ইন্তিফাদা জিন্দাবাদ: ফিলিস্তিনি শিশু-কিশোরদের ঢিল আর গুলতি লড়াই


ফিলিস্তিনের শিশু-কিশোররা লড়ছে ঢিল আর গুলতি দিয়ে। তাদের বিরুদ্ধে ইজরাইলের আধুনিক মারণাস্ত্র, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, মারকেভা ট্যাংক, মিসাইল, হেলিকপ্টার গানশিপ আর আনুষঙ্গিক ভারি যুদ্ধবাহন। একেকটি ঢিল আর গুলতির গুলির বিপরীতে সব স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্র গর্জে উঠছে ইজরায়েলি সৈন্যদের হাতে। শিশু-কিশোরদের বুক আর মাখার খুলি লক্ষ্য করে ছোঁড়া হচ্ছে গুলি। মরছে তারা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনের উল্লেখ করে মার্কিন ভাষাতত্ত্ববিদ এবং মানবাধিকারের প্রশ্নে সরব নোয়াম চমস্কি বলছেন, এই ধরণের বিশদ ও বিস্তৃত প্রতিবেদনের কোনো উল্লেখ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হয় না বললেই চলে। চমস্কি যখন তার ‘আল আকসা ইন্তিফাদা’ নিবন্ধটি লিখছেন ততদিনে কমপক্ষে ১০০ জন ফিলিস্তিনি শহীদ হয়েছে, যাদের মধ্যে ৩০ জন শিশু-কিশোর, বয়স দশ থেকে চৌদ্দ-পনের বছরের মধ্যে। এই লেখা যখন লিখছি তখন ফিলিস্তিনিদের পক্ষে শহীদের সংখ্যা তিনশয়ের বেশি ছাড়িয়ে গেছে। অধিকাংশই শিশু আর কিশোর। ইজরায়েলের পক্ষেও হতাহত হয়েছে, কিন্তু সেটা শিশু আর কিশোরদের ঢিল-গুলতির আঘাতে নয়। আল আকসা ইন্তিফাদার শুরুর দিকে প্রকাশিত অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি একজন ইজরাইলির বিপরীতে ১৫ জন ফিলিস্তিনিকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এই অনুপাত এখন বহুগুণে ছাড়িয়ে গেছে।

অক্টোবর মাসের ৩ তারিখের একটি খবরে জানা যায় যে, মাত্র এক সপ্তাহের সংঘর্ষের মধ্যেই ইজরাইল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে হামলাবাজিতে দক্ষ যুদ্ধের হেলিকপ্টার (Blackhawk Military Helicopters) কিনেছে। এই হেলিকপ্টারের দাম হচ্ছে ৫২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অক্টোবরের ২৫ তারিখে ইজরাইলের একটি বিখ্যাত পত্রিকা ‘হারেতজ’-এ সাংবাদিক আলুফ বেন খবর দিচ্ছেন যে, এই সামরিক সাহায্যের অতিরিক্ত আরো ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ইমার্জেন্সি সামরিক সাহায্য ইজরাইল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চেয়েছে। সব মিলিয়ে আগামী বছরের মধ্যে ইজরাইলে মার্কিন সামরিক সাহায্যের পরিমাণ হবে প্রায় দুই বিলিয়ন (১.৯৮) মার্কিন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র ইজরাইলি আগ্রাসনে সরাসরি অস্ত্র দিচ্ছে। সংঘর্ষের প্রথম থেকেই গুলতি আর ঢিলের ব্যাপারটিকে যুদ্ধের রূপ দিয়েছে ইজরাইল, আর ক্রমাগতভাবে তারা এই শিশুদের ঢিল আর গুলতিকে ফিলিস্তিনিদের সন্ত্রাসী হামলা বলে প্রচার চালাচ্ছে। গণমাধ্যমগুলো সেটা প্রচারও করছে। যতবারই এই রক্তপাত বন্ধের প্রস্তাব এসেছে ততবারই ইজরাইল বলছে, আগে ওরা আক্রমণ বন্ধ করুক তারপর আমরা করব। অর্থাৎ আগে ওরা ঢিল আর গুলতি ছোড়া বন্ধ করুক তারপর আমরা গোলাগুলি আর মিসাইল হামলা থামাব।

