই সঙ্গে আমাদের প্রায় প্রত্যেকের মধ্যে গুপ্ত জায়নবাদীর বিনাশও যেন ঘটাতে পারে।
ইতিহাসের যে পর্যায়কে আমরা সাম্রাজ্যবাদ বলে থাকি তার চরিত্রে পুঁজির প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিদ্যমান। রাষ্ট্রকে পুঁজির আত্মস্ফীতি ও পুঞ্জিভবনের কাজে খাটাবার দরকারে রাষ্ট্রের শক্তি ও কাঠামোয় হানাদারি রূপান্তর পুঁজির এই বিশেষ চরিত্রের কারণে। এ সম্পর্কে আমরা কমবেশি অবহিত। দুনিয়াকে ভাগ বাঁটোয়ারা করবার জন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর অনিবার্য ও অপ্রতিরোধ্য তাগিদ পুঁজির প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকেই নিত্য তৈরি হয়ে চলেছে। এই দিক থেকে পুঁজির স্বভাব থেকে সাম্রাজ্যবাদের চলন আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি অবশ্যই। সাম্রাজ্যবাদ নিছকই সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর নীতির ব্যাপার-স্যাপার নয় যে, ওয়াশিংটন, লন্ডন, ব্রাসেলস বা নয়াদিল্লির নীতি বদলানো গেলে সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে আমরা নিস্তার পেয়ে যাবো। নজর রাখতে হবে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার নৈর্ব্যক্তিক চরিত্রের দিকে, মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে যে চলন তাকে জেনেই তাকে রূপান্তরের কাজ সফল করা সম্ভব।
সাম্রাজ্যবাদ ও হানাদার যুদ্ধবিগ্রহ নৈর্ব্যক্তিক গতিপ্রক্রিয়ার প্রকাশ। যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে, একটি জনগোষ্ঠীর আত্মরক্ষার জন্য বিশেষ অবস্থায় প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে কিন্তু সাম্রাজ্যবাদকে পরাস্ত করা মানে একটি দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রবেশের সংকল্প ও পরিকল্পনা করা। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থাকে অসম্ভব করে তোলা। এই দিক থেকে ফিলিস্তিনের জনগণের দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার মূল্য অপরিসীম। এই দীর্ঘ লড়াই বিস্ময়ের উদ্রেক করে। যার কারণে ফিলিস্তিন সারা দুনিয়ার নিপীড়িত ও নির্যাতিত জনগণের প্রতীক হয়ে উঠেছে এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই-সংগ্রামের আন্তর্জাতিক ভরকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এই কারণে যে, ফিলিস্তিন প্রসঙ্গের আলোচনা ছাড়া সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ইহুদিবাদের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক এবং জীবাশ্মভিত্তিক শিল্প সভ্যতার সঙ্গে তেলের অর্থনীতি ও রাজনীতির সম্পর্ক বিচার আড়াল হয়ে যায়। ইহুদিবাদের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের এখনকার চেহারা এবং তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আশু কর্তব্যগুলো অস্পষ্ট হয়ে যায়। বিশেষত সাম্রাজ্যবাদী গণমাধ্যম প্রচার-প্রপাগান্ডা কেন ইসলামকে ‘বর্বর’ ও জঙ্গি ধর্ম হিশাবে প্রচার করে তার বিরুদ্ধে আমাদের কর্তব্য বোঝা বা ধরতে পারা কঠিন হয়ে পড়ে। জায়নবাদের বিরুদ্ধে লড়াই ছাড়া কেউই একালে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই করছে দাবি করতে পারে না। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা সেই ক্ষেত্রে সোনার পাথরবাটির মতোই অবাস্তব, অন্তঃসারশূন্য ও আকাশ কুসম ধারণার অধিক কিছু হয়ে উঠতে পারে না।