বিবিসি তার একটি সংবাদ প্রতিবেদনে দেখিয়েছে যে, ইজরাইলি সৈন্যরা যখন গুলি করে তখন তাদের লক্ষ্য থাকে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা, শুধু ছত্রভঙ্গ করার জন্য নয়। যদিও ইজরাইল ঢিল আর গুলতির প্রচারই আন্তর্জাতিকভাবে চালাচ্ছে। যেমন, প্রতিটি গুলির লক্ষ্য ছিল শরীরের ওপরের অংশ, যেন গুলি শিশু-কিশোরদের মাথার মগজ সরাসরি ভেদ করে যায়, অথবা সরাসরি বুকের মধ্যে গিয়ে লাগে – যেন তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয় তাদের। গুলি ছোড়ার এই প্যাটার্ন অতি সহজেই শহীদদের শরীর পরীক্ষা করে বোঝা যায়। এখনো কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি হাসপাতালে আহত অবস্থায় পড়ে আছে। তাদের অনেকের মগজের মধ্যে ইজরাইলি সৈন্যদের ছোঁড়া গুলি গিয়ে বিঁধে গেছে। ওদের মগজ বিকল হয়ে গেছে। বাঁচলেও তারপর আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে না। ফিলিস্তিনিদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এক হিশাবে দেখিয়েছেন, নিহত এবং আহতদের প্রত্যেকের শরীরের ওপরের অংশে আঘাতের চিহ্ন, পায়ে বা শরীরের নিচের অংশে নেই। অর্থাৎ ইজরাইলিদের পক্ষে থেকে হত্যার প্রবল ইচ্ছাটাই ধরা পড়ছে। ইজরাইলের পক্ষ থেকে বারাবার বলা হচ্ছে, এই ছোঁড়াগুলো কেন ঢিল ছুড়ছে? তাদের গুলি করে মারতে হবে। ওরা ভয়ানক। এমন নগ্ন ও নির্লজ্জ সহিংসতা অবিশ্বাস্য।

যারা স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্রের বিপরীতে ঢিল আর গুলতির এই লড়াই দুই এক পলক টেলিভিশনে দেখেছেন তাদের চোখ ফেটে পানি আসবে। কী অপরাধ এই শিশু আর কিশোরদের? আজ যুদ্ধক্ষেত্রে নামছে এই শিশু-কিশোর এটা তো সবারই লজ্জার কথা। বিশেষত, ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি (Oslo Accord) হওয়ার পর কেন এই মৃত্যুর জবজবা জমে উঠল? কেন এই শিশু-কিশোরদের বলি হতে হচ্ছে ইজরাইলি কামান, বন্দুক, ট্যাংক আর মারণাস্ত্রের সামনে? এটা তো ঘটার কথা নয়। যারা এতদিন দাবি করে আসছিলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং ইজরাইল ও প্যালেস্টাইন পরস্পরের প্রতিবেশী হয়ে শান্তিতে বসবাস করবেন, তারা এখন কোথায়?

টেলিভিশনে শিশু-কিশোররা সাক্ষাৎকারে বলছে, তারা শহীদ হওয়ার জন্য তৈরি। তারা মরতে চায়। তারা ইজরাইলি বুলেট আর মিসাইল বুকে নিয়ে আজরাইলের কাজ সহজ করার জন্য তৈরি। তাদের ধারণা প্রতিটি মৃত্যু প্যালেস্টাইন জনগণের মুক্তির জন্য জরুরি। ইজরাইলের আছে মারণাস্ত্র আর প্যালেস্টাইনিদের আছে প্রাণ দেয়ার ক্ষমতা। দেখা যাক কে জেতে!

পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো প্যালেস্টাইনি জনগণের সংগ্রামকে বিকৃত করে হাজির করে। কিন্তু তবুও ইজরাইলি সমরাস্ত্রের বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনি শিশু-কিশোরের এই অসম যুদ্ধ তারা না দেখিয়ে পারে নি। কিন্তু তাদের চোখে এই শিশু-কিশোররা হলো সন্ত্রাসী, ইজরাইলি সেনাবাহিনী নয়। গুলতি আর ঢিল হাতে ‘সন্ত্রাসী’ শিশু-কিশোরদের দেখানো হয়। আর ইজরাইলি সৈন্যদের দেখানো হয় মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির দূত হিশাবে। শিশু-কিশোরদের দিকে তাক করে ছোঁড়া গুলি যেন জলপাই গাছের ডাল থেকে পাতা ছিটানো মাত্র, হত্যা নয়। একদিকে বিশ্বে ক্ষমতার অসাম্য, জনগণের বিরুদ্ধে মারণাস্ত্রের এই নিষ্ঠুর মৃত্যুযজ্ঞ আর অন্যদিকে যারা ভূক্তভোগী তাদেরকেই দোষী বানাবার ক্রমাগত প্রচেষ্টা সব মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটাই একটা আজগুবি কল্পকাহিনীর মতো মনে হয়।

কিন্তু এটাই সত্য। এটাই বাস্তব। এই বাস্তবতার মধ্যেই নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে, লড়তে হবে। জায়োনিজম (Zionism) বা ইহুদিবাদ যার অতিশয় নগ্ন অভিপ্রকাশ। এই লড়াই শুধু বাইরের দুশমনদের বিরুদ্ধে নয়। নিজেদের মধ্যেও। এডওয়ার্ড সাঈদ ‘আল আহরাম’ পত্রিকার একটি নিবন্ধে সেই কারণে বলেছেন, আল আকসা মসজিদকে কেন্দ্র করে এই দ্বিতীয় দফার এই ইন্তিফাদা আসলে সরাসরি অসলো চুক্তি এবং যারা এই চুক্তির কারবারী তাদেরও বিরুদ্ধেও (দেখুন (ME: The Tragedy Deepens. ডেইলি স্টার, ১২/১২/২০০০)। তিনি বলছেন, ‘কারবারিদের চক্রে শুধু এহুদি বারাক আর ডেনিস রস-ই নেই, আছে ফিলিস্তিনিদের গুটিকয়েক কর্মকর্তা। ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী গণমাধ্যমের ক্রমাগত অপপ্রচারের পরিপ্রেক্ষিতে সাঈদ ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের সমালোচনার ক্ষেত্রে সতর্ক, এটা তার ভাষা দেখলেই বোঝা যায়। বলছেন, এরা Irresponsible বা দায়িত্বজ্ঞানহীন। সাঈদ বলছেন, ‘এসব ফিলিস্তিনি কর্মকর্তার এখন অন্তত জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে ভুল স্বীকার করার মতো ভদ্রতাটুকু থাকা উচিত এবং যদি তাদের আদৌ কোনো (মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্কট সমাধানের) পরিকল্পনা থাকে তবে তারা তার পক্ষে সমর্থন চাওয়ার সৎ সাহস প্রদর্শন করুক।

এডওয়ার্ড সাঈদের নিবন্ধের মূল সমালোচনা আরব নেতাদের কপটতার বিরুদ্ধে। তাদের অতিশয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রীতিকে তিনি সমালোচনা করছেন। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। তবে বিস্ময়ের দিকটা হলো গত দশ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ইজরাইলকে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র দিচ্ছিল তখন কোনো আরব দেশই প্রতিবাদ জানায় নি। যে হেলিকপ্টার গানশিপ আমরা এখন টেলিভিশনে ফিলিস্তিনের জনগণকে হত্যা এবং তাদের বাড়িঘর ও সহায়সম্পত্তির সর্বনাশ ঘটানোর জন্য নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে দেখছি তারও উৎস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই হেলিকপ্টারগুলো যখন ইজরাইল জোগাড় করছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অতিশয় প্রীতির কারণে আরব নেতারা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নি।