অনেকের ধারণা, ফিলিস্তিন বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা থেকে অনেক দূরের একটি প্রসঙ্গ। কথাটি সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে সত্য নয় বরং যারা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাজনীতির কথা বলেন, তাদের ক্ষেত্রেই কথাটি সত্য। ফিলিস্তিন প্রশ্নে বাংলাদেশের জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করা সহজ। কিন্তু এই কাজটি না করবার কারণে ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ একান্তই যেন ইসলামী দলগুলোর ব্যাপার হয়ে উঠেছে। এই ক্ষেত্রে সচেতনতার প্রকট অভাব আছে। পুঁজি বা পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিমূর্ত কথাবার্তা অন্তঃসারশূন্য হয়ে যায় যদি চেনা বিষয়গুলো দৈনন্দিন লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে জনগণ কীভাবে বিচার করবে তার হদিস না পায়। যদি কীভাবে সংগ্রাম করবে তার পথ আমরা বাতলাতে না পারি। জনগণের মনের ব্যথা, বেদনা ও প্রতিবাদের ভাষা বুঝতে আমরা এখনো অক্ষম থাকি তাহলে আমরা পিছিয়ে পড়ব।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে বাংলাদেশের জনগণের লড়াই-সংগ্রামের জায়গা থেকে আমরা হাজির করতে পারি নি। মানুষের ব্যথা, বেদনা ও প্রতিবাদের ভাষাকে আমরা সঠিক ঐতিহাসিক অভিমুখে প্রবাহিত করবার দিশা দিতে পারি নি। জনগণ যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলে, যে বিষয় তাদের চিন্তার, মনোযোগের এবং আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু সেই বিষয় ধরে তার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা আমরা সাধারণত করি না। শেষে এডওয়ার্ড সাঈদের একটি কথার সূত্র ধরে বক্তব্য শেষ করবো।
ফিলিস্তিন ও এডওয়ার্ড সাঈদ
ফিলিস্তিন সম্পর্কে এডওয়ার্ড সাঈদের ভাষ্য হচ্ছে ‘এ এক অদ্ভুত ধরণের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা’ (Peculiar form of historical experience)।
কথাটা তিনি শুধু ফিলিস্তিনিদের দিক থেকে বলেন নি, মানবেতিহাসের নতুন অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে বলছিলেন। তাঁর Question of Palestine বইয়ের ১৯৯২ সালের ভূমিকা লিখতে গিয়ে তিনি বলছিলেন, আমরা যখন কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ব্যাপারটিকে প্রশ্ন আকারে তুলি যেমন বলি question of…’ তখন ব্যাপারটা এমন যে অন্য সকল বিষয় থেকে এই বিষয়টাকে আলাদা করবার জন্যই -- সাঈদের ভাষায়, ‘আলাদা করে বিবেচনার জন্যই তোলা।’ দ্বিতীয়ত এই ‘the question of’ কথাটা বলতে হচ্ছে কারন এমন কিছু বিষয় আছে যা দীর্ঘকাল অমীমাংসিত পড়ে আছে। পড়ে আছে অচিহ্নিত বিষয় হিশাবে কিন্তু যা ফিরে আসছে বারবার : যেমন, অধিকারের প্রশ্ন, প্রাচ্যের প্রশ্ন, বাক স্বাধীনতার প্রশ্ন ইত্যাদি। তৃতীয়ত এমন কোন বিষয় আদৌ আছে কি নাই, যে অবস্থান সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই, সেই সকল অসাধারণ ক্ষেত্রেও ‘the question of’ কথাটা তোলা হয়। যেমন ভূত। ভূত আছে কি নাই আমরা জানি না। ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে ‘প্রশ্ন’ কথাটা তোলা হয় এই তিন অর্থেই। সাঈদ বলছেন ‘যে প্রাচ্যের অংশ ফিলিস্তিন, আটলান্টিকের এপারে সেই ফিলিস্তিন অন্য জগতের।’ ফিলিস্তিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সবচেয়ে জটিল প্রশ্ন। এমনকি 'ফিলিস্তিন' নাম নিয়েই বাদানুবাদ আছে। শুধু নামোচ্চারণই ফিলিস্তিনের জনগণের দিক থেকে ইতিবাচক রাজনৈতিক কাজ। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি জনগণের শত্রুদের দিক থেকেও 'ফিলিস্তিন' নামোচ্চারণ বিপরীত রাজনীতির সূচনা করে -- এই নামোচ্চারণ দূরের কথা, নামটিকে মুছে ফেলার জন্য, অস্বীকারের দরকারে। ষাট দশকের শেষের দিকে এবং সত্তর দশকের অধিকাংশ সময় জুড়ে মার্কিন শহরগুলোতে যে স্লোগান দেখা যেত তাতে দেখা যেত কেউ হয়তো দাবি করছে ‘ফিলিস্তিন আছে’ আর কেউ দাবি করছে ‘ফিলিস্তিন’ নাই। গোল্ডা মেয়ার ১৯৬৯ সালে সাফ সাফ বলে দিয়েছিলেন ফিলিস্তিন বলে কিছু নেই।