বছর দেড়েক আগে এহুদ বারাক যখন নির্বাচনে জিতে এসেছিলেন তখন সব আরব নেতাই তাকে অভিনন্দন জানালেন। সাঈদ বলেছেন, যে এহুদ বারাকের পুরো জীবনই কাটল আরবদের হত্যা করে তাদের রক্তে নিজের রাঙাতে, সেই বারাককে অভিনন্দন জানানোর মোজেজাটা কী? সেটা নিশ্চয়ই আবারও মার্কিনপ্রীতি। সেটা না হয় হলো, কিন্তু এহুদ বারাক শান্তি প্রক্রিয়ার প্রতি আন্তরিক এই বিশ্বাস আরব নেতাদের রাজনৈতিক কপটতার লক্ষণ, নিছকই কাণ্ডজ্ঞানহীনতা নয়। সাঈদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরব নেতাদের আঁতাতের দিকটার প্রতি জোর দিয়ে তাদের রাজনৈতিক কপটতার কারণ ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। ফিলিস্তিন সংগ্রামের মর্মার্থ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, কিন্তু আরব নেতাদের রাজনীতি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা। ফিলিস্তিনি জনগণের রক্তক্ষয় এবং শিশু-কিশোরদের এত মূল্য দেয়ার একটি প্রধান কারণ এখানে।

ফিলিস্তিন ও ইজরাইলের মধ্যে এই সহিংস ঘটনার সৃষ্টি করেছেন এহুদ বারাক। গত সেপ্টেম্বর মাসের ২৮ তারিখে বারাক সরকারের অনুমতি ও প্রণোদনায় এরিয়েল শ্যারন হাজারখানেক পুলিশ নিয়ে আল আকসা যান। আল-আকসার সঙ্গে ফিলিস্তিনি আবেগ ও ইতিহাসই শুধু জড়িত নয়, ওর সঙ্গে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মীয় স্থানের আবেগ ও ইতিহাস জড়িত রয়েছে। ফিলিস্তিনদের কাছে শ্যারন ইজরাইলের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ব্যক্তি এবং হামলাবাজ হিশাবে পরিচিত। ১০৫৩ সাল থেকে আজ অবধি ফিলিস্তিনিদের ওপর ইজরাইলি অত্যাচারের প্রতীক এই শ্যারন। কিন্তু শুধু শ্যারনের আগমনই এত সহিংসতার সৃষ্টি করে নি। এহুদ বারাক আল-আকসায় শ্যারনের এই আগমনের উসিলায় জামাতে নামাজের দিনে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে পুলিশ ও মিলিটারির উপস্থিতি দিয়ে উসকানির সৃষ্টি করে, ফলে সংঘর্ষ হয়। এই দিনেই ৭৮ জন ফিলিস্তিনি শহীদ হয় এবং ২০০ জন আহত হয়। সহিংসতা এভাবেই শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে বারাক ও ইজরাইলের আচরণে এটা সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ সৃষ্টি হয়েছে যে, এহুদ বারাক এটাই চেয়েছিলেন। তথাকথিত শান্তি প্রক্রিয়া থেকে তার আর কিছুই পাওয়ার নেই। অসলো চুক্তি থেকে তিনি যা পাওয়ার পেয়েছেন, বিশেষত ইয়াসির আরাফাতের কাছ থেকে ইজরাইলি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। অতএব সেই প্রক্রিয়া থেকে এখন কোনো একটা ছুতোয় বেরিয়ে আসার জন্যই এই সহিংসতার সৃষ্টি। সেই দিক থেকে এহুদ বারাককে সফলই বলতে হবে।

১৯৮৭ থেকে ১৯৯২ সাল অবধি ফিলিস্তিন জনগণের লড়াই বা প্রথম ইন্তিফাদার আত্মত্যাগ, রক্তপাত ও লড়াইয়ের সাফল্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পায়ে বিকিয়ে দেওয়ার ইতিহাস। ইয়াসির আরাফাত সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে যে শান্তি চুক্তি করেছেন তার ফল হলো এক টুকরা জমির ওপর পিএলও’র মিউনিসিপ্যাল কর্তৃত্ব। ওয়েস্ট ব্যাংকের ৫৯ ভাগ জমি ইজরাইলেরই দখলে রয়ে গেছে। ফিলিস্তিন প্রশ্নের মীমাংসা আরো ছয় বছর পরে হবে এই সিদ্ধান্ত তিনি মেনে নিয়েছেন। এই ছয় বছরে ইজরাইল ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে আরো ইহুদি বসতি গড়ে তুলেছে, ওয়েস্ট ব্যাংককে খণ্ডবিখণ্ড করে এমন অবস্থা সৃষ্টি করেছে যাতে এক খণ্ডের সঙ্গে অন্য খণ্ডের কোনো যোগাযোগ না থাকে, গড়ে তুলেছে ইজরাইলি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হাইওয়ে ও অন্যান্য ব্যবস্থা। তার মানে হলো চমস্কি, সাঈদ, এজাজসহ প্রত্যেকেই বলছেন, যদি কোনো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ইজরাইল এখন মেনেও নেয় সেটা হবে দক্ষিণ আফ্রিকার বান্টুস্তানের মতো। সেটা হবে স্বাধীনতা নয়, ইজরাইলি রাষ্ট্রের মধ্যে ফিলিস্তিনের জন্য দেয়ালহীন কারাগার। ইজরাইলি ধর্মান্ধতা ও বর্ণবাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত নব্য এপারথেড। যে কারণে নেলসন ম্যান্ডেলা একবার মন্তব্য করেছিলেন যে, দক্ষিণ আফ্রিকা আর বর্ণবাদের কী দেখেছে? ফিলিস্তিনিরা বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার যে শিকার হয়েছে তার কোনো তুলনা নেই।

১৫ নভেম্বর ফিলিস্তিন তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেছে। পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। সম্প্রতি কাতারে অনুষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর দোহা ঘোষণায় ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন এবং ইজরাইলের আগ্রাসনের প্রতি নিন্দা জানানো হয়েছে। ফিলিস্তিন প্রশ্নে দুজন বিখ্যাত মানুষের বরাত আগে দিয়েছি। একজন নোয়াম চমস্কি এবং অন্যজন এডওয়ার্ড সাঈদ। এরা কেউই জন্মসূত্রে মুসলমান নন। প্রথমজন ইহুদি এবং দ্বিতীয় জন খ্রিস্টান। উভয়ই মার্কিন-ইজরাইলি হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে লেখালেখি করছেন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের দিকটি পরিষ্কার বুঝতে পারলে আমরা বুঝব কেন বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতার বাইরের প্রতিটি অংশই ফিলিস্তিন প্রশ্নে নীরব। এমনকি মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ নিয়ে যে সব দল এই দেশে রাজনীতি করে তারাও প্রায় নীরবে এই হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ কী? কারণ ইসলামী দলগুলো এখনো তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটাও কমবেশি স্পষ্ট যে, জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির সম্পর্কটাই প্রধান, ইসলামের নয়। জালিম বা অত্যাচারীর বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরার যে লড়াকু ঐতিহ্য, সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে এই দলটির আন্তরিক কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম তার বাইরের ছদ্মবেশ মাত্র। যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতি বাংলাদেশে ইসলামী কোনো একটি দলেরও ন্যূনতম অঙ্গীকার থাকত তাহলে অন্তত সেই নৈতিক অঙ্গীকারের তাগিদে আমরা তাদের বাংলাদেশের রাজপথে দেখতাম। ফিলিস্তিনি শিশু-কিশোরদের পক্ষে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের রাজনৈতিক সংগ্রামের পক্ষে বাংলাদেশে জনমত সৃষ্টির তারা চেষ্টা করত। অন্তত তার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যেত।