ফিলিস্তিন আছে কি নাই এই তর্কটা সাঈদ তুলছেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্রবেশ করবার জন্য। ফিলিস্তিন অপরিচিত জায়গা। আমিও এই লেখায় আজ অবধি ফিলিস্তি নামের অগম্য স্থানগুলো পরিদর্শনের ডাক দিচ্ছি। মধ্যপ্রাচ্য ভাবলেই যে চিন্তা মাথায় আসে তা হলো আরব ও ইজরায়েলিদের মধ্যে বিরোধ, দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ। কিন্তু ওর মধ্যে ‘ফিলিস্তিন’ বলে একটা ব্যাপার আছে এই বিষয়টা বোঝাতে ফিলিস্তিনিদের লড়াই করতে হয়েছে এবং এডওয়ার্ড সাঈদের মতো মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের বড় একটা সময় ফলস্তিন নামে কিছু একটা ব্যাপার আসলেই আছে সে কথাটা বোঝাতে ব্যয় করতে হয়েছে । ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির পর ১৯৭৮ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যপ্রাচ্যের মানে হয়ে উঠেছিল মেনাখেম বেগিন, আনোয়ার সাদাত এবং জিমি কার্টার কিম্বা আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইজরায়েলের যুদ্ধবিগ্রহ বা শান্তিচুক্তির ব্যাপার। ফিলিস্তিন নামে একটি দেশ ও জনগোষ্ঠী যে ১৯৪৮ সালের আগে ছিল এবং ইজরায়েলের প্রতিষ্ঠার অর্থ যে ফিলিস্তিনকে দুনিয়ার মানচিত্র থেকে মুছে দেয়া এবং ফিলিস্তিনবাসীদের দেশ ছাড়া করা এই সত্য দুনিয়া ভুলে গিয়েছিল। ‘কিন্তু যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’, সাঈদ বলেছেন, “এই অজ্ঞতা ও অস্বীকার যে প্রায় ৪০ লক্ষ মুসলমান ও খ্রিস্টান আরব আছে যারা নিজেদের ও অন্যান্য আরবদের কাছে ফিলিস্তিনি নামেই পরিচিত। এই ‘ফিলিস্তিন প্রশ্ন’ তাদেরই। যদি ফিলিস্তিন নামে কোনো দেশ না থাকে তাহলে তার কারণ এটা নয় যে, ফিলিস্তিনি বলে কেউ নাই। অবশ্যই আছে।”
ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সত্য ছিল এই যে, ফিলিস্তিন বলে কিছু ছিল না। তাকে মুছে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু ফিলিস্তিন ছিল স্মৃতি হয়ে। তবে আরো গুরুত্বপূর্ণ যে, ফিলিস্তিন ছিল ধারণা হিশাবে, রাজনৈতিক ও মানবিক অভিজ্ঞতা হয়ে জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের মধ্যে মূর্ত হয়ে হাজির ছিল ফিলিস্তিন। যার বিনাশ অসম্ভব বৈকি। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের লড়াই এই কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাম্রাজ্যবাদ যে মানচিত্র মুছে ফেলতে চেয়েছে, যাদের তারা তাদের জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করে দিয়ে দাবি করছে ঐতিহাসিকভাবে তাদের কোনো অস্তিত্বই ছিল না -- তাকে রুখে দেয়া, মিথ্যা প্রমাণ করা সহজ কাজ ছিল না। সাঈদ বলছেন, ব্লাক সেপ্টেম্বরের ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিন যে পথ পাড়ি দিয়েছে তার মধ্যে যেমন উজ্জ্বল সফলতার দিক আছে তেমনি আছে চরম ব্যর্থতা ও বিপর্যয়ের দিক। দুর্দান্ত সাফল্য কিন্তু একই সঙ্গে বিপর্যয় ও ব্যর্থতা এই দুইয়েরই কেন্দ্রে আছে ফিলিস্তিনি সংগ্রাম। অথচ এক ইঞ্চি জমিও ইজরায়েলি দখলদারির কবল থেকে আজও মুক্ত হয় নি। সাফল্য এই অর্থে যে, সাম্রাজ্যবাদী ঘটনা্ঘটনের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিরা যে লড়াইয়ের সূত্রপাত করেছে সেই সময় থেকে শুরু করে একদিকে যেমন চরম বিপর্যয় ঘটছে, অন্যদিকে এমন সব ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের বিজয় ঘটছে যা রীতিমতো অবিশ্বাস্যই ছিল।
বলা বাহুল্য, ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ যেখানে হাজির হয়েছে তা আমাদের আশা পূর্ণ করবার মতো নয়। কিন্তু ফিলিস্তিনি জনগণের লড়াই-সংগ্রাম মানুষের ইতিহাসকে নতুন করে ভাববার যে দিগন্ত উন্মোচন করেছে ফিলিস্তিনিদের অভিনন্দন জানাবার পাশাপাশি সেই অসাধারণ সাফল্যকেও অভিনন্দন জানাই।