একটি নিবন্ধ লিখেছেন এজাজ আহমেদ। সেখানে শুরুতেই ভারতে ইজরাইল সম্পর্কে লেখালেখির মুশকিলের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটা গুণগত বদল ঘটেছে। যখন ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রাধান্য ছিল তখন সেটা শুধু জনগণের সচেতন অংশের মধ্যেই সক্রিয় ছিল এমন নয়, ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে তার প্রতিফলন ছিল। এজাজ বলছেন যে, সে কারণে ভারতের শাসক শ্রেণী ইজরাইলকে দেখতো অপরের ভূখণ্ডে জবরদখলকারী একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র হিশাবে। ইজরাইল থেকে দূরে থাকাই ছিল ভারতের নীতি। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সমর্থন ছিল ভারতের। কারণ তারা ছিল দখলদার ঔপনিবেশিক শক্তির ‘ভিকটিম’ বা ভুক্তভোগী। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এই বাস্তবতাকে ধরে নিয়েই কাজ করত। একইভাবে আরব দেশগুলোর মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ধারার সঙ্গে একাত্মবোধ করত ভারত। সেই একাত্মতা প্রকাশের ক্ষেত্রেও তার দ্বিধা ছিল না। যেমন, আলজেরিয়ার জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম, নাসেরের জোট নিরপেক্ষ নীতি ইত্যাদি। আরবের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জনগণের প্রতি ভারতের একাত্মতার ইতিবাচক প্রবণতাটুকু দৃশ্যমান ছিল।

ভারতের এই পররাষ্ট্রনীতি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আলোচনারও বিষয় ছিল এবং প্রশংসিত হতো। বাইরের জগতে ভারত সম্পর্কে যে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে, আজ অবধি তার জের রয়েছে। এজাজ এই প্রসঙ্গে তার নিজের অভিজ্ঞতার কথাও বলেছেন। যেমন ষাট এবং সত্তর দশকে তিন যে সব আরব বুদ্ধিজীবী, কূটনীতিবিদ ও অন্যান্য ব্যক্তিত্বের মুখোমুখি হয়েছেন তারা ফিলিস্তিন প্রশ্নে পাকিস্তানের সমর্থনকে একটা হালকা ইসলামী ব্যাপার বলে পাত্তা দিত না। কিন্তু ভারতের সমর্থনকে দেখত ধর্মনিরপেক্ষ ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির স্বাভাবিক সংহতির অভিব্যক্তি হিশাবে। ফলে পাকিস্তান আরব জনগণের মনে মুসলমান সেজে যে ভাবমূর্তি ও শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারে নি, ভারত তার ধর্মনিরপেক্ষ ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির কারণে তার চেয়ে অনেক বেশি সম্মান ও শ্রদ্ধা অর্জন করতে পেরেছে।

এজাজ আহমেদ পুরনো পরিপ্রেক্ষিতটা তুলেছেন বর্তমানের সঙ্গে তুলনা করার জন্য। সেই ভারত আর নেই। সেটা অবশ্য বাইরে থেকেও স্পষ্ট। সম্প্রতি যশোবন্ত সিং ইজরাইল ঘুরে আসার একটা পর্যায়ে বলেছেন, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি মুসলমানদের ভোটের কাছে এতকাল জিম্মি ছিল। এখন ভারত সেটা শোধরাবে। তার মানে, এতকাল ভারত প্যালেস্টাইনকে সমর্থন দিয়েছে ভারতের মুসলমানদের খুশি করার জন্য, কোনো জোটনিরপেক্ষ বা ধর্মনিরপেক্ষ নীতির চর্চা হিশাবে নয়। এখন সে মুসলমানদের আর খুশি করবে না, খুশি করবে ইহুদিদের। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি শোধরানোর এটাই তো মানে। যশোবন্ত সিং এই মন্তব্য করে ভারতের অতীত মুছে ফেলতে চাইছেন এবং বিজেপির মুসলমানবিরোধী সাম্প্রদায়িক নীতিটাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করলেন। উল্লেখ থাকা দরকার যে, অটল বিহারী বাজপেয়ী বাবরী মসজিদের ভগ্নস্তূপের ওপর সম্প্রতি আগামী নির্বাচনের আগেই রামমন্দির নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। এই উপমহাদেশের আরেকটি দাঙ্গার ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে।

ইজরাইলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক হচ্ছে ইজরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ-এর সঙ্গে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইংয়ের ঘনিষ্ঠ কাজের সম্পর্ক গড়ে ওঠা। এটা অবশ্য খুবই স্বাভাবিক। কারণ ভারত যদি নিজেকে ইহুদি রাষ্ট্রের মতো ও হিন্দু রাষ্ট্র হিশাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাহলে তাকে তার দেশের অভ্যন্তরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে, কাশ্মীরের জনগণকে শায়েস্তা করতে হবে। একই সঙ্গে তাকে পশ্চিমে পাকিস্তান এবং পূর্বে বাংলাদেশের জনগণকে মোকাবেলা করতে হবে। রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইংয়ের সঙ্গে ইহুদি গোয়েন্দা সংস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে হরকাতুল জেহাদ, ওসামা বিন লাদেনের অনুসারীদের হন্যে হয়ে খোঁজা এবং বাংলাদেশকে একটি ‘মৌলবাদী’ দেশে পরিণত করার প্রচার প্রপাগান্ডা বেড়েছে। এর পেছনে মোসাদ ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সম্পর্ক থাকা খুবই স্বাভাবিক। একই কারণে ফিলিস্তিন প্রশ্ন ইসলামপন্থী দলগুলোর নীরবতাও অতিশয় সন্দেহজনক।

পাকিস্তান যখন নিজেকে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ বলে ঘোষণা দেয়, তখন তাকে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি থেকে চ্যুত রাষ্ট্র বলে যথার্থই নিন্দা করা হয়। যখন ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ ভারতকে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ বানানো দাবি তোলে এবং দাঙ্গাবাজদের দিয়ে চার্চ আর মসজিদ ভাঙার উৎসবে মেতে ওঠে, তখন তাকে যথার্থই ‘ফ্যাসিস্ট’ বলে নিন্দা করা হয়। কিন্তু একটি ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ হিশাবে সৃষ্ট এবং ঘোষিত ইজরাইল এক অদ্ভুত সৃষ্টি। তার ভিত্তি ইহুদিবাদ এবং ইহুদি ধর্ম। ইসলামী মৌলবাদ বা হিন্দু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় কিন্তু ধর্মান্ধ, জাতি বিদ্বেষী ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইজরাইল সম্পর্কে কোন কথা বলাও সেন গুনাহ। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো ইহুদি রাষ্ট্র ইজরাইলের বিরুদ্ধে কিছু বলতে নারাজ তো বটেই এমন কি সব সময়ই তারা এই ধারণাই দিয়ে থাকে যে ইজরাইল একটি আধুনিক, গণতন্ত্রী আর প্রগতিশীল রাষ্ট্র। ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা মানে যেন হিটলারের ইহুদিবিরোধী মানসিকতার দ্বারা আক্রান্ত হওয়া। এই পরিস্থিতির বদল কেবল তখনই সম্ভব যদি আমরা সাম্রাজ্যবাদ আর ইহুদিবাদ একই মুদ্রার দুই পিঠ হিশাবে শনাক্ত করতে শিখি। তৃতীয় বিশ্বের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধবাজ ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটিকে সাম্রাজ্যবাদ শক্তি যে কোনো মূল্যে টিকিয়ে রাখবে যতদিন না ফিলিস্তিনি জনগণের লড়াইকে আমরা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল জনগণের লড়াই বলে গণ্য না করি।

ততদিনে আর কত ফিলিস্তিন শিশু-কিশোরকে আত্মাহুতি দিতে হবে, কে জানে!!

যুগান্তর

১৬-১২-২০০০, শ্যামলী

দুই হাজার এক  সালে এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের  রিপোর্ট Broken Lives: A year of Intifada  এখন ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। - সম্পাদনা বিভাগ ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।